এই গল্প একজন গল্পকারের, যে আমার বন্ধু।
গল্পটা তারই লেখার কথা ছিল। সে আমাকে প্রায়ই বলত, ‘জানিস, আমি আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখব।’ তারপর গল্পটা কেমন হবে, তার টুকরো টুকরো বিন্যাস আমাকে সে শোনাত। যাই হোক, সে এখনো গল্পটা লিখতে পারেনি। আর পারবে বলেও মনে হয় না। তাই আমাকেই গল্পটা বলতে হচ্ছে। শুনুন তাহলে
গল্পটা – জীবনে চলতে চলতে আচমকা একদিন সে বুঝতে পারল, পৃথিবীতে সে জন্মেছে শুধু গল্প লেখার জন্য, অন্য কিছুর জন্য নয়। এমন বিশ্বাস থেকে বেশকিছু গল্প লিখে ফেলল সে অল্পদিনের মধ্যে। সেসব গল্প প্রখ্যাত সব লিটল ম্যাগে প্রকাশিত হলো। গল্পকার হিসেবে তার খ্যাতি জুটল। শুধু খ্যাতিই। তাই এখান-ওখান থেকে গল্প চেয়ে তার কাছে যেমন আমন্ত্রণ আসতে লাগল, তেমনি অনেক পত্রিকাগোষ্ঠীও তাকে আমন্ত্রণ জানাতে
শুরু করল তাদের আয়োজিত আসরে গল্প পাঠের জন্য।
এসব করেই একটা দশক কাটল তার। বহু গল্প সে লিখে ফেলল। শতাধিকের মতো। নিজে চেষ্টাচরিত্র করে দুটি গল্পের বই প্রকাশ করল। বই দুটি প্রশংসাও পেল।
তারপর একদিন, নিজের ইচ্ছায় নয়, বাড়ির লোকের চাপে তাকে বিয়ে করতে হলো। প্রথমে সে কিছুতেই বিয়ে করতে চাইছিল না। তখন আমিই তাকে বুঝিয়েছিলাম এই বলে, ‘বিয়ে করবি না ঠিক আছে। কিন্তু মেয়ে দেখতে যেতে দোষের কী? বুঝলি, তোর আব্বা-মা আমাকে ধরেছেন, যাতে আমি তোকে বুঝিয়ে রাজি করি। কিন্তু তুই তো আর অবুঝ নোস যে, আমার বুঝ তোকে নিতে হবে। তুই তোর ভালোটা বেশ বুঝিস। তবে আমার যুক্তি – চল, মেয়ে দেখে আসি। এসে তুই বলবি যে, মেয়ে তোর পছন্দ হয়নি। ব্যাস, তাহলেই ঝঞ্ঝাট চুকে যাবে।’
আমার যুক্তি মেনে বন্ধু মেয়ে দেখতে যায় আর মেয়ে দেখতে যাওয়াই তার কাল হয়। সে মেয়ের সামনে, মেয়ের আত্মীয়স্বজনের সামনে কিছু কথা বলে। একেবারে তার নিজস্ব ঢংয়ে বলা কিছু কথা। আমার স্পষ্ট মনে আছে সব। বন্ধু বলেছিল, ‘আমার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। কারণ আমি উপার্জন করতে পারি না। আর কোনো মেয়ে চাইবে না যে তার স্বামী উপার্জনহীন হোক। আমাকে দিয়ে বাড়ি থেকে ব্যবসা করানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। আমি পারিনি। আসলে আমি একজন গল্পকার। আমার কাজ গল্প লেখা। এতে অবশ্য উপার্জন হয় না। তবে ভবিষ্যতে হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। তবু আমি আপনাকে দেখতে এসেছি আমার মায়ের জন্য। মা বেঁচে থাকতে থাকতে আমার বিয়ে দিতে চান এবং বউমা হিসেবে আপনি মায়ের ভীষণ পছন্দ। এখন সব সিদ্ধান্তের ভার আপনার ওপর। আপনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই হবে। আমার আর কিছু বলার নেই।’
বন্ধুর এমন কথায় মেয়েটি তার বউ হয়ে যায়। আমি খুব আশ্চর্য হয়েছিলাম। যাই হোক, বিয়ের পর বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর বছরখানেক দাম্পত্য দারুণ কাটাল। সত্যি কথা বলতে, ওদের দাম্পত্য দেখে আমি খুব হিংসে করেছি। তারপর যেই ওদের প্রথম সন্তান জন্মাল, শুরু হয়ে গেল দাম্পত্যের আসল খেল। বন্ধু আমাকে সব খুলে বলত। আমি সব শুনতাম। প্রথম প্রথম খুব আনন্দ পেতাম। কিন্তু পরে বন্ধুর জন্য আমার খুব মায়া হতে শুরু করল। কষ্ট হতে লাগল। যদিও তখন পর্যন্ত তার ডালভাতের অভাব ছিল না। কিন্তু এই ভোগবাদের যুগে ডাল-ভাতটাই তো শেষ কথা নয়। তার অন্য দুই ভাই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, যাদের জীবনযাপনে চাকচিক্যের প্রকাশ ছিল। বন্ধুর তা ছিল না। বন্ধু অবশ্য তা নিয়ে ভাবত না। কিন্তু বন্ধুপত্নী তাকে গঞ্জনা দিতে কসুর করত না। অদ্ভুত সেসব গঞ্জনা – ‘কী হবে গল্প লিখে? তার চেয়ে উপার্জনের চেষ্টা করো। দেখছো না পৃথিবীটা, পৃথিবী দেখতে হবে না, নিজেদের বাড়িটাকেই দ্যাখো। তোমার দুই ভাইকে দ্যাখো। তাদের বউদের দ্যাখো – বাচ্চাদের দ্যাখো। তোমার দুই ভাই ভিন্ন বাড়ি করবে বলে প্লট কিনেছে। তাদের মোটরবাইক আছে। তাদের ঘরে রঙিন টিভি আছে। ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন আছে। তাদের বাচ্চারা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ে। সপ্তাহে অন্তত একদিন হলেও তারা বাইরে কোথাও ঘুরতে বের হয়। আর তুমি-তোমার বউ-তোমার ছেলে? তোমার ভাগের একটা ঘর। যে-ঘরে এসে কোনোদিন দেখলাম না ঘরটা তুমি রং করালে। টিভিটাও মান্ধাতা আমলের। সাদা-কালো। এখন কত কত চ্যানেল! এই টিভিতে কটা দেখতে পাই? ঘরে টিউবলাইটটা আজ কতদিন নষ্ট। যে-বালবটা জ্বলে তার আলো এমনই যে, পরনের ছেঁড়া শাড়িটা রাতের বেলা বসে যে একটু সেলাই করবো, তাও পারি না। বলি তুমি যে এতো লিখছো, তা দিয়ে সংসারের উন্নতিটা কী হচ্ছে?’
বন্ধু আমার সব শুনতো, কিচ্ছুটি বলতো না।
একথা প্রথম যেদিন আমি শুনি, বন্ধুকে আমি বলেছিলাম, ‘রোজ রোজ তোর বউ তোকে এমনসব কথা বলে আর তুই তাকে কিছু বলিস না?’
‘না, কিছু বলি না। কাকে বলবো? অবুঝ যে! তাই শুনি। তাছাড়া সে মিথ্যা তো কিছু বলে না। যা সত্যি তা-ই বলে।’
আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। তখন বন্ধুর মতো আমারও অবস্থা। আমিও তখন উপার্জনহীন। আমিও গল্প লিখি। আমার বউ আমাকে বলুক তো এমন কথা। না, সে-সাধ্য তার নেই। যদিও আমি আমার প্রকৃত অবস্থা বলে বিয়ে করিনি। কিন্তু বন্ধু তো করেছিল। তবে তার এই দশা কেন?
আমার বউকে বন্ধুর কথা-বন্ধুপত্নীর কথা আমি শুনিয়েছিলাম। বউ তা শুনে গর্ব করে বলেছিল, ‘দ্যাখো আমি কত ভালো! আমি তোমাকে কিচ্ছুটি বলি না। কারণ আমি চাই তুমি তোমার বন্ধুর চেয়ে বড় গল্পকার হও।’
বউ বলেছে, আমিও শুনেছি। কারণ আমি জানতাম, বন্ধুর মতো একটিও গল্প আমি আমার সারাজীবনে লিখতে পারব না। আশ্চর্য রকমের দৃষ্টি তার! পর্যবেক্ষণক্ষমতাও। ওই দৃষ্টিতে সে যা দেখে, কেবল সে-ই দেখে, আমরা দেখতে পাই না – সে যতক্ষণ না আমাদের দেখায়।
আরো কিছুদিন পর আমি লক্ষ করি, আমাদের নিয়মিত আড্ডায় বন্ধু আর আসছে না। তাহলে কি সবকিছু থেকে সে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছে? নাকি তার কোনো অসুখ-বিসুখ করল? আমার এমন চিন্তার মধ্যে রাস্তায় একদিন তার সঙ্গে দেখা। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী ব্যাপার রে, তুই আর আড্ডায় আসছিস না যে?’ উত্তরে বন্ধু আমায় বলল, ‘একটা বড় লেখা নিয়ে বড্ড ব্যস্ত বুঝলি। তাই সময় পাচ্ছি না একেবারে।’
আমি জানি বন্ধু তার লেখার ব্যাপারে ভীষণ সিরিয়াস। তার কথা আমি বিশ্বাস করি।
তারপর আরো কিছুদিন কেটে গেছে। বন্ধুর কথা আমি ভুলে গেছি। কারণ, ততোদিনে আমি গল্প লেখার ভাবনা সরিয়ে রেখে উপার্জনের একটা রাস্তা খুঁজে নিয়েছি। রাস্তাটা অবশ্য আমার শালার কাছে পাওয়া। একটা আমেরিকান কোম্পানির সেলস ম্যানেজার। সারা সপ্তাহ আমাকে বাড়ির বাইরে কাটাতে হয়। শুধু ছুটির দিনে বাড়িতে থাকতে পাই।
অনেকদিন পর সেরকম এক ছুটির দিনে হঠাৎ আমার বন্ধুর কথা মনে পড়ল। সন্ধেবেলা গেলাম তার বাড়ি। আমার কৌতূহল ছিল তার সেই বড় লেখাটি নিয়ে। লেখাটির কী করল সে? কোনো পত্রিকায় পত্রস্থ হলো কি না? হলে নিয়ে পড়ব।
বন্ধুর বাড়ি মানে তাদের এজমালি সেই বিরাট বাড়িটা তখন অন্ধকারে 888sport app। চারদিকে বিদ্যুতের আলো। তার মাঝে একটা অন্ধকার ভুতুড়ে বাড়ি যেন দাঁড়িয়ে আছে। দরজার কাছে গিয়ে আমি কলিংবেলের সুইচ খুঁজি। কিন্তু সুইচ খুঁজে পাই না। বদলে আমার হাত পড়ে দরজায় পাশের দেয়ালের একটা গর্তে। অন্ধকারে গর্তে হাত পড়া মানে সাপের ভয়। আমি হাত টেনে নিই। তারপর বন্ধুর নাম ধরে হাঁক দিই। বন্ধুপত্নী দোতলার রেলিং থেকে সাড়া দেয়। আমি তার কাছে বন্ধুর খোঁজ নিতেই ঝাঁজাল কণ্ঠে শুনতে পাই, ‘বাড়ি নেই। দেখুন গে বাসুর দোকানে বসে মদ গিলছে।’
বাসুর দোকানে মদ! আশ্চর্য! বন্ধু আমার শেষ পর্যন্ত মদ ধরেছে?
অন্ধকারে বাড়ি ছেড়ে আলোতে আসি আমি। রাস্তা ধরে আনমনে হাঁটতে শুরু করি। অথচ কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না যে বন্ধু আমার মদ ধরেছে। কেননা, অকেশনে আমিও মদ খেয়েছি। বন্ধু কখনোই খায়নি। বন্ধু বলত, ‘মদ কেউ খায়? জঘন্য জিনিস।’ সেই বন্ধু কি না বাসুর দোকানে দেশি মদের ঠেকে?
এমন অবিশ্বাস থেকেই বোধহয় বাসুর দোকান আমাকে টানল। হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমি সেখানে পৌঁছলাম। বন্ধুকে দেখলাম, হাতে ধরা মাটির ভাঁড়ের তরল সে তার গলায় ঢালছে। তার অনেক সঙ্গী।
দোকানের বাইরে, রাস্তা থেকেই বন্ধুকে ডাক দিই। আমার ডাক শুনে হইহই করে বেরিয়ে এলো সে। বলল, ‘বুঝলি, শালা আমরা ভদ্রলোকেরা কত কিছু না দেখে, কত কিছু না চেখে যে মরে যাই তার ইয়ত্তা নেই। আমিও হয়তো ভদ্রলোক হয়েই মরে যেতাম। ভাগ্যিস শালা বিয়েটা করেছিলাম।’
বন্ধুর কথার মাথামুণ্ডু কিছুই খুঁজে পাই না। তাই বোধহয় তাকে টানতে টানতে বাসুর দোকান ছেড়ে একটু তফাতে নিয়ে আসি। আর বলি, ‘শেষ পর্যন্ত মদ ধরলি তুই?’
‘হ্যাঁ ধরেছি বন্ধু। দারুণ জিনিস বুঝলি। মদ খেলে বেঁচে থাকাটাই পাল্টে যায়! ভালো মন্দ হয়ে যায়। মন্দ ভালো হয়ে যায়।’
আমি জানতে চাইলাম, ‘কী রকম?’
‘এই ধর আমি এখানে বসে মদ খাচ্ছি আর বউ-বাচ্চা অন্ধকারে বাড়িতে বসে আছে। অভুক্ত। তবু তাদের নিয়ে আমার কোনো ভাবনা নেই। চিন্তা নেই।’
আমি তাকে জিজ্ঞেস করি, ‘হ্যাঁ, আমিও তাই দেখলাম। তোদের বাড়ির চারদিকে আলো, শুধু তোদের বাড়িটাই অন্ধকারে 888sport app। কী ব্যাপার বলতো?’
‘ব্যাপার কী হবে আবার? ইলেকট্রিকের বিল দিতে পারিনি। কানেকশন কেটে দিয়েছে। এখন তো আর ভাইয়েরা এ-বাড়িতে থাকে না। আমি একা থাকি। এখন সব দায় আমার। সকাল হলে বউ শুরু করে এটা নেই-ওটা নেই, কী খাবো, কী পরবো? শুধু খিচখিচ বুঝলি। আমার লেখা মাথায় ওঠে। ছেলেটারও হাজার বায়না – বাপি এটা দাও, ওটা দাও! আচ্ছা বলতো, আমি একজন গল্পকার। আমি কোথায় টাকা পাব যে ওদের মা-ছেলের বায়না মেটাবো? তাই কিছুদিন ধরে সন্ধ্যা হলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। বাসুর দোকানে এসে বসি। এখানে কারা এসে বসে জানিস – সব আমার মতো ব্যর্থ মানুষেরা।’
বন্ধুকে এবার আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তোর সেই বড় লেখাটার কী হলো? যেটা লিখছিলি!’
‘বড় লেখাটা! ও হ্যাঁ, বুঝলি – ওটা একটা জায়গায় এসে আজ বহুদিন যাবৎ আটকে আছে। জট বেঁধে গেছে। কিছুতেই খুলছে না। ব্যাপারটা নিয়ে তোর সঙ্গে আলোচনা করা যেতে পারে, তুইও যখন গল্প লিখিস।’
আমি বললাম, ‘না বন্ধু, আমি আর গল্প লিখি না। আমি এখন চাকরি করি। বউ-বাচ্চার দেখভাল করি।’
বন্ধু একটুক্ষণ কী ভাবল। তারপর বলল, ‘না, তুই একসময় লিখতিস তো, তাই তোকে জিজ্ঞেস করছি। এমন জায়গায় গল্পটাকে তুই কী করতিস?’
আমি জিজ্ঞেস করি, ‘কোন জায়গায়?’
বন্ধু বলল, ‘এই ধর উপার্জনহীন স্বামী বাড়িতে বসে আছে। কীসব ছাইপাশ লিখছে। বাড়িতে উনুন জ্বলছে না। বাচ্চা খিদের জ্বালায় কান্নাকাটি করছে। আর স্ত্রী স্বামীকে উদ্দেশ করে বলছে, আজ বাড়ি থেকে বেরিয়ে সংসার খরচের টাকা যদি সংগ্রহ করতে না পারো, তাহলে আর বাড়ি এসো না। স্বামী উত্তর দিচ্ছে, আচ্ছা। সে এমন বলছে কারণ, একটা লেখা নিয়ে সে তখন ভীষণ ব্যস্ত। লেখাটা শেষ করে সে পত্রিকা অফিসে যাবে। যদি লেখাটা সম্পাদকের পছন্দ হয়, পঞ্চাশ বা একশ টাকা পাবে এবং তার বিশ্বাস – লেখাটা সম্পাদকের পছন্দ হবেই। স্ত্রী কিন্তু স্বামীর ওই সংক্ষিপ্ত উত্তরে রেগে যাচ্ছে। রেগে গিয়ে বলছে, আচ্ছা কী? আচ্ছা কী? হায়রে আমার কপাল! বলতো তুমি কী মানুষ? তোমার নিজেরও কি খিদে পায় না? স্বামী লিখতে লিখতেই রসিকতা করে উত্তর দিচ্ছে, আমি মানুষ নই গো, আমি ভূত। স্ত্রী তার উত্তর শুনে হাসবে না কাঁদবে, ভেবে পাচ্ছে না। তারপর স্বামী লেখাটা শেষ করে স্নান সেরে বাড়ি থেকে বের হবে, তার আগে স্ত্রীকে বলছে, লক্ষ্মী সোনা আমার, কোনোমতে আজকের দিনটা চালিয়ে নাও। আজ আমি সত্যিই কিছু টাকার বন্দোবস্ত করে তবেই বাড়ি ফিরব। তখন স্ত্রী শাসাচ্ছে, রোজই তো ওই একই কথা বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। কিন্তু বাড়ি ফেরো শূন্যহাতে। আজ যদি শূন্যহাতে ফিরেছো, তাহলে বুঝতে পারবে। স্বামী তখন বলছে, সত্যি বলছি সোনা, আজ আমি টাকা নিয়েই ফিরব। কথা দিচ্ছি, টাকা সংগ্রহ করতে না পারলে বাড়ি ফিরব না। তবে তুমি একটু সাবধানে থেকো। স্ত্রী কৌতূহলে জানতে চাইছে, কেন? আমি সাবধানে থাকব কেন? স্বামী বলছে, আমার অবর্তমানে টাকা নিয়ে আমার ভূত আসতে পারে! তাই শুনে স্ত্রী তেড়ে যাচ্ছে স্বামীর দিকে। আর স্বামী চম্পট দিচ্ছে। ঠিক এমন জায়গায় লেখাটা আমার আটকে আছে। এরপর কী করব, ভেবে পাচ্ছি না।’
বন্ধুর ভাবনার খেই আমি নিজেও পাই না। অগত্যা বলি, ‘তুই এখন বাড়ি যাবি না?’
‘বাড়ি! না, এখন নয়, আরো কিছুক্ষণ পর। তুই এখন যা। কাল আছিস তো? দেখা হবে। তখন আমার লেখাটা নিয়ে আলোচনা করা যাবে কী বলিস?’ বলেই বন্ধু আর আমার কাছে দাঁড়াল না, পেছন ফিরে একরকম দৌড়ে গিয়ে ঢুকল আবার ওই বাসুর দোকানে। আমি তবু আরো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। একা একা। যেন এইমাত্র একটা সম্ভাবনার মৃত্যু প্রত্যক্ষ করলাম। যেটা মেনে নিতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।
ইতোমধ্যে চাকরিতে আমার প্রমোশন হয়েছে।
আমি নাকি নর্থ জোনে দারুণ ব্যবসা দিয়েছি কোম্পানিকে। তাই আমার পদোন্নতি। পূর্বাঞ্চলের হেড অফিস কলকাতায় আমার পোস্টিং। কোম্পানি বাংলো, গাড়ি সব দিয়েছে। বউ-বাচ্চা নিয়ে দারুণ থাকা বলতে যা বোঝায়, আমি এখন তেমনই আছি। উইক এন্ডে রবীন্দ্রসদন-নন্দন-আকাদেমিতে যাই। নাটক-সিনেমা দেখি। বিভিন্ন পার্টিতে হাজির হই প্রায় দিনই। 888sport cricket BPL rate শতকের ব্যস্ততম মানুষ বলতে যা বোঝায়, আমি এখন তাই। স্বভাবতই আমার সেই গঞ্জ-শহর, আমার আত্মীয়স্বজন, আমার বন্ধু-বান্ধবকে নিয়ে ভাবার সময় নেই। খবরের কাগজ পড়তে হয় বাথরুমের কমোডে বসে। কমোডে বসেই খবরের কাগজে চোখ বুলোচ্ছিলাম সেদিন। হঠাৎ একটা খবরে আমার চোখ আটকে গেল – এই সময়ের এক উল্লেখযোগ্য গল্পকারকে এ-বছর ‘888sport live footballরত্ন’ 888sport app download bd প্রদান করা হলো আকাদেমি সভাগৃহে। 888sport app download bd তুলে দেন সংস্কৃতি মন্ত্রী মহাশয়।
সেই উল্লেখযোগ্য গল্পকার আমার সেই বন্ধু। আমার ভীষণ আনন্দ হয়। আমি পারিনি, আমার বন্ধু তাহলে পারল। যদিও তাকে শেষ দেখেছিলাম বাসুর দোকানে দেশি মদের ঠেকে। এখন আমার মনে হলো, ইস্ খবরটা যদি আগে পেতাম। তাহলে নিশ্চয় সব কাজ সরিয়ে রেখে আকাদেমি সভাগৃহে গিয়ে উপস্থিত হতাম। বন্ধুকে জড়িয়ে ধরতাম।
বাথরুম থেকে চেঁচিয়ে বললাম স্ত্রীকে, ‘এই শুনছো, বন্ধু আমার শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতিটা পেল। ‘888sport live footballরত্ন’টা পেল এ-বছর।’
স্ত্রী তখন রান্নাঘরে। তার কণ্ঠ থেকে আক্ষেপ ঝরে পড়ল, ‘আমাকে কী বলছো? নিজেই ভাবো। তুমি যদি লেগে থাকতে তাহলে তুমিও পেতে!’
স্ত্রীকে আমি বলি কী করে বন্ধুপত্নীর কথা। কী অবস্থায় দিন কাটাতে হয়েছে তাকে। অগত্যা চুপ করে প্রাতঃকর্ম সারি আর মনস্থির করি, এই উইক এন্ডে দেশে যাব। বন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আসব। তাছাড়া দেশে অনেকদিন যাওয়া হয়নি। আত্মীয়স্বজন কে কেমন আছে, তাদের খোঁজ নেওয়াও হবে।
স্ত্রীকে যদিও বলি না এ-কথা। যাওয়ার আগের দিন রাতে তাকে সারপ্রাইজ দেব। তাছাড়া উইক এন্ড আসতে এখনো পাঁচদিন বাকি। এর মধ্যে অফিসে যদি আবার উটকো ঝামেলা এসে পড়ে আর যদি শেষ পর্যন্ত না যাওয়া হয়, স্ত্রী মন খারাপ করবে, বাচ্চাটার আনন্দ মাটি হয়ে যাবে।
যথা ভাবনায় অফিসে দু-দিন ছুটি নিয়ে উইক এন্ডে গিয়ে হাজির হই আমার দেশের বাড়িতে। অনেকদিন পর দেশে ফেরা। স্বভাবতই আমার ভাই, ভাইবউ, তাদের ছেলেমেয়ের খুব আনন্দ। আমার ভাই স্কুলটিচার। ইংরেজি অনার্স ছিল বলে পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় হাইস্কুলে কর্মকর্তারা ঢুকিয়ে নিয়েছিল। আমার আগেই সে চাকরিতে ঢুকেছিল বলে চাপা অহংকার আছে তার। রাতে খেতে বসে সেই ভাইকে আমি জিজ্ঞেস করলাম বন্ধুর কথা, বন্ধুর 888sport app download bdপ্রাপ্তির কথা। তারপর স্থানীয় কোনো সংস্থা বন্ধুকে সংবর্ধনা দিচ্ছে কি না জিজ্ঞেস করব, তার আগেই ভাই বলে উঠল, ‘ধুর, তোর বন্ধু 888sport app download bd পাবে কেন? 888sport app download bd পেয়েছে ওই নামের অন্য কেউ। আর তোর বন্ধু তো কবেই লেখা ছেড়ে দিয়েছে। এখন দু-নম্বরি ব্যবসা করে তার বিশাল অবস্থা। গাড়ি-বাড়ি-ইটভাঁটা, আরো কত কী করেছে…’
আমি হতবাক হয়ে যাই। ভাই আরো কত কী বলে, আমি কিছুই শুনি না। তবে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করি। ভাইয়ের কথা আমার বিশ্বাস হয় না। তাই ‘একটু আসছি’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। পাড়ার মোড়ে নিমাইদার ঢপ থেকে এক প্যাকেট সিগারেট কিনি। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে বন্ধুর বাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করি।
গঞ্জশহর বলে তখন বেশ রাত। চারদিক নিঝুম। সিগারেট টানতে টানতে রাস্তায় হাঁটছি আর বন্ধুর কথা ভাবছি। গল্প লেখা ছেড়ে বন্ধু আমার শেষ পর্যন্ত দু-নম্বরি ব্যবসা করছে। এও কি সম্ভব?
হ্যাঁ, সম্ভব। শেষবার বন্ধুর বাড়ি দেখেছিলাম, অন্ধকারে ডুবে ছিল। অথচ এখন আমার চোখের সামনে সেই বাড়ি আলোয় আলোময়। আমি দেখছি, বাড়িটা রং করা হয়েছে, যার ঔজ্জ্বল্যে আমার চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তবু আমি এগিয়ে যাচ্ছি সেই বাড়ির দরজার দিকে। দরজার পাশে তিনখানা বাইক দাঁড়িয়ে। একটা মারুতি ভ্যানও। দরজার ওপরের ঝোলানো বালবের আলোয় সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমি। এমনকি কলিংবেলের সুইচটাও আমার স্পষ্ট চোখে পড়ল। তবে সেটা স্পর্শ করি না আমি। তার আগেই আমার চোখ চলে যায় দরজার বাঁ-পাশের ঘরটার জানালা বেয়ে ভেতরে। আমি দেখি, বন্ধু আমার একটা হুইল চেয়ারে বসে আছে ঠিক দাউদ ইব্রাহিমের ভঙ্গিতে। তার সামনে একটা কাচ বসানো টেবিল। সেই টেবিলে টাকার বান্ডিলের স্তূপ। ঘরে আরো কয়েকজন আছে, বন্ধু তাদের সঙ্গে জরুরি কীসব কথা বলছে!
বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবার ইচ্ছেটাই হারিয়ে গেল আমার। আমাকে যাতে কেউ দেখে না ফেলে সেই ভয়ে আমি তাড়াতাড়ি বন্ধুর দরজা থেকে ফিরে হাঁটতে শুরু করলাম। তখনই শুনলাম, ওপর তলায় বন্ধুপত্নীর কণ্ঠস্বর, ‘বাপি আয়, দুধ খেয়ে নে, পরে টিভি দেখবি।’ বন্ধুপত্নী ছেলেকে ডাকছে দুধ খেতে। টিভির আওয়াজও ভেসে আসছে সেই সঙ্গে, ‘জো হুকুম জাঁহাপনা, বান্দা হাজির।’ ‘আলিফ লায়লা’ বোধহয়। যতসব অবাস্তব গল্প ভেবে একটা-দুটো এপিসোডের পর আর দেখি না। কিন্তু এই মুহূর্তে ‘আলিফ-লায়লা’ আর আমার অবাস্তব মনে হয় না। তাই খুব দ্রুত আমি হেঁটে চলে আসি স্কুলমাঠের কোনায় রোডস অফিসের পাশের রাস্তাটায়, যেখানে অফিসের ভেতর থেকে একচিলতে আলো এসে পড়ছে। সেই আলোতে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে সিগারেট-দেশলাই বের করে ধরাই। তারপর আবার হাঁটার জন্য ডান পা-টা যেই তুলেছি অমনি একজনকে পাশ কাটিয়ে যেতে দেখে আমি চমকে উঠি। কে? আমার গল্পকার বন্ধু না? হ্যাঁ, সে-ই তো।
বন্ধু চলে যাচ্ছিল। সামনের দিকে শরীরটা ঝুঁকে ছিল তার। একটু টলছিলও বোধহয়। আমি আর পারলাম না, তার নাম ধরে ডাক দিলাম।
আমার ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়াল সে। আমি এগিয়ে গেলাম তার কাছে। বললাম, ‘কী ব্যাপার বলতো, আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। এখনই তোকে তোর বাড়িতে দেখে আসছি আমি। তোদের বৈঠকখানা ঘরের সামনে টেবিলে টাকার বান্ডিল নিয়ে হুইল চেয়ারে বসে তুই কজনের সঙ্গে কথা বলছিলি। এর মধ্যে আবার তোকে রাস্তায় দেখছি। তাও আসছিস অন্যদিক থেকে। মাতাল হয়ে!’
বন্ধু আমার কথা শেষ করতে দিলো না, নিজেই বলে উঠল, ‘বাড়িতে বৈঠকখানা ঘরে তুই যাকে দেখে এসেছিস, সে আমি নই রে – আমার ভূতকে দেখে এসেছিস তুই। আর এই তো আমি বাসুর মদের ঠেক থেকে এখনই উঠে এসেছি। খবরদার এ-কথা কাউকে বলিস না যেন!’
থুড়ি! বন্ধুর বারণ সত্ত্বেও বলে ফেললাম আপনাদের আমার গল্পকার বন্ধুর গল্প। অপরাধ নেবেন না।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.