বাংলা ছোটগল্পের কলকব্জা কী, অথবা তার নান্দনিক তত্ত্বালোচনা এই রচনার উদ্দেশ্য নয়। ওই জাতীয় বিদগ্ধ বাক্যস্রোত আমার কলমে আসে না। আমি বরং নিজ গল্প লেখার অভ্যাস সম্পর্কেই কিছু অক্ষর সাজাতে পারি।

আমার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়েছিল চল্লিশাধিক বর্ষ পূর্বে। সম্প্রতি প্রকাশিত মদীয় ‘গল্প সমগ্র’র ‘নিবেদন’ অংশে এ-প্রসঙ্গে যা বলা আছে উদ্ধৃত করছি।

‘চল্লিশাধিক বর্ষ’ অনেক শোনায়। আসলে আমার গল্প রচনার কালস্রোত অত দীর্ঘপ্রবাহী নয় – ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৯ এই বারো বছর এবং ১৯৮৮ থেকে অদ্যাবধি আবার বারো বছর। মাঝখানে পড়ে আছে আঠারো বছরের বালুচর। আঠারো বছরের কোনো হিসাব পাওয়া যায় না। শুষ্ক স্রোতের কোনো কারণও নয়। দীর্ঘ বিদেশবাস কী মুক্তিযুদ্ধে বিপর্যস্ত জীবনের কথা বলা যায় হয়তো। কিন্তু তাতেও আঠারো বছর উঠে আসে না।..

আমার গল্প রচনার প্রথমকালে সম্মুখে ছিলেন বাংলা ছোটগল্প চরাচরের অনেক অধীশ্বর। এবং আন্তর্জাতিক ছোটগল্পেরও। গল্প রচনার শুরুতে তাঁদের কথা মনে রাখলেও, পরে নিজের পথ নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়েছিল। নিজেকে আলাদা করবার জন্য অবশ্যই, অনুকরণীয় কাউকে দেখিনি হয়তো, একারণেও।…

‘আঙ্গিকসর্বস্বতা নয়, তবুও নিজ গল্পের চেহারা, শব্দ ব্যবহার ও বাক্য গঠনরীতিসহ স্থির করে নিতে হয়েছিল নিজেকেই। ছোটগল্পের সীমিত অবয়বে জনজীবন বর্ণনার পৌনঃপুনিকতা বাধ্য করেছিল নিশ্চিত আশ্রয় পরিত্যাগে। বঞ্চিত, পীড়িত, মধ্যবিত্ত কী খিন্ন, ক্লিন্নজীবন গণমানুষই কেবল নয়, গ্রাম থেকে উঠে আসা ছোট শহরের মানুষ, বড় শহর পার হয়ে পৃথিবীর গগনছোঁয়া নগরের ভেতর দিয়ে তাই আলোর বৃত্তে এসে দাঁড়ায়। অযুত গ্রামীণ মানুষের নৌকার গুণেই আছে বাড়তি হাওয়ার টান এই বিশ্বাসে স্থির থাকা যায় না। এ কারণে পঞ্চেন্দ্রিয়গ্রাহ্য নিজ জীবনের সারাৎসার ব্যবহার করি গল্পে।….

নিজ গল্প রচনার কলাকৌশল, কী অভ্যাস সম্পর্কে সব কথাই সম্ভবত ওই সামান্য কিছু বাক্যে ধরা আছে। তবুও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিতব্য নিবন্ধ রচনার একটি রীতি তো আছে। এ কারণে আরো কিছু বাকবিস্তার না করে পারা যাবে না।

দুই

গল্প লেখা কি শেখানো যায়? আমি নিজে কারো কাছে গল্প লেখা শিখিনি, যদিও জানি স্কুল-কলেজে গল্প-লেখা শেখানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নানা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক্রিয়েটিভ রাইটিং’ তো শেখানো হয়ই, ওই দেশের বাইরেও অন্যখানে অমন লেখা শেখার ক্লাস নেয়া হয়। ‘ফিকশন রাইটিং’ বলে যে কোর্স পড়ানো হয় সেটি নিঃসন্দেহে গল্প-লেখা শেখানোর সমগোত্রীয়। এইসব কোর্স যাঁরা পড়ান তাঁদের অনেকেই বড় ঔপন্যাসিক বা গল্পকার, যদিও তাঁরা নিজেরা ক্লাস নিয়ে লেখা শিখেছেন বলে উল্লেখ নেই কোথাও।

ক্লাসে বসে যে রচনা লেখা শেখা যায় তা মূলত সংবাদভিত্তিক। ‘রিফ্লেকটিভ রাইটিং’ বা ‘এক্সপোজিশন’ নাম দিয়েও বেশ কয়েক রকমের লেখা শেখানো হয় সেসব 888sport live-নিবন্ধ জাতীয় রচনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর ডিগ্রির জন্যে প্রয়োজনীয় যে পৃথুল তামামি রচনা লেখা হয়, “থিসিস’ বা ‘ডিসার্টেশন’ বলা হয় যাকে, ছাপালে যেটি বৃহদাকার গ্রন্থ হয়, সেই রচনার কলাকৌশলও কিন্তু ক্লাসে শেখানো হয়। প্রকৃতপক্ষে গ্র্যাজুয়েট স্কুলে ‘থিসিস’ কী ‘ডিসার্টেশন’ লেখা একটি অবশ্যপাঠ্য বিষয়। কিন্তু এইসব কোনোটিই গল্প-লেখা শেখায় না।

গল্প-লেখা শেখানোর সবচেয়ে কাছের কোর্সটি আমি নিজেও কিছুকাল পড়িয়েছি—নিউইয়র্কের সেন্ট জনস ইউনিভার্সিটিতে। কোর্সটিকে বলা হতো ‘নিউ জার্নালিজম’।

মূলত সংবাদভিত্তিক এই রচনার ধারা অবশ্য অনেককালের, কিন্তু এটিকে আনুষ্ঠানিক চেহারা দিয়ে জনসমক্ষে হাজির করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক-লেখক টম উলফ। ষাট দশকেই প্রায় সাংবাদিকতার ক্লাসে অনেক রকম ‘রিপোর্টিং বা 888sport world cup rate লেখা শেখানোর মধ্যে ‘হিউম্যান ইন্টারেস্ট স্টোরি’ বা মানবিক আবেদনসম্পন্ন 888sport world cup rate লেখাও শেখানো হয়। জীবনের নানা প্রকৃত ঘটনা যা চারপাশে অহরহ ঘটে চলেছে তার আবেগমণ্ডিত কাহিনীরূপ সংবাদ পরিবেশনই ওই জাতীয় রচনা। ‘ফিচার রাইটিং’ বলেও অনেক সময় এরকম লেখা শেখানো হয় কিন্তু ‘নিউ জার্নালিজম’-এর রচনা তার চাইতে কিয়ৎ পরিমাণে ভিন্ন।

‘নিউ জার্নালিজম’ নামটি খুব যুৎসই নয়। টম উলফ নিজেও এই নাম নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগেছেন। অন্য কোনো নাম খুঁজে না পেয়ে এই বিশেষ ধারার রচনার ওই নাম দিয়েছিলেন তিনি। ‘নিউ জার্নালিজম’-এর গভীরে আছে প্রাত্যহিক জীবনের লৌকিক সংবাদই অথচ তার পরিবেশন এমনই যে, পড়বার সময় এবং পরেও মনে হয় যেন গল্প কী 888sport alternative linkই পাঠ করা হচ্ছে। এইরকম ‘গল্প’ বা ‘888sport alternative link’ লেখা ক্লাসে শেখানো যায়। ঘটনার ব্যাপ্তি বা তীব্রতা যখন বস্তুনিষ্ঠ 888sport world cup rate রচনায় ধরা যায় না তখন এই পদ্ধতি গ্রহণে বড় মনোহারী রচনা সৃষ্টি করা সম্ভব।

‘নিউ জার্নালিজম’ রচনার মূল কৌশল নিহিত লেখকের বর্ণনা ক্ষমতায়, দৃশ্যনির্মাণের দক্ষতায়। ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিবরণে, চরিত্র গঠনের কুশলতায় যে চরিত্র নির্মিত হবে অবিকল রক্তমাংসের বাস্তব চরিত্রটির আদলে। বস্তুত লেখক তাঁর চরিত্রটিকে এত গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন, প্রায় অণুবীক্ষণ দ্বারাই যেন, সৃষ্ট চরিত্র মনে হয় তাঁর মানসসঞ্জাতই। যে ঘটনা 888sport world cup rateটির মূলে থাকবে তার উপস্থাপন মনে হয় যেন ‘ফিকশনাল ই লেখক ঘটনাটিকে এমন করে বিশ্লেষণ করেন, প্রতিটি মুহূর্তের এমন হিসাব রাখেন যেন মনে হয় অমন করে কিছুই জীবনে ঘটে না। ‘নিউ জার্নালিজম’-এর চেহারাই এই রকম।

লেখক যখন প্রকৃত ঘটনার দৃশ্যটি পুনর্নির্মাণ করেন, যাকে বলা হয় ‘সিনিক রিকনস্ট্রাকশন’ তখন আশপাশের তুচ্ছাতিতুচ্ছ বস্তুটিকেও তুলে আনার চেষ্টা করেন। দেয়ালঘড়ির বড় কাঁটাটির হালকা হয়ে যাওয়া রঙ থেকে বাথরুমের একটি টাইলের অসমান কোনা কী শার্টটির পেছনের ভাঁজে একটি কৃষ্ণবিন্দু- সব, সবই লেখক তুলে আনেন। চরিত্রটির মুখের রেখাই কেবল নয়, কষ্টের হাসি মুখে ফোটালে ক্ষয়ে যাওয়া দাঁতের যে সামান্য অংশ দেখা যায় সেটুকুও ধরা থাকে, ভরদুপুরের দিগন্তবিস্তৃত প্রেইরিতে উড়ে বেড়াচ্ছে সেজ ব্রাশের গোলাকৃতি উন্মূল ঝোপটি–সেটিও তিনি দেখেন, শোনেন শূন্যহৃদয় কর্মহীন তরুণীর দীর্ঘশ্বাস, মাত্র কিছুকাল আগে যার ছোট শহরের পোশাক তৈরির কারখানাটি বন্ধ হয়ে গেছে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে। 888sport world cup rateটির মূল প্রতিপাদ্য শেষতক দেখা যাবে ক্ষীয়মাণ জন888sport free betর শহরে বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানায় সৃষ্ট বেকার সমস্যাই।

ওই রকমই ঘটে দর্পী সেনানায়ক যখন ফ্রন্টলাইনে সৈন্যদল পরিদর্শনে যান অথচ শুনতে পান না সদ্য অতিক্রান্ত কিশোরের ক্রন্দন, জলকাদার ট্রেঞ্চে গোলাবারুদে ছিন্নভিন্ন পা-টি নিয়ে যে শুয়ে আছে। অযুত দর্শকের আদরে সিক্ত পেশাদার খেলোয়াড়টি কী করে নিজ শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখেন প্রতিটি খেলায় সমস্ত শরীর কালশিরায় ভরে গেলেও, রক্ত জমাট বেঁধে গেলেও পরদিনই যাকে আবার মাঠে নামতে হয়। তার কথা আর কেউ শুনবে না, শুনবে ওই ‘নিউ জার্নালিজম’-এর প্রতিবেদকই। আর বুকছেঁড়া সেইসব প্রকৃত জীবনের কথা বলে যাবে।

‘নিউ জার্নালিজম’-এর সঙ্গে পরিচিত হবার পরে মনে হয়েছে আমার গল্প লেখা যেন অমনই। শুধু তফাৎ এই যে ওই লেখকের সব বিবরণ যেমন প্রকৃত ঘটনা, আমার হয়তো তেমন নয়, তার সবকটি চরিত্র যেমন দৈনন্দিন জীবনের বুকে হেঁটে বেড়ায় আমার হয়তো ঠিক অতোটা নয়, যেন রাস্তার সবকটি বাঁকই তার নিজ চোখে দেখা, আমার হয়তো সবকটি নয়, এই। তবুও আমি আমার গল্প লেখার কলাকৌশলের সঙ্গে ‘নিউ জার্নালিজম’-এর কলাকৌশলের মিল দেখতে পাই। বড় তফাৎ অবশ্য দেখি যখন আমার গল্পের অন্তর্নিহিত আবেগ শতধারে প্রবাহিত হতে থাকে, সৃষ্টি করা যায় বলেই, ‘নিউ জার্নালিজমে অতো নয়।

সবচেয়ে বড় কথা এই যে, আমি যখন গল্প লেখার অনেক পথই পার হয়ে এসেছি তখনই কেবল ‘নিউ জার্নালিজম’-এর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছে। আর বিস্ময়ের সঙ্গে আমাদের ‘জীবনমুখী’ গল্প বা 888sport alternative linkের সঙ্গে তার সাযুজ্য লক্ষ করেছি।

এইখানে এসে আমার সন্দেহ হচ্ছে যে, গল্প লেখার ব্যাপারটি, অন্তত আমার গল্প-লেখার ব্যাপারটিকে আমি বোধ হয় খুবই সাদামাটা চেহারায় হাজির করছি। কেন না ‘নিউ জার্নালিজম’-এর লেখক চোখ খুলে দেখেন সব, আমি দেখি নিমীলিত চোখে। সৃষ্ট দৃশ্যই কেবল দেখেন তিনি, আর আমি নিয়ত দৃশ্য সৃষ্টি করে চলি। তাই মনে হয়, আমার গল্প-লেখা সম্বন্ধে আরো কিছু বলা দরকার। তিন

স্কুল-কলেজে অনেক কাল অজস্র গল্প, 888sport alternative link ইত্যাদি পড়বার পরেই গল্পলেখার কথা মনে এসেছিল আমার। বাংলা 888sport live footballের এবং বিদেশী নানা 888sport live footballের অনূদিত রচনা পাঠ করেই। কৈশোরে রহস্যরোমাঞ্চের কাহিনী পড়বার পরেও অমন ঘটেছিল এবং একটি ক্ষুদ্র গোয়েন্দা কাহিনী লিখেও ফেলেছিলাম তখন। যদিও পরবর্তীকালে এর কোনো হদিস আর পাইনি। কখনো মনে হয়, কলেজ বার্ষিকী সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত না হলে, কী কলেজ বার্ষিকীতে নিজ রচনা ছাপার অক্ষরে দেখার অদম্য বাসনা না থাকলে হয়তো ওই সময়ে গল্প লেখার কথা মনে আসত না কখনো। এবং কলেজ বার্ষিকীর সার্বিক দায়িত্বে যে অধ্যাপক ছিলেন তিনি যদি আমার লেখা সবকটি রচনা, গল্প, একাধিক 888sport app download apk, রম্যরচনা ইত্যাদি যদি মুদ্রণযোগ্য মনে না করতেন তাহলেও পরে গল্প রচনায় আমার অতো মনোনিবেশ করা ঘটত কিনা।

কলেজ বার্ষিকীতে প্রথম গল্প প্রকাশ এবং অনতিকাল পরে তৎকালীন দৈনিক পত্রিকাদিতে গল্প রচনা ওই রকমভাবেই ঘটেছিল। নানা গল্পকারের রচনা পাঠ করেই। তৎকালে মনে হয় ছোটগল্পের রবীন্দ্রসংজ্ঞাও কিছু পরিমাণে কাজ করে থাকবে (পরে যদিও ছোট কথা, ছোট প্রাণ আসলেই ছোট গল্পের মুখ্য চিহ্ন নয় বলে বুঝেছি)। বিপন্ন আর্তমানুষ কী অন্যায়ী বিত্তবান অথবা সামাজিক বৈষম্য, ইত্যাকার বিষয় প্রথা অনুযায়ী উপস্থিত করে চলাই তখন ছিল গল্প-লেখা। রবীন্দ্রসংজ্ঞার শেষ অংশ ‘সাঙ্গ করি মনে হবে’-র ওপরেও বেশ নজর দেয়া হতো অন্তর্গত সত্য, যত না বহিরঙ্গ বর্ণনায় মনোযোগ ছিল অনেক বেশি। আমার গল্পরচনার প্রথমকালে লেখা ওইসব কল্পকাহিনীর কোনো চিহ্নই প্রায় নেই এখন।

এইরকম করেই চলে বেশ কিছুকাল। কিছু কিছু সাময়িকীতেও রচনাদি প্রকাশিত হতে থাকে কিন্তু গল্প রচনার 888sport live chatশৈলী নিয়ে ওই সময়ে বিশেষ চিন্তিত ছিলাম বলে মনে হয় না। অধীত গল্পসমূহের রচনাকৌশল নিজ রচনাতেও প্রয়োগ করতাম। এক শুভানুধ্যায়ীর মন্তব্য এই সবকিছু পাল্টে দেয়। তিনি আমাকে আধুনিক গল্প পড়তে বলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হয় তৎকালে পঠিত সমস্ত গল্পলেখক রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ, সুবোধ ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, আলাউদ্দিন আল আজাদ-এঁরা যদি আধুনিক না হন তাহলে আধুনিক লেখক কারা? চেখভ, মোপাসাঁ ও হেনরির পাশাপাশি কাফকা কী জয়েস পড়বার চেষ্টাও করি তখন। মোরাভিয়া, দাসিয়া মারাইনি কিংবা লরেন্স ডারেল, ডি এইচ লরেন্স, কিংসলি অ্যামিস, জ্যাক কেরুয়াক এঁদের রচনাও। আধুনিক রচনার জগৎ তবুও যথেষ্ট স্পষ্ট হয় না। ওই সময়ে ‘সমকাল’ এবং ‘উত্তরণ’ প্রকাশিত হতো 888sport app থেকে; ‘নতুন 888sport live football’, ‘চতুরঙ্গ’, ‘পরিচয়’ প্রকাশিত হতো কলকাতায়। এসব পত্রপত্রিকার লেখাও পড়ি অনিয়মিত। এবং ওই রকম কোনো একদিন ‘আধুনিকতার’ দরজা অকসাৎ খুলে যায় আমার কাছে। ‘সমকাল’ সম্পাদক কর্তৃক আমার একটি গল্প অমনোনীত হবার পরেই। সেই গল্পটি ছিঁড়ে পুকুরের জলে ভাসিয়ে দিয়ে ভাবতে থাকি যখন ‘আধুনিক গল্প’ কী—তখনই সেটি ঘটে। আমি স্পষ্ট বুঝি এই ‘আধুনিক’ রচনা অন্যসব রচনার চাইতে আলাদা। আমার একান্ত নিজস্ব রচনাটিই সর্বাধুনিক। এবং সেই বিশ্বাস থেকে লিখতে শুরু করি গল্প “একজন মানুষ চাই”–প্রতিটি শব্দ যার মাপা, বাক্যগঠন পরিশ্রমী, বাক্য গ্রন্থনাও সুচিন্তিত। প্রতিটি বাক্য অতি প্রয়োজনীয়। কিন্তু নজর থাকে না বাক্যে ব্যবহৃত শব্দের শ্রেণিবিভাগের ওপর। তৎসম শব্দের আধিক্য থাকলেও রচনায় অক্লেশে ব্যবহার করি তদ্ভব ও দেশী-বিদেশী শব্দ অনবরত। মূল লক্ষ্য থাকে পাঠতৃপ্তি। কাহিনী সেখানে মুখ্য নয়, অনুভব কী বোধ সৃষ্টিমূল। বর্ণনাটিই মুখ্য এবং ওই বর্ণনার কৌশল পুঙ্খানুপুঙ্খ, তাই নিয়ে যায় দৈনন্দিন জীবনের ঘটনা কী আশা নিরাশাকে ভিন্ন জগতে। ঠিক এইরকম ভেবেই যে লেখা শুরু করেছিলাম বলা যাবে না, তবে রচনাশেষে ওই রকমই মনে হয়েছিল। অমনোনীত রচনা ফেরত আনবার সপ্তাহ দুয়ের মধ্যেই ‘একজন পুরুষ চাই’ দিয়ে আসি ‘সমকালে’। এবং দু দিন পর খোঁজ নিতে গেলে সিকান্দার আবু জাফর প্রেসের ভেতরে গিয়ে প্র দেখে আসতে বলেন। ওই মাসেই গল্পটি প্রকাশিত হয়। বুঝি, এই হচ্ছে আধুনিক গল্প। আরো একটি ব্যাপারও লক্ষ করি তা হচ্ছে গল্পের জন্যে, তার মালমশলা সংগৃহীত আছে অজস্র উপকরণ—সেসব তুলে আনা চাই। চারপাশসহ নিজেকে সংগ্রহের জন্যে সর্বদা বহির্বিশ্বে নজর রাখার প্রয়োজন নেই। নিজের মধ্যেই নিজ গল্পে তুলে আনা শুরু হয় তখন থেকে তাই।

গল্প রচনার উপরোক্ত কৌশল যে একইভাবে সর্বদা ব্যবহার করেছি তা নয়। গল্পের প্রয়োজনে বদলেছে কৌশল, বর্ণনার ভঙ্গিও, এমনকি শব্দ ব্যবহার ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং ওই রচনার কিছুকাল পরেই আসে আমার গল্পে আলো- বাক্যগঠনও— তবুও ‘একজন পুরুষ চাই’-এর রচনাস্রোত আমাকে অনেকদূরই আঁধারের খেলা – বস্তু ও কল্পলোক একাকার করে দেয়ার প্রক্রিয়া। লক্ষ রাখতে থাকি যেন একটু ফাঁকও না থাকে ওই দুই লোকে আরোহণ অবরোহণে।

উদ্ভূত এইসব চিন্তাস্রোত অনেক সময় সমকালীন অথবা কালের এপারে ওপারের 888sport live footballভাবনার নানা তত্ত্ব সর্বদাই শ্রুত হয়। মূলত বিভিন্ন জীবনদর্শন থেকে অনেক লেখককেই স্পর্শ করে। ওই জাতীয় বিশেষ কোনো দার্শনিক চিন্তাস্রোত দ্বারা আমিও স্পর্শিত হয়েছি নিঃসন্দেহে, কিন্তু সেটি কি আমি জানি না। আমার বিবেচনায় সৃষ্টিশীল লেখকের রচনাই হচ্ছে সমকালীন 888sport live footballচিন্তার আধার। সমালোচক বা ‘লিটারারি ক্রিটিক’ যা-ই বলা হোক না কেন, তাদের কাজ হচ্ছে সেইসব চিন্তার সূত্র খুঁজে বের করে আনা এবং উৎসাহীজনের সম্মুখে তুলে ধরা। এইসব কথা বলার কারণ একটিই : আমি অন্য কোনো লেখকের চিন্তা বা রচনাশৈলী দ্বারা সজ্ঞানে কখনো প্রভাবিত হয়েছি বলে মনে করি না।

গল্পরচনার উৎস মনোজগৎ—সব লেখকের মতো আমারও। বহির্বিশ্ব সেখানে প্রবেশ করে, প্রতিফলিত হয়, সম্পৃক্ত হয় নিজ চিন্তা ও বিশ্বাসের সঙ্গে। এ কারণেই কেবল বহির্বিশ্বের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক – আমার মনোজগতের বাইরে, কখনোই 888sport live chatের সৃষ্টি করে না। কেবল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ এবং মানুষই নয়, চাই বৎসরাধিক কাল কী তারও বেশি। তাই একসাথে পাশাপাশি একাধিক গল্পভ্রূণের আরো বেশি কিছু। এজন্যে কোনো গল্পের বীজ ভাবনায় প্রোথিত থাকে কখনো বসবাস। প্রয়োজনে কাউকে তুলে এনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে দেখে শরীর দেওয়ার চেষ্টা করা। যদিও তাদের কেউ কখনো কখনো শরীর পায়ও না।

চার

আমার গল্পরচনার দুটি কাল – ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৯ বারো বছর, এবং ১৯৮৮ থেকে অদ্যাবধি, বছর পনেরো। মাঝখানে পড়ে আছে আঠারো বছরের নিষ্ফলা গল্পবপনের জমি। মূলত বিদ্যাভ্যাস এবং জীবিকা অর্জনে কাটে এইসময়। প্রকৃতপক্ষে ওই আঠারো বছরে ব্যক্তিগত চিঠিপত্র ব্যতীত কোনো বাংলা রচনাই লিখিনি। জীবিকার জন্যে ভিন্ন ভাষার আশ্রয় নিলে সেই ভাষাতেই প্রকাশিত হয় তৎকালীন সমস্ত রচনা। আঠারো বছর পরে পুনরায় বাংলা গল্পরচনার শুরুতে তাই সংশয় ছিল। এই দীর্ঘকাল কী দাগ রাখবে রচনায় ভেবে দ্বিধা ছিল অনেক। গল্পরচনার পূর্বায়ত্ত কৌশল সব ঠিক আছে কিনা, থাকলেও সেইসব কৌশল আবার ব্যবহারযোগ্য কিনা, বারবার ভাবতে হয়েছে। এই স্থলিত পায়ে চলা, আমার বিশ্বাস দ্বিতীয়কালের প্রথম কিছু গল্পে ধরা পড়ে থাকবে। তবুও ক্রমে দেখি নতুন পালার জন্যে নতুন কিছু রীতি আরোপ করা প্রয়োজন। দুই পালার মধ্যবর্তীকালে আমার গল্পপাঠ সম্পূর্ণই বিদেশে, প্রধানত সাময়িকীতে প্রকাশিত গল্পাবলি। ‘আটলান্টিক’, ‘নিউইয়র্ক’, ‘কেনিয়ন রিভিউ’ কী ‘গ্রান্টা’য় প্রকাশিত গল্প পাঠে লক্ষ করি অন্তর্বর্তী এই বিশ বছরে গল্পের বহিরঙ্গে যে দ্যুতি ছিল তা এখন অন্তলীন। দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্পে এইরকম রচনার চেহারা খুব বদলায়নি। বরং ষাট-সত্তরের ‘এভারগ্রিন’-এ প্রকাশিত গল্পের কিছু ছাপ পাওয়া যায় – যদিও সামান্যই। আমি আমার প্রথম পর্বের গল্পকৌশলের সঙ্গে মেশাই আরো পাঠযোগ্যতা, পাঠতৃপ্তি – মনোমুগ্ধকর, হার্দ মুখোমুখি হতে হয় অযুত ইঙ্গিত ও সম্ভাবনার। শেষে দেখা যায় এক জীবনের আবেদন। আপাতসরল বহিরঙ্গ গল্পে প্রবেশ সহজ করে দেয় কিন্তু তারপরই গল্প সীমানা পেরিয়ে চলে গেছে অন্য জীবনে। এইরকম করেই গল্প লেখা হয়। জীবনে ওঠে, জীবন গল্পে নামে শুধু সীমানাটিই বোঝা যায় না।