গল্পটা আনন্দ নিকেতনের অথবা …

মারিয়া

মারিয়া ঠিক করতে পারে না আনন্দ নিকেতন থেকে বের হয়ে সে কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে? বিয়ের পর নিজের উচ্চশিক্ষা আর অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ইচ্ছা নিয়েও নিতান্ত গৃহবধূ হয়েই আনন্দ নিকেতনে একটা যুগ কাটিয়ে দিয়েছে সে, নিজের জন্য আলাদা করে কিচ্ছু ভাবেনি কিংবা ভাবার দরকারও পড়েনি। শিহাবদের তিন পুরুষের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসা। নিজেও পড়াশোনা শেষ করে চাকরি-বাকরির কথা মোটেই ভাবেনি শিহাব। বরং উত্তরাধিকারের ব্যবসার হাল ধরার গুরু দায়িত্ব ছিল তার ওপরই।

এখন এই বয়সে, এই সময়ে, এই অবস্থায় চাইলেই কি নিজের কিছু তৈরি করতে পারবে মারিয়া? কোনো চাকরি, কোনো ঠিকানা? এই আনন্দ নিকেতন থেকে বের হয়ে কোথায় যাবে সে? নিজের বেডরুম থেকে বের হয়ে পাশের বেডরুম লাগোয়া সিঁড়িতে ছেলে দুটোর হাত ধরে থ মেরে বসে থাকে মারিয়া। কী হয়ে গেল, কী করে হয়ে গেল, কেন হলো, এখন কী হবে … ভাবতে ভাবতে দিলরুবা খাতুনের আরেকটা তাড়া খেতে হলো, যাবি? নাকি ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করতে হবে? হ্যাঁ যাবে মারিয়া, যেতে তো হবেই। যেতেই হবে।

যাওয়ার আগে বাড়িটার দিকে ঘুরে তাকায় মারিয়া, শেষবারের মতো। প্রথম দিন ঢুকে যে বিস্ময় তাকে রহস্যময় গুহার মতো হা করে গিলে খেয়ে ছিল আজো সেই রহস্যই বদহজম হয়ে তাকে উগড়ে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে। পার্থক্য একটাই, তখন ছিল প্রবেশ-পরবর্তী শিহরণ আর ঠিকানা পাওয়ার নিশ্চিত অধিকার আর এখন সে ছিটকে পড়ছে অনিশ্চিত ভবিতব্যে।

সদর ফটকের পর দুখানা বড় বড় পাল্লা দাঁড়িয়ে আছে পাহারাদারের মতো। সিমেন্ট-ইট কেটে কেটে বাহারি ঢেউ পাল্লা দুটোতে। দুই পাল্লার জোড় লাগানো পাটাতনে মাধুরী লতার ঝোপ। অদ্ভুত মাদক গন্ধ। এক যুগ আগে এই বাড়িতে ঢোকার সময় যে গন্ধ ঘ্রাণেন্দ্রিয় পেরিয়ে পেট অবধি ঢুকে পড়ে ছিল আজো গন্ধটা নাড়ি ছাড়ছে না। অথচ এই বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ হচ্ছে, নাড়ির বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে মারিয়ার দু-ছেলের। ওই যে সদর ফটক লাগোয়া কৃষ্ণচূড়া, তার নিচেই পোঁতা হয়েছিল দুই ছেলের নাড়ি। দিলরুবা খাতুনের নির্দেশ, এই বন্ধন রাখা যাবে না। ছিঁড়তেই হবে। পারলে হয়তো পোঁতা নাড়ি দুটোও তুলে ফেলে দিতেন তিনি।

দুপুরের পর ঘটেছে ঘটনাটি। দুপুরের পর দিন খুব দ্রুত গড়ায়। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাতে পৌঁছায় পরবর্তী দিনের ডাকে। দুদিকে তাকায়, সারি সারি ঘরগুলো যেন শূন্যে ঝুলে আছে। বারো বছরের জীবনে একদিনও ঘরগুলো খুলতে দেখেনি মারিয়া। আজ সে ঘরগুলো হা করে খোলা। দরজা দিয়ে উপচে পড়ছে আলো, মøান কিন্তু অবাধ্য আলো। বারান্দা ডিঙিয়ে বাড়ির মাঝখানে লন পর্যন্ত এসেও যেন স্বস্তি নেই তার। সীমানা প্রাচীর ডিঙিয়ে পৌঁছে যেতে চায় পড়শিদের বাড়ি। বারো বছরে যে ঘরগুলোর ভেতরটা দেখতে পারেনি আজ সেগুলো দেখার তীব্র আগ্রহ হয়, কে জানে হয়তো এই আনন্দ নিকেতনে আর কোনো দিন আসা হবে না তার। কুমারী 888sport promo codeর অবৈধ সন্তানের মতো ইচ্ছাটাকে গলাটিপে হত্যা করে সে তৎক্ষণাৎ। এখন আর এই আগ্রহকে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখন আনন্দ নিকেতন ছেড়ে চলে যাওয়াই একমাত্র গন্তব্য মারিয়ার।

আজ দিলরুবা খাতুন যে আচরণ করছেন তা পুরোই অচেনা। দীর্ঘ এক যুগে দিনে-রাতে কাজে-অকাজে যে দিলরুবা খাতুনকে চেনা হয়েছে এ যেন সে নয়, অন্য কেউ। শান্ত সুস্থির। ভেবেচিন্তে কাজ করছেন, মোটেই উত্তপ্ত মস্তিষ্কে নয়। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে নয়। প্রথমে মারিয়াকে বলেছেন এই মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে। তারপর একে একে খুলে দিচ্ছেন আনন্দ নিকেতনের এক একটা কক্ষের দরোজা। আর তার থেকে ঠিকরে পড়া আলোয় আনন্দ নিকেতনের চোরাগোপ্তা আঁধার ভেঙে ভেঙে যাচ্ছে।

নূর বানু

আলীকে নিয়ে যখন বের হয় তার স্বামী, নূর বানু তখন বিস্মিত বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ঘটনাটির মর্ম 888sport app download apk latest version করতে চায়। কথা নেই বার্তা নেই বাড়ির ছোট ছেলেকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন তিনি! নূর বানু স্বামীকে ভয় পায়, সমীহ করে। ভয় আর সমীহের এই দেয়াল মানুষটি নিজেই তৈরি করে রেখেছে। নূর বানু চাইলেও ভাঙতে পারেনি। অনেকদিন বিছানায় মানুষটির উন্মত্ত মিলনের ঘোরে জানতে চেয়েছে, পুব পাড়ের বিথান থেকে চাষীদের সরাইয়া দিছেন কেন, কিংবা আপনে নাকি আরো দশটা গাই কিনতেছেন? নিজেকে নির্গত করে দেওয়ার যে মুহূর্তে পুরুষ সবচেয়ে দুর্বল তখনো সে হুঁশ হারায়নি। কণ্ঠ কঠোর করে বলেছে, সব জিনিস নিয়া মাইয়া মানুষের কথা বলা আমি পছন্দ করি না। স্বামীর মেজাজ বুঝে অনেক কিছুই মানতে না পারলেও চুপ করে থেকেছে নূর বানু। একমাত্র ননদ খায়রুন্নেছাকে যখন সতীনের ঘরে বিয়ে দেয়, নূর বানু কোনোভাবেই মানতে পারেনি। মানুষটাকে বলা বৃথা, তবু ভেতরের উদ্বিগ্নতা আর বেদনার নিয়ন্ত্রণহীনতায় অস্থির হয়ে খুব মিনমিন করে বলেছিল নূর বানু, এতো সুন্দর পরির মতো মাইয়াডারে সতীনের ঘরে দিতেছেন … আর কথা বাড়তে দেয়নি। ঠাস করে চড় মেরে ছিল নূর বানুর গালে।

আদর-আহ্লাদের সঙ্গে এরকম চড়-থাপ্পড় খেয়ে খেয়ে বাড়ির পোষা গরুটির মতোই অভ্যস্ত নূর বানু। তবু অব্যক্ত বেদনা তাকে বেয়াড়া করে দেয়। কখনো কখনো পরিস্থিতির বাস্তবতা আর ভবিষ্যতের ভয়াবহতার আশঙ্কায় সে কথা বলে ফেলে। শারীরিক নিগৃহীত হওয়ার বিষয়টি তার মনুষ্য জন্মের সার্থকতা প্রমাণ করার জন্যই হয়তো পোষা গাইয়ের মতো মুখে কুলুপ এঁটে চুপ থাকতে দেয় না। আলীকে নিয়ে বের হওয়ার সময় অজানা কোনো অন্তর্গত শক্তির উৎসে চিৎকার করে সে, ওরে নিয়া কই যান? দূরের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসার মতো প্রতিধ্বনিত হয় তার স্বামীর বার্তা। গঞ্জের মক্তবে থাকবে ও। হাফেজ হয়ে ওখানেই ইমামতি করবে। নূর বানু জানে, পৃথিবী নড়বে তবু নড়বে না তার স্বামীর সিদ্ধান্ত। নূর বানু জানে, আলী আর এই বাড়িতে ফিরবে না। তবু সর্বশক্তি দিয়ে অক্ষম চিৎকারে আপত্তিটা জানিয়ে রাখে নূর বানু, এতো বড় অন্যায় আপনি করতে পারেন না, বাপের ভিটা থেকে ছেলেরে তাড়াইয়া দিতে পারেন না। একটা লাথি নেমে আসে কোমর বরাবর। নূর বানু প্রচণ্ড ব্যথায় গোঙাতে থাকে ঘর আর বাইরের চৌকাঠে। শরীর আর মনের প্রবল যন্ত্রণা আলী আর তার স্বামীর চলে যাওয়ার ছায়ার সঙ্গে অসহায় দৃষ্টিতে মিশে যেতে থাকে, যতদূর দেখা যায় …।

দিলরুবা খাতুন

দিলরুবা খাতুন দাঁড়ায় ঘরটির ঠিক মাঝামাঝি। উঁচু সিলিং। কালো কালো কাঠের বরগা। পাকিস্তান আমলের একটা সিলিং ফ্যান, চারটা পাখা ডানা মেলে আছে কালের সাক্ষী অশ্বত্থ গাছের মতো। এখনো চালালে শীতল বাতাস দেয়। ঘরময় দেয়ালজুড়ে কেবল বই আর বই। ঘরের এক কোনায় কাঠের অনুচ্চ ডিভান। তার ওপর হারমোনিয়াম, তানপুরা, তবলা, বড় চাদর দিয়ে 888sport app, ওপরে ধুলোর পুরো স্তর। বহুকাল এই কক্ষে কেউ ঢোকেনি। দিলরুবা খাতুন নিজেও না। দিলরুবা খাতুন দেখেছেন এ-ঘরে একসময় সুবীর নন্দী আর তপন নন্দী
দু-ভাই আসতেন। নিয়মিত গানের আসর বসতো। তপন নন্দী গান ধরতো, ও ঘাটে জল আনিতে যেও না যেও না, ও ললিতে …, আর সুবীর নন্দী নীরব শ্রোতা। মান্না দে-র কণ্ঠ যেন খাঁজ কেটে বসানো তপন নন্দীর গলায়। শহরে সবাই তপন নন্দীকেই 888sport live chatী হিসেবে চিনতো। জানতো, শহর ছেড়ে রাজধানীমুখী হলে বড় 888sport live chatী হবে সে। অথচ দেশজুড়ে খ্যাতি পেল সুবীর নন্দী। আর তপনটা পাড়ি জমালো কানাডার কোনো এক নিভৃত ঠিকানায় …। এটা আবেদের ঘর, সৈয়দ আবেদুর রহমান। দিলরুবা খাতুনের মেজো দেবর। আবেদ বৈশাখ, নিজেই নিজের নাম রেখেছিল। খুব ভালো গানের গলা ছিল ওরও। শহরের নানা অনুষ্ঠানে ডাক পড়তো তারও। কণ্ঠের অদ্ভুত মাদকতায় শ্রোতাকে ডুবিয়ে গাইতো, আমি এতো যে তোমারে ভালোবেসেছি …। শ^শুরের মৃত্যুর পর কী হলো, পুরোদস্তুর ধার্মিক হয়ে গেল। তাবলিগ জামাতে যেত নিয়মিত। গানের সঙ্গে চিরবিচ্ছেদ। সেই যে ঢাকনা পড়লো হারমোনিয়াম, তবলা, তানপুরায় … আর ওঠেনি সে-ঢাকনা। ফেলেও দেয়নি ঘৃণা ভরে, বিক্রি করার মতো নির্দয়ও হতে পারেনি বোধহয়। হয়তো হৃদয়ের কোনো কোণে অচেনা কিছু মায়া ছিল সুর আর তালের সঙ্গে এক জীবন বসবাসের, যা কখনো জানা হয়নি দিলরুবা খাতুনের। তাবলিগে যেতে যেতে তারপর কোথায় হারিয়ে গেল একদিন, আর ফিরে এলো না আবেদ। শাশুড়ি তখনো বেঁচে। এক মাস, দুই মাস, এক বছর, দুই বছর … জলজ্যান্ত ছেলেটা নিখোঁজ। ফিরছে না। শাশুড়ির কোনো ভাবান্তর দেখলেন না দিলরুবা খাতুন। না শোক, না আক্ষেপ। ভারি অদ্ভুত লাগতো দিলরুবা খাতুনের। নিজের ভেতরে দলা পাকানো কষ্ট আর 888sport sign up bonus নিজেই পুরনো কাপড়ের মতো মায়ার ন্যাপথালিন দিয়ে যত্নে রেখে দিত সে। জন্মদায়িনী মা যেখানে নির্বিকার, সেখানে সে তো পরের মেয়ে। বাড়ির বউ। নেহায়েত কম বয়সে বউ হয়ে আনন্দ নিকেতনে এসেছিলেন বলে অনেকটা সময় কাটিয়েছেন এদের সঙ্গে। সময়ের পরতে পরতে জমেছে মায়া আর 888sport sign up bonusর মেদ। যে-মেদ জীবনের জন্য কখনো সুন্দর, কখনো বাহুল্য। আবেদকে ভাত বেড়ে খাওয়াতেন দিলরুবা খাতুন। ঘি আর পাটপাতার ভাজি – অদ্ভুত এই খাবারটা খুব পছন্দ ছিল আবেদের। এই বাড়িতে গলা ছেড়ে গান গেয়ে বাড়ির নিস্তব্ধতা ভাঙাতো আবেদ। এই দাবিতে আবেদের প্রসঙ্গ তুলে বেশি শোক দেখালে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি – প্রবাদটারই যথার্থতা মিলবে হয়তোবা।

মারিয়া

ততোক্ষণে খবরটি ছড়িয়ে গেছে বাতাসের বেগে। একজন দুজন থেকে দলে দল লোক আসতে থাকে আনন্দ নিকেতনমুখী। সবাই দুহাতে দুই ছেলেকে ধরে রাখা মারিয়াকে এ-সময় বের হওয়ার ফটকের সিঁড়িতে দেখে বিস্ময়ে তাকায়। দুয়েকজন দাঁড়ায় কয়েক সেকেন্ড, আবার দ্রুত পা চালিয়ে ভেতরে চলে যায়। মারিয়ার মুখের থমথমে অশ্রুসজল দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে কেউ কিচ্ছু বলে না, এখন বাড়ির সম্ভ্রম ভাঙা আর কৌতূহল লুকিয়ে রাখাই যে সামাজিক নিয়ম। মারিয়া ভাবে, এখানে বেশিক্ষণ থাকা উচিত হবে না, দ্রুত চলে যেতে হবে। যতই মানুষ বাড়বে, বাড়বে কৌতূহলী দৃষ্টি আর অযাচিত প্রশ্ন। দিলরুবা খাতুন এখনো দোতলায়, একটা একটা করে খুলে দিচ্ছেন প্রতিটি ঘরের দরজা। নিচে নেমে যদি দেখেন এখনো যায়নি মারিয়া, হয়তো সমাগত লোকজনের সামনেই অপমান করা শুরু করবেন। কিন্তু কোথায় যাবে মারিয়া?

আনন্দ নিকেতনে প্রথম যেদিন ঢুকেছিল সেদিন মারিয়া কল্পনাও করেনি এখান থেকে এভাবে বের হয়ে যেতে হবে। পেছন ফিরে আরো একবার আনন্দ নিকেতনের দিকে তাকায় মারিয়া। নতুন বউ হিসেবে বাসায় ঢুকেছিল সে, জীবনসঙ্গী শিহাব ছাড়া বাড়িতে তখন দুজন মানুষ। দুই ঘরে দুই বিধবা। এক ঘরে দিলরুবা খাতুন আরেক ঘরে তার শাশুড়ি, শিহাবের দাদি। দিলরুবা খাতুনের শাশুড়ি তখন একেবারে বিছানায়। দিলরুবা খাতুন নিয়ম করে পোশাক বদলান, বিছানার চাদর বদলান আর মলমূত্র মাখানো নেপি বদলে অন্য নেপি পরিয়ে দেন।

এই আনন্দ নিকেতনের গল্প নিজের মায়ের কাছেই শোনা মারিয়ার – জানিস জীবনে প্রথম ফ্রিজ দেখেছি আনন্দ নিকেতনে। সবুজ রঙের বাক্স। আমি ভাবলাম কী না কী। দেখি কী ভেতরে ঠান্ডা পানির বোতল। মা হাসতে হাসতে ভেঙে পড়তেন নিজের বোকামিতে। দিলরুবা খাতুনের বাসায় দেখার আগে ঠান্ডা পানির ফ্রিজ বলতে মা বুঝতেন ড্রামের মতো কিছু, যেখানে পানি জমিয়ে রাখলে ঠান্ডা থাকে। নিজের বোকামি মায়ের কাছেই হাস্যকর লাগে। শহরের একটাই অভিজাত বাড়ি – আনন্দ নিকেতন। মায়ের নাকি স্কুলে যেতে-আসতে পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটিকে মনে হতো টিনের বেড়ায় ঝুলে থাকা স্বপ্নের মতো কোনো ছবি। মফস্বল শহরে সব
ছন-বাঁশ-টিনের ভিড়ে আনন্দ নিকেতন সত্যি একটা স্বপ্নের ছবির মতো বাড়ি। মায়ের কাছেই শোনা ব্রিটিশ আমলে শহরতলির আদি বাড়িতে কাপড়ের কল বসিয়ে কাপড় বুনে ধনী হয়েছেন শিহাবের পূর্বপুরুষদের কেউ একজন। কলকাতা বাজারে যেত সে-কাপড়। নদীপথে আজমিরীগঞ্জ হয়ে ভৈরব বাজার, লঞ্চে সেখান থেকে সরাসরি কলকাতা। শৌখিন মানুষ তারা, ব্রিটিশ আমলেই বাড়িটা বানিয়েছিলেন কোনো এক পূর্বপুরুষ। কোন কোন দেশ থেকে যেন সব ফিটিংস আর ইন্টেরিয়র আনিয়েছিলেন। মায়ের মুখে শোনা গল্প তলিয়ে খুঁটিনাটি জানতে চায়নি কোনোদিন মারিয়া। কেবল শুনেই গেছে। শুনতে শুনতে টের পেত বাড়িটির জন্য মায়েরও অসীম মোহ কিংবা অতুল্য মায়া রয়েছে। মারিয়া তো আর তখন জানতো না এ-বাড়িতেই তারও নিয়তি বাঁধা।

কত গল্পই যে করতেন মা, মায়ের জীবনের প্রথম

টিভি-ভিসিআর দেখাও নাকি দিলরুবা খাতুনের বাড়িতে। দিলরুবা খাতুনের বাড়ি মানে আনন্দ নিকেতন। দিলরুবা খাতুনের বিয়ে হওয়ার আগে পর্যন্ত তো ওই বাড়িতে প্রবেশাধিকার ছিল না। ওই বাড়ির ছেলের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন দিলরুবা খাতুন। মায়ের প্রাণের সখী। শহরে যেখানে পাড়ায় পাড়ায় টিনের ছাউনি সেখানে এমন তিনতলা আনন্দ নিকেতন, বংশানুক্রমিক নামকরা কাপড়ের ব্যবসা। সেই পরিবারের বড় ছেলে সৈয়দ মাহবুব-এ-আলম তখন কলেজ

পড়ুয়া। আর দিলরুবা খাতুন দশম শ্রেণির ছাত্রী। কী

উথাল-পাতাল প্রেম দুজনের। চিঠিতে চিঠিতে। আর স্কুল কলেজ প্রাইভেট স্যারের কাছে যেতে-আসতে রিকশা সাইকেলে। তখন তো আর হাতে হাতে মোবাইল, ফেসবুক কিংবা বন্ধুর বাড়ি ডেটিং ছিল না। একটুখানি চোখে চোখ আর না ছুঁয়েও পাশাপাশি চলার মধ্যেই নদীর পাড় ভাঙার তোলপাড় থাকতো। মফস্বল শহরগুলোতে এসব প্রেম তখন মুখে মুখে ফিরতো। কীভাবে কীভাবে সবাই জেনে ফেলতো। সার্ক গঠনের রাজনীতি নয়, তারকা যুদ্ধের বিশ^ পরিস্থিতি নয়, কী করে যেন এসব প্রেমের গল্পই হয়ে উঠতো শহরের মূল আলোচনার বিষয়।

দিলরুবা খাতুনের শাশুড়ির কানও বা বাকি থাকে কেন? তখনো দিলরুবা খাতুনের শাশুড়ি হননি তিনি। তীব্র অহংকার তার। রূপের নাকি বংশ গৌরবের, নাকি টাকার ঠিক জানে না দিলরুবা খাতুন। পাড়ার মেয়ে দিলরুবা খাতুনকে কখনোই মানবেন না বউ হিসেবে। আগপিছ ভাবার মতো পরিণত বোধবুদ্ধি কই তখন, উন্মত্ত বয়সে পালিয়ে বিয়ে করে ফেললো দুজন।

মারিয়ার মায়েরা ততোদিনে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে একই শহরে কলেজছাত্রী। স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে মিছিল করেন আর কলেজ ফাঁকি দিয়ে আর একমাত্র বিয়ে হওয়া বান্ধবী দিলরুবা খাতুনের বাসায় লুকিয়ে সাত পাকে বাঁধা আর হারানো সুর দেখেন। দিলরুবা খাতুন বান্ধবীদের কোল্ড ড্রিংকস আর কেক খাওয়ান। মফস্বলে কারো বাড়ি গেলে নাবিস্কো বিস্কুট আর চাই যেখানে অমূল্য জুটতো আপ্যায়নে, সেখানে এই কোক আর কেকই তো ছিল রাজকীয় আপ্যায়ন। শহরের একমাত্র বেকারি রহমানিয়া বেকারির তৈরি কেক কিনে খাওয়ার সামর্থ্য কয়জনেরই বা ছিল তখন!

শিহাবের সঙ্গে প্রেম আর বিয়ের কথা বললে মারিয়া প্রথম ধাক্কাটা খেয়ে ছিল মায়ের কাছেই। জন্মের পর থেকে মারিয়া দেখে এসেছে মা সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা-সংকট সব জানাতেন একমাত্র বন্ধু দিলরুবা খাতুনকেই। বিয়ে হয়ে চলে এসেছেন 888sport appয়। তবু নিজ শহরে গেলে দিলরুবা খাতুনকে না দেখে ফিরতেন না মারিয়ার মা। দিস্তা দিস্তা চিঠি লিখতেন দু-বান্ধবী। অথচ দিলরুবা খাতুনের ছেলে শিহাবের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কটা শুনে তিনি এমন অবিশ^াস্য প্রতিক্রিয়া দেখালেন যে মারিয়ার মনে হলো, এ সারাদিন আনন্দ নিকেতনের গল্প করা মা নয়, অন্য কেউ। মারিয়ার মা কোনেভাবেই মেনে নেবেন না সম্পর্কটা। কেন? কী কারণে? কীসের জন্য? অনেক বিস্ময় আর কৌতূহলের উত্তরে শুধু একটাই কথা বলেছিলেন মারিয়ার মা, দুই ঘরে দুই বিধবা। সেই বাড়িতে আবার তুই যাবি আবার বিধবা হতে?

আসলে এই উত্তরে প্রশ্নের সমাধান হয় না, প্রশ্ন আরো বাড়ে। সব সংস্কার ভাঙার বয়স তখন। 888sport promo codeবাদের তরঙ্গ নিয়ে ভাবে মারিয়া, ওর কাছে এটা কোনো কারণ হতে পারে? দাদাশ্বশুর মারা গেছেন, শ্বশুরও নেই। শিহাবকে বিয়ে না করার এটা কোনো কারণ হতে পারে মা? মারিয়ার মা প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয় না। বরং শিহাবসহ শিহাবের আম্মুর সঙ্গে যোগাযোগটাই বন্ধ করে দেয়।

নতুন বউ হয়ে বাড়িতে ঢোকামাত্র দিলরুবা খাতুনের শাশুড়ি বলে ওঠেন মারিয়াকে, কেন আইছিস এই বাড়িতে – মরতে, না মারতে? দিলরুবা খাতুনকেও নাকি এভাবেই আক্রমণ করেছিলেন তার শাশুড়ি। পালিয়ে বিয়ে করে আনন্দ নিকেতনে আসার পর। শিহাব সান্ত্বনা দিয়েছিল নতুন বউ মারিয়াকে।

দিলরুবা খাতুন

দিলরুবা খাতুন সব শেষ ঘরের তালাটা খুলে দেন। পূর্ব দিকের দেয়ালে ঘরে মার্কস, লেনিন আর দক্ষিণে জানালার পাশে কমরেড ফরহাদের পোস্টার। এক কোণে গালে হাত দিয়ে সুকান্ত। ঘরটা হাবিবুরের। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর গণতান্ত্রিক 888sport appsে দু-পক্ষের বন্দুকযুদ্ধ লেগেই থাকতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের দুপক্ষের লড়াইয়ে ক্রসফায়ারে মারা গিয়েছিল হাবিবুর। সেবারও শাশুড়ির কোনো ভাবান্তর দেখেননি দিলরুবা খাতুন। দিলরুবা খাতুনের কৌতূহল এবার আর বাঁধ মানে না। কফিনবন্দি হাবিবুরের মৃতদেহ এলো শহরে। সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়িভর্তি ছাত্র। শহরের মানুষ বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো উপচে পড়লো বাড়িতে। শহরে হাবিব হত্যার বিচার চেয়ে মুহুর্মুহু মিছিল হলো। দলে দলে 888sport promo codeরাও যেতে থাকলো অন্দরে। কিন্তু তার শাশুড়ি নির্বিকার বসে ছিলেন বিছানায়। সবার দিকে পেছন দিয়ে, মাথা নুইয়ে, হাতে তসবি নিয়ে। কেউ না জানলেও দিলরুবা খাতুন জানতেন এক ফোঁটা অশ্রু ফেলছেন না তিনি পুত্রশোকে। দিলরুবা খাতুন আর সামলে রাখতে পারলেন না নিজের বিস্মিত কৌতূহল। প্রথমে তিনি পড়লেন স্বামী মাহবুবের কাছে। দু-দুটো ছেলে মারা গেল চোখের সামনে অথচ তাদের মা নির্বিকার। হাবিবুরের দাফন-কাফন শেষ হয়ে যাওয়ার পর তিনি মাহবুবকে চেপে ধরলেন, দুটো ছেলে মারা গেল চোখের সামনে। তোমার মা এমন নির্বিকার কেন? পুত্রশোকে কাঁদে না পর্যন্ত – এমন মানুষ তো আমি জীবনে দেখিনি। উত্তর না দিয়ে মাহবুবের বিব্রত পালিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো কিছু লুকানোর গন্ধ ঠিকই পেল দিলরুবা খাতুন। আজ তার জানতেই হবে, কেমন মহিলা তিনি, কেন তিনি পুত্রশোকেও কাঁদেন না? সারাদিনের সব শোকার্ত আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে শেষ মানুষটিও চলে গেলে শাশুড়ির ঘরে ঢুকলেন দিলরুবা খাতুন। দরজা বন্ধ করলেন। আজ জানতেই হবে ছেলের মৃত্যুতে কাঁদেন না কেন তিনি!

নূর বানু

দোকান কর্মচারীর মেয়ে নিশিচানকে বিয়ে করে বাড়ির ফটক ডিঙিয়ে ভেতরে ঢুকতে পারেনি ওসমান। ফটকের সামনেই লাঠিসোঁটাসহ দাঁড়িয়েছিল অনুগত লাঠিয়াল চাষিরা। নিশিচানকে খুব পছন্দ ছিল নূর বানুর। গড়পরতা মেয়েদের চেয়ে লম্বা সবার মাঝে উঁচু গম্বুজের মতো দৃষ্টি কাড়ে। মাজা গায়ের রং। কিন্তু কী চকচকে! পিঠজুড়ে ঘরের চালার ছনের মতো তল না মেলা মেলে থাকে ঘন চুল। চটপটে মধ্যমণি অন্দরের, সবাইকে মাতিয়ে রাখে কাজের ফাঁকে, ক্লান্ত হতে দেয় না। সবচেয়ে বড় কথা অদ্ভুত গানের গলা। অবসর সন্ধ্যায় অন্দরের বারান্দায়
বউ-ঝিদের আসরে নিশিচানের উপস্থিতি ছিল আবশ্যিক। রাধারমণ গাইতো নিশিচান, ভাইবে রাধারমণ বলে, শোনরে কালিয়া …। ওর গানের সুর অন্দরের দেয়াল ভেদ করে সদর, কাছারি পেরিয়ে কখন যে ওসমানের দিলে গিয়ে বিঁধেছে টের পায়নি নূর বানু। ওসমান কবুল করে ঘরে নিয়ে এলে কী এমন ক্ষতি? না কোনোভাবেই মানবে না নূর বানুর স্বামী। দোকান কর্মচারীর মেয়ে হবে বাড়ির বউ, সম্ভবত ভূমিকম্পে বাড়ি ধসে পড়ার ভয়াবহ সম্ভাবনা তৈরি হয় – এমন ভাব করে তিনি মানতে অস্বীকার করলেন। তাকে কিছু বলা বৃথা। তবু অন্দরে একবার পান খাওয়ার জন্য ঢুকলে নূর বানু, তীব্র গন্ধের ভেজা কাঁচা সুপারি আর মাথায় ঝিম লাগিয়ে দেওয়া সাদা পাতা পানের ভেতরে ঢুকিয়ে ভাঁজ করতে করতে মিনমিন করে বলেছিলেন, কবুল পড়া বউ। না খেদাইলে হয় না? নূর বানু জানতেন লাভ নেই, তবু নিজের বিবেক দংশনের জ্বালা অসহ্য হয়ে উঠলে ভয়-ডর, সমীহ-সম্ভ্রম তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। সদর ফটক থেকেই বিদায় করে দিলেন ওসমান আর নিশিচানকে। এটুকু মানতে পেরেছিলেন নূর বানু। কিন্তু যেদিন ঘুম থেকে উঠে শুনলেন রাতে রাস্তায় ডাকাতদলের হামলায় প্রাণ গেছে ওসমানের, লাশ পড়ে আছে তেপথের মোড়ে তার সন্দেহ বিশ্বাসে পরিণত হলে তিনি শেষবারের মতো বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। রাতে ঘরে ঘরে গভীর ঘুমের নিশ^াস অচেতনের মতো গভীর হলে, ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকা নূর বানু মশারির বাইরে এসে নিজেরও অচেনা রূপে দাঁড়ালো স্বামীর সামনে। কুচকুচে কালো মেহগনি কাঠের চেয়ারের হাতলে লেগে ঠিকরে পড়ছে হারিকেনের চকচকে চিমনি ভেদ করা আলো। চেয়ারে বসে থাকা স্বামীর হাত থেকে হুঁক্কার নল কেড়ে নিয়ে ছুড়ে মারলেন নূর বানু, সারা ঘরে ছিটকে পড়লো আগুনের হল্কা, ছাই, জল …, ওসমানরে আপনি মারাইছেন? ধানসিদ্ধ করা চুলার হা করা গনগনে আগুনের মতো মুখ নিয়ে এক ধাক্কায় সিন্দুকের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন নূর বানুকে। কোমর ভেঙে গিয়েছিল নূর বানুর। আর দাঁড়াতে পারেননি কোমর তুলে।

মারিয়া

আনন্দ নিকেতন বাড়িটার প্রতি মায়ের বিশেষ আকর্ষণ ছিল। ফেসবুকে নানা পুরনো নতুন বাড়ির ছবি দেখালে মা কেবলই বলতেন আনন্দ নিকেতনের কথা। সেই আনন্দ নিকেতনের ছেলে শিহাবের সঙ্গে মারিয়ার আরো আগেই পরিচয় হতে পারতো। অথচ হলো ফেসবুকে, কাকতালীয় একেবারেই। মায়ের আনন্দ নিকেতনপ্রীতি নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিল মারিয়া। মেসেঞ্জারে এসে নক করেছিল শিহাব। মায়ের জানে জিগরি বন্ধু দিলরুবা খাতুন। দিলরুবা খাতুনের ছেলে শিহাব। একই বিশ^বিদ্যালয়ের সায়েন্স ফ্যাকাল্টির ছাত্র। একথা সেকথায় সম্পর্কটা হয়ে গেল। মা আপত্তি করতে পারে এমনটি ভাবনাতেই ছিল না মারিয়ার। মারিয়ার বাবা যদিও বা গররাজি ছিল – মা কোনোভাবেই শিহাব-মারিয়ার সম্পর্কটা মেনে নিচ্ছিল না যখন তখন মারিয়া আশা ছেড়েই দিয়েছিল। ঘরে ওর পরে আরো তিন-তিনজন বোন। পালিয়ে বিয়ে করলে বাকি বোনদের মেনে নেওয়ার মতো সামাজিক উদারতা তখনো তৈরি হয়নি সমাজে। বাবা-মায়ের পছন্দতে বিয়ে করে ফেলবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর শেষ আশা হিসেবে বড় মামাকেও ডেকেছিল মারিয়া। বড় মামাকে অনেকটা ঈশ্বরের মতো মানে মা। বড় মামাকে অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে-পড়িয়ে নিয়ে আসে মারিয়া। মামা তো মহাখুশি। দিলরুবার ছেলে শিহাব, আরে তোর মা রাজি হবে না মানে! বড় মামা বোঝাতে এসে নিজেই কী বুঝে চলে গেলেন আর বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন না। কয়েকবার বড় মামাকে নক করেছে মারিয়া। উত্তর না পেয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিল মারিয়া। নিজের সুখের জন্য বাকি বোনদের বিপদে ফেলার মতো স্বার্থপর সে হতে পারবে না কোনোভাবেই।

তখন ভরসা দিয়েছিল শিহাব। তার আম্মু দিলরুবা খাতুনের মতো উদার মহিলা ত্রিভুবনে নেই। তিনি একবার বললে মারিয়ার মা না করতেই পারবেন না। ভাবা যায়, কত আগেই তিনি প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করেছিলেন আব্বুকে! আবার আব্বু মারা যাওয়ার পর তিন ভাইকে বাবা-মা দুজনের স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন তিনি। তিনি সাদরে মেনে নেবেন মারিয়াকে। কিচ্ছু ভাবনা নেই। খুব প্রত্যাশা আর ভরসার শক্তপোক্ত পথ ধরে শিহাব একবার মারিয়াকে নিয়ে গেল আনন্দ নিকেতনে। দিলরুবা খাতুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে বলে।

হবু শাশুড়ি হিসেবে শিহাবের আম্মু দিলরুবা খাতুনের সঙ্গে আশার প্রচণ্ড উত্তাপ নিয়ে দেখা করতে গিয়ে উপচানো ডাল পড়ে নিভে যাওয়া চুলার মতো চুপসে যায় মারিয়া। নতুন ধরনের এক মহিলাকে দেখছে সে? এমনতর মহিলা হতে পারে সে জীবনে দেখেওনি, শোনেওনি, কল্পনা তো করেইনি। এখন সামনে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছে না কোনো মহিলা এভাবে বলতে পারে। মরে গেলেও আমার ছেলেকে বিয়ে করো না, করো না। খুব বদমেজাজি আর রগচটা ছেলে শিহাব। রাগ উঠলে ঘরের কিচ্ছু আস্ত রাখে না। আমি মা বলে সহ্য করি, তুমি পারবে না। একদম মারা যাবে। সাবধান বিয়ে করো না এ-ছেলেকে। নিজের ছেলেকে এভাবে মন্দ বলতে পারে কেউ! মারিয়া থ মেরে যায়।

 এই মহিলার অনেক গল্প শুনেছে শিহাবের কাছে। অনেক গল্প মানে শিহাবের কাছে দিলরুবা খাতুন ছাড়া কোনো গল্প নেই। আব্বু মারা যাওয়ার পর কী করে শুধু কর্মচারী দিয়ে দোকানটা টিকিয়ে রেখেছে দিলরুবা খাতুন, প্রতিদিন সব কাজ সেরে গভীর রাত পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন হিসাবের খাতা। কর্মচারীদের কেউ না কেউ প্রতিদিন লাল সালু কাপড়ে বেঁধে রাতে দিয়ে যেত আবার সকালে নিয়ে যেত। প্রতি মাসে একবার দোকানে যেত স্টক মেলাতে। শুধু টিকিয়ে রাখা নয়, অতীতের সব সুনাম, অর্জন আর আয় অক্ষুণ্ন রেখে। ছেলেদের পড়াশোনা করিয়েছেন। সংসারের ঝামেলার আগুন দূরে থাক, আঁচটুকু লাগতে দেননি। শিহাবের কাছে গল্প মানে সুযোগ পেলেই দিলরুবা খাতুন। মারিয়ার একসময় মনে হতো, এ যেন ইডিপাস কমপ্লেক্স।

সেদিনও খুব বড় মুখ করে দিলরুবা খাতুনের কাছে মারিয়াকে নিয়ে এসেছিল শিহাব। আর কেউ না হোক পৃথিবীতে একটা মানুষই মারিয়া আর শিহাবকে মেনে নেবে – সে দিলরুবা খাতুন। শিহাবের আম্মু। বারবার জানতে চেয়েছিল, কী বললেন আম্মু? চুপ করেছিল মারিয়া। কী বললো সে তো আর বলা যায় না শিহাবকে।

বিয়ের পর আনন্দ নিকেতনে চলে আসার পর দিলরুবা খাতুন একদিনও ভালো করে কথা বলেননি। অথচ ছেলের সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক তার। মারিয়া অবাক হয়। বিয়ে না করার জন্য ছেলে সম্পর্কে কত আজেবাজে কথা বললেন দিলরুবা খাতুন এখন মনে হচ্ছে মারিয়াই শত্রু, ছেলে নয়। হিসাব মেলাতে পারছিল না মারিয়া। ছেলে সম্পর্কে যা যা বলেছিলেন, বাস্তবে তার একটাও নেই শিহাবের। অসম্ভব ধৈর্য আর দায়িত্বশীল ছেলে শিহাব, ঠিক যেমনটি চেয়েছিল মারিয়া। তবে দিলরুবা খাতুন এমনভাবে কেন বলেছিলেন? তিনিও কি চাননি মারিয়া আর শিহাবের বিয়েটা হোক। কেন চাননি?

বিয়ের পর শিহাবের সঙ্গে আনন্দ নিকেতন ঘুরেফিরে দেখছিল মারিয়া। মায়ের কাছে এত গল্প শুনেছে বাড়িটার তা কেবল দু-তিনটি ঘরেই সীমাবদ্ধ। কতগুলো ঘর এই আনন্দ নিকেতনে – মারিয়া গুনে শেষ করতে পারে না। দোতলায় এ-মাথা থেকে ও-মাথা যাওয়ার করিডোর। দু-পাশে এ-মাথা ও-মাথা ঘরের পরে ঘর। একদিন শিহাবের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখছিল মারিয়া। দেখা যেন শেষ হয় না। ঘরগুলো খুলে দেখার ইচ্ছা ছিল মারিয়ার। কিন্তু দেখা নিষেধ। শিহাব বন্ধ ঘরটাই আঙুল তুলে দেখায়। এই ঘরটায় থাকতো রিহান, শিহাবের ছোট ভাই। এখন নাই। 888sport app থেকে ফেরার সময় গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে রিহান। শিহাব ফিসফিস করে কথা বলতো যেন দিলরুবা খাতুন শুনতে না পায়।

মারিয়ার প্রথম ছেলের জন্মের পর কোনো আনন্দ অনুষ্ঠান হয়নি শিহাবদের পরিবারে। বিয়ের বছর না ঘুরতেই বাচ্চা। নতুন বউয়ের প্রচলিত গন্ধ তখনো যায়নি গা থেকে। চুপ করে ছিল মারিয়া। কিন্তু দ্বিতীয় ছেলের জন্মের পর আর চুপ করে থাকতে ইচ্ছে করলো না। যদিও ততোদিনে দিলরুবা খাতুনের সঙ্গে সহজ-স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি মারিয়ার। শিহাবও আম্মুর অনুমতি ছাড়া কিচ্ছু করবে না। আবার আম্মুকে মুখ ফুটে বলার সাহসও নেই তার। তার এক কথা, করার হলে আম্মু নিজেই বলতো। অনেক ভেবেচিন্তে নিজেই সাহস সঞ্চিত করে দিলরুবা খাতুনকে একবার বলেই ফেলে মারিয়া, মা দুই দুইটা নাতি হলো আপনার। একজনেরও আকিকা করলেন না। এতো নামধাম টাকা-পয়সা দিয়ে কী করবেন মা? কথার ঝাঁঝে ভেতরের রাগ গোপন করতে পারলো না মারিয়া। দিলরুবা খাতুন কী জানি কী বুঝলেন, তীব্র ঝাঁঝে তিনিও উত্তর দেন, তুই বাচ্চাগুলারে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে পারবি? আমি অনেক টাকা দেব। তুই শখ মিটিয়ে আকিকা জন্মদিন সব করতে পারবি।

বলে কি মহিলা! এ যেন বাংলা সিনেমার ডায়ালগ! এই নাও ব্ল্যাংক চেক, টাকার অংক বসিয়ে নিও। চৌধুরী সাহেব, আমরা গরিব হতে পারি …। মহিলা কি এখনো মারিয়াকে মেনে নিতে পারেনি? কেন? সারাজীবন গণিতে এ-প্লাস পাওয়া ছাত্রী মারিয়া হিসাব মেলাতে পারে না।

 এই ঘটনার ঠিক দুদিন পর খবর আসে শিহাবের মেজো ভাই নেহার ফিলাডেলফিয়ায় মারা গেছে হঠাৎ স্ট্রোক করে। অদ্ভুত নীরবতায় দিলরুবা খাতুন খবরটা শোনে। তার তিন ছেলের মধ্যে তখন কেবল শিহাবই বেঁচে। আমেরিকার সঙ্গে কথা বলে শিহাব। নেহারের ডেডবডি দেশে আনার ব্যাপারে মোটেই আগ্রহ দেখায় না দিলরুবা খাতুন।

বরং তারপর থেকেই দিলরুবা খাতুন কেবল মারিয়ার ওপর চাপ দিতে থাকে শিহাবকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য। এ কেমন মা? বউকে সারাদিন ফুসলায় ছেলেকে ডিভোর্স দেওয়ার জন্য। অথচ শিহাবের সঙ্গে কোনো দ্বন্দ্ব, মনোমালিন্য নেই মারিয়ার। কেন শিহাবকে ডিভোর্স দেবে সে? শিহাবকে জানিয়েও কোনো সমাধান পায় না মারিয়া। চুপ করে থাকে শিহাব। মারিয়া বোঝে সারাজীবন এত গর্ব করে দিলরুবা খাতুনের গল্প করেছে সে মারিয়ার সঙ্গে, ওর তো এখন উত্তর দেওয়ার মতো মুখ নেই।

মাঝেমধ্যে উড়ো খবর আসতো কানে। ব্যবসায় অনেক টাকা ঋণ হয়ে গেছে শিহাবের। দোকান কর্মচারীরা বাসায় এলে বলতো। পাওনাদারদের যন্ত্রণায় দোকানে বসা মুশকিল। ওরাই খবর দেয় – এই আনন্দ নিকেতনও নাকি ব্যাংকে বন্ধক রাখা। কিস্তি বাদ পড়েছে অনেকদিন। যে কোনো দিন দখল নিতে আসবে ব্যাংক। শিহাবকে জিজ্ঞেস করলে বলতো, আরে ধুর! ব্যবসা করতে গেলে এসব কত হয়। ওসব নিয়ে তুমি মাথা ঘামিও না তো। আমাদের চার পুরুষের ভিটা। আমি কি এত অবিবেচক। এভাবে বিশ্বস্ততার চাদরে মুড়িয়ে রেখে রেখে আজ হঠাৎ কথা নাই বার্তা নাই গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়লো শিহাব।

শিহাবের মৃতদেহটা তখনো ঝুলছে। কয়েকজন চেয়ারের ওপর টুল বসিয়ে নামানোর আয়োজন করছে, তখন দিলরুবা খাতুন সব উপেক্ষা করে পড়লেন মারিয়াকে নিয়ে, ছেলেগুলা কই? যা, যা বাড়ি থেকে ভাগ, এক্ষুনি ভাগ!

শিহাবের মৃতদেহটা বিছানায় শুইয়ে দিলে মারিয়া এক কাপড়ে দুই বাচ্চা নিয়ে বের হয়ে যায় নিজের ঘর থেকে। বারোটি বছর ধরে তিল তিল করে সাজানো ঘর। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে তোলা দুজনের ছবি, বাচ্চাদের হামাগুড়ি দেওয়া ছবি। ক্লজেটভর্তি কাপড়। এপ্লিকের চাদর, ব্লকের পর্দা। আড়ংয়ের শোপিস। ঘর কি কেবল ঘর। কোনায় কোনায় তিল তিল স্বপ্ন, রুচি আর 888sport sign up bonus।

সারা বাড়ি ভরে গেছে মানুষে। সন্ধ্যা তখন মধ্যরাতে। মানুষের ভিড়ে মিশে লোকের চোখ এড়িয়ে মারিয়া উঠে দাঁড়ায়। চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে হঠাৎ একটা হাত পড়ে কাঁধে। দিলরুবা খাতুন। আরো কাছে এসে
দু-কাঁধে দু-হাত রাখেন। আমাকে নিবি না বউ? এই মৃত্যুপুরীতে আমাকে একা রেখে যাবি? ভালো হয়েছে বাড়িটা এবার ব্যাংক নিয়ে নেবে। আমি আর তুই কোথাও বাসা ভাড়া করে থেকে যাবো। এই বাচ্চাগুলো এবার বাঁচবে দেখিস। আনন্দ নিকেতন আর আমাদের নেই তো। আমরা এখন আনন্দ নিকেতনের কেউ না। আমার শাশুড়ি বলেছিলেন, তার শ^শুর আনন্দ নিকেতন একা ভোগ করার জন্য সব ভাইকে নানা ফন্দি-ফিকির করে এক এক করে বের করেছেন বাড়ি থেকে। আমার শাশুড়ি অনেক বাধা দিয়েছেন, শোনেননি তিনি। শাশুড়ির গায়ে হাতও তুলেছেন বারবার, শাশুড়ি পঙ্গু হয়েছেন। তবু আনন্দ নিকেতনের লোভ ছাড়তে পারেননি। আমার শাশুড়ি বলেছেন, তিনি জানতেন – এই বাড়ি বংশের কেউ ভোগ করতে পারবে না। কাউকে ঠকিয়ে কেউ পার পায় না। আমার শাশুড়ির তিন ছেলে মরেছে চোখের সামনে, এটাই নিয়তি, নির্বিকার মেনে নিয়েছেন তিনি। আমার তিন ছেলে মরেছে আমার চোখের সামনে। আমিও নিয়তি মেনে নিয়েছি। এবার তুই আর আমি চল পালাই, শিগগির পালাই। তোর ছেলেদের বাঁচাই। আনন্দ নিকেতনে অভিশাপ আছে। খুব ভালো হয়েছে আনন্দ নিকেতন আমাদের ছেড়ে গেছে।

মারিয়া ভাবে, দোষ আসলে কার? আনন্দ নিকেতনের, না অন্য কিছুর?