গল্পের জগৎ

সৈয়দ শামসুল হক

 

গল্পের জগৎ সে কেমন? তার কাঠকুটোই কী বা তার হয়ে ওঠাটাই বা কেমন? আরো জিজ্ঞাসা – চারপাশের জগৎ যা চোখে দেখছি, ছুঁয়ে দেখছি, ঘেঁটে দেখছি, যার জন্যে এত মাথা কুটছি, এই যে জন্ম এবং জীবন, সুখদুঃখময় এই জগতের সঙ্গে গল্পের জগতের সম্বন্ধটাই বা কী? নাকি কোনো সম্পর্ক সম্বন্ধই নেই? – যেমন নেই রূপকথার সঙ্গে বাস্তব জীবনের; বাস্তবে পাতালপুরী কই? ঘুমিয়ে থাকা রাজকন্যা কই? – অথবা যেমন হালের জাদুবাস্তবতার গল্প, যেখানে কংকালেও কথা কয় অথচ বাস্তবের কংকাল বড়জোর মেডিক্যাল শিক্ষার্থীদের সমুখে নীরব পাঠ দেয় মাত্র! কিন্তু রূপকথার ভেতরে মানব-জীবনের সারকথাও তো

উঁকি দেয়! এরই সম্প্রসারণে জাদুবাস্তবতার গল্পের শেকড়েও কর্কট বাস্তবতা লক্ষ করা যায় নাকি?

পাঠকের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয়, 888sport live footballের অনুষ্ঠানে যাই, সমালোচকদের বক্তৃতা শুনি, এমন একটা ধারণা পাই, এ ব্যাপারে তাঁদেরও কোনো স্পষ্ট দিশা নেই। পাঠক গল্প পড়েন, কাঁদেন হাসেন, ভুলে যান, আবার আরেক গল্পে প্রবেশ করেন। সমালোচক গল্প নিয়ে কাটাছেঁড়া করেন। কাউকে তিনি জীবনের বিশ্বস্ত নিপুণ রূপকার খ্যাতি দেন, কাউকে কথাপ্রহারে জর্জরিত করেন যে, নাহ্ কিচ্ছু হয়নি! কিন্তু বাস্তব জগতের সঙ্গে গল্পের জগতের সম্বন্ধ প্রকৃতিটির নির্ণয় কারুরই কথায় পাই না।

এতকাল লিখতে লিখতে বয়সের এই প্রান্তে পৌঁছে এখন আমার স্থির মনে হয়, পাঠকের বা সমালোচকের দায় নয় এই সম্বন্ধের রূপটিকে জানা, না-জানলে তাদের কোনোই ক্ষতি নেই, কিন্তু এটা জানা অত্যন্ত জরুরি লেখকের জন্যে। জানতেই হয়, যদি গল্পলেখক হিসেবে থাকে তাঁদের উচ্চাশা। লেখক অনেকে লিখতে লিখতেই জেনে যান স্পষ্ট করে, অথবা কলমের কালি কিনা রক্তেরই বোধ – ভেতরে, অনেকেরই আবার হাতড়ে ফেরা। যদি নবীন কেউ শুরুতেই এ বিষয়ে পাঠ পেয়ে যান, তাহলে আমার মতো এতগুলো বছর নষ্ট কষ্ট করতে হয় না গল্পের জগৎ আর  বাস্তব জগতের সম্বন্ধটি নিয়ে।

সেই যে কলম হাতে শুরু করেছিলাম একদিন, গল্প লিখছিলাম কোনোটি শহর কোনোটি গ্রামের পটভূমিতে, ক্রমে গ্রামই ব্যবহার করছিলাম অধিক। এক সময়ে লক্ষ করি, একেকটি গল্পের জন্যে নতুন করে একেকটি গ্রাম আমাকে রচনা করে নিতে হচ্ছে। এক সময় ভাবি, কী হয় যদি একটি এলাকাই কল্পনা করে উঠি – ছোট একটি শহর, তার চারপাশে গ্রাম, গ্রামের পর গ্রাম, নদী একটি?

কুড়িগ্রামে জন্ম নিয়েছিলাম, জন্মের সময় কুড়িগ্রামটি যে গ্রামের মতোই ছিলো, তাকে কাঠামো করে, আরো কত কী যোগ করি তার মানচিত্রে যা সেখানে নেই – যেমন বাবা কুতুবুদ্দিনের মাজার – আমার বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ 888sport alternative linkে তো বটেই, আরো কত গল্পে বারবার এসেছে এই মাজার, যেমন মান্দারবাড়িতে রাজা প্রতাপের উৎসন্ন হয়ে যাওয়া রাজবাড়ি, আমার অন্তর্গত কথাকাব্যে প্রথম এটি উঠে আসে। কল্পনার এই মানচিত্র নির্মাণের শুরুটা উনিশশো চুয়াত্তর সালে, তখন লন্ডনে বসে দ্বিতীয় দিনের কাহিনী লিখতে লিখতে আমি যে আমার গল্প-888sport alternative linkের পটভূমি হিসেবে আস্ত একটা জনপদই গড়ে তুলি, নাম দিই জলেশ^রী। পাঠকেরা এখন এটিকে আমার গল্পের জগৎ বলেন।

গল্পের জগৎ তবে কি শুধুই একটি কল্পিত জনপদ? আর, মানুষগুলো? তারা কি বাইরের? বাস্তবেরও কিংবা কি অধিক বাস্তবেরই কি নয়? তাই যদি হয়, তবে গল্পের জগৎ আর বাস্তবের জগৎ, এ-দুয়ের ভেতরে কোনো সংঘাত আছে কি? সংঘাত নয় সংশ্লেষই যদি, তবে তার রূপটিই বা কেমন?

গল্প লেখার শুরুর সময়ে, সেই উনিশশো বাহান্ন তেপান্ন সালে, আমার কোনো ধারণাই ছিলো না গল্পের জগৎ সম্পর্কে। তখন পর্যন্ত গল্পের করণকৌশল বিন্দুমাত্র জানতাম না। ভাষা তো পাওয়াই ছিলো প্রতিদিনের জীবন থেকে, আর ছিলো কল্পনা। এ দুয়ের সম্বলে রাতের পর রাত হারিকেনের বাতি জ্বালিয়ে লিখে চলেছিলাম গল্পের পর গল্প। বোধহয় সব লেখকেরই যাত্রা শুরু হয় অগ্রজদের রচনা অনুকরণে, আমারও ছিলো তাই। অতএব, পূর্বপাঠ নজিরে গল্পের একটা চেহারা দিতেই পারছিলাম রচনাকে, আর ছাপাও হচ্ছিলো, ভালোমন্দ প্রশংসাও জুটছিলো।

বইও একদিন একটা হয়ে উঠেছিলো আমার আঠারো বছর বয়সে – তাস – সাতটি গল্প নিয়ে। ওতে ‘সম্রাট’ নামে প্রথম যে-গল্পটি ছিলো, আমার সতেরো বছর বয়সে লেখা – বাহান্নর 888sport cricket BPL rateে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এক পিতা ও তাঁর তরুণ পুত্রকে নিয়ে গল্প – ভাষা-আন্দোলনে অংশ নিয়েছে পুত্র, পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে আসছে, বিত্তবান পিতা বিচলিত, পুত্রের বিশ^াস ও দৃঢ়তার সমুখে চূর্ণিত হচ্ছেন। এখন ওই গল্পটির দিকে ফিরে তাকাই।

গল্পটি সে-সময় অগ্রজ লেখকদের – বিশেষ করে শামসুদ্দিন আবুল কালামের কথা মনে পড়ছে – তাঁর কাছে অজস্র উৎসাহবাক্য পেলেও – মনে পড়ছে ফজলুল হক হলের ডাইনিং রুমে এক 888sport live footballসভায় তিনি ছিলেন সভাপতি, সবার লেখা পড়া হলে তিনি এ-গল্পটিকেই সন্ধ্যার সেরা বলেছিলেন, কিন্তু পেছন ফিরে এখন এর কয়েকটি বিষয় আমার চোখে পড়ছে। এর কোনোটিই ঘুণাক্ষরে কারু অনুমান করার কথা নয়, এবং এর কোনোটিই আমার ওই গল্প লেখার অনুকূলে যাচ্ছে বলে এখন আমি দেখে উঠি না। এক, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তখন আমার স্পষ্ট ধারণা ছিলো না। দুই, বাহান্নর 888sport cricket BPL rateে ফেব্রুয়ারি আমি দেশেই ছিলাম না। তিন, আন্দোলনকারী কোনো ছাত্রকেই আমি দেখিনি, জানিনি। চার, পুলিশের গ্রেফতার করতে আসবার কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অভিজ্ঞতা আমার ছিলো না। পাঁচ, রাষ্ট্রভাষাবিরোধী কোনো উচ্চবিত্ত ব্যক্তিকে  জানা দূরে থাক, চোখেও দেখিনি। কিন্তু গল্পটি আমি লিখে ফেলেছি! এবং প্রশংসাও জুটেছে!

একটা আবহ তখন ছিলো – রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের, বাহান্নর 888sport cricket BPL rateে ফেব্রুয়ারির পরে এক বছরও পার হয়নি, 888sport live footballের আড্ডায় বসছি, হাসান হাফিজুর রহমান তখনো 888sport cricket BPL rateের প্রথম সংকলনটির কথা ভেবে ওঠেননি, ওদিকে পরিচিতদের মধ্যে কাউকে কাউকে রাজনৈতিক কারণে গা-888sport app দিতে দেখছি, আনিসুজ্জামানের হাত দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের জন্যে টাকাও তাঁর হাত দিয়ে দিচ্ছি যা পারছি, সবটা মিলিয়ে এমন একটা আবহ যে তার ভেতর থেকে অবোধ একটা ভালোবাসা জেগে ওঠে এইসবের প্রতি, আমারও কিছু একটা করতে ইচ্ছে হয়। যা পারি তাই করি, বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতা নেই, একটা গল্পই লিখে ফেলি – ‘সম্রাট’। আমার ভেতরটা আরাম পায়। কল্পনার একটি সাঁকো বেয়ে গল্পের সহায়ে আমি যেন আর-সকলের সঙ্গে এক হয়ে যাই।

কিন্তু ওই গল্পে যে একটা জগৎই আমি গড়ে তুলেছিলাম, কল্পনা দিয়েই তো! বাস্তবে তার তিলমাত্র আমার দেখা নয়, জানা নয়, এমনকি শোনাও নয়। কল্পনাই সবটা। তবু গল্পটা বোধহয় 888sport live footballের বিচারে গল্পই হয়ে যায়, প্রশংসাও পায়, অর্থাৎ বানানো গল্প হলেও সত্যকার মতো সে গৃহীত হয়।

প্রণম্য বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর এক লেখায় প্রশ্ন করেন – ‘এটা যদি গল্প তবে সত্য কোন কথা?’ গল্প কি তবে মিথ্যা নিয়েই? আমরা যে গল্প লিখি তাও কি মিথ্যার বেসাতি আসলে? এ যদি হয়, তাহলে আমার সতেরো বছর বয়সে সেই যে একজনাকে দেখেছিলাম, নামাজ রোজা করা মানুষ, দোজখের ভয়ে ভীত মানুষ, হাশরের কল্পনায় কম্পিত, তাঁকে একদিন যে দেখেছিলাম ঘুষ খেয়ে কোমরে পুলিশের দড়ি বাঁধা জেলে যেতে – সত্য এ পর্যন্তই, কিন্তু ওই যে আমি কল্পনা করেছিলাম তাঁর আছে বিবাহযোগ্য কন্যা কয়েকটি, তাদের বিয়ের জন্যে টাকার জোগাড়েই ঘুষটি খেয়েছিলেন তিনি, এ নিয়ে যে একদিন ‘শীতবিকেল’ নামে একটি গল্প লিখেছিলাম, গল্পই তো! – মিথ্যা এর কোনখানে? আর যদি মিথ্যাই না হয়, তাহলে সত্য আর গল্পের মধ্যে বিবাদটি উঠছে কেন?

সমালোচক বলছেন, গল্প হতে হবে  বাস্তব জগৎ থেকে নেওয়া, তবেই সে গল্প। আতান্তরে পড়ে যাই যখন রবীন্দ্রনাথকে তাঁর ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্প সম্পর্কে বলতে শুনি, ‘ক্ষুধিত পাষাণে’র কল্পনাও কল্পলোক থেকে আমদানি।’ কিন্তু আমরা দেখি ‘ক্ষুধিত পাষাণে’র জগৎ বাস্তবের অধিক বাস্তব। তিনি যখন তাঁর ‘কাবুলিওয়ালা’ গল্পটির বিষয়ে বলেন, ‘কাবুলিওয়ালা বাস্তব ঘটনা নয়’ – আমরা হকচকিয়ে যাই। তাঁর সমগ্র গল্পগুচ্ছ সম্পর্কেই যখন তিনি বলেন, ‘আমি একটা কথা বুঝতে পারিনে, আমার গল্পগুলিকে কেন গীতধর্মী বলা হয়। এগুলি নেহাত বাস্তব জিনিশ। যা দেখেছি, তাই বলেছি। ভেবে বা কল্পনা করে আর কিছু বলা যেত, কিন্তু তা তো করিনি আমি।’ – তখন তিনি আমাদের বিভ্রান্তই করেন। কল্পনা আর বাস্তবের মধ্যে – গল্প-888sport alternative linkে – রচনার কাজটি ও রচনাটির পাঠটির ভেতরে আসল সাঁকোটি নির্ণয় করে উঠতে আমরা থমকে যাই।

প্রাতঃ888sport app download for androidীয় হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্রনাথেরই প্রেরণা ও সহায়তায় করা তাঁর বঙ্গীয় শব্দকোষ অভিধানে গল্প শব্দটির অনেক অর্থের ভেতরে একটি অর্থ দেন – ‘রচা কথা’। অর্থাৎ অবিশ^াস্য। উদাহরণে, রবীন্দ্রনাথের ছিন্নপত্র উলটে পাই এমনই এক রচা কথার সাক্ষাৎ। তিনি লিখছেন, ‘পোস্টমাস্টারের গল্প শুনতে আমার বেশ লাগে। বিস্তর অসম্ভব কথা বেশ গম্ভীরভাবে বলে যান। কাল বলছিলেন, এ দেশের লোকের গঙ্গার উপর এমনি ভক্তি যে, এদের কোনো আত্মীয় মরে গেলে তার হাড় গুঁড়ো করে রেখে দেয়, কোনো কালে গঙ্গার জল খেয়েছে এমন লোকের যদি সাক্ষাৎ পায় তাহলে তাকে পানের সঙ্গে সেই হাড়-গুঁড়ো খাইয়ে দেয় আর মনে করে তার আত্মীয়ের একটা অংশের গঙ্গা লাভ হল। আমি হাসতে হাসতে বললুম, ‘এটা বোধ হয় গল্প?’ তিনি খুব গম্ভীরভাবে চিন্তা করে স্বীকার করলেন, ‘তা হতে পারে।’ এইকালেই রবীন্দ্রনাথ লিখছেন গল্পগুচ্ছ, আর হয়তো সমুখের এই বাস্তব পোস্টমাস্টারই তাঁর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটিতে উঠে এসেছে, তার পরেও গল্প শব্দটি তিনি ব্যবহার করছেন রচা কথা অর্থে! কত বিচিত্র অর্থেই না একেকটি শব্দ আমরা কাজে লাগাই!

গল্প তবে এক অর্থে রচা কথা। কী? না, রচনা করা কথা! রচনার মানেটি তবে একবার হরিচরণেই জেনে নেওয়া যাক – নির্মাণ, কৃতি, গ্রন্থন, স্থাপন। সরলার্থে – তৈরি করা। আবার, গল্প শব্দটির মূল তিনি নির্দেশ করেন – জল্প। তাঁরই অভিধানে পাই জল্প মানে অনর্থক বাক্য প্রয়োগ! তবে কি, জল্প থেকে যে গল্প শব্দটি, তা অনর্থক বাক্য প্রয়োগযুক্ত কোনো রচনা?

এ-কথায় আমরা গল্পলেখকেরা দুহাত নেড়ে প্রতিবাদ করে উঠবো – না! না! হতেই পারে না!

পাঠকও বিচলিত হবেন জানি, তাঁরা বলবেন – সে কী! তবে যে একটি গল্প পড়ে এই যে কেঁদে উঠলাম, রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ পড়ে রতনের জন্যে আমাদের চোখ ভিজে উঠলো, প্রেমেন্দ্র মিত্রর ‘তেলেনাপোতা আবিষ্কার’ পড়ে ওই যে মেয়েটির জন্যে মন আমাদের মেদুর হয়ে গেলো, জগদীশ গুপ্তের ‘দিবসের শেষে’ গল্পটি যে আমাদের দাঁড় করিয়ে দিলো এক হতভাগ্য বালকের কুমিরের মুখে মৃত্যুর সমুখে, আমরা যে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম, এসবই কি হতে পারলো তাঁদের অনর্থক কথা রচনায়? কিন্তু আমাদের চোখের এই জল, মনের এই মেদুরতা, দৃষ্টির এই স্তম্ভন – এ যে বাস্তবের চেয়েও আরো বাস্তব, এ যে সত্যের অধিক সত্য!

জল্প আর গল্প শব্দ দুটির টানে এখন আমরা কল্পনা শব্দে পৌঁছোই – ফিরে যাই কল্পনায় – নিছক শব্দধ্বনির মিলে নয়, অন্তর্গত অভিধার টানে। সাংসারিক স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই টের পাই, একটা কিছু তৈরির আগে তো তার কল্পনাই আমরা করে উঠি প্রথমে, পরে তার রূপ ধরে দিই। মাটির তাল হাতে কুমোরের কল্পনায় ঘট, তবে তার নির্মাণ। বাসরে প্রবেশ করে অপেক্ষমাণ বধূটি, কল্পনায় জেগে ওঠে সংসার, তার পরেই তো সব! লেখকের বেলাতেও কি তাই নয়? – কল্পনা থেকে গল্প। গল্পের সেই জগৎটি কি তবে কল্পলোক? – রবীন্দ্রনাথ যেমনটি বলেছেন ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ এসেছে তাঁর কল্পলোক থেকে আমদানি হয়ে, বাস্তব থেকে নয়!

নয় কি? দেখা যাক তবে রবীন্দ্রনাথেই। তাঁর ছিন্নপত্র! এরই এক পত্রে সাহজাদপুরের দুপুরের বর্ণনা দিয়ে লিখছেন তিনি, ‘কেন জানিনে মনে হয়, এইরকম সোনালি রৌদ্রে ভরা দুপুর বেলা দিয়ে আরব্য 888sport alternative link তৈরী হয়েছে। অর্থাৎ, সেই পারস্য এবং আরব্য দেশ, দামাস্ক, সমরকন্দ, বুখারা – আঙুরের গুচ্ছ, গোলাপের বন, বুলবুলের গান, শিরাজের মদ – মরুভূমির পথ, উটের সার, ঘোড়সওয়ার পথিক, ঘন খেজুরের ছায়ায় স্বচ্ছ জলের উৎস – নগরের মাঝে মাঝে চাঁদোয়া-খাটানো সংকীর্ণ বাজারের পথ, পথের প্রান্তে পাগড়ি এবং ঢিলে কাপড়-পরা দোকানি খরমুজ এবং মেওয়া বিক্রি করছে – পথের ধারে বৃহৎ রাজপ্রাসাদ, ভিতরে ধূপের গন্ধ, জানালার কাছে বৃহৎ তাকিয়া এবং কিংখাব বিছানো – জরির চটি, ফুলো পায়জামা এবং রঙিন কাঁচলি-পরা আমিনা জোবেদি সুফি – পাশে পায়ের কাছে কুন্ডলায়িত গুড়গুড়ির নল গড়াচ্ছে, দরজার কাছে জমকালো-কাপ-পরা কালো হাবশী পাহারা দিচ্ছে…’ আমরা চমকে উঠে আবিষ্কার করবো ‘ক্ষুধিত পাষাণে’র হাবশীকে, পত্রের বাক্য দীর্ঘ হতে থাকবে, হতেই থাকবে, সারা ছিন্নপত্রে এত দীর্ঘ বাক্য রবীন্দ্রনাথের কলমে আমরা আর পাবো না, বাক্য দীর্ঘ হচ্ছে কারণ তিনি সাহজাদপুরের বাস্তবতা থেকে তখন যাত্রা করছেন আরব্য রজনীর কল্পলোকে। আমাদের ও তাঁরও ঘোর তখনি ছুটবে যখন তিনি গল্পটি লিখতে লিখতে আমাদের শোনাবেন মেহের পাগলার চিৎকার, ‘তফাৎ যাও! তফাৎ যাও! সব ঝুট হ্যয়! সব ঝুট হ্যয়!’

ঝুট, কল্পলোকটাই তবে ঝুট? কল্পনার জগৎ মিথ্যে? গল্প কেবলি রচা কথা? লেখকের কলমের মুখে অবিশ^াস্য সব উপাখ্যান? বঙ্কিমচন্দ্রের প্রশ্নটি আবার উত্থাপন করি, ‘এটা যদি গল্প তবে সত্য কোন কথা?’ এবং তাঁর সঙ্গে যোগ করি আমারও সম্প্রসারিত এই প্রশ্ন – সত্য তবে কোথায়? তার আগে তো ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ থেকে বেরুতেই পারছি না, সেই কল্পলোকই সত্যের অধিক সত্য বলে দেখছি, আর গল্পটি পড়া শেষ করে উঠেও আমাদের শ্রুতি থেকে মিলিয়ে যাচ্ছে না বন্দি ক্রীতদাসীর সেই আকুল উচ্চারণ – ‘কঠিন মায়া, গভীর নিদ্রা, নিষ্ফল স্বপ্নের সমস্ত দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া, তুমি আমাকে ঘোড়ায় তুলিয়া, তোমার বুকের কাছে চাপিয়া ধরিয়া, বনের ভিতর দিয়া, পাহাড়ের উপর দিয়া, নদী পার হইয়া তোমাদের সূর্যালোকিত ঘরের মধ্যে আমাকে লইয়া যাও। আমাকে উদ্ধার করো।’ আর, এ-গল্পের পাঠক আমরাও অতঃপর আমাদের মনের মধ্যে আর্ত আমাদেরই হতাশ চিৎকার অতঃপর অবিরাম শুনে উঠছি – ‘আমি কে! আমি কেমন করিয়া উদ্ধার করিব?’ এবং আমাদের চোখ থেকে মুছে যাচ্ছে কি কখন মুছে গিয়েছেই বাস্তব জগৎ।

এ যদি সত্য নয়, এ যদি কল্পলোকেরই, তবে সত্য আর কাকে বলে জানি না।

আমরা বলতে প্রলুব্ধ হই – কল্পলোকেই সত্যের প্রকৃত অবস্থান।

আমরা দেখে উঠি, জীবনের সত্য আবিষ্কারের অপেক্ষায় থাকে, নানা পাঁক ও কাঁটায়, বিভ্রান্তি ও সংস্কারে আবিল হয়ে থাকে সত্য; তাকে পরিশ্রুত ও পরিষ্কার রূপে আমরা পাই 888sport live footballে – গল্পে, 888sport alternative linkে, 888sport app download apkয় এবং গানেও। তাই দোলনায় কোনোদিন না উঠেও আমরা আমাদেরই দেখতে পাই ‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা’, মৃত্যুর মুখোমুখি না হয়েও আমাদের ভেতরটা এই সত্যে উন্নত হয়ে ওঠে যে, আমরা বলে উঠি, ‘মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে বলিব তুমি আছো আমি আছি।’ আর, উলাপুরে না গিয়েও আমরা পোস্টমাস্টার হয়ে উঠি, আর কোথাও নয় ওই তেলেনাপোতাতেই ফিরে যাবার তুমুল টান জাগে আমাদের, বরীচ নামে অজানা অচেনা একটি জনপদে কবেকার কোন দ্বিতীয় শা-মামুদের ভগ্ন প্রাসাদে আমরা সন্ধ্যাকালে সাজসজ্জা করে দূতীর প্রতীক্ষা করি, সে আমাদের নিয়ে যেতে থাকে সেই ক্রন্দসীর কাছে, যে বিলাপ করে কেবলি বলছে – ‘আমাকে লইয়া যাও, আমাকে উদ্ধার করো।’

এই হচ্ছে সত্য। এই হচ্ছে বাস্তব। কিন্তু কল্পিত। কল্পিতই!

কল্পলোকেই জীবনের সত্য আবিষ্কার করে ওঠা।

সেই যে উনিশশো তেষট্টি সাল, কবি আবুল হোসেনের তাড়নায় পরপর তিনদিনে জনসন রোডের মাইরান্ডার রেস্টুরেন্টের কেবিনে বসে লিখে উঠেছিলাম ‘রক্তগোলাপ’ গল্পটি, সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বুটের নিচে এ-দেশ তখন, একষট্টি সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী পালনে তাঁর কঠোর নিষেধাজ্ঞা, আমার মনে হয়েছিলো কবির বুক থেকে লাল রক্ত ঝরছে, ওই লাল রক্তটিকেই আমি ধরতে চেয়েছি ওই গল্পে। পারস্যের মহাকবি ফিরদৌসির নামে নাম এক বাজিকরকে আমি কল্পনা করে উঠেছি, অদ্ভুত শক্তির অধিকারী তাকে আমি দেখে উঠি, হাত ঘোরাতেই রক্তগোলাপ তার হাতে দেখা দেয়, শেষ পর্যন্ত জাদুর মঞ্চে সে যখন বোর্ডে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ায়, একজন তার দিকে ছোরা ছুড়তে থাকে মঞ্চখেলায়, উদ্দেশ্য একটিও ছোরা তাকে বিঁধবে না, তার চারদিক ঘিরে ছোরাগুলো গেঁথে যাবে, কিন্তু না! ছোরা তার বুকে একের পর এক বিঁধে যায়, আর? আর, রক্তের বদলে ফিনিক দিয়ে তার বুক থেকে ফোয়ারার মতো নির্গত হতে থাকে গোলাপ, রক্তগোলাপ! গোলাপের ঘ্রাণে ভরে যেতে থাকে মঞ্চলোক।

এ-মঞ্চ কল্পলোকের। তখন পর্যন্ত জাদুবাস্তবতার বিন্দুবিসর্গ জানি না লাতিন গল্পের, মার্কোয়েজ তখন পর্যন্ত তাঁর জাদু-কলমটির খাপ খোলেননি, ‘রক্তগোলাপ’ আমি লিখে উঠি। উড়োজাহাজ যেমন মাটির ওপর দিয়ে চলতে চলতে দ্রুত বেগ পায়, তারপর উড়ে যায় আকাশে, আমিও বাস্তবের জমিতে গল্পটি রেখে রেখে একসময় উড্ডীন করে দিই তাকে, পাঠককে তিলমাত্র ভাবতে দিই না এখন সে আকাশে, এখন সে কল্পলোকে, তাই ছোরার মুখে ফিরদৌসির বুক থেকে রক্তের বদলে রক্তগোলাপের উদ্গিরণও সে অবাস্তব বলে বোধ করে উঠতে পারে না, বাস্তব রূপেই এ সকল সে দেখে ওঠে।

এতক্ষণে সময় হয়েছে কল্পলোক আর গল্পলোক, বাস্তবের জগৎ আর গল্পের জগতের সম্বন্ধটি বলবার। গল্পের জগৎ গড়ে তুলি কল্পনায়, গল্পে যা হচ্ছে বাস্তবে তা ঘটে নি, কিন্তু যদি ঘটতো, তবে এই-ই হতো। গল্প তবে সম্ভাবনারই জগৎ, এমন দৃপ্ত সক্ষম সম্ভাবনা যে – এর মানুষ কল্পিত, এর ঘটনা কল্পিত, হোক মানুষগুলো বাস্তব, হোক পটভূমি আমাদের শত চেনা, গল্পে এই যা ঘটছে বাস্তবে এমন কখনোই হোক ঘটে নি, কিন্তু যদি ঘটতো, তবে এই রকমটাই হতো, অন্য কিছু তা  হতেই পারতো না।

‘ক্ষুধিত পাষাণ’ও আর কিছু হতে পারতো না।

বুক থেকে রক্তের বদলে রক্তগোলাপের উদ্গিরণও ভিন্ন আর কিছুই হতো না।

গল্পের জগতে তিনিই আমাদের সর্বাংশে ও সর্বাঙ্গে নিতে পারেন, যাঁর কলমে আছে সম্ভবপরতা রচনার এই জাদু। এই সম্ভবপরতাই কল্পিত গল্পকে জীবনের গল্প করে তোলে। বাস্তবের জগৎ আর গল্পের জগৎ – এ দুয়ের ভেতরে সম্বন্ধটি আসলে এইখানেই। লেখক যিনি এই সম্ভবপরতাকে যত বেশি জোরালো করে তুলতে পারেন, ততই তাঁর সিদ্ধি।

জীবনের সম্ভাবনা অফুরান, কল্পনারও, গল্পও তাই অফুরান; পৃথিবীতে কত ভাষা, কত লেখক, কত হাজার বছর ধরে লেখা হচ্ছে গল্প, এত কোটি গল্পের পরেও গল্প তাই আজো ফুরোয় না, গল্পলেখকের কালিও শুকোয় না \

২২শে জুন ২০১৫