গাল্পিক সরদার জয়েনউদ্দীন ও নয়ান ঢুলী

আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ

বাংলা888sport live footballে ছোটগল্প গ্রামীণ জীবননির্ভর। তুলনাসূত্রে  উলেস্নখ করা আবশ্যক, আমাদের ছোটগাল্পিকরা নিম্নবিত্ত বা গ্রামীণ জীবনচিত্রণে যতখানি সুদক্ষ-স্বচ্ছন্দ-বস্ত্তনিষ্ঠ, অপরদিকে নগরজীবনের মধ্যবিত্ত জীবনযাপন চিত্রণে ততখানি আগ্রহী বা স্বচ্ছন্দ নন। আমরা দেখি রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ বাংলার গ্রামের কথালেখ্য হলেও তাঁর কলমে গ্রামীণ ভাষা আমরা প্রত্যাশাও করিনি এবং পাইনি তা বলা বাহুল্য। তারাশঙ্কর অবশ্য শরৎচন্দ্রের উত্তরসূরি, তাই বলে অন্ধ-অনুসারী বলা যাবে না। পলিস্নজীবনের কাকুতি-দৃশ্যাবলি-জীবন সংগ্রাম চিত্রায়ণে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। তারাশঙ্কর এবং বিভূতিভূষণ গ্রামের গল্প লিখেছেন অনেক। বিভূতিভূষণের গল্পে-888sport alternative linkে মূর্ত চরিত্রগুলোর সংলাপ সম্পর্কে সত্যজিৎ রায় একদা মন্তব্য করেছিলেন – ‘এ যেন রেকর্ডিং মেশিনে তুলে আনা একেকটা মণি-মাণিক্য’। কারণ তাঁর গল্পে জীবন যেমন আছে, আছে তাঁর শক্তি; সেই শক্তি দিয়েই বাংলা888sport live footballকে আজ অবধি শাসন করছেন। জীবনের গল্প, মানুষের গল্প তাঁর লেখায় জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে বলেই তিনি জীবন888sport live chatী।

বিভূতিভূষণ বা তারাশঙ্কর এবং সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ-শওকত আলী-হাসান আজিজুল হক গ্রামীণ এবং নাগরিক জীবনের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে সুকৌশলে পৌঁছাতে পেরেছেন বলেই তো জীবন888sport live chatী। বাংলা ছোটগল্প গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের বিসত্মৃত উপাখ্যানে সুসমৃদ্ধ। এমনকি গ্রামীণ ও নাগরিক জীবনের সমবায়ী তরঙ্গও দুর্নিরীক্ষ্য নয়। কিন্তু যান্ত্রিক কোলাহলে সমসত্ম 888sport sign up bonus ও ঐতিহ্য আবেগ, কোমল অনুভবময়তা কালের নির্মম পদপাতে পিষ্ট-বিনষ্ট হয়ে গ্রামীণ সমাজ ও জীবনের ক্রমশ নাগরিক হয়ে-ওঠার হৃদয় চুরমার করা হাহাকারে বাংলা ছোটগল্পের দুর্লভ উপস্থিতি। জীবনানন্দের গল্পের মূল উপজীব্য মানুষ। মানুষের জীবনের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সামাজিক-রাজনৈতিক বিচিত্র অবস্থার পরিবর্তনের ফলে মানুষের ওপর প্রতিফলিত প্রতিক্রিয়া প্রভৃতি খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে তিনি তুলে ধরেছেন গল্পে। ফলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পাশাপাশি নদী-আকাশ, গাছগাছালি-পানি, গরম্ন-ছাগল অন্ধকার নৌকা, ঝাউবন-প্রেম-ভালোবাসা-যৌনক্ষুধা-অত্যাচার-লালসা-কাঁটাঝোপ, সকাল-দুপুর, গ্রাম-শহর শহরতলি-বসতি ভোরের সোনালি রোদ্দুর কোনো কিছুই তাঁর বিশেøষণের বাইরে যায়নি। মৃত্তিকাসংলগ্ন জনমানুষের যে-জীবনালেখ্য, যে বৈচিত্র্যময় পরিবেশের অনুসন্ধান, তাকে কী বলব – অবশ্যই জীবনের গল্প। জীবন এখানে বৈচিত্র্যময়-অনুভূতিপ্রবণ আর তিক্ত অভিজ্ঞতাসম্পূর্ণ।

মূলত 888sport appsের গ্রামীণ জনপদের ভাঙন-সামাজিক শোষণ, কখনো প্রতিবাদ বা বাঁচার সংগ্রাম এসব বিষয় নিয়ে 888sport live footballিক সরদার জয়েনউদ্দীনের (১৯১৮-৮৬) গল্পের গল্পজগৎ। সেই গল্পজগতের একমাত্র শাসক তিনি। জন্ম পাবনা জেলার কামারহাটি গ্রামে। সেনাবাহিনীর কেরানি থেকে পত্র-পত্রিকায় এবং বাংলা একাডেমি-জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র-জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুসত্মক বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। জয়েনউদ্দীন বাংলা 888sport live footballাকাশে এক অনন্য প্রতিভা বলতেই হয়। তাঁর গল্পের ভাষা-নির্মাণ, বাক্যশৈলী ও গল্পের উপস্থাপনায় এ-কথা স্বীকৃত যে, গ্রামীণ গল্প বাংলা 888sport live footballের প্রাণ। কারণ গ্রামভিত্তিক 888sport appsের বিশাল জনসাধারণের শেকড় ওই গ্রামেই রোপিত। তাই গ্রামই হয়ে ওঠে প্রাণ। সে-কারণেই তাঁর গল্পের বিশাল একটা অংশে নিহিত যে-গ্রামীণ জীবনধারা, তা অস্বীকার করা যায় না। গল্প দিয়ে 888sport live footballাকাশে আগমন এবং গল্পেই ঘটেছে সমধিক প্রসার বা উত্তরণ। দীর্ঘ 888sport live footballজীবনে তিনি বিপুলসংখ্যক গল্প নির্মাণে নিমগ্ন থেকেছেন, যদিও তাঁর গল্পগ্রন্থ চারটি আলোর মুখ দেখেছে। নয়ান ঢুলী (১৯৫২), খরস্রোতা (১৯৫৫), বীর কণ্ঠীর বিয়ে (১৯৫৫), অষ্টপ্রহর (১৯৭০), বেলা ব্যানার্জীর প্রেম (১৯৭৩)। এর বাইরে আরো কিছু গল্প হয়তো থাকলেও থাকতে পারে। ছোটগল্প ছাড়াও তিনি বেশ কয়েকটি উচ্চমানের 888sport alternative link রচনা করেছেন। সেই 888sport alternative linkেও জীবনকে গভীরভাবে নিরূপণ করেছেন। 888sport live footballকর্মে তাঁর মানবিক গুণাবলি তাঁকে একজন শ্রেষ্ঠ 888sport live footballিকের মর্যাদা দান করেছে। এমনই একজন বি888sport sign up bonusপ্রায় 888sport live footballিক সরদার জয়েনউদ্দীন। আজ আমাদের বাংলা 888sport live footballাকাশে তাঁর মতো গাল্পিককে বারবার তুলে ধরতে হবে। তাঁর বিশাল 888sport live footballভা-ারের কাছে আমরা কতখানি ঋণী, হয়তো সেটা কোনো প্রশ্ন নয়, তারপরও তিনি বাংলা 888sport live footballের একজন কা-ারি। কারণ আমাদের শেকড় যে কতটা গভীরে, তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাঁর গল্পে। বাংলা ভাষাভাষি মানুষ যখন কলকাতাকেন্দ্রিক 888sport live footballে ডুবে আছে আপাদমসত্মক, আর 888sport appকেন্দ্রিক বা 888sport appsের 888sport live football যখন মিলন-হুমায়ূন, আনিসুর-ইকবালের দখলে, মানুষ তাঁদের নিয়েই ব্যসত্ম, তখন সরদারের নাম কে-বা নেবে, কে পরিচয় করিয়ে দেবে সরদার জয়েনউদ্দীনের 888sport live footballের সঙ্গে। বড় টানাপড়েন সময়। দুর্ভাগ্য আমাদের ললাটে, কে খ-াতে পারে! জয়েনউদ্দীনের প্রথম গল্পগ্রন্থ নয়ান ঢুলী নিয়ে এখানে আলোচনা করে দেখব, তিনি বাংলা 888sport live footballের কতটা শিখরে উঠেছিলেন, যদিও তাঁকে নিয়ে সেভাবে আলোকপাত করা হয় না প্রায়। তাই ভুলে-যাওয়া গাল্পিকের গল্প নিয়ে আলোচনা অর্থাৎ একটু পরিচয়মূলক পর্যালোচনা।ী

করালী চিরদিনের মতো জামেলাকে হারাল। এভাবেই সরদার জয়েনউদ্দীন ‘করালী’ গল্পের পরিণতি দেখিয়েছেন। জমিদার-সামন্ত বাবুরা কীভাবে সাধারণ মানুষকে নাজেহাল করেছে এবং ঘরের ইজ্জত নিয়ে বেইজ্জত করেছে তার একটা ছবি এই গল্পে চিত্রায়িত হয়েছে। ঘরে বউ নিয়ে শুয়ে ছিল কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখে জামেলা হাওয়া। কোথায় গেল, বুঝে উঠতে পারে না। দৌড়ে যায় কাছারিতে, তাও পায় না। লোকজন উত্তেজিত হয়। জমিদারের বিরম্নদ্ধে কথা ওঠে – খাজনা নিচ্ছে আবার ঘরের বউকে ছিনিয়ে নেয়। সবাই বলে, সদরে গিয়ে মামলা ঠুকে দিতে; কিন্তু মন তার বোঝে না। ইচ্ছে করছিল খুব করে কাঁদে; কাঁদলে বোধহয় দুঃখ কিছু কমে। করালী পেয়াদা কী করবে ভেবে যখন দিশেহারা, তখন মানিক বিশ্বাস ধমক দিয়ে ওঠে। সোজা কোটে যাও। তোর সাথে গাঁয়ের-দেশের মান-সম্মান জাত যায়। ভালো চাস তো আজই সদরে যা। থানায় গিয়ে কাজ নাই, ওসব দারোগা-ফারোগায় বিশ্বাস নাই, শালারা ঘুষের বাচ্চা। সোজা সদর, পুলিশ সা’ব কি ম্যাস্টের কোট। ঘরের বউ পরের সাথে ভেগেছে, শরম-লজ্জায় কাঁচুমাচু করে করালী। অকস্মাৎ বৈঠকখানার কোনা থেকে নববই বছরের বুড়ো উজির সরদার – এককালের নামকরা লেঠেল, চাপাস্বরে ফিসফিসিয়ে বলে, জমিদারের সাথে ঝগড়া-ফ্যাসাদ করবার দরকার নাই। সবাই মিলে হুজুরের হাতে-পায়ে ধরে ঘরের বউকে ঘরে নিয়ে আসো। হাজার হলেও জমিদার মুনিব। তারপর 888sport sign up bonus হাতড়ে পেছনের গল্প বলে, খোনকারের ছেলের, হুজুরের এবং গহের সরদারের… মানিক প্রতিবাদ করে। সেকাল নাই চাচা, জমিদারের বিষদাঁত ভেঙে দেবো। শালার জমিদার… বংশ নিপাত না করে ছাড়ছি না; কিন্তু করালী ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সাতপাঁচ ভেবে ঘুরে বসে। মামলা-মকদ্দমা বড় খারাপ জিনিস, ওপথে অনেক হাঙ্গামা। উজির দরদারই ঠিক কথা বলেছে, জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে পেরে ওঠা যায় না। করালী মনস্থির করে, সত্যিই হয়তো তাই। সামন্তরাজ সর্বত্র গ্রাস করছে, বেঁচে থাকা কঠিন। শেষে তার পেয়াদাগিরি চাকুরি চলে যাবে। হাজার ভেবে করালী জমিদারবাড়িই রওয়ানা হলো। এভাবেই মানুষ হয়তো ক্ষমতার কাছে, শক্তির কাছে মাথা নত করে এবং করতেই হয় জীবনযাপনের কারণে।

ভালোবাসা যে সত্যিই ভাগ করে দেওয়া যায় না, ‘ভাবী’ গল্পে সোহাগী সে-কথাই 888sport app download for android করিয়ে দেয়। কৃপণ নেজামদ্দি সরকার মরে যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরে তার বড় ছেলে নেয়াজ মহাম্মদ, ছোট ছেলে নবীবক্স নবম শ্রেণিতে পড়ে। নেয়াজ জমিজিরাত নিয়ে দিনমান মেতে থাকে, আর নবীবক্স শুধুমাত্র ভাবিকে নিয়ে দিনরাত্রি শেষ করে। সংসারের দিকে বিন্দুমাত্র তার খেয়াল নেই। শহরে গিয়ে সিনেমা দেখা, ভাবির জন্য চুড়ি-ফিতে-শাড়ি কিনে আনা যেন নবীর কাজ হয়ে দাঁড়ায়, যদিও সেসব পয়সা সোহাগীই দিত স্বামীর কাছ থেকে চেয়ে। একপর্যায়ে যে সোহাগী একটু-একটু করে নবীবক্সের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ে, তা নিজেই টের পায়। তখন নিজেকে শক্ত করে বাঁধে; কিন্তু দেখা যায়, তা বাঁধতে গিয়ে সোহাগী নিজেই হারিয়ে ফেলে নিজেকে। নবীর বিয়ে দিতে গিয়ে প্রকৃতপক্ষে টের পায় যে, সত্যি-সত্যিই নবীকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে। সেই ভালোবাসা হয়তো শারীরিক নয়, তারপরও মানসিক এক সম্পর্কের দোলাচলে গল্পটি এগিয়ে যায় অনেকটা দূর। নবীবক্স বিয়ের দিন সালাম করতে গিয়ে দেখে ভাবির সেই চেহারা আর নেই। মুখখানা শুকিয়ে আধখানা হয়েছে। বুক ভেঙে যায়, কী দেখছে সে! সোহাগী টাল খেয়ে পড়ে। কাঁদতে থাকে আর মনে-মনে ভাবে পুরম্নষ জাতটার পরাণ বলে কিছু নাই, বড় বে-রহম! মনস্তাত্ত্বিক এ-গল্পে জীবন যেন অন্যভাবে ধরা দিয়েছে। ভালোবাসা যে কতটা সূক্ষ্ম অনুভূতি, তা একবাক্যে বোঝানো সম্ভব নয়; ভালোবাসার স্পর্শ দিয়েই বোঝাতে হয়। সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিক বা স্টাইল গল্পে ধরা পড়েছে। ভাষায় গতিময়তায় অসামান্য ভাস্কর্য নির্মাণ করতে পেরেছেন জয়েনউদ্দীন। কোনো-কোনো গাল্পিকের কোনো একটি গল্পের ভাবকল্পে, তার অন্তর্বয়ন ও 888sport live chatনির্মিতির স্বাতন্ত্র্যে কিংবা নির্মিতির স্রষ্টার 888sport live chatীসত্তার বিম্বিত রূপ অনুসন্ধান তীব্র অবিনাশী পুনর্নির্মাণ। হয়তো তা বিদ্যায়তনিক 888sport live footballালোচনা নয়, বিদ্বদগোষ্ঠী অনুমোদিতও নয়। কিন্তু সরদার জয়েনউদ্দীনের যে-888sport live footballকৃতির সঙ্গে আমাদের পরম আত্মীয়তা, সেখানে সেই 888sport live chatবাসত্মবে সবই রহস্যময়। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ বা ডিটেলসের প্রতি আকর্ষণ তাঁকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি, বরং প্রতিক্ষেত্রে সচেতন নিমগ্নতা তাঁকে বাসত্মব পরিপ্রেক্ষেতের প্রতি বিশ্বসত্ম থাকতে প্ররোচিত করে। এই বিশ্বসত্মতা দেখি ইতিহাসের প্রতি, মানুষের প্রতি, দেশমাতৃকার প্রতি এবং স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের প্রতি। আখ্যানে যে-স্থানের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা, তাতে আমরা দেখি একটি জনপদ, একটি জনগোষ্ঠী, জনপথের অতীত-বর্তমান, সেইসঙ্গে ভবিষ্যৎ-অতীতের হাড়গোড়ের সত্মূপ থেকে নড়েচড়ে ওঠে আরেকবার, একটি অমরণশীল জীবনযাপন।

‘কাজী মাষ্টার’ গল্পে আমানত কাজী মাস্টারের চরিত্রটি বেশ গুরম্নত্বপূর্ণ বলা যায়, যে কিনা ১৯২১ সালে বি.এ পাশ করেও শহরে গিয়ে হাকিম-উকিল না হয়ে হয়েছে স্কুলের মাস্টার, দেশের মানুষকে, গাঁয়ের মানুষকে শিক্ষার আলো দেবে বলে যার এমন আকাঙক্ষা, তাকে শেষাবধি একটা স্কুলের জন্য নতুন করে আবার তৈরি হতে হয়। নিজের উৎপাদিত কপি বিক্রি করে পাঠশালার ঘর তুলবে, লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষকে নতুন করে বাঁচাবে। অথচ একটা স্কুলের মাস্টার ছিল সে, পরাণের মেয়ে ময়নাকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করতে চেয়েছিল। শহরে গিয়ে বৃত্তি দেবে, কত নাম হবে দেশজোড়া; কিন্তু গ্রাম সমাজের গণি ম-ল প্রধান তা চায় না, কারণ তার নজর পড়েছে ময়নার ওপর। চলিস্নøশ বছরের বুড়ো কিনা ময়নাকে বিয়ে করতে চায়, ঘটক পাঠায়। আমানত মাস্টার প্রতিবাদ করায় নতুন যুগের বে-শরিয়তি বলে ময়নার পড়া বন্ধ করে গ্রামপ্রধান গণি, স্কুল ভেঙে ফেলার হুকুম দেয়। বসারত আর দেরাজ মোল্লা সে-রাতে মাস্টারের চোখের সামনে পাঠশালার চালা কেটে ফেলে। শুধু তাই নয়, পরাণের জমিটুকু একে-একে চলে যায় গণির জরিপ করা টাকা-খাওয়া আমিনের হাত দিয়ে। এভাবেই সমাজের একশ্রেণির মানুষ নিজেদের ক্ষমতা প্রকাশ করে, বিচারের বাণী নীরবে কেঁদে মরে, আর কেঁদে মরে মনুষ্যত্ব। ধর্ম দিয়ে মানুষকে কব্জা করতে না পারলে যে-অত্যাচার তার জন্য নির্ধারিত হয়, গাল্পিকতার রূপ যে এভাবে গল্পাকারে তুলে ধরবেন, তা সত্যিই অভিনব। গল্পে গ্রামীণ মানুষের কষ্ট-যন্ত্রণার সঙ্গে ভালোমানুষের পাশাপাশি নষ্ট-ভ্রষ্ট কাঠমোলস্না
শ্রেণির চরিত্রটি বেশ চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে, যার ভেতর কোরান-হাদিসের জ্ঞান না থাকলেও উল্টাপাল্টা বিধান দিতে এতটুকু কার্পণ্য  করে না, সামন্তত্ম বা জোতদার শ্রেণি আমাদের সমাজদেহকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করে তার চালচিত্র গল্পে দেখতে পাওয়া যায় আগাগোড়া।

সোনার মা শেষ অবধি জোতদারের কাছে মাথা নত করেছে। প্রেসিডেন্ট সবজানকে বাঁধা মাগি হিসেবে রেখেছে। ‘সবজানের সংসার’ গল্পটি এভাবেই শেষ হয়, কেতাবদি জেল থেকে ফিরে দেখে বাড়িঘরের

শ্রীবৃদ্ধি, দিনকাল ফিরেছে। তাহলে দুঃখ-দুর্দশা অভাব-অনটনের মধ্য দিয়ে বাঁচতে-বাঁচতে মানুষ একটা সময় কূল-কিনারা পেয়ে যায়। একটা আশা এবং স্বপ্ন যখন সত্য-সত্যি মুছে যায়, তখন সে কী নিয়ে বাঁচে? হিতাহিত-জ্ঞান হারিয়ে কোনো একটা খড়কুটো ধরে বেঁচে থাকতে চায়। কেতাবদিকে মিথ্যে চুরির অপরাধে জেলে ছয় মাস থাকতে হয়। প্রেসিডেন্ট যতই জাকাত দিক বা দান-খয়রাত করম্নন না কেন, সে মূলত সর্বনাশা বদমায়েশের চূড়ান্ত। সবজানকে সে নিজের করে পেতে চায় এবং তার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। ক্ষেতের সেরা কামলা কেতাবদিকে কিল-লাথি, চড়-ঘুষি মারলেও কথা ছিল, চুরির অপরাধ দিয়ে দারোগা ডেকে ধরিয়ে দেয়। সামন্ত-মহাসামন্তরা যেভাবে মানুষকে চুষে খায়, শুষে খায় রক্তচোষার মতো, সেভাবেই সাম্রাজ্যবাদ নিষ্পেষিত করে এবং সেখান থেকে পরিত্রাণের কোনো রাস্তা নেই। গ্রাম্য অর্থনীতি একশ্রেণির হাতে মজুদ। তারাই নিয়ন্ত্রণ করে সমাজের আর দশজনের ভাগ্যকে, শ্রেণিহীন মানুষকে গিনিপিগ বানিয়ে উপর্যুপরি নির্যাতন করে মানসিক-শারীরিকভাবে এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিকভাবে।

‘নয়ান ঢুলী’ গল্পের প্রধান চরিত্র নয়ান। সে ঢোল মেরামতের কাজ করে জীবিকা চালায়। তার এ-পেশায় দিনদিন রোজগারপাতি কমে আসছে, কারণ আগে হাতে খুব কাজ আসত, বারোয়ারি মন্দিরের কাজ, চৈত্রসংক্রামিত্মর কাজ, গাঁয়ের যাত্রা পার্টির কাজ, তাছাড়া ভাসান-গাজির গান, তিননাথের মেলা, রামনামের আসর থেকেও তার ডাক আসত। ঢোল মেরামতের বায়না, দিনদিন সব কেমন হয়ে গেল। পরিবর্তন হলে একশ্রেণির মানুষের পেটে যে টান পড়ে তার একটা ইঙ্গিত স্পষ্ট দেখা যায়। তাই আজকাল কাজ পেলে নয়ানের মন ভরে, হাতে যেন সোনার তাল পায়, চোখে অনেক স্বপ্ন গিজগিজ করে, দুঃখ-সুখের দিনগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকে। হতভাগ্য একজন মানুষের জীবনের কাহিনি গাল্পিক অত্যন্ত দরদের সঙ্গে চিত্রায়িত করেছেন। দারিদ্র্য মানুষকে কুরে-কুরে নিঃশেষ করে। আজ নয়ানের ঘরবাড়ি মানে ওই জড়াজীর্ণ ঝুপড়ি, সাথি-সঙ্গী সব মরে গেছে। শুধু ওই ছাগল টেপীকে নিয়েই সংসার! বারান্দায় বসে হুককুর-হুককুর কাশে আর কাজকর্ম দেখে। ওর এককালের সাগরেদ পচাই। তার দুঃখ-দুর্দশার কথা শোনায়। নয়ানের স্বতন্ত্র একটা জীবন ছিল। মানুষের বাড়িঘর নির্মাণ ওর পৈতৃক পেশা। নয়ান ঘরামির ডাকনাম ছিল দেশগাঁয়ে। একবার হারান পরামানিকের বাড়িতে কাজ করে চারদিন; কিন্তু টাকা দিতে চায় না। বলে, টাকা নাই, কাল নিও… নয়ান জানায়, বাড়িতে চাল নাই, তবু হারান নাছোরবান্দা ফিরিয়ে দেয়। ঘরে মেয়ে জরিপোশ ক্ষুধায় কাতর, ওর মা জ্বরে অজ্ঞান। ঘরে চাল নেই, বার্লি নেই, ডাক্তারও পয়সার অভাবে আসে না। দিশেহারা নয়ান শীতেলের কাছে যায়, জেলের ঘুঘু শীতেল চোর, গরিবের প্রতি অগাধ ভালোবাসা। সিঁদকাটা চোর হলেও মানুষের কষ্ট বুঝত। নয়ানের কথা শুনে শীতেল বলল, কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকার জায়গাটা শুধু দেখিয়ে দিবি। সে-রাত্রে দুজনে হারানের বাড়ি চুরি করে। সকালে ডাক্তারের কাছে ফিসের টাকা নিয়ে গেলে ধরিয়ে দেয়। সারা গাঁয়ে হুলস্থুল কা-! বিচারে দুজনের ছয়-ছয় মাসের জেল হয়। জেল থেকে বের হয়ে জরিপোশ আর ওর মাকে দেখতে পায়নি নয়ান। মরে গেছে না-খেতে পেয়ে। সেই থেকে পিতৃপুরম্নষের পেশা ছেড়ে নয়ান ঘরামি হয়ে যায় নয়ান ঢুলী। কথা বলতে-বলতে চোখ ফেটে পানি ঝরে। সাগরেদ পচাই বলে, কাঁদলে হবে না, চলো আবার শিকারে। আমি নিজের হাতে করব, তুমি উঠে দাঁড়াও নইলে যে আমরা বাঁচব না। গল্পের শেষে দেখা যায়, শেষরাত্রের দিকে পচাই আসে নয়ানের বাড়ি। ঘন অন্ধকারে দুজন এগিয়ে যায় সামনে। আঁধারের গভীরতা ভয় জমিয়ে তোলে মানুষের মনে, তবু ওরা আঁধার ভেদ করে যেতে থাকে। আঁধারের চেয়ে ক্ষুধা বড় মারাত্মক। দারিদ্র্য মানুষকে ভীরম্ন করলেও উদ্যমী ও সাহসী করে তোলে কখনো। নয়ান ঢুলী সেই পিতা, যে তার মেয়ে জরিপোশকে ক্ষুধার অন্ন দিতে পারেনি। বউকে ওষুধ-পথ্য দিতে পারেনি, টাকার অভাবে বাড়িতে ডাক্তার আসেনি। মানুষের প্রতি মানুষের এই নির্মমতা-পৈশাচিকতা 888sport live footballিক সরদার জয়েনউদ্দীন সহজ-সরল ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন। মাটি-মানুষের এই মেলবন্ধন গল্পটিকে একটা যোগ্য আসনে উপনীত করেছে বলতে দ্বিধা নেই।

মায়ের নিকের পক্ষের স্বামী নসিব মিঞা, লোকে বলে কানাফকির, কোলটুও কানাফকির বলেই ডাকে, ‘কানা ফকিরের ব্যাটা’ গল্পে কোলটুর চরিত্রই নজর কাড়ে। ওর বাপ তোরাপ বেপারী, ব্যবসা-বাণিজ্য করত; মরিচ-পটোলের বেপারী ছিল। অথচ আজ সে কানাফকিরের বেদম মার খায়, কারণ ওর সঙ্গে ভিক্ষে করতে যায় না এই অপরাধে। কোলটু আর ওর মা এভাবে অত্যাচার সহ্য করতে-করতে কখনো সত্যিই প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। তবে কানাফকিরের হাজারো যুক্তি দিয়ে অপমান-অশ্রাব্য গালিগালাজ করে। একদিন কোলটু বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ওর বয়সী ছেলেরা স্টেশনে কুলিগিরি করে পয়সা রোজগার করে। চ্যারাগের সঙ্গে সেও কুলিগিরি করবে বলে মনস্থির করে। কানাফকিরের মতো ভিক্ষা বা পিরগিরি করে জীবন চালানো কোনো সম্মানের কাজ নয়। ওর মাও ভিক্ষাকে ঘৃণা করে। গল্পে দেখা যায়, একজন মানুষের মাথা উঁচু করে বাঁচার মধ্যে আছে অনেক তৃপ্তি-আনন্দ। সে-কথায় 888sport app download for android করিয়ে দেয়, কোলটুর ভেতর দিয়ে সভ্যতাকে দেখা যায়, জীবনের রং স্পর্শ করা সম্ভব হয়।

‘ফুলজান’ গল্পে একজন দশ বছরের বাবলুকে দেখা যায়, যার পিতা কবির মাস্টারের স্বপ্ন ছিল ছেলেকে গড়ে তুলবেন দেশের গৌরবের জন্য মানুষের মতো মানুষ করে। কিন্তু সে-স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গেল। হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হিসেবে কবির মাস্টারের গ্রামে একটা নামও ছিল। তাই সময়-অসময়ে রাত্রিদিন ডাক পেলেই কলেরা রোগীকে দেখে, রোগ দেখে একফোঁটা ডোজ দিয়ে আসতে হয়। শেষাবধি কলেরার আক্রমণে তাকেও চলে যেতে হলো একদিন আকস্মিকভাবে। বাবলু হলো এতিম, সেই বিয়ালিস্নøশ সালে নবীনগরের কবির মাস্টারের ভিটে ছেড়ে ফুলজান পেটের দায়ে ছলিম সরদারের ঘর করতে যায় দশ বছরের বাবলুকে নিয়ে চরসানিকদে। চোখে অনেক স্বপ্ন ছিল, একদিন দিন ফিরবে; কিন্তু সবই ভুল হলো। ছলিম কারণে-অকারণে মা-ছেলেকে অত্যাচার করতে থাকে। দিনে দু-চারবারও নির্যাতন চলে অতটুকু বাবলুর ওপর। করম্নণ চোখে তাকিয়ে থাকে আর বলে, মা-মা… ছলিম পাষ- মানুষ, হুঙ্কার আর মারমুখী ভাব সবসময়, সহ্য করতে পারে না ফুলজান ছেলের ওপর এত অত্যাচার। একদিন বাবলুকে বলে, আমি তোর মা নই। তোর মার নবীনগরের মাস্টারের বাড়িতে সমাধি হয়েছে। এখানে তোর কেউ নেই, মামুদের বাড়ি যা। তারপর আরেকদিন দুহাতে ঠেলে বের করে দেয় ছেলেকে। যাওয়ার সময় দুটো পামত্মা খেতে চেয়েছিল, তাও দেয়নি। বলেছিল, তোর পাতে ভাত আর উঠবে না। ঘরের বেড়া ধরে অনেক কেঁদেছিল বাবলু। তারপর বেরিয়ে যায়, কোথায় হারিয়েছে কেউ জানে না। লোকে বলে, মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে চাকরি দেবে বলে। ফুলজান সবই সহ্য করেছে। যেদিন ছলিম ওকে তালাক দিয়েছিল, সেদিনও মুখ বুজে স্বামীর ভিটে ছেড়ে আর্তনাদ করে বলেছিল, হায় অদৃষ্ট! গল্পে পাঠক একজন সংগ্রামী ফুলজানকে দেখতে পান, যে আজ ভাগ্যদোষে অন্যের বাড়ির ঢেঁকিপাড়ার ধানবারানি। ফুলজানের চেহারা-সুরত ভালো বলে নবীনগরের মাতবর রশিদ মিয়া রসিকতা করে নিকে করতে চেয়েছিল। একবার ভেবেছিল গেলেও মন্দ কী; কিন্তু মন সায় দেয়নি, বাবলুর অপেক্ষায় থাকবে। সে নিশ্চয় একদিন ফিরে আসবে; কিন্তু আবার মন বলে, সে কি সত্যিই আর ফিরে আসবে? যুদ্ধ তো কবে শেষ, তবে কি যুদ্ধের ময়দানে কোথাও হারিয়ে গেল? স্বপ্ন শেষ হলেও আশা নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে। ফুলজান সেই আশায় বুক বাঁধে। স্বপ্নহীন আশাহীন মানুষের জীবনের গল্প এভাবেই একটা অন্ধকার-বাঁকে এসে থিতু হয় অথবা হারিয়ে যায়। তারপরও ফুলজানেরা-বাবলুরা-কবির মাস্টারেরা বেঁচে থাকে মানুষের আকাঙক্ষায় আপন বৃত্তে।

সরদার জয়েনউদ্দীন এভাবেই প্রতি গল্পের ছত্রে-ছত্রে দাগ রেখে গেছেন, সে-দাগ আমাদের অনেক দূরে নিয়ে যায়। আমরা তন্ময় হয়ে তাকিয়ে থাকি তাঁর গল্পের কাহিনিমালার দিকে, গল্পের বাঁকে-বাঁকে এত জীবন্ত ছবি, তা যেন আমাদের জীবন বা পারিপার্শ্বিক ছবি, চিত্রায়িত হয়েছে বিশাল ক্যানভাসে, সত্যিকার 888sport live footballিকই তো সেই ক্যানভাসকে ফুটিয়ে তোলেন জগতের মুখোমুখি।