গিরিজা দেবী (১৯২৯-২০১৭)

গোলাম মুস্তাফা

 

ঠুমরি সম্রাজ্ঞী বিদুষী গিরিজা দেবী চলে গেলেন অক্টোবরের ২৪ তারিখ আটাশি বছর বয়সে। ঠুমরি-সম্রাজ্ঞী হিসেবে সমধিক পরিচিত হলেও ভারতীয় ধ্রম্নপদী সংগীতের সকল আঙ্গিকেই গিরিজা দেবী পারঙ্গম ছিলেন।

ভারতীয় সংগীতের এই কিংবদন্তি জন্মেছিলেন উত্তর ভারতের একটি গ্রামে, ১৯২৯ সালের ৮ মে তারিখে। তাঁর বাবা রামদেও রাই ছিলেন জমিদার। সংগীত শিখবেন বলেই উত্তর ভারতের জমিদারির কাজ ছেড়ে বেনারসে এসে বাস করতে থাকেন। চমৎকার হারমোনিয়াম বাজাতেন রামদেও রাই। পিতার সঙ্গে থেকে থেকে গিরিজারও আগ্রহ জন্মে সংগীতে। এই বেনারসেই গিরিজা দেবীর জন্ম, তাঁর জীবনের সিংহভাগ কেটেছে বেনারসেই। শেষ জীবন তাঁর কেটেছে কলকাতায়, কিন্তু বেনারস ছিল তাঁর হৃদয়জুড়ে। বেনারসের খাঁটি দুধ, মালাই ও পান তাঁর খুব প্রিয় ছিল। বেনারসের দুধের স্বাদ তিনি অন্য কোথাও পাননি। বেনারসের গঙ্গাতীর ছিল তাঁর প্রিয় বিচরণক্ষেত্র। গঙ্গার বালুময় তীরে সঙ্গীদের সঙ্গে খেলা করা, সাঁতার শেখা ও মাছ ধরায় খুব আনন্দ পেতেন বালিকা গিরিজা। তাঁর বাবা রামদেও রাই গিরিজাকে অনেকটা ছেলের মতোই গড়ে তুলতে চেয়েছেন। ঘোড়ায় চড়তে, সাঁতার কাটতে এমনকি লাঠিখেলা-কুসিত্মও শিখিয়েছেন। সেকালে মেয়েদের জন্য এসব ছিল অকল্পনীয়। অবশ্য মেয়েদের একটি খেলা তাঁর প্রিয় ছিল – পুতুল খেলা। বান্ধবীদের সঙ্গে মিলে পুতুল সাজিয়ে বিয়ে দিতেন।  মাছ ধরতে গিয়ে গিরিজা লক্ষ করতেন বেঁচে থাকার জন্য ধরা পড়া মাছগুলো কী অসম্ভব চেষ্টা করত। দয়াপরবশ হয়ে শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিতেন সেগুলো। গিরিজা বলেছেন, বাঁচার জন্য মাছের যে সংগ্রাম ও আকুতি তা তাঁকে নাড়া দিত। সেই আকুতি তিনি পরবর্তীকালে তাঁর সংগীতে অভিব্যক্ত করতে চেয়েছেন।

বেনারসে তখন সংগীতের চমৎকার পরিবেশ ছিল। শৈশবেই গিরিজা দেবী বেনারসের সংগীত-আবহের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেন। বেনারসে তখন চৌমুখী গানের আবহ। চৌমুখী বলতে গিরিজা দেবী বুঝিয়েছেন, চতুর্দিকে গানের পরিবেশ। বাবার সঙ্গে সংগীত আসরে গিয়ে অল্প বয়সেই উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ, রামপুর উস্তাদ মুশতাক আলী খাঁ, প–ত কৃষ্ণরাও শঙ্করের গান শুনেছেন সামনাসামনি বসে। ওঙ্কারনাথ ঠাকুর ছিলেন তখন বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর সংগীত তো শুনেছেনই, তাঁর সান্নিধ্যও পেয়েছেন। একবার উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ বেনারসের একটি মন্দিরে ললিত রাগে আলাপ করছিলেন। রাত তখন তিনটে বেজেছে। গিরিজা এই আসরে গিয়েছিলেন পিতার সঙ্গে। ফৈয়াজ খাঁর আলাপে স্বর প্রয়োগ শুনে গিরিজা বিস্মিত হয়ে গেলেন। বিস্ময়ে তাঁর চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। ফৈয়াজ খাঁ তা দেখে গিরিজাকে কাছে ডাকলেন। জানতে চাইলেন, ‘এই কন্যা কার?’ রামদেও এগিয়ে গিয়ে বললেন, ‘এ আমার মেয়ে।’ ফৈয়াজ খাঁ বললেন, ‘এই মেয়ের সংগীতবোধ তো অসাধারণ। এই বয়সেই সে স্বর প্রয়োগ শুনে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়ে!’ তখন গিরিজার বয়স সবে আট।

গিরিজা দেবী আপ্পাজি নামেও পরিচিত ছিলেন। পুতুলের শখ ছিল গিরিজার, আগেই উল্লেখ করেছি। বৃদ্ধ বয়সেও পুতুলের শখ ছিল অব্যাহত। তাঁর বেনারস ও কলকাতার ঘরে অনেক পুতুলের সংগ্রহ আছে। তাঁর এক বড় বোনের একটি পুত্র হয়েছিল, গিরিজার মনে হতো এই শিশুটি যেন পুতুলের মতোই। তিনি বোনকে বললেন, ‘পুতুল’টি তাঁকে দিয়ে দিতে। সেই শিশুর সঙ্গে সবসময়ে খেলতেন তিনি। ছয়-সাত মাস বয়সে বোনের ছেলের মুখে বোল ফুটতে শুরু করল। গিরিজাকে দেখলেই আপ্, আপ্পা বলত সে। গিরিজাও সায় দিতেন। গিরিজা ক্রমে সবার কাছে আপ্পা হয়ে উঠলেন। দেশে-বিদেশে তাঁর শিষ্য-অনুরাগীরা তাঁকে মাতৃজ্ঞানে ‘আপ্পাজি’ নামেই সম্বোধন করেন। ‘আপ্পা’ মানে মা।

গিরিজা দেবীর সংগীতে তালিম শুরু হয় পাঁচ বছর বয়সে, তাঁর পিতার সংগীতগুরু সারেঙ্গিবাদক প–ত সরযূপ্রসাদ মিশ্রের কাছে। সরযূপ্রসাদের কাছে তিনি খেয়ালসহ ধ্রম্নপদী সংগীতের বিভিন্ন আঙ্গিক সম্পর্কে শিক্ষালাভ করেন। ঠুমরি ও টপ্পাও শিখেছেন এই গুরুর কাছ থেকে। সরযূপ্রসাদের মৃত্যুর পর প–ত শ্রীচাঁদ মিশ্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

কন্যাকে সংগীত-শিক্ষা দেওয়ার ব্যাপারে রামদেওয়ের খুবই আগ্রহ ছিল। কিন্তু পরিবারের অন্যরা গিরিজার সংগীত শেখার বিষয়টি মেনে নিতে চাননি। বিশেষ করে গিরিজার মায়ের বেশ আপত্তি ছিল। তিনি সংগীত-শিক্ষাকে সময়ের অপচয় বলে মনে করতেন। পরবর্তীকালে অবশ্য তিনি গিরিজার সংগীত উপভোগ করতেন বেশ আনন্দ ও উৎসাহের সঙ্গে। স্বামী মধুসূদন জৈন সবসময়  গিরিজার সংগীতসাধনায় উৎসাহ ও সমর্থন জুগিয়ে গেছেন। মধুসূদন জৈনের সঙ্গে গিরিজার বিয়ে হয়েছিল পনেরো বছর বয়সে। গিরিজার চেয়ে কুড়ি বছরের বড় ছিলেন মধুসূদন। অসবর্ণ বিয়ে। বাড়িতে আপত্তি ছিল। এই পরিস্থিতিতে তাঁর সংগীতসাধনাও বছরখানেক বন্ধ ছিল। কিন্তু  888sport live football ও সংগীতের প্রতি মধুসূদনের অপরিসীম অনুরাগে মুগ্ধ হয়ে গিরিজা সব বাধা উপেক্ষা করে মধুসূদন জৈনকেই বেছে নেন জীবনসঙ্গী হিসেবে। বিয়ের আগে অবশ্য সংগীতসাধনা করতে দেওয়ার প্রতিশ্রম্নতি আদায় করে নিয়েছিলেন মধুসূদনের কাছ থেকে।

বিয়ের এক বছর পর গিরিজা ও মধুসূদনের ঘরে এক কন্যাসন্তান আসে। নবজাতিকার লালনপালন করে সংগীতের রেওয়াজ করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। সংগীতসাধনা অব্যাহত রাখার জন্য গঙ্গার অপর পারে সরনাথে একটি বৌদ্ধসত্মূপের পাশে গিরিজার জন্য একটি বাড়ির ব্যবস্থা করেন মধুসূদন। সেখানে একজন পরিচারিকা নিয়ে থাকতেন গিরিজা। কন্যাশিশুটিকে রেখে যান মায়ের কাছে। প্রতি বিকেলে স্বামী মধুসূদন ও গুরু শ্রীচাঁদ মিশ্র সারনাথে গিরিজার বাড়িতে যেতেন। নির্জন সেই বাড়িটি সংগীতসাধনার জন্য ছিল বেশ অনুকূল। এখানে শুরু হয় গিরিজার সংগীতচর্চার কঠোর তপস্যা। প্রতিদিন ভোররাত সাড়ে তিনটায় শুরু হতো রেওয়াজ। চলত ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গিরিজা দেবী এই এক বছরের অনলস ও গভীর চর্চাকে ‘আধ্যাত্মিক সাধনা’র সমধর্মী বলে উল্লেখ করেছেন। এই এক বছরে গিরিজার সংগীত-শিক্ষা অনেকটাই সম্পন্ন হয়। সুর ও স্বর সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধি গভীরতর  হয়। সংগীতের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে শুরু করেন।

অল্প বয়সেই তিনি খেয়াল, ধামার, ধ্রম্নপদ, তারানা, ভজন ও লোকসংগীতের তালিম পেয়েছেন। সেই সময়ে বেনারস হিন্দু ও মুসলমান ধ্রম্নপদী সংগীত888sport live chatীদের সাধনার ক্ষেত্র ছিল। গিরিজা দেবীদের বাড়ির কাছেই ছিল ‘কবীর চৌরা’। এই চৌরাতে বসেই  গিরিজা দেবীর পূর্বাপর অনেক 888sport live chatী – কান্থে মহারাজ, কিষণ মহারাজ, হনুমান প্রসাদ, বড়ে রামদাস, রাম সাহাই রাজন ও সাজন মিশ্রসহ অনেক গুণী সংগীতের সাধনা করেছেন। কবীর চৌরার সাংগীতিক পরিবেশ গিরিজার সংগীতসাধনায় বেশ প্রভাব ফেলেছিল।

গিরিজা দেবী হিন্দু-মুসলমান – এই উভয় সম্প্রদায়ের সাংগীতিক ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করেছিলেন নিরলস সাধনায়। বেনারস ও সেনিয়া ঘরানায় তালিম পেয়ে তিনি সম্পন্ন হয়ে উঠেছেন। জীবনব্যাপী সাধনাকালে তিনি সংগ্রহ করেছেন অনেক ঐতিহ্যবাহী বন্দিশ। তাঁর সংগীত এর ফলে অনেক সমৃদ্ধ ও বর্ণময় হয়ে উঠেছে। পূর্বী অঙ্গের ঠুমরি পরিবেশনে তিনি ছিলেন বিশেষভাবে পারদর্শী। অল্প বয়সেই গিরিজা দেবী পূর্বী অঙ্গের গায়কিতে তাঁর সামর্থ্যের স্বীকৃতি পেয়েছেন সিদ্ধেশ্বরী দেবীর মতো এই অঙ্গের প্রবাদপ্রতিম 888sport live chatীর কাছ থেকে। একবার রাসুলন বাঈ সিদ্ধেশ্বরী দেবীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আমাদের পর পূর্বী অঙ্গের গায়কির কী হবে?’ সিদ্ধেশ্বরী দেবী বললেন, ‘কেন আমাদের গিরিজা আছে না?’

গিরিজা দেবী প্রথম সংগীত পরিবেশন করেন মাত্র কুড়ি বছর বয়সে, ১৯৩৯ সালে, আকাশবাণীর এলাহাবাদ কেন্দ্রে। অবশ্য তারও দশ বছর আগে, ১৯২৯ সালে, তিনি একটি live chat 888sportে অভিনয় করেছিলেন। গিরিজার এক মামা ছিলেন কুসিত্মগির। তাঁর একটি আখড়া ছিল। live chat 888sportের পরিচালক-প্রযোজকগণ সেই আখড়া থেকে মারামারির দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য গিরিজার মামার শিষ্যদের নিয়ে যেতেন। একদিন একজন চিত্রপরিচালক গিরিজাকে দেখে তাঁকে live chat 888sportে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন। সে-যুগে অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে গায়ক-গায়িকাদের বেশ কদর ছিল। সেই কারণেই গিরিজা অভিনয়ের প্রস্তাব পেলেন। একজন অচ্ছুত কন্যার সংগ্রামের গল্প নিয়ে ছিল এই ছবিটি। ছবিটি শুরু হওয়ার আগে জববলপুরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন বসেছিল। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষচন্দ্র বসু, মাওলানা আজাদসহ বিশিষ্ট অনেক নেতাই ছিলেন। ছবিতে অভিনয় শুরুর আগে গিরিজা এই নেতৃবৃন্দের আশীর্বাদ নিয়েছিলেন।

এলাহাবাদ বেতারে গিরিজার প্রথম সংগীত পরিবেশনা বেশ সমাদৃত হয়েছিল। মাত্র কুড়ি বছর বয়সে সংগীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার সুযোগ পাওয়া সে-যুগে বেশ বিরল ছিল। গিরিজা দেবীর পারদর্শিতার জন্য সেই সময়েই দূরদর্শনের এলাহাবাদ কেন্দ্র থেকে তিনি বিসমিল্লাহ খাঁ, সিদ্ধেশ্বরী দেবী ও কান্থে মহারাজের সমান সম্মানী – নববই টাকা – পেয়েছিলেন। সেই সঙ্গে বেনারস থেকে এলাহাবাদ যাতায়াতের প্রথম শ্রেণির ট্রেন ভাড়া।

এর দুবছর পর, গিরিজা দেবী প্রথম শ্রোতাসমক্ষি সংগীত পরিবেশন করেন বিহারের আররাহে অনুষ্ঠিত সংগীত সম্মেলনে, ১৯৫১ সালে। সেই সম্মেলনে প–ত ওঙ্কারনাথ ঠাকুর ও কান্থে মহারাজও অংশগ্রহণ করেছিলেন। পথে গাড়ি খারাপ হওয়ায় প–ত ওঙ্কারনাথ সময়মতো পৌঁছুতে পারেননি। তাঁর জায়গায় গিরিজা দেবীকে গাইতে বলা হলো। তিনি প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না। অনেক সাধাসাধির পর মঞ্চে উঠলেন। তাঁর অভ্যাসানুযায়ী শ্রোতাদের সম্ভাষণ জানিয়ে চোখ বন্ধ করে গাইতে শুরু করলেন। গাওয়ার পর চোখ মেলে দেখলেন, আড়াই হাজার শ্রোতা নিবিষ্ট হয়ে শুনেছেন গিরিজার পরিবেশনা। এঁরা সবাই ওঙ্কারনাথের গান শুনবেন বলেই এসেছিলেন, গিরিজা তাঁদেরই মন জয় করলেন। ১৯৫২ সালে তিনি কলকাতার সদারাঙ্গ সংগীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। পরে এই কলকাতাই তাঁর দ্বিতীয় আবাসভূমিতে পরিণত হয়।

বেতার888sport live chatী হিসেবে জীবন শুরু করলেও গিরিজার তালিম  ছিল অব্যাহত। সংগীত পরিবেশনের সঙ্গে শিক্ষাও চলতে থাকে। স্বামীর উৎসাহে ও সহযোগিতায় ভারতের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠিত সংগীত সম্মেলনেও অংশগ্রহণ করতে থাকেন তিনি। এসব সম্মেলনে রবিশংকর ও আলী আকবর খাঁর সঙ্গে সংগীত পরিবেশন করতে থাকেন গিরিজা। রবিশংকর ও আলী আকবর খাঁর সঙ্গে গিরিজা দেবীর সম্পর্ক ছিল বেশ সৌহার্দ্যপূর্ণ। অনেকটা এক পরিবারের সদস্যের মতোই ছিলেন তাঁরা। গিরিজা দেবীকে বিভিন্ন সংগীত সম্মেলনে নিয়ে গেছেন মধুসূদন জৈন। কিন্তু কোনো ঘরোয়া অনুষ্ঠানে গিরিজা সংগীত পরিবেশন করুন – মধুসুদন জৈন সেটি চাননি। গিরিজাও স্বামীর এই ইচ্ছাকে মান্য করে গেছেন।

স্বামীর প্রেরণায় এবং নিজের সাধনায় গিরিজা দেবীর সাংগীতিক  প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি প্রসারিত হতে থাকে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে মধুসূদন জৈনের আকস্মিক মৃত্যুর ফলে গিরিজার জীবনে সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। মধুসূদন যতদিন ছিলেন, সংসার দায়িত্ব নিয়ে গিরিজাকে খুব একটা ভাবতে হয়নি। সংগীতচর্চা ও সাধনায় যাতে গিরিজা একাগ্র হতে পারেন, সেজন্য সংসারের সবকিছু সামলেছেন মধুসূদন জৈন। স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর ওপরই এসে পড়ে সংসারের সব কর্তব্য পালনের ভার। তাঁর সংগীতচর্চায় ছেদ পড়ল। এক কঠিন দুঃসহ জীবনের মুখোমুখি হলেন গিরিজা দেবী।

এই অবস্থায় কয়েক বছর কেটে যায়। গুণগ্রাহী ও শুভানুধ্যায়ীরা গিরিজার এই অবস্থা মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের চেষ্টায় ও বারবার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত তিনি আবার সংগীত পরিবেশনায় ফিরে আসেন। তখন গিরিজার মনে হয়েছিল, সংগীতই তাঁর নিয়তি। অবস্থা যা-ই হোক না কেন, সংগীতকে অাঁকড়ে ধরেই তাঁকে বাঁচতে হবে।

তবে ক-বছরে গিরিজার ভাবান্তর হয়েছে। সাংসারিক কর্তব্য পালনের কঠিন অভিজ্ঞতা তাঁকে কিছুটা দার্শনিক-ভাবনায় মগ্ন করে ফেলে। ঈশ্বরচিন্তায় অনেকখানি আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন তিনি। কৃষ্ণ-আরাধনায় তিনি প্রশান্তি খুঁজতে থাকেন। তাঁর সংগীতেও এর প্রভাব পড়ে। জীবনের প্রতি আসক্তি ও নিরাসক্তির দ্বন্দ্ব তাঁকে উদ্বেল করে তোলে। তাঁর সংগীতে ইন্দ্রিয়জ বিষয়াদিও গভীর আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনায় রূপান্তরিত হয়ে ওঠে।

সংগীতকে আরো গভীরভাবে বুঝতে ও পরিবেশন করতে চাইলেন তিনি। সংগীতে বাণীর গুরুত্বের প্রতি মনোযোগী হলেন। ‘রস’ বা আবেগের যথাযথ প্রকাশ তাঁর সংগীতের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল। গিরিজার ঠুমরিতে কৃষ্ণ-কাহিনির প্রাধান্যই বেশি। এই ঠুমরি নিয়ে শুরু হলো তাঁর নানা পরীক্ষা ও উদ্ভাবন-প্রয়াস। ঠুমরিকে একটি নতুন রসে ও রূপে সাজাতে চাইলেন তিনি। ভাবলেন, ঠুমরিই হতে পারে তাঁর সাংগীতিক অভিব্যক্তির উপযুক্ত মাধ্যম। প্রেমের নিবেদন ও আকুতি যেন  ঠুমরিতেই বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। সুরের সুচারু প্রয়োগে বাণীর পরিস্ফুটনে সচেষ্ট হলেন তিনি। তাঁর মনে হলো, চিত্র888sport live chatের মতো গানেরও অবয়ব নির্মাণ করা সম্ভব। গিরিজা তাঁর শিষ্যদের বলতেন, ‘বাণীকে সুরে বিন্যস্ত ও ব্যাখ্যা করার সময়ে রূপ ও রঙের কথা ভাববে, এর সঙ্গে তোমাদের অনুভব ও অভিজ্ঞতা দিয়ে একটি চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করবে।’

লোকগীতিকে ধ্রম্নপদীরূপে পরিবেশনের চেষ্টাও শুরু করলেন গিরিজা। রাধা-কৃষ্ণ প্রেমের প্রচলিত রূপকগুলোকে নতুনভাবে সাজিয়ে পরিবেশন করতে চাইলেন তিনি। ঠুমরি পরিবেশনায় বাণীর সাবলীলতা ছিল তাঁর কাম্য। সুরের দোলায় বাণী আন্দোলিত না হলে, তাঁর মতে, ঠুমরির প্রকৃত রস পাওয়া যায় না। তিনি বলতেন, ‘উয়োহ ঠুমরি হি কিয়া, জিসমে শব্দ্ ঠুমককে না নিকলে (শব্দ  নেচে না উঠলে কি আর ঠুমরি হয়)?’

নতুনভাবে সংগীতজীবনে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই গিরিজা দেবী সংগীতরসিকদের কাছে আদৃত হতে থাকেন। খেয়াল, দাদরা, চৈতী, ঝুলা ও ঠুমরি পরিবেশন করে তিনি শ্রোতাদের হৃদয়াসন অধিকার করে নেন। তবে ঠুমরি888sport live chatী হিসেবেই তিনি প্রধানত স্বীকৃত হন। গিরিজা দেবী ঠুমরি ও দাদরাকে খেয়ালের মতোই উত্তর ভারতীয় ধ্রম্নপদী সংগীতের আত্মারূপ বিবেচনা করতেন। কাজরী-ঝুলার বাণী ও সুর-বৈশিষ্ট্যকে তিনি বেনারসি সংগীতের অনন্য সম্পদরূপে  আখ্যায়িত করেছেন। এই সব ধরনের সংগীতেই তাঁর আগ্রহ ও পারঙ্গমতা ছিল প্রশ্নাতীত। তবে ঠুমরিতেই যেন এই সংগীত-দেবীর অধিষ্ঠান। ঠুমরির বর্ণবৈভব তাঁর কণ্ঠে যেন দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। খেয়াল ও ঠুমরির পার্থক্য সম্পর্কে গিরিজার একটি তুলনা এই প্রসঙ্গে 888sport app download for android করা যায় :

‘খেয়াল হলো একটি জমিতে রোপণ করা ধান বা গমের বীজের মতো। সেখান থেকে ধান বা গমই উৎপন্ন হবে। কিন্তু ঠুমরি হচ্ছে বহু পুষ্পশোভিত বাগানের মতো। মানবমনের বিভিন্ন অনুভূতির রঙে রাঙানো সেই ফুলবাগান। একজন গায়ক সেই বাগানের নানা বর্ণ ও গন্ধের সমন্বয়ে, নানা রাগের বুননে ঠুমরি পরিবেশন করেন। অবশ্য রাগের সমন্বয় যথাযথ হওয়া চাই।’

ঠুমরি পরিবেশনায় গিরিজা একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। ভাবের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সাবলীল কুশলতায় পরিবেশন করতেন ঠুমরি। কোনো একটি রাগে – খামাজ বা ভৈরবীতে ঠুমরি গাওয়ার সময়ে হয়তো সেই রাগ থেকে কিছুটা বেরিয়ে গেলেন। ঠুমরিতে 888sport live chatীর এই স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু আবার মূল রাগে ফিরে আসতেন তিনি অবলীলায়। হিন্দুস্তানি রাগ নিয়ে জীবনব্যাপী সনিষ্ঠ সাধনার ফলেই গিরিজা আয়ত্ত করেছিলেন এই সাবলীলতা। তালের সঙ্গে তাল মেলাতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ঠুমরির প্রথমাংশ ‘লগ্গি’ যখন গাইতেন, তবলিয়ার সঙ্গে তাঁর মেলবন্ধন শুরু হতো তখনই। তার বোল-বানানা বা বোল বিস্তার করতেন অনায়াস পারদর্শিতায়। মুখভরা পান নিয়ে তাঁর বোলের বিস্তার ছিল মনোমুগ্ধকর। ঠুমরির অলংকার ছিল তাঁর অস্থিমজ্জায়। এই আঙ্গিকের গানে ইন্দ্রিয়জ আবেগের সঙ্গে আকুতি ও বিধুরতার যে অসাধারণ মিশ্রণ থাকে গিরিজার কণ্ঠ থেকে তা নিঃসৃত হতো ঝরনার মতো। তাঁর কণ্ঠসম্পদ ছিল অসাধারণ। মাধুর্যের সঙ্গে দার্ঢ্য – বজায় ছিল তাঁর কণ্ঠে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। শেষ জীবনেও যখন ঠুমরি পরিবেশন করেছেন, তখনো বয়সোচিত জরার কোনো গ্রাস তাতে অনুভূত হয়নি।

গানের ভাবকে শ্রোতাদের মনে সঞ্চারিত করতে পারতেন তাঁর পরিবেশনার জাদুতে। যখন মীরার ভজন ‘বালা, ম্যায় বৈরাগন হুঙ্গি’  (তোমার জন্য আমি এই জগৎত্যাগী বৈরাগিনী হব) গাইতেন, তখন শ্রোতারা যেন সংসারত্যাগী যোগিনীর আবেগের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেতেন। যোগিনীর সংসার-নিরাসক্তির আবেগ সঞ্চারিত হতো শ্রোতাদের মনে।

ঠুমরির একটি বৈশিষ্ট্য হলো – বাণী বা বোল বিস্তারের স্বাধীনতা। সুরের দোলায় বোলকে, বোলের আবেগকে প্রকাশ করা সহজসাধ্য নয়। কিন্তু ঠুমরি পরিবেশনকারীকে এই কাজটি করতে হয় অনায়াস সাবলীলতায়। একজন 888sport live chatী বোলের আবেগ ও তাৎপর্যকে নানাভাবে শ্রম্নতিগ্রাহ্য করতে পারেন। বিশেষ করে ‘বোল-বানাও’ ঠুমরিতে এই সাংগীতিক কারুকাজে 888sport live chatীর পারঙ্গমতা পরীক্ষেত হয়। গিরিজা ছিলেন এই কারুকাজের অসাধারণ এক 888sport live chatী। তাঁর কণ্ঠে একই সঙ্গে পরিবেশিত হতো ভাবের নানা অনুষঙ্গ। তাঁর গানে, বিশেষত ‘পুকার’ পরিবেশনার সময় মনে হতো সংগীতের বুঝি মুক্তি ও বিস্তার ঘটেছে। ভাষা-সংস্কৃতির সীমানা পেরিয়ে তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।

গিরিজা দেবীর সংগীতের অনুরাগী ছিলেন সর্বশ্রেণির মানুষ। ১৯৫২ সালে বেনারসে এক সংগীত সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন গিরিজার স্বামী মধুসূদন জৈন। এই সময়ে রবিশংকর গিরিজার গান প্রথম শোনেন। ওই বছরেই দিলিস্নর সংবিধান ক্লাবে দেশের রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের বড় বড় নেতার জন্য একটি ঘরোয়া জলসার আয়োজন করা হয়েছিল। রবিশংকর উদ্যোক্তাদের বললেন গিরিজা দেবীকে সেই আসরে আমন্ত্রণ জানাতে। দেশের রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ও প্রধানমন্ত্রী নেহরু আসতে পারেননি অনুষ্ঠানে। তবে উপরাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণ ও সরোজিনী নাইডুসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সেখানে উস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ ও প–ত পি. ভি. পুলস্করের সঙ্গে গিরিজা দেবীরও গাইবার সুযোগ হলো। প্রত্যেকের জন্য সময় বরাদ্দ ছিল কুড়ি মিনিট। একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন গিরিজা, ভাবছিলেন কী গাইবেন। রবিশংকর পরামর্শ দিলেন, ‘তুমি পাঁচ সাত মিনিট একটি টপ্পা গাও, পরে একটি ঠুমরি গেয়ে কুড়ি মিনিট কাটিয়ে দিও।’ গিরিজা আঠারো মিনিটেই শেষ করলেন টপ্পা ও ঠুমরি। মঞ্চ থেকে উঠতে যাবেন, এমন সময় রাধাকৃষ্ণণ তাঁকে ইশারা করে আরো গাইতে বললেন। গিরিজা গাইতে চাইছিলেন না। সঙ্গী বাদককে বললেন, ‘আমি গাইতে শুরু করলে সবাই উঠতে শুরু করবে।’ তাঁর জানা ছিল না, মাইক তখনো সচল ছিল। তাঁর কথা রাধাকৃষ্ণণ শুনে ফেললেন। ইশারায় জানালেন, তিনি উঠে যাবেন না। গিরিজা খামাজ রাগে শুরু করলেন একটি ঠুমরি – ‘মোহে কাল না পড়ত চিন রাধা পিয়ারি বিনা’। চোখ বন্ধ করে গাইতে শুরু করলেন। সময়ের কথা মনেই রইল না। প্রায় চলিস্নশ মিনিট ধরে গাওয়ার পর চোখ মেলে দেখলেন অনুষ্ঠানগৃহের কোনো শ্রোতাই উঠে যাননি। পরদিন সংবাদপত্রে পিতা ও গুরুসহ গিরিজার ছবি বেরোলো। সেই দিনের মতো খুশি আর কখনো হননি গিরিজা দেবী।

একবার দুর্গাপুজোর সময়ে বিহারের দ্বারভাঙ্গা প্রদেশের একটি গ্রামে গাইতে গেছেন গিরিজা দেবী। অনুষ্ঠানে একজন 888sport live chatী  আসতে পারেননি বলে তাঁকে বলা হলো সেই 888sport live chatীর জন্য নির্ধারিত সময়ে গাইতে। তখন রাত তিনটে। গিরিজা দেবী স্নান ও পুজো না করে কখনো গাইতেন না। সেই রাতে উঠে স্নান-পুজো সেরে যখন অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হলেন, তখন দেখলেন সেখানে কোনো শ্রোতা নেই। কয়েকজন কর্মী ও তবলাবাদক কমলেশ্বরনাথ মিশ্রই শুধু আছেন। মঞ্চে একদিকে দুর্গা ও অন্যদিকে শিবের ছবি ছিল। গিরিজা ভাবলেন, এই দুজনই যোগ্য শ্রোতা হবেন তাঁর গানের। চোখ বন্ধ করে তিনি শুরু করলেন একটি খেয়াল। বিলম্বিত পর্ব শেষ করে, পঁয়ত্রিশ মিনিট পর, চোখ মেলে দেখেন অনুষ্ঠান-স্থান শ্রোতায় ভরে গেছে। চোখ ভরে গেল জলে। অনেক কষ্টে নিজের আবেগ দমন করে দ্রম্নত বন্দিশ শেষ করলেন। এরপর শুরু করলেন ওয়াজিদ আলী শাহ্র লেখা বিখ্যাত ঠুমরি ‘বাবুল মোরা নাইহার’। ভৈরবী রাগের ঠুমরিটি যখন শেষ করলেন তখন ভোরের আলো ফুটে গেছে। শ্রোতাদের করতালি ও প্রশংসায় সিক্ত হয়ে মঞ্চ থেকে নামার পর দেখলেন একজন সাধু তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে। গৌরবর্ণ, দীর্ঘ শ্মশ্রম্নশোভিত সাধুর হাতে একটি কম-লু (পানির পাত্র)। কোমরে ছিল একটি লাল রঙের গামছা। সাধু গিরিজাকে বললেন, ‘বেটি আমি অনেকের গান শুনেছি, কিন্তু তুমি আজ যা গেয়েছো সেরকম কখনো শুনিনি। আমার এই কমনদল ও গামছাটি তোমাকে দিচ্ছি, গ্রহণ করো।’

এই সময়ে পিতার একটি কথা মনে পড়ে গেল গিরিজার, ‘কখনো কোনো সাধুর কাছ থেকে কিছু নেবে না, বরং তাঁকে কিছু দেওয়ার চেষ্টা করবে।’ তিনি সাধুকে প্রণাম করে বললেন, ‘আমি আপনার এই দান গ্রহণ করতে পারব না। আপনি আমাকে আশীর্বাদ করুন।’ সাধুকে কিছু দেওয়ার জন্য ব্যাগ খুললেন। ব্যাগ থেকে সাধুর জন্য প্রণামি বের করে তাকিয়ে দেখেন সেই সাধু নেই। তিনি অনেক খুঁজলেন, পেলেন না। এই কথা খুব রটে গিয়েছিল। অনেকে বলতে লাগলেন, ‘এই সাধু ছিলেন সাক্ষাৎ শিব। তোমাকে কিছু দিতে চেয়েছিলেন। তুমি গ্রহণ না করাতে চলে গেলেন।’ এই সাধুর কথা গিরিজা কখনো ভোলেননি। তাঁর খোঁজ করেছেন জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত।

বিদেশি শ্রোতারাও গিরিজার গানের গুণগ্রাহী ছিলেন। একবার ফ্রান্সে তিনি শ্রোতাদের গান শুনিয়েছেন প্রায় সোয়া তিন ঘণ্টা ধরে। শ্রোতাদের সবাই ছিলেন ইউরোপীয়। কিন্তু পিনপতন নিস্তব্ধতায় তাঁরা গিরিজার গান উপভোগ করেছেন। গিরিজারও মনে হয়েছে, শ্রোতাদের সংগীত রসাস্বাদনের ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে গিরিজার কণ্ঠে মীরার ভজন শুনে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

ভারতীয় সংগীতকে নানাভাবে শ্রোতাদের কাছে উপস্থাপন করেছেন গিরিজা দেবী। তিনি যখন কবীর বা নানকের নির্গুণ ভজন গান তখন মধ্যযুগের অধ্যাত্ম-চেতনা মূর্ত হয়ে ওঠে শ্রোতাদের মনে। একরঙ মিয়া নামে একজন মুসলমান সাধক কবির ভজন গিরিজা প্রায়ই গেয়ে থাকেন। ভারতের নানা সাধন-ধারা সম্পর্কে গিরিজা নিয়মিত চর্চাও করে থাকেন। বেনারসে 888sport live footballিক ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর জানাশোনাও অসাধারণ। সংগীতসাধনার প্রয়োজনেই কিংবা বেনারসের ঐতিহ্যের কারণেই তিনি হিন্দি-উর্দু রপ্ত করেছেন ভালোভাবেই। ভারতীয় তো বটেই, পারস্যের সাংগীতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর জ্ঞান বেশ গভীর। গিরিজা দেবী গায়িকাই শুধু নন, একজন সংগীত-রচয়িতাও। তাঁর ঐতিহ্যবাহী দুর্লভ বন্দিশের সংগ্রহের কথা লিখেছি। তিনি নিজেও বন্দিশ রচনা করেছেন অনেক। তাঁর মাপের 888sport live chatীদের অনেকেই নতুন রাগ সৃষ্টি করেছেন। তিনি করেননি। তিনি বলতেন, ‘আমি নিজে রাগ সৃষ্টি করিনি। আমার গুরুদের সৃষ্টিগুলোকেই আমি সযতনে লালন করি, পরিবেশন করি।’ তিনি বেনারস ও সেনিয়া ঘরানায় তালিমপ্রাপ্ত। তাঁর কি কোনো ঘরানা আছে? এরকম প্রশ্ন করলে তিনি কৌতুক করে উত্তর দিতেন, ‘আমার ঘরানা তো ক্ষেত-খামার করা। গুরুদের ঘরানাই আমার ঘরানা।’ তবে তিনি না মানলেও তাঁর নিজস্ব একটি শৈলী গড়ে উঠেছে, তাকে একটি স্বতন্ত্র ঘরানা বললেও বেশি বলা হয় না।

গিরিজা দেবী কখনো live chat 888sportের জন্য গান করেননি কেন?  এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। উস্তাদ বড়ে গুলাম আলী খাঁ, উস্তাদ আমির খাঁ, প–ত পি. ভি. পুলস্কর live chat 888sportের জন্য গেয়েছেন। উস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁও সানাই বাজিয়েছেন। গিরিজা দেবী এর উত্তরে বলতেন, ‘live chat 888sportের জন্য গাওয়ার পর শ্রোতারা বিভিন্ন আসরে আমির খাঁ সাহেবের কাছ থেকে live chat 888sportে গাওয়া গানই শুনতে চাইতেন। বিসমিল্লাহ খাঁ সাহেবকে অনুরোধ করতেন গুঞ্জ উঠে শেহনাইয়ে বাজানো ধুন শোনাতে। এগুলো খুবই বিরক্তিকর। এ জন্যই আমি সিনেমায় গাইতে চাইনি, গাইনি।’

এই সংগীত-বিদুষী রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্মান-স্বীকৃতি পেয়েছেন অনেক। পদ্মশ্রী (১৯৭২), সংগীত-নাটক আকাদেমি 888sport app download bd (১৯৭৭), পদ্মভূষণ, (১৯৮৯), পদ্মবিভূষণ (২০১৬), মধ্যপ্রদেশ সরকারের তানসেন সম্মান, এলাহাবাদের প্রয়াগ সংগীত সমিতির সংগীত-শিরোমণি 888sport app download bdসহ অনেক 888sport app download bd পেয়েছেন তিনি। সম্মানসূচক ডক্টরেট উপাধিও পেয়েছেন। ঠুমরির জন্য বিখ্যাত হলেও সংগীত-নাটক আকাদেমি তাঁকে সম্মানিত করেছে খেয়াল গায়কিতে অসাধারণ সাবলীলতা ও পারঙ্গমতার জন্য। কিন্তু এসব পদক-888sport app download bd নিয়ে তাঁর কোনো উৎসাহ-আগ্রহ ছিল না। তিনি বলতেন, ‘888sport app download bd-পদক আসবে, চলেও যাবে। আসল কথা সংগীতকে বাঁচিয়ে রাখা। আমার শিষ্যরা যদি সংগীতের ধারাকে বাঁচিয়ে রাখে তবেই আমি পুরস্কৃত হব। আর সবচেয়ে বড় 888sport app download bd তো শ্রোতাদের ভালোবাসা।’ তাহলে পদ্মবিভূষণ গ্রহণ করলেন কেন? এর উত্তরে গিরিজা বলতেন, ‘আমি এই 888sport app download bd গ্রহণ করেছি আমার গুরুদের প্রতি 888sport apk download apk latest version জানানোর জন্য। তাঁদের শিক্ষা-আশীর্বাদেই তো আমি পুরস্কৃত হচ্ছি।’

স্বামী মধুসূদন জৈনের মৃত্যুর পর গিরিজার জীবনে বিষাদ নেমে এসেছিল। কোনো কাজেই উৎসাহ পাচ্ছিলেন না। এই অবস্থা থেকে তাঁকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করলেন প–ত বিজয় কিচলু। ১৯৭৮ সালে কলকাতায় সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। প–ত বিজয় কিচলু হলেন এর পরিচালক। তিনি গিরিজা দেবীকে আমন্ত্রণ জানালেন অ্যাকাডেমিতে যোগ দেওয়ার জন্য। গিরিজাকে বললেন, ‘আপনাকে বেনারস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’ সেই থেকে তিনি কলকাতাকেই তাঁর দ্বিতীয় আবাসভূমি হিসেবে গ্রহণ করলেন। কলকাতাকে তিনি ক্রমশ ভালোবেসে ফেললেন। সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে তাঁর তালিমে তৈরি হতে থাকল অনেক 888sport live chatী। গিরিজা বলতেন, ‘সংগীত রিসার্চ অ্যাকাডেমিতে আমি অনেক কিছুই পেয়েছি। ডালিয়া রাহুত, মহুয়া দাশগুপ্ত, মঞ্জু সুন্দরম, বীণাপাণি মিশ্রের মতো শিষ্যা পেয়েছি। এরাই আমার সাধনাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’ গিরিজা কিছুদিন বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়েও সংগীত-শিক্ষিকা ছিলেন। সেখানেও অনেক শিষ্য তৈরি করেছেন তিনি। তালিম দিয়ে অনেক শিষ্য-শিষ্যা তৈরি করলেও তাঁর নিজের পরিবারের কেউ এই উত্তরাধিকার বহন করছে না। তাঁর একমাত্র কন্যা সুধা দত্ত ওড়িশি নাচের 888sport live chatী। সুধা কেন সংগীতের ধারায় গেলেন না? গিরিজার স্বামী মধুসূদন জৈনই চেয়েছিলেন, সুধা যেন নৃত্য888sport live chatী হয়।

গিরিজা দেবী ছিলেন খুবই সাদাসিধে প্রকৃতির একেবারেই মাটির মানুষ যাকে বলে। মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত। মঞ্চে উঠে শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলতেন, ভাব জমাতেন। কিন্তু সংগীতে নৈরাজ্য তাঁকে রুষ্ট করত। সংগীতের বাণিজ্যায়নে বিরক্ত ছিলেন তিনি। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংগীতেও পরিবর্তন আসবে – এটা তিনি মেনে নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আশাবাদী। শুদ্ধ সংগীতের ধারা কখনো শুষ্ক হবে না – এই বিশ্বাস তাঁর ছিল।

সংগীত নিয়ে তাঁর গবেষণা ও উদ্ভাবন-প্রয়াস চলেছে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত। তাঁর ভাষায়, ‘আমি যখন সংগীত নিয়ে গবেষণা করি তখন স্বর এবং স্বরসৃষ্ট সংগীতের নেশায় আমি বুঁদ হয়ে যাই। সংগীত আমার কাছে একটি মহাসমুদ্রের মতো। এই মহাসাগরে আমি পরমানন্দে সাঁতার কেটে বেড়াই। জীবনব্যাপী আমি সংগীতেই অবগাহন করতে চাই।’

আজীবন সংগীত মহাসাগরেই অবগাহন করেছেন তিনি। বয়সের ভার তাঁকে সিত্মমিত করতে পারেনি। তিনি বলতেন, ‘এই বয়সে যদি আমি চলাফেরা-খাওয়াদাওয়া করতে পারি, গাইতে পারব না কেন?’ 888sport appsে বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উচ্চাঙ্গসংগীত সম্মেলনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন তিনি। মনে পড়ে একবার মঞ্চে উঠে বললেন, ‘আমি অসুস্থ। আমার শিষ্যারা আমাকে গাইতে মানা করেছিল। মগর ম্যায় গাউঙ্গি।’ তিনি যখন গাইতে শুরু করলেন, অসুস্থতার কোনো রেশ শোনা গেল না তাঁর কণ্ঠে। স্পষ্ট ও সাবলীলভাবে গেয়ে গেলেন।

গিরিজার স্বপ্ন ছিল, কলকাতা থেকে ফিরে গিয়ে বেনারসে বড় একটি জায়গা নিয়ে গড়ে তুলবেন আশ্রমের মতো একটি সংগীত- বিদ্যালয়। গুরুকুল-পরম্পরায় সেখানে সংগীতের তালিম নেবে প্রকৃত সংগীত-অনুরাগী শিক্ষার্থীরা। নিজের পাঁচ বিঘে জমি ছিল, আরো কিছু জমি নিয়ে গড়তে চেয়েছিলেন তাঁর স্বপ্নের সেই আশ্রম-সংগীত বিদ্যালয়। সেই ইচ্ছা তাঁর পূরণ হয়নি। মানুষের সব স্বপ্ন কি পূরণ হয়?

বেনারস ঘরানা বা পূর্বী অঙ্গের মহান 888sport live chatীরা একে একে চলে গেলেন। প–ত কিষণ মহারাজ, উস্তাদ বিসমিল্লাহ খাঁ, হনুমান মিশ্র, সিতারা দেবী – সবাই পাড়ি জমিয়েছেন ওপারে। গিরিজা দেবীও চলে গেলেন। সংগীতজগতের জন্য এ এক অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু এই গুণী 888sport live chatীরা সংগীতের যে-ধারা সৃষ্টি করে গেছেন তা ম্রিয়মাণ হওয়ার নয়। গঙ্গার মতোই প্রবাহিত হয়ে গিরিজা দেবীর সংগীত পৌঁছে যাবে আগামী প্রজন্মের সংগীতপিপাসুদের কাছে। r