মূল : আবরার মোজীব
888sport app download apk latest version : জ্যোতির্ময় দাশ
ই দানীং প্রায়ই আমার সম্পর্কে চারদিকে নানান গুজব ছড়িয়ে পড়ার কথা শুনতে পাওয়া যায়। এসব মিথ্যে রটনা কে যে ছড়ায় তার কিছুই আমি ঠিকমতো বুঝতে পারি না, আর কেন যে ছড়ায় তারও কোনো হদিস পাই না আমি। অন্যের হেঁশেলের খবর টেনে বের করতে যারা ভালবাসে তারাই আমাকে নিয়ে এসব গুজবের কথা বাড়িতে এসে আমায় শুনিয়ে যায়। কেবল শুনেই নিস্তার নেই আমার, গাদা-গাদা প্রশ্নবাণ ছুটে আসে তারপর আমাকে লক্ষ করে, যেমন : ‘কী ব্যাপার বলুন তো, দাদা?’, ‘পরিবেশটা এমন খারাপ হয়ে ওঠার কারণ কী মশাই?’, ‘এমন কাজ তুমি করলে কেন ভাই?’, ‘এই জটিলতা কাটিয়ে ওঠার উপায় কী হবে এখন?’, ‘এই মুশকিল থেকে কীভাবে বেরিয়ে আসতে চাও তুমি?’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনসব প্রশ্ন শুনে প্রাথমিকভাবে আমি বেশ ঘাবড়ে যাই; সারাশহর যে আমার সম্পর্কে এমন একটা আগাম ধারণা করে বসে রয়েছে, সে-সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। তার ওপর আবার এসব প্রশ্নের ঝড়! এই বিচিত্রসব গুজবের সঙ্গে আমার কোনোভাবেই বিন্দুমাত্র যোগাযোগ ছিল না যখন, তাহলে কীভাবে আমি প্রশ্নগুলোর উত্তর দেবো?
সাতদিনও হয়নি হঠাৎ এক রহস্যজনক নিসন্তব্ধতার ঘেরাটোপে শহরটা যেন 888sport app পড়ে গেল। রাস্তায় মানুষজন একে অন্যকে এড়িয়ে যেতে লাগল। একটা অদ্ভুত অবিশ্বাস আর সন্দিগ্ধতার আবহাওয়া ছেয়ে আছে। এই আবহাওয়া একটু একটু করে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছিল এবং এই বেড়ে ওঠার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছিল না। আমি এ-ব্যাপারটা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছিলাম, সে-সময়ে হঠাৎ আমার এক পরিচিত ব্যক্তি আমাকে বাড়িতে এসে বলে গেল যে, শহরের অবস্থার অবনতির জন্য আমি নাকি দায়ী। ‘আমিই একমাত্র কারণ!’ আমি হতভস্ব হয়ে গেলাম। শহরের এমন অভূতপূর্ব এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী অবস্থার জন্যে আমি কীভাবে দায়ী হতে পারি? আমি তো একজন নিতান্তই সাধাসিধে হরিপদ কেরানি, যে রোজ সকালে নিয়মমতো অফিসে যায়, বিকেল পর্যন্ত ফাইলের সত্মূপের মধ্যে ডুবে থেকে সন্ধ্যায় ক্লান্ত-পায়ে বাড়ি ফিরে আসে। হ্যাঁ, অবশ্যই এক-একদিন ফেরার পথে বাজার থেকে সবজি, ফল আর মিষ্টি কিনে আনি। বাড়ি ফিরে এসে হাত-পা ধুয়ে এক কাপ চা নিয়ে সকালবেলার খবরের কাগজ হাতে বারান্দায় রাখা চেয়ারে এসে বসি। সেদিন সেই পরিচিত লোকটি, যে আমাকে বলেছিল, শহরের এই বিচিত্র অবস্থা আমার জন্যই ঘটেছে, সে আবার আমার কাছে এলো।
‘দাদা, এ কী কথা বলছেন আপনি?’
‘হ্যাঁ’ – সে আমার একান্ত কাছে এসে ফিসফিস করে জানাল, ‘সকলেই আপনার কথা বলাবলি করছে।’
‘আমার কথা বলছে সকলে?’ আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম। তারপর জানতে চেয়েছিলাম, ‘কিন্তু এ-ব্যাপারে আমাকে কীভাবে জড়াচ্ছে সকলে?’ ‘সকলে বলছে যে, আপনি নাকি বাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে যেতে চান, আর সে-কথা আপনি সকলের সামনে জোরগলায় বলেছেন!’ সে বেশ বিশ্বাসযোগ্যভাবে বলে। ‘আমি কোনোদিন ও-কথা বলিনি কাউকে, আর যদি বলেও থাকি তার সঙ্গে এই শহরের এভাবে থম মেরে চুপচাপ হয়ে যাওয়ার কী সম্পর্ক?’
‘তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আপনার ওই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে শহরের আবহাওয়া বদলের কোনো সম্পর্ক নেই?’ লোকটি নিচু চাপাস্বরে কথা বলে। ‘আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার বিষয়ে কারো সঙ্গে কোনো কথা বলিনি, আমি জানি না কে এ গুজব রটাচ্ছে! আর ঈশ্বরের দোহাই, আমার মত একজন সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত সিদ্ধাস্তে একটা শহর এভাবে প্রভাবিত হতে পারে কীভাবে?’ আমি বিহবলভাবে বলি।
কিন্তু আমি আমার এই ক্ষোভের কথা উচ্চারণ করার সঙ্গে-সঙ্গে লোকটি যেন আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে ওঠে, ‘কী ধরনের লোক আপনি মশাই? আপনার বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধাস্তের সরাসরি প্রভাব পড়েছে অন্যদের ওপরে। আপনার আশপাশের প্রতিবেশীরাও সকলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে।’
‘আমি এমন যুক্তির মধ্যে কোনো সারবত্তা খুঁজে পাচ্ছি না। মিছিমিছি আমার নামে কলঙ্ক দেওয়া হচ্ছে।’
‘না, কেউ আপনার নামে কোনো কলঙ্ক লাগাতে চাইছে না’, লোকটি বলে ওঠে, ‘তারা মনে করছে আপনি ভেতরের খবর জানেন। কী ঘটতে চলেছে আপনি আগাম তার খবর রাখেন!’
সত্যি কথা বলতে কী, আমার মনে হয় না আমি ভেতরের গোপন তত্ত্বকথার সুলুক-সন্ধান কিছু জানি, কিন্তু এ-কথা সত্যি যে, অকারণে নিগৃহীত হওয়ার অন্তরের যন্ত্রণার কষ্টটা আমি অনুভব করতে পারি। তবে আমার সামনে বসে থাকা লোকটির জন্য আমার এই মানসিক যন্ত্রণাটা ক্রমশ চাপা ক্রোধে পরিণত হতে থাকে। কারণ, আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, আমি কারো কাছেই এ-ধরনের কোনো কথা বলিনি। ভেতরের রাগটাকে একসময় দমন করে আমার মনে হলো এই লোকটার কোনো দোষ নেই, তাছাড়া ও তো শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকা গুজবের কথা অন্যের মুখ থেকে যেমন শুনেছে, সে-কথাই বলতে এসেছে। আমাদের কথাবার্তা আরো আধঘণ্টা চলার পর ঠান্ডা হয়ে যাওয়া জঘন্য চায়েতে শেষ চুমুক দিয়ে আমি লোকটিকে বিদায় করলাম। যে-খবর সে আমাকে শুনিয়ে গেল, তা যে-কোনো মানুষকে আতঙ্কিত করার পক্ষে যথেষ্ট। সে জানাল যে, আমার ওই তথাকথিত বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর দুদিনের মধ্যেই বাজারের কাছের মাঠে একটা মিটিং ডাকা হয়, সে-মিটিংয়ে সাধুসন্তরা ছাড়াও বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাও যোগ দিয়েছিল। সেই মিটিংয়ের পর শহরের 888sport app অঞ্চলের লোকজন বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। সে খুবই অবাক হয়ে গিয়েছিল যে, সকলকে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে দেওয়ার পরও আমি কেন আজো যাইনি, যদিও শহরের অবস্থার আরো অবনতি ঘটে গেছে। শহরের লোকদের মধ্যে যে পাগলের মতো আচরণ শুরু হয়েছে তা দেখে আমার মনে হল যে, আমি হয়তো সত্যি-সত্যিই কাউকে কথাটা বলেছিলাম, কিন্তু আমার কিছুই তার মনে পড়ছে না। আমার মনে পড়ার তো কথাই নয়, কারণ শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো বাহ্যত কোনো কারণই ঘটেনি। আমি একশভাগ নিশ্চিত যে, আমি কাউকে এমন কথা বলিনি, এমনকি আমার নিজের পরিবারের লোকদেরও নয়।
আমি বেশ আরাম করে চেয়ারে বসে একটা সিগারেট ধরিয়ে মৌজ করে টানতে থাকি। মুখ থেকে গলগল করে সিগারেটের ধোঁয়া বেরোতে দেখে আমার বহুকাল আগে দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যায়, যাতে আমি গভীর ঘন মেঘের মতো ধোঁয়া দেখেছিলাম। সেই ধোঁয়ার মেঘ মনে হলো পৃথিবীর জমি থেকে উঠে আসছিল আর ঘন ধোঁয়ার আচ্ছাদনের মধ্যে বাড়িঘর আর মানুষজনকে খুব ঝাপসা লাগছিল। সে-সময়েই আমি মনস্থির করেছিলাম এই বাড়ি ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো সুরক্ষেত জায়গায় চলে যাব। এখন প্রশ্ন হল, স্বপ্নের মধ্যে গ্রহণ করা কোনো সংকল্পকে অন্য কেউ কী করে জানতে পারে? আমি দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি, আমার স্বপ্নে নেওয়া এই গোপন সিদ্ধান্তটিকে আমি কখনো প্রকাশ্যে আসতে দিইনি।
শহরের এই অদ্ভুত পরিস্থিতির জন্য আপাতদৃষ্টিতে আমিই যে দায়ী এ-চিন্তায় আমি বেশ উৎকণ্ঠায় পড়ে যাই। আমি ভাবতে শুরু করি, কীভাবে এই ঝঞ্ঝাট থেকে শহরকে মুক্ত করতে পারা যায়। আমি কি নতুন করে ঘোষণা করব যে, আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার কোনো বাসনা নেই, কিন্তু তাতে বোধহয় আর কোনো লাভ হবে না, কারণ এখন আমার নামটা হাজার-হাজার গুজবের সমুদ্রের তলায় ডুবে গেছে। লোকজন এখন ভিড় করে জমায়েত হয়েছে; শহরের বিভিন্ন এলাকার লোকজন বাড়ি খালি করে চলে যাওয়ার নেশায় মেতে উঠেছে। তাহলে এখন কী করা যায়? বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করে আমি একটা সিদ্ধাস্তে এসে পৌঁছলাম। স্থানীয় থানায় গিয়ে আমি পুলিশকে জানাব যে, আমাকে নিয়ে যে-খবরটা শহরে এমন আলোড়ন ফেলেছে সেটা ভয়ংকরভাবে একটা গুজব, আমি শহরের ওই অঞ্চলে আমার বউ-বাচ্চাদের নিয়ে এখনো বাস করছি। এ-সিদ্ধান্তটা আমার বেশ যুক্তিসংগত বলে মনে হলো। আমি তড়িঘড়ি স্থানীয় থানায় চলে যাই।
‘কী ব্যাপার আপনার?’ ইন্সপেক্টর খুব সন্দিগ্ধভাবে আমাকে লক্ষ করতে-করতে প্রশ্ন করেন।
‘আমি নিজের ব্যাপারে একটা স্বীকারোক্তি করতে চাই।’ ঠিক কী করে যে কথাটা শুরু করব বুঝতে পারি না আমি।
‘আপনি কি কোনো অভিযোগ জানাতে চান?’
‘না স্যার, আমি নিজের ব্যাপারে একটা স্বীকারোক্তি করতে চাই!’
‘তাহলে আপনি সত্য কথা বলতে চাইছেন’, ইন্সপেক্টর বেশ মনোযোগ দিয়ে আমার শরীরের ভাষাটা লক্ষ করতে থাকেন, টেবিলে রাখা কাঠের ব্যাটনটা হাতে তুলে নেন, বেশ আপত্তিকরভাবে ব্যাটনটা হাতে ঘোরাতে-ঘোরাতে সামনের চেয়ারে পা তুলে দিয়ে আরামের ভঙ্গিতে বসে বলেন, ‘বেশ বলুন আমাকে’, ব্যাটনটা তখনো এক হাতে ঘোরাতে-ঘোরাতে জিগ্যেস করেন।
‘কিছু লোক আমার নামে গুজব ছড়িয়ে এ-শহরের শামিন্ত ভঙ্গ করছে।’
‘কী গুজব?’ ইন্সপেক্টর ব্যাটনটা টেবিলে রেখে জিজ্ঞাসু চোখে দেখতে থাকেন আমাকে।
‘আমি নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি অন্য শহরে।’
‘তার মানে!’ ইন্সপেক্টর হতভম্ব হয়ে গেলেন। তারপর জিগ্যেস করেন, ‘কী নাম আপনার?’ আমি আমার নাম বলতে তিনি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন, তারপর মুখে একটা অস্পষ্ট শিস দেওয়ার মতো শব্দ করতে লাগলেন। আমার দিকে একটা অন্তর্ভেদী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিগ্যেস করলেন, ‘শহরের কোন এলাকায় থাকেন?’ আমি এলাকার নাম বলতে তিনি বেশ চিন্তামগ্ন হয়ে গেলেন, তারপর আচমকা কিছুটা রুক্ষস্বরে ধমকে উঠলেন, ‘এখনো কেন বাড়ি ছেড়ে চলে যাননি আপনি?’
‘কী বলছেন আপনি স্যার, আমার বাড়ি ছেড়ে চলে যাব কেন আমি?’ বিস্মিত হয়ে জিগ্যেস করি আমি।
ইন্সপেক্টর বেশ কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এক গভীর দীর্ঘশ্বাস নেওয়ার পর বললেন, ‘দেখুন মশাই, আপনার ভালোর জন্য একটা কথা বলতে চাই। লোকজন শহরের অন্যসব এলাকা ছেড়েও চলে যাচ্ছে। যতদিন যাচ্ছে শহরের পরিস্থিতি আরো বেশি খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আপনার বাড়ি ছেড়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যান আপনি।’ পুলিশের ওপর ভরসা করে থাকার সব আশা জলাঞ্জলি দিতে হলো এরপর আমাকে।
থানা থেকে বেরিয়ে আসার সময় ইন্সপেক্টর প্রায় আমাকে ধমক দিয়ে জানালেন, বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে, না হলে তিনি আমার জন্য কিছুই করতে পারবেন না। আমি সেটা ভালোভাবেই অনুভব করতে পেরেছিলাম, কোনো কথা না বলে আমি থানা থেকে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে তখন বেশ অন্ধকার। হয়তো লোডশেডিং হয়েছে। শহরের পূর্বদিকের আকাশটা লাল হয়ে উঠছে মনে হলো। সম্ভবত স্টিল পস্নান্টের জন্য এমনটা হয়েছে, ওরা রাতের বেলা গলানো লোহার গাদ বাইরে ফেলে। আকাশ এভাবে লাল হয়ে উঠলেই আবহাওয়ার উষ্ণতা বেড়ে যায়, লোকদের জলের তেষ্টা জাগে। আমিও তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠি, কিন্তু ধারেকাছে কোথাও পানীয়জলের কোনো ব্যবস্থা নেই, আমি ঠিক করলাম বাড়ি ফিরে জলতেষ্টা মেটানোর কাজটা সারাই ভালো। আকাশে লাল আলোর দ্যুতিতে মনে হচ্ছে অসংখ্য পাখি বন্দি হয়ে পড়েছে, তাদের ডানা ঝাপটাতে-ঝাপটাতে চক্রাকারে আকাশে ওড়ার ছায়া দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পাখিগুলো যেন আলোর খামখেয়ালিপনায় কিছুটা ভীতসন্ত্রসন্ত। চারদিকে যেন এক অনন্ত মরীচিকা, তারা বিস্মিত হয়ে দেখছে এখনো আলোর ঝলকানি রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে সকালকে ডেকে আনছে, আবার কিছুক্ষণের মধ্যে ভোরের আলো নিভে গিয়ে রাতের গভীর অন্ধকার ফিরে আসছে!
আমি বাড়ি ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যসন্ত হয়ে উঠেছিলাম। দ্রুত পা চালিয়ে আমি বাড়ির পথ ধরলাম। হঠাৎ আমি অনুভব করলাম চতুর্দিকে এক আশ্চর্য নিসন্তব্ধতা ছেয়ে আছে, ঠিক যেন ঝড়ের পূর্বের সন্তব্ধতা। কোথাও কোনো গাড়ি-ঘোড়া চলছে না, রাস্তায় লোকজনও তেমন কেউ নেই। অবশ্য বেওয়ারিশ কিছু কুকুর রাস্তায় এদিক-সেদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। সাধারণত এই কুকুরগুলোকে এমন উত্তেজিত হয়ে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায় না, বিশেষ করে এই ভোরবেলাতে, কিন্তু সন্তব্ধতার এই নিবিড় বাঙ্ময়তায় বিপর্যসন্ত কুকুরগুলো হয়তো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। ক্ষেপ্ত কুকুরগুলো আমাকে আবার না তেড়ে আসে এই চিন্তায় আমি বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু আমার বাড়ি পৌঁছানো পর্যন্ত তেমন কিছু ঘটেনি।
আমার বাড়ির সামনে কিছু লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা আতঙ্ক নেমে আসে। লোকজনকে কিছুটা উপেক্ষা করে আমি বাড়িতে ঢুকলাম। আমার স্ত্রী চেয়ারে বসে টিভিতে সংবাদ শুনছিল। সে আমাকে ভেতরে আসতে দেখে। আমি তার দুচোখে এক আতঙ্কের ছাপ দেখতে পেলাম। রহস্য-রোমাঞ্চের সিনেমা আর 888sport alternative link পড়ার জন্য আতঙ্কিত হয়ে ওঠার একটা প্রবণতা আমার স্ত্রীর আছে।
এই গত মাসেই তার পীড়াপীড়িতে ব্রাম স্টোকারের ড্রাকুলা বইটা হাতে নিতে হয়েছিল আমাকে। 888sport alternative linkটা পড়ার সময় বাতাসের জন্য জানালায় সামান্য শব্দ হলেই তার মনে হতো শার্শিতে বাদুড়েরা ঝাপটা মারছে বোধহয়। কখনো-কখনো সে আমাকে জানালার পাল্লাদুটো ভাল করে বন্ধ করে পর্দা টেনে দিতে বলে। ড্রাকুলা ধোঁয়ার আকার নিয়ে জানালা-দরজার ফাঁকফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়তে পারে এমন ভয়ের কথাও সে বেশ কয়েকবার বলেছে আমাকে। একবার ঘরের মধ্যে একটা ইঁদুরকে ছোটাছুটি করতে দেখে সে পাগলের মতো চিৎকার করতে শুরু করেছিল। আমি জানতে চেয়েছিলাম যে, নেংটি ইঁদুরকে দেখেও সে এমন ভয় পাচ্ছে কেন? উত্তরে সে বলেছিল, সেটা নাকি ড্রাকুলা, ইঁদুরের রূপ ধরে ঘরে ঢুকেছে তাদের রক্ত চুষে খাবে বলে। সেদিন আমার স্ত্রী আমাকে গির্জা থেকে রসুনের ফুল আর পবিত্র রুটি এনে দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। আমার তাতে ছেলেমানুষি মনে হয়েছিল প্রথমে, কিন্তু তার মানসিক অবস্থা দেখে ভেবেছিলাম এই জিনিসগুলোতে যদি তার অলীক দর্শনের ঘোরটা কেটে যেতে সাহায্য করে ভালোই হবে। আমার এক খ্রিষ্টান বন্ধু চার্চের পবিত্র রুটির ব্যবস্থা করে দেয়; কিন্তু আমি দশকর্মার দোকানে রসুনের ফুল কোথাও পেলাম না। বাড়িতে এসে সেদিন আমি তাকে মিথ্যে কথা বলেছিলাম। আমি জানলাম যে, গির্জার পাদ্রি সাহেব বলেছেন, রসুনের ফুল পাওয়া না গেলে কয়েক কোয়া রসুন থেঁতো করে পবিত্র রুটির সঙ্গে ঘরের চার কোনায় ছড়িয়ে দিলেও কাজ হবে। আসলে ড্রাকুলা রসুনের গন্ধেই পাথরে পরিণত হয়ে যায়, তা সে-গন্ধ রসুনের ফুলের হোক বা রসুনের কোয়ার হোক না কেন! আমার এই ব্যাখ্যা সে মেনে নিয়েছিল। সে রসুন থেঁতো করে রুটির সঙ্গে ঘরের চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়। তার গন্ধে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আমার মনে হলো, ড্রাকুলা আর কেউ নয় আমি নিজে, আর আমার এই ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। তবে এই ব্যাপারটা আমার স্ত্রীকে মানসিক শামিন্ত দিয়েছিল। তবু সে একদিন আমাকে গির্জা থেকে একটা ক্রুশকাঠি এনে দিতে বলল, তার নাকি সেটা না হলেই চলবে না। আমি হতভম্ব হয়ে যাই। আমাদের বাড়িতে ক্রুশ থাকবে? লোকেরা কী বলবে? তাছাড়া আমাদের সম্প্রদায়ের লোকজনই বা সেটা কী চোখে দেখবে? কিন্তু আমার স্ত্রী একেবারে নাছোড়বান্দা। তার যুক্তি হলো, শয়তানকে বাড়ির ত্রিসীমানায় আসতে না দেওয়ার এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। শেষ পর্যন্ত আমি তাকে একটা ক্রুশচিহ্ন এনে দিয়েছিলাম। সে সেটা দেয়ালে পেরেক দিয়ে আটকে রাখে।
সে যা-ই হোক, বর্তমানে আমার স্ত্রী সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং সে বেশ কিছুদিন কোনো আতঙ্কের সিনেমা দেখেনি বা কোনো 888sport alternative linkও পড়েনি। কিন্তু তার চোখমুখের ভাব দেখে মনে হলো সেই ড্রাকুলার আতঙ্ক আবার তার মনে বাসা বেঁধেছে।
‘কী ব্যাপার, কী হয়েছে?’ আমি তার পাশে বসে জিগ্যেস করি।
‘তুমি শোনোনি কিছু?’ তার চোখে আতঙ্ক আরো নিবিড় হয়ে ওঠে।
‘কী কথা, সেটা খুলে বলো আমাকে।’ আমার ভীষণ বিরক্তি লাগে। এমনিতেই ওই ইন্সপেক্টরের আচরণে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে ছিল, তার ওপরে স্ত্রীর এভাবে রহস্য করে কথাবার্তা!
‘বাইরের ওই লোকজনেরা তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে, ওরা কিছু বলেনি তোমাকে?’
ক্রমশ আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার অবস্থা, উৎকণ্ঠার পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হতে থাকায় আমার বিরক্তি শেষ পর্যন্ত নিদারুণ উদ্বেগের কারণ হয়ে ওঠে। বাড়িতে ঢোকার সময় আমি বাইরে কয়েকজনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম বটে, কিন্তু তারা আমার জন্যই যে অপেক্ষা করছে এটা আমার কল্পনাতেও আসেনি। আর তারা যদি আমার সঙ্গেই দেখা করতে এসে থাকে, তাহলে আমাকে দেখে কোনো কথা বলল না কেন? হয়তো আমি তড়িঘড়ি বাড়িতে ঢুকে পড়াতে তারা কথা বলার সেভাবে সুযোগই পায়নি কিংবা তারা হয়তো চাইছিল আমি বাড়িতে ঢুকে আগে আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি – ঠিক কী তারা চাইছিল, কেন চাইছিল তার কিছুই আমার জানা নেই।
‘ঠিক কী ব্যাপার, সেটা বলছ না কেন আমাকে?’ কোনোমতে, আমি রাগ দমন করে জানতে চাই।
‘গলাকাটা শবদেহটাকে শহরের দক্ষিণ মহল্লায় ছুটে যেতে দেখা গেছে, আর তার গলা থেকে ফোয়ারার মতো ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছিল!’ আমার স্ত্রী ভূতে-পাওয়া আতঙ্কগ্রসন্তদের মতো গলায় আমাকে জানায়। তার কথা শুনে মনে হয় তার গলা যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
‘খানিকটা দৌড়ে এলে তার শরীরটা মাটিতে আছরে পড়ে। যারা বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে তারা একটা পতাকা নিয়ে এসেছে দেহটাকে জড়িয়ে নিয়ে যাবে বলে। কয়েকজনে মু-ুটাকে খুঁজতেও বেরিয়েছে।’ ঘটনাটি বর্ণনা করার সময় উত্তেজনায় আমার স্ত্রীর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসে।
‘কী বলছ…?’ আমি আর্তনাদ করে উঠি কিন্তু গলা দিয়ে অর্থব্যঞ্জক কোনো শব্দ বের হয় না। আতংকগ্রসন্ত এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। লোকগুলো তখনো সেখানেই ছিল। তাদের মধ্যে একজন আমার কাছে এগিয়ে এসে ফিসফিস করে বলে, ‘আপনি এখনো এখানে রয়েছেন, আপনার তো সকলের আগে এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত ছিল, আর আপনি তো আগের থেকেই সবকিছু জানতেন।’
‘আগের থেকে কী জানতাম আমি?’ আমি রাগতভাবে প্রশ্ন করি।
‘আপনি কি জানেন দক্ষিণের মহল্লায় কী ঘটনা ঘটেছে আজকে?’
‘হ্যাঁ, আমার স্ত্রী বলেছে আমাকে।’
‘তাহলে…’
‘কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না,’ আমি কপালে হাত ঘষতে-ঘষতে জবাব দিই।
‘দেখুন দাদা, আমরা তাকে পতাকায় জড়িয়ে রেখেছি। আমাদের বলা হয়েছে আপনাকে স্পষ্টভাবে জানাতে যে, আপনি এখুনি বাড়ি ছেড়ে চলে যান। তা না হলে…। আমরা তো পতাকা নিয়ে বারবার এখানে আসার ঝুঁকি নিতে পারি না।’
তারা নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ আলাপ-আলোচনা করে, তারপর তাদের একজন দূর থেকে আমাকে চোখের ইশারায় সাবধান করে সেখান ছেড়ে সকলে চলে গেল।
আমি গভীর দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পরিস্থিতি অত্যন্ত দ্রুত আয়ত্তের বাইরে চলে যাচ্ছে। মু-ুহীন শরীরের ছুটে যাওয়ার ঘটনা যে চূড়ান্ত আতঙ্কের তা বলে বোঝাতে হয় না। চরম উদ্বেগ আর মানসিক যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ে আমার স্ত্রী। সে আমার মুখের দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকে এবং স্পষ্টভাবে আমাকে জানিয়ে দেয় যে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আমার মতো দ্বিধাগ্রসন্ত, অকর্মণ্য মানুষ সে আগে দেখেনি। আমি নিজেকে আপ্রাণভাবে শান্ত রাখার চেষ্টা করে পূর্বাপর সবকিছু ভাবতে থাকি। প্রতিমুহূর্তে পরিস্থিতি জটিল ও খারাপের দিকে যে যাচ্ছে, তা সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না আমার।
আমার স্ত্রীর মত হলো, আমরা এখুনি বাড়ি ছেড়ে অন্যেরা সকলে যেখানে যেতে বলছে সেখানে যেন চলে যাই। বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াটাই সবদিক থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে হচ্ছে; কিন্তু সকলে যেখানে আমাদের নিয়ে যেতে চাইছে সে-জায়গা সম্পর্কে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিছুটা সন্দিহান। আমার স্ত্রী জানাল যে, বর্তমান অবস্থার থেকে তা বেশি খারাপ হতে পারে না কিছুতেই!
ইতোমধ্যে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের প্রার্থনা করার মঞ্চের সামনে বিশাল এক জায়গাজুড়ে শত শত তাঁবু খাটানো হয়েছে। আমাদের সেখানে একটা তাঁবু দেওয়া হল। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে সেখানে লোকজন এসেছে। নির্দিষ্ট সময়মতো মঞ্চে প্রার্থনা চলছে; আর পতাকা জড়ানো দেহগুলো এক বড় বেদিতে এনে রাখা হয়েছে। লোকেরা নানান সেস্নাগান দিচ্ছে, প্রস্তাব রাখছে ভবিষ্যতের করণীয় কাজের সম্পর্কে এবং পতাকা জড়ানো অবস্থাতেই দেহগুলোকে কবর দিচ্ছে।
একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার বিছানার চারপাশে বেশ কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। আমার খুব অবাক লাগল তাতে। তাঁবুর একধারে বসে আমার স্ত্রীকে দেখলাম বুক চাপড়াতে চাপড়াতে অঝোরে কাঁদছে। এখানকার কয়েকজন ভদ্রমহিলা তাকে সান্তবনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। আমার বিছানার চারপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিল তারা নিচু গলায় আমার মৃত্যু নিয়ে আলাপ-আলোচনা করছে। এবার পুরো ষড়যন্ত্রটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। কিছু লোক রাতের অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে আমার মৃত্যুর গুজবটাকে ভালোভাবে প্রচার করেছে। এরকম যে একটা ব্যাপার ঘটবে আমার গোড়া থেকেই সন্দেহ ছিল, আর সে-কারণেই আমি এখানে আসতে চাইছিলাম না। আমার সন্দেহটা শেষ পর্যন্ত সত্যি হলো! তাদের মৃদু আলাপচারিতার মধ্যে আমি শুনতে পেলাম কেউ কেউ বলছে যে, আমি বাড়ি ছেড়ে আগে এখানে চলে এলে বেঁচে থাকতাম, কিন্তু নিজের ভবিতব্যকে কে খ-াতে পারে!
আমার ভয়ংকর রাগ হয়ে গেল। আমি চিৎকার করে সবাইকে জানাতে চাইলাম যে, আমার মৃত্যুর খবরটা একটা গুজব, আমি বেঁচে রয়েছি। কিন্তু আমার গলার স্বর ধ্বনি হয়ে প্রকাশ পেল না, আমার প্রচ- উৎকণ্ঠার কারণ হতে পারে আর আমার আশপাশের লোকজন কেউ আমার এই নিঃশব্দ আর্তনাদের দিকে খেয়াল করার প্রয়োজনই বোধ করেনি।
কিছুক্ষণ পর লোকেরা আমাকে স্নান করাল। স্নানের পর সেই একই পতাকায় আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত 888sport app দিয়ে আমাকে প্রার্থনা মঞ্চের সামনের বেদিতে রেখে সবাই প্রার্থনা করতে আরম্ভ করল। প্রার্থনার পর তারা আমাকে কাঁধে তুলে নিল। কয়েকজন চিৎকার করে বলল যে, আমাকে শহরের উন্মুক্ত চত্বরে নিয়ে যাবে, অন্য অনেকে প্রশ্ন করল ‘কেন’? সমবেত কণ্ঠ গর্জে উঠল। আমাদের অন্যদের দেখানো দরকার যে, আমরা এসব ঘটনায় বিন্দুমাত্র ভীত নই। সবাই কাঁধে করে আমাকে একটা উন্মুক্ত চত্বরে নিয়ে এসে আমার দেহটাকে একটা উঁচু বেদির মতো জায়গায় রাখল।
সমসন্ত দেহ পতাকায় জড়ানো দেখে, আমার মৃত্যুর গুজবকে আমি আর অস্বীকার করার মতো কোনো সংগত কারণ খুঁজে পেলাম না।
[আবরার মোজীব (জন্ম : ১৯৬৪) উর্দু 888sport live footballের তরুণ প্রজন্মের উল্লেখযোগ্য কথাকার। রাত কা মনজারনামা নামে একটি গল্পসংকলন প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের গুরুত্বপূর্ণ উর্দু 888sport live footballপত্রিকায় নিয়মিত তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়। রাভী নামে একটি ষাণ্মাসিক উর্দু 888sport live footballপত্রিকার বর্তমানে তিনি প্রধান সম্পাদক। মূল উর্দু গল্প ‘আফবাহ্’ ২০১৪ সালে জেহনে জাঙ্গীদ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।] r

