888sport app download apk latest version : জয়কৃষ্ণ কয়াল
আমার ছোটবেলাটা কেটেছে একটা আদ্যিকেলে খামারবাড়ির পাশে। জার্মানির এক অমত্ম্যজ শহরের একটা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন আমার বাবা। জায়গাটা পাহাড়-জঙ্গলে ঘেরা, হাড়-কাঁপানো ঠান্ডা বাতাসের জন্যে বিখ্যাত। সেই শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটা গ্রামের ধারে বাসা নিলাম আমরা। আমাদের ঠিক পাশের বাড়িটা ছিল ট্রাপ পরিবারের। তাঁরা কিছু জমি-জায়গা চাষবাস করতেন, গরম্ন-মুরগি-শূকর পুষতেন। বুড়ো কর্তা পেনশন পেতেন। আয়-উপার্জনের জন্যে তাই তাঁর চাষ-আবাদের দরকার হতো না। তাঁর ছেলে রাইমুন্ড বিয়ে থা করে শহরের একটা কারখানায় কাজ করতেন। ট্রাক্টর, ধানঝাড়াই কল বা বৈদ্যুতিক দুধদোয়ানো মেশিন কেনার সংগতি ট্রাপদের ছিল না। আমার মনে হয়, তার দরকারও হতো না। তাঁদের জমি-জায়গা কম ছিল। চাষটা করতেন যত না দরকারে, তার চেয়ে বেশি দরদে পড়ে।
যখনই পারতাম আমি সেই কোলকুঁজো ঠাকুরদার মতো লোকটার সঙ্গে এঁটুলি সেঁটে যেতাম। তাঁকে সাহায্য করতে পেরে নিজেকে অশেষ গর্বিত মনে করতাম। বড়ো কাসেত্ম দিয়ে তিনি ঘাস কাটতেন আর আমি সেই সদ্যকাটা ঘাসগুলো আমার সেই বয়সের সামর্থ্যমতো একদিকে গাদা করতাম। গরম্নর গাড়িতে ভরা দিতে তাঁকে সাহায্য করতাম। পরে এগুলো টাটকা গোখাদ্য হিসেবে কাজে লাগত। আলুর মরসুমে আমি তাঁদের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে মাঠে যেতাম। সারাটা দিন গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে মাটি ঘেঁটে-ঘেঁটে আলু খুঁটতাম। তাঁদের সঙ্গে আমি তাঁদের সমান-সমান কাজ করছি তা শোনার জন্যে বা তাঁদের তারিফ পাওয়ার জন্যে আমি কান খাড়া করে থাকতাম। কাটা ঘাসগুলো শুকোনোর জন্যে তাঁদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে বড়ো কাসেত্ম দিয়ে সেগুলো উলটেপালটে দিতাম। তাতে নিজেকে যতটা গর্বিত মনে হতো অন্য কিছুতে তা নয়। পরে খড়গুলো আমরা গাড়িতে ভরে খামারে এনে খালাস করতাম। সেখানে সেগুলো গাদা করা হতো শীতকালে গরম্ন-ছাগলের খাওয়ার জন্যে। এতটা উৎসাহ অবশ্য একেবারে নিঃস্বার্থ ছিল না আমার। সারাদিন খাটাখাটুনির পর আমাকে দেওয়া হতো একটা ডিম কিংবা একটু আচার বা বাগানের কটা টমেটো। সেসব বাড়িতে আনার জন্যে। বলতে গেলে সে-ই আমার প্রথম উপার্জন, মণিমাণিক্যের মতো এনে পরম দাক্ষেণ্যে বাড়ির লোকের হাতে দিতাম তাঁদের সেবার জন্যে।
ট্রাপরা নিজেরাই শূকর জবাই করতেন। বলির সময় আমার সেখানে থাকার অনুমতি ছিল না। কিন্তু দেখতাম কাটা পশুটাকে কীভাবে বড়ো একটা কাঠের টবের টগবগে গরম জলে ফোটানো হতো। কীভাবে মইয়ের সঙ্গে বেঁধে খামারবাড়ির দেয়ালে ঠেস দিয়ে তার ঘাড় থেকে লেজ পর্যন্ত ছাল ছাড়ানো হতো, পরিষ্কার করে টুকরো-টুকরো করে কাটা হতো। পরদিনই বাড়িতে আনার জন্যে পেতাম শূকরের রক্ত ফুটিয়ে তৈরি আচার।
এর মধ্যে বয়স আমার চার থেকে দশে গড়াল। খামারবাড়ির ওই ক-বছরে আমার মনের একটা গড়ন তৈরি হয়ে গেল। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় চার বছর আমার ভিয়েনায় কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছে। তখন চক্কর মেরেছি নাটকে, যাত্রায়, জলসায়, নাচের অনুষ্ঠানে, সিনেমায়… নতুন কোনো প্রযোজনা ছাড়াছাড়ি নেই। কিন্তু শহরজীবন আমার কখনোই পছন্দ নয়। রাস্তার গ-গোল বা পাশের বাড়ির টিভির শব্দ ভাড়াটে ঘরে সেঁধিয়ে আমাকে পীড়া দিত। ব্যসত্ম জনপথের হট্টগোলের ভেতর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যেতে ভয় করত। শহরের কোনো বড়ো পার্কে বা ভিয়েনার শান্ত, সিত্মমিত আলোর কোনো বড় গির্জায় পালাতে পারলে যেন বর্তে যেতাম। কিছুক্ষণের জন্যে সেখানে গিয়ে শহরজীবনের কথা ভুলতে পারতাম। পিএইচ.ডির শেষ মৌখিক পরীক্ষার প্রস্ত্ততির সময় ফি-দিন সকালে গিয়ে বসতাম বেলভেডিয়োর পার্কের বিশেষ একটা কোনায়। সেখানে পুরোপুরি আমার নিজের মতো করে নোটগুলোয় চোখ বুলাতাম। বিভিন্ন বইয়ের নাম তালিকা মুখস্থ করার বিরক্তিকর জঘন্য 888sport sign up bonusর চেয়ে প্রকৃতির ঘেরাটোপে সেই মনোরম নির্জনতার মাসগুলো আমি এখনো আনন্দের সঙ্গে 888sport app download for android করি।
প্রথম যখন ভারতে আসি তখনো আমাকে আকৃষ্ট করেছিল প্রকৃতির বৈভব। তখন আমি ভিয়েনার ছাত্র। শিক্ষামূলক 888sport slot gameে এখানে এসেছিলাম প্রধানত শহরাঞ্চলেই। কিন্তু সেখানেও রোদের আলোর জাদু এড়াতে পারিনি। ইউরোপের তুলনায় ভারতীয় জনজীবনে এই বস্ত্তটির ভূমিকা অনেক বেশি ভাস্বর। ভারতের সূর্যোদয়-সূর্যাসত্ম, বিশেষ করে বর্ষাকালের সূর্যাসত্ম দেখলে কে না আবেগবিহবল হবেন বলুন? 888sport cricket BPL rate বছর বয়সে একা-একা এখানে ঘোরার সময়েই মালুম হয়েছিল ভারতীয় জনজীবনে প্রকৃতির প্রভাব। সেই তুলনায় ইউরোপের প্রকৃতি তো ঘরপোষা, যান্ত্রিক প্রকরণে গ্রহণকবলিত। মানুষের ইচ্ছাশক্তির গোলাম। প্রকৃতিকে আমি তার পূর্ণ মহিমায় উপলব্ধি করতে চেয়েছি। আমার কাছে পরিপূর্ণ জীবনযাপনের ধারণা এ-রকমই।
সে-কারণে দু-বছর পরে কলকাতার রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচারে জার্মান পড়ানোর চাকরি নিয়ে যখন এখানে ফিরে এলাম তখন শর্ত ছিল যে, আমাকে ইনস্টিটিউটে থাকতে হবে না। শহরের বাইরে, মাঠ-পুকুরে ঘেরা তাঁদের নরেন্দ্রপুর আশ্রমে থাকতে চেয়েছিলাম। সুখেই ছিলাম সেখানে। মনে ভাবতাম যে, বাংলার গ্রামজীবনের প্রকৃত আভাস বুঝি বুঝতে পারছি।
আমার ভাবনা যে কতটা ভুল তা বুঝতে পারলাম যখন আমার বন্ধু জয়কৃষ্ণ ২৪-পরগনার দক্ষেণে তাদের গ্রামে আমাকে গ্রাম দেখাতে নিয়ে গেল। সে নরেন্দ্রপুর কলেজের ছাত্র, তখন আশ্রমে চাকরি করছে। সেই যাওয়া আমার কাছে দিব্যদর্শনের চেয়ে কিছু কম নয়। তা আমার জীবনের অন্যতম মুখ্য অভিজ্ঞতা। ছোট্ট এই হিন্দু গ্রামটি আমার বোধের সামনে যে জীবনালেখ্য মেলে ধরল তা আমার আগে দেখা ভারত বা ইউরোপের জীবনধারার সঙ্গে শুধু যে মাত্রায় আলাদা তাই নয়, মানেও পুরোপুরি ভিন্নধর্মী। পার্থক্যটা যে ঠিক কোথায় তা ধরা প্রথমে বেশ কঠিন মনে হচ্ছিল। জীবনের যা কিছু ঘটনা এখানে ঘটছিল প্রকাশ্যে। এটা একটা উলেস্নখযোগ্য বৈশিষ্ট্য সন্দেহ নেই। উঠোন এখানে বসার জায়গা, বারান্দা খাওয়া-শোয়ার ঠাঁই। উঠোনের একদিকের চালা রান্নাঘর, গ্রামের শেষের ঝোপঝাড় পায়খানা এবং গ্রামের পুকুরটাই চানঘর। আরো মজার কথা, গ্রামের রাস্তা-পথঘাট পর্যন্ত যেন চওড়া হয়ে আছে প্রতিটি পরিবারের গৃহস্থালি। মানুষ স্বচ্ছন্দে সেখানে জড়ো হচ্ছে, মেলামেশা করছে। প্রকৃতি এবং নিজের পড়শিদের সঙ্গে এমন প্রত্যক্ষ যোগাযোগের অভিজ্ঞতা আগে আমার কখনো হয়নি।
গ্রামের মানুষজন প্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝখানে আমূল উন্মুক্ত। ফলে প্রকৃতির সৌন্দর্য এবং তার কল্যাণের মহত্তর আনন্দ তারা সবখানি লুটেপুটে নিতে পারে। একই সঙ্গে, কোনো শহরবাসী বা জার্মানির যে-কোনো জায়গার মানুষের চেয়ে প্রকৃতির বিরম্নদ্ধশক্তির মুখোমুখিও তারা অনেক বেশি। পরিবারের সকলের সঙ্গে, প্রতিবেশী এবং বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে মেলামেশায় গ্রামের মানুষের এক ধরনের স্বাচ্ছন্দ্য আছে। আছে অকৃত্রিমতা আর আবেগের মাধুর্য। আমার মনে হয়েছে, ইউরোপীয় আচার-আচরণের সঙ্গে তার আসমান-জমিন ফারাক। এই মেলামেশা এমনকি তাদের দৈহিক সত্মর পর্যন্তও পরিব্যাপ্ত। তাদের হাত-পা নাড়া, তাকানোর ভঙ্গি, শরীরী মুদ্রার ব্যবহার জার্মানির তুলনায় অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ। ও-দেশে কাউকে জড়িয়ে ধরা মোটেই ভদ্ররীতি নয়। কিন্তু এখানে আমার সঙ্গীদের সঙ্গে এ-রকম ঘনিষ্ঠতর সার্বিক মেলামেশায় আমি বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
মাদ্রাজে তিন বছর কাটানোর পর আবার পশ্চিমবঙ্গে ফেরার মনস্থ করলাম। সচেতনভাবেই তখন বেছে নিলাম শামিত্মনিকেতন। তখনো পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের লেখা আমি সামান্যই পড়েছি। তাই তিনি যে আমাকে টেনেছিলেন তা নয়। বরং ঘটনা এই যে, আমি দেখেছিলাম সমসত্ম আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাসহ এখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তা সত্ত্বেও জায়গাটা গ্রামীণ পরিম-লে। এখানে এসেই পাশাপাশি গ্রামগুলোতে বিকেলের দিকে সাইকেল নিয়ে চক্কর দিতে শুরম্ন করলাম। গ্রামের লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হতে শুরম্ন করল। তাদের সঙ্গে বসে কাপ-কাপ চা ওড়াতে লাগলাম। স্বচ্ছন্দে আমি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একাত্মতা বোধ করতে শুরম্ন করলাম। বীরভূমের চারপাশে তিনি যেন আমার নিজের উৎসাহের ভাষা ছড়িয়ে রেখেছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে জায়গাটা একঘেয়ে। পাহাড় নেই, হ্রদ নেই, সমুদ্র বা বড়ো নদী নেই। তবে আছে তপোশুদ্ধ সৌন্দর্য, উদার অনুভূতি এবং ব্যাপ্তি। এগুলো কবি বা 888sport live chatীদের মন মাতাতে সমর্থ। গ্রামগুলোর গাছপালা ঝোপঝাড়ে চাপাপড়া মেটে রঙের বাড়ি, তালবীথি, আমগাছে ঘেরা ছোটো-ছোটো পুকুর – পারিপার্শ্বিক সামগ্রিকতার সঙ্গে সবকিছু এমনভাবে সেঁটে আছে যে তা স্বয়ং প্রকৃতি বলে মনে হয়।
আমার সেই গোড়ার দিকের পরিচিতদের একজনই আমাকে ঘোষালডাঙা গ্রামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। সপরিবারে সে পাশের গ্রামে থাকত। সে আমাকে তার গ্রামে রাত কাটানোর নেমন্তন্ন করল। মাঝেমধ্যে সেখানে থাকতে শুরম্ন করলাম। আসেত্ম-আসেত্ম তার প্রতিবেশীদের সঙ্গে পরিচয় হলো। গ্রামের সব যুবক এবং সাবালকের সঙ্গে কথাবার্তা হতে লাগল। তখন আমি তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব নিয়ে অধ্যাপক কালিদাস ভট্টাচার্যের কাছে পিএইচ.ডি করছি। জার্মান প্রকাশকদের বরাতমতো লেখালিখি করে খাওয়া-পরা চলছে। অনেক সন্ধ্যায় ঘোষালডাঙার সাঁওতাল চাষিদের সঙ্গে কাটিয়ে একই সঙ্গে আমার বিশ্রাম আর বিনোদনের ব্যবস্থা হতে লাগল।
আমার কাছে তারা এত গুরম্নত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন? আর যা-ই হোক, তারা তো আর লেখাপড়া বা 888sport live footballরস নিয়ে আলোচনা করতে পারত না। এর উত্তরে বলব, তারা আমার কাছে জীবন ও মননের এমন একটা ধরন প্রকাশ করেছিল যা শামিত্মনিকেতন, কলকাতা এবং আমার জার্মানির বন্ধুবান্ধবের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। সবচেয়ে বড়ো কথা, ছোট্ট প্রত্যন্ত এই আদিবাসী গ্রামটা অদ্ভুতভাবে ভারতে আমার কাছে এমন একটা ভূখ- হয়ে উঠল যার সঙ্গে আমি পুরো একাত্ম হয়ে গেলাম। কেন এমন হলো? কারণ, আমি যেভাবে গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়ালাম, তারা তাদের অশিক্ষেত সরলতায় ঠিক সেভাবেই আমাকে মেনে নিল। আমি কিছু চাইনি তাদের কাছে, কিছু দিইওনি। তাদের বন্ধু হয়ে, তাদের একজন হয়ে তাদের কাছে গেলাম। তারাও তাদের বন্ধু হিসেবে, তাদের একজন মনে করে আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। তারা প্রশ্ন তুলল না আমি কোথা থেকে এসেছি, আমার চলে কীভাবে। প্রশ্ন করল না আমি কী করি, কেন এখানে এসেছি। তা যদি করত তাহলে হয়তো আমার অনেক কথাই তারা ঠিকঠাক বুঝতে পারত না। তাদের ছোট্ট গ্রামজগৎটিতে তারা যেভাবে মজে ছিল, সেভাবেই একজন মানুষ হিসেবে তারা আমাকে নিল। তারা আমাকে কোনো দলে ঠেলল না। কোনো ইতিহাসজ্ঞানের সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে ফেলল না। খবরের কাগজ এবং দূরদর্শন খোঁটা কোনো খবরের সঙ্গে মেলাতে চাইল না। আমার কাছে তারা পুরোপুরি স্বচ্ছন্দ। সেই স্বাচ্ছন্দ্য তারা প্রকাশ করল আপাতদৃষ্টিতে লাগামছাড়া তাদের কথার চাপান-উতর আর হাসি-মশকরার সহজাত দক্ষতায়।
কলকাতা এবং শামিত্মনিকেতনে আমাকে রম্নটিনবাঁধা কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। বারবার আমার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়েছে নতুন করে। আমি চিরন্তন বিদেশি। কখনো আমাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়েছে। এমনকি মিথ্যা অভিযুক্ত করা হয়েছে। জার্মানটা এত বছর ভারতে করছেটা কী? লোকটার আসল ধান্দা কী? ভারতের মানুষ এবং তার সংস্কৃতির টানে যে এখানে পড়ে আছি, অনেক শিক্ষিত মানুষের কাছেও কথাটা খুব সাজানো মনে হয়েছে। যখন জানাজানি হলো যে, আমি রবীন্দ্রনাথের লেখা এবং শ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত 888sport app download apk latest version
করছি, ভারতবর্ষ নিয়ে লেখালিখি করছি, তখন অবশ্য সন্দেহটা থিতোতে শুরম্ন করল।
দুটো ঘটনা আমাকে ঘোষালডাঙায় আরো শক্ত করে বেঁধে ফেলল। এক, পাশের একটা স্কুল বোর্ডিং থেকে মাধ্যমিক পাশ করে সোনা মুর্মুর ঘোষালডাঙায় ফিরে আসা। এ-পর্যন্ত তাদের গ্রামে একটা অবিশ্বাস্য কা- করল সোনা। গ্রামের ভেতরে বা বাইরে কারো সাহায্য ছাড়াই পুরোপুরি নিজের জোরে সে হাইস্কুল পাশ করল। ব্যাপারটা তার প্রবল ইচ্ছাশক্তির লক্ষণ, পশ্চিমবঙ্গের তরম্নণ প্রজন্মের মধ্যে যা যথেষ্ট বিরল। অবিলম্বে সোনার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। সেটা ১৯৮৪ সাল। সোনাদের বাড়িতে আমার খাওয়া-দাওয়া শুরম্ন হলো। আর একজন চাষি, লালন মুর্মু, গ্রামের পেছনের দিকে তার নিজের জমিতে আমার জন্যে ছোট্ট একটা মেটে কুঁড়ে তৈরি করে দিলো। তাদের আপ্যায়নের অভিব্যক্তিতে আমি অভিভূত হয়ে গেলাম। গ্রামে গেলে এখনো সেই কুঁড়েতে আমি রাত কাটাই।
সমাজসেবা বা মনে অন্য কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আমি গ্রামে যাইনি। গিয়েছিলাম ঘোষালডাঙার বন্ধুদের ডাকে তাদের সঙ্গে গ্রামজীবনে অংশ নিতে। এই যোগাযোগ যে তাদের মধ্যে কিছু কাজের সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে তা উপলব্ধি করতে আরো বছর দুয়ের বেশি গেল। সোনা মুর্মুকে পাশে পাওয়ায় আমার পক্ষে কাজ শুরম্নর আদর্শ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো। গ্রামের একমাত্র শিক্ষেত সে, স্বাভাবিকভাবে সে গ্রামের ছেলেদের নেতা। তার মনের জোর, সততা, গ্রামের জীবনবোধ – এগুলো তার বাড়তি গুণ। আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আমার কাজ সফল করতে গেলে তা করতে হবে সোনার মাধ্যমে। তাকে তালিম দিতে হবে, উদ্বুদ্ধ করতে হবে, সাহায্য করতে হবে যাতে বিনিময়ে সে তার গ্রামের লোকদের সাহায্য করতে পারে। গ্রামের ছেলে সোনা, তাকেই নিতে হবে পরিবর্তনের সর্বময় দায়িত্ব। বহিরাগত হিসেবে আমার অবস্থান হবে নেপথ্যে। টাকা-পয়সার জোগানদার অনেক সংস্থা একটা ভুল করে। তাদের বিশেষজ্ঞরা কাজের জায়গায় না গিয়ে বা সেখানের জীবনযাত্রা না বুঝে ওপরওয়ালার মতো ব্যবহার করেন। আমি শুরম্ন থেকেই সেই প্রমাদ এড়িয়ে চলেছি।
আমাদের কাজকে আমি কখনোই সমাজসেবা বলি না। আমাদের কাছে এটা বন্ধুত্বের কর্ম। আমি গ্রামের মানুষের বন্ধু হয়েছি। এক বন্ধুর প্রয়োজন দেখলে অন্য বন্ধু স্বাভাবিক কারণেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। এ-উপলব্ধি থেকে আমাদের কাজকর্ম ক্রমশ পরিবর্তিত হচ্ছে। গোড়ায় কাজের ধরনটা ছিল তাৎক্ষণিক। যেমন কেউ অসুস্থ হলে তাকে পরামর্শ দেওয়া বা সাহায্য করা। পরে ধীরে-ধীরে তা সাংগঠনিক চেহারা নিয়েছে। ১৯৮৫ সাল থেকে সোনা আর আমি সংগঠিতভাবে আমাদের বিবেচনায় মুখ্য তিনটি ক্ষেত্রে কাজ করেছি।
একটা হলো চিকিৎসা সাহায্য। আমরা ঠিক করলাম ঘোষালডাঙার কেউ যদি আমাদের কাছে (গ্রামে সোনার কাছে বা শামিত্মনিকেতনে আমার কাছে) চিকিৎসার জন্যে সাহায্য চায় তাকে ফেরানো হবে না। দরকারমতো আমরা শুধু ডাক্তারের ফি এবং ওষুধপথ্য কিনে দিয়ে সাহায্য করব না, রোগীকে উপযুক্ত চিকিৎসকের (ওঝা বা হাতুড়ের কাছে যাওয়া বন্ধ করে) কাছে পাঠাব। তাদের চিকিৎসার তদারকি করব। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং স্বাস্থ্যের ব্যাপারে গ্রামের মানুষকে সচেতন করা খুবই জরম্নরি। কাজটা বরাবরই খুব কঠিন। একেবারে গোড়াতেই সোনা লড়াই করল পানাসক্তির বিরম্নদ্ধে। আমরা বুঝলাম, অপুষ্টির পরেই গ্রামের মানুষের, বিশেষ করে বয়স্কদের, রোগের মূল কারণ এটাই। উলেস্নখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে সে।
অন্য যে দুটো ক্ষেত্রে আমরা নিয়ম করে কাজকর্ম শুরম্ন করলাম তা হলো শিক্ষা এবং বনসৃজন। সাঁওতাল ছেলেমেয়েদের পক্ষে ভিড়ে ভিড়াক্কার সরকারি প্রাথমিক স্কুলগুলোয় গিয়ে পড়াশোনা করা ভীষণ কঠিন। আশপাশের গ্রামের অসংখ্য বাঙালি ছেলেমেয়ের মধ্যে তারা শিগগির নিরম্নৎসাহিত হয়ে পড়ে। তাদের লেখাপড়া শিখতে হয় একটা অজানা ভাষায় (বাংলায়)। শিক্ষকরা যেহেতু বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রী নিয়ে ক্লাস সামলাতেই হিমশিম, তাদের ব্যাপারে কোনো বাড়তি মনোযোগও দিতে পারেন না তাঁরা। বাবা-মা বা বাড়ির বড়োরা নিরক্ষর। শিক্ষার সুফল সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তাদের। তাই তাদের কাছ থেকেও কোনো সাহায্য বা উৎসাহ আশা করতে পারে না তারা। অন্যদিকে তাদের পারিবারিক পরিবেশের সমসত্ম কিছুই লেখাপড়ার প্রতিকূল। সন্ধ্যায় পড়াশোনার জন্যে তাদের না আছে কেরোসিন, না লম্ফ। সময়ও নেই। কেননা, ধরেই নেওয়া হয় যে, তারা বাড়ির কাজকর্ম করবে। মাঠে খাটবে, বিশেষ করে, রাখালি করবে। তারা স্কুলে যাচ্ছে কিনা তা দেখার কেউ নেই, গেলেও কোনো বাহবা নেই।
প্রাইমারি স্কুলের ছেলেমেয়েদের সোনা সন্ধেবেলা পড়াতে শুরম্ন করল। আমরা একটা গ্যাসের আলো আর বসার জন্যে মাদুর কিনলাম। সন্ধেবেলা সোনা বাড়ি-বাড়ি ঘুরে বাচ্চাদের ধরে নিয়ে আসত। তাদের বাড়ির কাজের তদারকি করত। পড়া বলে দিত। ব্যায়াম শেখাত। সে নিজে নিয়মিত উপস্থিত থাকত এবং ছাত্রদের নিয়মিত উপস্থিতিকে উৎসাহিত করত। ছাত্রেরা তাতে আসেত্ম-আসেত্ম রপ্ত হয়ে গেল এবং বিপুল বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও তারা হাইস্কুল পর্যন্ত পড়াশোনা চালাতে লাগল। দশ বছর আগে ঘোষালডাঙায় একটাও হাইস্কুলে-পড়া ছেলে ছিল না। এখন সেখানে চারজন মেয়েকে নিয়ে বাইশজন হাইস্কুলে পড়ছে।
গাছ লাগানো একটা উন্নয়নমুখী প্রয়াস – গ্রামের সবাইকে নিয়ে। এজন্যে দরকার যথেষ্ট ধারাবাহিকতা এবং শৃঙ্খলা। বীজ জোগাড় করা, চারা তৈরির ব্যবস্থা ও তার দেখাশোনা, গাছ লাগানোর জন্যে গর্ত খোঁড়া, তারপর গাছ লাগানো। গরম্ন-ছাগলের মুখ থেকে বাড়ন্ত গাছগুলো বাঁচানোর জন্যে একজন পাহারাদার লাগাতে হবে। গাছগুলো বড়ো হলে তখন দায়িত্বজ্ঞানহীন কিছু মানুষের হাত থেকে সেগুলোর অকালবিনষ্টি আটকাতে হয়। গাছ লাগানো এবং তা বড়ো করার কাজ একটা গ্রামকে আক্ষরিক অর্থে সারাবছর ব্যসত্ম রাখে। এতে খরচ প্রায় নেই বললেই চলে, কিন্তু দরকার সুশৃঙ্খল একটা যৌথ প্রয়াস। এটা এমন একটা কাজের দৃষ্টান্ত যার মাধ্যমে একটা গোটা গ্রাম তার বৃহত্তর সার্বিক স্বার্থে কাজ করার শিক্ষা পায়। গ্রামের রাস্তা বা খালের পাশে গাছ লাগিয়ে কোনো ব্যক্তিবিশেষের উপকার হয় না, কিন্তু গোটা গ্রামের কল্যাণ হয়। এতে তাৎক্ষণিক কোনো লাভের আশা নেই। তবে চাষ-দাওয়ার বাইরে যেসব চাষি সাধারণত অন্য কিছু ভাবতে পারেন না, তাঁদের কাছে কাজটা নতুন তো বটে। অন্যের জন্যে চিমত্মাভাবনার মানসিকতা এখানে অপরিহার্য।
গাছ লাগানো এবং তার পরিচর্যা, আমি লক্ষ করেছি, কোনো গ্রামের পক্ষে অসীম মূল্যবান একটা শিক্ষামূলক কার্যক্রম। গত কয়েক বছরে কয়েক হাজার গাছ লাগানো হয়েছে। তার অধিকাংশ বড়ো হচ্ছে। ঘোষালডাঙার চারপাশে এখন সর্বত্র চোখে পড়বে গ্রামের মানুষের নিজের হাতে তৈরি করা সবুজ বৃক্ষশ্রেণি। তাদের মনে কিছুটা আত্মপ্রসাদও এসেছে। একটা গ্রাম শুধু গাছ লাগানোর সুবাদেই আলাদা একটা পরিচিতি পাচ্ছে। এই লাভের দিকটা এখন সবচেয়ে বেশি দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে।
[নিবন্ধকারের ইচ্ছানুযায়ী 888sport app download apk latest versionকের সংযোজন : রচনাটি বেশ কয়েক বছর আগের। ইতিমধ্যে ড. কেম্পশেনের গ্রামের কাজ
শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে বহুমুখী রূপ নিয়েছে এবং দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে, বিশেষত ইউরোপে, ব্যাপক স্বীকৃতি পেয়েছে। দক্ষিণ চবিবশ পরগনার গ্রামটি জয়নগর ২ নম্বর বস্নকের অন্তর্গত খেজুরতলা গ্রাম, 888sport app download apk latest versionকের জন্মস্থান। এই গ্রামে ড. কেম্পশেন গিয়েছেন বেশ কয়েকবার। তবে তিনি প্রথম গিয়েছিলেন ১৯৭৩ সালে। সে-গ্রামের প্রকৃতি এবং জীবনধারায় এখন, স্বাভাবিক নিয়মেই, এসেছে অনেক পরিবর্তন। ১৯৭৩ থেকে আজ পর্যন্ত শুধু যা অটুট আছে তা মার্টিনদার সঙ্গে জয়কৃষ্ণের বন্ধুতা]

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.