যারা এডওয়ার্ড সাঈদের ওরিয়েন্টালিজম (১৯৭৮) গ্রন্থটি পড়েছেন এবং যারা তাঁর উত্তর-উপনিবেশী নানা চিন্তা-ভাবনাকে অনুসরণ করেন, প্যালেস্টাইন সম্বন্ধে তাঁর লেখালেখি ও তাঁর মানবতাবাদী বিশ্বাসের সঙ্গে যাদের পরিচয় রয়েছে এবং যারা তাঁর গৃহহীনতার বেদনাকে বুঝতে চান, তাদের জন্য আউট অফ প্লেস অবশ্যপাঠ্য। এ বইটি সাঈদ লিখতে শুরু করেন ১৯৯৪ সাল থেকে – এর মাত্র তিন বছর আগে তাঁর শরীরে লিউকোমিয়া ক্যান্সার – ধরা পড়ে। মৃত্যু নিয়ে তাঁর কোনো ভয় অথবা অতৃপ্তি ছিল না, তবুও ক্যান্সারের চিকিৎসা যখন চলছে এবং মাঝে মাঝে উন্নতির কিছু লক্ষণও দেখা যাচ্ছে, সাঈদ জেনে নিয়েছেন মৃত্যু অপেক্ষা করে আছে তাঁর জন্য। একটা তাড়া তিনি অনুভব করেছেন এবং লিখতে বসেছেন আত্মজীবনী। তবে এ বইতে পুরো জীবনটাকে তিনি তুলে ধরেননি, এর ব্যাপ্তি মাত্র তাঁর জন্ম (১৯৩৫) থেকে শুরু করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 888sport live footballে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে বেরুনো পর্যন্ত – অর্থাৎ জীবনের প্রথম সাতাশটি বছর। এরপর ১৯৯৪ সালে এই 888sport alternative link লিখতে শুরু করা অথবা ২০০২ সালের অক্টোবরে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁর জীবন ছিল সক্রিয়তার, সাফল্যের এবং ব্যাপক পরিচিতির। ওরিয়েন্টালিজম তাঁকে যে খ্যাতি এনে দিয়েছিল পরবর্তীতে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ তা অনেক পরিব্যাপ্ত করেছে। প্যালেস্টাইন-প্রশ্নে সাঈদ এক দীর্ঘ সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে পড়েছিলেন, যা তাঁকে ওই ভূখ-ের নির্যাতিত মানুষের এক মুখপাত্রে পরিণত করেছিল এবং একই সঙ্গে ইহুদিবাদীদের চোখে এক বৈরী অবস্থানে বসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এই দীর্ঘ সক্রিয়তা, খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা/বৈরিতা এবং একজন মৌলিক চিন্তাবিদ হিসেবে তাঁর দৃঢ় একটি অবস্থানের কাহিনী রয়ে গেল ওই আত্মজীবনীর বাইরে। সাঈদের হাতে অবশ্য সময় ছিল না, আক্ষরিক অর্থেই, এবং তাঁকে 888sport app অনেক কাজও করতে হয়েছে ওই পাঁচ বছর, সংবাদপত্রে প্যালেস্টাইন প্রশ্নে অন্তহীন লেখালেখি যেমন (তাঁর লেখা কলামের 888sport free bet কয়েক হাজার ছিল বলে একটি ওয়েবসাইট জানাচ্ছে)। তবে, জীবনের সাতাশ বছরের বৃত্তান্তের ভেতরেই তিনি তাঁর নিজেকে নিয়ে, পিতামাতাকে নিয়ে; দেশ ও দেশহীনতা, স্থান ও স্থানচ্যুতি নিয়ে; রাজনীতি ও সময় এবং জীবন, অস্তিত্ব এবং অনস্তিত্ব নিয়ে তাঁর যে অনেক প্রশ্ন ছিল,
ক্ষোভ ছিল, উপলব্ধি ছিল সেগুলোর প্রকাশ ঘটিয়েছেন। অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি, অনেক নিবিড় উপলব্ধি বরং উস্কে দিয়েছে বেদনা অথবা কষ্টের অনুভূতিকে – কিন্তু সাঈদ জীবন888sport sign up bonusর কোনো পাতাকে আড়াল রাখতে চাননি। নিজের গড়ে ওঠার একটা বিস্তৃত সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সাহস ও সততার সঙ্গে তিনি বর্ণনা করেন তাঁর বালকবেলা এবং যৌবনের ঘটনাগুলো, খোলামেলা মন্তব্য করেন তাঁর পিতা ও মাতা সম্পর্কে, ব্যাখ্যা করেন তাঁদের সঙ্গে তাঁর জটিল সম্পর্ককে। জন্মস্থান জেরুজালেম থেকে নিয়ে কায়রো অথবা লেবাননের পাহাড়ি গ্রাম ধুর-আল-শোয়ের – যেখানে অনেকগুলো গ্রীষ্ম কাটিয়েছে ওয়াদি সাঈদের পরিবার – অথবা গেজিরা প্রিপেরাটরি স্কুল, ভিক্টোরিয়া কলেজ, মাউন্ট হার্মন স্কুল, প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি : যেখানেই শৈশব ও যৌবনের কিছুটা হলেও সময় কেটেছে সাঈদের, সেইসব শহর অথবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছবি অত্যন্ত দক্ষ হাতে ফুটিয়ে তোলেন তিনি, যেন তাঁর নিজস্ব ইতিহাসের পুরোটা অঞ্চল জুড়ে তারা যে ছায়া ফেলেছে, তার অতি সামান্যও যেন মুছে না যায়।
আউট অফ প্লেস (লন্ডন : গ্রান্টা বুকস, ১৯৯৯) আত্মজীবনীর একটি খ- অবশ্যই, কিন্তু একই সঙ্গে একটা সময়ের এবং ইতিহাসের পুনর্নির্মাণও বটে। রাজনৈতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহের বিচিত্রমুখী অভিঘাতের একটি সংবেদনশীল চিত্রও এ বইটি। তত্ত্বের অঞ্চলে যারা ন্যাশন – দেশ বা জাতি – এবং নির্বাসন, ক্ষমতা ও জ্ঞানের আন্তঃসম্পর্ক এবং নিম্নবর্গীয়ের নিষ্পেষণ নিয়ে অনুসন্ধান করেন অথবা উৎপ্রেক্ষার জগতে যারা গৃহ ও গৃহহীনতা, অস্তিত্বের শেকড়-বাকড় অথবা মানুষে মানুষে সম্পর্কের গুঢ়ার্থগুলো অন্বেষণ করেন, তাদের জন্য আউট অফ প্লেস অনেক চিন্তার জোগান দেয়। কিন্তু বর্ণনা বা আখ্যানের একটা অন্তরঙ্গ পর্যায়েও এই বইটি পাঠকের মনোযোগ ক্রমাগত অধিকার করে রাখে। ১৯৯৯ সালে প্রকাশের পর এটি নন-ফিকশনের জন্য নিউইয়র্কার বুক অ্যাওয়ার্ড লাভ করে। সাঈদের ভাষাটি অজটিল এবং আকর্ষণীয়, দৃশ্যকল্পের সরল বিস্তার পাঠককে ঘটনা থেকে ঘটনায় নিয়ে যায় অবলীলায়, তবে দৃশ্যের অভ্যন্তরে অনেক চিন্তার উপাদান জড়ো হয়, ইতিহাস ও সময়ের অনেক অনুষঙ্গ মূর্ত হয়, তাদের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অনেক সময় সাঈদ কিছুটা নৈর্ব্যক্তিক; অনেক সময় কৌতুক অথবা আয়রনির ব্যবহারে বর্ণনাটিকে তীর্যক করে তোলেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁর অনুভূতির তীব্রতাটা আন্দাজ করা যায়। এটি আয়েশ করে পড়ার মতো বই নয় – এর সঙ্গে একটা কথপোকথন চলে পাঠকের, এমনকি যিনি তাঁর বিশ্বাস থেকে দূরে, তারও।
দুই
আউট অফ প্লেস নামটি একটা ব্যাখ্যা দাবি করে শুরুতেই। সাঈদ লিখেছেন এ বইতে তিনি চেষ্টা করেছেন ‘বলতে গেলে হারিয়ে যাওয়া অথবা ভুলে যাওয়া’ জগতের ব্যক্তিনিষ্ঠ একটি খতিয়ান তুলে ধরতে (ভূমিকা)। এই জগৎটি প্রথমত তাঁর একান্ত নিজস্ব – ব্যক্তি এডওয়ার্ড সাঈদের। কিন্তু এই জগৎ আড়াআড়িভাবে বিস্তৃত রাজনীতি এবং ইতিহাসের একটি জগতের ভেতরে, যার এপিসেন্টার হচ্ছে প্যালেস্টাইন। অতএব, সাঈদ ওই ভূমিকাতে জানান, ‘মধ্যপ্রাচ্যের ওই তুমুল বছরগুলোর একটা আনঅফিসিয়াল ব্যক্তিগত বিবরণও এই বইটি’। এ বইতে রাজনীতির অবস্থান কেন্দ্রীয় নয়, তবে প্রান্তিকও নয় – বিষয়টি নির্ভর করে রাজনীতির কি সংজ্ঞা আমরা নির্মাণ করি, তার ওপর। স্কুলে যখন ইংরেজ শিক্ষক অকারণে শাস্তি দেন তাঁকে; অথবা তাঁর বাবা একটা বনেদি ক্লাবের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও যখন আরেক ইংরেজ তাঁকে ক্লাবের জমিতে অনুপ্রবেশের জন্য ধমক দেয়, তখন উপনিবেশ, উপনিবেশী শাসন এবং উপনিবেশী প্রজা নির্মাণ বিষয়ে তাঁর যে উপলব্ধি হয়, তাকে বুঝতে হলে রাজনীতির শরণ নিতে হয় আমাদের। আউট অফ প্লেস যখন লেখেন সাঈদ, তখন রাজনীতি বিষয়টি নিয়ে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত তাঁর নেয়া হয়ে গেছে; ন্যাশন ও নির্বাসন, উপনিবেশ ও উপনিবেশী শাসন, প্যালেস্টাইনিদের রাষ্ট্রচ্যুতি ও ইন্তেফাদা নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা ও তত্ত্বে তিনি পৌঁছে গেছেন। কাজেই আউট অফ প্লেস-এর পরোক্ষে সেগুলো যে ক্রিয়াশীল থাকবে না, এর রাজনৈতিক বিষয়-কেন্দ্রটিকে প্রভাবিত করবে না, এ রকম ভাবার কোনো কারণ নেই।
‘আউট অফ প্লেস’ কথাটিকে সোজা বাংলায় স্থানচ্যুতি বললে একটা ছবি পাওয়া যায় সাঈদের মনোবেদনার। তবে এ শুধু স্থানচ্যুতির বিবরণ নয়, বরং একটা জায়গাকে নিজের করে নেবার জন্য যে মানসিক ও আবেগগত বিনিয়োগ প্রয়োজন তার একটা বর্ণনাও বটে। এবং অনেক বিনিয়োগের পর যখন হঠাৎ জায়গাটি বেদখল হয়ে যায় অথবা হারিয়ে যায়, তখন মনে যে ক্ষোভ জন্মে তার বর্ণনা আছে এ বইটিতে। আউট অফ প্লেস-এর অনেকখানি জুড়ে আছে সাঈদের দলছুট অভিজ্ঞতাগুলো অথবা একটি পরিচিত, ‘স্বাভাবিক’ বলয়ে সন্নিবদ্ধ হতে না-পারার কষ্টকর বিবরণ। বৃত্তের বাইরে তিনি রয়ে গেছেন নামের কারণে, জাতীয়তার কারণে, ধর্মের কারণে, ভূগোল-ইতিহাস এবং রাজনীতির প্রতিকূল নানা অবস্থানের কারণে। ‘সাঈদ’ নামটির ইতিহাস তাঁর পক্ষে যায়নি, যেমন যায়নি তাঁর আরব জাতীয়তা অথবা তাঁর ধর্ম – সাঈদ ছিলেন অ্যাংলিকান – এবং আত্মজীবনীর এক স্থানে যেমন তিনি বলেছেন, তাঁর শারীরিক গঠন অথবা রং ছিল অনেকের থেকে আলাদা। স্কুলে সমবয়সীদের থেকে মাথায় উঁচু ছিলেন, কিন্তু চালচলনে সাবলীল ছিলেন না। ক্লাসে মনোযোগী ছিলেন না, গোলমেলে ছাত্র হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এসব কারণে নিজেকে আবিষ্কার করেছেন বৃত্তের বাইরে অথবা বড়জোর প্রান্তে। তাঁর চরিত্র গঠনে বিশাল প্রভাব ফেলেছে এই বৃত্তের ভেতরে সংহত হতে না পারার ক্ষোভ অথবা শুধুই উদাসীনতা।
সাঈদের বাবার নাম ছিল ওয়াদি ইব্রাহীম এবং তাঁর জন্ম হয়েছিল জেরুজালেমে। মায়ের নাম ছিল হিল্ডা মুসা, তাঁর দেশ ছিল লেবানন এবং জন্ম হয়েছিল নাজারেথ-এ। সেই হিসেবে সাঈদের নাম হওয়ার কথা ছিল এডওয়ার্ড ইব্রাহীম। কারণ তাঁর কোনো পিতামহের নাম সাঈদ ছিল না। এ নামটি ওয়াদি গ্রহণ করেন। সাঈদের অবশ্য এই আরব নামে আপত্তি ছিল না – ছিল ‘এডওয়ার্ড’ নামটিতে। ১৯৩৫ সালে সাঈদের জন্মের বছরে প্রিন্স অব ওয়েলস এডওয়ার্ড জেরুজালেম সফরে যান। তখন এই নামটি গ্রহণ করা হয় সাঈদের জন্যে। আত্মজীবনীতে সাঈদ জানাচ্ছেন, এডওয়ার্ড নামে ধাতস্থ হতে তাঁর পঞ্চাশ বছর সময় লেগে যায়। এই নামকরণটি কিছুটা কৌতুকের বলেও মনে হয়েছে তাঁর কাছে। কারণ সাঈদের বাবা ছিলেন আমেরিকার একজন একনিষ্ঠ সমর্থক, ব্রিটিশদের কখনো প্রীতির চোখে দেখেননি তিনি। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ওয়াদি বছর দশেক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। নাগরিকত্ব নিয়েছেন সে-দেশের এবং প্রথম মহাযুদ্ধে সামরিক বাহিনীতে যোগও দিয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিল যুক্তরাষ্ট্রে থেকে গিয়ে আইন পেশায় যোগ দেবেন, কিন্তু তাঁর মায়ের অনুরোধে প্যালেস্টাইন ফিরে
আসেন। এডওয়ার্ড নামটি তাঁরও পছন্দ হওয়ার কথা নয়, অথচ সাঈদের জন্য এটিই নির্বাচিত হলো। পারিবারিক নামটি মাত্র এক প্রজন্মের, ক্রিশ্চান নামটি ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের নামবৃক্ষ থেকে ধার করা – এরকম এক নাম-পরিচিতির জটিলতা নিয়ে এডওয়ার্ড সাঈদের যাত্রা শুরু হলো জীবনে।
এবং এই বিভ্রম 888sport app ক্ষেত্রেও দেখা দিল, তাঁকে ‘জায়গা’ থেকে সরিয়ে দিল। যেমন ভাষা। সাঈদ তিনটি ভাষা জানতেন – আরবি, ইংরেজি এবং ফরাসি। আরবিতে তিনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন এবং মায়ের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞ ছিলেন যে, আরবিতে অন্তত অর্ধেকটা সময় কথাবার্তা বলতেন তিনি। হিল্ডা ভালো ফরাসি জানতেন, কায়রোতে ‘জাতে ওঠার জন্য’ অন্য মহিলারা যখন ফরাসি বলার জন্য অস্থির থাকতেন, তখনো হিল্ডা আরবিতে অথবা ইংরেজিতে কথা বলতেন। সাঈদ যেসব স্কুলে গিয়েছেন, আরবি বলার অনুমতি ছিল না সেসব স্কুলে। ফলে আরবি না ইংরেজি, কোনটা ছিল তাঁর প্রথম ভাষা – এ নিয়ে বহুদিন বিভ্রম ছিল। এক সময় তাঁর এরকমও মনে হয়েছিল, দুটির কোনোটিই যেন তাঁর প্রথম ভাষা নয়। কায়রোতে যখন ছিলেন সাঈদ, হিল্ডার আরবিকে তাঁর মনে হতো ‘সাবলীল ইজিপশিয়ান’। অথচ এই কায়রোতে তাঁরা মূলধারায় কখনো স্থিত হতে পারেননি। মিশরে যেসব আরব অন্য জায়গা থেকে এসে থাকতেন, বিশেষ করে সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন ও প্যালেস্টাইন থেকে, তাদের বলা হতো শামি। তাদের ভাষাকেও বলা হতো শামি। ওয়াদির পরিবার ছিল শামি অর্থাৎ বহিরাগত। অনেক পরে, যখন গামাল নাসের ক্ষমতায় আরোহণ করেন মিশরে এবং তাঁর নিজস্ব মার্কার আরব সমাজতন্ত্রের প্রচলন করেন, কায়রো হঠাৎ খুব রক্ষণশীল হয়ে পড়ে বিদেশীদের ব্যাপারে। ইউরোপ-আমেরিকা তো ভিন্ন কথা, এই শামিদের ক্ষেত্রেও মনোভাব দ্রুত পালটায়। ওয়াদি ইব্রাহীম/সাঈদ-এর রমরমা ব্যবসা ছিল অফিস সাপ্লাই, বই ইত্যাদির। সেই ব্যবসায় ধস নামে, সাঈদদের ছাড়তে হয় কায়রো। এই একটা পরিচিত ‘জায়গা’ থেকে চলে যাওয়া, এই নির্বাসন – এখানেও সেই বৃত্তের বাইরে নিক্ষিপ্ত হওয়ার গল্প। আত্মজীবনীর শুরুতেই তাই সাঈদ জানাচ্ছেন, ‘আমি অনেক পরিচিতির একটি অস্থিতিশীল অনুভূতি ধরে রেখেছি মনে, যেগুলোর বেশিরভাগ একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত, সারা জীবন, এবং একই সঙ্গে আমার এক হতাশার অনুভূতির কষ্টকর 888sport sign up bonusও মনে আছে, যখন আমি ভাবতাম, আমি যদি পুরোপুরি আরব হতাম অথবা পুরোপুরি ইউরোপীয় অথবা আমেরিকান অথবা পুরোপুরি অর্থোডক্স ক্রিশ্চান অথবা পুরোপুরি মুসলমান অথবা পুরোপুরি মিশরীয় অথবা এরকম’ (৫)। এই যে হাইফেন-সংযুক্ত পরিচিতি, সিকি অথবা আধা পরিচিতি, তাতে তাঁর অস্তিত্বের একটা সংকটই সৃষ্টি হয়েছিল। তুমি কে? তুমি কি? এরকম যখন প্রশ্ন উঠত, সাঈদ হয়তো বলতেন, আমি আমেরিকান অথবা আরব কিন্তু উত্তরে বলা হতো, ‘কিন্তু সাঈদ তো আরব নাম’, ‘তুমি একজন আমেরিকান কিন্তু কোনো আমেরিকান নাম ছাড়া, আর তুমি কোনোদিন আমেরিকাতেও যাওনি।’ ‘তোমাকে দেখতেও আমেরিকান মনে হয় না।’ ‘তুমি একজন আরব বটে, কিন্তু কি ধরনের? প্রোটেস্টান্ট?’ (৫-৬)।
আউট অফ প্লেস – অর্থাৎ ঘরে থেকেও গৃহচ্যুত ছিলেন তিনি। বস্তুত আত্মজীবনীর এক বড় অংশ জুড়ে আছে তাঁর বেড়ে ওঠার কঠিন সংগ্রামের বিবরণ। এই সংগ্রাম ছিল তাঁর বাবার কঠিন ব্যক্তিত্ব, তাঁর অনুশাসন, তাঁর নিয়ন্ত্রণ, তাঁর উদাসীনতা এবং তাঁর দূরবর্তিতার ফলে সৃষ্ট প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। ‘আমার বাবা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের, যুক্তিবাদী শৃঙ্খলা এবং অবদমিত আবেগের এক বিধ্বংসী মিশ্রণ’, সাঈদ লিখেন (১২)। ছোটবেলা থেকে কুড়ি ছাড়িয়ে যাবার পরও অনেক বছর সাঈদকে নিয়ন্ত্রণ করতেন ওয়াদি। বাবার সঙ্গে দূরত্ব ছিল এবং সেটি অনতিক্রম্য মনে হতো যখন তিনি তাঁর চাওয়া-পাওয়াকে চাপিয়ে দিতেন সাঈদের ওপর, এবং তাঁর ‘কখনো হার না মানার’ মন্ত্রে সাঈদের জীবনকে চালিত করতে চাইতেন। সাঈদ অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গে জানান, তাঁর অবসর অথবা আরামের কোনো ধারণাই ছিল না ছেলেবেলায়। বাবার ক্ষমাহীন দৃষ্টির নিচে নিজেকে একটা উঁচু জায়গায় তুলে ধরার অবিরাম চেষ্টা তাঁকে প্রতিবাদী করেছিল, যে প্রতিবাদ স্কুলের ‘দুষ্টু’ ছেলে হওয়ার মধ্য দিয়ে এবং এক সময় নিজের পছন্দমতো বিষয় পড়া ও নিজের মতো এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছার মধ্যে প্রতিফলিত হতো। তবে মায়ের সঙ্গে সম্পর্কটা অনেকটাই সহজ ছিল তাঁর – শুধু তাঁর কাছেই বুদ্ধিগত আর আবেগগত সঙ্গের জন্য ফিরতেন সাইদ। তবে আত্মজীবনীতে তিনি এ-ও বর্ণনা করেছেন, কিভাবে মায়ের কতগুলো অভ্যাস, বিশ্বাস অথবা চর্চা প্রগাঢ় প্রভাব ফেলেছিল তার জীবনে। হিল্ডা সাঈদের ছিল ঘুমহীনতার ইতিহাস, যার বেশিরভাগ স্বসৃষ্ট; ছিল একটা কাজ ঠিকমতো না হলে এর বিকল্প কি হতে পারে সে নিয়ে ‘অবশ করার মতো উদ্বেগ’, এক গভীর অস্থিরতা অথচ তা সত্ত্বেও মানসিক এবং শারীরিক প্রাণশক্তির এক অফুরন্ত সরবরাহ; নিঃসঙ্গতাকে একই সঙ্গে মুক্তি এবং অসুখের প্রকাশ হিসেবে নানাভাবে প্রতিপালন করা – এ-সবই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। মায়ের মতো সংগীতের প্রতি এক প্রবল টান ছিল সাইদের। অথচ সাঈদের ভাষায়, ‘পৃথিবী এবং আমার প্রতি মায়ের ছিল এক প্রগাঢ় এবং অনিষ্পন্ন দ্বিমুখীতা।’ মা তাঁর থেকে চাইতেন ‘ভালোবাসা এবং ভক্তি এবং সেগুলো দ্বিগুণ-চারগুণ করে ফেরত দিতেন; অথচ হঠাৎ করে তা ফিরিয়েও নিতে পারতেন, যার ফলে আমার মধ্যে তৈরি হতো এক আধিবিদ্যক ভীতি’। বস্তুত হিল্ডা সাঈদের ‘শক্তিদায়ী হাসি এবং তার শীতল মুখভঙ্গি অথবা তার নাকচকারি ভ্রƒকুঞ্চনের মাঝখানে’ বালক সাঈদের অস্তিত্ব ছিল একই সঙ্গে ‘একজন সৌভাগ্যবান এবং আশাহীনভাবে দুর্দশাগ্রস্তের, কখনো পুরোপুরি একটি অথবা পুরোপুরি অন্যটি নয়’ (১৩)।
এই মাঝখানের জীবনকে তিনি অনেকটা স্বতঃসিদ্ধই ধরে নিয়েছিলেন। একে পরিবর্তন করার ইচ্ছা অথবা প্রত্যয় যে তাঁর মধ্যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু পরিস্থিতি অথবা ইতিহাস কখনো তাঁর অনুকূলে ছিল না। জেরুজালেমে জন্ম হয়েছে তাঁর, কিন্তু জেরুজালেমে থাকেনি তাঁর ফিরে যাবার মতো একটি স্থায়ী ঠিকানা। ১৯৪৮ সালের মাঝামাঝিতেই ওই শহরের পুরনো অধিবাসীদের সরিয়ে ইহুদি অভিবাসীদের দিয়ে শহরটা ভরে ফেলা হয়। সাঈদ লিখেছেন, তিনি জেরুজালেমের যেখানটায় জন্মেছিলেন, সময় কাটিয়েছেন এবং যাকে তিনি ঘর বলে ভাবতেন, সেই জায়গাটা পুরোপুরি দখল করে নিয়েছিল পোলিশ, জার্মান এবং আমেরিকান অভিবাসীরা, যারা শহরটা ‘জয় করে ফেলে এবং তাকে পরিণত করে তাদের দৃষ্টান্তহীন সার্বভৌমত্বে, যাতে প্যালেস্টাইনি জীবনের কোনো জায়গা ছিল না’ (১১১)। ঘর হারানোর এই বেদনা সাঈদ সারাজীবন বয়ে বেরিয়েছেন বলে তিনি জানেন প্যালেস্টাইনের আদিবাসীদের তা কতটা ক্ষুব্ধ এবং মরিয়া করে তুলেছিল। যারা প্যালেস্টাইনের আরবদের নিজের জীবনের খ-িত টুকরোগুলোকে জোড়া লাগাবার সংগ্রামকে – যা অনেক সময় রক্তাক্ত হতে বাধ্য – একটি নেতিবাচক চাদর-বর্ণনায় ‘উগ্রপন্থী’ বলে শ্রেণিবদ্ধ করতে চান, তারা সাঈদের এই বর্ণনাটুকু পড়লে বুঝতে পারবেন আউট অফ প্লেস আসলে শুধু বুদ্ধিগতভাবে এই বঞ্চনার সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসার বিষয়টিকে শুধু নয়, বরং ঘরের জন্য মানুষের আদিম ও ঐতিহাসিক আবেগকেও সমান গুরুত্ব দিয়ে উপস্থাপিত করে। ঘরের সঙ্গে মানুষের আবেগ বড় গভীরভাবে জড়িত। সাঈদের মতো একজন তাত্ত্বিক, অধ্যাপক ও বুদ্ধিজীবীও তাঁর সাতাশ বছরের বর্ণনায় প্যালেস্টাইন হারানোর অংশে এসে আবেগতাড়িত হন।
জেরুজালেমে জন্ম নিলেও সাঈদ শৈশবের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন মিশরে – কায়রোতে। সেখানে তাঁরা থাকতেন জামালেক নামে নীল নদের একটি দ্বীপে। সাঈদ তাকে বর্ণনা করেছেন একটি ‘উপনিবেশী চৌকি’ হিসেবে। জামালেকের ইউরোপীয় অধিবাসীরাই এর সামাজিক জীবনের ছন্দটি নির্দিষ্ট করে দিত, অথচ ওদের সঙ্গে আরবদের আদান-প্রদান, মেলামেশা ছিল সামান্যই। সাঈদরা ওর ভেতরেই নিজেদের জগৎটি তৈরি করে নেন। কিন্তু কায়রোর জীবনে অনেক ঘটনা, অনেক অভিজ্ঞতা, অনেক পরিচয়ের সমাহার ঘটলেও শেষ পর্যন্ত তাকে ঘর বলে সাজিয়ে নিতে পারেননি সাঈদরা। পঞ্চাশের দশকেও, যখন সাঈদ পড়াশোনার জন্য আমেরিকায় চলে গিয়েছিলেন, মাঝে মাঝে কায়রোতে আসতেন, এক ধরনের ‘ঘরে ফেরার’ মতো। কিন্তু ১৯৬০ সালে জেনারেল মোহাম্মদ নাগিবের কাছ থেকে নাসের ক্ষমতা নিয়ে নিলে ধীরে ধীরে সেই ‘ঘরের’ চরিত্র পরিবর্তিত হতে থাকে। বিদেশীদের প্রতি সরকার ও মানুষের আচরণ কঠিন হতে থাকে। সাঈদ ততদিনে অনেকটা আমেরিকান বনে গেছেন, তাঁর কথাবার্তায় আমেরিকান ইংরেজির সুর, তাঁর আচরণেও আমেরিকান প্রভাব, কাজেই তিনিও ওই বিদেশীদের কাতারেই পড়লেন। ওয়াদি সাঈদের ব্যবসায়ে বাধা এলো, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে তাঁর প্রচুর সমস্যা হতে লাগল। সেগুলো থেকে পরিত্রাণ পেতে তিনি চাতুরির আশ্রয় নিলেন। সাঈদ বাবার ব্যাবসার সঙ্গে নামেমাত্র জড়িত ছিলেন। অফিস যেতেন যখন কায়রোতে থাকতেন, কিন্তু কাজ কিছুই ছিল না। কিন্তু বাবার অনুপস্থিতিতে তাঁকে একদিন একটা চুক্তি স্বাক্ষর করতে হয়। চুক্তিটা ছিল অবৈধ, কাজেই সাঈদকে মাথায় ১৫ বছরের সাজার ভয় নিয়ে কায়রো ছাড়তে হয়। আরো পনেরো বছরের গৃহহীনতাকে তিনি দেখেছিলেন এক স্থায়ী নির্বাসন হিসেবে। জেরুজালেমের পর কায়রোকেও হারাতে হলো তাকে। আউট অফ প্লেস নয়তো কি!
অথচ আমেরিকাতেও যে তিনি ঘর খুঁজে পেয়েছিলেন, এমন নয়। সাঈদের বৃত্তের বাইরের জীবন ছিল আশ্চর্যজনকভাবে বন্ধুহীন। স্কুলে কোনো অন্তরঙ্গ বন্ধু তাঁর ছিল না। বাবা ও মা – উভয় দিকেই ছিল বিশাল কাজিন বাহিনী। তাদের সঙ্গে গ্রীষ্মে, অবকাশে, পারিবারিক অনুষ্ঠানাদিতে অনেক সময় কাটিয়েছেন, অন্তরঙ্গতাও ছিল অনেকের সঙ্গে, কিন্তু সত্যিকার বন্ধুত্ব ছিল না বলতে গেলে কারো সঙ্গে। বাড়িতে মা ছিলেন একমাত্র বন্ধু। সাঈদের চারটি বোন ছিল, কিন্তু তাঁর আত্মজীবনীটি পড়লে মনে হবে, তারা কেউই তাঁর বড় বন্ধু ছিল না। সেজন্যে একাকীত্ব এবং নিঃসঙ্গতাকে সাঈদ মেনে নিতে পারতেন। নিজেকে নিয়ে থাকার একটা সামর্থ্যও তাঁর ছিল। কিন্তু ওই যে ছোটবেলা থেকেই হয় এটা নয় ওটা, কখনো পরিপূর্ণভাবে কোনোটা নয় – এরকম দুয়ের মাঝখানের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন সাঈদ, তাতে কোনো অস্তিত্বই তাঁকে শেষ পর্যন্ত পূর্ণতা দেয়নি। সেজন্যে ছোটবেলা থেকে বই হয়েছে তাঁর সঙ্গী, যৌবনে 888sport live football এবং সংগীত এবং পরিণত বয়সে চিন্তা ও সক্রিয়তার জগতে ঘনিষ্ঠ অংশগ্রহণ তাঁকে দিয়েছে সান্ত¡না। ছোটবেলায় তিনি ছিলেন মুসলমানদের মাঝখানে একজন ক্রিশ্চান, ইংরেজদের মাঝখানে একজন আরব এবং মিশরীয়দের মাঝখানে একজন শামি। আমেরিকাতে এসে পরিচয়-বিভ্রাটটি আরেকটু বাড়ল। সেখানে তিনি নাগরিকত্বে আমেরিকান অথচ প্যালেস্টাইন থেকে উঠে আসা একজন আরব। তাঁর ভাষা, উচ্চারণ, চেহারা, আচার-ব্যবহার বলে দেয় তিনি একজন বিদেশী। ‘জাতীয়তা, পেছনের ইতিহাস, সত্যিকার শিকড় এবং অতীতের কর্মকা- এসবই ছিল আমার সমস্যার উৎস।’ সাঈদ লিখেন, ‘যেসব প্রেতাত্মা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় স্কুল থেকে স্কুলে, গ্রুপ থেকে গ্রুপে, অবস্থা থেকে অবস্থান্তরে, তাদের আমি তাড়াতেই পারছিলাম না’ (১৩৭)।
১৯৪৮ সালে ওয়াদি সাঈদের গুরুতর স্বাস্থ্যগত জটিলতা দেখা দিলে তাঁকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়া হয়। সাঈদও সঙ্গে যান, তবে তাঁকে পাঠানো হয় মেইনের ক্যাম্প মারানাকুক-এ। সেখানে তাঁর প্রথম অভিজ্ঞতা হয় পরিবারকে ছেড়ে এত দীর্ঘ সময়ের জন্যে কোথাও থাকার। এই ক্যাম্প তাঁকে নিঃসঙ্গতার মুখোমুখি দাঁড় করায় এবং তাঁকে প্রস্তুত করে পরিচিতির অনিশ্চিত পথে পদচারণায়। এরপর ১৯৪৯ সালে কায়রোর ভিক্টোরিয়া কলেজে যখন ভর্তি হন সাঈদ, তাঁর পরিচিতির সংকটটি নতুন একটি মোড় নেয়। এই কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এসেছিল বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ধর্ম থেকে। কিন্তু আরবি বলায় নিষেধ ছিল, সাঈদ কলেজের পরিবেশকে বর্ণনা করেছেন ‘অসহ্য’ এবং ‘নিষ্পেষণমূলক’ হিসেবে। এর জগৎকে তিনি বলেছেন বর্ণশঙ্কর। ভিক্টোরিয়া কলেজ তাঁকে কোনো ‘নৈতিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো’ দেয়নি যা দিয়ে নিজেকে পরিমাপ করা যায়, যেন কলেজে ঢোকার আগেই তাঁকে বিচার করে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া শিক্ষকদের আচরণও ছিল নিন্দনীয়। কলেজে শারীরিক শাস্তির ব্যবস্থাও ছিল। তবে এতসব নেতির মধ্যে, সাঈদের বর্ণনায়, একটা ইতিবাচক অবদান ছিল কলেজটির। এখানে এসে তাঁর প্রত্যয় হলো, শিক্ষকদের ধারণা যেহেতু এতই নিচু, পরিশ্রম করে আর কি হবে, কাজেই নিজেকে খুব হাল্কা মনে হতো তাঁর, যেন প্রত্যাশার চাপ নেই, নিজেকে প্রমাণ করার দায় নেই। তাছাড়া ভিক্টোরিয়া কলেজে এসে বাবা-মার তৈরি পরিচিতির খোলসটা যেন আলগা হয়ে গেল। যে নৈতিক মানদ- ছোটবেলা থেকে তাঁকে শিকলে বেঁধে রেখেছিল, তা গেল শিথিল হয়ে। কলেজের উপনিবেশী কাঠামো ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে শুরু হলো সাঈদের উত্তর-উপনিবেশী একটা প্রতিরোধ। কলেজ কর্তৃপক্ষ অবশ্য সাঈদের প্রতিবাদী আচরণকে দেখেছেন ‘নষ্ট হয়ে যাওয়ার’ আলামত হিসেবে। কলেজ থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়।
১৯৫১ সালে সাঈদকে পাঠানো হয় আমেরিকাতে, মাউন্ট হার্মন স্কুলে। সাঈদের জীবনে এই স্কুলটির একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, এই স্কুল তাঁকে প্রকৃত অর্থে নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখিয়েছে। সমাজ ও ধর্ম সম্পর্কে তাঁর চিন্তাগুলোকে সংহত করেছে, ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিষয়ে তাঁকে প্রতিবাদী একটি অবস্থান গ্রহণে অনুপ্রাণিত করেছে। এই স্কুলে পাঠানোর পেছনে তাঁর পিতামাতার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাঁর মধ্যে কাজের প্রতি একটি প্রোটেস্টান্ট নীতি-আদর্শিক নিষ্ঠা তৈরি করা। সাঈদ সেখানে ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত হবেন এরকম কোনো চিন্তা তাঁদের ছিল না। কিন্তু স্কুলটির ধর্মীয় পরিবেশ ছিল সাঈদের জন্যে শ্বাসরুদ্ধকর। স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ডি.এল মুডিকে প্রায় সন্তজ্ঞানে ভক্তি নিবেদন করা হতো, তাঁর প্রদর্শিত ধর্মীয় পথে অগ্রসর হতে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত – বাধ্য না হলেও – করা হতো। সাঈদের প্রবল আপত্তি ছিল এই ধর্মীয় অনুশাসনের আতিশয্য নিয়ে। তাঁর মাতামহ একজন ব্যাপ্টিস্ট ধর্মযাজক ছিলেন, তাঁর মায়ের ধর্মানুরাগ ছিল, কিন্তু সাঈদ কখনো ধর্মকে গুরুত্ব দিয়ে জীবনে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর মায়ের এক খালা ছিলেন যাঁকে সাঈদও আন্ট মিলিয়া বলে ডাকতেন, যাঁর ভালোবাসা সেই শিশুকালে মায়ের ভালোবাসার বিকল্প হিসেবে দেখা দিত সাঈদের কাছে, বিশেষ করে মা তিরস্কার করলে। ১৯৫৬ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে তাকে সাঈদ জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ঈশ্বর বলতে কেউ কি আছেন?’ এবং আন্ট মিলিয়া উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে’ (১৫)। এই সন্দেহ সাঈদের মধ্যেও সংক্রামিত হয়েছিল। তাছাড়া, ধর্মটাকে যখন তিনি সহিংসতা, নিবর্তন এবং নিষ্পেষণের একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখলেন, প্যালেস্টাইন এবং অন্যত্র, তখন এর পুরোহিতদের প্রতি কোনো 888sport apk download apk latest version দেখাতে পারলেন না। মুডিকে সাঈদ বর্ণনা করেছেন একজন ‘শার্লাটান’ অথবা ভ- হিসেবে এবং অবাক হয়ে দেখেছেন, পুরো মাউন্ট হার্মনের কেউই – সাঈদ এবং আরো দুই ব্যতিক্রম ছাড়া – মুডি যে সব প্রশংসার দাবিদার হতে পারেন না, সে ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করছে না (২৩৪)।
হিল্ডা সাঈদের ধর্মযাজক পিতার পরিবারের লোকজন ধর্ম নিয়ে যতটা অনুরাগী ছিলেন, ততটা যুদ্ধংদেহী ছিলেন মুসলমান 888sport free betলঘু এলাকায় ক্রিশ্চান হিসেবে বসবাসের ব্যাপারে। ধর্মকে তারা পরিচিতি এবং অস্তিত্ব রক্ষার একটা উপায় হিসেবে গণ্য করতেন। আর সাঈদ বিষয়টাকে দেখতেন সমালোচকের দৃষ্টিতে। সাঈদের মামা-নানারা ইসলামকে দেখতেন মার্কিনিদের দৃষ্টি দিয়ে, যা ছিল প্রকৃতই অবমাননাকর। আমেরিকার প্রশাসন, মিডিয়া এবং এ দুয়ের কল্যাণে সাধারণ মানুষজনও সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই ইসরায়েল রাষ্ট্রকে সমর্থন দিয়ে আসছে। যে-উৎসাহে ইসরায়েলকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে, ঠিক সেই অনুপাত উৎসাহ নিয়েই যেন ইসলামকে খাটো করে দেখার একটা প্রয়াস চলেছে আমেরিকাতে। সাঈদ তাঁর নানা-মামাদের এই অযৌক্তিক পক্ষাবলম্বন এবং ইসলাম-বিদ্বেষকে গ্রহণ করতে পারেননি। এর একটি কারণ অবশ্যই ধর্ম সম্পর্কে তাঁর নির্মোহ দৃষ্টি এবং ধর্ম থেকেও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীকে বরং বিবেচনা করার প্রবণতা; দ্বিতীয় একটি কারণ, সাঈদের ভাষায়, হচ্ছে, তাঁর বাবা-মা ও বোনদের মধ্যে ‘ইসলাম সম্পর্কে বৈরিতার মৌলিক কোনো ধারণার অনুপস্থিতি’ (১৬৯)। প্রকৃতই উদারপন্থি ছিল পরিবারটি।
মাউন্ট হার্মন স্কুল তাঁকে দ্বিতীয় একটা গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জনে সাহায্য করেছিল, যদিও বিষয়টি শেষপর্যন্ত স্কুলটির বিপক্ষেই যায়। শিক্ষকরা যদিও বাইরে ছিলেন যতœবান, ‘অভিন্ন এবং ভাগ করে নেওয়ার মতো মূল্যবোধে’ প্রবলভাবে বিশ্বাসী, নেতৃত্ব অথবা সুনাগরিকত্বের মতো বিমূর্ত বিষয়কে শিক্ষার্থীদের জীবনে প্রতিফলিত করতে সংকল্পবদ্ধ, ভেতরে ভেতরে তারা – তাদের কেউ কেউ অন্তত – ভিন্ন একটি চরিত্র লালন করতেন। সাঈদ লিখেছেন, ‘মাউন্ট হার্মনে থাকার সময় আমাকে কখনো ফ্লোর অফিসার, টেবিলের প্রধান, ছাত্র সংসদের সদস্য অথবা ভ্যালেডিকটোরিয়ান (দাপ্তরিকভাবে ক্লাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ) এবং স্যালুটোরিয়ান (দ্বিতীয়) করা হয়নি, যদিও আমার সকল যোগ্যতা ছিল (২৩০)। কেন করা হয়নি, সাঈদ তা কখনো জানতে পারেননি, যদিও এটি খুব দুর্জ্ঞেয় হওয়ার কথা নয়। সাঈদ শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান হলে নিশ্চয় এ কথাগুলো তাঁকে লিখতে হতো না। তবে এই অবিচার তাঁকে একটা শিক্ষা দিয়েছিল। ‘আমি দ্রুত আবিষ্কার করলাম যে আমাকে কর্তৃত্ব থেকে নিজেকে সুরক্ষা দিতে হবে’ (২৩০)। একই সঙ্গে, তিনি নিজে যা, তা হতে, সেই হিসেবে বেড়ে উঠতে এবং স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে যে রূপে দেখতে চায়, তা না হতে – সেই
সম্ভাবনাকে ঠেকাতে, কিছু কলাকৌশল যে তাকে রপ্ত করতে হবে এই অনুধাবনটি স্পষ্টরূপ গ্রহণ করছিল। এই প্রক্রিয়ায় এক জীবনব্যাপী সংগ্রামের সূত্রপাতও প্রত্যক্ষ করেন সাঈদ, যে সংগ্রাম ক্ষমতার মর্জি এবং ভ-ামির বিরুদ্ধে। ভ-ামি – কারণ মাউন্ট হার্মন স্কুলে তিনি দেখেছেন কিভাবে অনেক ভালো ভালো উদ্দেশ্যের আবরণে আসলে কর্তৃপক্ষ তাঁকে একটা পূর্ব-আরোপিত বিচারসূত্রে রীতিবদ্ধ করে ফেলেছে।
মাউন্ট হার্মন স্কুল কখনো সাঈদকে তাঁর অস্বস্তি আর অনীহাকে ভুলতে দেয়নি। কিন্তু কিভাবে এসবের প্রভাবকে গুরুত্বহীন করে ফেলা যায়, তা-ও সাঈদ শিখেছেন এই স্কুলে। নিজেকে এবং পরিপার্শ্বকে ভুলে থাকার একটা প্রক্রিয়ায় তিনি এমন সব বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, যেগুলো থেকে তিনি তৃপ্তি পাবেন। ‘এর বেশিরভাগ – সব না হলেও – বুদ্ধিবৃত্তিক’ (২৪০)। বুদ্ধিবৃত্তিকে জীবনের কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠা দেওয়ার পেছনে স্কুলটির সত্যি একটি বড় অবদান ছিল।
মাউন্ট হার্মন থেকে ১৯৫৩ সালে সাঈদ গেলেন প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঈদের মানসগঠনের একটি পর্যায় পরিপূর্ণতা পেল। প্রক্রিয়াটি অবশ্য সহজ ছিল না – এখানেও তাঁকে সংগ্রাম করতে হয়েছে নানা প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে। এখন প্রিন্সটন বলতে যে আধুনিক, কসমোপলিটান এবং মিশ্র সংস্কৃতির একটি প্রতিষ্ঠান বোঝায়, সে সময় তা ছিল না। শুধু ছাত্ররাই পড়তো প্রিন্সটনে, ছাত্রীদের জন্য দরোজা ছিল বন্ধ। কালোরাও অনুপস্থিত ছিল, বিদেশীদের 888sport free bet ছিল নগণ্য। গাড়ি ছিল নিষিদ্ধ এবং শনিবার (তা-ও সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত) ছাড়া মেয়েরাও। এরকম পরিবেশে নিজের ‘বিদেশীত্ব’ অনেক বেশি প্রকট হয়ে দাঁড়ায়। সাঈদ প্রিন্সটনের পরিবেশকে বর্ণনা করেছেন ‘গ্রাম্য’ এবং ‘বিষাক্ত’ হিসেবে। ফেব্রুয়ারি মাসের দুই সপ্তাহে ‘বিকার’ নামে একটি জঘন্য পদ্ধতির মাধ্যমে সকল ছাত্রকে কোনো না কোনো ক্লাবের সদস্য হতে হতো। বিকার ছিল একটি অমানবিক প্রথা, র্যাগিং থেকেও অনেক বেশি অবমাননাকর। সাঈদ এই বিষাক্ত পরিবেশ থেকে গা-বাঁচানোর জন্যে একটি প্রতিষেধকের আশ্রয় নিলেন – যা ছিল লেখা এবং পড়া। তিনি মেজর বিষয় হিসেবে নিলেন হিউম্যানিটিস – তবে 888sport live football নয়। এর ফলে তাঁর পড়াশোনার ব্যাপ্তি বেড়ে গেল। তিনি ক্রমাগত এবং প্রচুর পড়তেন, তাঁর 888sport sign up bonusশক্তিও ছিল প্রখর – যে 888sport sign up bonusশক্তিকে এই বইয়ে এক জায়গায় তাঁর পাওয়া সবচেয়ে বড় উপহার হিসেবে বর্ণনা করেছেন তিনি। প্রিন্সটনে তাঁর পড়ার জগতে দিক নির্দেশক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন দুজন বিদগ্ধ অধ্যাপক – আর.পি. ব্ল্যাকমুর এবং আর্থার জাথমারি। ব্ল্যাকমুর ছিলেন 888sport live footballের শিক্ষক, জাথমারি দর্শনের। শেষোক্ত জন ছিলেন তাঁর মতোই সংশয়বাদী, তবে তাঁর ছিল প্রচলিত চিন্তা মতবাদ ইত্যাদি সম্পর্কে প্রচুর প্রশ্ন এবং অনেক ক্ষেত্রে অ888sport apk download apk latest version। ব্ল্যাকমুর আধুনিক 888sport app download apkর ব্যাখ্যা দিতেন, অর্থ খুঁজতেন – এবং তাঁর বিশ্লেষী ক্ষমতা সাঈদকে আকর্ষণ করতো। ‘ব্যাখ্যার আনন্দ’ সাইদ গ্রহণ করেছেন ব্ল্যাকমুর থেকে।
হার্ভার্ডে যে পাঁচ বছর (১৯৫৮-৬৩) কাটিয়েছেন সাঈদ, 888sport live footballে একজন গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট হিসেবে, তাকে সংক্ষিপ্ত কলেবরে বর্ণনা করেছেন তিনি, আউট অফ প্লেস-এর শেষ কটি পৃষ্ঠায়। বলেছেন, হার্ভার্ডের বছরগুলো বস্তুত ছিল প্রিন্সটনেরই বুদ্ধিবৃত্তিক সম্প্রসারণ। শিক্ষকদের পড়ানো ছিল গৎবাঁধা, ছাত্ররা ছিল নিষ্ক্রিয় গ্রাহক, যদিও সাঈদ নিজে পড়াশোনা করতেন একজন ক্ষুধার্ত মানুষের খাদ্যভক্ষণের মতো। হার্ভার্ডে নিজেদের আউট অফ প্লেস মনে হতো, যেন বা ভুল জায়গায় এসে পড়েছেন। যেটুকু মৌলিক অর্জন বলে মনে হয়েছে তাঁর, তা ছিল অ্যাকাডেমিক চর্চার বাইরে কয়েকজন বিদগ্ধ ব্যক্তির সংস্পর্শে এসে, যেমন আর্থার গোল্ড, মাইকেল ফ্রাইড এবং টম কার্নিচেলি।
তাছাড়া ভিকো, সার্ত্র, হাইডেগার, মার্লু-পন্টির মতো লেখক-দার্শনিকের মতবাদ অথবা চিন্তা-ভাবনা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল।
হার্ভার্ডে সাঈদের সংগীতের প্রতি নিষ্ঠা আরেকটু দৃঢ় হয়েছিল। তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড় সাংগীতিক প্রভাব বলে যাকে তিনি বর্ণনা করেন, সেই ইগনাস টিয়েগারম্যান নামে ক্ষুদ্রাকৃতির এক পোলিশ পিয়ানোবাদক, হার্ভার্ডেও তাঁকে অনুপ্রাণিত করে যেতে থাকেন। টিয়েগারম্যান তাঁকে হাতে ধরিয়ে শিখিয়েছেন অনেক কিছু। এক সময় সাঈদ পেশাদার পিয়ানোবাদক হতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পরে সে ইচ্ছায় ভাটা পড়ে যায়। সাঈদের জীবনে সংগীত নিয়ে অবশ্য স্বতন্ত্র একটি 888sport live – হয়তো একটি বইও লেখা যায়, তবে এ নিবন্ধে পরিসর স্বল্পতার জন্য বিষয়টি শুধুই উল্লেখ করা হলো।
তিন
আউট অফ প্লেস জুড়ে রয়েছে স্থানচ্যুতির শংকা ও উদ্বেগ, এক আদিম অস্থিরতা- যা শুধু ঘরের সন্ধানে নয়, বরং অস্তিত্বের সন্ধানে মানুষকে চালিত করে। নিজের চামড়ার ভেতরে যেন অন্য কেউ বাসা বেঁধেছিল – এরকম ভাবতেন সাঈদ। ঘর হারানো মানুষ নির্বাসনে গিয়ে ঘর খোঁজে। কিন্তু আমেরিকাতে গিয়েও তিনি ঘর-পাননি। যেসব আরব থাকত আমেরিকাতে – ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, চাকরিজীবী – তাদেরকে খুব অদ্ভুত মনে হতো সাঈদের। তারা জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট, অতীতকে ভুলে যাবার চেষ্টায় যেন রত। তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হতো না সাঈদের। পড়াশোনার রুটিন এবং পুনরাবৃত্ত জীবনে সাঈদ প্যালেস্টাইনকে কিছুটা ভুলেও গিয়েছিলেন। নিজেই স্বীকার করেছেন, কিভাবে কিছুটা ‘অরাজনৈতিক’ জীবন কেটেছে তাঁর। তবে তা এজন্যে নয় যে বাবা রাজনীতি পছন্দ করতেন না। সাঈদকে কড়া করে বলে দিয়েছিলেন, ‘888sport live footballের অধ্যাপনা করছ, ও নিয়েই থাকো।’ এ অবশ্য হার্ভার্ড থেকে বেরুনোর পর। কিন্তু সাতাশ বছরের জীবনে কখনো অরাজনৈতিক ছিলেন না সাঈদ – একটা অবস্থান তাঁর আপনা-আপনিই নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থানটা ছিল নির্যাতিত প্যালেস্টাইনিদের পক্ষে, ক্ষমতা ও শক্তির বিরুদ্ধে, মানুষকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করতে বাধ্য করে যেসব নিয়ম-শৃঙ্খলা – উপনিবেশী থেকে নিয়ে পারিবারিক পর্যায় পর্যন্ত যেগুলোর প্রয়োগ – সেসবের বিরুদ্ধে। তাঁর একটা সুচিহ্নিত অবস্থান ছিল চিন্তা ও জ্ঞানের জগতে, পশ্চিমের আধিপত্যের কারণে সৃষ্ট অসংখ্য সামান্যিকরণের প্রবণতার বিরুদ্ধে। এই অবস্থান তিনি চিন্তা ও সক্রিয়তা – এ দুই অঞ্চলেই গ্রহণ করেছিলেন।
আউট অফ প্লেস যেহেতু আত্মজীবনী, শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের দিনগুলোর, সেজন্য তাতে অবধারিতভাবে ভিড় জমিয়েছেন অসংখ্য মানুষ। কিছু আত্মীয়, কিছু পরিচিতজন। কেউ শিক্ষক, চিন্তাবিদ, কেউ রাজনীতিবিদ। এই অসংখ্য মানুষ উপস্থিত হয়েছেন নানা শ্রেণিতে বিভক্ত হয়ে, কিন্তু প্রত্যেক চরিত্রই, যাকে বলে, অনন্য। চরিত্রকে সজীব করে তোলার, তাদের জীবনে আমাদের প্রবিষ্ট করাবার যে কুশলতা সাঈদের রয়েছে, তা একজন বড় ঔপন্যাসিকের মতোই স্বতঃস্ফূর্ত মনে হবে এই আত্মজীবনীতে।
অনেক চরিত্রের মধ্যে কিছু এমন চরিত্র রয়েছে, যাদের আসা-যাওয়াটা যেন হয় অন্যের হাত ধরে, অথচ তারা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন সাঈদের বৃহত্তর আখ্যানে। প্যালেস্টাইন যখন ইসরায়েলের অধিকারে চলে যায় এবং ইহুদিদের সঙ্গে আরবদের দূরত্ব বাড়ে, তখন সাঈদের কাছে এটি একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি বলেও মনে হয়। ডেভিড এজরা নামে এক ইহুদি বন্ধু ছিল তাঁর, কিন্তু যখন প্যালেস্টাইনের পরিস্থিতি উত্তেজনাকর হয়ে দাঁড়ায়, ধর্মীয় উগ্রবাদ পরিব্যাপ্ত হয়, আরব ও ইহুদিদের মাঝখানে একটা বিরাট দেয়াল দাঁড়িয়ে যায়, তখন ডেভিডের সঙ্গে সাঈদের সম্পর্কটাও শেষ হয়ে যায়। এই ঘটনাটি একটি প্রতীকী তাৎপর্যে প্রতিষ্ঠা করেন সাঈদ।
আত্মজীবনী – এবং জীবনের প্রায় সাতাশ বছরের- হলেও আউট অফ প্লেস-এ সাঈদ তাঁর যৌন জীবন নিয়ে প্রায় কিছুই লেখেননি। তাঁর নিজের অবদমিত যৌনতার উল্লেখ আছে, কৈশোরের শারীরিক উচ্ছ্বাসের কথা আছে, এক বন্ধুর হস্তমৈথুনের গল্প আছে – কিন্তু ঘুরেফিরে পরিবারের কঠিন নৈতিকতার কাছে এসব আবেগ-উচ্ছ্বাসের স্ফূর্তিহীন মিলিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিতটাও রয়েছে। তবে সপ্তম পরিচ্ছেদে ধুর-এ তাঁর জীবনে এক তরুণীর প্রবেশের ছোট্ট গল্পও আছে। টেনিস খেলা তাঁকে পিতামাতা থেকে স্বাধীন একটা জীবন-যাপনের সুযোগ দিয়েছিল উল্লেখ করে সাঈদ জানাচ্ছেন, তাবারা ক্লাবে তাঁর পরিচয় হয় নাইফ পাশা ইমাদের দুই মেয়ের সঙ্গে। তাঁর একজন ইভা, সাঈদ থেকে সাত বছরের বড়। ‘অবিবাহিতা, বিত্তশালী এবং তার পরিপার্শ্ব থেকে সামাজিকভাবে বিচ্যুত। ইভা ছিলেন প্রথম 888sport promo code সত্যিকারভাবে আমি যার কাছে আসতে পেরেছিলাম’ (১৭৮)। আত্মজীবনীতে প্রেম ও যৌনতার অনুপস্থিতি অনেকের কাছে অবাক হওয়ার মতো হলেও যারা সাঈদের লেখা পড়েছেন, তারা জানেন তিনি আসলেই খুব প্রাইভেট মানুষ ছিলেন। একটা লাইন তিনি টেনে দিতেন তাঁর চারপাশে, যার ভেতরে একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়গুলো থেকে যেত পাঠকের দৃষ্টির বাইরে।
চার
আউট অফ প্লেস কেন গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস ও 888sport live footballের পাঠকদের – বিশেষ করে 888sport live footballকে যারা জীবন ও তত্ত্বের সঙ্গে মিলিয়ে পড়বেন তাদের জন্য এবং যারা সাঈদের প্রাচ্যবাদ ও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ ও সক্রিয়তার বিষয়টি অনুসরণ করেন, তাঁদের জন্য – তা পরিষ্কার হয় একেবারে গোড়া থেকেই। উত্তর-উপনিবেশী 888sport live football তত্ত্বে যে ভিন্নকরণ – বা ড়ঃযবৎরহম-প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়, যা এক মানুষকে তার স্থির কেন্দ্র থেকে চ্যুত করে প্রান্তে পাঠিয়ে দেয়, সেই মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তার পরিপার্শ্ব থেকে এবং নিজের অজান্তে সে উপনিবেশী একটি সত্তা – প্রজা অথবা সাবজেক্টে পরিণত হয়, তার প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। ঘরে বাবা-মার শাসন, স্কুলে শিক্ষকদের এবং বড় পৃথিবীটাতে স্বার্থপর, অন্ধ রাজনীতির বিধ্বংসী খেলা – এই ত্রয়ী প্রভাবে সাঈদের জীবনে কেন্দ্রচ্যুতি ঘটছিল। তাঁকে অবশ্য পায়ের নিচে মাটি যুগিয়েছে 888sport live football, সংগীত, জ্ঞানের জগৎ। এই জ্ঞানতাত্ত্বিক ভূমি থেকে তিনি তাঁর অবস্থান, সমকালীন ইতিহাস, রাজনীতি – এসবকে বিশ্লেষণ করেছেন, তাদের পরস্পরবিরোধী অনেক প্রকাশকে সূত্রবদ্ধ করেছেন। 888sport live football নিয়ে তাঁর উচ্ছ্বাস প্রবল। ধুর-এর গ্রীষ্ম-অবকাশের সাঈদ প্রচুর পড়াশোনা করতেন। স্কুলে তো পড়াশোনাটাই ছিল নিজের কাছে পালিয়ে আসার একটা সুযোগ। আউট অফ প্লেস-এর শুরুর দিকের বর্ণনায় আছে, এই পালানোর তাঁর উপায় ছিল দুটি – প্রথমত রূপকথা আর বাইবেলের গল্প, গ্রিক পুরাণ। দ্বিতীয়ত, সিনেমা, বিশেষ করে আরব্যরজনীর গল্প, ওয়েস্টার্ন ফিল্ম এসব। সেই কৈশোর থেকে সাঈদ যে সব বই পড়েছেন, সিনেমা দেখেছেন, সে-সব ছিল তাঁর খুব প্রিয়, সেগুলোকে, তাঁর ভাষাতেই, প্রাচ্যবাদী চিন্তায় পূর্ণ বলে আমরা দেখতে পাই। এই আত্মজীবনীতে ওরিয়েন্টালিজমের অনেক খোরাক রয়েছে।
স্কুল-কলেজে পড়ার সময় যে-সব পাঠ্যক্রম ছিল সাঈদের, সেগুলো সম্পর্কে তাঁর হতাশা ও সমালোচনা ছিল। ‘আমরা ইংল্যান্ডের জীবন ও 888sport live football নিয়ে পড়তাম, রাজা ও পার্লামেন্ট, ভারত ও আফ্রিকা নিয়ে, অভ্যাস ও বাকধারা নিয়ে পড়তাম, যার কোনো ব্যবহার আমরা ইজিপ্টে অথবা অন্য কোথাও করতে পারতাম না।’ লিখেছেন সাঈদ, ‘আমরা নিজেদের নিকৃষ্ট ভাবতাম…’ (১৮৬)। এই প্রবণতার বিরুদ্ধে সাঈদ, অন্তত নিজের জীবনে, একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন সেই শুরু থেকেই।
আউট অফ প্লেস-এ সাঈদ তাঁর অনেকখানি জীবনীশক্তি বিনিয়োগ করেছিলেন – এ বইটি তিনি লিখেছেন মৃত্যুর ছায়ার নিচে বসে। তিনি চেষ্টা করেছেন, তাঁর কথাগুলো যেন সব বলা হয়ে যায়, যেন পাঠক এবং তাঁর মাঝখানে কোনো ফাঁক না থাকে। শুরুতে একটি মুখবন্ধ লিখেছেন – সেখানে এই আত্মজীবনীর উদ্দেশ্য-উপায় এসব নিয়ে বলেছেন। আবার নবম পরিচ্ছেদে এসে কাহিনী থেকে বের হয়ে চলে এসেছেন ১৯৯১ সালে, গালফ যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে নানান উদ্বেগের সঙ্গে নিজের ক্যান্সার ধরা পড়ার কথা আবার লিখেছেন। তাঁর অসুস্থতার সঙ্গে আত্মজীবনীর একটি নিবিড় সংযোগের কথা নিজেই বলেছেন, যদিও এর ঘটনাপ্রবাহ অসুস্থতার ৩০ বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। ‘এই বইয়ের সময়ে আমার অসুস্থতার সময়, পর্যায় এবং ওঠানামার সঙ্গে অন্তরঙ্গভাবে জড়িত,’ লিখেছেন সাঈদ, তার পর জানান, লেখাটা হচ্ছে যেরকম একটি শব্দ থেকে আরেকটি শব্দে এগিয়ে যাওয়া, অসুস্থতাও এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় যাওয়ার মতো – দুটোতেই আছে কষ্ট (২১৬)। সাঈদ জানাচ্ছেন, এ বইটির একটা প্রধান বিষয় হচ্ছে তাঁর সচেতনভাবে নির্মিত সত্তাটির ভেতরে লুকিয়ে থাকা আরেকটি সত্তার আবিষ্কার, যে সত্তাটিকে তিনি বলেছেন – ‘সেকেন্ড সেল্ফ’ (২১৭)। এই সেকেন্ড সেল্ফটি আসলে আমাদের অনেক প্রশ্নের উত্তর জানিয়ে দেয়, আবার অনেক জিজ্ঞাসার দ্বারপ্রান্তে দাঁড় করিয়ে দেয়; আমাদের ভাবায়, অনুপ্রাণিত করে, আমাদের তার সহযাত্রীতে পরিণত করে। কিন্তু দুটি সত্তার সম্মিলনে যে সাঈদ, তিনি বারবার থেকে যান আউট অফ প্লেস – যেন ঘরেরও নয়, পারেরও নয়, মাঝখানে এক অনিশ্চিত এলাকায় যার বাস এবং একটা নিশ্চিতির জন্য যার আজীবন সংগ্রাম।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.