সৌরীন ভট্টাচার্য
মহাশ্বেতাদির যে-ছবি আমার মনে মুদ্রিত হয়ে আছে সে ওই ঘোরানো লোহার সিঁড়ির বাড়ি। বালিগঞ্জ স্টেশন রোডে। ওইরকম সরু লোহার সিঁড়ি আগের দিনের বাড়িতে খুব দেখা যেত। সাধারণত ওটা হতো পেছন দিক বা পাশের দিকের সিঁড়ি। মহাশ্বেতাদি ওই যে-বাড়িটায় থাকতেন সেটাও আমার ধারণা বাড়ির পেছনের দিকই। গোটা বাড়িটা বোধহয় একটা গেস্টহাউস। প্রধান অংশ সামনের দিকে। আমরা ওই ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে উঠতে-উঠতে নিজেরা বলাবলি করতাম এই সরু সিঁড়ি দিয়ে উনি রোজ ওঠানামা করেন। কিন্তু এ-কথা ওঁকে বললেই মুখ-ঝামটা সুনিশ্চিত। আমাদের মতো সমাজের সুবিধাভোগী লোকদের জীবনযাপনের কোনো অসুবিধার কথা তুললে আর উপায় ছিল না। আমরা তো আমাদের বাইরে-বাইরে যারা তাদের কথা বিশেষ মাথায় রাখি না। তাই সেটা ভালোমতো দেগে দেওয়ার জন্য বোধহয় ওরকমভাবে বলতেন। উনি ওরকম বলবেন বলেও আমরা মাঝে-মাঝে খুঁচিয়ে ওই ধরনের কথাবার্তা তুলতাম। বুঝতেন, হাসতে-হাসতে ওঁর যা শোনাবার তাও শোনাতেন।
আমি মহাশ্বেতাদির ওই বাড়িতেই বেশি গেছি। ওখান থেকে উনি যখন গলফ গ্রিনের বাড়িতে এলেন, তখনো কয়েকবার গেছি। কসবার বাড়িতে আর আমার যাওয়াই হয়নি। পরের দিকে দেখাশোনা কমে এসেছিল। মাঝে-মাঝে ফোন করতেন। ওঁর মাথায়-আসা নতুন কোনো আইডিয়ার কথা বলতেন। আমার মতো কর্মবিমুখ, সোজা কথায় ফাঁকিবাজ, ওঁকে এটাসেটা বলে পাশ কাটাতাম। ঠিক বুঝতেন, ধমক-ধামক যা দেওয়ার ঠিক দিতেন। এসব ইন্টেলেকচুয়ালদের দিয়ে কিসসু হবে না। আমিও বলতাম, আচ্ছা আমাকে বলছেন বলুন, সব ইন্টেলেকচুয়ালকে গালাগাল দিচ্ছেন কেন। তাঁরা আমার চেয়ে অনেক ভালো লোক, আমার মতো গোলমেলে লোক নন তাঁরা। বলতেন সব জানি – সুরটা এমন যে পরের বাক্যটা যেন অনিবার্যভাবে হবে, সব ব্যাটাকেই জানি। ওঁকে যাঁরা জানেন তাঁরা ভালোই জানেন ওঁর কথাবার্তার ধরন ও মুখের ভাষার রীতি। সে-রীতি ‘ভদ্রলোকের’ শালীনতার বুলিতে নিজেকে অকারণে বেঁধে রাখবে কেন। বিদ্যাসাগর বিষয়ে লিখতে গিয়ে রাধারমণ মিত্র লিখেছিলেন, বিদ্যাসাগর মশায়ের মুখের ভাষা ঠিক বিদ্যাসাগরী ছিল না। মহাশ্বেতাদিও মুখ টিপে হাসতে-হাসতে আমাদের সঙ্গে দিব্যি, আমরা বলতাম, বাংলা বলতেন। এমনও হয়েছে যে, আমাদের সঙ্গে অপ্রাপ্তবয়স্ক কেউ গেছে ওঁকে দেখবে বলে। তারা অনেকেই ওঁর ন্যাদোশের এমন ভক্ত যে, সে-লেখককে চোখে দেখার লোভ তারা সামলাবে কেন। পরিবার নিয়ে ওঁর লেখাগুলো সত্যিই সেই জাতের, বাচ্চাদের ঠেকানো যাবে কেন। সেরকম ঘটলে উনি আবার বলতেন, সঙ্গে করে এদের নিয়ে এসেছে, একটু যে বাংলা বলব তারও উপায় নেই।
ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে উঠে সামনের ঘরেই জুতো খুলে ঘরে ঢুকতে হতো। ওই জুতো খোলার ঘরে ঢুকে সিঁড়ির সোজাসুজি দাঁড়ালে বাঁদিকে একটা ঘর আর মুখোমুখি আর একটা ঘর। মুখোমুখি ঘরটা বড়। প্রথম যেদিন ও-বাড়িতে গিয়েছিলাম সেদিন ওই ঘরে বসেই কথা বলেছিলাম। পরে যতবার গেছি ওই বাঁদিকের ঘরে বসেছি। আসলে ওই বড় ঘরটা সংসারের ভেতর দিক। বাইরের ঘরে বসেই ওই ভেতরের দিকে তাকিয়ে বলতেন এ-ঘরে দু-কাপ চা দিয়ে যেতে। বাইরের ঘরে বসে জানালা দিয়ে দেখা যেত সংলগ্ন বেশ বড় খোলা ছাদ। ছাদে যেতে হতো সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরে না ঢুকে একটা-দুটো সিমেন্টের নিচু সিঁড়ি পেরিয়ে। অনেকদিন মহাশ্বেতাদিকে ওই ছাদেই দেখেছি আমি। বোধহয় শীতের দিনে রোদ্দুরে টুল নিয়ে বসে কিছু পড়ছেন। ওঠার সময়ে দেখতে পেয়ে বলতেন, বোসো, আসছি। অন্তত একদিন দেখেছি ওই খোলা ছাদে পাখি পায়রাদের গম-চাল কিছু একটা ছড়িয়ে-ছড়িয়ে খাওয়াচ্ছেন। পেছনে লাগার মতো করে বলতাম, তবে এই যে এত চোটপাট করেন, এইতো দিব্যি পায়রা খাওয়াচ্ছেন। ওঁর সেই যে মুখ টিপে হাসার একটা ভঙ্গি ছিল সেই হাসিটা হাসতেন। কোন কথার পিঠে কোন কথা আসত তা আর তেমন গুছিয়ে মনে পড়ে না এখন। কিন্তু কথা অনেক বেশ মনে আছে।
নানা প্রসঙ্গে বাম রাজনীতির কথা এসে পড়ত। আমি যখনকার কথা বলছি সে কিন্তু সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের অনেক আগের কথা। পশ্চিমবঙ্গে বামেদের নিয়ে তখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। কিন্তু প্রশ্ন তো আমাদের অনেক ছিল। মহাশ্বেতাদিও একদিন অনেকটা কথা বলেছিলেন। খুব নরম সুরে। মোটেই কোনো রাগ ঝরাচ্ছিলেন না সেদিন। বলেছিলেন, বামেদের মধ্যে থেকে ভালোবাসা এভাবে হারিয়ে গেল কেন বল তো। এই সেদিন, মহাশ্বেতাদির মৃত্যুর পরে, টিভিতে একটা সাক্ষাৎকার দেখলাম, নবীন কিশোরের সঙ্গে কথোপকথন। সেখানেও এই রকম নরম সুরে অনেক কথা বলেছিলেন উনি। গান্ধীর মৃত্যুর দিনের যেসব কথা বলছিলেন তা খুব স্পর্শ করে। সত্যি কথা বলতে, সেদিন যে-সুরটা ওঁর কথায় পেলাম সেটা আমারও প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় আছে। আমার বয়স তখন অবশ্যই কম, তবে এত কম নয় যে, কী ঘটে গেল তা বুঝিনি। বেশ বুঝেছিলাম এবং সেদিনের পুরো থমথমে আবহাওয়ার কথা আমার আজো দিব্যি মনের মধ্যে চেপে আছে। ফলে ওই সাক্ষাৎকারে মহাশ্বেতাদির অতটা নরম মনের কথা খুব টেনেছিল আমাকে। এই দিকটা ওঁর মধ্যে আমি কখনো-কখনো দেখেছি। চাপা থাকত। অনেক সময়ে হয়তো চাপাই থাকত। হয়তো নিজে চেষ্টা করেও কখনো চাপা দিতেন। বাইরের যে-চেহারাটা ছিল হয়তো তার সঙ্গে অনেকে এর মিল পাবেন না। আমার অবশ্য দুটো চেহারা নিয়ে কখনো খুব অসুবিধা হয়নি। আমাদের অনেককেই তো সংসারের দারুণ ঠেলা সামলাতে নানা চেহারার ছদ্মবেশ ধারণ করতে হয়। এ-ছদ্মবেশ বাইরের জন্য নয়। নিজেরই জন্য নিজের কাছেই নানা চেহারার ছলাকলা লাগে। সমস্যা এই যে, সংসার তা বেশিরভাগ সময়েই বোঝে না। আবার অনেক সময়ে ছদ্মবেশ কখনো যে নিজেকে পেয়ে বসে না, তাও নয়। নিজেকে তো তাই নিজের কাছ থেকে বাঁচানোই বড় দায় হয়ে ওঠে। এই এক মোকাবেলা চলতেই থাকে।
মহাশ্বেতাদির অনেক কান্না দেখার সুযোগ হয়েছে আমার। অনেক কান্না ছিল ওঁর জীবনে। এমন নয় যে, আমার সঙ্গে কখনো তা আলাদা ভাগ করে নিয়েছেন উনি। সেই অন্দরমহলে, বিশেষ করে আমার, প্রবেশের কোনো জায়গা ছিল, তাও নয়। এসব নিয়ে সবার জন্য উনি যা বলেছেন বা লিখেছেন, আমারও সম্বল তাই। কিন্তু কান্নাটাকে দেখতে পারলে অনেকদূর দেখা যায়। ওঁর এক ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর পরে সুরেশদার সঙ্গে ওঁর কাছে গিয়েছিলাম। আমাদের গুরুজন সহকর্মী সুরেশ মৈত্র মহাশ্বেতাদির বিজয়গড় কলেজের বন্ধু-সহকর্মী। দুপুরবেলার দিকে গিয়েছিলাম আমাদের বন্ধু অশোকের সাদার্ন অ্যাভিনিউর ফ্ল্যাটে। মহাশ্বেতাদি তখন ওখানে ছিলেন। ঘরে ঢুকতে উনি সুরেশদাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে চুপ করে সে-দৃশ্য দেখলাম। শান্ত হলেন কিছু পরে। অনেক কান্না ঝরে পড়েছিল সেদিন।
888sport appsের আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মৃত্যু হয়েছিল অকালে। কলকাতার নার্সিং হোমে যখন তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচার হয় তখন আমাদের অনেকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। কলকাতায় স্বাভাবিকভাবে তাঁর অনেক বন্ধু ও গুণগ্রাহী। খোয়াবনামা কলকাতার লেখার জগতে তখন রীতিমতো একটা ঘটনা ছিল। চিলেকোঠার সেপাই ও খোয়াবনামার লেখক গুরুতর অসুস্থ। কলকাতা উদ্বিগ্ন। শেষ খারাপ খবর একদিন এলো। আমি প্রথম খবরটা পেলাম মহাশ্বেতাদির টেলিফোনে। কয়েকদিন ধরেই এ-ওর কাছে খবর নিচ্ছিলেন ইলিয়াস কেমন আছেন। 888sport appsের সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ বেশি তাঁদের মারফতই খবর পাওয়া যাচ্ছিল।
মহাশ্বেতাদির টেলিফোন এলো সকালের দিকে। শুনেছ, ইলিয়াস নেই, বলেই অঝোরে কাঁদতে থাকলেন। আমি এপারে টেলিফোন ধরে চুপ করে আছি। ওই কান্নার মধ্যেই অনেক কথা বলতে থাকলেন। শেষবার দেখা হওয়ার সময়ে উনি অসুস্থ ইলিয়াসকে গান শুনিয়েছিলেন, ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন, এসব যেমন হয় এমনি সময়ে। আমি চুপ করেই আছি। বলার তো সত্যি কিছু নেই। একবার শুধু বলেছি, কাঁদবেন না, কী করবেন কেঁদে বলুন… ব্যস, আমাকে স্বভাবসিদ্ধ ধমক, মানে, কী বলছ কি তুমি, ইলিয়াস চলে গেল আর আমি একটু কাঁদতে পারব না। আমি আবার চুপ করে রইলাম। এমনি করে সেদিন সকালে অনেকক্ষণ। বললেন, জানো ইলিয়াসকে আমি বলে এসেছি, তুমি আমার চেয়ে অনেক বড় লেখক। শুনে ইলিয়াস অসুস্থ শরীরে আপত্তি জানানোর জন্য বিছানায় উঠে বসতে গিয়েছিল। আমি আবার তাকে চেপে শুইয়ে দিয়েছি। আমি বললাম, সেটা ভালোই করেছেন। বাংলা 888sport live footballে কে কার চেয়ে বড় লেখক সে না হয় পরে ঠিক হবে। কথা আসেত্ম-আসেত্ম আবার স্বাভাবিক হয়ে এলো। এখন মহাশ্বেতাদিও চলে গেলেন। পরিণত বয়সেই গেলেন। শরীরেও কষ্ট পাচ্ছিলেন। সেদিক থেকে কী আর বলার আছে। লেখকদের আসরে কার কী জায়গা, সে-বিচার সময়ের হাতে তোলা থাক। সমসাময়িকদের মতামতে শেষ পর্যন্ত কী আর এসে যায়।
কমিউনিস্টদের প্রসঙ্গে ওই যে ভালোবাসার কথা তুলেছিলেন একবার। আর ওঁর এই কান্না। আমার ইচ্ছে করে এ দুটো জিনিসকে একটানে দেখতে। আসলে গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ওঁরা যাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির কাছাকাছি এসেছিলেন তাঁদের কাছে এই ভালোবাসার কথাটা আমার মনে হয় খুব সহজে আসে এবং আসারই কথা। সবাই হয়তো কমিউনিস্ট পার্টিতে সেভাবে সরাসরি আসেননি। কে পার্টির সদস্য ছিলেন আর কে ছিলেন না, তা আমি সব ক্ষেত্রে জানিও না, আর আমি যে-কথাটা বলার চেষ্টা করছি তার জন্য সে-কথা খুব জরুরি নয়। ওঁদের অনেকের পক্ষেই পার্টির কাছে ঘেঁষে আসা ব্যাপারটা ছিল ভালোবাসারই টানে। এ-লাইনগুলো লিখতে-লিখতে উমাদির একটা বক্তৃতার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। পাঠভবনের উমাদি, উমা সেহানবিশ। সেবার ওঁর অবসর। পাম অ্যাভিনিউর ছোটদের স্কুলের মাঠে বা উঠোনে একটা সভামতো আয়োজন করা হয়েছে। ছেলেমেয়েরা আছে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা আছেন, অভিভাবকেরা আছেন। সেদিন উমাদির কথায় সবার চোখে জল এসেছিল। কী দিন একদিন গেছে তাঁদের। রান্নাঘরে রান্না করতে-করতে জানালার বাইরে ‘ফ্যান দাও’ আওয়াজ। এই বাংলার সেই পঞ্চাশের মন্বন্তর। এই শহরের সেই দুর্দিন। পার্টির কাছাকাছি তখন অনেকে এসেছিলেন সেই সময়কার দুর্ভিক্ষ ত্রাণের কাজের সূত্রে। সে তো ছিল ভালোবাসারই কথা। পার্টিও তখন ভালোবাসায় এসে দাঁড়িয়েছিল সেসব ছন্নছাড়া মানুষের পাশে। স্কুল গড়া, নাচ-গান-নাটক করা ও লেখালেখি – সবই ওই একটানে দেখা দিয়েছিল একদিন এই বাংলায়। কাজগুলো করা একদিন দরকার মনে হয়েছিল তাই কিছু মানুষ এসে জড়ো হয়েছিলেন।
তারপর তো গঙ্গা-পদ্মায় অনেক জল বয়ে গেছে। মহাশ্বেতাদি যেদিন ওই ভালোবাসার প্রশ্ন তুলছেন আক্ষেপের সুরে, সেদিন কতদিকে যে কত ভাটার টান লেগেছে তার আর ঠিকঠিকানা নেই। রাষ্ট্রক্ষমতার তাপে ভালোবাসা আসেত্ম-আসেত্ম শুকিয়ে গেছে আমাদের চোখের পরে আমাদের অজান্তে। সব ভালোবাসারই হয়তো পরিণতি তাই।
ওই কান্নাধন সম্বল করে মহাশ্বেতাদি পথে বেরিয়েছিলেন একদিন। হয়তো আরো অনেকেরই মতো। পথে কোনো না কোনোভাবে এঁদের বেরোতেই হতো। পথে বেরিয়ে নানা কারণে এঁদের সবার পথ আর মেলেনি। মহাশ্বেতাদির কান্না তাকে নিয়ে গেছে আদিবাসী চোখের জলের দিকে। সেখানে তিনি পথে হেঁটেছেন আবার রাতে ঘরে ফিরে কলমও তুলে নিয়েছেন হাতে। এতগুলো বছর নিরন্তর-নিরলসভাবে। ক্লান্ত হতেন কিনা জানি না। তবে জিজ্ঞাসা করার উপায় ছিল না। কেমন আছেন বললেই সপাটে উত্তর দিতেন, আমি তো কখনো খারাপ থাকি না। কাজ, কাজ করো, তাহলে আর খারাপ থাকবে না। শুধু বাকতাল্লাই না করে কাজ করো। এসব ছিল ওঁর মুখের লব্জ।
ওঁর লেখার প্রসঙ্গে ভাষা ব্যবহার নিয়ে একবার একটা কথা জিজ্ঞাসা করেছিলাম। যে-জীবন নিয়ে উনি লেখেন তাতে ভাষা খুব মোলায়েম হওয়ার কোনো কারণ নেই। কিন্তু ওই একটু খসখসে ভাষার মধ্যে একটা ঝরঝরে চলনের যে দ্রম্নততা আছে তা খুব ভেবেচিন্তে কিছু করেন কিনা, এই ছিল প্রশ্ন। আমার তখন মাথায় ছিল প্রধানত চোলি কা পিছে ক্যা হায় গল্পটা। ওই গল্প তখন সবে বেরিয়েছে। অনেকেরই খুব নজরকাড়া গল্প। গল্পের শুরুতে প্রায় পাতা দেড়েক ঝাপট মারার মতো ভাষায় যেভাবে চারপাশের চালু ধরনটাকে ধরা হয়েছে তা বেশ চোখে পড়ার মতো। উনি বলেছিলেন, না, খুব ভেবেচিন্তে কিছু করি, তা না। ওইরকমভাবেই তো আসে।
মহাশ্বেতাদির কথা বলতে গেলে ওঁর শবর ছেলেদের কথা কিছু না বললে কি চলে। এ সম্বন্ধে যা বলার তা এতদিনে সবাই সব জেনে গেছেন। আমার নতুন কিছু বলার নেই। দুটো প্রসঙ্গ একটু হয়তো বলা চলে। জানেন অনেকেই তবে ইদানীং দেখছি সে-কথা বোধহয় একটু দূরে সরে গেছে। ললিত শবর আর বুধন শবরের কথা। শবর সম্প্রদায় অপরাধপ্রবণ জাতি হিসেবে চিহ্নিত ছিল। গায়ে-লাগা এই দাগ আর মোছে না। তাই অঞ্চলে চুরিচামারি যাই হোক না কেন, লোকে এদেরই প্রথম দোষারোপ করে। ধরে নিয়ে যায়, মারধর করে। পুলিশও তাই। এভাবে ললিত শবরকে ধরা হয়েছিল। শুরুটা হয়েছিল বোধহয় ছাগল চুরি নিয়ে। এতদিন বাদে, সব হয়তো আমার ঠিকঠিক মনে পড়ছে না। গাছে বেঁধে চুরির দায়ে ললিতের হাত কেটে নেওয়া হয়েছিল। মহাশ্বেতাদির চেষ্টায় খেড়িয়া শবর সমিতির তরফে ললিতকে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য এনে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সমিতির আর্থিক সাহায্য ছাড়াও মহাশ্বেতাদির উদ্যমে ললিতের চিকিৎসার জন্য অর্থ সংগ্রহ করা হয়। তখনকার মতো ললিতের বিপদ কেটেছিল।
বুধনের গল্প আরো জটিল ও আরো অনেক লম্বা সময়ের। বুধনের ক্ষেত্রে মৃত্যু না হত্যা তাই নিয়ে প্রশ্ন ছিল। মৃতদেহ ঘরের মধ্যে মেঝের নিচে পুঁতে রাখা হয়েছিল। আবারো মহাশ্বেতাদির নেতৃত্বে শবর সমিতির তরফে হাইকোর্টে মামলা লড়া হয়। সেই মামলা দীর্ঘদিন ধরে চলে। তারপর কোর্টের আদেশে সেই মৃতদেহ আবার তুলে ফরেনসিক পরীক্ষা ইত্যাদির পরে বুধনের পরিবারের পক্ষে রায় মেলে এবং বুধনের পরিবার ক্ষতিপূরণ পায়। অনেকদিন আগের কথা। নেহাত 888sport sign up bonus থেকে লিখছি। কিছু ভুলচুক হলে কেউ না কেউ ধরিয়ে দেবেন আশা করি।
কিন্তু বুধনের কথা এখানেই শেষ হয়নি। মহাশ্বেতাদি এর পরে কিছুদিনের জন্য তাঁর কর্মকা- বরোদায় প্রসারিত করেন। সেখানে অধ্যাপক গণেশ দিভির সহায়তায় ডিনোটিফায়েড ট্রাইবসদের নিয়ে সংগঠন তৈরি হয়। সেখান থেকে ইংরেজি ভাষায় গবেষণাধর্মী পত্রিকা প্রকাশ করেন। সেই পত্রিকার নাম রাখা হয়েছিল BUDHAN. সন্দেহ নেই মহাশ্বেতা দেবী নিজেকে অনেকদূর ছড়িয়েছিলেন। বহু কাজের মধ্যে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। ইংরেজি বুধনের কথা বললাম। বাংলা বর্তিকার কথা আমি আর বললাম না। সে-কথা সবাই জানেন। বর্তিকার লেখালেখি উনি লেখালেখির বাইরের জগতেও প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। যাদের জীবন ধারণ করতে গিয়ে আর কলম ধরার সময় হয় না তাদের দিয়েও উনি বর্তিকায় তাদের জীবনের কথা লিখিয়েছিলেন। সে-লেখা বানান ভুলসমেতই হাজির হতো পাঠকের দরবারে। এসব চিন্তা যে একদিন মাথায় এসেছিল সে-কথাটা মাথায় রাখা দরকার। এত কিছু করেছেন, এত কিছুর মধ্যে জড়িয়ে ছিলেন তাই তাঁকে নিয়ে বিতর্কও কিছু কম ছিল না। আমাদের বাম জমানার দিনে বাম রাজনীতির প্রধান অংশ তাঁর দিকে খুব প্রসন্নদৃষ্টিতে তাকায়নি। কেবল তখনকার খুব শ্রদ্ধেয় নেতা ও মন্ত্রী বিনয় চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর ছিল পারস্পরিক সম্ভ্রমের সম্পর্ক। পুরুলিয়ার যে-অঞ্চলে উনি ওঁর সমাজকর্ম করতেন, সেখানকার কোনো সমস্যা জানালে মন্ত্রী দ্রম্নত তা সমাধানের চেষ্টা করতেন। কোথাও কোনো জলের কলে জল পড়ছে না, রাস্তার পিচ উঠে গেছে এজাতীয় সমস্যা পোস্টকার্ডে লিখে জানালে মন্ত্রীর নির্দেশমতো দফতর সে-কাজ তাড়াতাড়ি করে দেওয়ার চেষ্টা করত। মহাশ্বেতাদি বলতেন, এতে তোমাদের বিপস্নবের কাজ এগোবে না, কিন্তু ভাঙা কলে জল পড়বে।
ওঁর লেখালেখির দিক নিয়েও বিতর্ক ছিল। আসলে ওঁর ব্যক্তিত্ব নিয়ে যাদের সমস্যা ছিল তাদের অনেকের ওঁর লেখা নিয়েও সমস্যা ছিল। আমাদের বামপন্থী মনের একটা অংশে মহাশ্বেতাদির ম্যাগসাইসাই 888sport app download bd নিয়ে খুব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। এখানকার প্রচলিত মনন সংস্কারে ওই 888sport app download bdের সঙ্গে সিআইএর কথিত সংযোগ নিয়ে অস্বস্তি ছিল। শম্ভু মিত্র, গৌরকিশোর ঘোষের মতো প্রাপকদের বেলাতেও এই অস্বস্তি যথেষ্টই ছিল। আমার পরিচিত একজন শ্রদ্ধেয় মানুষ একদিন আমাকে সকালবেলায় ফোন করেন। উনি সাধারণত সকাল সাতটা নাগাদ ফোন করতেন। তখনো আমার সকালের প্রথম চা শেষ হতো না। ঘুম-জড়ানো চোখে ওঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলতে-বলতে ঘুম কেটে যেত। সেদিন উনি ফোনে আমাকে আক্রমণাত্মকভাবে শুরু করলেন এভাবে। মহাশ্বেতাকে কি আপনি খুব বড় লেখক মনে করেন? উনি কি প্রম্নসেত্মর মতো বড় লেখক? যাঁর ফোন তিনি মহাশ্বেতা দেবীর চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন কিন্তু আমাকে আপনিই বলতেন। আমি আমতা-আমতা করে বললাম, মানে হ্যাঁ, উনি তো বড় লেখক। তবে প্রম্নসেত্মর মতো কিনা কী করে বলি বলুন তো। কিন্তু কী হয়েছে? ওপাশ থেকে সে রাগত স্বর আরো বেশ কিছুক্ষণ চলল। ম্যাগসাইসাই 888sport app download bdও নেব আবার ডাউনট্রডনদের জন্য কাজ করব, এই দুই একসঙ্গে চলতে পারে না। ততক্ষণে আমি ব্যাপারটা খানিক ধাতস্থ করতে পেরেছি। বললাম, কিন্তু ওঁর লেখার অনেক জিনিস আছে, তা আপনি ঠিক ফেলতে পারবেন না। উনি তাতেও হতোদ্যম হলেন না। বললেন, বলুন একটা কোনো লেখার কথা, বলুন তো দেখি কেমন। আমি ওই ঘুম-ঘুম চোখেই হঠাৎ দুম করে বলে বসলাম টেরোড্যাকটিলের কথা। পড়িনি, কী আছে সে-888sport alternative linkে? আমি যা যেমন বুঝি তেমনি খানিকক্ষণ বললাম। তাতে দেখলাম আসেত্ম-আসেত্ম একটু নরম কাটলেন। এমনি হয়। জনশ্রম্নতি কাজ করে, খুবই কাজ করে।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.