চন্দ্রভূক অমাবস্যার গল্প

চোখের সামনে বেশ্যা হয়ে গেল লাইলী। প্রকৃতপক্ষে কী যে তার নাম, সে-কথা নীলগঞ্জের কেউ জানে না। এ-শহরের যুবকেরা কম চেষ্টা করেনি; নানাভাবে খুঁচিয়ে দেখেছে, উত্ত্যক্ত করেছে, তার সত্যিকারের নাম কেউ আবিষ্কার করতে পারেনি। যে-মানুষ কথাই বলে না, তার নাম জানবে কী করে! শুধু নাম কেন, তার সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানা যায়নি। কোথায় বাড়ি, জগত-সংসারে তার আপনজন কে আছে, কীভাবে এখানে এল, কেন এল, কোথায় যাবে – কোনো প্রশ্নেরই উত্তর মেলেনি। দু-একজন নাকি রাতের সিক্সটিন ডাউন ট্রেন থেকে তাকে নামতে দেখেছে। কে দেখেছে, তার আবার লেজ খুঁজে পাওয়া যায় না কিছুতেই। তবু প্রশ্ন জাগে – তাহলে কি সে গোয়ালন্দ থেকে আসছে? কিংবা নদীপারের অন্য কোনো গাঁও-গঞ্জ থেকে? কেউ জানে না। কিছু জানে না। সে মুখে কিছু বলে না বলেই কারো কিছুই জানা হয় না। মুখের ভাষায় বর্ণনা ছাড়াই যে-সরল তথ্যটুকু সবাই অবলীলায় জানতে পারে তা হচ্ছে, সে একটা মেয়ে-মানুষ। সারা শরীর জুড়ে তার মেঘভাঙা রোদের খেলা, জানালা-দরজা খুললেই হুমড়ি খেয়ে লুটিয়ে পড়বে কাঁচা রোদ। নদীর বাঁক-বদলের মতো তার দেহেও শুরু হয়েছে বাঁক-বদলের জোয়ার-ভাটা। তা সে যা-ই হোক, মানুষ মাত্রই কমপক্ষে একটি করে নাম বহন করে চলে; মুখে প্রকাশ করুক আর না-ই করুক, এই মেয়েটিরই বা নাম থাকবে না কেন! নীলগঞ্জের একমাত্র সিনেমা হল আয়না মহলে এখন ছবি চলছে – লাইলী মজনু। এই মফস্বল শহরের যুবকদের চোখ-মুখ-বুক জুড়ে তখন মজনু মজনু জ্বালা-পোড়ার দাহ। তারাই এই অচেনা-অজানা মেয়েটির নাম পাড়িয়ে দিল – লাইলী। সিনেমার পর্দায় লাইলীর ভূমিকায় অভিনয় করেছে যে-মেয়েটি, তার সঙ্গে কোথায় যে কী সাদৃশ্য খুঁজে পেল, তারাই জানে। নায়িকাসুলভ সৌন্দর্যের ঠমক আদৌ তার চেহারায় ছায়া ফেলেনি। বরং তার বাম চোখের তুলনায় ডান চোখটি সামান্য একটু ছোট হওয়ায় চেহারার আলগা লাবণ্যও কিছুটা ম্লান হয়েছে। তাই বলে সারামুখ অন্ধকার করে লাবণ্যের দীপশিখা একেবারে নিভে যায়নি; বরং সেই মালিন্যটুকু আবার পুষিয়ে দিয়েছে চিবুকের অসামান্য একটি তিল। শরৎ-আকাশে দূরের নক্ষত্র যেন-বা আপন উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত করেছে সমগ্র চরাচর।

সদরউদ্দিন ডাক্তার প্রথম যেদিন লাইলীকে দেখে, সেদিন এমন খুঁটিয়ে দেখার অবকাশ ঘটেনি। সিক্সটিন ডাউন ঝমঝমিয়ে চলে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর 888sport app দিনের মতোই দোকানের শাটার টানতে গিয়ে নজরে পড়ে লাইলীকে। করগেট টিনের ঢেউ-খেলানো শাটারের সঙ্গে পিঠ সেঁটে দাঁড়িয়ে থাকা জবুথবু কিশোরী। কিশোরীই তো, যৌবনের উঠোনে সবে পা দিয়েছে কী দেয়নি – বুঝে ওঠা যায় না। সন্ধের পর জাঁকিয়ে শীত পড়ছে বলে আদর্শ হোমিও হলের উত্তরের শাটার প্রায় বন্ধই থাকে। খোলা হয় পুবের শাটার। আসলে রোগীপত্তর যা হবার সন্ধে সাতটার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। তখন দোকানে আসে নির্মল মাস্টার, সুগারমিলের হেডক্লার্ক হাফিজুল মিয়া। হারুর দোকানের টলটলে কাচের গ্লাসে কাঁচা লিকারের রং-চা খায় ঢুকুশ ঢুকুশ, আর নাকের উপরে চশমা চড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ে রাজনীতিকদের তুলোধুনা করে। সেই নির্মল মাস্টার 888sport appয় গেছে স্কুলের কাজে, আর স্ত্রীর শরীর খারাপের কথা বলে হাফিজুল মিয়া এক শিশি মাদার টিনচার পালসেটিলা নিয়ে সকাল সকাল বাড়ি চলে যাওয়ায় সদরউদ্দিন ডাক্তার একা একা কাগজে মুখ গুঁজে বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না। এদিকে শীতের কামড়ে হাত-পা জমে যাবার যোগাড়। ফলে খবরের কাগজ ভাঁজ করে গুছিয়ে রেখে বাইরে বেরিয়েই দেখতে পায় পঁচিশ পাওয়ারের ঝুলন্ত বাল্বের নি®প্রভ আলোর নিচে লাইলী দাঁড়িয়ে। অবশ্য তখনো সে লাইলী হয়ে ওঠেনি। একহারা স্বাস্থ্যের হালকা-পাতলা কিশোরী। মাথায় উড়ু উড়ু রুক্ষ চুল। পরনে মলিন সালোয়ার-কামিজ। চোখে-মুখে কেমন সন্ত্রস্ত ভাব। সদরউদ্দিন শাটারে হাত লাগিয়ে জিজ্ঞেস করে,

– এই মেয়ে, কে রে তুই?

মেয়ে নীরব।

– আ মুশকিল! বাড়ি কোথায়? এখানে কী কাজ?

যাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে, উত্তর দেওয়ার কোনো গরজই দেখা যায় না তার। এমনকি, এই প্রশ্ন তার কানে পৌঁছেছে বলেও মনে হয় না। সদরউদ্দিন ডাক্তার ঝমঝম করে শাটার টেনে দেয়। তালা লাগায়। তারপর মেয়েটির মুখোমুখি হয়,

– কী নাম তোর?

নাম কেন, কিছুই বলে না সে। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। চোখের ভাষাতেই কী যেন জবাব দিতে চায়। সদরউদ্দিন ডাক্তার সে-জবাবের কিছুই বোঝে না। বরং তখনই নজরে পড়ে, মেয়েটির ডান চোখটি লক্ষ্মীট্যারা, একেবারে রেহানার মতো। চমকে ওঠে – রেহানার মতো? আবার ভালো করে তাকায়, অজান্তে নিজের হাত উঠে আসে মেয়েটির মাথার উপরে- হ্যাঁ, রেহানার মতোই ডান চোখটা সামান্য ছোট। আহা, এই সামান্য অসম্পূর্ণতার জন্য তার মেয়েটিকে কতো-না গঞ্জনা সইতে হয়েছে শ্বশুরবাড়িতে! ভালোবাসার বিয়ে বলে রক্ষা। ভাগ্যিস জামাই বাবাজি শক্ত দেয়াল হয়ে রেহানার পাশে দাঁড়িয়েছিল। শাশুড়ি যা বলে, রায়বাঘিনী ননদ বলে শতগুণ। আড়ালে-আবডালে নয়, প্রকাশ্যেই দোষারোপ করে – এই দেড় ব্যাটারির আলোতেই আমার ভাইয়ের চোখ ঝলসে দিয়েছ! সদরউদ্দিন ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে এবং অচেনা মেয়েটির মাথায় হাত রেখে আবার জানতে চায়,

– কী নাম রে বিটি?

মমতার স্পর্শে তার চোখ-মুখ থেকে সন্ত্রস্ত ছায়া সরে যায় বটে, তবু সে মুখ খোলে না। একটুখানি কেঁপে ওঠে মাত্র। শীতের তড়পানিতে সদরউদ্দিন ডাক্তারও তখন কাঁপছে। কাঁহাতক আর এই একতরফা জিজ্ঞাসাবাদ ভালো লাগে! ভেতরে ভেতরে খানিকটা বিরক্তও হয়ে ওঠে। স্টেশন রোডে হোমিও দোকান খোলার পর এরকম বিচিত্র মানুষ তো আর কম দেখেনি সে! তারা যে কে কোথা থেকে আসে, আবার কোথায় ভেসে যায়, কে রাখে সেই খবর! সদরউদ্দিন শেষবারের মতো মেয়েটির মুখের দিকে তাকায়, তারপর ধমকে ওঠে।

– কথা বলবিনে তো যা ভাগ! যা এখান থেকে।

এই ধমকানিতে কী যে বোঝে সে, ভেগে যাওয়া তো দূরের কথা, বরং শাটারের সঙ্গে পিঠ সেঁটে ছোট্ট রোয়াকের ওপরেই বসে পড়ে। সদরউদ্দিন ডাক্তার মুখে গজগজ করতে করতে রাস্তায় নেমে আসে। বাড়ি ফিরে রেহানার মায়ের চিবুকের নিচে কালো তিলে চোখ পড়তেই সে আবারো চমকে ওঠে; 888sport app download for android করতে চেষ্টা করে – ঐ মেয়েটির মুখের মানচিত্রেও কি এই তিলটিই মুদ্রিত ছিল? এরপর অতিচেনা স্ত্রীর মুখের আয়নায় অকারণেই কী যেন এক হারানো ছবি খুঁজে ফেরে। স্ত্রী এসবের কিছু না বুঝে মুখ ঝামটা দিয়ে ওঠে – ভিমরতি!

ভিমরতি নয়, পরদিন সকালে ডাক্তারখানা খুলতে এসে সদরউদ্দিনের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। আদর্শ হোমিও হলের পাশের এক চিলতে রোয়াকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে সেই মেয়েটি। তার পশ্চাদ্দেশে রক্তের ছোপ, সালোয়ারে রক্ত জমে কড়কড়ে। রোয়াকের মেঝেতেও রক্তের দাগ শুকিয়ে এসেছে। ঋতুচক্রের আবর্তনে রক্তস্নাত হয়েছে হয়ত। কিন্তু ভুল ভাঙে পরক্ষণেই। মেয়েটিকে অনেক ডাকাডাকি করে, অতঃপর হাত ধরে উঠিয়ে বসাতেই সে ফিতেছেঁড়া সালোয়ার টেনে লজ্জাস্থান ঢাকতে তৎপর হয়; তখনই বোঝা যায় রক্তপ্রবাহ মোটেই বন্ধ হয়নি। সে আবার মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে এবং হাতের আড়ালে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ওঠে। সদরউদ্দিন তখন কী করে! শীতের সকালে বাজারঘাট তখনো বিশেষ খোলেনি। এরই মধ্যে পথ-চলতি দু-চারজন কৌতূহলী মানুষ গোল হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। হোমিওপ্যাথি হলেও তো ডাক্তার বটে সদরউদ্দিন, তথাপি সে এই মেয়েটির জন্য কোনো ওষুধই নির্বাচন করতে পারে না। তার সারা মুখে কেমন এক সন্ত্রস্ত ছায়া নেমে আসে। এদিকে তাকায়, ওদিকে তাকায়, কিন্তু কিছুতেই যেন সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। অবশেষে দ্বিধান্বিত চিত্তে বাক্স হাতড়ে কী একটা শিশি থেকে দুফোঁটা ওষুধ ঢেলে দেয় মেয়েটির মুখে। তারপর পরিচিত একটা রিকশাভ্যানে তুলে দিয়ে নির্দেশ দেয় – হাসপাতালে নিয়ে যা। হাসপাতালে যাবার পর জানা গেল যে মেয়েটি বোবা। বেশ কিছুটা সুস্থ হবার পর সে আকারে-ইঙ্গিতে জানায়, ঐ রাতে চার যুবক তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। এই পৈশাচিক বর্বরতার সঙ্গে সদরউদ্দিন ডাক্তারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, তবু ভেতরে ভেতরে সে খুব অব্যাখ্যেয় এক অপরাধবোধে পীড়িত হয়। বারবার মনে হয়, ঐ চন্দ্রভূক অমাবস্যা রাতে তার কি অন্য কিছু করণীয় ছিল? সঠিক জবাব পায় না। তবু মেয়েটির ডানদিকের লক্ষ্মীট্যারা চোখ এবং চিবুকের কালো তিল তাকে দগ্ধায়, অদৃশ্য কিন্তু অনতিক্রম্য সুতোয় বেঁধে টানে; নিয়মিত হাসপাতালে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসে। এ-ঘটনার তিনদিন পর বেলা-গড়ানো এক বিকেলে চোয়াড় চেহারার চার যুবক আদর্শ হোমিও হলে এসে রীতিমতো চার্জ করে,

– লাইলীকে আপনি কোথায় ফেললেন ডাক্তার সাহেব?

– লাইলী? সদরউদ্দিন আকাশ থেকে পড়ে। এরা কারা চিনতে চেষ্টা করে। এই ছোট্ট শহরে বহু মানুষই চেনাজানা, অন্তত মুখচেনা। কিন্তু এদের কাউকেই সে চিনতে পারে না। রেলওয়ে-শহরের এই এক বিড়ম্বনা, অনেক নতুন মানুষেরও আনাগোনা হয় বটে। তাই বলে ছোট্ট এই নীলগঞ্জেও? আগন্তুকদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাঙা গলায় জানতে চায়,

– কার কথা বলছো তোমরা?

– লাইলী, লাইলী। লাইলীর কথা বলছি।

অন্য একজন পেছন থেকে সামনে এগিয়ে এসে বলে,

– হেভি ডোজের ওষুধ ঝেড়েছেন শুনলাম।

– ঐ মেয়েটির নাম লাইলী নাকি? তোমরা ঠিক জানো?

সদরউদ্দিন ডাক্তার এতোক্ষণে লাইলীকে চিনতে পেরেছে দেখে চার যুবকের মধ্যে দুজন খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসে। একজন বলে – ওই মাগি তো বোবা-কালা। নামধাম বলে না দেখে আমরাই নাম দিলাম লাইলী। অন্যজন জানায় – মজনুর তো অভাব নেই! মজনু দেখলেই লাইলী তখন অভিনয় করে। মরার মতো ভান করে। চুপচাপ পড়ে থাকে। খ্যাকশিয়ালের মতো অতি চালাক যুবকটি হাসি থামিয়ে সহসা টেবিল চাপড়ে ধমকে ওঠে,

– লাইলী কোথায় বলেন!

– তা আমি কেমন করে বলব! ওষুধ খেয়েই সে চলে গেছে।

সজ্ঞানে এই মিথ্যেটুকু বলে সদরউদ্দিন। কিন্তু তাতে আশ্বস্ত হয় না যুবকেরা। আবারো একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দেখে – আপনি সত্যি বলছেন তো?

এবার দিগি¦দিকের কাণ্ডজ্ঞান লুপ্ত হয়ে পড়ে সদরউদ্দিনের। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘুরে দাঁড়ায়,

– কী পেয়েছ তোমরা? একটা মেয়ের সর্বনাশ ঘটিয়ে তোমরা হয়েছ সাধু, আর আমি মিথ্যুক? লজ্জা করে না তোমাদের?

চার যুবকই লেজ গুটিয়ে দোকানের বাইরে বেরিয়ে যায়। কেবল একজন মুখ ঘুরিয়ে বলে,

– বেশি তড়পাবেন না। আমরা আছি। আবার আসব।

এ-ঘটনার পর সদরউদ্দিনের ভেতরে কী যে  ভাবান্তর হয়, সেদিনই হাসপাতাল থেকে রিলিজ করিয়ে লাইলীকে নিয়ে আসে নিজ বাড়িতে। পথের ধুলো ঘরে তোলার এ-ঘটনা তার স্ত্রী খুব প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করে না। গজ্গজ্ করে, ফোঁস-ফোঁস করে, কিন্তু ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলতেও পারে না। স্বামীর স্বভাব-চরিত্র তার অজানা নয়, এমন ঘটনা একেবারে নতুনও নয়। পথের মানুষকে বাড়ি এনে হাঁড়ি উলটিয়ে ভাত খাওয়ানো, রাতে আশ্রয় দেওয়া, নগদ দক্ষিণা দিয়ে বিদেয় করার ঘটনা বহুবার ঘটেছে। তাই বলে চেনা নেই জানা নেই, একেবারে বাজারঘাঁটা বেবুশ্যা মেয়েছেলে এনে ঘরে তুলবে?

– বেবুশ্যা? বেবুশ্যা কাকে বলে? এ্যাঁ? স্ত্রীর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকান সদরউদ্দিন, অতোটুকুন মেয়েটাকে তুমি ঐ নোংরা কথাটা বলতে পারলে রেহানার মা? জানো, গণ্ডা-খানেক পাষণ্ড মিলে রাতভর খামচে-খুবলে ওকে মেরেই ফেলেছিল প্রায়!

এর বেশি কুৎসিত তথ্য আর স্ত্রীর কাছেও প্রকাশ করতে পারে না। সেই পাষণ্ডরা যে দোকানে এসে যাচ্ছেতাই আস্ফালন করে গেছে এবং তা নিয়ে যে বুকের গভীরে সে গোপন আতঙ্ক বয়ে চলেছে, সে- কথা কোথাও বলতে পারে না। ড্যাব-ড্যাব করে তাকানো মেয়েটির লক্ষ্মীট্যারা চোখে চোখ পড়তেই তার বুকের বেলুন চুপসে স্নেহার্দ্র দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তখন মনে হয়, সেই তো পথের ঝঞ্ঝাট বাড়িতে এনে তোলাই হলো, তবে সেই শিশিরস্নাত রাতে হাত ধরে নিয়ে এলেই বা কী হতো!

সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে আরো সপ্তাহখানেক কেটে যায় লাইলীর। এরই মধ্যে সদরউদ্দিনের স্ত্রীরও মনের উত্তাপ মিইয়ে আসে। বরং ইশারা-ইঙ্গিতে তার সঙ্গে ভাব-বিনিময় করতে করতে মনে মনে সে একরকম পরিকল্পনাও এঁটে বসে। মাস তিন-চারেকের মধ্যে রেহানার ছেলেপুলে হবে। এ-সময়ে একটু বিশ্রাম দরকার। অথচ একান্নবর্তী বড় সংসারের জোয়াল টানতে গিয়ে দম ফেলার ফুরসত হয় না তার। বাঁধা কাজের মানুষও নেই। মেয়ের বিশ্রাম এবং সেবাযত্নের কথা ভেবে লাইলীকে রেহানার কাছে পাঠানোর প্রস্তাব করে। সদরউদ্দিন ডাক্তার প্রথমে দম ধরে বসে থাকে, কী যেন চিন্তা করে গভীরভাবে, তারপর বহু কসরত করে লাইলীর মতামত জানতে চায় – তুই কি যাবি মেয়ের বাড়ি?

কী যে বোঝে সে-ই জানে, একবার রেহানার মায়ের দিকে তাকিয়ে ঘাড় দুলিয়ে দিব্যি সম্মতি জানায়। রেহানার মাও একগাল হাসি ছড়িয়ে জানায় – একটুখানি ইশারা করলেই ও সব বুঝতে পারে। হাতের কাজও বেশ গোছালো। রেহানার খুব কাজে লাগবে। বাস্তবেও হলো তাই। মাত্র দিন দশেকের মাথায় বাপের বাড়ি এসে রেহানা জানায় – মেয়েটা আসলেই খুব ভালো মা, সব কাজ গুছিয়ে করতে জানে। রেহানার শ্বশুরবাড়ি এ-পাড়া ও-পাড়ায়, তবু বাপের বাড়ি এসে দু-একদিন কাটিয়ে যাবার অনুমতি মেলে না সহজে; এবার মিলেছে। জামাই নিজেই নাকি বলেছে, লাইলী তো আছেই, যাও দুদিন ঘুরে এস।

সদরউদ্দিন বেশ কদিন পর এই নাম শুনে চমকে ওঠে,

– তোরাও ওকে লাইলী বলিস না-কি?

প্রশ্নের ধারা শুনে রেহানাও যেন আকাশ থেকে পড়ে,

– কেন, ওর কি অন্য কোনো নাম আছে? মা যে সেদিন বলল…

দোষ তো আসলে রেহানার মায়েরও নয়। সদরউদ্দিন বুঝতে পারে, এ-নাম কখনো তার মুখ থেকেই আলগোছে বেরিয়ে পড়েছে। শব্দটি যতোই শঙ্খ-সাদা নির্দোষ হোক, মাত্র এই কদিনের ব্যবধানে ঐ শব্দটির উচ্চারণ কেমন যেন অশ্লীল শোনায়, সেই কুৎসিত মুখগুলো মনে পড়ে যায়। এই নাম তো দিয়েছে ঐ জানোয়ারের দল, তা-ও ফুর্তি করার জন্য! নাহ্, একটুখানি সতর্ক হলেই ঐ নামটি বেশ এড়ানো সম্ভব ছিল। পিতৃহৃদয়ের এত ভাবান্তর টের পায় না রেহানা, সে খলবলিয়ে জানায়,

– জানো মা, তোমাদের লাইলীও খুব ঝুল ধরেছিল এখানে আসার জন্য!

রেহানার মা লাইলীকে নিয়ে আসার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে – ডেলিভারির আগে আগে যখন মেয়েকে নিয়ে আসবে, তখন তাকেও এখানে এনে রাখবে, এই তাদের পরিকল্পনা। লাইলী থাকলে আঁচি-আঁতুরের ঝামেলা সামলানো সহজ হবে।

দুই

নামহীন গোত্রহীন একটি মেয়ের পথরেখা যদি এতোটাই মসৃণ হবে, তাহলে আর সে লাইলী হয়ে উঠবে কী করে! মফস্বলের এই ছোট্ট শহরের পথে পথে অসংখ্য মজনু তার জন্য গোলাপের বদলে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে। সেই কাঁটা মাড়িয়ে হঠাৎ একদিন সে আবার স্টেশন রোডে আদর্শ হোমিও হলের সামনে হাজির। সদরউদ্দিন ডাক্তারের তো চোখ কপালে! লাইলীকে নয়, সে যেন-বা দেখতে পায় ঝড়ে দুমড়ানো-মুচড়ানো কলাগাছ; লাইলীর মাথার চুল নয়, হাওয়ায় দুলছে যেন ছিন্নভিন্ন পত্ররাজি। শুকনো কাশির সঙ্গে ওয়াক করে একদলা বমি উদ্গিরণের পর লাইলী দেয়াল ধরে বসে পড়ে। বসে পড়া নয়, এ-যেন তার ধসে পড়া। অথচ রেহানার সঙ্গে এই মেয়েকেই পরদিন তার আনতে যাবার কথা। সদরউদ্দিন অবাক বিস্ময়ে হাত ইশারায় জানতে চায় – কীরে, তুই এখানে যে! লাইলী এ-প্রশ্নের কী যে বোঝে সে-ই জানে, উত্তরে সে একবার নিজের তলপেটে হাত দেয়, বুকে হাত দেয়, আবার হাত শাসিয়ে মারামারির ভঙ্গিও করে, মাটিতে পা ঠুকে লাথি মারে এবং আঁ-আঁ করে কাঁদতে থাকে। সেই কান্নার মধ্যেই উগরে আসে কাঠবমি। সদরউদ্দিনের সব তালগোল পাকিয়ে যায়। কোনো ইঙ্গিতই ধরতে পারে না। অথচ গত মাসেই সে রেহানার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে গর্ব করে বলেছিল – লাইলীর সব ইশারাই সে সহজে বুঝতে পারে। চারাগাছে পানি পড়লে যেমন সবুজ পাতা গজায়, ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠে সজীবতায়, লাইলীকে দেখে সেইরকম সপ্রাণ মনে হয়েছিল সেদিন। বিদায় নেবার আগে মাথায় হাত বুলানোর সময় সে কেঁদে উঠেছিল আকুল হয়ে; কেবল সেই কান্নার কোনো অর্থ সেদিন বুঝতে পারেনি, এই তার ধারণা। কিন্তু এখন সদরউদ্দিনের মনে হয়, কোনোদিন সে কিছুই বোঝেনি লাইলীর।

দুর্বোধ্য এই মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে সদরউদ্দিন ডাক্তার বাড়ি ফেরে বটে, কিন্তু অচিরেই যে-রহস্যজট উন্মোচিত হয়, তা জানার পর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া ছাড়া তার গত্যন্তর থাকে না। শ্বশুরবাড়ি থেকে রেহানা এসে দাপায় – আবার এখানে এসে জুটেছিস? হারামজাদি! খান্কি মাগি! শ্রবণ-অযোগ্য গালাগালিতেও যখন মনের ঝাল মেটে না, তখন চুলের মুঠি ধরে টেনে-হিঁচড়ে লাইলীকে বাড়ির বাইরে বের করে দিতে উদ্যত হয়। বিমূঢ় সদরউদ্দিন মাঝখানে দাঁড়িয়ে রেহানাকে নিরস্ত্র করে। তারপর রেহানার মাকে ডেকে শুধায়,

– তুমি কি সত্যিই জানো, লাইলী অন্তঃসত্ত্বা?

রেহানার মাও মুখের আগল একেবারেই খুলে দেয়,

– ঐ দেড় ব্যাটারির ছিনালকেই শুধাও। পথের বেবুশ্যা ঘরে তুলেছ, এখন ঘর সামলাও।

ডাক্তারের কর্ণকুহরে যেন তপ্ত সীসা গলে পড়ে। লক্ষ্মীট্যারা চোখের জন্য এই দেড় ব্যাটারি শব্দযুগল একদা তাদের সবাইকে কতো না নিষ্ঠুরভাবে বিদ্ধ করেছে! অথচ সেই কুৎসিত শব্দটাই এখন রেহানার মায়ের কণ্ঠ থেকে অবলীলায় হলাহল হয়ে গড়িয়ে পড়ে – ঐ দেড় ব্যাটারি দিয়েই জামাইয়ের মাথা খেয়েছে গো, আমার সর্বনাশ করেছে। ওকে আমি বটি দিয়ে কাটব, কেটে টুকরো টুকরো করব।

উন্মাদের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে বটি আনতে ছুটলে সদরউদ্দিন দ্রুতবেগে স্ত্রীর হাত চেপে ধরে, অনুনয় করে,

– তুমি শান্ত হও রেহানার মা। এখন এর সমাধান কী তাই বলো!

– সমাধান? ওষুধ দিয়ে আগে ওর পেট সাফ করে দাও। ঐ পাপ খসিয়ে দাও। শিউরে ওঠে সদরউদ্দিন ডাক্তার, এ-কী প্রস্তাব দিচ্ছে তার স্ত্রী! কুমারী মেয়ের গর্ভধারণে পাপ আছে, আর সেই গর্ভ খসানোয় পাপ নেই বুঝি! না না, এ-ওষুধ তার জানা নেই। ডানে-বামে দুলে ওঠে তার মাথা। আর তখনই লাইলী আবার ওয়াক-ওয়াক করে ওঠে। এই বমন-প্রচেষ্টার শব্দে আসন্নপ্রসবা রেহানার মাথার চাঁদি ধাঁ-ধাঁ করে জ্বলে যায়। কোনো প্রকার সমাধানের প্রতীক্ষা না করেই সে ভারি শরীর নিয়ে তেড়ে যায় লাইলীর কাছে, দশ আঙুলের সাঁড়াশিতে জাপটে ধরে তার গলা। একবার ওয়াক করে উঠেই লাইলী শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে সাঁড়াশিমুক্ত হয় এবং এক দৌড়ে বাড়ির বাইরে পালিয়ে যায়।

এ-ঘটনার পর দীর্ঘদিন লাইলী আর আদর্শ হোমিও হলের সামনে আসেনি। সদরউদ্দিন তবু ভয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে, পথে-ঘাটে দৈবাৎ যদি দেখা হয়ে যায়! বলা যায় না, হতেও তো পারে! মনে মনে শত সহস্রবার কামনা করে, আর যেন কখনোই দেখা না হয়। এই ছোট্ট শহর থেকে বাসে কিংবা ট্রেনে চড়ে কতো মানুষ কতো দূর-দূরান্তে চলে যাচ্ছে, লাইলীও তো তেমনই কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারে! যেমন অন্ধকারে এসেছিল, আবার অন্ধকারেই হারিয়ে গেল না হয়! এরই মাঝে রেহানার মা কথায় কথায় জানিয়েছে, আপদ বিদেয় হয়ে ভালোই হয়েছে। বাজারের বেশ্যা, কার না কার ছেলে পেটে ধরেছে কে জানে! অহেতুক জামাইয়ের নামে দুর্নামের একশেষ! সাদা কাপড়ে কালির ছিটা! অথচ রেহানার যেদিন ছেলে হয়, সেদিন সদরউদ্দিনের আবার উলটো সম্ভাবনার কথা মনে হয়েছে – লাইলীর ছেলেটাও যদি দেখতে একই রকম হয়! নাক-মুখ-চোখ-গায়ের রং সব যদি মিলে যায়! এ কি একেবারে অসম্ভব! রেহানা তো নিজেই বলেছে, তার স্বামীর বিছানায় লাইলীকে স্রেফ হাতে-নাতে ধরেছে। রেহানার পুত্রের চেহারায় যেমন পিতৃআদলের ছায়া পড়েছে, সামাজিক বৈধতা থাকুক আর না-ই থাকুক, লাইলীর সন্তানের বেলাতেও সেই ছায়া তো পড়তেই পারে!

রেহানার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ধারণা ছিল, তার প্রথম সন্তান মেয়ে হবে। ওদের পরিবারে এ-রকমই নাকি হয়ে আসছে। বিশেষ অভিজ্ঞ দাদি-শাশুড়িও গর্ভের আকৃতি দেখে বহু আগেই কন্যা সম্ভাবনার ভবিষ্যদ্বাণী করে রেখেছে। এসব নিয়ে সবারই উৎকণ্ঠা ছিল। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরেক আশঙ্কা – ছেলেমেয়ে যা-ই হোক, তার চোখ হবে মায়ের মতো ট্যারা। কিন্তু বাস্তবে সকল আশঙ্কা মিথ্যে প্রতিপন্ন হওয়ায় এবং উত্তরাধিকারের চেহারায় বংশসাদৃশ্য খুঁজে পাওয়ায় সবাই খুশি। রেহানার শাশুড়ি নাতির মুখ দেখতে এসে বৌমার ট্যারা চোখের সঙ্গে বারবার মিলিয়ে দেখার পর এতদিনের ব্যবধানে স্বেচ্ছায় ঘোষণা দেয় – আমাদের বৌমার চোখের ঐটুকু লক্ষ্মী। তিনমাস পর তারা রীতিমতো ধুমধাম করে বাদ্য বাজিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বংশবাতিকে ঘরে নিয়ে যায়। সদরউদ্দিন ডাক্তারও যেন আবার নতুন করে কন্যাবিদায়ের অভিজ্ঞতা লাভ করে। সত্যি বলতে কী, নতুন করে তার চোখের কোনা ভিজে ওঠে আবার। তবে বেদনা বা উৎকণ্ঠায় নয়, এবার যেন স্বস্তির ভরাট নিশ্বাস চোখের তটিনী বাষ্পাকুল করে তোলে। অতিথি বিদায়ের পর ভরপেট ভুঁড়িভোজন সেরে সদরউদ্দিন ডাক্তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। সারাটা দিন কেটেছে মেহমানদারিতে। ডাক্তারখানা খোলাই হয়নি। জোরে পা চালিয়ে আয়না মহলের সামনে এসে বুলুর দোকানের পান চিবোনোর ইচ্ছে হয়। প্রায় প্রতিদিনই দুপুরের আহারের পর এ-দোকানের একখিলি পান খাওয়ার অভ্যেস তার। কী চমৎকার পানের হাত বুলুর; চুন সুপারি, মিষ্টি জর্দা, চমনবাহার – সবকিছুর অনুপাত বোঝে। মুখে দিলেই মাখনের মতো মিলিয়ে যায় পান, কিন্তু ঠোঁটজুড়ে টুকটুকে লাল রং আর ভুরভুরে সৌরভটুকু লেগে থাকে অনেকক্ষণ। সেই লোভেই পান খাওয়া। কিন্তু সদরউদ্দিনের মুখে সেই অতিপরিচিত প্রিয় পানও হঠাৎ বেসুরো ঠেকে। চুনে কম পড়ল না-কি! চুনের অনুপাতে তারতম্য ঘটলে গাল-মুখ জ্বালা করে, অস্বস্তি হয়। পানের বোঁটায় চুন নিয়ে জিভের ডগায় লাগাতে গিয়ে ঠোঁটের কাছে উঠে আসা হাত সহসা থমকে দাঁড়ায়, হাত থেকে খসে পড়ে চুনঅলা বোঁটা, সদরউদ্দিনের চোখের পলক পড়তে চায় না – সামনেই লাইলী দাঁড়িয়ে। বুলুর পানের দোকান থেকে সামান্য কয়েক গজ দূরে বিশাল আয়তনের সিনেমা-পোস্টার সাঁটা – ‘ছেলে কেন বিদ্রোহী’। সেই পোস্টারে মায়ের কোলে শিশু হাসছে। লাইলী তন্ময় হয়ে হাসিসুধা পান করছে নির্নিমেষ নয়নে। সদরউদ্দিন ডাক্তার নিজেকে চিমটি কাটার মতো করে প্রশ্ন করে – ভুল হচ্ছে না তো কোথাও? এতোদিন পর লাইলী এল কোত্থেকে? হ্যাঁ, লাইলীই তো বটে! সে স্পষ্ট দেখতে পায় – ডানদিকের সেই লক্ষ্মীট্যারা চোখ। পরনে রেহানার ব্যবহৃত ছাপা শাড়ি হাওয়ায় দুলছে। সেদিন সত্যিকারের অন্তঃসত্ত্বা হলে এখন কতো মাসের গর্ভবতী হবার কথা যেন! সদরউদ্দিন ডাক্তার সভয়ে দৃষ্টি নামিয়ে আনে লাইলীর তলপেটে। দক্ষিণের হাওয়ায় অগোছালো শাড়ি ফুলে-ফেঁপে ওঠায় সে নিঃসংশয় হতে পারে না, বরং ভাবনা হয় – এতোদিনে অবাঞ্ছিত গর্ভ কোনোভাবে খসিয়ে ফেলেনিতো!

এরই মাঝে দুই যুবক এসে লাইলীর ধ্যান ভাঙিয়ে দেয়। হাত ধরে টানাটানি করে। পোস্টারের মাতৃমূর্তি থেকে চোখ ফিরিয়ে সে হঠাৎ তেড়ে ওঠে। যুবকেরা তাতে মোটেই লজ্জিত বা শঙ্কিত হয় না। বরং একজন দুপা এগিয়ে এসে জাতীয় সংসদের ছবি আঁকা দশ টাকার একটি পলিমার নোট পকেট থেকে বের করে খ্যাঁ-খ্যাঁ করে হাসতে হাসতে লাইলীর সামনে বাড়িয়ে ধরে। খুব সামান্য হলেও এতোদিনে লাইলী তার শরীরের মূল্য বুঝেছে; দশ টাকার প্রস্তাব উপেক্ষা করে সে দু আঙুল নাচিয়ে চোখের ইশারায় তার দাবির পরিমাণ জানায়। তারপর ঠোঁট কাঁপিয়ে রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে দেয়। সদরউদ্দিন ডাক্তার আর সেখানে দাঁড়াতে   পারে না। ওয়াক থু করে পানের পিক ছুড়ে      ফেলে। পানের পিক তো লাল হবারই কথা! তবু সেই লাল পিক দেখে সে আঁৎকে ওঠে – রক্ত নয় তো!

দুই যুবকের হাত ধরে সদরউদ্দিনের নাকের ডগা দিয়ে লাইলী লাস্যময়ী ভঙ্গিতে শরীর নাচিয়ে আয়না মহলের পাশের ঘুপচি গলিতে ঢুকে পড়ে। সদরউদ্দিন ডাক্তারকে সে যেন চিনতেই পারে না। অথচ বেসুরো পানের কারণে কপালে ঘাম এবং সারামুখে তিক্ত বিস্বাদ নিয়ে পথে পা বাড়াতেই তার গভীর গোপন একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে এবং সে অন্তর্গত আর্তনাদে কঁকিয়ে ওঠে – মেয়েটা বেশ্যা হয়ে গেল!ৎ

সিদ্ধান্তে আসতে পারে না। অবশেষে দ্বিধান্বিত চিত্তে বাক্স হাতড়ে কী একটা শিশি থেকে দুফোঁটা ওষুধ ঢেলে দেয় মেয়েটির মুখে। তারপর পরিচিত একটা রিকশাভ্যানে তুলে দিয়ে নির্দেশ দেয় – হাসপাতালে নিয়ে যা। হাসপাতালে যাবার পর জানা গেল যে মেয়েটি বোবা। বেশ কিছুটা সুস্থ হবার পর সে আকারে-ইঙ্গিতে জানায়, ঐ রাতে চার যুবক তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে। এই পৈশাচিক বর্বরতার সঙ্গে সদরউদ্দিন ডাক্তারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, তবু ভেতরে ভেতরে সে খুব অব্যাখ্যেয় এক অপরাধবোধে পীড়িত হয়। বারবার মনে হয়, ঐ চন্দ্রভূক অমাবস্যা রাতে তার কি অন্য কিছু করণীয় ছিল? সঠিক জবাব পায় না। তবু মেয়েটির ডানদিকের লক্ষ্মীট্যারা চোখ এবং চিবুকের কালো তিল তাকে দগ্ধায়, অদৃশ্য কিন্তু অনতিক্রম্য সুতোয় বেঁধে টানে; নিয়মিত হাসপাতালে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে আসে। এ-ঘটনার তিনদিন পর বেলা-গড়ানো এক বিকেলে চোয়াড় চেহারার চার যুবক আদর্শ হোমিও হলে এসে রীতিমতো চার্জ করে,

– লাইলীকে আপনি কোথায় ফেললেন ডাক্তার সাহেব?

– লাইলী? সদরউদ্দিন আকাশ থেকে পড়ে। এরা কারা চিনতে চেষ্টা করে। এই ছোট্ট শহরে বহু মানুষই চেনাজানা, অন্তত মুখচেনা। কিন্তু এদের কাউকেই সে চিনতে পারে না। রেলওয়ে-শহরের এই এক বিড়ম্বনা, অনেক নতুন মানুষেরও আনাগোনা হয় বটে। তাই বলে ছোট্ট এই নীলগঞ্জেও? আগন্তুকদের মুখের দিকে তাকিয়ে সে ভাঙা গলায় জানতে চায়,

– কার কথা বলছো তোমরা?

– লাইলী, লাইলী। লাইলীর কথা বলছি।

অন্য একজন পেছন থেকে সামনে এগিয়ে এসে বলে,

– হেভি ডোজের ওষুধ ঝেড়েছেন শুনলাম।

– ঐ মেয়েটির নাম লাইলী নাকি? তোমরা ঠিক জানো?

সদরউদ্দিন ডাক্তার এতোক্ষণে লাইলীকে চিনতে পেরেছে দেখে চার যুবকের মধ্যে দুজন খ্যাঁক-খ্যাঁক করে হাসে। একজন বলে – ওই মাগি তো বোবা-কালা। নামধাম বলে না দেখে আমরাই নাম দিলাম লাইলী। অন্যজন জানায় – মজনুর তো অভাব নেই! মজনু দেখলেই লাইলী তখন অভিনয় করে। মরার মতো ভান করে। চুপচাপ পড়ে থাকে। খ্যাকশিয়ালের মতো অতি চালাক যুবকটি হাসি থামিয়ে সহসা টেবিল চাপড়ে ধমকে ওঠে,

– লাইলী কোথায় বলেন!

– তা আমি কেমন করে বলব! ওষুধ খেয়েই সে চলে গেছে।

সজ্ঞানে এই মিথ্যেটুকু বলে সদরউদ্দিন। কিন্তু তাতে আশ্বস্ত হয় না যুবকেরা। আবারো একটা ঝাঁকুনি দিয়ে দেখে – আপনি সত্যি বলছেন তো?

এবার দিগি¦দিকের কাণ্ডজ্ঞান লুপ্ত হয়ে পড়ে সদরউদ্দিনের। সে চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘুরে দাঁড়ায়,

– কী পেয়েছ তোমরা? একটা মেয়ের সর্বনাশ ঘটিয়ে তোমরা হয়েছ সাধু, আর আমি মিথ্যুক? লজ্জা করে না তোমাদের?

চার যুবকই লেজ গুটিয়ে দোকানের বাইরে বেরিয়ে যায়। কেবল একজন মুখ ঘুরিয়ে বলে,

– বেশি তড়পাবেন না। আমরা আছি। আবার আসব।

এ-ঘটনার পর সদরউদ্দিনের ভেতরে কী যে  ভাবান্তর হয়, সেদিনই হাসপাতাল থেকে রিলিজ করিয়ে লাইলীকে নিয়ে আসে নিজ বাড়িতে। পথের ধুলো ঘরে তোলার এ-ঘটনা তার স্ত্রী খুব প্রসন্নচিত্তে গ্রহণ করে না। গজ্গজ্ করে, ফোঁস-ফোঁস করে, কিন্তু ঘাড় থেকে নামিয়ে ফেলতেও পারে না। স্বামীর স্বভাব-চরিত্র তার অজানা নয়, এমন ঘটনা একেবারে নতুনও নয়। পথের মানুষকে বাড়ি এনে হাঁড়ি উলটিয়ে ভাত খাওয়ানো, রাতে আশ্রয় দেওয়া, নগদ দক্ষিণা দিয়ে বিদেয় করার ঘটনা বহুবার ঘটেছে। তাই বলে চেনা নেই জানা নেই, একেবারে বাজারঘাঁটা বেবুশ্যা মেয়েছেলে এনে ঘরে তুলবে?

– বেবুশ্যা? বেবুশ্যা কাকে বলে? এ্যাঁ? স্ত্রীর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকান সদরউদ্দিন, অতোটুকুন মেয়েটাকে তুমি ঐ নোংরা কথাটা বলতে পারলে রেহানার মা? জানো, গণ্ডা-খানেক পাষণ্ড মিলে রাতভর খামচে-খুবলে ওকে মেরেই ফেলেছিল প্রায়!

এর বেশি কুৎসিত তথ্য আর স্ত্রীর কাছেও প্রকাশ করতে পারে না। সেই পাষণ্ডরা যে দোকানে এসে যাচ্ছেতাই আস্ফালন করে গেছে এবং তা নিয়ে যে বুকের গভীরে সে গোপন আতঙ্ক বয়ে চলেছে, সে- কথা কোথাও বলতে পারে না। ড্যাব-ড্যাব করে তাকানো মেয়েটির লক্ষ্মীট্যারা চোখে চোখ পড়তেই তার বুকের বেলুন চুপসে স্নেহার্দ্র দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। তখন মনে হয়, সেই তো পথের ঝঞ্ঝাট বাড়িতে এনে তোলাই হলো, তবে সেই শিশিরস্নাত রাতে হাত ধরে নিয়ে এলেই বা কী হতো!

সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে আরো সপ্তাহখানেক কেটে যায় লাইলীর। এরই মধ্যে সদরউদ্দিনের স্ত্রীরও মনের উত্তাপ মিইয়ে আসে। বরং ইশারা-ইঙ্গিতে তার সঙ্গে ভাব-বিনিময় করতে করতে মনে মনে সে একরকম পরিকল্পনাও এঁটে বসে। মাস তিন-চারেকের মধ্যে রেহানার ছেলেপুলে হবে। এ-সময়ে একটু বিশ্রাম দরকার। অথচ একান্নবর্তী বড় সংসারের জোয়াল টানতে গিয়ে দম ফেলার ফুরসত হয় না তার। বাঁধা কাজের মানুষও নেই। মেয়ের বিশ্রাম এবং সেবাযত্নের কথা ভেবে লাইলীকে রেহানার কাছে পাঠানোর প্রস্তাব করে। সদরউদ্দিন ডাক্তার প্রথমে দম ধরে বসে থাকে, কী যেন চিন্তা করে গভীরভাবে, তারপর বহু কসরত করে লাইলীর মতামত জানতে চায় – তুই কি যাবি মেয়ের বাড়ি?

কী যে বোঝে সে-ই জানে, একবার রেহানার মায়ের দিকে তাকিয়ে ঘাড় দুলিয়ে দিব্যি সম্মতি জানায়। রেহানার মাও একগাল হাসি ছড়িয়ে জানায় – একটুখানি ইশারা করলেই ও সব বুঝতে পারে। হাতের কাজও বেশ গোছালো। রেহানার খুব কাজে লাগবে। বাস্তবেও হলো তাই। মাত্র দিন দশেকের মাথায় বাপের বাড়ি এসে রেহানা জানায় – মেয়েটা আসলেই খুব ভালো মা, সব কাজ গুছিয়ে করতে জানে। রেহানার শ্বশুরবাড়ি এ-পাড়া ও-পাড়ায়, তবু বাপের বাড়ি এসে দু-একদিন কাটিয়ে যাবার অনুমতি মেলে না সহজে; এবার মিলেছে। জামাই নিজেই নাকি বলেছে, লাইলী তো আছেই, যাও দুদিন ঘুরে এস।

সদরউদ্দিন বেশ কদিন পর এই নাম শুনে চমকে ওঠে,

– তোরাও ওকে লাইলী বলিস না-কি?

প্রশ্নের ধারা শুনে রেহানাও যেন আকাশ থেকে পড়ে,

– কেন, ওর কি অন্য কোনো নাম আছে? মা যে সেদিন বলল…

দোষ তো আসলে রেহানার মায়েরও নয়। সদরউদ্দিন বুঝতে পারে, এ-নাম কখনো তার মুখ থেকেই আলগোছে বেরিয়ে পড়েছে। শব্দটি যতোই শঙ্খ-সাদা নির্দোষ হোক, মাত্র এই কদিনের ব্যবধানে ঐ শব্দটির উচ্চারণ কেমন যেন অশ্লীল শোনায়, সেই কুৎসিত মুখগুলো মনে পড়ে যায়। এই নাম তো দিয়েছে ঐ জানোয়ারের দল, তা-ও ফুর্তি করার জন্য! নাহ্, একটুখানি সতর্ক হলেই ঐ নামটি বেশ এড়ানো সম্ভব ছিল। পিতৃহৃদয়ের এত ভাবান্তর টের পায় না রেহানা, সে খলবলিয়ে জানায়,

– জানো মা, তোমাদের লাইলীও খুব ঝুল ধরেছিল এখানে আসার জন্য!

রেহানার মা লাইলীকে নিয়ে আসার ব্যাপারে আশ্বস্ত করে – ডেলিভারির আগে আগে যখন মেয়েকে নিয়ে আসবে, তখন তাকেও এখানে এনে রাখবে, এই তাদের পরিকল্পনা। লাইলী থাকলে আঁচি-আঁতুরের ঝামেলা সামলানো সহজ হবে।

দুই

নামহীন গোত্রহীন একটি মেয়ের পথরেখা যদি এতোটাই মসৃণ হবে, তাহলে আর সে লাইলী হয়ে উঠবে কী করে! মফস্বলের এই ছোট্ট শহরের পথে পথে অসংখ্য মজনু তার জন্য গোলাপের বদলে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে। সেই কাঁটা মাড়িয়ে হঠাৎ একদিন সে আবার স্টেশন রোডে আদর্শ হোমিও হলের সামনে হাজির। সদরউদ্দিন ডাক্তারের তো চোখ কপালে! লাইলীকে নয়, সে যেন-বা দেখতে পায় ঝড়ে দুমড়ানো-মুচড়ানো কলাগাছ; লাইলীর মাথার চুল নয়, হাওয়ায় দুলছে যেন ছিন্নভিন্ন পত্ররাজি। শুকনো কাশির সঙ্গে ওয়াক করে একদলা বমি উদ্গিরণের পর লাইলী দেয়াল ধরে বসে পড়ে। বসে পড়া নয়, এ-যেন তার ধসে পড়া। অথচ রেহানার সঙ্গে এই মেয়েকেই পরদিন তার আনতে যাবার কথা। সদরউদ্দিন অবাক বিস্ময়ে হাত ইশারায় জানতে চায় – কীরে, তুই এখানে যে! লাইলী এ-প্রশ্নের কী যে বোঝে সে-ই জানে, উত্তরে সে একবার নিজের তলপেটে হাত দেয়, বুকে হাত দেয়, আবার হাত শাসিয়ে মারামারির ভঙ্গিও করে, মাটিতে পা ঠুকে লাথি মারে এবং আঁ-আঁ করে কাঁদতে থাকে। সেই কান্নার মধ্যেই উগরে আসে কাঠবমি। সদরউদ্দিনের সব তালগোল পাকিয়ে যায়। কোনো ইঙ্গিতই ধরতে পারে না। অথচ গত মাসেই সে রেহানার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে গিয়ে গর্ব করে বলেছিল – লাইলীর সব ইশারাই সে সহজে বুঝতে পারে। চারাগাছে পানি পড়লে যেমন সবুজ পাতা গজায়, ফনফনিয়ে বেড়ে ওঠে সজীবতায়, লাইলীকে দেখে সেইরকম সপ্রাণ মনে হয়েছিল সেদিন। বিদায় নেবার আগে মাথায় হাত বুলানোর সময় সে কেঁদে উঠেছিল আকুল হয়ে; কেবল সেই কান্নার কোনো অর্থ সেদিন বুঝতে পারেনি, এই তার ধারণা। কিন্তু এখন সদরউদ্দিনের মনে হয়, কোনোদিন সে কিছুই বোঝেনি লাইলীর।

দুর্বোধ্য এই মেয়েটিকে সঙ্গে নিয়ে সদরউদ্দিন ডাক্তার বাড়ি ফেরে বটে, কিন্তু অচিরেই যে-রহস্যজট উন্মোচিত হয়, তা জানার পর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হওয়া ছাড়া তার গত্যন্তর থাকে না। শ্বশুরবাড়ি থেকে রেহানা এসে দাপায় – আবার এখানে এসে জুটেছিস? হারামজাদি! খান্কি মাগি! শ্রবণ-অযোগ্য গালাগালিতেও যখন মনের ঝাল মেটে না, তখন চুলের মুঠি ধরে টেনে-হিঁচড়ে লাইলীকে বাড়ির বাইরে বের করে দিতে উদ্যত হয়। বিমূঢ় সদরউদ্দিন মাঝখানে দাঁড়িয়ে রেহানাকে নিরস্ত্র করে। তারপর রেহানার মাকে ডেকে শুধায়,

– তুমি কি সত্যিই জানো, লাইলী অন্তঃসত্ত্বা?

রেহানার মাও মুখের আগল একেবারেই খুলে দেয়,

– ঐ দেড় ব্যাটারির ছিনালকেই শুধাও। পথের বেবুশ্যা ঘরে তুলেছ, এখন ঘর সামলাও।

ডাক্তারের কর্ণকুহরে যেন তপ্ত সীসা গলে পড়ে। লক্ষ্মীট্যারা চোখের জন্য এই দেড় ব্যাটারি শব্দযুগল একদা তাদের সবাইকে কতো না নিষ্ঠুরভাবে বিদ্ধ করেছে! অথচ সেই কুৎসিত শব্দটাই এখন রেহানার মায়ের কণ্ঠ থেকে অবলীলায় হলাহল হয়ে গড়িয়ে পড়ে – ঐ দেড় ব্যাটারি দিয়েই জামাইয়ের মাথা খেয়েছে গো, আমার সর্বনাশ করেছে। ওকে আমি বটি দিয়ে কাটব, কেটে টুকরো টুকরো করব।

উন্মাদের মতো ক্ষিপ্ত হয়ে রান্নাঘর থেকে বটি আনতে ছুটলে সদরউদ্দিন দ্রুতবেগে স্ত্রীর হাত চেপে ধরে, অনুনয় করে,

– তুমি শান্ত হও রেহানার মা। এখন এর সমাধান কী তাই বলো!

– সমাধান? ওষুধ দিয়ে আগে ওর পেট সাফ করে দাও। ঐ পাপ খসিয়ে দাও। শিউরে ওঠে সদরউদ্দিন ডাক্তার, এ-কী প্রস্তাব দিচ্ছে তার স্ত্রী! কুমারী মেয়ের গর্ভধারণে পাপ আছে, আর সেই গর্ভ খসানোয় পাপ নেই বুঝি! না না, এ-ওষুধ তার জানা নেই। ডানে-বামে দুলে ওঠে তার মাথা। আর তখনই লাইলী আবার ওয়াক-ওয়াক করে ওঠে। এই বমন-প্রচেষ্টার শব্দে আসন্নপ্রসবা রেহানার মাথার চাঁদি ধাঁ-ধাঁ করে জ্বলে যায়। কোনো প্রকার সমাধানের প্রতীক্ষা না করেই সে ভারি শরীর নিয়ে তেড়ে যায় লাইলীর কাছে, দশ আঙুলের সাঁড়াশিতে জাপটে ধরে তার গলা। একবার ওয়াক করে উঠেই লাইলী শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে সাঁড়াশিমুক্ত হয় এবং এক দৌড়ে বাড়ির বাইরে পালিয়ে যায়।

এ-ঘটনার পর দীর্ঘদিন লাইলী আর আদর্শ হোমিও হলের সামনে আসেনি। সদরউদ্দিন তবু ভয়ে ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে, পথে-ঘাটে দৈবাৎ যদি দেখা হয়ে যায়! বলা যায় না, হতেও তো পারে! মনে মনে শত সহস্রবার কামনা করে, আর যেন কখনোই দেখা না হয়। এই ছোট্ট শহর থেকে বাসে কিংবা ট্রেনে চড়ে কতো মানুষ কতো দূর-দূরান্তে চলে যাচ্ছে, লাইলীও তো তেমনই কোথাও নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারে! যেমন অন্ধকারে এসেছিল, আবার অন্ধকারেই হারিয়ে গেল না হয়! এরই মাঝে রেহানার মা কথায় কথায় জানিয়েছে, আপদ বিদেয় হয়ে ভালোই হয়েছে। বাজারের বেশ্যা, কার না কার ছেলে পেটে ধরেছে কে জানে! অহেতুক জামাইয়ের নামে দুর্নামের একশেষ! সাদা কাপড়ে কালির ছিটা! অথচ রেহানার যেদিন ছেলে হয়, সেদিন সদরউদ্দিনের আবার উলটো সম্ভাবনার কথা মনে হয়েছে – লাইলীর ছেলেটাও যদি দেখতে একই রকম হয়! নাক-মুখ-চোখ-গায়ের রং সব যদি মিলে যায়! এ কি একেবারে অসম্ভব! রেহানা তো নিজেই বলেছে, তার স্বামীর বিছানায় লাইলীকে স্রেফ হাতে-নাতে ধরেছে। রেহানার পুত্রের চেহারায় যেমন পিতৃআদলের ছায়া পড়েছে, সামাজিক বৈধতা থাকুক আর না-ই থাকুক, লাইলীর সন্তানের বেলাতেও সেই ছায়া তো পড়তেই পারে!

রেহানার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ধারণা ছিল, তার প্রথম সন্তান মেয়ে হবে। ওদের পরিবারে এ-রকমই নাকি হয়ে আসছে। বিশেষ অভিজ্ঞ দাদি-শাশুড়িও গর্ভের আকৃতি দেখে বহু আগেই কন্যা সম্ভাবনার ভবিষ্যদ্বাণী করে রেখেছে। এসব নিয়ে সবারই উৎকণ্ঠা ছিল। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আরেক আশঙ্কা – ছেলেমেয়ে যা-ই হোক, তার চোখ হবে মায়ের মতো ট্যারা। কিন্তু বাস্তবে সকল আশঙ্কা মিথ্যে প্রতিপন্ন হওয়ায় এবং উত্তরাধিকারের চেহারায় বংশসাদৃশ্য খুঁজে পাওয়ায় সবাই খুশি। রেহানার শাশুড়ি নাতির মুখ দেখতে এসে বৌমার ট্যারা চোখের সঙ্গে বারবার মিলিয়ে দেখার পর এতদিনের ব্যবধানে স্বেচ্ছায় ঘোষণা দেয় – আমাদের বৌমার চোখের ঐটুকু লক্ষ্মী। তিনমাস পর তারা রীতিমতো ধুমধাম করে বাদ্য বাজিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের বংশবাতিকে ঘরে নিয়ে যায়। সদরউদ্দিন ডাক্তারও যেন আবার নতুন করে কন্যাবিদায়ের অভিজ্ঞতা লাভ করে। সত্যি বলতে কী, নতুন করে তার চোখের কোনা ভিজে ওঠে আবার। তবে বেদনা বা উৎকণ্ঠায় নয়, এবার যেন স্বস্তির ভরাট নিশ্বাস চোখের তটিনী বাষ্পাকুল করে তোলে। অতিথি বিদায়ের পর ভরপেট ভুঁড়িভোজন সেরে সদরউদ্দিন ডাক্তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। সারাটা দিন কেটেছে মেহমানদারিতে। ডাক্তারখানা খোলাই হয়নি। জোরে পা চালিয়ে আয়না মহলের সামনে এসে বুলুর দোকানের পান চিবোনোর ইচ্ছে হয়। প্রায় প্রতিদিনই দুপুরের আহারের পর এ-দোকানের একখিলি পান খাওয়ার অভ্যেস তার। কী চমৎকার পানের হাত বুলুর; চুন সুপারি, মিষ্টি জর্দা, চমনবাহার – সবকিছুর অনুপাত বোঝে। মুখে দিলেই মাখনের মতো মিলিয়ে যায় পান, কিন্তু ঠোঁটজুড়ে টুকটুকে লাল রং আর ভুরভুরে সৌরভটুকু লেগে থাকে অনেকক্ষণ। সেই লোভেই পান খাওয়া। কিন্তু সদরউদ্দিনের মুখে সেই অতিপরিচিত প্রিয় পানও হঠাৎ বেসুরো ঠেকে। চুনে কম পড়ল না-কি! চুনের অনুপাতে তারতম্য ঘটলে গাল-মুখ জ্বালা করে, অস্বস্তি হয়। পানের বোঁটায় চুন নিয়ে জিভের ডগায় লাগাতে গিয়ে ঠোঁটের কাছে উঠে আসা হাত সহসা থমকে দাঁড়ায়, হাত থেকে খসে পড়ে চুনঅলা বোঁটা, সদরউদ্দিনের চোখের পলক পড়তে চায় না – সামনেই লাইলী দাঁড়িয়ে। বুলুর পানের দোকান থেকে সামান্য কয়েক গজ দূরে বিশাল আয়তনের সিনেমা-পোস্টার সাঁটা – ‘ছেলে কেন বিদ্রোহী’। সেই পোস্টারে মায়ের কোলে শিশু হাসছে। লাইলী তন্ময় হয়ে হাসিসুধা পান করছে নির্নিমেষ নয়নে। সদরউদ্দিন ডাক্তার নিজেকে চিমটি কাটার মতো করে প্রশ্ন করে – ভুল হচ্ছে না তো কোথাও? এতোদিন পর লাইলী এল কোত্থেকে? হ্যাঁ, লাইলীই তো বটে! সে স্পষ্ট দেখতে পায় – ডানদিকের সেই লক্ষ্মীট্যারা চোখ। পরনে রেহানার ব্যবহৃত ছাপা শাড়ি হাওয়ায় দুলছে। সেদিন সত্যিকারের অন্তঃসত্ত্বা হলে এখন কতো মাসের গর্ভবতী হবার কথা যেন! সদরউদ্দিন ডাক্তার সভয়ে দৃষ্টি নামিয়ে আনে লাইলীর তলপেটে। দক্ষিণের হাওয়ায় অগোছালো শাড়ি ফুলে-ফেঁপে ওঠায় সে নিঃসংশয় হতে পারে না, বরং ভাবনা হয় – এতোদিনে অবাঞ্ছিত গর্ভ কোনোভাবে খসিয়ে ফেলেনিতো!

এরই মাঝে দুই যুবক এসে লাইলীর ধ্যান ভাঙিয়ে দেয়। হাত ধরে টানাটানি করে। পোস্টারের মাতৃমূর্তি থেকে চোখ ফিরিয়ে সে হঠাৎ তেড়ে ওঠে। যুবকেরা তাতে মোটেই লজ্জিত বা শঙ্কিত হয় না। বরং একজন দুপা এগিয়ে এসে জাতীয় সংসদের ছবি আঁকা দশ টাকার একটি পলিমার নোট পকেট থেকে বের করে খ্যাঁ-খ্যাঁ করে হাসতে হাসতে লাইলীর সামনে বাড়িয়ে ধরে। খুব সামান্য হলেও এতোদিনে লাইলী তার শরীরের মূল্য বুঝেছে; দশ টাকার প্রস্তাব উপেক্ষা করে সে দু আঙুল নাচিয়ে চোখের ইশারায় তার দাবির পরিমাণ জানায়। তারপর ঠোঁট কাঁপিয়ে রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে দেয়। সদরউদ্দিন ডাক্তার আর সেখানে দাঁড়াতে         পারে না। ওয়াক থু করে পানের পিক ছুড়ে      ফেলে। পানের পিক তো লাল হবারই কথা! তবু সেই লাল পিক দেখে সে আঁৎকে ওঠে – রক্ত নয় তো! দুই যুবকের হাত ধরে সদরউদ্দিনের নাকের ডগা দিয়ে লাইলী লাস্যময়ী ভঙ্গিতে শরীর নাচিয়ে আয়না মহলের পাশের ঘুপচি গলিতে ঢুকে পড়ে। সদরউদ্দিন ডাক্তারকে সে যেন চিনতেই পারে না। অথচ বেসুরো পানের কারণে কপালে ঘাম এবং সারামুখে তিক্ত বিস্বাদ নিয়ে পথে পা বাড়াতেই তার গভীর গোপন একটি দীর্ঘশ্বাস পড়ে এবং সে অন্তর্গত আর্তনাদে কঁকিয়ে ওঠে – মেয়েটা বেশ্যা হয়ে গেল!