চিত্তপ্রসাদ : মর্মযাতনার রূপকার

শরীফ আতিক-উজ-জামান

চিত্তপ্রসাদ (১৯১৫-৭৮) 888sport appsের চট্টগ্রামের মানুষ, জন্মেছিলেন ১৯১৫ সালের ২১ জুন নৈহাটিতে। ব্রাহ্মণের ছেলে, কিন্তু কখনো নামের সঙ্গে ভট্টাচার্য উপাধি ব্যবহার করেননি। কোনো পৈতেও পরতেন না। জাতিপ্রথার বিরুদ্ধে এ ছিল তাঁর নিজস্ব ও নীরব এক প্রতিবাদ। প্রবল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য নিয়ে তিনি সারাজীবন পথ চলেছেন। ১৯৩২ সালে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হন। পরিবারের ইচ্ছায় চিকিৎসক বা কাকার ইচ্ছায় ব্যবসায়ী – কোনোটাই হওয়া হয়নি তাঁর। 888sport live chatের প্রতি যাঁর আগ্রহ আবাল্য, চিত্রী হওয়াটাই তাঁর ভবিতব্য। সেজন্যে প্রয়োজন পড়েনি কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার। এ-রকম একজন মেধাবী 888sport live chatীকে কলকাতার আর্ট স্কুল বা শান্তিনিকেতনের কলাভবন ভর্তি করতে অস্বীকৃতি জানায়। একেবারে স্বশিক্ষিত 888sport live chatী তিনি। একবার নন্দলাল বসুর কাছে অাঁকা শিখতে গিয়েছিলেন। তাঁর ছবি দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘তোমার তো শেখা হয়ে গেছে – নতুন করে আর শিখবে কী?’১ এ-কথার মধ্যে প্রশংসা না তাচ্ছিল্য ছিল, আমরা জানি না। তবে নন্দলাল তাঁকে অাঁকা শেখাননি, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তবে তা তাঁর 888sport live chatী হওয়ার পথে কোনো অন্তরায় হয়ে ওঠেনি। কলেজে পড়ার সময় থেকেই জাতীয় আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া চিত্তপ্রসাদ পোস্টার, ড্রইং, ব্যঙ্গচিত্র অাঁকতে থাকেন। এ-সময়ই অগ্নিযুগের বিপ্লবী পুর্ণেন্দু দস্তিদার তাঁকে দলে টেনে নেন। ১৯৪০  সালে  (মতান্তরে ১৯৪১) তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। সেই সময় যুদ্ধ চলছিল। মানুষ দুর্দশাগ্রস্ত, অনাহারক্লিষ্ট। চট্টগ্রাম শহর থেকে বেরিয়ে তিনি ঘুরতে লাগলেন প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তুলির অাঁচড়ে তুলে আনতে লাগলেন বুভুক্ষু অসহায় মানুষের সংকটময় অবস্থা। চট্টগ্রাম থেকে কমিউনিস্ট ছাত্রনেতারা তাঁকে এনে ছাত্র ফেডারেশনের আস্তানা কলকাতার কলাবাগানের একটি দোতলা বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। তাঁর ছবি তখন ছাপা হতে লাগল জনযুদ্ধ ও পিপল্স ওয়ার পত্রিকায়, খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল সারা ভারতে।

১৯৪৩ সালে তিনি পার্টি থেকে দুর্ভিক্ষ, দামোদরের বন্যা ও মেদিনীপুরের সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ সম্পর্কে রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব পেলেন। মেদিনীপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে লিখলেন হাংরি বেঙ্গল। অাঁকা ছবি আর ঘটনার বিবরণে প্রকাশিত সেই বই ইংরেজ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। তবে ‘চট্টগ্রামের পর মেদিনীপুরের এই মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতাই নিয়ন্ত্রণ করেছে চিত্তপ্রসাদের জীবন ও মনন শেষদিন পর্যন্ত।’২ বিজন চৌধুরীও তেমনি মনে করেন। তাঁর সম্পর্কে এক 888sport liveে তিনি লিখেছেন :

আসে দুর্ভিক্ষ ও ১৩৫০ সালের মহামন্বন্তর। …চিত্তপ্রসাদ এই সময়ে রাজনীতি সচেতন 888sport live chatী হিসেবেই তাঁর দায় পালন করছিলেন এই আগ্রাসী যুদ্ধের বিরুদ্ধে অসংখ্য সাদা-কালো রংয়ের চিত্র এঁকে। এইসময় অনেক চিত্রেই তাঁর পূর্বের উল্লিখিত অংকনশৈলীর কিছু পরিবর্তনও ঘটে। কার্টুন ও ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিমায় একজন সমালোচকের ভূমিকায় 888sport live chatীকে আমরা দেখতে পাই। প্রকাশরূপেতে আসে কল্পিত প্রতীকের ব্যবহার ও আকৃতি বিকৃতকরণ।৩

আর সে-কারণেই তিনি হয়ে রইলেন মন্বন্তরের 888sport live chatী। ১৯৪৬ সালে তেভাগার ঠিক আগে পি.সি. যোশী তাঁকে মুম্বাই নিয়ে না গেলে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে আমরা তেভাগার চিত্র পেতাম, যা হতো বাংলার চিত্রকলার মূল্যবান সম্পদ। তবু যে-চিত্রগুলো তিনি এঁকেছেন তার মধ্যে ‘তেভাগার প্রতিরোধ’, ‘ফসলের অধিকার’ শিরোনামের ছবি দুটি ছাড়াও শিরোনামহীন আরো কয়েকটি ছবি দেখতে পাই। ছবিগুলোর প্রতিটিতে আন্দোলনের সময়কার আবহ ফুটে উঠেছে। কালি-তুলিতে অাঁকা ‘তেভাগার প্রতিরোধ’ ছবিটাতে দেখতে পাই, সন্তানের মমতায় কর্তিত ধানের অাঁটি বুকের সঙ্গে চেপে ধরে বসে আছে এক কৃষক-রমণী, আর তার পাশে লাঠি হাতে পাহারায় এক যুবক কৃষক। অধিকার আদায়ের সংগ্রামের কী অসাধারণ জীবন্ত প্রতিচ্ছবি! ‘ফসলের অধিকার’ ছবিটাতে দেখতে পাই, ফসলের মাঠে পড়ে থাকা প্রাণহীন এক কৃষকের দেহ, বুকের তলে কর্তিত ধানের গোছা, কাস্তেটা তখনো ডান হাতে ধরা, বাঁ-হাত মুষ্টিবদ্ধ, বুকের নিচ থেকে রক্তের ধারা বয়ে চলেছে, ভিজিয়ে দিয়েছে সবুজ ধান, পাশে শক্ত মুঠোয় চেপে ধরা লাঠি নিয়ে ছুটে চলেছে সুঠাম দেহের কৃষক শত্রুর মোকাবিলায়, আর এই দুটি ফিগরের মাঝে একটি 888sport promo codeমূর্তি বাঁ-হাতে একটি ঝান্ডা নিয়ে ছুটে চলেছে সামনে। ছবিটির এই 888sport promo codeমূর্তি মনে করিয়ে দেয় ১৮৩০ সালে ফরাসি চিত্রকর ইউজেন দেলাক্রোয়ার অাঁকা ‘লিবার্টি’ ছবিটির কথা। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য মৃতদেহ ডিঙিয়ে প্রবল বিক্রমে মুক্তিকামী যোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলেছে এক 888sport promo code, যার ডান হাতে ঝান্ডা আর বাঁ-হাতে রাইফেল। অসাধারণ প্রতিবাদী চেতনার ধারক ছবিটি। চিত্তপ্রসাদ ছবি-দুটি এঁকেছিলেন তেভাগার অনেক পরে। ‘তেভাগার প্রতিরোধ’ ১৯৫১ সালে আর ‘ফসলের অধিকার’ ১৯৫৭ সালে। অন্য ছবিগুলোর একটাতে দেখতে পাই বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, একপাশে এক কৃষক-রমণী ধান কাটছে, আরেক রমণী অাঁটি বাঁধছে, তার পাশে জড়ো করা হচ্ছে ধান, তা ঘিরে বসে আছে সতর্ক কৃষক, পাশে লাঠি-হাতে দন্ডায়মান কিষানি। অন্য একটা ছবিতে দেখতে পাই, কাস্তে-হাতুড়ি অাঁকা ঝান্ডা পুঁতে জমির সীমানা নির্ধারণ করে ধানকাটা চলছে। কিষানি ধান কাটছে, পাশে লাঠি-হাতে পাহারায় সুঠামদেহী কৃষক, কাটা ধান অাঁটি বেঁধে মাথায় তুলে নিরাপদ গন্তব্যে ছুটছে তারা, এক হাতে মাথার অাঁটি সামলাচ্ছে, অন্য হাতে নিরাপত্তার জন্য বহন করছে বাঁশের লাঠি। অস্তিত্বের সংগ্রাম ও অধিকার আদায়ে কৃতসংকল্প কৃষকের প্রত্যয়ী চিত্র। অন্য আরেকটি ছবিতে রাইফেল তাক করে অবস্থান নেওয়া পুলিশের মুখোমুখি লাঠি-হাতে প্রতিরোধ-উদ্যত জনতা, গুলিতে একজন লুটিয়ে পড়েছে। আন্দোলনের সময় পুলিশি বর্বরতার চূড়ান্ত রূপ এ-চিত্রে ধরা পড়েছে। বস্ত্তত স্বল্প হলেও চিত্তপ্রসাদ তেভাগা আন্দোলনের যে-ছবি এঁকেছেন, তা সে-সময়কার পরিস্থিতির অনেকটাই আমাদের উপলব্ধিতে এনে দেয়। কিন্তু 888sport live chatী চিত্তপ্রসাদের মূল্যায়নে তাঁর তেভাগার ছবি নিয়ে সমালোচকরা কোনো মন্তব্য করেন না। যেমন, রণজিৎ সিং চিত্তপ্রসাদের ছবির বিষয়বস্ত্ত নিয়ে যে-মন্তব্য করেছেন তা পড়লে মনে হবে, চিত্তপ্রসাদ নিছকই আটপৌরে জীবনের 888sport live chatী, যিনি জীবনের সুখময় আনন্দঘন দিকগুলোই তুলে ধরতে চেয়েছেন। তাঁর লেখনী থেকে আমরা তেমনই একটি চিত্র পাই :

888sport live chatী চিত্তপ্রসাদ তাঁর সময়ের বিস্তৃত ভূখন্ড পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন। মানবজীবনকে তাঁর পরিমন্ডলে দেখেছেন। পূর্ণতার অভিযাত্রী মানুষ তাঁর ছবির বিষয় হয়েছে। তাঁর শিশু আর ফুল পরস্পরের প্রতিকল্প। পূর্ণতার সৃষ্টি তারা। তাঁর শিশুরা বিশ্বের অঙ্গনে বসে শান্তির শ্লোগান লেখে, তাদের মধ্যে মানবজাতির সকল ভাষার আদান-প্রদান চলে। তাঁর শিশুরা অভুক্ত থেকেও, প্রহৃত হয়েও, খাটুনির ধকলে ঘুমিয়ে পড়েও রূপকথার রাজ্যে চলে যায়। আর কি স্বাস্থ্যময়, প্রসন্ন আর ঢলোঢলো মুখ সেইসব শিশুর। তাঁর ছবির বন্ধনীর মধ্যে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পাখি, পশু, কীট পতঙ্গ, তৈজস, আসবাব, খেলনা, আলপনা, লতা, পাতা, ফুল, ফসলের গোছা কি রূপময় হয়ে ওঠে। তাঁর গৃহবধূ পোশাকে-অলঙ্কারে সুন্দরভাবে সেজে, ছোট্ট ছেলের দেওয়ালির প্রদীপ ধরা দুটি হাত, সযত্নে ধরে রাখেন, প্রদীপশিখার আলোয় শিশু আর জননীর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে থাকে। ওই প্রদীপের আর পেছনের শহরের বাড়িগুলোর অসংখ্য প্রদীপের আলো আকাশকে উদ্ভাসিত করে।৪

কিন্তু এ-মন্তব্য খন্ডিত। চিত্তপ্রসাদ খেটে-খাওয়া মানুষের জীবনের দুর্দশা ও দ্রোহ দেখেছিলেন। সেই দ্রোহের কাহিনি চিত্রিত করেছিলেন। কিন্তু তা কেন এই সমালোচকদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেল বোধগম্য নয়। চিত্তপ্রসাদের শৈলী নিয়ে দু-একটি কথা না বললেই নয়। তাঁর ছবির মানুষেরা খুবই স্বাস্থ্যবান। হাত-পা মোটা মোটা, প্রচলিত অ্যানাটমিকে অনুসরণ করে অাঁকা নয়। মানুষের ভেতরের শক্তির দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ প্রদান করেছেন অস্বাভাবিক আকৃতি চিত্রায়ণের মাধ্যমে। এ-কথার সমর্থন মেলে বিজন চৌধুরীর মন্তব্যে :

বাস্তবতা তাঁর চিত্রে অন্যভাবে উপস্থিত হয়েছে বারবার। বিষয় ও মানুষের আয়তন বাড়িয়ে, বলিষ্ঠ গতিবেগ সঞ্চারিত করে, প্রচলিত চিত্রপ্রকাশভঙ্গির যে গন্ডি তার বাইরেই থেকেছেন চিত্তপ্রসাদ। কোনো সনাতনী ও নিশ্চল 888sport live chatকলাশৈলী বন্ধন তাঁর ছিল না। এসব কারণে 888sport live chatী হিসেবে চিত্তপ্রসাদ আধুনিক ছিলেন বলা অসংগত হয় না।৫

বস্ত্তত চিত্তপ্রসাদ তাঁর লালিত বিপ্লবী-চেতনার কারণে সক্রিয় অংশগ্রহণ বা প্রত্যক্ষ অবলোকন ছাড়া তেভাগার যে-চিত্র রচনা করেছেন, তা সময়ের বিচারে আজ আমাদের অমূল্য সম্পদ। কিন্তু অন্য 888sport live chatীরা তখন বা পরবর্তীকালে কেন তেভাগা নিয়ে চিত্র সৃষ্টি করলেন না, তার ব্যাখ্যা মেলা ভার। ফলে চিত্রকলায় তেভাগা উপেক্ষিতই থেকে গেল বলা চলে।

চিত্তপ্রসাদও যে খুব বেশি ছবি এঁকেছিলেন তা নয়, কয়েকখানা মাত্র। তাও আবার আন্দোলনের চাক্ষুষ অভিজ্ঞতা থেকে নয়। তেভাগা যখন সংঘটিত হয়, চিত্তপ্রসাদ তখন বাংলা থেকে অনেক দূরে মুম্বাইয়ের আন্ধেরিতে। বাংলায় থাকলে নিশ্চয়ই তিনি আন্দোলনের অভিঘাতকে অগ্রাহ্য করতে পারতেন না। না, শুধু পার্টির সদস্য ছিলেন বলেই নয়, তাঁর চেতনায় মানুষ – বিশেষ করে দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের জন্য যে-দরদ ছিল –  তা ছিল তাঁর সৃষ্টির নিয়ামক। মুম্বাইয়ের শ্রমিক সমাবেশে পুলিশের গুলিতে আহত এক মজুরকে বুকে টেনে নিয়ে দীর্ঘদেহী যে-মানুষ উঁচু লোহার রেলিং ডিঙিয়ে যেতে পারেন, পঞ্চাশের মন্বন্তরের সময় যিনি চট্টগ্রাম ও মেদিনীপুরের গ্রামগুলোতে ঘুরে ঘুরে মন্বন্তরের ঘটনা টুকে আনতেন, করে আনতেন স্কেচ, তেভাগার মতো খেটে খাওয়া মানুষের সংগ্রাম তাঁর চিত্তে নাড়া দিত – এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আন্দোলন থেকে সহস্র মাইল দূরে অবস্থান করায় তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাভিত্তিক কোনো ছবি আমরা পাই না। যা পাই তা কল্পনানির্ভর। আর হয়তো সে-কারণেই তিনি দুর্ভিক্ষের চিত্রী হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তাঁকে নিয়ে বিজন চৌধুরী, রণজিৎ সিং বা মুরারি গুপ্তের লেখা 888sport liveে তাঁর তেভাগা-বিষয়ক কোনো ছবির উল্লেখ দেখতে পাই না। ব্যতিক্রম শুধু অশোক ভট্টাচার্য, কিন্তু তিনিও মন্তব্য করেছেন, ‘কৃষকসভার তেভাগা আন্দোলনের ওপর অাঁকা প্রত্যক্ষ ছবিও তাঁর নেই তেমন, যেমন ছিল দুর্ভিক্ষের সময়কার কৃষকদের দুর্দশার সাড়া জাগানো ছবি।’৬ দুর্ভিক্ষের ছবি তিনি বেশি এঁকেছেন, এ-কথা সত্য। ‘দুর্ভিক্ষের কবলে মেদিনীপুর’, ‘দুর্ভিক্ষের কবলে কন্টাই’ শিরোনামে তাঁর একাধিক ছবি রয়েছে। কালি-তুলিতে করা ছবিগুলোতে নিরন্ন মানুষ, বিবর্ণ গ্রাম-জনপদ, অভাবের তাড়নায় গরু, কাঁসার ঘটিবাটি-কলসি ইত্যাদি শেষ সম্বল বন্ধক রাখার জন্য সুদখোর মহাজনের দরজায় অভাবী মানুষ, মৃত মানুষের মাথার খুলি-হাড়গোড় এঁকে আকালের ভয়াবহতা তুলে আনার চেষ্টা করেছেন তিনি। দুর্ভিক্ষ কীভাবে তাঁকে বিপর্যস্ত করেছিল তার বর্ণনা পাই তাঁর বোন গৌরীর বয়ানে :

…দাদা ফিরত অনেক রাতে। পরিশ্রান্ত উস্কোখুস্কো চুল, ময়লা ধুলোভরা জামাটি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মায়ের ঘরে বসে বলত সারাদিন যা দেখেছে, যা শুনেছে, যা  জেনেছে তার মর্মান্তিক কাহিনী, ব্যাগ থেকে বের করত খাতা, কাগজ, ওতে অজস্র ছবি অাঁকা। গ্রাম-গ্রামান্তরে হেঁটে হেঁটে লিখে আনা ঘটনা, এঁকে আনা ছবি একে একে দেখাত মাকে, পড়তে পড়তে গলা ধরে  যেত দাদার, আর মা কাঁদেন ছবি দেখে আর ঘটনা শুনে।

চিত্তপ্রসাদের 888sport live chatী ও রাজনৈতিক সত্তা এক কথায় অভিন্ন। গণনাট্য সঙ্ঘের প্রতীকটির স্রষ্টাও তিনি। লিনোকাটে করা ‘খরার কবলে কোলাপুর’, ‘বন্যার কবলে’, ‘বিশ্বশান্তির পক্ষে’ প্রভৃতি ছবি মানুষের প্রতি তাঁর বিশেষ সহমর্মিতার প্রকাশ। মার্কসবাদের দীক্ষা তাঁকে শোষিত শ্রেণির 888sport live chatী করে তুলেছিল হয়তো, কিন্তু এর মাঝেও তিনি লিনোকাটে করেছেন ‘মা’, ‘মা ও শিশু’, ‘ফসল কাটা’, ‘নিসর্গ’র মতো অসামান্য সব জীবনমুখী ছবি। কিন্তু দলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভেঙে গেল। তবে  যে-আদর্শ নিয়ে তিনি তাঁর ব্যক্তি ও 888sport live chatীসত্তা গড়েছিলেন, তা থেকে সরে আসতে পারলেন না, সম্ভব ছিল না। দলের অনেকেই তাঁর কাছে আসতেন, যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। সে-কারণেই ক্রস রোড নামে দলের যে-সাপ্তাহিক পত্রিকাটি ছিল তাতে নিয়মিত ছবি আঁকতেন।

উনিশশো পঞ্চাশের দশক থেকেই চিত্তপ্রসাদ ছাপচিত্রের প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন। লিনোকাট মাধ্যমটি নিয়ে তিনি খুবই আশাবাদী ছিলেন। ‘লিনোকাট অবলম্বন করে একটা কিছু খাড়া করার বুদ্ধি এসেছে আমার মাথায়। কারণ লিনোকাট দিয়ে কম খরচে কম সময়ে সারা দেশময় সারা পৃথিবীময় ছবি অর্থাৎ এদেশের কাহিনি ছড়িয়ে দেওয়া যায়।’৮ তখন থেকে লিনোকাটই হয়ে ওঠে তাঁর প্রকাশের প্রধান মাধ্যম। ‘লিনোকাটের ক্ষেত্রে চিত্তপ্রসাদ ছাড়া এত বড়মাপের আরেকজন 888sport live chatীর নাম সহসা 888sport app download for androidে আনা শক্ত। এসব ছবিতে জীবনের সপ্রাণতা, তার গতি ও ছন্দের তুলনা হয় না। সাদা কাগজের পটে তুলি বা কলমের মতোই অবলীলায় লিনোর ওপরে টুলসের অনায়াস স্বচ্ছন্দ বিচরণ মাঝে মাঝে আমাদের চোখে অবিশ্বাস্য ঠেকে।’৯ এরপর পুতুলনাচের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। এ-জন্য বেছে নিয়েছিলেন গোপাল ভাঁড়কে। কিন্তু পুতুলনাচের মাধ্যমে নাটক মঞ্চস্থের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো না। পৃষ্ঠপোষকতার প্রতিশ্রুতিদানকারীরা পিছুটান দেওয়ায় তিনি হতাশায় মুষড়ে পড়েছিলেন। ‘স্টোরি অব ইন্ডিয়া’ এবং ‘বাংলার ইতিহাসে’র ছবির বই করার পরিকল্পনায়ও হাত দিতে পারেননি। ব্যক্তিজীবনের ভালোবাসাও পরিণতি লাভ করল না, কিন্তু তাতে তাঁর সৃষ্টিশীলতা থেমে থাকেনি। লিনোকাটের সঙ্গে প্যাস্টেল, জলরঙে এঁকেছেন নিসর্গ ও চেনা আটপৌরে জীবন।

চিত্তপ্রসাদকে শুধু দুর্ভিক্ষের চিত্রী হিসেবে চিত্রায়ণে অধিক আগ্রহ তাঁর অন্য সৃষ্টিসম্ভারকে খানিকটা হলেও আড়াল করে। একজন 888sport live chatীর সৃষ্টির গায়ে বিশেষ ধারা বা সামাজিক-রাজনৈতিক চেতনার মোহর লেগে গেলে তা মুছে ফেলে নতুন পরিচয় নির্মাণ করা বেশ মুশকিলই। চিত্তপ্রসাদ দুর্ভিক্ষের ছবি বেশি এঁকেছেন হয়তো, কিন্তু খেলনা হাতি, বেতবোনা, দৌড়, ফসল কাটা, রাখাল ছেলে, রামায়ণ চিত্রণ, ফুল ইত্যাদি ছবি দেখলে এ-ধারণা পালটে যেতে বাধ্য।

শৈলীর ক্ষেত্রে তিনি বাংলার লোকচিত্রকলার শৈলীকে বেছে নিয়েছিলেন। সাদা-কালোতে 888sport promo code-পুরুষ-শিশু, খরা, বন্যা, রামায়ণ ইত্যাদি ছবিতে তাঁর নিজস্ব অ্যানাটমি দৃষ্টি কাড়ে। জীবিতাবস্থায়ই তাঁর খ্যাতি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছিল। চেকোস্লোভাকিয়া, ডেনমার্ক, হল্যান্ড, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। কিন্তু দেশে কতটুক মূল্য পেয়েছেন? মাত্র দুটি প্রদর্শনী তাঁর 888sport live chatসম্ভার ও 888sport live chatীসত্তাকে পরিপূর্ণভাবে দর্শকের কাছে তুলে ধরেনি। চৌষট্টি বছর বয়সে কলকাতায় একপ্রকার নিভৃতেই মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর গুণমুগ্ধ ও অনুসারীর 888sport free betও খুব স্বল্প। তবে তাতে তাঁর প্রাসঙ্গিকতাকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। আজো তাই চিত্তপ্রসাদ জরুরি।

 

তথ্যসূত্র

১।   কালচেতনার 888sport live chatী, অশোক ভট্টাচার্য, কলকাতা, ২০০৩,  পৃ ৭৬।

২।  প্রাগুক্ত, পৃ ৫২।

৩।   ‘চিত্তপ্রসাদ আজও একান্ত প্রাসঙ্গিক’, বিজন চৌধুরী, পরিচয়, ১৯৯৪, ৬৪ বর্ষ ৪-৫ 888sport free bet, পৃ ১০৯।

৪। ‘চিত্তপ্রসাদ’, রণজিৎ সিং,  প্রগতির পথিকেরা, সম্পাদনা-দেবাশিস সেনগুপ্ত, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃ ৯৭।

৫।   বিজন চেŠধুরী, প্রাগুক্ত, পৃ ১১০।

৬।   কালচেতনার 888sport live chatী, অশোক ভট্টাচার্য, কলকাতা, ২০০৩,   পৃ ৮।

৭।    প্রাগুক্ত, পৃ ৫২।

৮। মুরারি গুপ্তকে লেখা চিত্তপ্রসাদের চিঠি, শারদীয় দেশ, ১৩৮৮, পৃ ১৪।

৯।           ‘চিত্তপ্রসাদের ছবি কিছু ভাবনা কিছু জিজ্ঞাসা’, সুশোভন অধিকারী, 888sport live chat ও 888sport live chatী,  নভেম্বর ২০১১, পৃ ৫২।