বদরুন নাহার
আবদুর সাত্তার আজ হাঁটতে পারছেন না। যদিও কোহিনূর পাবলিক লাইব্রেরি থেকে তিনি হেঁটেই বাড়ি ফেরেন। কিন্তু আজ তাঁর পায়ে বড় অস্বস্তি, এমনকি খানিকটা কুটকুটে অ্যালার্জি সমস্ত পায়ে জড়ো হয়েছে আর তাতে হাত নিশপিশ করে উঠলে হাতে ধরা বইটি পড়ে যায়, উবু হয়ে তা তোলার ফাঁকে ভাবেন খানিকটা পায়ে নোখের অাঁচড় বসিয়ে নেবেন কিন্তু পারলেন না। সহসা মনের কাঁটায় খচখচ করা স্যান্ডেলটা আবার চোখের তারায় উঠে এলো আর তাতেই তিনি হাত গুটিয়ে বইটি তুলে নিতে নিতে পা খানিকটা বেরও করে আনেন। ফলে পায়ের গোড়ালির অংশটা স্যান্ডেলের বাইরে এলেও বাকি অংশের মাথায়
স্যান্ডেলটা জুড়েই থাকল। রিকশায় তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে এক পাটি স্যান্ডেল পড়েও গেল। তাতে আবদুর সাত্তারের একপা নিচে পুনরায় ঝুলিয়ে তা তুলে নিতে হলো, ফলে ছুতমার্গের বালাই ছেড়ে পায়ে তা আরো একটু গাঢ়ভাবে মাখামাখিও হয়ে গেল। স্যান্ডেলটার ওপরের চামড়ার চলটা ওঠা আর তলা ক্ষয়ে গোড়ালির জায়গায় খানিকটা নাই হয়ে গ্যাছে। আবদুর সাত্তারের সমস্যা স্যান্ডেলের এই বিধ্বস্ত অবস্থার জন্য না, তাঁর সমস্যা স্যান্ডেলটা তাঁর নিজের না, এটা চোরের স্যান্ডেল। আর তাই ক্রমাগত তার মগজে চোরের স্যান্ডেল… চোরের স্যান্ডেল কথাটা ভন ভন করতে লাগল। জীবনে তিনি এমন কুয়োয় যেন আগে আর পড়েননি। একে বলে কুয়োর জলে হাবুডুবু খাওয়া। জলজ্যান্ত নিজের নতুন দামি স্যান্ডেলটা খুইয়ে চোরের স্যান্ডেল পায়ে বাড়ি ফেরা! নানা রকম অস্বস্তিতে রিকশার পা-দানিতে স্যান্ডেলটা খুলে রাখলেন, তারপর পা দুটোকে রিকশার সামনের রডের সঙ্গে ঝুলিয়ে দিলেন। আপাতত যেন চোরের ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে রক্ষা।
আবদুর সাত্তারের বাড়ির দূরত্ব হাঁটাপথে মিনিট পনেরো। মফস্বল শহরে এই পথ পাড়ি দিতে রিকশায় চড়ার অভ্যাস খুব কম মানুষের আছে, তারপর সে যদি হয় আড্ডাবাজ তা হলে তো কথাই নেই। ভাঙা আড্ডাটাকেও পায়ে পায়ে বাড়ির মোড় পর্যন্তনিয়ে যাওয়া তাদের কাজ। লাইব্রেরি থেকে বেরুলে সাত্তার সাহেবের বাড়ির পথে দুটো মোড় পড়ে, একটা বেলতলা আর তালতলা। তালতলা মোড়েই তার বাড়ি। প্রায় দিনই বেলতলা পর্যন্ত তিনি আরো দু-চারজনের সঙ্গে আড্ডায় মশগুল থাকেন। তাঁরা সবাই এই শহরের কবি-888sport live footballিক। আবদুর সাত্তারেরও এক সময় কবি হওয়ার শখ ছিল, শখ না বলে স্বপ্নও বলা যায়। তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একটা এলোমেলো অগোছালো জীবনের, যেখানে কেবল 888sport app download apkর পঙ্ক্তিগুলো বেরিয়ে আসবে পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বলতা পূর্ণ। গোপনে গোপনে ছাত্র বয়সে লিখে লিখে একটা খাতাকে 888sport app download apkর খাতাও বানিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু তা কাউকে দেখাবার আগেই কলেজ ম্যাগাজিনে কানিজ ফাতেমার লেখা 888sport app download apk ‘ছেড়ে গেল প্রেম’ পড়ে তিনি মুষড়ে পড়েন। আর সে-প্রেম উদ্ধারে নেমে আবদুর সাত্তার সফল হলেন, ব্যর্থ হলো তাঁর কবিসত্তা। এবং ক্রমাগত নিজের গোছানো জীবনকে সমৃদ্ধ করতে গিয়ে 888sport app download apk লেখা তাঁর আর হয়ে ওঠে না। কিন্তু কবিদের সান্নিধ্যে থাকতে পছন্দ করেন। সেইসঙ্গে পড়ুয়া পাঠক তিনি হতে পেরেছেন। আর তাতেই যেন আজকের এই বিপত্তি। কোহিনূর পাবলিক লাইব্রেরিতে তিনি দীর্ঘ দশ বছর ধরে যাচ্ছেন। এমন ঘটনা এই প্রথম। ছুটির দিন ভেবে দুপুরের পরপরই লাইব্রেরিতে ঢুকে মাহবুব লীলেনের উকুনবাছা দিনের গল্পে মজে যান। পড়তে পড়তে বেশ দেরি করে ফেলেন। লাইব্রেরিয়ান জামান আহম্মেদের ডাকে তিনি বই থেকে উঠে পড়েন।
জামান সাহেব নিজেই আজ তালা হতে দাঁড়িয়ে। জানালেন সহকারী লাইব্রেরিয়ান বাকীবিল্লাহ সাহেব ঘণ্টাখানেক আগে ছুটি নিয়ে বেরিয়ে গেছেন। তিনি আজ বউ-বাচ্চা নিয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাচ্ছেন দিনদশেকের জন্য। এমন খুচরো কিছু কথাবার্তা বলতে বলতে তারা দরজার বাইরে এসে দাঁড়ান আর তখনই সাত্তার সাহেব দেখেন তাঁর স্যান্ডেলটা নেই। সেখানে জামান সাহেব বাদে আরো তিনজন ছিলেন, সবার মুখে সমবেদনা আর দেশের যে কী অবস্থা হইছে – এসব যথার্থভাবে উচ্চারিত হতে থাকে। তা থেকে জানা যায়, নতুন কিছু ছিঁচকে চোর আর মাদকসেবীদের আড্ডা নাকি কাছেই, ওই চৌরঙ্গীর মোড়ে। এসব কথাবার্তার ভেতর দিয়ে যখন সবাই যার যার স্যান্ডেল জোড়া পায়ে গলিয়ে নিল, তখন বাকি রইল শুধু এই অর্ধক্ষয়িত স্যান্ডেলখানা। গত মাসেই বেশ দাম দিয়ে সাত্তার সাহেব স্যান্ডেলটা কিনেছিলেন। আজ এক উকুনবাছা দিন পড়ার ফাঁকে তা হাওয়া হয়ে গেল! অবশিষ্ট স্যান্ডেলের দিকে যখন আবদুর সাত্তার করুণ-চোখে তাকিয়ে ছিলেন, তখন জামান সাহেবেরও সেদিকে চোখ যায়। সহসা জামান সাহেবের মনে হতে থাকে এই বিধ্বস্ত স্যান্ডেলখানা তিনি আগেও দেখেছেন, এটা কি বাকীবিল্লাহর পায়ে দেখেছিলেন? মনের মধ্যে এসব সন্দেহ জেগে উঠলেও তিনি সুনিশ্চিত হতে পারেন না। আর তাই সে-কথা মুখে আনলেন না, বরং সাত্তার সাহেবকে বললেন – হয়তো ভুলে কারো সঙ্গে পাল্টেও যেতে পারে, আপনি এটা পরেই যান। হয়তো কাল কেউ ফেরত দিতে আসবে।
যদিও এ-কথায় আবদুর সাত্তারের সদ্যবিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা মন-মেজাজ ভালো হয় না। তবু তিনি কোনো বাক্য ব্যয় না করে স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে নেন। তবে সবার সঙ্গে সাবলীল ভঙ্গিতে হাঁটতে পারলেন না। এই অস্বস্তিকর অবস্থাটা থেকে রেহাই পেতেই যেন সকলে আজ একটু তাড়াতাড়িই বিদায় নিয়ে নিল। তখন একাকী সড়কে দাঁড়িয়ে আবদুর সাত্তারের খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়, কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিলেন না চিৎকার করে তিনি কী বলবেন, চিৎকার করে কান্নার বিষয় বা বয়স কোনোটাই এখন নেই। তখন তিনি বেশ উঁচু গলায় একটা রিকশা ডেকে বসেন।
বাসার সামনে রিকশা থেকে নামতে গিয়ে একবার ভাবেন স্যান্ডেলটা রিকশার পাটাতনেই রেখে নেমে যাবেন। কিন্তু রিকশাওয়ালাই বা কী ভাববে, নির্ঘাত পাগল! এসব ভেবে কোনো রকমে স্যান্ডেলটা পায়ে গলিয়ে দরজায় এসে দাঁড়ান। কানিজ ফাতেমা রিকশার শব্দ শুনে জানালায় দাঁড়িয়ে দেখছিলেন, এই সময় কে এ
লো? রিকশা থেকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে আবদুর সাত্তারকে নামতে দেখে তাঁর গা জ্বলে। তিনি জানালায় দাঁড়িয়েই গলা উঁচু করে ডাকেন
ঝর্ণা দরজা খোল তোর ভাইজান আইছে।
আবদুর সাত্তার সিঁড়িতে স্যান্ডেলটা খুলে ঘরে ঢুকতেই, ঝর্ণা রিনরিনে গলাই বলে ওঠে – ‘ইডা কার স্যান্ডেল, ভাইজান?’
সাত্তার সাহেবের সে-কথার উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না। তিনি ভেতরের ঘরে ঢুকে যান। মনের মধ্যে জড়ো হওয়া প্রচন্ড বিষাদ তাঁর চেহারায় যে-ছাপ ফেলে তা কানিজ ফাতেমা দেখেন না। তাঁর কেবল বাজে ভাবে লাফিয়ে নামাটাই খেয়ালে থাকে এবং আবদুর সাত্তার যে হরহামেশা পাঞ্জাবি ছিঁড়ে ফেলেন তা এ-কারণেই – সে-ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকে না, বিষয়টা পুরনো হলেও কানিজ ফাতেমার মনটা সহসা তিতা হয়ে ওঠে। তাই তিনি কণ্ঠে রুক্ষতা ধারণ করে বলেন, এমন ঘোড়ার মতো লাফাইয়া যে একটার পর একটা জামা ছিঁড়ো, বয়স তো কম হইল না।
সাত্তার সাহেবের এই তিরস্কার আজ কতটা অসহনীয় লাগল তা তিনি কানিজকে বোঝাবেন ক্যামনে? আর সে-কথা বোঝানোর মতো অবস্থাও তাঁর নেই, পায়ে যেন ফুসকুড়ি পড়ে যাচ্ছে! শেষ পর্যন্ত একটা চোরের স্যান্ডেল তাঁকে পরতে হলো! যতক্ষণ পর্যন্ত সাবান-পানিতে পা না ধুচ্ছেন ততক্ষণ এর চেয়ে অশান্তির আর কিছুই হতে পারে না। তাই হাতের বইখানা ছুড়ে রেখে কোনো উত্তর না দিয়েই বাথরুমে ঢুকে যান সাত্তার সাহেব। আর তাতে কানিজ ফাতেমার রাগ আরো বেড়ে যায়, এমন ভাব দ্যাখাইয়া গেল! তিনি আরো একটু উচ্চস্বরে বলেন, কোন মহাভারতে যাইয়া এত ভাব হইল?
সাত্তার সাহেব কলকল করা পানির শব্দে তা আর শুনতে পেলেন না। আর এখন কানিজের কথা শুনে গলা বাড়িয়ে ঝগড়া করার ইচ্ছা নেই। একটা স্যান্ডেলের যন্ত্রণায় সারা সন্ধ্যাটাই মাটি হয়ে গেল, সে-খেদই তিনি মাথা থেকে তাড়াতে পাড়ছেন না। এর মধ্যে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করার মানে নেই, যদিও বয়স নিয়ে খোঁটা দেওয়ার অভ্যাস কানিজের দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তবু তিনি এসব বিষয় গায়ে না মেখে বেশ আয়েশ করে পা ধুতে থাকেন। আবদুর সাত্তারের পায়ের রং ফর্সা, শুধু পা নয় আপাদমস্তক তিনি ফর্সা, সেই ফর্সা পায়ের ওপর পানির স্রোত বয়ে গেলে তা আরো সাদা দেখায়, মরা মানুষের চামড়ার মতো। লোমহীন এমন সাদা চামড়া তাঁর পছন্দ নয়, কানিজের পছন্দ। হয়তো তিনি নিজে শ্যামলা বলেই। আজকাল গরমের দুপুরে ঘেমে খালি গায়ে শুয়ে থাকলে কানিজ কেমন আলতো ভঙ্গিতে সারাশরীর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দ্যাখেন আর বলেন, ঘাইমা কেমন মাখনের মতো নরম হইয়া গেছ! নানা ভাবনায় যখন সন্ধ্যার ঘটনাকে বাথরুমের পানির স্রোতে ভাসিয়ে দিয়ে আবদুর সাত্তার বেরিয়ে আসেন ঠিক তখনই ঝর্ণা এসে বলে – ভাইজান, স্যান্ডেলটা কার?
এতক্ষণে সরিয়ে রাখা সব রাগ তিনি ঝর্ণার ওপর বর্ষণ করেন – তা দিয়ে তোর দরকার কী? তোর গোছানোর কাজ গুছাইয়া রাখ।
আবদুর সাত্তার আর কানিজ ফাতেমার সংসারে ঝর্ণার আগমন বছরদেড়েক। গৃহকাজের সহযোগী হিসেবে আগমন ঘটলেও নিঃসন্তান এই দম্পতির কাছে ক্রমেই ঝর্ণা যেন কোনো এক শূন্যস্থান পূরণের দিকে চলেছে। এ-বছর ওকে ইমামউদ্দিন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হলো। এসবই কেবল সন্তানহীনতার কারণেই ঘটছে, তা না। বরং ঝর্ণার আপত্ত সারল্য এবং অতি চঞ্চলতা ক্রমেই তাঁদেরকে মুগ্ধ করে। একদম অধিকারবিহীন ঝর্ণার কথার মধ্যে আহ্লাদ আর দাবির সুর প্রকট, তাতে প্রথম প্রথম এই দম্পতির বিরক্তবোধ হলেও কিছুদিন বাদে তাঁরা তা বেশ উপভোগ করতে শুরু করেন। ঝর্ণা তাই দ্বিধাহীনভাবে অনেক প্রশ্ন করতে পারে, কথার পিঠে কথাও বলে ফেলে। আর তা বলতে তার সময়জ্ঞান খুব যে থাকে, তা নয়। তাই সে আবারো বলে, স্যান্ডেলটা তো আপনের না।
কানিজ ফাতেমা বুঝতে পারেন আবদুর সাত্তারের এই রিকশায় চেপে বাড়ি ফেরার পেছনে তাহলে কোনো ঘটনা লুকিয়ে আছে। নিজের অনুমানের ওপর ফাতেমার ভীষণ রকমের ভরসা আছে, তিনি বলেন, নতুন স্যান্ডেলটা হারাইছো?
কানিজের এমন রূঢ় প্রশ্নে আবদুর সাত্তারের মনে হয় স্ত্রীরা মুহূর্তে স্বামীদের কেমন শিশুজ্ঞান করে কথা বলতে পারে! এমন শাসনের সুর তো ভালোবাসাহীন আর তা খুবই অসহনীয়, তা বোঝে না কেন? কিন্তু সবাইকে পিছে ফেলে ঝর্ণা এবার বেশ উৎফুল্ল ভাষায় বলে – হেইলিগাই তো কই, ওমুন পুরেনো ছেঁড়া জুতা কার? ভাইজান, ওইডা চোরের জুতা?
আবদুর সাত্তার যদিও সারাটা পথ এইটা চোরের স্যান্ডেল ভেবেই গজগজ করছিলেন; কিন্তু ঝর্ণার মুখে এমন করে চোরের জুতা কথাটা তিনি হজম করতে পারছেন না। অতি রাগে চট করে তাঁর মুখে মোক্ষম কথাটাও জুটছিল না। তাঁর সেই অগ্নিময় অবস্থায় দক্ষ পুরোহিতের মতো একটু একটু করে ঘি ঢালা শুরু করেন কানিজ ফাতেমা। আবদুর সাত্তার যে বোকার হদ্দ আর সারাজীবনই বোকাই রয়ে গেল! তাই আজ তাঁর স্যান্ডেলই চুরি হলো, না হলে আর যারা ছিল তাদের স্যান্ডেল কেন চুরি হলো না? ফাতেমার মতে, ডাইলখোররাও বোঝে কারডা চুরি করা সহজ, আড্ডায় বসলে তো দুনিয়া ঠিক থাকে না। তিনি আরো জানান, ভালোই হইছে, নতুন স্যান্ডেলে দাম ভালো পাইব, ডাইলের বোতল বেশি কিনতে পারব। আজ নেশাখোরদের নেশা যে জমে উঠবে তাও জানালেন কানিজ।
আবদুর সাত্তার চাইলে কানিজ ফাতেমার বিষয়গুলোর যুক্তি খন্ডন করতে পারতেন। তিনি যে মোটেও আড্ডা দেননি, আজ যে তার সতীর্থ আড্ডাবাজরাও আসেনি এবং তিনি যে-বই পড়ছিলেন – এসবই বলতে পারতেন। তাছাড়া তাঁর স্যান্ডেলের চেয়ে নতুন কোনো স্যান্ডেল ওইখানে ছিল না। আর এসব বললে ফাতেমা যে একটা কথাও মাটিতে ফেলবে না, তাও তিনি জানেন। ফাতেমা বলবে, এমুন নতুন স্যান্ডেল পইরা লাইব্রেরিতে যাওয়ার দরকার কী, ওইটা তো বেড়ানোর জায়গা না। বই পড়ার সময় স্যান্ডেল হাতে কইরা নিয়া টেবিলের নিচে রাখলেই পারতা, চোরের ভয়ে মানুষ তো আজকাল মসজিদেও স্যান্ডেল নিয়া সিজদার সামনে রাখে। লাইব্রেরিতে যাওয়া যে কেন কানিজ ফাতেমার পছন্দ নয় তাও তিনি বোঝেন না। যে-ফাতেমা একদিন ‘ছেড়ে গেল প্রেম’ নামে হৃদয় নাড়া দেওয়া 888sport app download apk লিখেছিল! এসব ভাবনায় আবদুর সাত্তারের মনোজগতের বিষ যেন ক্রমেই গলে যেতে থাকে, তাঁর কেন জানি মনে হতে থাকে স্যান্ডেলটা চুরি যায় নাই, কোনো কবি ভুল করে পায়ে দিয়ে চলে গেছে। আর এই ভাবনা মনে হতেই তিনি আশ্চর্য রকম একটা শান্তির অনুভব করেন। তাই এত ঘি ঢালার পরও আবদুর সাত্তার জ্বলে উঠলেন না, যেন কানিজ ফাতেমা ঘি নয় এতক্ষণ চামচে করে পানি ঢেলেছেন, না হলে এমন ভিজে গলায় আবদুর সাত্তার বললেন কী করে! তিনি বলেন, আসলে ফাতু স্যান্ডেলটা চুরি যায় নাই, কোনো এক ভুলোমনা কবি ভুল কইরা পইরে গ্যাছে। ঘোরের মধ্যে ছিল তো, দেইখো সে নিজেই আবার নিয়ে আসবেনে।
কানিজের মনে হয় আরো কোনো ঘটনা তাইলে আছে, নাইলে সাত্তার রাগ না হয়ে এমন ভিজা বেড়ালের মতো কথা বলত না, এসব ভাবনায় সাত্তার সাহেবের নরম-সরম কথায় আরো জ্বলে ওঠে কানিজ বলেন, কবি না ছাই, এমুন আবাইলা কথা আর কইও না। রাগে আমার গা জ্বলে।
ঝর্ণা বুঝতে পারে এখন আর এখানে দাঁড়িয়ে কথা শোনার মানে নাই। আপাতত পচা স্যান্ডেলটারে উঠায় রাখা ছাড়া কিছু তার মাথায় খেলছে না। তবু সে যাওয়ার আগে বলে, ভাইজান – স্যান্ডেলটা তাইলে ব্যাগে ভইরা রাখমু? না কি আপনের র্যাকে রাহুম?
র্যাকে রাখার কথা শুনে সাত্তার সাহেব কেমন যেন অাঁতকে ওঠেন। তিনি তাড়াতাড়ি বলেন – না না, র্যাকে না, বরং ব্যাগে ব্যাগে শপিং ব্যাগে রাখ।
কানিজ ফাতেমা সে-কথায়ও ফোড়ন কাটে, – না ব্যাগে ক্যা, বাক্সে ভইরা উঠায়া রাখো।
ঝর্ণা এবার খিলখিল করে হেসে ফেলে – ভাবিসাব যে কি-ই কন, এ্যাইয়া দিয়া তো ফেরিওয়ালাও কটকটি দিবার চাইব না।
ঝর্ণা মুখে যা-ই বলুক মনে মনে ভেবে রাখে কাইলই ফেরিওয়ালা ডেকে একটু কটকটি খেয়ে নেবে। আর সে-ভাবনায় সে স্যান্ডেলটাকে নিজের চৌকির নিচে নিয়ে রাখবে বলে ঠিক করে।
এসব তিরস্কারমূলক কথায় আবদুর সাত্তার মর্মে মর্মে আহত হতে থাকেন, কিন্তু গতানুগতিকভাবে ঝগড়ায় লিপ্ত হন না। কেন জানি তিনি কোনো কথা না বলে ব্যালকনির দিকে চলে যান। সেখান থেকে কানিজ ফাতেমার নানা গজগজানির আওয়াজ পাওয়া গেলেও তা কানের পাশ দিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যেতে দেন। তিনি সামনের ঝোপে অজস্র জোনাক পোকা দ্যাখেন। তারা ঝুমুর-নৃত্য করছে। যেন সব আদিবাসী জোনাক, গোল হয়ে একই তালে নাচে! কিন্তু এত নাচেও সাত্তার সাহেবের মনের বিষাদ কাটে না, কেবল চোখে ধাঁধা লাগে।
বাসায় একটা থমথমে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, দুজন সমভাবে ঝগড়া করলে সহজে বরফ গলে যেত। আজ আর তা গলছে না। কানিজও শক্ত হয়ে শুয়ে আছে, কানিজ ফাতেমা কিছুতেই ভুলতে পারছেন না স্যান্ডেলটা 888sport cricket BPL rate শত টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল! এ নিয়ে লোকটার কোনো মাথাব্যথা নেই! সাত্তার সাহেব ভাবছেন, সামান্য বিষয় নিয়ে এমন চৌদ্দগোষ্ঠীর কথা টেনে আনার স্বভাব কানিজ ছাড়তে পারছে না কেন? জীবনে কত কিছুই তো থাকে না, তা নিয়ে বসে থাকলে চলে! তাদের পারস্পরিক ভাবনার আকাশ-পাতাল তফাৎ ঘটতে থাকলে বিছানায় চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া আবদুর সাত্তারের কোনো গতি থাকে না।
রাতে আবদুর সাত্তার স্বপ্নে বিভোর হলেন। দেখেন তাঁর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে, তার পায়ে দিব্যি শোভা পাচ্ছে আবদুর সাত্তারের স্যান্ডেল! তিনি হতবিহবল চোখে তাকিয়ে আছেন, ছেলেটার মাথা নিচু। কণ্ঠে আবৃত্তির স্বর, বলে – আমি জনাব আবদুর সাত্তারকে খুঁজচ্ছি।
সাত্তার সাহেব কি ছেলেটার কথা শুনতে পাচ্ছেন? মনে হয় না। তিনি সেই একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ছেলেটার পায়ের দিকে? না-কি তিনি আসলে অনেক দূরের কিছু ভাবছেন? ছেলেটা আবার বলে – কোহিনূর পাবলিক লাইব্রেরি থেকে ঠিকানাটা নিয়ে এলাম। এই বাসার ঠিকানা…
এতক্ষণে আবদুর সাত্তার স্বপ্নে ফেরেন – কাকে চাই?
ছেলেটার মাঝে তালতলা মাঠের সমস্ত কৃষ্ণচূড়ার লজ্জা জড়ো হয়েছে, তাতে তার কণ্ঠ লজ্জায় নুয়ে পড়ে, সে বলে – জি সাত্তার সাহেবকে চাইছিলাম। আমি ভুল করে তাঁর স্যান্ডেলটা পায়ে দিয়ে চলে যাই।
আবদুর সাত্তার আবার ছেলেটার পায়ের দিকে তাকালেন। হ্যাঁ, তারই স্যান্ডেল। তিনি বলেন, দাঁড়ান আপনার স্যান্ডেলটা নিয়ে আসি।
ছেলেটা এবার গ্রীবা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলল – আনতে হবে না। সে পা থেকে স্যান্ডেলটা খুলে আবদুর সাত্তারের পায়ের সামনে এমন ভঙ্গিতে রাখল যেন সে পুরনো ভৃত্য, ক্ষমা করুন জাঁহাপনা বলতেই এসেছিল। কিন্তু ছেলেটা কোনো কথা না বলে খালি পায়ে হেঁটে যেতে থাকলে সাত্তার সাহেব পেছন থেকে আবারো বলেন – আপনার স্যান্ডেলটা…
ছেলেটা পেছনে না ফিরেই আকাশের মতো উদার কণ্ঠে বলে – ঠিক করেছি আজ থেকে আর স্যান্ডেল পরব না, বড় ভুলোমন। এতটা খেয়াল রাখতে গেলে 888sport app download apk হারিয়ে ফেলি। 888sport app download apk ছাড়া আমার চলবে না।
বাকি রাতটা আবদুর সাত্তারের আর ঘুম হলো না। জেগে জেগে তিনি নিজের হারিয়ে যাওয়া 888sport app download apkগুলো খুঁজতে লাগলেন।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.