দীপা বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ-প্রকাশিত সংগীতচিন্তা (প্রথম প্রকাশ বৈশাখ ১৩৭৩) গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথের সংগীত-ভাবনার ধারাবাহিক এবং পরিপূর্ণ চিন্তার পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া যায়। জীবন888sport sign up bonus, ছিন্নপত্র থেকে শুরু করে পত্র888sport live football, 888sport slot game888sport live football, 888sport app 888sport liveে প্রকাশিত কবির সংগীত-ভাবনার সন্ধান পাওয়া যায় এই বইয়ে। সংগীতের প্রসঙ্গ, সংগীত-বিষয়ে ভাবনা তাঁর বিভিন্ন রচনায় কতভাবে এসেছে তার পরিচয় দেওয়া সহজ নয়। সংগীত-বিষয়ক নয়, এমন লেখায়ও সংগীতের প্রসঙ্গ নানাভাবে এসে গেছে। বিপুল সেই সংগীতালোচনার সম্পূর্ণ পরিচয় দেওয়া কঠিন। সংগীতচিন্তা গ্রন্থে সংকলিত ছিন্নপত্রাবলীর কয়েকটি চিঠিতে সংগীত-বিষয়ে কবি যা বলেছেন সেই ভাবনাকে অবলম্বন করে নিবন্ধটি রচনার ক্ষুদ্র প্রয়াস।
রবীন্দ্রনাথের সেরা সৃষ্টি তাঁর গান। শুধু গানের একক স্পর্ধায় ছাপিয়ে গেছেন 888sport app সৃষ্টিকে। যে-ধ্রুবপদ বিশ্ববিধাতা বেঁধে দিয়েছিলেন, নিজের সৃষ্টির সঙ্গে তাকে মিলিয়ে নেওয়ার খেলা চলেছে সারাজীবন ধরে। সংগীত সৃষ্টিতে যে-আনন্দ তিনি পেতেন তেমন আর কিছুতে নয়। পশ্চিম যাত্রীর ডায়ারির ‘যাত্রী’ অংশে প্রৌঢ় বয়সে তাঁর এই গীতসর্বস্বতার স্বীকারোক্তির কথা তিনি বলেছেন। কবি লিখেছেন, ‘… গান লিখতে যেমন আমার নিবিড় আনন্দ হয় এমন আর কিছুতে হয় না। এমন নেশায় ধরে যে, তখন গুরুতর কাজের গুরুত্ব একেবারে চলে যায়, বড় বড় দায়িত্বের ভারাকর্ষণটা হঠাৎ লোপ পায়, কর্তব্যের দাবিগুলোকে মন একধার থেকে নামঞ্জুর করে দেয়।’ সৃষ্টিশীলতার বাঁকে বাঁকে গানের ভেতর দিয়ে ভুবনকে দেখার যে আনন্দ, ঈশ্বর, মানুষ, প্রকৃতি তাঁর গানে যে নিবিড় সৌন্দর্যের ছবি ফুটিয়ে তুলেছে তাঁর গানের ভেতর দিয়েই তাকে আমরা দেখি। তিনি গানের ভেতর দিয়ে আমাদের চিনিয়েছেন জীবন ও জগতের রূপরহস্য। তাঁর গানের জাদুস্পর্শ মুহূর্তকে ভরিয়ে দিতে পারে অনির্বচনীয়তায়। রবীন্দ্রসংগীত শব্দটির মধ্যে অভাবিত এক বিস্ময় লুকিয়ে আছে। বিস্ময় এই ভেবে, এ-গান এমনই এক সৃষ্টি, যা হৃদয় দিয়ে গ্রহণ করতে পারলে অপার্থিব আনন্দে প্রাণ-মন ভরে ওঠে।
রবীন্দ্রনাথের গানই তাঁকে চেনার সব থেকে সহজ উপায়। তাঁর গান তাঁর সংগীত-ভাবনাকে আমাদের কাছে মূর্ত করে তোলে। নিজ হাতে সাজিয়ে দেওয়া গীতবিতানের প্রথম গানগুলো, যেগুলো তাঁর গানের গান, তাঁর প্রথম গানটিতে তিনি এই পৃথিবীতে চিরজীবন গানের ডালা বয়ে যাবার ইচ্ছার কথা বলেছেন।
কান্নাহাসির-দোল-দোলানো পৌষ-ফাগুনের
পালা,
তারি মধ্যে চিরজীবন বইব গানের ডালা –
এই কি তোমার খুশি, আমায় তাই পরালে মালা
সুরের-গন্ধ-ঢালা।
ভালোলাগা, ভালোবাসায় সংগীতকে সারাজীবন সঙ্গী করেছেন। বলেছেন ‘লাগল ভালো, মন ভোলালো এই কথাটাই গেয়ে বেড়াই।’
কবি বিশ্বাস করতেন, বিশ্বসৃষ্টির সঙ্গে সংগীতের গভীর সম্পর্ক আছে। এই বিশ্ব তাঁর কাছে এক মহাসংগীত বলে মনে হয়েছে। শান্তিনিকেতন গ্রন্থমালার ‘শোনা’ নামক 888sport liveে (৫ পৌষ, ১৩১৫) কবি লিখেছেন – ‘এই প্রকান্ড বিপুল বিশ্বগানের বন্যা যখন সমস্ত আকাশ ছাপিয়ে আমাদের চিত্তের অভিমুখে ছুটে আসে, তখন তাকে এক পথ দিয়ে গ্রহণ করতেই পারিনে, নানা দ্বার খুলে দিতে হয়, চোখ দিয়ে, স্পর্শেন্দ্রিয় দিয়ে, নানা দিক দিয়ে তাকে নানা রকম করে নিই। এই একতান মহাসংগীতকে আমরা দেখি শুনি ছুঁই শুঁকি আস্বাদন করি।’ গদ্যে যে-কথা বলেছেন, গানেও সে-কথাই বলেছেন :
বিশ্ববীণারবে বিশ্বজন মোহিছে।
স্থলে জলে নভোতলে বনে উপবনে
নদী’নদে গিরিগুহা-পারাবারে
নিত্য জাগে সরস সংগীতমধুরিমা,
নিত্য নৃত্যরসভঙ্গিমা। –
সংগীতের প্রাণ – শব্দ, সুর ও বাণী। প্রকৃতিতে প্রতিনিয়ত কত রকমের শব্দ, বাতাসে আন্দোলিত গাছের শব্দ, নদীর বয়ে চলার শব্দ, মেঘের গর্জন, পাখির ডাক, – এসবের মিলিত শব্দ সংগীত হয়ে উঠেছে কবির কাছে। অনন্ত এ-শব্দস্রোত কবির কাছে শুধু সত্য নয়, প্রকৃতিতে নিরন্তর বয়ে চলা এই শব্দস্রোতের বন্যায় বিপুল এই বিশ্বসংগীতের রূপক হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে তাঁর কাছে। এই আকাশ, সমুদ্র, পৃথিবী অসীম, নদীর বয়ে চলা যেমন অবিচ্ছিন্ন, মানুষের স্রোতটাকে তেমনি অসীম আর অবিচ্ছিন্ন বলে মনে হয়েছে কবির। ভালোলাগা, ভালোবাসায় মিশেছে কল্পনা, শুরু হয়েছে কাব্য, সংগীতের নূতন নূতন উৎসধারা।
সংগীতচিন্তা গ্রন্থে বিশ্বসৃষ্টির সঙ্গে সংগীতের সম্পর্ক, নিজের সংগীতসৃষ্টির প্রেরণা, রাগ-রাগিণীর অন্তর্নিহিত আবেদন, সংগীতে রাগ-রাগিণীর ব্যবহার, সংগীতের মূলতত্ত্ব বিষয়ে বিভিন্ন লেখায় তাঁর গভীর উপলব্ধির কথা দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে ব্যক্ত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথের কবিজীবন এবং সংগীতজীবনের শুরু প্রায় একই সময়ে হওয়ায় তাঁর সংগীত-ভাবনাও বলা যায় একই সঙ্গে সমান্তরাল চলেছে। জন্মেছিলেন ধ্রুপদী সংগীত-চর্চামুখর পরিবারে। শেখার আগেই শ্রবণ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ নিজে ধ্রুপদ গাইতেন। সন্তানদেরও মার্গ সংগীতশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় এবং ধ্রুপদী সংগীতের শিক্ষকদের কাছে কবির সংগীতের শিক্ষানবিশি পর্ব শুরু হয়েছিল। কবি অবশ্য পরে বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, শাস্ত্রীয় সংগীতের শিক্ষা তাঁর ব্যর্থ হয়েছে। তেরো বছর বয়সে প্রথম গান রচনা, প্রথমবার বিলাত থেকে ফেরার পর বাল্মীকি প্রতিভা গীতিনাট্য রচনা, এছাড়া ব্রহ্মসংগীত ও 888sport app নানা ধরনের সংগীত রচনা তাঁর সৃষ্টি-প্রতিভাকে সক্রিয় রেখেছিল কৈশোর থেকেই। সংগীত-বিষয়ে প্রথম 888sport live ‘সংগীত ও ভাব’ যখন রচনা করেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি বছর। ১৮৮১ সালে দ্বিতীয়বার বিলাত যাত্রার আগে তিনি 888sport liveটি রচনা করেন এবং বেথুন সোসাইটির এক সভায় পাঠ করেন। এই 888sport liveে তিনি উদাহরণসহ বোঝাতে চেয়েছিলেন গানের কথাকে গানের সুরের দ্বারা পরিস্ফুট করে তোলা সংগীতের মুখ্য উদ্দেশ্য। কবি আরো বলেছিলেন, ভাব প্রকাশ করাই সংগীতের প্রধান উদ্দেশ্য, রাগ-রাগিণীর ওস্তাদি কিংবা ক্রিয়াকলাপ দেখানো নয়। এ-কথা বলার পেছনে হয়তো তাঁর ব্যক্তিগত এবং সংগীতের সমসাময়িক প্রচলিত ধারাটির কথাই মনে ছিল। ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিতে আমরা দেখব ভাবপ্রকাশের জন্য তিনি বাণীবিরল রাগ-রাগিণীর সুরের ছায়ায় ফিরে গেছেন।
বাল্মীকি প্রতিভা গীতিনাট্যের রচনাকাল ১২৮৭ বঙ্গাব্দ আর ‘সংগীত ও ভাব’ 888sport liveটি রচনা করেন জ্যৈষ্ঠ ১২৮৮ বঙ্গাব্দে। সংগীত-বিষয়ে কবির গভীর অনুসন্ধিৎসা অল্পবয়স থেকেই তাঁকে ভাবিয়েছে, প্রশ্নবিদ্ধ করেছে সংগীতের মুক্তির পথ সন্ধানে। ‘সংগীত ও ভাব’ 888sport liveে কবি বলেছিলেন, ‘সংগীত সবে জাগিয়া উঠিয়াছে মাত্র, কাজ ভালো করিয়া আরম্ভ হয় নাই’ – বাল্মীকি প্রতিভা রচনার মধ্য দিয়ে কবি নিজেই সংগীতে সেই জাগরণের সূচনা করলেন। যাত্রা, পাঁচালি, হাফ আখড়াই-অধ্যুষিত উনিশ শতকের বাংলায়, ‘আপন হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে’ সবার অলক্ষে নিজেকে যে তিনি বাংলা সংগীতের মুক্তির দিশারি হিসেবে তৈরি করছিলেন বাল্মীকি প্রতিভা গীতিনাট্য রচনাই তার প্রমাণ। ঠাকুরবাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে অভিনীত হলেও সে-সময়ে এই গীতিনাট্য নতুন আঙ্গিক, সংগীত এবং অভিনয়-ভাবনার স্বাক্ষর রেখেছিল। বাল্মীকি চরিত্রে কবি নিজেই অভিনয় করতেন। বাল্মীকি চরিত্রের সূক্ষ্ম অন্তর্বিপ্লব, তার অন্তরের করুণা আর আলোড়ন অভিনয়ের মধ্য দিয়ে কবি জীবন্ত করে তুলতেন। বাল্মীকি চরিত্র সৃষ্টিতে তরুণ রবীন্দ্রনাথের ছায়াই প্রতিফলিত হয়েছে, কারণ বাল্মীকির কথা রবীন্দ্রনাথের নিজের কথাই। ‘ব্যাকুল হয়ে বনে বনে/ ভ্রমি একেলা শূন্যমনে/ কে পুরাবে মোর কাতর প্রাণ/ জুড়াবে হিয়া সুধা বরিষণে \’ – কবির প্রার্থনা আর বাল্মীকির কথা এক হয়ে গেছে। পার্থিব সাফল্য নয়, অলৌকিক আনন্দই পারে প্রাপ্তির আনন্দে মন ভরিয়ে দিতে। সংগীতে সাবেকিআনা ভাঙার যে প্রবল ইচ্ছা, তাঁর সেই ইচ্ছার প্রতিফলন এই গীতিনাট্য। গায়করা যে শুধু কতকগুলি চেতনাহীন জড়সুরের ওপর সংগীতকে স্থাপন করেন তিনি তার বিরোধিতা করেছিলেন। কবি তাকে ‘জীবন্ত অমর ভাবে’র ওপর স্থাপন করতে চাইলেন।
অনেক পরে জীবন888sport sign up bonusতে যখন তরুণ বয়সে লেখা সংগীত বিষয়ক রচনাগুলোর উল্লেখ করেছেন, তখন তাঁর ভাবনা থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন তিনি। জীবন888sport sign up bonusতে কবি লিখেছেন, ‘… যে মতটিকে তখন এত স্পর্ধার সাথে ব্যক্ত করিয়াছিলাম সে মতটি যে সত্য নয়, সে কথা আজ স্বীকার করিব। গীতিকলার নিজেরই একটি বিশেষ প্রকৃতি ও বিশেষ কাজ আছে। গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিত হয় না, সেই সুযোগে গানকে ছাড়াইয়া যাওয়া। সেখানে সে গানেরই বাহন মাত্র। গান নিজের ঐশ্বর্যেই বড়। বাক্যের দাসত্ব সে কেন করিতে যাইবে! বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেইখানেই গানের আরম্ভ। যেখানে অনির্বচনীয় সেই খানেই গানের প্রভাব।’ ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিগুলোতে সংগীতের সেই অনির্বচনীয় সুষমার কথা কবি বলেছেন, যেখানে গান নিজের ঐশ্বর্যেই বড় হয়ে উঠেছে।
১২৮৭ বঙ্গাব্দ বাল্মীকি প্রতিভা গীতিনাট্যের রচনাকাল আর ইংরাজি ১৮৯০ – মাঝে কেটে গেছে অনেকটা সময়। এই সময়ের মধ্যে বিচ্ছুরিত হয়েছে কবির সৃষ্টি প্রতিভার বিচিত্র সম্ভার। 888sport live footballে, সংগীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাঁর অনন্যতা। তরুণ বয়সের সংগীতভাবনা থেকেও তিনি সরে গেছেন দূরে। বিশ্বের রহস্য তখন তাঁর কাছে অনিঃশেষ। অপার বিস্ময় আর মুগ্ধতায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করেছেন, বিস্ময়ে জেগে উঠেছে তাঁর গান। অবাক লাগে ভাবলে, কত তুচ্ছের মধ্যে তিনি আবিষ্কার করেছেন পরম মূল্য। গানের সুরে জীর্ণ তুচ্ছতাও অর্থের বন্ধনমুক্ত হয়ে মহৎ ভাবের স্বর্গলোকে উত্তীর্ণ করে দিয়েছে তাঁকে। জীবনের পরম সত্য গানের মধ্য দিয়ে বলেছেন,
গানের ভিতর দিয়ে যখন দেখি ভুবনখানি
তখন তারে চিনি আমি, তখন তারে জানি।
রবীন্দ্রনাথের গান তাঁর কবিজীবনের শূন্যস্থান পূরণের জন্য নয়, তাঁর গান অন্যসব রচনাকে ছাপিয়ে যাওয়া অমৃতসঞ্চারী এক সৃষ্টি, যা তাঁর আপন ‘হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে’ বাসা বেঁধেছিল তাঁর শৈশবেই। সব 888sport live chatের সৃষ্টিমুহূর্তের যন্ত্রণা যেমন আছে, তেমনি আছে আনন্দ। প্রসব-বেদনার মতো। 888sport live footballসৃষ্টির অন্তরালের আনন্দ কতভাবে, ভাষায়, ছন্দে কবি শুনিয়েছেন, সংগীতসৃষ্টি সম্পর্কেও একই রকম আনন্দঘন কৈফিয়ত দিয়েছেন। বলেছেন ‘অপ্রয়োজনের সৃষ্টিই আনন্দের সৃষ্টি।’ সব সৃষ্টির মূলে রয়েছে লীলাময় রূপের প্রকাশ। কবির মন সেই প্রকাশের অহেতুক আনন্দে যখন যোগ দিতে পারে, তখনই সৃষ্টির মূল আনন্দে মন পৌঁছে যায়। সংগীত রচনা সম্পর্কে কবির যে-আনন্দময় কৈফিয়ত তা হলো, ‘সৃষ্টির অন্তরতম এই অহেতুক লীলার রসটিকে যখন মন পেতে চায়, তখনই বাদশাহি বেকারের মতো সে গান লিখতে বসে। চারখানি পাপড়ি নিয়ে একখানি ছোট জুঁইফুলের একটুখানি গান যখন সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে তখন সেই মহাখেলা ঘরের মেজের উপরেই তার জন্য জায়গা করা হয়, সেখানে যুগ যুগ ধরে গ্রহনক্ষত্রের খেলা হচ্ছে। সেখানে যুগ আর মুহূর্ত একটি, সেখানে সূর্য আর সূর্যমণি ফুল অভেদাত্মা, সেখানে সাঁঝ সকালের মেঘে যে রাগরাগিণী আমার গানের সঙ্গে তার অন্তরের মিল আছে।’ তেষট্টি বছর বয়সের এই অভিব্যক্তি কবির সারাজীবনের সংগীত-ভাবনার মূল সুরটিকে আমাদের সামনে তুলে ধরে।
রবীন্দ্রনাথের সংগীত-বিষয়ক সব আলোচনাই হৃদয়কে নাড়া দেয়, জাগিয়ে দেয় বিস্ময়-বিমুগ্ধতায়, কারণ এসব আলোচনা তাঁর অনুশীলনে চর্চিত বিদ্যা থেকে আহরিত নয়। জীবন দিয়ে উপলব্ধিসঞ্জাত। মেধা, উপলব্ধি, অভিজ্ঞতার অসাধারণ প্রেরণার ফসল। সংগীতের প্রতি ভালোবাসার কথা কতজনকে কতভাবে বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন – তার সবটুকুর পরিচয় দেওয়া সহজ নয়। দিলীপ কুমার রায়ের সঙ্গে সংগীত-বিষয়ে আলোচনায় কবি বলেছিলেন, ‘আমি যখন গান বাঁধি তখনই সবচেয়ে আনন্দ পাই। মন বলে, 888sport live লিখি, বক্তৃতা দিই, কর্তব্য করি, এ সবই এর কাছে তুচ্ছ।’ আমি একবার লিখেছিলাম,
যবে কাজ করি
প্রভু দেয় মোরে মান।
যবে গান করি,
ভালোবাসে ভগবান।
এ কথা বলি কেন? – এই জন্যে যে, গান যে-আলো মনের মধ্যে বিছিয়ে যায় তার মধ্যে আছে এই দিব্যবোধ যে, যা পাবার নয়, তাকেই পেলাম, আপন করে, নতুন করে। এই বোধ যে, জীবনের হাজারো অবান্তর সংঘর্ষ, হানাহানি, তর্কাতর্কি এসব এর তুলনায় বাহ্য – এই হলো সারবস্ত্ত। কেননা, এই হলো আনন্দলোকের বস্ত্ত, যে-লোক জৈবলীলার আদিম উৎস। প্রকাশলীলায় গান কিনা সবচেয়ে সূক্ষ্ম – ethereal – তাই তো সে অপরের স্বীকৃতির স্থূলতার অপেক্ষা রাখে না। শুধু তাই নয়, নিজের হৃদয়ের বাণীকে সে রাঙিয়ে তোলে সুরে। যেমন ধরো, যখন ভালোবাসার গান গাই তখন পাই শুধু গানের আনন্দকেই না; ভালোবাসার উপলব্ধিকেও মেলে এমন এক নতুন নৈশ্চিত্যের মধ্য দিয়ে যে, মন বলে পেয়েছি তাকে যে অধরা, যে আলোকবাসী, যে ‘কাছের থেকে দেয় না ধরা – দূরের থেকে ডাকে।’ (সংগীতচিন্তা) গান হলো আনন্দলোকের বস্ত্ত, প্রকাশলীলায় সব থেকে সূক্ষ্ম, স্বর্গীয়, তাই সে কারো স্বীকৃতির স্থূলতার ধার ধারে না।
সংগীতচিন্তা গ্রন্থে ছিন্নপত্রাবলী থেকে ১৬টি চিঠি সংকলিত হয়েছে। চিঠিগুলো কবির সংগীত-ভাবনাকে ধারণ করে আছে। বারোটি চিঠি শিলাইদহ, পতিসর, শাহজাদপুর থেকে লেখা, চারটি লেখা হয়েছে কলকাতা থেকে। ছিন্নপত্র লেখার সময় এবং প্রেক্ষাপট জানা থাকলে কবির ওই সময়ের মানসিক, সামাজিক অবস্থার ছবিটিও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়। সংগীতে আগের অবস্থান থেকে তিনি কতটা দূরে সরে এসেছেন, চিঠিগুলো তাঁর সেই ভাবনাকেও আমাদের কাছে তুলে ধরে। তরুণ বয়সে যে-কথা বলেছিলেন, যে-বিশ্বাস তাঁর সংগীতচিন্তাকে সে সময় প্রভাবিত করেছিল, গানের কথাই কণ্ঠসংগীতের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, সেখান থেকেও সরে এসেছেন। ১৮৯৪ সালে ইন্দিরা দেবীকে লেখা ছিন্নপত্রাবলীর একটি চিঠিতে বাণীবিরল সুরমগ্নতায় আচ্ছন্নতার খবর জানিয়ে কবি লিখেছেন – ‘আমার সুরের সঙ্গে কত টুকরো টুকরো কথা যে আমি জুড়ি তার আর 888sport free bet নেই – এসব এক লাইনের গান সমস্ত দিন কত জমছে এবং কত বিসর্জন দিচ্ছি। রীতিমতো বসে সেগুলোকে পুরো গানে বাঁধতে ইচ্ছা করছে না। … আজ সমস্ত সকাল নিতান্ত সাদাসিধা ভৈরবী রাগিণীতে যে গোটা দুই-তিন ছত্র ক্রমাগত আবৃত্তি করছিলুম সেটুক মনে আছে এবং নমুনা স্বরূপে নিম্নে উদ্ধৃত করা যেতে পারে –
ওগো তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে।
(আমার নিত্যনব!)
এসো গন্ধ বরণ গানে।
আমি যে দিকে নিরখি তুমি এসো হে
আমার মুগ্ধ মুদিত নয়ানে।
(ছিন্নপত্রাবলী, কলকাতা, ২১ নভেম্বর ১৮৯৪)
ভৈরবীতে ‘ওগো তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে’র দুই-এক লাইন লিখেই কবি তখন খুশি। শুরু হয়েছিল ‘মায়ার খেলা’ থেকেই, যেখানে গানের রসেই সমস্ত মন ছিল অভিষিক্ত। ছিন্নপত্রাবলীর আশ্চর্য বর্ণনাময় রচনার মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারি কীভাবে তাঁর মন মগ্ন হচ্ছে সুরের জগতে।
রবীন্দ্রনাথ জীবন888sport sign up bonus লিখেছিলেন পরিণত বয়সে পৌঁছে (৫০), সেখানে জীবনের প্রথম পঁচিশ বছরের কথা বলে দাঁড়ি টেনে দিলেন। জীবন888sport sign up bonusতে যা বলেননি সেই না-বলা কথার সুরের ছোঁয়ায় ভরে উঠেছে ছিন্নপত্রের চিঠিগুলো। পঁচিশ থেকে চৌত্রিশ বছর বয়সের রবীন্দ্রনাথের জীবন এবং ভাবনার অন্তরঙ্গ ছবি ফুটে উঠেছে ছিন্নপত্রাবলীর চিঠির পাতায় পাতায়।
১৮৯০ থেকে ১৯০০ – এই দশ বছর ছিল কবির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দশ বছর। গুরুত্বপূর্ণ এ-কারণে যে, এই সময়ে তাঁর জীবনে ঘটে গেছে অনেক পরিবর্তন। রবীন্দ্র-জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের মূল্যবান গ্রন্থ থেকে জানতে পারি, ১৮৯০ থেকে ১৯১০ এই বিশ বছর রবীন্দ্রনাথের জীবনে সব থেকে ‘গুরুত্বপূর্ণ, সব থেকে সংকটময়, সব থেকে আত্ম-অভিজ্ঞান অন্বেষায় চঞ্চল বিশ বছর।’ এই সময়ে কবির উদ্বেগ, যন্ত্রণা, উৎকণ্ঠা, তাঁর সামাজিক, নৈতিক, রাষ্ট্রিক ও ব্যক্তিগত জীবন ও কর্মের স্বরূপ সম্বন্ধে সাম্প্রতিককালের গবেষণা থেকেও অনেক কিছু জানা যায়। অনেকের মতে, আত্ম-অভিজ্ঞান অন্বেষায় চঞ্চল এই বিশ বছরের আগে তিনি যা কিছু ভেবেছেন এবং করেছেন তা যেন এক হিসাবে এর জন্যই তৈরি হয়ে ওঠা, আর এর পরে যা কিছুই করেছেন তা এর প্রভাবেই ক্রমপরিণাম।
১৮৯০ থেকে ১৯০০ সাল – এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ কলকাতা শহরে নাগরিক জীবনের শিকড়হীন আধুনিকতার বাইরের চাকচিক্য আর জৌলুস থেকে, তার স্বার্থকেন্দ্রিক জীবনের বৃত্ত থেকে দূরে পদ্মাপারের জীবনে স্থিতু হয়ে চিনে নিচ্ছিলেন গ্রামবাংলাকে। পদ্মাপারের জীবন, এর অকৃত্রিম অন্ধকার আকাশ, দিগন্ত-বিস্তৃত সমতল, নির্জন-নীরবতা, নদী, সহজ-সরল মানুষের সান্নিধ্য তাঁকে জীবন, সমাজ, সংসারকে নতুনভাবে দেখা-জানার সুযোগ করে দিয়েছিল। ছিন্নপত্রাবলীর ৩-সংখ্যক চিঠিতে কবি তাঁর মুগ্ধতার কথা লিখেছেন – ‘পৃথিবী যে বাস্তবিক কি আশ্চর্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হয়। এই যে ছোট নদীর ধারে শান্তিময় গাছপালার মধ্যে সূর্য প্রতিদিন অস্ত যাচ্ছে, এবং এই অনন্ত ধূসর নির্জন, নিঃশব্দ চরের উপরে প্রতিরাত্রে শত সহস্র নক্ষত্রের নিঃশব্দ অভ্যুদয় হচ্ছে, জগৎ সংসারে এ যে কী একটা আশ্চর্য মহৎ ঘটনা তা এখানে থাকলে তবে বোঝা যায়।’ ১৮৯০-এর কয়েক বছর আগে থেকে গ্রামবাংলার সঙ্গে আসা-যাওয়ার মধ্য দিয়ে আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছিল কবির সম্পর্ক। ১৮৯০-এর পর থেকে তা আরো নিয়মিত হয়ে উঠেছিল। ১৮৯৫ সালে কবির মন যখন সংসার-সমাজের নানা অসামঞ্জস্যে পীড়িত, গ্রামজীবনের অতিদরিদ্র, বিমূঢ়, জমিদার-শাসিত মানুষের দুঃখকষ্টের সঙ্গে প্রতিদিন তাঁর প্রত্যক্ষ পরিচয় হচ্ছে, তখন মাঝে মাঝে সংগীতের সুধারসে ডুব দিতে ইচ্ছে হয়েছে তাঁর। ছিন্নপত্রাবলীর ২১১-সংখ্যক চিঠিতে কবি লিখেছেন – ‘আমাদের কাছে আমাদের প্রতিদিনের সংসারটা ঠিক সামঞ্জস্যময় নয় – তার কোনো তুচ্ছ অংশ হয়তো অপরিমিত বড়ো, ক্ষুধাতৃষ্ণা ঝগড়াঝাঁটি আরাম ব্যারাম টুকিটাকি খুঁটিনাটি খিটিমিটি এইগুলিই প্রত্যেক বর্তমান মুহূর্তকে কণ্টকিত করে তুলছে, কিন্তু সংগীত তার নিজের ভিতরকার সুন্দর সামঞ্জস্যের দ্বারা মুহূর্তের মধ্যে যেন কী-এক মোহমন্ত্রে সমস্ত সংসারটিকে এমন একটি পারসপেকটিভের মধ্যে দাঁড় করায় যেখানে ওর ক্ষুদ্র ক্ষণস্থায়ী অসামঞ্জস্যগুলো আর চোখে পড়ে না – একটা সমগ্র একটা বৃহৎ একটা নিত্য সামঞ্জস্য দ্বারা সমস্ত পৃথিবী ছবির মতো হয়ে আসে এবং মানুষের জন্ম-মৃত্যু হাসি-কান্না ভূত-ভবিষ্যৎ – বর্তমানের পর্যায়ে একটি 888sport app download apkর সকরুণ ছন্দের মতো কানে বাজে। সেই সঙ্গে আমাদেরও নিজ নিজ ব্যক্তিগত প্রবলতা তীব্রতার হ্রাস হয়ে আমরা অনেকটা লঘু হয়ে যাই এবং একটি সংগীতময়ী বিস্তীর্ণতার মধ্যে অতি সহজে আত্মবিসর্জন করে দিই।’ সম্পূর্ণ চিঠিটিই এখানে উদ্ধৃত করা হলো। চিঠিটি লেখা হয়েছে কলকাতা থেকে, ২ মে ১৮৯৫ সালে। সংগীত তাঁর মোহমন্ত্রে সংসারে তুচ্ছতা-কণ্টকিত অসামঞ্জস্যপূর্ণ বর্তমানকে দূরে সরিয়ে একটা সমগ্র, একটা সামঞ্জস্য দিয়ে পৃথিবীকে ছবির মতো সুন্দর করে তুলতে পারে। সংগীতের সুরে ব্যক্তিগত জীবনের ভার তীব্রতা, প্রবলতা হ্রাস পায়, মন তখন লঘু হয়ে একটি সংগীতময়ী বিস্তীর্ণতার মধ্যে অতি সহজে আত্মবিসর্জন করতে পারে। এই চিঠি কবি যখন লিখেছেন তখন বিশ্বজোড়া সংকট, দেশে মুক্তি-আন্দোলনের সমস্যা, ব্যক্তিগত জীবনের নানা অবসাদ কবিকে বিষাদগ্রস্ত করে রেখেছিল। কিন্তু এই অবসাদ, ক্লান্তিকে অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে হবে – এই বোধ এই সময়ে রচিত তাঁর গানে প্রবল হয়ে উঠেছে। এই সময়েই তিনি লিখেছেন ‘চিত্ত পিপাসিত রে’, ‘তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’, ‘তুমি নব নব রূপে এসো প্রাণে’, ‘আনন্দধারা বহিছে ভুবনে’, ‘কী রাগিণী বাজালে হৃদয়ে’, ‘এ কী আকুলতা ভুবনে’ প্রভৃতির মতো সব গান। সমাজ, সংসারের যে-অসামঞ্জস্যের কথা তিনি চিঠিতে লিখেছিলেন, যা তাঁকে সেই মুহূর্তে পীড়িত করছিল, এই গানগুলোতে ব্যক্তিগত সেই প্রবলতার তীব্রতা বিন্দুমাত্র নেই।
জীবন888sport sign up bonus গ্রন্থের ‘গান সম্বন্ধে 888sport live’ শিরোনাম-অধ্যায়ে কবি লিখেছেন, ‘যেখানে অনির্বচনীয় সেইখানেই গানের প্রভাব। বাক্য যাহা বলিতে পারে না গান তাহাই বলে।’ ১৮৯৫-এর ২০ সেপ্টেম্বর শিলাইদহ থেকে লেখা ছিন্নপত্রের একটি চিঠিতে সংগীতবিষয়ে একই কথা বলেছেন – ‘সংগীতের মতো এমন আশ্চর্য ইন্দ্রজালবিদ্যা জগতে আর কিছুই নেই – এ এক নূতন সৃষ্টিকর্তা। আমি তো ভেবে পাইনে – সংগীত একটা নতুন মায়াজগৎ সৃষ্টি করে না এই পুরাতন জগতের অন্তরতম অপরূপ নিত্যরাজ্য উদ্ঘাটিত করে দেয়। গান প্রভৃতি কতকগুলি জিনিস আছে যা মানুষকে এই কথা বলে দেয় যে, ‘তোমরা জগতের সকল জিনিসকে যতই পরিষ্কার বুদ্ধিগম্য করতে চেষ্টা করো-না কেন এর আসল জিনিসটাই অনির্বচনীয়’ এবং তারই সঙ্গে আমাদের মর্মের মর্মান্তিক যোগ – তারই জন্যে আমাদের এত দুঃখ, এত সুখ, এত ব্যাকুলতা।’ সংগীত এক আশ্চর্য ইন্দ্রজালবিদ্যা, অলৌকিক শক্তি, যা নতুন একটি মায়াজগৎ সৃষ্টি করে, পুরনো চিরচেনা জগতের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা অন্তরতম অপরূপ নিত্যরাজ্য উদ্ঘাটিত করে। বচন যেখানে ব্যর্থ সেখানেই অনির্বচনীয়, যতই আমরা বুদ্ধি দিয়ে বোঝাই, বাক্যের পর বাক্য সাজাই, কবির মতে, যেটা বুঝতে চাই, জানতে চাই, সেই আসল জিনিসটাই তো অনির্বচনীয়, আর তার সঙ্গেই আমাদের প্রাণের যোগ, তাকে জানতেই আমাদের এত দুঃখ, সুখ আর ব্যাকুলতা। সংগীতের ঐন্দ্রজালিক শক্তির কথা কবি বহু জায়গায় বহুভাবে বলেছেন। চিঠিটি লেখা হয়েছিল শিলাইদহ থেকে, ২০ সেপ্টেম্বর ১৮৯৫ সালে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর সুদীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবনে সংগীতকে সর্বাধিক মূল্য দিয়েছেন – একথা বললে তাঁর 888sport app সৃষ্টিকে কোনোভাবেই লঘু করা হয় না। গানের সুরে তিনি জেগেছেন, প্রাণ-মন ভরে উঠেছে আনন্দে। সুরের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মার নিবিড় যোগ। তাঁর কবি-হৃদয়ের প্রেরণাও গানের সুরের সঙ্গে গাঁথা হয়ে আছে। এ-প্রসঙ্গে জীবন888sport sign up bonusতে তাঁর জীবনে সংগীতের প্রভাব বিষয়ে মনোরম আলোচনা করেছেন। কবি লিখেছেন – ‘চিরকালই গানের সুর আমার মনে একটা অনির্বচনীয় আবেগ উপস্থিত করে। এখনো কাজকর্মের মাঝখানে হঠাৎ একটা গান শুনিলে আমার কাছে এক মুহূর্তেই সমস্ত সংসারের ভাবান্তর হইয়া যায়। এই সমস্ত চোখে দেখার রাজ্য গানে-শোনার মধ্য দিয়ে হঠাৎ একটা কী নূতন অর্থ লাভ করে। হঠাৎ মনে হয় আমরা যে জগতে আছি বিশেষ করিয়া কেবল তাহার একটা তলার সঙ্গেই সম্পর্ক রাখিয়াছি এই আলোকের তলা, বস্ত্তর তলা – কিন্তু এইটেই সমস্তটা নয়।… গানের সুরে যখন অন্তঃকরণের সমস্ত তন্ত্রী কাঁপিয়া উঠে তখন অনেক সময় আমার কাছে এই দৃশ্যমান জগৎ যেন আকার-আয়তনহীন বাণীর ভারে আপনাকে ব্যক্ত করিতে চেষ্টা করে – তখন যেন বুঝিতে পারি জগৎটাকে যেভাবে জানিতেছি তাহা ছাড়া কতরকমভাবেই যে তাহাকে জানা যাইতে পারিত তাহা আমরা কিছুই জানি না।’ রবীন্দ্রনাথের সংগীত-আলোচনা কোনো বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নয়, দার্শনিকের তত্ত্বমূলক গভীর কোনো আলোচনাও নয়। সংগীতকে তিনি প্রকৃতি ও প্রয়োজনের দিক থেকে বুঝতে চেয়েছেন। জীবন যখন তুচ্ছতার জঞ্জালে পরিকীর্ণ হয়ে ওঠে, সংগীতের সুষমা সেই জঞ্জাল সরিয়ে জীবনে আনে সামঞ্জস্য, সৌন্দর্য, প্রশান্তি। সংগীতজীবনকে জাগ্রত করে, সৃষ্টির পথে, কর্মের পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি দেয়।
ছিন্নপত্র লেখার সময় কবির মন কথানিরপেক্ষভাবে রাগ-রাগিণীর সুরে মুগ্ধ হয়েছে। ভৈরবী, মুলতান, পূরবী, রামকেলি, ইমনকল্যাণের সুরে ভরে উঠেছে তাঁর মন, তাঁর দিন-রাত্রি। এই সময়ে প্রকৃতির সঙ্গে গানের গভীর সম্পর্ক আবিষ্কারে তাঁর মন কৃতার্থ হয়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে গানের যে নিবিড় সম্পর্ক সে-সম্বন্ধে ২৬ সেপ্টেম্বর ১৮৯৫ সালে শিলাইদহ থেকে ছিন্নপত্রাবলীর একটি চিঠিতে কবি লিখেছেন – ‘প্রকৃতির সঙ্গে গানের যত নিকট সম্পর্ক এমন আর কিছু না – আমি নিশ্চয় জানি এখনি যদি আমি জানলার বাইরে দৃষ্টি রেখে রামকেলি ভাঁজতে আরম্ভ করি তা হলে এই রৌদ্ররঞ্জিত সুদূরবিস্তৃত শ্যামলনীল প্রকৃতি মন্ত্রমুগ্ধ হরিণীর মতো আমার মর্মের কাছে এসে আমাকে অবলেহন করতে থাকবে। যতবার পদ্মার উপর বর্ষা হয় ততবারই মনে করি মেঘমল্লারে একটা নতুন বর্ষার গান রচনা করি… কথা তো ঐ একই – বৃষ্টি পড়ছে, মেঘ করেছে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। কিন্তু তার ভিতরকার নিত্যনূতন আবেগ, অনাদি-অনন্ত বিরহ-বেদনা, সেটা কেবল গানের সুরে খানিকটা প্রকাশ পায়।’ চিঠিটিতে প্রকৃতির সঙ্গে গানের নিবিড় সম্পর্কের কথা বলতে গিয়ে অপরূপ একটি চিত্রকল্প যেমন ব্যবহার করেছেন, তেমনি রাগ-রাগিণীর ভেতরকার নিত্যনূতন আবেগ, অনাদি-অনন্ত বিরহ-বেদনা যা কেবল গানের সুরে প্রকাশ পায় তার কথাও বলেছেন। তরুণ বয়সের সংগীত-ভাবনায় রাগ-রাগিণীর পরিবেশনায় ওস্তাদি ক্রিয়াকলাপের প্রতি কবির বিরূপতা শেষ অবধি অক্ষুণ্ণ ছিল, কিন্তু রাগ-রাগিণীর অন্তর্নিহিত সূক্ষ্ম আবেদনকে তাঁর সংবেদনশীল মন কখনো অগ্রাহ্য করেনি। প্রকাশলীলায় গান যে সব থেকে সূক্ষ্ম, হৃদয়ের বাণীকে যে তা সুরে রাঙিয়ে তোলে, রাগ-রাগিণীর সুরের স্পর্শে তা প্রস্ফুটিত হয়, আপনাকে উজাড় করে মেলে ধরে। রাগ-রাগিণীর দাসত্ব নয়, সংগীতে ভাব প্রকাশ করাই রাগ-রাগিণীর উদ্দেশ্য।
কবি বিশ্বাস করতেন আমাদের শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিণীগুলো 888sport sign up bonusকে জাগিয়ে দেয়। গভীর কোনো শোক-দুঃখ হতে পারে, সেই শোক প্রিয়জন হারাবার শোক, গভীর সেই শোকেও কোনো রাগিণীর সুর পারে 888sport sign up bonusকে জাগিয়ে দিতে। ভৈরবী ছিল কবির প্রিয় রাগিণী। ‘ভৈরবী যেন সমস্ত সৃষ্টির অন্তরতম বিরহব্যাকুলতা।’ (‘ছন্দের অর্থ’, চৈত্র ১৩২৪) ভৈরবীর করুণ সুর মনের গভীরে সুপ্ত 888sport sign up bonusকে জাগিয়ে শোকের বার্তা নিয়ে আসে। মানসী কাব্যের ‘ভৈরবী গান’ 888sport app download apkর কয়েকটি লাইন উদ্ধৃত করলে সে-কথা বোঝা যাবে –
হায় অতৃপ্ত যত মহৎ বাসনা
গোপনমর্মদাহিনী,
এই আপনা মাঝারে শুষ্ক জীবনবাহিনী।
ওই ভৈরবী দিয়া গাঁথিয়া গাঁথিয়া
রচিব নিরাশাকাহিনী।
প্রিয়জন হারানোর শোক বুকে নিয়েই কবি লিখেছিলেন 888sport app download apkটি। প্রিয়জন হারানোর শূন্যতা যে হতাশা-নৈরাশ্য সৃষ্টি করে, সংগীত, রাগ-রাগিণীর সুর সেই শোক-শূন্যতাকে সরিয়ে অতীত 888sport sign up bonusর সুরভিতে মনকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। সহজ-কঠিন দ্বন্দ্বে-ছন্দে চলা জীবন রাগ-রাগিণীর সুরে জেগে ওঠে। 888sport sign up bonusকে সামনে এনে দেয়। বিষণ্ণতায় বিষাদে বাজে ভৈরবী। ভোরের এই রাগিণী যেন জগতের প্রাণকেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসক্তিহীন এক ব্যথার সুর ছড়িয়ে দেয় আকাশে-বাতাসে। নিবিড় এক প্রশান্তি তখন ব্যক্তিগত দুঃখ-শোককে আড়াল করে। ভৈরবীর কোমল পর্দাগুলো চিরবিরহের ব্যথাকে চিরমিলনের আশ্বাসে পরিণত করে।
১৮৯৪ সালের ২১ নভেম্বর কলকাতা থেকে লেখা একটি চিঠিতে বিয়োগশোককাতর সংসারের ভেতর চিরস্থায়ী সুগভীর যে দুঃখ ভৈরবীর সুর তাকে বিগলিত করে বের করে নিয়ে আসে, সে-কথা জানিয়েছেন। কবি লিখেছেন – ‘কর্মক্লিষ্ট সন্দেহপীড়িত বিয়োগশোককাতর সংসারের ভিতরকার যে চিরস্থায়ী সুগভীর দুঃখটি, ভৈরবী রাগিণীতে সেইটিকে একেবারে বিগলিত করে বের করে নিয়ে আসে। মানুষে মানুষে সম্পর্কের মধ্যে যে-একটি নিত্যশোক নিত্যভয় নিত্যমিনতির ভাব আছে, আমাদের হুদয় উদ্ঘাটন করে ভৈরবী সেই কান্নাটিকে মুক্ত করে দেয় – আমাদের বেদনার সঙ্গে জগদ্ব্যাপী বেদনার সম্পর্ক স্থাপন করে দেয়। সত্যিই তো আমাদের কিছুই স্থায়ী নয়, কিন্তু প্রকৃতি কী এক অদ্ভুত মন্ত্রবলে সেই কথাটিই আমাদের সর্বদা ভুলিয়ে রেখেছে – সেই জন্যেই আমরা উৎসাহের সহিত সংসারের কাজ করতে পারি। ভৈরবীতে সেই চিরসত্য সেই মৃত্যুবেদনা প্রকাশ হয়ে পড়ে, আমাদের এই কথা বলে দেয় যে, আমরা যা-কিছু জানি তার কিছুই থাকবে না এবং যা চিরকাল থাকবে তার আমরা কিছুই জানিনে।’ অসাধারণ এই চিঠিতে শুধু সংগীত নয়, জীবনের গভীর সত্য উদ্ঘাটন করে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন আমাদের। প্রকৃতির মোহন রূপ আর মন্ত্রবলে কর্মক্লিষ্ট, বিয়োগশোককাতর সংসারের ভেতর বাসা বেঁধে থাকা চিরস্থায়ী সুগভীর যে-দুঃখ, নিত্যনতুন কর্মের প্রবলতায় যাকে আমরা ভুলে থাকি, ভৈরবীর সুর সেই কান্নাকে মুক্ত করে দিয়ে জগতে ছড়িয়ে থাকা কান্নার সঙ্গে আমাদের ব্যথার যোগসূত্রটি স্থাপন করে দেয়। কিছুই যে স্থায়ী নয়, সবই যে অ-নিত্য, ভঙ্গুর, সেই চিরসত্য, সেই মৃত্যু-বেদনা ভৈরবীর সুরে প্রকাশ হয়ে পড়ে। তাই বোধহয় সকালবেলার আলোয় বিদায়ব্যথার ভৈরবীর সুর বাজে।
সংগীতচিন্তা গ্রন্থে ছিন্নপত্রাবলীর আরো দুটি চিঠিতে ভৈরবী রাগিণীর বিষণ্ণ করুণ আবেদনের উল্লেখ আছে। ১৮৮৯-এর জুনে কলকাতা থেকে লেখা চিঠি – ‘ভৈরবী সুরের মোচড়গুলো কানে এলে জগতের প্রতি এক রকম বিচিত্র ভাবের উদয় হয়… মনে হয় একটা নিয়মের হস্ত অবিশ্রাম আর্গিণযন্ত্রের হাতা ঘোরাচ্ছে এবং সেই ঘর্ষণবেদনায় সমস্ত বিশ্বব্রহ্মান্ডের মর্মস্থল হতে একটা গম্ভীর কাতর করুণ রাগিণী উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছে – সকাল বেলাকার সূর্যের সমস্ত আলো ম্লান হয়ে এসেছে, গাছপালারা নিস্তব্ধ হয়ে কী যেন শুনছে, এবং আকাশ একটা বিশ্বব্যাপী অশ্রুর বাষ্পে যেন আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে – অর্থাৎ, দূর আকাশের দিকে চাইলে মনে হয় যেন একটা অনিমেষ নীল চোখ কেবল ছলছল করে চেয়ে আছে।’ 888sport app download apkয় গানের রাগ-রাগিণী সম্পর্কে যে উপলব্ধির কথা বলেছেন, ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিতেও সেই উপলব্ধির প্রতিধ্বনি শুনি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় কড়ি ও কোমলের ‘ঘোগিয়া’ এবং মানসী কাব্যের ‘ভৈরবী গান’ 888sport app download apk দুটির কথা। রাগ-রাগিণীর সুরগুলো যেন জগতের অন্তস্তল থেকে উঠে এসে আকাশে-বাতাসে আসক্তিহীন এক ব্যথার বন্যা ছড়িয়ে দেয়। ব্যক্তিগত শোক-দুঃখের হাহাকার দূরে গিয়ে গভীর শান্তির বার্তা আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে, চিরবিরহের ব্যথাকে চিরমিলনের আশ্বাসে পরিণত করে। ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিগুলোতে কবি রাগ-রাগিণীর সুরের আবেদন মনের ওপর যে মোহ-মায়াজাল বিস্তার করে সে সম্পর্কে বিস্তৃতভাবে বলেছেন। এই সময় কথার কুহক থেকে সরে গিয়ে প্রকৃতির নিশি্ছদ্র নীরবতায় সুরের ইন্দ্রজালে ডুব দিতে চেয়েছে তাঁর মন। কোনো রাগিণীর করুণ-মধুর 888sport sign up bonusজাগানিয়া সুরের মধ্যে বয়ে চলে ব্যথাহীন সুরের ধারা। শোকের মধ্যেও তাই সৃষ্টির শক্তিকে খুঁজে নিয়েছেন রাগ-রাগিণীর সুরে ডুবে গিয়ে। মানসী কাব্যের ‘ভৈরবী গান’ নিদারুণ কোনো মৃত্যুশোক থেকেই উৎসারিত।
ছিন্নপত্রাবলীর ১৬টি চিঠির মধ্যেই এ-লেখা সীমাবদ্ধ। ছিন্নপত্রের প্রথম ১৩টি চিঠি ১৮৮৫ থেকে ১৮৯০ সালের মধ্যে লেখা। ১৮৯১ থেকে ১৮৯৫-এর মধ্যে লেখা চিঠিগুলো রবীন্দ্রনাথের জীবনের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে লেখা বলেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তরুণ রবীন্দ্রনাথ যে-সংগীত ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, যৌবনের পরিণত মন ক্রমশ তা থেকে সরে এসেছে দূরে। সৃজনশীলতা কখনো এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। রবীন্দ্রনাথের মতো সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনে ভাঙাগড়ার খেলা নতুন কিছু নয়।
রবীন্দ্রনাথ শাস্ত্রীয় রাগ-রাগিণীর চরিত্রকে যেভাবে বর্ণনা করেছেন, সেভাবে আমাদের শাস্ত্রীয় সংগীতের ওস্তাদেরা ভাবেননি। সবুজপত্রে প্রকাশিত ‘সংগীতের মুক্তি’ 888sport liveে বলেছেন, আমাদের রাগ-রাগিণীতে যে অনির্বচনীয় বিশ্বরস থাকে তাকে নানা বড় বড় আধারে ধরে রাখা হয়। উপলব্ধির সেই অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কালোয়াতি গানটা ঠিক যেন মানুষের গান নয়, তাহা যেন সমস্ত জগতের।’ তাঁর অনুভবে একেকটি রাগ বিমূর্ত হয়েছে তার স্বকীয়তায়। ‘ভৈরোঁ যেন ভোরবেলার আকাশেরই প্রথম জাগরণ; পরজ যেন অবসন্ন রাত্রিশেষের নিদ্রাবিহবলতা; কানাড়া যেন ঘনান্ধকারে অভিসারিকা নিশীথিনীর পথবি888sport sign up bonus; ভৈরবী যেন সঙ্গবিহীন অসীমের চিরবিরহবেদনা; মুলতান যেন রৌদ্রতপ্ত দিনান্তের ক্লান্তিনিশ্বাস; পূরবী যেন শূন্য-গৃহচারিণী বিধবা সন্ধ্যার অশ্রুমোচন।’ (সংগীতচিন্তা) মুলতান রাগের যে রূপটি তাঁর কল্পনায় প্রতিভাত হয়েছে ছিন্নপত্রাবলীর একটি চিঠিতেও কবি মুলতানকে সেইভাবে তুলে ধরেছেন। ২২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৫-এ শিলাইদহ থেকে লেখা চিঠি – ‘আমাদের মুলতান রাগিণীটা এই চারটে-পাঁচটা বেলাকার রাগিণী, তার ঠিক ভাবখানা হচ্ছে – ‘আজকের দিনটা কিছুই করা হয়নি।’… আজ আমি এই অপরাহ্ণের ঝিকমিকি আলোতে জলে-স্থলে-শূন্যে সব জায়গাতেই সেই মুলতান রাগিণীটাকে তার করুণ চড়া অন্তরা-সুদ্ধ প্রত্যক্ষ দেখতে পাচ্ছি – না সুখ, না দুঃখ, কেবল আলস্যের অবসাদ এবং তার ভিতরকার একটা মর্মগত বেদনা।’ অপরাহ্ণের ঝিকমিকি আলোতে জলে-স্থলে সব জায়গাতেই মুলতান রাগিণীর করুণ চড়া সুরে যে উপলব্ধি তা সুখ নয়, দুঃখ নয়, কেবল আলস্যের অবসাদ আর তার ভেতরকার মর্মগত বেদনা। পূজা পর্যায়ের ‘আপনি আমার কোনখানে’ গানটিতে মর্মগত এই বেদনার ছায়াই কি দেখি না –
আপনি আমার কোন্খানে
বেড়াই তারি সন্ধানে \
নানান রূপে নানান বেশে ফেরে যেজন ছায়ার দেশে
তার পরিচয় কেঁদে হেসে শেষ হবে কি, কে জানে \
আমার গানের গহন-মাঝে শুনেছিলাম যার ভাষা
খুঁজে না পাই তার বাসা।
বেলা কখন যায় গো বয়ে, আরো আসে মলিন হয়ে –
পথের বাঁশি যায় কী কয়ে বিকালবেলার মুলতানে \
আমাদের রাগ-রাগিণীর মধ্যে সময়ের যে-বৈশিষ্ট্য, সকাল, সন্ধ্যা, মধ্যরাতের রাগ, এমনকি বর্ষা-বসন্তের রাগের মধ্যে কবি তাঁর নিজের মতো করে গভীর এক তত্ত্বসংকেত আবিষ্কার করেছেন, যা একান্তই তাঁর নিজের। প্রিয় রাগ ভৈরবী এবং মুলতান বিষয়ে ৫ জুলাই ১৮৯২ সালে শাহজাদপুর থেকে লিখছেন, ‘আজ সকালে একটা সানাইয়েতে ভৈরবী বাজাচ্ছিল, এমনি অতিরিক্ত মিষ্টি লাগছিল যে, সে আর কী বলব – আমার চোখের সামনেকার শূন্য আকাশ এবং বাতাস পর্যন্ত একটা অন্তরনিরুদ্ধ ক্রন্দনের আবেগে যেন স্ফীত হয়ে উঠছিল – বড়ো কাতর কিন্তু বড়ো সুন্দর – সেই সুরটাই গলায় কেন যে তেমন করে আসে না বুঝতে পারি নে।… এখন আবার তারা মুলতান বাজাচ্ছে – মনটা বড়োই উদাস করে দিয়েছে – পৃথিবীর এই সমস্ত সবুজ দৃশ্যের উপরে একটি অশ্রুবাষ্পের আবরণ টেনে দিয়েছে – এক-পর্দা মুলতান রাগিণীর ভিতর দিয়ে সমস্ত জগৎ দেখা যাচ্ছে। যদি সব সময়েই এই রকম এক-একটা রাগিণীর ভিতর দিয়ে জগৎ দেখা যেত, তা হলে বেশ হত। আমার আজকাল ভারি গান শিখতে ইচ্ছে করে – বেশ অনেকগুলো ভূপালী… এবং করুণ বর্ষার সুর – অনেক বেশ ভালো ভালো হিন্দুস্থানী গান – গান প্রায় কিচ্ছুই জানি নে বললেই হয়।’ ভাবতে অবাক লাগে, শেখার সব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও যে-গান শেখায় তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না, সেই গানেরই সুরের জাদু তাঁকে, তাঁর পদ্মাপারের জীবনকে প্রলুব্ধ করছে। প্রকৃতির অন্তরসত্তার সঙ্গে মিশেছে তাঁর ব্যক্তিসত্তা – শান্ত, নির্জন সৌন্দর্যের মধ্যে ভোরের ভৈরবী আর বিকেলের মুলতানের সুরে মুগ্ধ আচ্ছন্নতা এ-কথাই বলে যে, প্রকৃতি আর সংগীত অবিচ্ছেদ্য, মেশামেশি করে থাকে। এরকম আরো একটি চিঠি। লেখা হয়েছিল শিলাইদহ থেকে ১৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৫ সালে। যেখানে কবি জানিয়েছেন পূরবী আর ইমন কল্যাণের আলাপে সমস্ত স্থির নদী আর স্তব্ধ আকাশ কীভাবে মানুষের হৃদয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সান্ধ্যপ্রকৃতির মধ্যে সমস্ত অন্তঃকরণ যখন পরিপ্লুত তখন – ‘…হঠাৎ দূরের এক অদৃশ্য নৌকো থেকে বেহালাযন্ত্রে প্রথমে পূরবী ও পরে ইমন কল্যাণে আলাপ শোনা গেল – সমস্ত স্থির নদী এবং স্তব্ধ আকাশ মানুষের হৃদয়ে একেবারে পরিপূর্ণ হয়ে গেল। ইতিপূর্বে আমার মনে হচ্ছিল মানুষের জগতে এই সন্ধ্যাপ্রকৃতির তুলনা বুঝি কোথাও নেই – যেই পূরবীর তান বেজে উঠল, অমনি অনুভব করলুম এও এক আশ্চর্য গভীর এবং অসীম সুন্দর ব্যাপার, এও এক পরম সৃষ্টি – সন্ধ্যার সমস্ত ইন্দ্রজালের সঙ্গে এই রাগিণী এমনি সহজে বিস্তীর্ণ হয়ে গেল, কোথাও কিছু ভঙ্গ হলো না – আমার বক্ষস্থল ভরে উঠল।’ (শিলাইদহ, ১৫ ডিসেম্বর, ১৮৯৫) প্রকৃতি যেমন পৃথিবীকে রাঙিয়ে দেয় তার সবটুকু রঙ দিয়ে তার মধ্যে তখন প্রাণের আনন্দ ঢেউ খেলে যায়, কোনো অর্থ খোঁজা, ব্যাখ্যা খোঁজার প্রয়োজন হয় না, আনন্দ আপনাতে আপনি বিকশিত হয়। কবি বারবার এই কথাই বলেছেন, অপ্রয়োজনের সৃষ্টিই আনন্দের সৃষ্টি, যেমন শরতের শিউলি ফুল, নববর্ষার জলবর্ষণে ঘাসের বুকে নামহারা রঙের চমক। ‘এটা হলো রূপের লীলা, কেবলমাত্র হয়ে ওঠাতেই আনন্দ।’ সমস্ত সৃষ্টিই এই অহেতুক আনন্দ থেকে উৎসারিত, কবির কাছে গানের ভূমিকা তাদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। কারণ গান হলো নিছক সৃষ্টিলীলা।
পতিসর থেকে একটি চিঠিতে কবি লিখছেন, আমাদের মতো বাধাহীন পরিষ্কার আকাশ, বহুদূর বিস্তৃত সমতলভূমি ইউরোপের কোথাও আছে কিনা সন্দেহ। এর মধ্যে যে অসীম ঔদাস্য লুকিয়ে আছে এদেশের মানুষ সেটা আবিষ্কার করতে পেরেছে। আর ‘এই জন্য আমাদের পূরবীতে কিংবা টোড়িতে সমস্ত বিশাল জগতের অন্তরের হাহাধ্বনি যেন ব্যক্ত করছে, কারো ঘরের কথা নয়। পৃথিবীর একটা অংশ আছে যেটা কর্মপটু, স্নেহশীল, সীমাবদ্ধ তার ভাবটা আমাদের মনে তেমন প্রভাব বিস্তার করবার অবসর পায় নি। পৃথিবীর যে ভাবটা নির্জন, বিরল, অসীম, সেই আমাদের উদাসীন করে দিয়েছে। তাই সেতারে যখন ভৈরবীর মিড় টানে, আমাদের ভারতবর্ষীয় হৃদয়ে একটা টান পড়ে।’ (পতিসর, ১৮ জানুয়ারি, ১৮৯১) রবীন্দ্রনাথ একসময় লিখেছিলেন, ‘ইংরাজি গানের সঙ্গে আমাদের সংগীতের প্রধান পার্থক্য ইংরাজি সংগীত লোকালয়ের সংগীত আর আমাদের সংগীত ‘প্রকান্ড নির্জন প্রকৃতির অনির্দিষ্ট অনির্বচনীয় বিষাদের সংগীত।’ কবির মতে, আমাদের রাগ-রাগিণীগুলো, যেমন কানাড়া টোড়ির মতো রাগিণীর মধ্যে যে অতল গভীরতা সে কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয়, ‘সে যেন অকূল অসীমের প্রান্তবর্তী এই সঙ্গীহীন বিশ্বজগতের।’ ইংরেজি সংগীত বিষয়ে কবির এই ধারণা শেষ পর্যন্ত অপরিবর্তিত ছিল। ছিন্নপত্রাবলীর একটি চিঠিতে দিন ও রাতের তুলনা করতে গিয়ে ইংরেজি ও ভারতীয় সংগীতকে কবি উপমান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ‘আমার মনে হয় দিনের জগৎটা য়ুরোপীয় সংগীত, সুরে-বেসুরে খন্ডে-অংশে মিলে একটা গতিশীল প্রকান্ড হার্মণির জটলা – আর রাত্রের জগৎটা আমাদের ভারতবর্ষীয় সংগীত, একটি বিশুদ্ধ করুণ গম্ভীর অমিশ্র রাগিণী। দুটোই আমাদের বিচলিত করে, অথচ দুটোই পরস্পরবিরোধী। আমাদের নির্জন এককের গান, য়ুরোপের সজন লোকালয়ের গান। আমাদের গানে শ্রোতাকে মনুষ্যের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখের সীমা থেকে বের করে নিয়ে নিখিলের মূলে যে-একটি সঙ্গীহীন বৈরাগ্যের দেশ আছে সেইখানে নিয়ে যায়, আর য়ুরোপের সংগীত মনুষ্যের সুখ-দুঃখের অনন্ত উত্থান-পতনের মধ্যে বিচিত্রভাবে নৃত্য করিয়ে নিয়ে চলে।’ (শিলাইদহ, ১০ আগস্ট, ১৮৯৪)
রবীন্দ্রনাথের গানে বিশ্বপ্রকৃতি অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। সুখে-দুঃখে, হাসি-কান্নায়, জীবনের উত্থান-পতনে জীবনের সঙ্গে সংগীতকে অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িয়ে নিয়েছেন। আমাদের প্রকৃতিতে যেমন অসীম ঔদাস্য লুকিয়ে আছে, তেমনি আমাদের গান প্রতিদিনের সুখ-দুঃখের সীমা থেকে আমাদের বের করে এনে সঙ্গীহীন বৈরাগ্যের দেশে পৌঁছে দেয়।
মানুষের যে জীবন লোভ আর লালসা, বিরোধ-বিদ্বেষ, আরাম-আয়েসে পরিপূর্ণ, দ্বন্দ্বে-ছন্দে চলা নিত্যদিনের সেই জীবন তুচ্ছতায় যখন সামঞ্জস্যহীন হয়ে ওঠে, সংগীত সেই অসামঞ্জস্যগুলোকে দূরে সরিয়ে সামঞ্জস্য ও সৌন্দর্য নিয়ে আসে। তখন ‘মানুষের জন্মমৃত্যু, হাসিকান্না, ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের পর্যায় একটি 888sport app download apkর সকরুণ ছন্দের মতো কানে বাজে।’ (ছিন্নপত্রাবলী, ২ মে, ১৮৯৫)
সংগীতকে রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য ইন্দ্রজালবিদ্যা বলেছেন। বলেছেন, ‘সংগীত নূতন এক সৃষ্টিকর্তা।’ (শিলাইদহ, ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৫) কবির মন সবসময়ই ভারতীয় রাগ-রাগিণীর অন্তর্নিহিত সত্য ও সৌন্দর্যকে খুঁজেছে। সাংগীতিক আলোচনাগুলো কবি-মনের ভাবকল্পনায় তাই অনন্য হয়ে উঠেছে। ১৮৯১ থেকে ১৮৯৫ – কবির জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ বছর। ছিন্নপত্রের চিঠিগুলো লেখারও সময়কাল। সংগীতচিন্তা গ্রন্থে সংকলিত ছিন্নপত্রাবলীর চিঠিতে কবির ব্যক্তিমনের বিষণ্ণতা, আনন্দের অভিব্যক্তি, প্রকৃতি-মুগ্ধতা, সংগীত, রাগ-রাগিণীর সুরে মগ্নতা তাঁর মনে যে আবেগ-অনুভূতি সৃষ্টি করেছে, তার প্রকাশ এই চিঠিগুলোতে যেভাবে হয়েছে, সম্ভবত তেমনভাবে আর কোথাও হয়নি। নিজেই তিনি সে কথা স্বীকার করেছেন। ২০০-সংখ্যক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথের গভীর আন্তরিক কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। ইন্দিরা দেবীকে লিখছেন, ‘আমাকে একবার তোর চিঠিগুলো দিস্ (বব), আমি কেবল ওর থেকে আমার সৌন্দর্য সম্ভোগগুলো একটা খাতায় টুকে নেব। কেননা যদি দীর্ঘকাল বাঁচি, তা হলে এক সময় নিশ্চয় বুড়ো হয়ে যাব, তখন এই সমস্ত দিনগুলি 888sport app download for androidের এবং সান্ত্বনার সামগ্রী হয়ে থাকবে। তখন পূর্বজীবনের সমস্ত সঞ্চিত সুন্দর দিনগুলির মধ্যে তখনকার সন্ধ্যার আলোকে ধীরে ধীরে বেড়াতে ইচ্ছা করবে। তখন আজকেকার এই পদ্মার চর এবং স্নিগ্ধ শান্ত বসন্ত জ্যোৎস্না ঠিক এমনি টাটকা-ভাবে ফিরে পাব। আমার গদ্যে পদ্যে কোথাও আমার সুখ দুঃখের দিনরাত্রিগুলি এ রকম করে গাঁথা নেই।’ (চিঠি 888sport free bet-২০০, ১১ মার্চ ১৮৯৫) পদ্মাপারের জীবন কবিকে মুগ্ধ করেছিল। অখন্ড অবসর আর নির্জন নীরবতায় সঙ্গীহীন সময় কেটেছে সৃষ্টি-বৈচিত্র্যের বন্যায়, ঘাটের কথা আগে লেখা হলেও এখানেই তাঁর ছোটগল্প লেখার শুরু, প্রকৃতির সঙ্গে মেশামেশি করে থাকা মানুষ তাঁর গল্পের চরিত্র, একই সঙ্গে গান, গল্প, চিঠি, 888sport app download apk – তারপরেও জীবনকে আর একভাবে ছুঁয়ে দেখার আকাঙ্ক্ষা। ‘পরশুদিন অমনি বোটের জানলার কাছে চুপ করে বসে আছি, একটা জেলেডিঙিতে একজন মাঝি গান গাইতে গাইতে চলে গেল – খুব যে সুস্বর তা নয় – হঠাৎ মনে পড়ে গেল বহুকাল হল ছেলেবেলায় বাবামশায়ের সঙ্গে বোটে করে পদ্মায় আসছিলুম – একদিন রাত্তির প্রায় দুটোর সময় ঘুম ভেঙে যেতেই বোটের জানলাটা তুলে ধরে মুখ বাড়িয়ে দেখলুম নিস্তরঙ্গ নদীর উপরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না হয়েছে, একটি ছোট্ট ডিঙিতে একজন ছোকরা একলা দাঁড় বেয়ে চলেছে, এমনি মিষ্টি গলায় গান ধরেছে – গান তার পূর্বে তেমন মিষ্টি কখনো শুনিনি। হঠাৎ মনে হল আবার যদি জীবনটা ঠিক সেইদিন থেকে ফিরে পাই! আর একবার পরীক্ষা করে দেখা যায় – এবার তাকে আর তৃষিত শুষ্ক অপরিতৃপ্ত করে ফেলে রেখে দিই নে – কবির গান গলায় নিয়ে একটি ছিপছিপে ডিঙিতে জোয়ারের বেলায় পৃথিবীতে ভেসে পড়ি, গান গাই এবং বশ করি এবং দেখে আসি পৃথিবীতে কোথায় কী আছে; আপনাকেও একবার জানান দিই, অন্যকেও একবার জানি; জীবনে যৌবনে উচ্ছ্বসিত হয়ে বাতাসের মতো একবার হু হু করে বেড়িয়ে আসি, তার পরে ঘরে ফিরে এসে পরিপূর্ণ প্রফুল্ল বার্ধক্য কবির মতো কাটাই।’ (শিলাইদহ, ৬ অক্টোবর ১৮৯১)
কুড়ি বছর বয়সে ‘সংগীত ও ভাব’ 888sport live থেকে শুরু করে সারাজীবন সংগীত-বিষয়ে যত কথা বলেছেন তার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। ছিন্নপত্র রচনার সময় ছিল কবির জীবনের চরম উদ্বেগ ও যন্ত্রণার, উৎকণ্ঠা আর আর্তির, সে-কথা আগেই উল্লেখ করেছি। যে-আলো রবীন্দ্রনাথ দেখেছিলেন কলকাতায়, লন্ডনে, সে-আলো তাঁকে নাড়া দিতে পারেনি। সে-আলো তাঁর কাছে অবাস্তব বলে মনে হয়েছে। (ছিন্নপত্রাবলী, ৭-সংখ্যক পত্র) তার থেকে অনেক বেশি সত্য ও বাস্তব বলে মনে হয়েছিল নিজ দেশের সমতলভূমির নিজস্ব অন্ধকার।
১৮৯৫ সালে কবির মন সংসার-সমাজের নানা অসামঞ্জস্যে পীড়িত ছিল। অশান্তির আঘাতে বেজেছে বীণা, চিঠিগুলোতে উঠে এসেছে তার আভাস। ১৬টি চিঠির প্রায় সবকটিতেই কবি প্রকৃতি এবং রাগ-রাগিণীর অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যের সম্মোহনী শক্তির কথা বলেছেন। পদ্মাপারের জীবন যেমন তাঁকে নতুন করে জীবন, জগৎ, প্রকৃতিকে চিনিয়েছিল; তাঁর গান, চিঠি থেকে আমরাও প্রকৃতিকে দেখার পাঠ নিয়েছি। আমাদের আকাশ, প্রান্তর, নদী, নির্জনতা, সকাল, সন্ধ্যা, রাত্রি এমন অর্থ কি কখনো খুঁজে পেয়েছে তিনি বলে দেবার আগে! আত্মোপলব্ধির দিকে কবির পরিপূর্ণ অভিযাত্রাও শুরু হয়েছিল ছিন্নপত্রের দিনগুলি থেকেই।
শেষ করব কবি অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি দিয়ে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর শেষ বয়সের স্থায়ী আস্তানা গান ও ছবি। তাঁর গানের বিরূপ সমালোচনা হয়েছে, ভ্রূক্ষেপ করেননি। গান তাঁর জীবনের সকল আনন্দের উৎস। চিঠিতে কবি লিখেছেন, ‘গানে আমার পান্ডিত্য নেই, একথা আমার নিতান্ত জানা – তার চেয়ে বেশি জানা গানের ভিতর দিয়ে অব্যবহিত আনন্দের সহজ বোধ। এই সহজ আনন্দের নিশ্চিত উপলব্ধির উপরে বাঁধা আইনের করক্ষেপ আমাকে একটুও নাড়াতে পারেনি। এখানে আমি উদ্ধত, আমি স্পর্ধিত আমার আন্তরিক অধিকারের জোরে। বচনের অতীত বলেই গানের অনির্বচনীয়তা আপন মহিমায় আপনি বিরাজ করতে পারে, যদি তার মধ্যে থাকে আইনের চেয়ে বড় আইন। গান যখন সম্পূর্ণ জাগে মনের মধ্যে, তখন চিত্ত অমরাবতীতে গিয়ে পৌঁছয়।’ (সংগীতচিন্তা) এটা কবির শেষ বয়সের স্বীকারোক্তি। গান রচনার নেশায় যখন তাঁকে পেয়েছে সব ভুলে, তখন তিনি তাতেই ডুবে গেছেন। আপন অন্তরের আর্তিকে, প্রকাশের বেদনাকে গানে মূর্তি দেবার যে-আনন্দ সে-আনন্দ তাঁর কাছে ছিল তুলনাহীন। সে-আনন্দের গভীরতা ছাপিয়ে গেছে অন্য সবকিছুকে।
কবি জানতেন, চলে যেতে হবে একদিন, রেখে যেতে হবে সবকিছু। শ্রম, স্বপ্ন আর সাধনায় দীর্ঘ ষাট বছরেরও কিছু বেশি সময় ধরে গান রচনা করেছেন, গানের সেই সম্ভার পড়ে রইবে পেছনে। তিনি জানতেন, চলে গিয়েও সেই তাঁর থেকে যাওয়া। জীবনের সমস্ত সুখ-দুঃখকে তাই গানের সুরে গেঁথে নিয়েছেন। ঈশ্বরের কাছে বর প্রার্থনা করেছেন, মৃত্যু থেকেও যেন জেগে উঠতে পারেন গানের সুরে।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.