সুরজিৎ দাশগুপ্ত
দার্জিলিং দার্জিলিং বুকের মধ্যে বাজল ঘণ্টা ঢং ঢং। চোখের সামনে উঠল ভেসে আকাশজোড়া মসত্ম এক বিশাল কুয়াশা এবং সেই কুয়াশার ভেতর থেকে আসেত্ম-আসেত্ম জেগে উঠতে লাগল কোনো গভীর ছায়া, ছায়ার পাহাড়, পাহাড়ের পর পাহাড়ের ছায়া, যেন অমত্মহীন ছায়ার মিছিল। এখন মনে হয় যেন এক স্বপ্ন, এলোমেলো, ছেঁড়া-ছেঁড়া, ঝাপসা-ঝাপসা। দেখা যাক, টুকরো-টুকরো ছবিকে জুড়ে কোনো সংলগ্নতা দেওয়া যায় কিনা।
কবে প্রথম দার্জিলিং গিয়েছিলাম? বোধহয় ১৯৪০ সালে, কিন্তু সেটা গ্রীষ্মে, না শরতে মনে নেই। উত্তর বাংলার প্রথম ভারতীয় লেডি ডাক্তার ছিলেন আমার মা অশ্রম্নবালা দাশগুপ্ত। তাঁকে খাতির করে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে নিয়ে গেছলেন শচীন চন্দের স্ত্রী। শচীন চন্দ ছিলেন জলপাইগুড়ির একজন সম্পন্ন ব্যক্তি। তাঁর ছিল অনেকগুলো চা বাগান আর দার্জিলিংয়েও ছিল একটা বাড়ি। চন্দ মাসিমা যখন মাকে নিয়ে দার্জিলিংয়ে যান তখন মায়ের সঙ্গে আমাদের দুভাইকেও নিয়ে যান।
যতদূর মনে পড়ে একদিন সকালে জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে আমরা দার্জিলিং মেলে চড়ে শিলিগুড়ি আসি, তারপর সেখান থেকে ন্যারো গেজের মানে টয় ট্রেনে দার্জিলিং। বলে রাখা ভালো, তখনকার যুগে শিয়ালদা থেকে দার্জিলিং মেল সারারাত ধরে সামত্মাহার পার্বতীপুর হয়ে সকালবেলা জলপাইগুড়ি আসত আর তার দৌড় শেষ হতো শিলিগুড়িতে। টয় ট্রেনে যেতে মজাই লাগছিল। কখনো এদিকের জানলায় গাছপালা, জঙ্গল, পাহাড়, কখনো ওদিকের জানলায়। কখনো এপাশে কুয়াশা, কখনো ওপাশে কুয়াশা। একবার কুয়াশার পর কুয়াশার ভেতর দিয়ে হাপুস-হুপুস করে হাঁপাতে-হাঁপাতে আমাদের নিয়ে ট্রেনটা মোটা দড়ির ফাঁসের মতো পাক খেয়ে নিচের পাহাড় থেকে উঠে পড়ল ওপরের পাহাড়ে। আবার একবার চলতে-চলতে হঠাৎ থেমে পড়ল, তারপর চলতে শুরম্ন করল পেছনের দিকে।
এভাবে কখনো সামনে কখনো পেছনে কখনো পাক খেয়ে আমরা একসময় পৌঁছলাম দার্জিলিং স্টেশনে। চকবাজার পর্যমত্ম হাঁটাপথে এসে আমরা পশ্চিমের ঢাল দিয়ে নিচের দিকে একটা পথে এঁকেবেঁকে নামতে লাগলাম। চন্দ মাসিমা নামতে-নামতে জানালেন এই পাহাড়ের অনেক বাসিন্দাই বাঙালি, তাই এটাকে বাঙালিপাড়া বলা যায়। বোধহয় পাড়াটার নাম চাঁদবাড়ি। ডানদিকে কালীবাড়ি আর লাইব্রেরি। নামতে-নামতে শেষ পর্যমত্ম চন্দ মাসিমার বাড়িতে পৌঁছে বিশ্রাম। রাসত্মা ছেড়ে গেট খুলে ঢুকে প্রথমে বারান্দা আর বাড়ির গেটটা না খুলে মানে বাঁ-দিকে রেখে সোজা এগিয়ে গেলে রাসত্মাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেই বাঁকের মুখে যে বড় গেটটা সেটা বোটানিক্যাল গার্ডেনসের গেট। মানে চন্দ মেসোর বাড়ির সামনে মাত্র কয়েক পা দূরে ছিল দার্জিলিং বোটানিক্যাল গার্ডেনস। লয়েড বোটানিক্যাল গার্ডেনস।
আবছা মনে পড়ে যে, বারান্দা থেকে ভেতরে ঢুকে প্রথম ঘরটা ছিল বসবার আর তার দেওয়ালে সাজানো ছিল ভালুক মহিষ হরিণ প্রভৃতি জন্তু-জানোয়ারের মাথা। বসবার ঘরের পেছনে ছিল খাবার ঘর। এই দুটো ঘরের দুপাশে ছিল দুজোড়া ঘর, যে-ঘর-জোড়া ছিল রাসত্মার ধারে, সে দুটো ছিল চন্দ মাসি-মেসো ও তাঁদের দুমেয়ের। আমরা যে-ঘর-জোড়াতে ছিলাম তার জানলাতে ছিল নজর
আড়াল-করা কিছু গাছপালা। সে-বাড়ির বাথরম্নম সম্বন্ধে কোনো কিছুই মনে পড়ে না, শুধু এটুকু মনে আছে যে, ঠান্ডা জলের কোনো ব্যাপার ছিল না। বাথরম্নমে সবসময়ই গরম জল পেতাম।
দার্জিলিংয়ে যাঁরা বেড়াতে যান তাঁদের প্রধান বেড়াবার জায়গা হলো ম্যাল। এটা পাকা বাঁধানো একটা যেন মাঝারি মাপের খেলার মাঠ। পশ্চিম দিকে বিলিতি ঢঙের কয়েকটা বাড়ির নিচে সারি-সারি চোখ ভোলানো নানা জিনিসের দোকান। আর পুবদিকে সবুজ পাহাড়ি গভীর উপত্যকা। উত্তর দিকে একটা পাহাড় যার মাথায় আছে মহাকালের মন্দির আর দক্ষিণ দিকের পাহাড়টার নাম জলাপাহাড় ও কাটাপাহাড়। এই মাঠটার, মানে ম্যালের ধারে-ধারে আছে বসার বেঞ্চ আর বেঞ্চগুলোর মাথায় ছাউনি। মহাকাল মন্দিরের পাহাড়টা ঘিরেই হেঁটে-হেঁটে বেড়ানো হচ্ছে দার্জিলিং বেড়ানোর আসল মজা। পাহাড়টার উত্তর ও পশ্চিমের দিগমত্মজুড়ে চুপ করে শুয়ে আছে বরফের বিরাট পাহাড়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে জলপাইগুড়িতে মায়ের কোয়ার্টার্সের সামনের রাসত্মা থেকেও এই বরফের পাহাড়টা দেখা যায়, কিন্তু ম্যাল থেকে কাছের দেখার আনন্দটাই আলাদা। দার্জিলিংয়ের ম্যালে বেড়ানোর কথা আমরা দার্জিলিংয়ে আসার আগে থেকেই শুনেছিলাম।
কিন্তু চন্দ মেসো-মাসির বাড়ি থেকে ম্যালের উচ্চতা ও দূরত্ব দুটোই অনেকখানি। দার্জিলিংয়ে তো জলপাইগুড়ির মতো ঘোড়াগাড়ি পাওয়া যায় না, হেঁটেই যেতে হবে। চন্দ মাসিমা পরামর্শ দিলেন চকবাজার পর্যমত্ম হেঁটে-হেঁটে উঠে পুশপুশ গাড়ি নেওয়ার জন্য। তখনকার দিনে দার্জিলিংয়ে পুশপুশ বলে একরকম রিকশা পাওয়া যেত। চড়াই ওঠার সময় সে রিকশা দুজন সামনের দিকে টানত আর পেছনের থেকে ঠেলত দুজন। আবার উতরাইয়ে নামার সময়ও দুজন পেছনের দিকে টানত আর সামনের দুজন
গড়িয়ে-পড়া আটকাত। এই রিকশাকেই বলত পুশপুশ। যারা ওই পুশপুশ
টানা-ঠেলার কাজ করত তাদের পোশাকের বৈশিষ্ট্য ছিল – গায়ে থাকত আলখালস্নার মতো লম্বা ঝুলের জামা, আর তার ওপরে, যতদূর মনে পড়ে, কোমর বা পেট থেকে ঝুলত হাঁটু-888sport app শতরঞ্জির মতো একটা মোটা কাপড়, বোধহয় ওই কাপড় দেখে বোঝা যেত কে বিবাহিতা, কে নয়। তাদের মাথায় থাকত লম্বা চুলের বিনুনি। শুনেছিলাম এরা দার্জিলিংয়ের আদিবাসী লেপচা-ভুটিয়া। চন্দ মেসোদের দার্জিলিংয়ের বাড়ি দেখভাল করত এক লেপচা পরিবার, আমরা বাঙালি কায়দায় তাদের লেপচা দিদি, লেপচা দাদা বলতাম।
যাহোক, পুশপুশ ছাড়াই বোধহয় দুদিন ম্যালে গিয়েছিলাম। আসলে প্রথম যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন ম্যাল আর আশপাশের সবকিছু 888sport app ছিল ঘন কুয়াশাতে, পশ্চিমের বরফ-888sport app পাহাড় আর পুবের উপত্যকা কিছুই দেখতে পাইনি। তবে ম্যালের চত্বরে দেখেছিলাম রংবেরঙের জামাকাপড়ের কিছু সাজগোজ করা লোকজন ও ছেলেমেয়ে এবং তাদের কাছে সবুজ পোশাকে কিছু ষ-াগু-ার মতো কালো-কালো চেহারার দৈত্য। পরে বুঝেছিলাম যে, এই দৈত্যরা আসলে ছিল মিলিটারি ও আফ্রিকার মানুষ, কিছুদিনের জন্যে বেড়াতে এসেছে ছুটি নিয়ে, হয়তো ফিরে গিয়ে যাবে যুদ্ধ করতে। আমার এখনো মনে আছে যে, তারা ম্যালে আসার পরে পরেই যারা এতক্ষণ ম্যালে বেড়াচ্ছিল তাদের অনেকেই ম্যাল ছেড়ে চলে গেল কোথায়। একে কুয়াশায় 888sport app চারদিক, তার ওপরে ওই মিলিটারিদের উপস্থিতি, এই দুয়ের জন্যে আমরাও নেমে এসেছিলাম তাড়াতাড়ি। কিন্তু দার্জিলিং ছেড়ে আসার আগে আর-একদিন গিয়েছিলাম ম্যালে। সেদিন আমরা বেশ পরিষ্কার রোদে ঝলমল দিন পেয়েছিলাম, উত্তর-পশ্চিমে দেখেছিলাম ঝকঝকে বরফ-888sport app পাহাড়ের ঢেউয়ের পর ঢেউ যেন দুলতে-দুলতে হঠাৎ থমকে অচল হয়ে গেছে।
কিন্তু কোনোদিনই আমরা ম্যালের ব্যান্ড পার্টি দেখিনি বা শুনিনি। তখনকার দিনে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে দার্জিলিং পুলিশের ব্যান্ড পার্টি জমকালো পোশাকে সেজে এসে নানা মাপের ড্রাম ট্রামপেট ঝাঁঝর ইত্যাদি বাজনা বাজাত আর তাদের পা-া একটা লম্বা ব্যাটন হাতে নানারকম অঙ্গভঙ্গি করত। তাদের কা- দেখবার ও শোনবার জন্য ভিড় জমে যেত। তবে চন্দ মেসো-মাসিদের অত নিচের বাড়ি থেকে কোনোদিনই আমরা ঠিক সময়ে ম্যালে পৌঁছতে পারিনি, শুধু তার গল্পকথা শুনেই আমরা ফিরে আসতে বাধ্য হই, কারণ হাসপাতালে মায়ের ছুটি ফুরিয়ে গিয়েছিল।
বোধহয় দিন পাঁচ-ছয় ছিলাম সেবার। দাদার তখন বছর ন-দশ বয়স ছিল আর তখন থেকেই তাঁর ছিল পড়ার নেশা। চন্দ
মেসো-মাসিদের বাড়িতে থাকত যে-পরিবার তাদের ছিল দাদার বয়েসি এক ছেলে। দাদার সঙ্গে সে ভাব করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু বই পেলেই দাদার হতো, আর কিছু চাই না। এই লেপচা পরিবারটির একটি মেয়েও ছিল আমার বয়েসি। তার সঙ্গে আমার বেশ ভাব জমেছিল। আমরা দুজনে সামনের বোটানিক্যাল গার্ডেনসে খেলতে যেতাম। কত হরেক রকমের, কত হরেক রঙের, কত বাহারের ফুল যে ছিল, তার ইয়ত্তা নেই। বাগানে ছিল মসত্ম কাচের ঘর, তাতে টবে ও দড়িতে শিকে করে ঝোলানো ছিল এমন সব ফুল-লতার ফণা ও শুঁড় যেসব আমি আগেও দেখিনি, পরেও দেখিনি। কোনো ফুল যেন হলুদ রঙের উড়মত্ম বক, কোনোটা যেন ডানা মেলে-দেওয়া গাঢ় বেগুনি রঙের প্রজাপতি, আবার কোনো লতাতে ফুটেছে ছোট মাপের গোলাপ। বাগানটা ছিল ফুলে-ফুলে মাতাল। কিন্তু যখন আমরা চলে আসি তখন অত ফুলের ফোয়ারা হাতের কাছে থাকা সত্ত্বেও সেই আপেলের মতো মুখের মেয়েটি আমাকে পাহাড়ের গা থেকে তুলে দিয়েছিল আকাশের তারার মতো ছোট্ট একটি ডেইজি ফুল। ঘন কুয়াশায় সেই প্রথমবার দার্জিলিংয়ে যাওয়ার সব 888sport sign up bonus মুছে গেলেও আমি বছরের বেড়া ডিঙিয়ে দেখছি, সেই বছর ছয়েকের নাম ভুলে-যাওয়া লেপচা মেয়ের দেওয়া ডেইজি ফুলটির কথা কনে দেখা আলো মাখানো আকাশে সবে ফোটা সাঁঝের তারাটির মতো আজো জেগে আছে। সবসময় নয়, কিন্তু কখনো-কখনো মনে পড়ে।
এর পরেও অনেকবার দার্জিলিং ও কয়েকবার কালিম্পং গিয়েছি। পরেরবার বোধহয় ১৯৪৪-৪৫ সালে, মায়ের কোনো রোগীবাড়িতে। সেবারে জেনেছিলাম ফুল কথাটার আর একটা মানে আছে – এই মানের ফুলটা মায়ের পেট থেকে বাচ্চার জন্মের ঘটনার সঙ্গে জড়ানো। বাচ্চা বেরিয়ে এসেছে, কিন্তু ফুল বেরোচ্ছে না। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে নতুন মা। তাই আমার ডাক্তার মাকে ডাকতে এসেছেন নতুন মায়ের আত্মীয়স্বজন। মা আমাকে বাবা বা দাদা কি বাড়ির লোকজনের ভরসাতে রেখে যেতে পারলেন না, আমাকে সঙ্গে নিয়েই দার্জিলিং গেছলেন। কিন্তু সে যাওয়ার কথা কিছু মনে নেই আমার, শুধু মনে আছে যে ওই বাড়ির কাছে ছিল মহারানি গার্লস স্কুল। বাড়িটার মাথায় ছিল শিলিগুড়ি-দার্জিলিংয়ের বড় রাসত্মা, যা হিল কার্ট রোড নামে সবাই জানে। আর ওই রোগীবাড়ির কাছেই ছিল এক বাঙালি পরিবারের বাড়ি, ওই বাড়ির একজনকে জেনেছিলাম আমাদের আত্মীয় এবং আরো পরিষ্কার করে দাদু বলে। এই দাদুটির নাম ছিল বীরেন কুশারি। তাঁকে জলপাইগুড়িতেও আমাদের বাড়িতে আসতে দেখেছি। বোধহয় বাবা-কাকার সুবাদেই আসতেন। বীরম্ন দাদুরা দার্জিলিংয়ে থাকতেন এক বড় পরিবার হিসেবে। পরে জেনেছি যে, বীরম্ন দাদুর এক ভাই ছিলেন ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনিয়ার। এই দুজনের কথা আমার এই 888sport sign up bonusকথায় পরে আসবে। তাঁদের আর-এক ভাই ছিলেন দার্জিলিং কোর্টের উকিল।
দার্জিলিং শহর ছাড়া কালিম্পংয়েও গেছি মায়ের সঙ্গে। কিন্তু কালিম্পংয়েরও কোনো 888sport sign up bonus নেই। তবে একটা 888sport sign up bonus মনে আছে যা আজকের কালিম্পং-যাত্রীদের, এমনকি হয়তো কালিম্পংয়ের অনেক বাসিন্দারও কৌতূহল জাগাতে পারে। সেটা হলো, টয় ট্রেনে করে কালিম্পং যাওয়ার 888sport sign up bonus। তখনকার দিনে শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পংগামী টয় ট্রেনের লাইন ছিল। ট্রেনে করে কালিম্পং যাওয়ার পথে জানলা দিয়ে গাছপালার ফাঁকে-ফাঁকে মধ্যে-মধ্যে ডানদিকের খাদের অনেক নিচে দেখা যেত তিসত্মার ধূসর-নীল জলের অাঁকাবাঁকা ধারা। আর তিসত্মার ওপারে আবার উঠে গেছে যে খাড়া পাহাড় তার গায়ে ঘন জঙ্গল। একবার ট্রেনের জানলা দিয়ে ওপারের জঙ্গলের ডালে-ডালে বানরদের লাফালাফিও দেখেছিলাম। মায়ের সঙ্গে কালিম্পংয়ে যাওয়ার এই 888sport sign up bonusটাই মনে আছে আজো। আর মনে পড়ছে, একদিন মাথা উলটে দেখেছিলাম বিশাল আকাশের গায়ে অসংখ্য তারার ঝিকিমিকি।
সেই বছরেই বা পরের বছরে আমাদের পরিবারে কিছু উলটোপালটা ঘটনা ঘটে। দাদা ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলেন আর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আকাশে নয়, অন্য শহরে, নিজের মতো স্বাধীন জীবনের সন্ধানে। কলকাতা থেকে ছোট মামিরা এসে দাদাকে নিয়ে গেলেন নিজের কাছে, পরে দাদা প্রেসিডেন্সি কলেজে ঢুকে হিন্দু হোস্টেলে পেলেন থাকার সুব্যবস্থা। বছর তিনেক কাটল মায়ের সঙ্গে আমার দুঃখ-সুখের দিন। আমার ম্যাট্রিক পরীক্ষার পরে গরমের ছুটির সময় দাদা এলেন জলপাইগুড়িতে আর তার পরেই ছোটকাকা-কাকিমা এলেন তাঁদের দুমেয়ে ও ছেলেকে নিয়ে। দাদা শুধু যে ভালো ছাত্র ছিলেন তা নয়, কাকা-কাকিমাদের সঙ্গেও তিনি ভালো যোগাযোগ রাখতেন, এমনকি ভিন্ন শহরবাসী ও স্বাধীন জীবনযাপনকারী বাবার সঙ্গেও। যাহোক, দাদা ও ছোটকাকার পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৫০ সালের মে মাসের মাঝামাঝি আমরা সবাই মিলে দার্জিলিং বেড়াতে গেলাম।
তখনকার দিনে দার্জিলিংয়ে বাসা ভাড়া হতো মরশুমের হিসেবে অর্থাৎ দুমাস কি তিন মাসের কড়ারে। আমরা হিল কার্ট রোডের নিচে গুডি রোডে একটা বাসা ভাড়া পেয়েছিলাম। এটা ছিল একটা দোতলা বাড়ি। গুডি রোডের সমান মাত্রায় মানে বরাবর বাড়িটার দোতলায়
থাকতেন বাড়ির মালকিন সুধীরাদি আর রাসত্মা থেকে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে একতলায় ছিল পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাট, যার একটাতে থাকতেন দার্জিলিংয়েই কোনো চাকরিতে নিযুক্ত এক বাঙালি পরিবার, যাদের দুটি ছেলে ছিল, একজনের বয়স সাত-আট, অন্যটি আরো ছোট। অন্য ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিলাম আমরা। আমরা ভাড়া নেওয়ার কয়েকদিন পরেই পাশের ফ্ল্যাটের পরিবারে দুজন অতিথি এলো। তারা দুজন আসলে ভাইবোন, কিন্তু সম্পর্কে মামাতো-পিসতুতো কিংবা ওইরকম কিছু সম্পর্কের, যা আমার আর মনে নেই। বোনটির নামটুকুই শুধু মনে আছে, তার নাম ডালিয়া।
আমার মতোই ডালিয়াও কলকাতার কোনো স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল। পরীক্ষার পরে তার বাবা-মা তাকে সম্পর্কের এক দাদার সঙ্গে দার্জিলিংয়ে তার মাসি-মেসোর কাছে বেড়াতে পাঠিয়েছিলেন। কথা ছিল ওই দাদা তাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরে যাবে কলকাতায়। কিন্তু ডালিয়াকে দার্জিলিংয়ে পৌঁছে দিয়ে দাদাটি আর কলকাতায় ফিরে যাওয়ার নাম করে না। নানারকম কারণ দেখিয়ে দাদাটি তার কলকাতায় যাওয়ার দিনটি ক্রমাগত মুলতবি করে যাচ্ছিল। মধ্যে থেকে মাসির কাছে বকুনি খাচ্ছিল ডালিয়া। ও-পাশের ফ্ল্যাটে যে একটা অশামিত্ম পাকাচ্ছে তা আমরা এ-পাশের ফ্ল্যাট থেকেও টের পাচ্ছিলাম আর সে-অশামিত্ম নিয়ে কাকা-কাকিমা ও মা অনেক সময় চাপাগলায় আলাপ করতেন। ডালিয়ার মা-বাবাই ভুলটা করেছেন ওভাবে মেয়েকে সম্পর্কের এক দাদার সঙ্গে পাঠিয়ে।
একদিন আমি আমাদের ফ্ল্যাটের বাইরে রেলিংঘেরা জমিটার ধারে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে পশ্চিমের আকাশ ছাওয়া কুয়াশার
দুলতে-দুলতে ভেসে-যাওয়া দেখছি, এমন সময় পাশের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এসে ডালিয়াও দাঁড়াল লোহার রেলিংয়ে ঠেসান দিয়ে। সুধীরাদির বাড়ির এই লোহার রেলিংগুলোর ওপারে পাহাড়ের খানিকটা ঢাল নেমে গিয়ে মিশেছে নিচের রাসত্মায়। আমি ডালিয়াকে সাবধান করার জন্য বললাম, ‘এই রেলিংয়ে বেশি ভর দেবেন না, হেলে পড়লে নিচে গড়িয়ে যাবেন।’ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে ডালিয়া বলল, ‘ভালোই হবে। সব মিটে যাবে।’ ফোঁস-ফোঁস আওয়াজে বুঝলাম ডালিয়া কাঁদছে। উচিত-অনুচিত না বুঝে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে?’ ডালিয়া কাঁদতে-কাঁদতে বলল, ‘মেয়ে হয়ে জন্মেছি – সব দোষ তো আমার।’ এমন সময় ভেতর থেকে ডাক এলো, ‘ডলি, ডলি।’ কয়েকবার ডাকাডাকির পরে ‘ওই, আবার শুরম্ন হয়েছে! এবার বোধহয় আপনার সঙ্গে কথা বলা নিয়ে নতুন মামলা হবে’ বলে ডালিয়া চলে গেল ভেতরে।
স্বভাবতই বাবার স্বতন্ত্র জীবন নিয়ে কাকার সঙ্গে মা ও আমার একটা নিগূঢ় ব্যবধান ছিল আর কাকিমা ও দাদা চেষ্টা করতেন একটা সেতু বাঁধবার। তবে মোটের ওপর দুপরিবার মিলেমিশে
খুব-আনন্দেই দিন কাটছিল। একদিন আমাদের মাথার ওপর হঠাৎ দুধ বৃষ্টি হলো। মানে আমাদের ফ্ল্যাটের ছাদ থেকে ঝরঝর করে দুধ পড়তে লাগল। আমাদের ওপরতলায় থাকতেন মালকিন সুধীরাদি। দার্জিলিংয়ের অধিকাংশ বাড়ির মেঝে হতো পাইন কাঠের তক্তার। ছাদ সিমেন্টের হলে মেঝে কাঠের, যাতে মেঝে থেকে ঠান্ডা না ওঠে। ব্যাপারটার রহস্য ভেদ হয় পরে। সুধীরাদি ছিলেন স্বামী মোহনানন্দ ব্রহ্মচারীর ভক্ত বা শিষ্যা। গুরম্নদেবকে খাওয়াবেন বলে বেশি করে দুধ নিয়েছিলেন আর দুধটা জ্বাল দেবেন বলে উনুনে চড়াবার জন্য রান্নাঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় দুধের বাসনটা উলটে যায়, ছড়িয়ে পড়ে ঘরের মেঝে জুড়ে। সেই দুধই তক্তার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়েছিল আমাদের ফ্ল্যাটে। চলিস্নশ বছর পরেও কাকিমা আমার স্ত্রীকে দুধ-বৃষ্টির গল্প বলে হাসাহাসি করেছেন।
সেবার দার্জিলিংয়ে কয়েকজন ছিলেন বিশেষ আকর্ষণের ব্যাপার। একজন ছিলেন মোহনানন্দ ব্রহ্মচারী। তাঁর পরনে থাকত সিল্কের লুঙি, চাদর বা উড়নি, মুখশ্রী ছিল যিশুখ্রিষ্টের মতো, পায়ে থাকত ভেলভেটের স্ট্যাপ দেওয়া খড়ম আর সর্বদা সঙ্গে থাকত বেশ কিছু সুবেশী ও সুবেশিনী। আর একজন ছিলেন সুন্দরী তরম্নণী, তাঁকেও সারাক্ষণ ঘিরে থাকত একদল যুবক-যুবতী। ইনি আসলে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের তখনকার গভর্নর কৈলাসনাথ কাটজুর মেয়ে। তাঁর নাম আজ আর মনে নেই। আরো একজন ছিলেন, যাঁকে ঘিরেও সবসময় থাকত ছোটখাটো ভিড়। তাঁকে অনেক বাঙালি ভালোই চেনেন অভিনেতা পাহাড়ি সান্যাল নামে। তিনি রোজ একবার করে কিছুক্ষণ সময় কাটাতেন ম্যালের পশ্চিমে অক্স্ফোর্ড বুক স্টোর্সে। ওই বইয়ের দোকানটি ছিল দার্জিলিংয়ের একটা ল্যান্ডমার্ক – এখনো আছে কি না জানিনে। মায়ের চেনা একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গেও আমাদের দেখা হলো ম্যালে। জলপাইগুড়ির ডিআইজি হীরেন গুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী পদ্মা গুপ্ত। আসলে মিসেস গুপ্তের সঙ্গেই মায়ের ভাব ছিল। তাদের ছেলে অমিতাভ ছিলেন দাদার কলেজবন্ধু। পরে তিনি সাংবাদিক হিসেবে নাম করেন কিন্তু মারা যান অকালে। বোধহয় দিন পাঁচেক তাঁরা সার্কিট হাউসে ছিলেন।
ম্যালে গেলে প্রতিদিনই চেনাজানা কোনো-না-কোনো মুখের দেখা পাওয়া যেত। চেনাজানা মানে সিনেমার পর্দায় দেখা মুখ। যেমন চন্দ্রাবতীকে দেখেছিলাম। তখনো দার্জিলিংয়ে অনেক ইউরোপীয় নর888sport promo code বাস করতেন। সবারই আলোচনার একটা বাঁধা বিষয় ছিল – কী রোদ্দুরে ঝলমলে দিন! জুন মাস পড়ে গেলেও মেঘবৃষ্টির দেখা নেই। একদিন ছোটকাকা বীরম্ন দাদুকে ধরে নিয়ে এলেন আমাদের ফ্ল্যাটে। বীরম্ন দাদুও বললেন যে, ছোট থেকে দার্জিলিংয়ে আছেন, কিন্তু এত বছরেও এমন খটখটে ঝকঝকে জুন মাসের শুরম্ন দেখেননি। আমাকে বীরম্ন দাদুও বকুনি দিলেন একটা ব্যাপারে। ব্যাপারটা আমি চেপে গিয়েছিলাম বাড়িতে। পুলিশ একদিন আমাকে ম্যালে গ্যালপ করে ঘোড়া ছোটাবার জন্য ধরেছিল। আমি জানতামও না কাকে গ্যালপ বলে। তবে একটা বড় ঘোড়ার পিঠে চড়ে খুব জোরে ছুটিয়েছিলাম। মায়ের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে আমি ম্যালে গিয়ে প্রতিদিনই কিছুক্ষণ ঘোড়ায় চড়তাম আর ম্যালের ঘোড়াওয়ালারা আমাকে বেশ চিনে গিয়েছিল। একদিন আমি ঘোড়ায় চড়ার পর সহিসটা এমনভাবে তার পেছনে থাবড়া বা চাবুক মেরেছিল যে, ঘোড়াটা ছুট লাগিয়েছিল বেদম-বেপরোয়া। সামনে পড়ে গিয়েছিল একটা প্যারামবুলেটর যাতে ছিল একটা বাচ্চা। ঘোড়াটা আমাকে নিয়ে গিয়ে বাচ্চাসুদ্ধ সেটা লাফিয়ে পার হয়ে যায়, হইচই পড়ে যায় চারদিকে, 888sport app সহিস ছুটে আসে আর বাঁশি বাজাতে-বাজাতে ধেয়ে আসে কয়েকজন পুলিশ। তখন আমাকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচান বীরম্ন দাদুর ভাই ইঞ্জিনিয়ার দাদু যাঁর নাম ছিল যতদূর মনে পড়ে জ্যোতিদাদু। এখানে জানিয়ে রাখি যে, দার্জিলিংয়ে এসে কাকা প্রথমেই বীরেন কুশারি অর্থাৎ কুশারিবাড়ির সঙ্গে পুরনো সম্পর্ক ঝালিয়ে নিয়ে বেশ ঘনিষ্ঠতা বানিয়ে নিয়েছিলেন। আমারও স্কুলের বন্ধু মৃণাল মুখোপাধ্যায় কী সুবাদে যেন এসে কুশারি পরিবারে থাকে। ওদের মধ্যে একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল এবং মৃণাল থাকাকালে আমি কুশারিবাড়িতে গেছিও।
এমনই খুচরো নানা কথা মনে আসছে লিখতে-লিখতে। আর মনে আসছে আমার তখন খুব প্রিয় 888sport app download apk ছিল ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ 888sport app download apkটি, যখন-তখন সেটি আওড়াতাম এবং কাকিমা ও তাঁর বাচ্চা দুটিও হাতের মুঠো সুধীরাদির উদ্দেশে ছুড়ে একসঙ্গে বলতাম ‘উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ।’ কাকিমা শেষ বয়সেও দেখা হলে আমাকে বলতেন, ‘মনে আছে, উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রন গুচ্ছ?’ তবে মাঝে-মাঝেই রডোডেনড্রনের নাম করে আওয়াজ উঠলেও আমরা কেউ তখনো দেখিনি যে, রডোডেনড্রন গাছ বা ফুলটা কেমন হয়। দাদা বললেন, ‘তোমরা ভুল করছ, রবীন্দ্রনাথ তো রডোডেনড্রন দেখেছেন শিলং পাহাড়ে।’ পরে জেনেছি, আসলে রডোডেনড্রন মে-জুন মাসের ফুল নয়, শীতের ফুল, জানুয়ারি-ফেব্রম্নয়ারিতে ফোটে। দেখতে কিছুটা মোরগের ঝুঁটির মতো।
যাহোক, জুন মাসের কয়েকটা ঝকমকে দিন কাটার পরে একদিন বৃষ্টি এলো বেশ হাঁকডাক করে। ভেবেছিলাম কিছুক্ষণ পরে থেমে যাবে। কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরেও থামার নামগন্ধ নেই। পড়ছে তো পড়ছেই, একঘেয়ে, একটানা। অবিরাম ঝরঝর বৃষ্টি পড়ার মধ্যে একটা এমন কোনো ফাঁক নেই যে, মাথা বের করে গলাটা বেঁকিয়ে আকাশের চেহারাটা দেখি। একটা পুরো দিন কেটে গেল এভাবে। সারারাত ধরে চলল বৃষ্টি। পরদিনও ওইরকম টানা বৃষ্টি সকাল থেকে সন্ধে পর্যমত্ম। বৃষ্টির অবিশ্রামত্ম ঝরঝরানির মধ্যেই আমরা পাশের ফ্ল্যাট থেকে শুনতে পেলাম উঁচু গলার কথাবার্তা। দুদিন ধরে বৃষ্টির টানা ঝিমঝিম শব্দের চাপে পাশের ফ্ল্যাট সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহল এখন আপনিই ঝিমিয়ে পড়েছে। পরদিন দুপুর নাগাদ বৃষ্টির ঝাঁপ যখন হালকা হয়ে এসেছে তখন হঠাৎ জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম মাথায় মাঝারি মাপের একটা সুটকেস চাপিয়ে ডালিয়ার দাদা কোথায় বেরিয়ে যাচ্ছে আর শুনতে পেলাম পাশের মাসিমা বলছেন, ‘আজকের দিনটা থেকে যাও, এই দুর্যোগে বেমক্কা ঝাঁপিয়ে পোড়ো না।’ চোরা না শোনে ধর্মকথা। বিকেলের পরে আরো চেপে এলো বৃষ্টি। তাই দেখে কাকা-কাকিমা আর মা বলাবলি করছিলেন, সত্যিই তো, এই বৃষ্টিতে কোথায় গেল ছেলেটা! পাগল ছাড়া এ ঘোর বৃষ্টিতে কেউ শখ করে বাইরে বেরোয়! আর বৃষ্টি বলে বৃষ্টি। যেন এতদিন ঝড়বৃষ্টি না হওয়ার জন্য জলজমির যা ক্ষতি হয়েছে তা এই এক বর্ষাতে মিটিয়ে দেওয়ার, এতদিনের সব ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার জন্য খেপে গেছে গোটা আকাশ। আর ঠিক অন্ধকার নামার আগে হঠাৎ ঝুপ করে বিজলি আলো চলে গেল। আমাদের ফ্ল্যাটের পুবদিকে রান্নাঘর ও পাশে বাথরম্নম এবং ওদিকের দেওয়ালের ওপারেই পাহাড় বলে ওই ঘর দুটোতে দিনের বেলাতেও ইলেকট্রিক বাতি না জ্বালালে যাওয়া যায় না। তাই বিজলি যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে কাকা শঙ্কিত হয়ে ছাতা মাথায় বেরিয়ে গেলেন এবং বেশ কিছুক্ষণ পরে, অন্ধকার ঘনিয়ে ওঠার পরে দাদা বড়-বড় মোমবাতি আর কয়েকটা মাঝারি মাপের টর্চ কিনে নিয়ে আসার সঙ্গে বাজারের খবর নিয়ে এলেন যে, শহরের কোথাও-কোথাও ধস নামছে, এই বৃষ্টি এভাবে চললে আরো ধস নামবে।
বাজারের গা-ঘেঁষে কোথায় যেন যাদের ঘর ধসে যেতে পারে তাদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সন্ধেবেলায় পাশের বাড়ির মেসো আরো ধসের খবর নিয়ে এলেন। এতদিন পাশাপাশি আছি, পাশের বাড়িতে গিয়ে কাকা-কাকিমা আলাপ করেও এসেছেন, মাসিমাও গল্প করতে এসেছেন আমাদের ফ্ল্যাটে, কিন্তু পাশের মেসো এই প্রথম এলেন দুর্যোগের খবর নিয়ে। কাকার সঙ্গে পরামর্শ করলেন, আমাদের সময় থাকতে-থাকতে এ-বাড়ি ছেড়ে বাজারে এভাকুয়েট করা ঠিক হবে কি না। কাকা মাকে কথাটা জিজ্ঞাসা করলেন। মা কিন্তু তখনই বাড়ি ছাড়তে রাজি হলেন না।
চার দিন চার রাত্রি বিরামবিহীনভাবে সমানে বৃষ্টির পর নতুন ভোরে বৃষ্টি থামল, আসেত্ম-আসেত্ম মেঘ কাটল, আবার একটু-একটু করে সামনের পাহাড় ফুটে উঠল চোখের সামনে। পাহাড়টা সামনের হলেও তার অবস্থান বেশ কয়েক মাইল দূরে। ওই পাহাড়ের মাথায় অনেকে ঘুম হয়ে ট্রেকিংয়ে যায়, সেই গমত্মব্যের নাম সন্দকফু, কেউ-কেউ আরো এগিয়ে ফালুটেও যায়। আমাদের সামনেরটাই সন্দকফু পাহাড়। সকালে যখন বৃষ্টি ধরে আকাশ পরিষ্কার হলো, তখন এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। চারদিন আগেও যেটা ছিল গাছ-জঙ্গলে 888sport app একটা সবুজ পাহাড় তার সারা গা-জুড়ে ধসের চিহ্ন, যেন সারারাত ধরে কোনো হিংস্র জানোয়ার বড়-বড় নখওয়ালা থাবা মেরে খাবলা-খাবলা মাংস ছিঁড়ে নিয়েছে, বেরিয়ে পড়েছে পাহাড়ের রক্তাক্ত মাংস সারা শরীরজুড়ে। আকাশ পরিষ্কার হলেও খারাপ খবর আসছিল চারদিক থেকে। পাশের মেসো খবর আনলেন, ধীরধামের লনটার অনেকখানি ধসে গেছে। দাদা ও আমি ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে গুডি রোডে উঠে দেখলাম সত্যিই ধীরধামের চারপাশ ঘিরে মাঠের মতো যে বিশাল সবুজ লনটা ছিল তার অনেকখানি নেই। যেটুকু আছে তার সবুজ অংশটার নিচের খাদ বেরিয়ে পড়েছে বীভৎস ক্ষতের মতো। তবু ভাগ্যি যে, ধীরধাম বাড়িটা আছে আর বাড়িটা ঘিরে আছে বেশ কিছুটা সবুজ লন আর স্টেশন থেকে ধীরধামে যাওয়ার রাসত্মা। আমরা গুডি রোড থেকে আমাদের ফ্ল্যাটে নামতে যাব এমন সময় নিচে থেকে উঠে এলো ডালিয়া আর পাশের মাসির বড় ছেলে। তারাও এসেছে রাসত্মা থেকে ধীরধামের ভাঙাচোরা চেহারা দেখতে। ডালিয়াকে দেখে দাদা নেমে গেলেন তাড়াতাড়ি।
‘দেখেছেন কী ব্যাপারটা ঘটেছে?’ আমিই যেচে জিজ্ঞেস করলাম। ডালিয়া বললেন, ‘হ্যাঁ, তাই ভাবছি।’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে যোগ করলেন, ‘কী যে হলো ছেলেটার! আর তো কোনো খবর নেই।’ বুঝলাম কার কথা বলছে। কিন্তু কী বলব বুঝতে পারলাম না। বললাম, ‘খবর আসা-যাওয়ার কোনো উপায় তো নেই। নিশ্চয়ই ঠিক পৌঁছে যাবে শিলিগুড়ি।’ তিন-চারজন লোক যাচ্ছিল। আমাদের দেখে নেপালি-হিন্দি মিলিয়ে জিজ্ঞেস করল যে, আমরা মকান ছেড়ে তাদের শেলটারে যেতে চাই কি-না। আমরা আমাদের বাড়িটা দেখাতে ওরা চলে গেল। আমাদের বাড়ির ধসেপড়ার ভয় নেই আন্দাজ করে। বাড়িতে ফিরে দেখলাম, সবার চোখেমুখে উদ্বেগ। সেই যে আগের দিন বিকেলে অল্প একটু জল এসেছিল কলে তার পরে আর জল আসেনি।
জল নেই, বিজলি নেই। কাকার সঙ্গে গিয়ে বাজারের মুখ
থেকে কাঠকয়লা নিয়ে এলাম। হিল কার্ট রোডে যেখানে রোপওয়ের গুদাম তার গায়েই কাঠকয়লা ও পাথুরে কয়লার দোকান। অবস্থা কোনদিকে যাচ্ছে, বুঝে নিয়ে কাকা আমাকে সঙ্গে করে সারাদিন ধরে বাজারের দোকানে-দোকানে পাক খেলেন। এভাবে দিনটা কাটল আমার।
পরদিন কাকা আমাকে পাকড়াও করার আগেই বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে। স্টেশনের কাছে তখন কাজ চলছে। দার্জিলিং স্টেশনের পশ্চিম দিকে রেলকর্মীদের কোয়ার্টার্স আর সেগুলোর গা-ঘেঁষে ধীরধামে যাওয়ার রাসত্মা। আশ্চর্যজনকভাবে ধীরধাম বেঁচে গেলেও এদিকে বেশ বিরাট ধস হয়েছে, রেল কোয়ার্টার্স পরিণত হয়েছে ধ্বংসসত্মূপে। খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। তাই দেখে আমি পেছনে ঘুরে ম্যালের রাসত্মা ধরে ম্যালের দিকে উঠতে লাগলাম। বাঁ-দিকে থাকল একটা চার-পাঁচতলা বিরাট বাড়ি, যার নাম চাচান ম্যানশন। বাড়িটার গায়ে ফাটল ধরেছে শুনলাম। ধসের প্রথম বড় দৃষ্টামত্ম দেখলাম ক্যাপিটলের মোড়টার আগে। এই রাসত্মাটার মাথার ওপরে ছিল জলাপাহাড়ে যাওয়ার পথে কুচবিহার মহারাজের বিশাল বাংলো, তার লাগোয়া ছিল চোখ-জুড়ানো বাগানের পাশে দুটো টেনিস কোর্ট, সেই জোড়া টেনিস কোর্ট ধসে পড়েছে নিচের অকল্যান্ড রোডের ওপরে, সেখান থেকে পড়েছে ক্যাপিটলের মোড়ে ল্যাডেন লা রোডের ওপরে রাসত্মাজুড়ে। কাদার ধ্বংসসত্মূপ সরিয়ে পাহাড়ের গা-ঘেঁষে এক ফুট চওড়া মতো পায়ে-চলা পথ বানানো হয়েছে ম্যাল রোডের দিকে যাওয়ার জন্য। সেই সরম্নপথ দিয়ে পৌঁছলাম ক্যাভেন্টার্সের সামনে, এখান থেকে উঠে গেছে ম্যাল রোড। গেস্ননারিজ পর্যমত্ম এগিয়ে আবার একটা ধস দাস স্টুডিওর সামনে। ধসের সঙ্গে একটা গাছ আড়াআড়ি পড়ে ম্যাল রোডটাকে আটকে দিয়েছে। গাছটা টপকে অনেকে আসা-যাওয়া করছে দেখে আমিও টপকে একটু এগিয়ে পৌঁছলাম ম্যালে। ব্যাপার-স্যাপার দেখবার জন্যে ম্যালেও ভিড় জমেছে ছোটখাটো। মহাকালের পাহাড় মানে অবজারভেটরি হিল ঘুরে যে-পথটা গভর্নর হাউস পর্যমত্ম গেছে, সে-পথটা মাঝখান বরাবর এমনভাবে ভেঙেছে যেন কেউ ধারালো ছুরি দিয়ে লম্বালম্বি কেটেছে। পুবের রাসত্মাটা দিয়ে একটু এগিয়ে ঝুঁকে দেখলাম নিচের স্টেপ অ্যাসাইড বাড়িটা অক্ষতই আছে। চিত্তরঞ্জন দাশের এই বাড়িটা ঐতিহাসিক বাড়ি। এই বাড়িতেই দেশবন্ধু শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন এবং শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন ভগিনী নিবেদিতাও। তাছাড়া বোধহয় ভাওয়াল সন্ন্যাসীর বিখ্যাত মামলার সঙ্গেও এ-বাড়িটা জড়িত। দেশবন্ধু ও নিবেদিতার 888sport sign up bonusবিজড়িত বাড়িটার কোনো ক্ষতি হয়নি দেখে যে-পথে গিয়েছিলাম সে-পথেই ফিরে এলাম আবার।
আবার দার্জিলিং স্টেশনে। সেখানে একটা ছোটখাটো জটলা। ম্যালের দিকে যাওয়ার সময় দেখেছিলাম স্টেশনটার পশ্চিমে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে কোয়ার্টার্সের দেওয়াল চাপা পড়ে কোনো মানুষ এখনো বেঁচে আছে কি না দেখবার জন্যে। তখন এ-ভিড় ছিল না। এখন ভিড় কেন? গিয়ে দেখলাম, পস্ন্যাটফর্মে রেলের অফিসঘরের দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসে আছে কাদাজলে মাখামাখি বছর বারো-তেরোর একটি মেয়ে আর তার বাঁ হাতে ধরা আছে একটা বাটি। আশ্চর্য! এই দেখতে এত ভিড়? তারপরে ভিড়ের কথাবার্তা থেকে বুঝলাম যে, আসলে এটা একটা মৃতদেহ। যখন ধস নামে ওদের ঘরের দেওয়াল ভেঙে তখন মেয়েটি বিছানায় ওইভাবে উবু হয়ে বসে হাতের বাটি থেকে মুড়ি খাচ্ছিল। যারা খোঁড়াখুঁড়ি করছে তারা ওকে ভাঙাচোরা কাদাফাদা সরিয়ে তুলে এনে পস্ন্যাটফর্মে বসিয়ে রেখেছে। এÿুনি সরকারি গাড়ি আসবে ওর দেহ তুলে নিয়ে যাবে বলে। ফিরে চললাম বাসায়। গুডি রোড থেকে নিচের বাসায় যাওয়ার সিঁড়িতেই কাকার সঙ্গে দেখা। আমার খোঁজেই বেরোচ্ছিলেন তিনি। বহুক্ষণ আমি নিরম্নদ্দেশ থাকাতে চিমত্মায় পড়েছিলেন বাড়ির মানুষ। একে তো পাশের বাড়ির ছেলেটা বৃষ্টি মাথায় করে কোথায় চলে গেছে কে জানে, তার ওপরে আমিও বেপাত্তা। যাহোক, একজন তো ফিরে এলাম।
আমি ফেরাতে মায়ের একটা চিমত্মা ঘুচল, কিন্তু আর একটা চিমত্মা উঠল মাথাচাড়া দিয়ে। কী করে ফেরা হবে জলপাইগুড়ি। মায়ের তো হাসপাতালে দুসপ্তাহ ছুটির পরে কাজে যোগ দেওয়ার ব্যাপার আছে। বীরম্ন দাদু ভরসা দিলেন – খোদ গভর্নর আটকা পড়েছেন, সব ব্যবস্থাই তাড়াতাড়ি হবে। জলের সমস্যাটাই প্রধান। মিউনিসিপ্যালিটি থেকে শহরের নানা জায়গায় জলের বড়-বড় ট্যাংক বসিয়েছিল। কাকা, দাদা, আমি এবং মা-ও সেরকম একটা ট্যাংক থেকে বালতি করে ঘাস-পাতাসুদ্ধ ঝর্নার জল নিয়ে আসছিলাম।
এমনই আসা-যাওয়ার পথে কার কাছ থেকে যেন একটা খোঁজ পাওয়া গেল। অনেকে হেঁটে জলাপাহাড়ের মিলিটারি রোড ধরে ঘুম স্টেশন পর্যমত্ম যাচ্ছে, তারপর হিল কার্ট ধরে সোনাদা। কিন্তু সোনাদার ধসটাই সবচেয়ে সাংঘাতিক। এখানে রাসত্মা বলতে কিছু নেই। সোনাদা স্টেশনের একটু আগে থেকে দড়ি ধরে-ধরে পাহাড়ের গা-বেয়ে উঠতে হবে বেশ কিছুটা, তারপর পাহাড়ের গা-বেয়েই এগিয়ে যেতে হবে গুটিগুটি পায়ে বাঁ-দিকে মংপুর রাসত্মা রেখে, তার পরে হিল কার্ট রোডে নামতে হবে টুং স্টেশনে। টুং থেকে কার্শিয়ং পর্যমত্ম ভাঙাচোরা কার্ট রোড দিয়েই যাওয়া যাবে। কার্শিয়ংয়ের পরে কিছু ছোটখাটো ধস আছে পাগলাঝোরাতে আর তিনধারিয়াতে। এখান থেকে গাড়ি যাচ্ছে শিলিগুড়ি পর্যমত্ম। এভাবে হেঁটে যাওয়ার জন্য শেরপা গাইডও পাওয়া যাবে খরচ দিলে, কুলিও পাওয়া যাবে মাল বওয়ার জন্য। এভাবে নাকি অনেকে যাচ্ছেন। হোটেলে-হোটেলে গাইডরা এসে খোঁজ করছে যে, কেউ এভাবে যাবে কিনা।
মাকে তো যেতেই হবে। তাই আমরা একদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম একদল অভিযাত্রীর সঙ্গে। শিলিগুড়িতে পৌঁছে শুনলাম জলপাইগুড়িতেও নাকি ওই বৃষ্টিতে ভীষণ বন্যা হয়েছে। গিয়ে কী হাল দেখব কে জানে! তাই সেদিন আমরা রাতটা শিলিগুড়িতে মায়ের এক রোগীবাড়িতে কাটালাম।
১৯৫০-এর পরেও অনেকবার দার্জিলিং গেছি। কিন্তু প্রত্যেকবারের কথা ঠিকঠাক মনে নেই। তবে ১৯৫২-এর মে মাসের কথা খুব মনে আছে। সেবার অন্নদাশঙ্কর রায় সপরিবারে দার্জিলিং এসেছিলেন। তখন তাঁরা থাকতেন শামিত্মনিকেতনে সিম্পল লিভিংয়ে। দার্জিলিংয়ে এলেন হাই লিভিংয়ে দুটো মাস ঠান্ডাতে ঠান্ডাতে কাটাতে। বাসা ভাড়া নিয়েছিলেন নর্থ পয়েন্টে লগ কেবিন নামে একটা বাড়িতে। তখন আমরা কয়েক বন্ধু মিলে দার্জিলিংয়ে বেড়াতে যাই আর নর্থ পয়েন্টের লগ কেবিনে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করি। অনেক রকম বিষয়ে অনেক কথার পরে মাস তিনেক আগের 888sport cricket BPL rateে ফেব্রম্নয়ারির ঘটনার কথা উঠল। অমনই তিনি সোজা হয়ে বসলেন। বললেন, ‘এই-যে এতগুলো তাজা তরম্নণ 888sport appর পথে বুকের রক্ত দিলো, এই রক্তদান বৃথা যেতে পারে না। শুধু আমাদের ইতিহাসে নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখতে পাবে, বিশ্ববাসী একদিন এই 888sport cricket BPL rateে ফেব্রম্নয়ারিকে 888sport apk download apk latest versionর সঙ্গে 888sport app download for android করবে।’ আজ সারা পৃথিবীজুড়ে এই তারিখটিকে 888sport app download for android করা হয় মাতৃভাষা দিবসরূপে। কিন্তু আমরা জলপাইগুড়ি ফিরে যখন সগর্বে সবাইকে বলছি যে, দার্জিলিংয়ে গিয়ে অন্নদাশঙ্করের মুখে এই কথা শুনেছি, তখন কেউ-কেউ ঠাট্টা করেছিলেন, এরকম কত 888sport cricket BPL rateে এলো-গেল কেউ তার হিসেব রাখে না।
আর একবার দার্জিলিংয়ে বেড়াতে গেছি, উঠেছি রিংক সিনেমার রাসত্মায় একটা হোটেলে। একই হোটেলে উঠেছিল দু-তিনজন ইউরোপীয় বা আমেরিকান ছেলে। একদিন রাতে তারা দলবেঁধে কোথায় বেরোচ্ছে দেখলাম। মুখোমুখি হতে তারা আমাকে ‘হ্যালো’ বলে সম্ভাষণ করলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘গোয়িং আউট?’ প্রশ্নটার কোনো মানে ছিল না, কারণ তারা যে বেরোচ্ছে সেটা দেখাই যাচ্ছিল। একজন বলল, ‘ইয়াহ্, টু আ মুভি।’ তাতেই জানলাম, সিনেমা কথাটা মানে হারাচ্ছে, নতুন মানে আসছে মুভি কথাটার। রিংক সিনেমা হলটা এখন নেই, কিন্তু এটাই দার্জিলিংয়ের প্রথম সিনেমা হল। রিংকের কথায় মনে পড়ল ১৯৫০-এ রিংকে রাজ কাপুরের বর্সাত অমত্মত দুবার দেখেছিলাম এবং পরে একবার আওয়ারাও দেখেছি।
আরো একবারের কথা বলি। সেবার ম্যালে দেখা হয়ে গেল জলপাইগুড়ির বিখ্যাত ধনী বীরেন ঘোষের ছেলে দেবব্রতর সঙ্গে। দেবব্রত আমার সঙ্গে জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে পড়ত। ম্যাট্রিক পাশ করে চলে যায় কলকাতায়। ভালো গান করত। তার সঙ্গে ছিলেন আরো দুজন আমাদের বয়েসি তরম্নণ। দেবব্রত আলাপ করিয়ে দিলো – অমর্ত্য সেন আর পার্থপ্রতিম গুপ্ত। ম্যাট্রিকে দুজনেই তাক-লাগানো রেজাল্ট করেছিলেন। পার্থপ্রতিম অকালে মারা যান, কিন্তু অমর্ত্য এখন বিশ্ববিখ্যাত বাঙালি। আর একবার দার্জিলিংয়ে গেছি, ম্যালে দেখা হয়ে গেল অন্নদাশঙ্করের বড় মেয়ে জয়া ও তাঁর সদ্য বিবাহিত বর অমিতাভের সঙ্গে। আমি তো অবাক। একমাসও হয়নি, তাঁদের বিয়ে হয়েছে এবং সে-বিয়েতে আমিও গিয়েছিলাম শামিত্মনিকেতনে। তখন তো শুনিনি যে, তাঁরা দার্জিলিং আসবেন হনিমুন করতে। তাঁরা এসেছেন তাঁদের মতো, আমি এসেছি আমার মতো। কিন্তু আমাকে টেনে নিয়ে গেলেন তাঁদের ডেরাতে। তাঁরা উঠেছেন ঘুমের বাতাসিয়া লুপের ওপরে সেনাবাস নামের বাড়িতে। এককালে এই সেনাবাস ছিল নামকরা বাড়ি। মনীন্দ্রলাল বসুর বিখ্যাত ‘দার্জিলিঙে’ গল্পটি লেখা হয়েছিল এই সেনাবাস নিয়েই। দিন চারেক অমিতাভ-জয়ার সঙ্গে কাটাবার পরে তাঁরা বললেন, চলুন আমাদের সঙ্গে সিকিমে। আমি এর জন্যে প্রস্ত্তত ছিলাম না। অমিতাভ লোভ দেখালেন যে, নাথুলা যাওয়া হবে।
সিকিম তখন ছিল ভারত থেকে স্বতন্ত্র রেসিডেন্টের অধীনে এক রাজ্য। রেসিডেন্টের সেক্রেটারির সঙ্গে পরিচয় অমিতাভের। গ্যাংটকে গিয়ে ওঁরা সেই সেক্রেটারি সাহেবেরই অতিথি হলেন, আমি উঠলাম একটা হোটেলে। যতদূর মনে হচ্ছে হোটেলটার নাম ডেনজং। তখন সেখানে মাত্র দুই-একটা হোটেল ছিল লেপচা-ভুটিয়াদের। গ্যাংটকে তিববতি সংস্কৃতিবিষয়ক একটা বিশাল গবেষণা কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল। একদিন সকালে আমরা নাথুলার উদ্দেশে রওনা দিলাম। আমার যথেষ্ট গরম জামাকাপড় ছিল না, যা ছিল তা দার্জিলিং বা গ্যাংটকের উপযুক্ত হলেও নাথুলার উপযুক্ত ছিল না। আমার তোয়ালেটাকেই আমি মাফলার করে নিয়েছিলাম। পথটা খুব সরম্ন। আমি ল্যান্ড রোভারের পেছনে বসেছিলাম। পিঠের চাপে বুঝতে পারছিলাম গাড়িটার বডি এক-এক সময় পাহাড়ের গায়ে ঘসটে যাচ্ছে। পথে পড়ল ছাঙ্গু হ্রদ। কী অদ্ভুত দৃশ্য! বিশাল হ্রদের সুনীল জল ঘিরে সাদা পাড়। ওই সাদা পাড়টা আসলে তুষার। ডান দিকে তুষারের পাড়ঘেরা হ্রদটাকে রেখে আমরা পৌঁছোলাম শেরাটুংয়ে ভারতীয় ফৌজদের ঘাঁটিতে। ফৌজিরা গ্যাস সিলিন্ডারের মতো লোহার উনুন ঘিরে বসে চা-টা খাচ্ছিলেন। উনুনে আগুন দেখেই আমরা আকুল হয়ে হাত বাড়ালাম হাত সেঁকার জন্য। ফৌজিরা সাবধান করে দিলেন – আগুনের অত কাছে হাত নেবেন না বা উনুনের লোহার গায়ে হাত দেবেন না। এখন বুঝবেন না, নিচে গিয়ে দেখবেন ফোসকা পড়ে গেছে। তাঁরাই তাড়া দিয়ে বললেন, নাথুলা যেতে হলে তাড়াতাড়ি যান, তুষারঝড় আসতে পারে। আবার রওনা দিলাম। বলতে ভুলে গেছি যে, অনেকক্ষণ থেকেই দেখছিলাম, আশপাশের গাছগুলো ক্রমশ বেঁটে হয়ে যাচ্ছে, তারপর একসময় আশপাশ একেবারে গাছপালা-শূন্য হয়ে গেল, শুধু তুষার, যাকে আমরা বরফ বলি। সামনের ওই টিলাতে উঠলে ওপারের খাদের নিচে চীনাদের দেখা যাবে। খুব বেশি হলে কুড়ি ফুট উঁচু হবে টিলাটা। কিন্তু আমরা খুব আসেত্ম-আসেত্ম হাঁপাতে-হাঁপাতে উঠলাম যেন বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গে আরোহণের ভীষণ পরিশ্রম করলাম। আসলে উচ্চতার জন্যে অঙিজেন কমে গেছে বলে এত পরিশ্রম মনে হচ্ছে। অঙিজেনের অভাবেই অঞ্চলটা বৃক্ষশূন্য। টিলার ওপর থেকে দেখলাম নিচে চীনা সৈন্যদের চলাফেরা করতে আর তাদের পেছনে একটা জিপ গাড়ি। ওরা জিপ গাড়ি পেল কী করে? শুনলাম ভারত থেকেই যায়। পার্টসগুলো খুলে নিয়ে মানুষের পিঠে-পিঠে চলে যায় এক-একটা গোটা জিপ। ভালো করে কিছু দেখবার আগেই আমাদের ঠেলে নামিয়ে দিলো তুষারঝড়। আমরা যখন নাথুলা থেকে নামছি তখন বাঁ-দিকে দেখি যে, সুনীল ছাঙ্গু হ্রদটা অদৃশ্য হয়ে গেছে, তার জায়গায় কেউ ছড়িয়ে দিয়েছে একটা বিশাল রেশমের সাদা চাদর। আসলে তুষারঝড়ে হ্রদের জল জমে তুষার হয়ে গেছে।
এটা বোধহয় ১৯৫৮ কি ৫৯-এর কথা। এর পরে ১৯৬২-তে বিয়ে করি এবং বিয়ের পর কখনো জুবিলি স্যানাটরিয়মে, কখনো অ্যালিস হোটেলে সস্ত্রীক গিয়ে থেকেছি, সেসব থাকার মেয়াদ পাঁচ-সাত দিনের বেশি নয়। একবার বাসা ভাড়া করে দিন বিশেক থাকলাম। আমার স্কুলের বন্ধু নির্মল সান্যাল তখন দার্জিলিংয়েই থাকতেন, চাকরি করতেন এলআইসিতে। তিনিই ব্যবস্থা করে দেন গুডি রোডে অথবা গুডি রোডের ঠিক নিচের রাসত্মায় তাঁর বাসার পাশে নাশপাতি বিল্ডিংয়ের একটা অংশে রান্নাঘর-বাথরম্নমসহ দেড়খানা ঘরের একটা ফ্ল্যাট এক মাসের জন্য। নিচের রাসত্মাটা পাক খেতে-খেতে কোথায় চলে গেছে কে জানে! একদিন দুর্বোধ্য কৌতূহলে সেই পথ ধরে নামতে-নামতে অবশেষে পৌঁছে গেলাম শ্মশানে। চারদিকে রডোডেনড্রন ও অজানা অনেক ঝোপঝাড়। কী অপূর্ব, কী মনোরম, কী শামত্ম! এখানেই ভগিনী নিবেদিতার নৌকো ডুবতে-ডুবতে পৌঁছে গিয়েছিল অগ্নিসিদ্ধ হতে। আবার আসেত্ম-আসেত্ম উঠে এলাম বাজার রান্নাঘর খাওয়া-দাওয়ার সংসারে। নির্মলের স্ত্রী শীলার মতো উষ্ণ হৃদয়ের সুগৃহিণী খুব কমই হয়। তাঁদের বছর তিনেকের মেয়ে নীলার গল্প লিখতে বসলে এ-লেখা বই হয়ে যাবে। নাশপাতি বিল্ডিংয়ে থাকাকালে আমাদের জলপাইগুড়ির বন্ধু সুরজিৎ বসু (যাঁকে আমরা বাচ্চুদা বলতাম) প্রায় সপ্তাহখানেক এসে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। ১৯৬৩ সালে আমরা দুবার দার্জিলিংয়ে যাই, একবার ছিলাম জুবিলি স্যানাটরিয়মে আর একবার নাশপাতি বিল্ডিংয়ে। একবার ম্যালে গিয়ে দেখি ম্যালের মুখগুলো আটকে সিনেমার শুটিং চলছে। কী ছবি? রাজ কাপুরের মেরা নাম জোকার। রাজ কাপুর কোথায়? ওই যে জোকার সেজে ডিরেকশন দিচ্ছেন। ভিড়ের মধ্যে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়! চলে এলাম। মজা এই যে, পরে যখন মঞ্জুর লরেটো কলেজের কাজে দার্জিলিংয়ে আসি থাকার জন্য তখন ক্যাপিটলে এই সিনেমাটাই দেখি। যাহোক, আমার স্ত্রী মঞ্জু বারবার দার্জিলিংয়ে আসার জন্য তিতিবিরক্ত হয়ে বললেন, ‘দেশে আর কোথাও বেড়াবার জায়গা নেই, প্রত্যেকবারই শুধু দার্জিলিংয়ে যাওয়া! এবার আমি দার্জিলিংয়েই চাকরি নেব, যাতে ছুটিতে অন্য কোথাও যাওয়া যায়।’ ইতিহাসে গোল্ড মেডালিস্ট মঞ্জুর দার্জিলিং লরেটো কলেজে সহজেই চাকরি হয়ে গেল। কলেজের প্রিন্সিপাল মাদার ডেমিয়ান ছিলেন আইরিশ নান। মঞ্জুর জন্যে তিনি ফ্ল্যাট, ঘরের কাজ করার লোক, বাচ্চাকে দেখাশোনা করার লোক – সবকিছুরই ব্যবস্থা করে দিলেন। কলকাতা থেকে পুরো সংসার তুলে নিয়ে শিয়ালদা, শিলিগুড়ি লুপ লাইনে স্টিমারে গঙ্গা পেরিয়ে আমরা অবশেষে এক বর্ষার বিকেলে দার্জিলিংয়ে বাস করতে এলাম। আমাদের সাহায্য করার জন্য সঙ্গী হয়ে এলেন সম্পর্কে আমার এক মামা, যাঁকে আমরা মেজো বলতাম। তাঁর নাম ছিল উদয়শঙ্কর গোস্বামী, যদিও যাদবপুরে তাঁকে সবাই চিনত মান্তু নামে।
১৯৬৬ সালের জুলাই মাসের শেষার্ধে আমাদের দার্জিলিং বাস শুরম্ন হলো। আমাদের ফ্ল্যাটটা ছিল ম্যালের ওপরে যে বিরাট বাড়িটা আছে তার দক্ষিণে কিছুটা ফাঁকা জমির পাশে যে কিউরিয়ো ও দর্জির দোকানটোকান আছে, সেই দোকানগুলোর নিচে। তখন ম্যালের ওপর ওই সৌধটার নাম ছিল অজিত ম্যানশন আর আমাদের ফ্ল্যাটগুলোর টিনের ছাদওয়ালা বাড়িটার নাম ছিল অজিত ম্যানশন’স অ্যানেকস। আমাদের ফ্ল্যাটের মাথায় ছিল, হয়তো আজো আছে, নেপাল কিউরি শপ এবং মাস্টার টেলর শামসুর টেলরিং শপ। শামসু ছিলেন সেকালের সাহেবসুবো ও রাজা-মহারাজদের পেয়ারের দর্জি। বছর তিনেক আগে গিয়ে দেখেছি, শামসু মারা গেছেন, কিন্তু তাঁর ছেলে আছেন, তবে দোকানটা ছোট হয়ে গেছে। কাল বা সময়ের প্রবাহকে কেউ ঠেকাতে পারে না।
আমাদের সময় যেটা ছিল অজিত ম্যানশন সেটার নাম আগে ছিল স্টিফেন ম্যানশন। এখন অন্য কী-একটা নাম হয়েছে।
অজিত ম্যানশন’স অ্যানেকসে আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকতেন মিসেস বেটলি নামে এক মেমসাহেব। তাঁর এক বন্ধু ছিলেন, মিসেস ব্রম্নস্টার, তিনি থাকতেন উইন্ডামেয়ার হোস্টেলে। আর একজন সাহেব ছিলেন কর্নেল মাসা। এই তিনজনকে তখন রোজ ম্যালে দুবেলাতেই দেখা যেত। কর্নেল মাসার হাতে সবসময় থাকত একটা রংবেরঙের ছাতা। পথে দেখা হলেই ‘গুড ডে’ বলে সম্ভাষণ করতেন। সত্যজিৎ রায়ের কাঞ্চনজঙ্ঘাতে এঁকে দেখানো হয়েছে। ম্যালের আর একটি নিয়মিত চরিত্র ছিলেন দিলীপ ভোস। তাঁকেও কাঞ্চনজঙ্ঘাতে সবাই দেখেছেন। আর-একজন যাঁকে দেখা যেত তাঁর নাম ভুলে গেছি, কিন্তু তিনিও খুব সুপরিচিত মানুষ ছিলেন, তাঁর হাঁটার একটা বিশেষ ভঙ্গি ছিল – হাত দুটি দুপাশে না ঝুলিয়ে পেটের ওপর জড়ো করে আসেত্ম-আসেত্ম হাঁটতেন, তিনি ছিলেন সত্যজিৎ, সুভাষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখের বন্ধু রাধাপ্রসাদ গুপ্ত ওরফে শাঁটুলদার শ্বশুর, বনবিভাগের বড় চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত। এক কথার মানুষ হিসেবে তিনি পরিচিত ছিলেন সমসত্ম মহলে এবং সেই হিসেবে অনেক মজার গল্পের বিষয় ছিলেন তিনি। প্রতিদিন দুবেলা যাঁদের দেখা যেত ম্যালে তাঁদের মধ্যে যাঁর সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠতা ছিল তিনি ছিলেন ঔপন্যাসিক দীপক চৌধুরী। তাঁর লেখা পাতালে এক ঋতু, দাগ
প্রভৃতি এককালে বাংলা 888sport live footballে খুব আলোড়ন তুলেছিল। বাইরে থেকে তিনি ছিলেন জবরদসত্ম সাহেব কিন্তু কথা বলতেন খাস পূর্ববঙ্গীয় ভাষায়। ম্যালের ওপরে অজিত ম্যানশনেই তিনি ও তাঁর স্ত্রী নমিতাদি থাকতেন। নমিতাদি ছিলেন দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজে ইংরেজির অধ্যাপিকা। আমাদের যৌবনকালে দীপক চৌধুরী ও সমরেশ বসু ছিলেন পেশাদার ঔপন্যাসিক অর্থাৎ 888sport alternative link লেখাই ছিল তাঁদের একমাত্র জীবিকা। দীপকদার পেশার বাইরে ছিল রান্না করার নেশা। অনেক রকম রান্না জানতেন তিনি আর কোনো-কোনো রান্নার প্রস্ত্ততি চলত চার-পাঁচদিন ধরে। কলকাতাতেও দীপকদা-নমিতাদির একটা ফ্ল্যাট রাখা ছিল বালিগঞ্জ স্টেশনের কাছে। দীপকদার আর একটা শখ ছিল গল্পে-গল্পে শ্রোতাদের মজানো। কলকাতা থেকেও অনেক প্রকাশক আসতেন তাঁর কাছে। দার্জিলিংয়ে আর একজন বাঙালি 888sport live footballিক ছিলেন, তাঁর নাম ছিল অচ্যুত চট্টোপাধ্যায়, তবে তাঁর পেশা ছিল দার্জিলিং কোর্টে ওকালতি। ক্যাপিটলের কাছে ছিল
তাঁর বাড়ি।
দার্জিলিংয়ের প্রশাসনের অঙ্গ ছিলেন যাঁরা, তাঁদের মধ্যে যাঁদের কথা মনে আছে, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন দার্জিলিংয়ের এসপি অরম্নণ প্রকাশ মুখোপাধ্যায়। তাঁর আমলেই নকশালবাড়ির অভ্যুত্থান হয়। এই অভ্যুত্থানের প্রকৃত ইতিহাস তিনি জানতেন এবং তাঁর পরিকল্পনা ছিল এই ইতিহাস তিনি লিখবেন, অবশ্য যদি সরকার তাঁকে সে-ইতিহাস প্রকাশের অনুমতি দেয়। তিনি যে ভেতরে-ভেতরে সে-বৃত্তামত্ম রচনার জন্যে প্রস্ত্তত হচ্ছেন এবং সব লিখে রাখছেন তার কাগজপত্র তিনি আমাদের দেখিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যমত্ম তাঁর বইটি বোধহয় বেরোয়নি, কারণ সে-বইয়ের কথা কোথাও পড়িনি বা শুনিনি। আর একজন ছিলেন ভাস্কর ঘোষ আইএএস, তিনি ছিলেন এডিএম এবং আমার স্ত্রী মঞ্জুর বড়দা শামিত্মপ্রসাদ চৌধুরীর সম্পর্কে কুটুম। ভাস্কর ঘোষ পরবর্তীকালে সরকারি সংবাদমাধ্যম কা–র একজন প্রভাবশালী ব্যক্তিরূপে বিখ্যাত হন।
ভাস্করের পরে এডিএম হয়ে আসেন পার্থপ্রতিম চৌধুরী আইএএস। তিনি প্রথম কর্মজীবনে ছিলেন ইংরেজি 888sport live footballের অধ্যাপক। তাঁর স্ত্রী ছিলেন আদি পিসি সরকার প্রতুলচন্দ্রের
মেয়ে গীতা। পার্থর সঙ্গে আমাদের বিশেষ ঘনিষ্ঠতার যোগসূত্র
ছিল বইয়ের জগৎ। নিজেও 888sport app download apk লিখতেন এবং তারাপদ রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখের সঙ্গেও তাঁর
ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরে বই সংগ্রহ করা ও ব্যক্তিগত লাইব্রেরি গড়ে তোলা তাঁর নেশা হয়ে ওঠে। অত্যমত্ম বন্ধুবৎসল ও সদালাপী ছিলেন। আমাদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এমন জমে গিয়েছিল যে, জলপাইগুড়িতে সরকারি কাজে গেলেও আমার মায়ের কাছেই খাওয়া-দাওয়া করতেন।
দার্জিলিংয়ে আমাদের ফ্ল্যাটটার অবস্থান ছিল অত্যমত্ম গুরম্নত্বপূর্ণ – একেবারে ম্যালের ওপরে বাড়ি দীপকদা-নমিতাদির ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে নিচে তাকালেই শুধু ম্যাল আর ম্যালের পুবের পাহাড় – আমাদেরটা অত ম্যালের বরাবর ছিল না; কিন্তু সাত-আটটা সিঁড়ি ভেঙে রাসত্মায় উঠে পা-দশেক হাঁটলেই পৌঁছে যাওয়া যেত ম্যালে। আর আমাদের ফ্ল্যাটের পশ্চিমের দেওয়ালটা জুড়ে ছিল কাচের জানলা, যে-জানলা দিয়ে দেখা যেত দূরে সন্দকফু পাহাড় আর তার পেছনে মাথা তুলে আছে বিশাল বরফের পাহাড় দুর্জয়লিঙ্গের মতো। একবার বুদ্ধদেব গুহ আমাদের ফ্ল্যাটে এসে অবাক হয়ে বলেছিলেন, সিনেমাতেই এরকম দেখা যায়, বাসত্মবেও যে দেখা যায়, জানলাম আপনাদের এখানে এসে। আমাদের ফ্ল্যাটের অবস্থানের জন্যেই হয়তো আমাদের ঘরে অতিথিদের আগমন প্রতিদিন লেগেই থাকত। বুদ্ধদেব গুহ ছাড়া সমরেশ বসুও এসেছিলেন আড্ডা দিতে। আবার তাঁর স্বর্ণশিখর প্রাঙ্গণের সিনেমার শুটিংয়ের সময়ও ক্যামেরাম্যান দিলীপ মুখুজ্যেকে নিয়ে এলেন তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট দেবেন দে। এরকম অনেকেই দার্জিলিংয়ে বেড়াতে বা কাজে এলে আমাদের ঘরে আসতেন। শুধু তাঁদেরই কয়েকজনের নাম করলাম, যাঁদের কথা বললে পাঠক-পাঠিকা বুঝতে পারবেন। এঁরা ছাড়া আমাদের চেনাজানা আরো যাঁরা কলকাতা ও 888sport app জায়গা থেকে আসতেন দার্জিলিংয়ে তাঁরাও আসতেন। কিন্তু অনেকবার আসব বলে জানিয়েও প্রেমেন্দ্র মিত্র শেষ পর্যমত্ম আসেননি, তবে আমরা পাকাপাকি দার্জিলিং ছেড়ে আসব জানার পরে তাঁদের আর দার্জিলিং আসা হলো না বলে খেদ করেছিলেন। নরেন মিত্রও আসেননি, কিন্তু তাঁর ছোট ছেলে অধ্যাপক অভিজিৎ মিত্র ওরফে ডন আমাদের সঙ্গে বেশ কয়েক মাস ছিলেন। অভিজিতের কথা মনে পড়াতে মনে পড়ল জয়শ্রী পত্রিকার সম্পাদক বিজয় নাগের কথা। অভিজিৎ, বিজয়, অধ্যাপক দীপক দাশ এবং আরো কেউ-কেউ মিলে একবার টাইগার হিলে গেছলাম। সেবার টাইগার হিলে ভারি তুষারপাত হয়েছিল। আমাদের বড় ছেলে শুভরূপ তখন বছর তিনেকের বা চারেকের। আইসক্রিম ভেবে সে একখাবলা বরফ মানে তুষার মুখে পুরে দিয়েছিল। গভর্নমেন্ট কলেজের দীপক, রাখোহরি, সূর্য, সুভাষ প্রমুখ অনেক অধ্যাপকই তখন আসতেন আড্ডা দিতে। সবাই জানতেন যে, এখানে এলেই দেখা হয়ে যাবে অনেকের সঙ্গে। গভর্নমেন্ট কলেজের অধ্যাপকরা তো আসতেনই, আবার মঞ্জুর লরেটো কলেজের কোনো-কোনো অধ্যাপিকাও আসতেন।
আমরা বছরখানেক থাকার পরে অজিত ম্যানশন’স অ্যানেকসের আর একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া এলেন মৈত্রেয় ঘটক আর তাঁর স্ত্রী লিপিকা। দুজনেই অধ্যাপনার কাজ পেয়েছিলেন লরেটো কলেজে। মৈত্রেয় ছিলেন মনীশ ঘটক মানে যুবনাশ্বের ছোট ছেলে। মৈত্রেয়র মা-ও একবার এসেছিলেন, মৈত্রেয়র দাদা অবুদাও এসেছিলেন দার্জিলিংয়ে। তাঁদের দিদি মহাশ্বেতা দেবী ততদিনে বাংলা 888sport live footballে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। ঘটক পরিবারের ঋত্বিক ও মহাশ্বেতা খুব খ্যাতি পেলেও অন্যরাও বেশ বুদ্ধি ও মেধাসম্পন্ন। আমাদের বিশেষত মঞ্জুর আত্মীয়স্বজনও আসতেন আমাদের কাছে বেড়াতে। তাঁরা যখন আসতেন তখন তাঁদের দৌলতে আমরা দার্জিলিংয়ের আশপাশে বেড়াতে যেতাম, যেমন কালিম্পং, গ্যাংটক, তাগদা ইত্যাদি স্থানে। এসব জায়গার মধ্যে তাগদা ছিল আমার খুব প্রিয় জায়গা। এককালে তাগদাতে বাংলার ব্রাহ্মরা বেশ একটা উপনিবেশ গড়েছিলেন, শিবনাথ শাস্ত্রী, প্রশামত্ম মহলানবিশ প্রমুখ অনেকে এখানে বাংলো বানিয়েছিলেন এবং নন্দলাল বসু ও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তির এখানে যাওয়া-আসা ছিল। ষাটের দশকের শেষার্ধেও এখানে রোহিনী সেন নামে নববই বছরের এক ব্রাহ্ম ভদ্রলোক বারো মাস থাকতেন। তাঁর দুমেয়ে থাকতেন কলকাতায়। তাঁরাই আসতেন তাঁর কাছে বেড়াতে। তাঁর বাড়িতে ছিল মসত্ম লন, তাতে কতবার পাক খেলে এক মাইল হয় তার একটা হিসেব ছিল তাঁর। আমার এখন মনে হয়, তিনি হয়তো প্রচ্ছন্ন ঋষি ছিলেন। রেলের চাকরিতে অবসর নিয়ে তাগদাতেই থাকতেন পরমানন্দে। তাগদার বিশেষ আকর্ষণ ছিল এখানকার পাইনের জঙ্গল আর এখানকার মাঝারি মাত্রার ঠান্ডা। পাইনের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সারাক্ষণ নিঃশব্দে চলাফেরা করত কুয়াশা আর মেঘছায়া। জঙ্গলে সারাক্ষণই অস্ফুট অদ্ভুত নানারকম আওয়াজ করত নির্জনতাপ্রিয় পশুপাখি আর টিনের চালে উঁচু পাইনের পাতা থেকে জলের ফোঁটা পড়ত টপ-টপ করে। আমি অমত্মত তাগদাতে রোদ ঝলমল দিন এমনটা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তবু জায়গাটার একটা রহস্যময় আকর্ষণ ছিল। শুনেছি মুখ্যমন্ত্রী হয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাগদাতে একটা পর্যটন কেন্দ্র করেছেন। পর্যটকদের ভিড় হলে তাগদার মায়া কতটা থাকবে জানিনে। অথচ তাগদা সত্যিই এক মায়াবী পৃথিবী। সেখানে শিবনাথ শাস্ত্রীর সম্পর্কে নাতনি সেবতী মিত্র ওরফে তোতাদির একটা চমৎকার বাংলো ছিল আর সেখানেই তোতাদির সেণহের পাত্রী ও আমাদের বন্ধু মঞ্জরীর সূত্রে কয়েকবার গিয়ে থেকেছি।
একটা জংশন স্টেশনের মতো জায়গা ছিল ঘুম। হিল কার্ট রোড একদিকে গেছে শিলিগুড়ি, অন্যদিকে দার্জিলিং হয়ে লেবং পর্যমত্ম। আর একটা রাসত্মা পশ্চিম দিকে গেছে সুকিয়াপোখরি দিয়ে সন্দকফু হয়ে ফালুট পর্যমত্ম। দার্জিলিং থেকে টাইগার হিল অথবা বাঘ পাহাড়ের ঠিক আগে জোড়বাংলা থেকে আর-একটা রাসত্মা পুব দিকে গেছে তিসত্মা বাজার পেরিয়ে কালিম্পং-গ্যাংটকের দিকে। এই রাসত্মাটার নাম পেশোক রোড; এই রাসত্মার ওপরেই লোপচু, পেশোক প্রভৃতি চা-বাগান। জোড়বাংলা থেকে বোধহয় মাইল সাতেক গেলে ডান দিকে বেরিয়ে গেছে তাগদার পথ। তাগদার পিঠের দিকে মানে পশ্চিমের পাহাড় বেয়ে কেউ যদি হাতড়ে-হাতড়ে সোজা ওপরে ওঠে তাহলে পৌঁছে যাবে মংপুতে। তিরিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ এখানে কয়েকবার এসে কাটিয়ে গেছেন।
কিন্তু কখনো মংপুতে যাওয়ার জন্যে আগ্রহ বোধ করিনি, শুধু একবারই কালিম্পং যাওয়া-আসার পথে কিছুক্ষণ কাটিয়েছিলাম। আমার বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথের বিশেষ ভালোবাসার জায়গা ছিল কালিম্পং। তিনি মংপুতে আসতেন মৈত্রেয়ী দেবীর ডাকাডাকিতে আর কালিম্পংয়ে যেতেন নিজের বুকের আবেগে। মংপুর আকর্ষণ সূর্যোদয় দর্শন আর কালিম্পংয়ের আকর্ষণ কাঞ্চনজঙ্ঘা ধবলাগিরির দিনভর সম্ভাষণ।
সূর্যোদয়ের কথা এলে টাইগার হিলের কথা আসবেই। তবে টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখার জন্য কপাল বা ভাগ্য থাকা চাই। ভাগ্যের দৌলতে একবার যাঁরা টাইগার হিল থেকে সূর্যোদয় দেখেছেন, তাঁরা সেই অলৌকিক রঙ্গমঞ্চে সূর্যোদয়ের অবিশ্বাস্য ইন্দ্রজাল সেই মহামহিম ঘটনার কথা কখনো জীবনে ভুলতে পারবেন না। বহুবার গেছি, প্রতিবারই নতুন-নতুন দৃশ্য দেখেছি, কিন্তু ১৯৫৮ কি ৫৯ সালে যে-সূর্যোদয় দেখেছি তার কোনো বর্ণনাই হয় না। তবু আমি আজো সবাইকে বলি, দার্জিলিং গেলে শরতে বা হেমমেত্ম যাবেন আর অবশ্যই যাবেন টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখতে। তবে টাইগার হিলে সূর্যোদয় দেখতে হলে শেষ রাতের বিছানার আরামটাকে ছাড়তে হবে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে যাত্রা। অবশ্য বয়স্কদের জন্য আর একটা জায়গা আছে যেখান থেকে অপূর্ব সূর্যোদয় দেখা যায়। জোড়বাংলা থেকে পেশোক রোড দিয়ে মাইলখানেক এগিয়ে ডান দিকে চলে গেছে রম্বির পথ। রম্বিতে বনবিভাগের বাংলোতে আমরা একটা দিন কাটিয়েছিলাম তখনকার এডিএম বন্ধু পার্থপ্রতিমের দৌলতে। দিন মানে বিকেলের আগে দিনের আলোতে পৌঁছানো, সন্ধ্যা, রাত্রি, ভোর ও সকাল কাটিয়ে দার্জিলিংয়ে ফেরা। সেদিন জ্যোৎসণার রাত্রি ছিল, বাংলোর সামনে পুঞ্জপুঞ্জ মেঘ ভাসছিল, পায়ের অল্প নিচে যেন শামত্ম মেঘসাগর আর তার ওপরে পড়েছিল আশ্চর্য জ্যোৎসণা আদিগমত্ম ছড়ানো কুহকিনীর অাঁচলের মতো। বাংলোর বাইরে যখন এমন কল্পলোকের রূপকথা তখন বাংলোর ভেতরে রান্নাঘরে মঞ্জু ব্যসত্ম ছিলেন দার্জিলিং থেকে আনা বাজারের সদ্ব্যবহার করে পেট-সমান উঁচু উনুনে কাঠের গনগনে আগুনে দারম্নণ মাংসের রোস্ট ও পরোটা রান্না করতে। তারপর যথারীতি আমরা সবাই রান্নার ঢালাও তারিফ করতে-করতে চাঁদের আলোতে হইহই করে ডিনার খেলাম। আমরা সবাই মানে আমরা আড়াইজন দাশগুপ্ত, পার্থ, তাঁর স্ত্রী গীতা আর ভাই মুকুট মিলে তিনজন চৌধুরী আর জলপাইগুড়ির বন্ধু সুরজিৎ বসু ওরফে বাচ্চুদা। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে হলো, কারণ সূর্য ওঠার আগে ভোরবেলায় উঠতে হবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মঞ্জুর পেটে শুরম্ন হলো তার গলস্টোনের যন্ত্রণা। ডাক্তাররাই বলেন সে যন্ত্রণা হার্ট অ্যাটাকের মতোই অসহ্য। তখনকার কালে গলস্টোন অপারেশন সহজ ছিল না। সেজন্যে চলছিল মসজিদবাড়ি স্ট্রিটের বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাক্তার এস.কে. দাসের চিকিৎসা। কিছুদিন ভালো থেকে রম্বিতেই আবার শুরম্ন হলো তার আক্রমণ। জরম্নরি অবস্থার জন্যে সঙ্গের ওষুধ খাইয়ে আর গরম জলের বোতলের সেঁক দিয়ে কোনোমতে রাতটা কাটানো গেল আর সবাইকে জাগিয়ে দেওয়া গেল ভোর হওয়ার আগেই। সত্যি-সত্যি বাংলোর বারান্দা থেকে দেখাও গেল কিংবদমিত্ম প্রসিদ্ধ রম্বির সূর্যোদয়। ফলে রম্বির 888sport sign up bonus আজো মিশ্র অভিজ্ঞতার অনুভূতিতে বেঁচে আছে।
রম্বিতে বাচ্চুদার উপস্থিতি আকস্মিক ছিল না। জলপাইগুড়িতে পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে আমি যখন কালরোগে শয্যাশায়ী ছিলাম, তখন থেকেই বাচ্চুদা আমাদের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন আর আমার বিয়ের পরে রবীন্দ্রসংগীতের সূত্রে হয়ে পড়েন মঞ্জুর খুব কাছের মানুষ। রবীন্দ্রসংগীত খুব দৃঢ়ভাবে মঞ্জু, বাচ্চুদা আর কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে এক সূত্রে বেঁধে দিয়েছিল। মনে পড়ে গেল দার্জিলিংয়ে শক্তি এসে দুরাত্রি আমাদের কাছেও ছিলেন আমাদের ছেলে শুভরূপকে জড়িয়ে। শক্তি দার্জিলিংয়ে বেশ কয়েকবার এসেছিলেন ও সাধারণত উঠতেন নিত্যপ্রিয় ঘোষের কাছে। তবে বাচ্চুদা যে কতবার এসে থেকেছেন আমাদের কাছে তার কোনো হিসেব নেই। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল শামিত্ম মাসিমার কথা। তিনি ছিলেন মহারানি গার্লস স্কুলের প্রধান শিক্ষয়িত্রী, থাকতেন দার্জিলিং স্টেশনের উত্তরে একটা বাংলোবাড়িতে। তাঁর স্বামী ইন্দুভূষণ মজুমদার জলপাইগুড়ির আনন্দচন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষের কাজ ছেড়ে দার্জিলিংয়ে এসে নর্থ পয়েন্টের সেন্ট জোসেফ কলেজে ফিলোজফির অধ্যাপকের চাকরি নেন। শামিত্ম মাসিমা দার্জিলিং ব্রাহ্ম মন্দিরেরও একজন কর্ত্রী ছিলেন। ম্যালে বেড়াতে এলে তিনি আমাদের ফ্ল্যাটেও আসতেন। ঘটনাক্রমে তিনি যখনই আসতেন তখনই দেখতেন, বাচ্চুদা আছেন আমাদের কাছে আর প্রত্যেকবারই অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করতেন, ‘আপনি এখনো আছেন?’ তাঁর দুই প্রতিক্রিয়া নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম। বাচ্চুদা যে এর মধ্যে জলপাইগুড়ি গিয়ে তাঁর সরকারি চাকরি সামলে এসেছেন, এটা তিনি বিশ্বাস করতে চাইতেন না।
দার্জিলিংয়ে আমাদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন সরকারি কলেজের বাংলার অধ্যাপক দেবদাস জোয়ারদার। তিনি থাকতেন দার্জিলিং কোর্টের নিচে লরেটো কনভেন্টের কাছে। তাঁর একটি ছেলে ছিল আমাদের ছেলের বয়েসি। তাকে ঘাড়ে তুলে দেবদাস ওই নিচে থেকে ম্যালে উঠে আসতেন আমাদের ঘরে। প্রত্যেক সপ্তাহেই অমত্মত একবার আসতেন তিনি। ক্বচিৎ কখনো তাঁর মিষ্ট ও স্বল্পভাষিণী স্ত্রী মীরাও আসতেন। তবে দেবদাসই আসতেন নিয়ম করে। তাঁকে নিয়ে আমাদের মধ্যে গল্পও হতো অনেক। সবাই কিছু খাচ্ছি, তাঁকে একই জিনিস দিলেও তিনি জানতে চাইতেন, এটা কোনো নিষিদ্ধ জিনিস কিনা। তাঁর খুব ভয় ছিল পাছে আমরা তাঁকে নিষিদ্ধ পানীয় অথবা নিষিদ্ধ মাংস খাইয়ে দিই। তাঁর 888sport live footballপ্রেম যেমন গভীর ছিল, তেমনই গভীর ছিল রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে জ্ঞান। তবে তাঁর কথাবার্তায় স্পষ্ট ছিল ময়মনসিংহের ভাষার টান। আর ছিল নিজেকে নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করার উদারতা ও রসবোধ। আমরা অনেকেই তাঁর সরলতা নিয়ে মজা করতাম, তিনি নিজেও সেসব সহজেই উড়িয়ে দিতেন। বাচ্চুদা, দেবদাস আর শক্তি যখন কখনো-কখনো জুটতেন তখন আর সময়ের হিসেব থাকত না। দেবদাস ও শক্তি আবার প্রেসিডেন্সি কলেজে সহপাঠী ছিলেন।
পার্থর উদ্যোগে দার্জিলিংয়ে আমরা একটা ফিল্ম সোসাইটিও গড়েছিলাম এবং ফিল্ম ফেস্টিভালও করেছিলাম একবার, সেই উপলক্ষে সুভেনিরও প্রকাশ করেছিলাম আর আমি তাতে ‘ফিল্ম অ্যাজ অ্যান আর্ট’ নামে একটা 888sport liveও লিখেছিলাম। ফিল্ম সোসাইটি, ফিল্ম ফেস্টিভাল, ফিল্ম সুভেনির ইত্যাদি সংক্রামত্ম যাবতীয় ব্যাপারে আমাদের প্রধান সহায় ছিলেন রামপ্রসাদ সেন। তাঁর ডাকনাম ছিল ভ-া, কিন্তু আমি ডাকতাম ভ- বলে। রামপ্রসাদের জন্ম ও লেখাপড়া সবই দার্জিলিংয়ে, আসলে তিনি ছিলেন দার্জিলিংয়েরই সমত্মান। চাকরি করতেন সোশ্যাল এডুকেশন অফিসার হিসেবে।
আমরা থাকাকালেই দার্জিলিংয়ের জনজীবনে একটা পরিবর্তন ঘটতে শুরম্ন করে, যার পরিণাম পরিষ্কার হয় ১৯৭৫ সালে। বোধহয় ১৯৬৭ সাল নাগাদ আমাদের ঘরের কাজ করতেন যিনি, যাঁকে আমরা ডাকতাম জেঠি বলে, তিনি জানালেন যে, আর আমাদের কাজ করতে পারবেন না, আমরা যেন নতুন কাজের লোক দেখে নিই। জেঠির স্বামী দার্জিলিং মিউনিসিপ্যালিটিতে কাজ করতেন। আমরা জেঠিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে অদ্ভুত খবর জানলাম। কোম্পানি টাকা দিচ্ছে, সেই টাকা নিয়ে দার্জিলিংয়ের অনেক দুস্থ নেপালি চলে যাচ্ছে সিকিমে, আর সেই টাকা দিয়ে সিকিমে জমি ধরে ঘর বানিয়ে সিকিমে বাস করছে। সিকিমে গিয়ে থাকার জন্য কোম্পানি টাকা দেবে বলে নেপাল থেকেও বহু নেপালি বর্ডার পেরিয়ে দার্জিলিংয়ে আসছে এবং এখান থেকে কোম্পানির টাকা নিয়ে চলে যাচ্ছে সিকিমে। আমাদের জেঠির স্বামী থাকবে এখানে, কিন্তু জেঠি চলে যাবে ঘর বানিয়ে সিকিমেই থাকবে বলে। ব্যাপারটা প্রথমে বুঝতে পারিনি, কিন্তু খানিকটা পরিষ্কার হয় যখন ১৯৬৭ সালে চেরি ফুল ফোটার কালে আমার শ্বশ্রূমাতা, মঞ্জু, লরেটোর অধ্যাপিকা মঞ্জরী মুখার্জি ও গভর্নমেন্ট কলেজের অধ্যাপক দীপক দাশ বেড়াতে গিয়ে গাড়ি খারাপের জন্য বাড়তি একটা রাত আটকে যাই। আমার আগের দেখা গ্যাংটক তখন অনেক পালটে গেছে, নেপালি হোটেল হয়ে গেছে কতকগুলো। প্রকৃতপক্ষে ধর্মগত, শোণিতগত, সংস্কৃতিগত ইত্যাদির বৈশিষ্ট্যগত রূপটাকে আসেত্ম-আসেত্ম বদলে দেওয়ার হিসেব ক্রমশ স্পষ্ট হবে। সিকিমের নতুন সমাজ স্বভাবতই আস্থা হারাবে রাজতন্ত্রে, দাবি তুলবে গণতন্ত্রের। এরকম কিছু-কিছু কানাঘুষো শুনতে পেতাম বাজারে অথবা এর-ওর মুখে। আসল ব্যাপারটা বোঝা যায় কয়েক বছর পরে সুনন্দ কে. দত্তরায়ের লেখা স্ম্যাশ অ্যান্ড গ্র্যাব : অ্যানেকসেশন অব সিকিম (ঝসধংয ধহফ এৎধন : অহহবীধঃরড়হ ড়ভ ঝরশশরস) বইটি পড়ে। তখন জানলাম যে, সিকিম আসলে ছিল ব্রিটিশ রেসিডেন্টের তত্ত্বাবধানে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের রাজতন্ত্র, কোনো বিশেষ এজেন্সি, জেঠি যাকে কোম্পানি বলেছিলেন, সেখানে হিন্দু নেপালিদের কয়েক বছর ধরে পাঠিয়ে-পাঠিয়ে তাদের দিয়ে গণতন্ত্রের জন্য দাবি তুলে এবং আন্দোলন ঘটিয়ে সিকিমের মহারাজাকে হটিয়ে শেষ পর্যমত্ম সিকিমের ভারতভুক্তিকে নির্বিঘ্নে সম্ভব করে তুলেছিল। তার ফলে সত্যজিৎ রায়ের সিকিম ছবিটা ভারতে প্রদর্শন নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
দার্জিলিং ম্যালে যাঁদের খুব দেখতে পেতাম এবং তাঁদের মধ্যে যাঁদের নাম করলে অনেকে চিনতে পারবেন তাঁদের অনেকের নাম করেছি আগে। কিন্তু একজনের কথা বলা বাকি রেখেছি ইচ্ছে করে। তাঁর নাম রমেশচন্দ্র মজুমদার। আধুনিক ভারতের যে কজন ঐতিহাসিক বিশ্ববিখ্যাত হয়েছেন রমেশচন্দ্র তাঁদের একজন। যদুনাথ সরকার ও রমেশচন্দ্রের ভারতীয় ইতিহাসে অবদান বহুকাল ইতিহাসে লেখা থাকবে সোনার অক্ষরে। রমেশচন্দ্রের খুব প্রিয় বিশ্রামের জায়গা ছিল দার্জিলিং আর দার্জিলিংয়ে তাঁর প্রিয় হোটেল ছিল ম্যালের ওপরে উইন্ডামেয়ার হোটেল এবং এই হোটেলে একটা ঘর ছিল বিশেষভাবে তাঁর জন্য সংরক্ষিত, যার জানলা দিয়ে একদিকে দেখা যেত ভোরের আকাশ অন্যদিকে বিকেলের সন্দকফু পাহাড়ের পেছনে বরফের মুকুট। ভালোবাসতেন ম্যালের পুবের পথে বেড়াতে। এই পথের এক প্রামেত্ম ম্যাল আর অন্য প্রামেত্মর থেকে দেখা যেত নিচে লেবং রেসকোর্স। আমি একদিন সাহস করে গিয়ে তাঁর সঙ্গে যেচে আলাপ করি। আমি দার্জিলিংয়ে থাকাকালে ভারত কীভাবে ইসলামের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে তা নিয়ে পড়াশোনা করছি আর আমার ভারতবর্ষ ও ইসলাম গ্রন্থখানির খসড়া লিখছি। আমি তাঁকে বলি যে, ভারতীয় বিদ্যাভবন থেকে তাঁর সম্পাদনায় ভারতীয় মানুষের যে-ইতিহাস বিপুল আকারে খ—খ– প্রকাশিত হয়েছে তাতে মুসলমানদের ও ইসলামের বিরম্নদ্ধে তাঁর মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। তিনি প্রথমে বলেন যে, যখন তিনি 888sport app বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন তখন 888sport appর মুসলমান সমাজের সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব হয় এবং বুঝতে পারেন যে, বন্ধু হিসেবে একজন মুসলমান যতখানি নির্ভরযোগ্য, একজন হিন্দু ততখানি নয়। কিন্তু এটা তাঁর ব্যক্তিগত বিচার, ঐতিহাসিক হিসেবে তাঁর বিচার হচ্ছে, মুসলমান শাসক কখন আঘাত হানবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাঁর সঙ্গে আমার তর্ক বেধে যায়। সে তর্ক সকাল থেকে মধ্যাহ্ন বিরতির পরে আবার বিকেল পর্যমত্ম, রাত্রের বিরতির পরদিন পর্যমত্ম চলে। কথা ছিল বিকেলে তিনি লরেটো কলেজে ভাষণ দেবেন। কিন্তু তর্কে-তর্কে এতটাই ক্লামত্ম হয়ে যান যে, ওই ভাষণ দেওয়ার কর্মসূচি তিনি বাতিল করে দেন। বোধহয় মোট পাঁচবেলা ধরে চলে আমাদের তর্কযুদ্ধ। আমি আজো মনে করি তাঁর মতো বড় ঐতিহাসিক যে আমাকে অতটা সময় দিয়েছিলেন এটা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তিগুলোর একটি। বাচ্চুদাও আমাদের তর্কযুদ্ধের সাক্ষী ছিলেন। প্রত্যেক দফা নয়, দুটো কি তিনটে দফা। আমি চেয়েছিলাম রমেশচন্দ্রের পাশে আমাদের ছেলে শুভরূপের একটা ছবি তুলতে। যখন ক্যামেরা তাগ করছি তখন তিনি শুভরূপকে বললেন, ‘সামনে সোজা তাকাও। সবসময় সোজা তাকাবে।’ বাচ্চুদা তখন সঙ্গে ছিলেন। বললেন ‘তাঁর এই কথাটার একটা গভীর অর্থ আছে – দুনিয়ার সমসত্ম ছাত্রের উদ্দেশে তাঁর এটাই নির্দেশ – সবসময় সোজা তাকাবে।’ কলকাতায় ফিরে গেলে তাঁকে তাঁর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে চিমত্মা জানিয়ে চিঠি দিয়েছিলাম। জবাবে তিনি লিখেছিলেন, কলকাতায় ফিরে যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি – নতুন ঐতিহাসিকরা কী ভাবছে, কী বুঝছে তা জানতে চান তিনি। বলেছি বটে তর্কযুদ্ধ, আসলে সংলাপ। ‘প্রবীণ নবীন সংলাপ’ নামে একটা লেখা লিখে পাঠিয়ে দিলাম ইতিহাস পত্রিকায় ছাপানোর জন্য, সঙ্গে ছবিও দিয়েছিলাম।
অধ্যাপক অমলেন্দু দে তখনই ছাপা হবে জানিয়ে পোস্টকার্ডও দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যমত্ম ছাপা হয়নি, আমিও ফেরত নিইনি। রমেশচন্দ্রের সঙ্গে দশ-বারো ঘণ্টা ধরে আমার কথা বলার ঘটনাটা দার্জিলিং সম্বন্ধে আমার একটা অত্যমত্ম মূল্যবান 888sport sign up bonus।
আমরা এখনো মনে করি, দার্জিলিংয়ের চার বছর আমাদের জীবনের সবচেয়ে আনন্দের, সবচেয়ে সুখের দিন। দার্জিলিং আমাদের এতই ভালোলেগে গিয়েছিল যে, আমরা ঠিক করে ফেললাম আমরা দার্জিলিংয়েই পাকাপাকি বাস করব। মায়ের চাকরি জীবন শেষ হয়ে গেছল, মা তাঁর সরকারি কোয়ার্টার্স ছেড়ে বাকি জীবন জলপাইগুড়িতে কাটাবেন বলে ভেবেছিলেন। আমরা দার্জিলিংয়ে থাকলে মায়ের কাছাকাছিই থাকা হবে। মা গ্র্যাচুইটির টাকাটা মঞ্জুকে দেবেন দার্জিলিংয়ে বাড়ি কেনার জন্য। আমরা দার্জিলিংয়ে হিল কার্ট রোডের ওপরে ‘তপোবন’ বলে বাড়িটা পছন্দও করে ফেললাম। এখান থেকে চোরাবাটো বা পায়ে হাঁটাপথে কাগঝোরার ভিক্টোরিয়া ফলস কাছেই। কিন্তু একটু বেশি দর চাইছিলেন বাড়ির মালিক, আর আমরা একটু কম করতে চাইছিলাম অর্থাৎ দর নিয়ে দরাদরি চলছিল। এর মধ্যে আমার খোঁচাখুঁচিতে মঞ্জুর হাতে সেপটিক থেকে একটু জ্বর হয়েছে বলে এবার পুজোতে আমরা জলপাইগুড়ি যেতে পারব না খবর পেয়ে মা জলপাইগুড়ি থেকে বাচ্চুদাকে অবলম্বন ধরে আর দাদার বড় ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে চলে এলেন দার্জিলিং। মঞ্জুকে মা ভীষণ ভালোবাসতেন ও বিশ্বাস করতেন, সম্ভবত আমাদের দুভায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন।
এদিকে মা এসেছেন শুনেই পার্থ চলে এলেন, বললেন মাকে নিয়ে জেলার যেসব জায়গায় লোকেরা কম যায় সেসব জায়গা ঘুরে দেখাবেন। বিভিন্ন ফরেস্ট বাংলো আমাদের জন্য রিজার্ভ করতে কিছু সময় লাগবে। বাদ সাধলেন বাচ্চুদা। তাঁর নাকি জলপাইগুড়িতে ভীষণ জরম্নরি কাজ আছে। শেষে ঠিক হলো, বাচ্চুদা ফিরেই যাবেন এবং পার্থ ও আমি বাচ্চুদাকে পৌঁছে দিয়ে আসব শিলিগুড়িতে। যেদিন বাচ্চুদার যাওয়ার কথা তার আগের দিন থেকে নামল কার্তিক মাসের অকাল বৃষ্টি। পরদিন মুষল বর্ষাতেই পার্থর জিপে বাচ্চুদা, পার্থ ও আমি শুরম্ন করলাম সমতলে নামা। পথে একটা বড় ধস দেখলাম তিনধারিয়াতে। বৃষ্টি তখন আরো প্রবল হয়ে উঠেছে। ফেরার সময় পার্থর ড্রাইভার বললেন, কার্ট রোড নিশ্চয়ই আরো ধসে বন্ধ হয়ে থাকবে, আমরা তাই পাঙ্খাবাড়ি রোড দিয়ে যাব। বারো-তেরো মাইল ধরে অনেকগুলো তীব্র বাঁক হয়ে পৌঁছে গেলাম কার্শিয়ংয়ে। মনে হচ্ছিল আকাশের দেবতারা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে বালতি-বালতি জল ছুড়ে দিচ্ছিলেন আমাদের ওপরে, যে-কোনো মুহূর্তে আমরা ধুয়ে ধসে পড়তে পারি নিচে। ওসত্মাদ ড্রাইভার শেষ পর্যমত্ম আমদের পৌঁছে দিলেন কার্শিয়ংয়ে হিল কার্ট রোডে। ঘরে পৌঁছে বললাম, আবার জলপাইগুড়ি ভাসবে। কিন্তু মনে-মনে ভাবছিলাম এবার দার্জিলিংও ধসবে কিনা। ধসে কী হতে পারে-না-পারে বলে আমার আগের অভিজ্ঞতা ছিল। প্রথমেই ড্রামে ও বিভিন্ন পাত্রে জল ভরে রাখলাম আর লণ্ঠন তৈরি করে রাখলাম। ছাতা মাথায় বেরিয়ে কিনে আনলাম কয়েকটা মোমবাতি। দেখে নিলাম মায়ের, মঞ্জুর ও বাচ্চাদের সব ওষুধ আছে কিনা, যা নেই তা নিয়ে এলাম ছুটে। মজুদ থাকা চাই যথেষ্ট বিস্কুট ও চকোলেট। প্রথম রাতটা কাটল ঘটনাবিহীনভাবে। পরদিন সকালে পার্থ এসে জানালেন গোটা পাহাড়জুড়ে ধস নামছে, আমাদের বেড়াতে যাওয়ার কর্মসূচি বাতিল, এই মুহূর্তে তিনি যাচ্ছেন চাঁদবাড়িতে – যেখানে কাগঝোরা থেকে ধস নেমেছে সেখানকার উদ্ধারকাজ তদারকি করতে। এভাবে ভয়ে-ভয়ে দিনটা কাটল, সন্ধেবেলায় অন্ধকার নামলে দেখলাম সন্দকফু পাহাড়ের নিচে বসিত্মর আলোগুলো আসেত্ম-আসেত্ম গড়িয়ে নামতে-নামতে হঠাৎ ঝুপ করে নিবে গেল।
ঘণ্টাখানেক পরে চলে গেল দার্জিলিং শহরের বিজলিও। ঘুটঘুটে অন্ধকারে একটানা বৃষ্টি ঝরছে ঝুরঝুর করে। কিন্তু শেষ রাতে কিংবা খুব ভোরে বৃষ্টির আওয়াজে বুঝতে পারলাম বৃষ্টি কমে আসছে। অবশেষে ভোর হলো। বৃষ্টি নেই। ম্যালে উঠে দেখি ছোটখাটো ভিড় জমেছে। শুনলাম সোনাদাতে ধস নেমেছে রেললাইনে। চলমত্ম ট্রেন ওপরে, ধস নামছে লাইনের তলায়। এমনই নাটকীয় মুহূর্তে ড্রাইভার ব্রেক কষে থামিয়ে দেয় ট্রেন। ইঞ্জিন শূন্যে ঝুলে পড়ে। মসত্ম বিপদ কেটে যায়, প্রাণে বেঁচে যায় প্যাসেঞ্জাররা। ইঞ্জিনসুদ্ধ রেললাইন এখনো ঝুলছে সার্কাসের ট্রাপিজ খেলার মতো। অজিত ম্যানশনের নিচে ট্যুরিস্ট অফিসের বারান্দা থেকে জল বিলি হচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি বালতি নিয়ে এলাম। কিন্তু আমার আগের অভিজ্ঞতার দরম্নন আমাদের বিশেষ সংকট হয়নি জলের। তিনদিন বাদে কলেজে গিয়ে মঞ্জু শুনলেন, জলপাইগুড়ি থেকে ফোন এসেছিল জানাতে যে, মঞ্জুর আত্মীয়রা ভালো আছে। আমরা তো অবাক। এর মানে কী? মঞ্জুর আত্মীয়রা ভালো তো থাকবেই।
পার্থই খবর আনলেন, ওয়্যারলেসে ডিএমের অফিসে খবর এসেছে যে, জলপাইগুড়িতে ভয়ংকর বন্যা হয়েছে। বড় মাসিমার জন্য মায়ের ভীষণ চিমত্মা হতে লাগল। তিনি কি আলমারির মাথায় উঠে প্রাণ বাঁচাতে পারবেন? এখানে দার্জিলিংয়ে আমরা তো ভালো আছি। ওখানে জলপাইগুড়িতে কী অবস্থা কে জানে। জলপাইগুড়ির খবর নিয়ে দাদা ও পার্টির দাদা রণেন মিত্র (ইনি তেভাগা আন্দোলনের জন্য বিখ্যাত ইলা মিত্রর স্বামী) পাহাড় ভেঙে এসে হাজির। মাকে বোঝালেন, তাঁর আর জলপাইগুড়ি যাওয়া উচিত হবে না। দাদারা বড় মাসিমাকে জোর করে নিয়ে পাশের হাসপাতালের দোতলায় চলে গেছলেন। হাসপাতালের দোতলার মেঝে দিয়ে জল বয়ে গেছে মায়ের কোয়ার্টার্সের ছাদের ওপর দিয়ে। কোয়ার্টার্সের ভেতরে আসবাবপত্র, আলমারি এমনকি দরজা-জানলা ইত্যাদি সব জলের তোড়ে ভেঙে চুরমার। মায়ের তো মাথায় হাত! ওই আলমারিতেই ছিল মায়ের গ্র্যাচুইটিতে পাওয়া টাকার চেক। দাদা ও রণেনদা মাকে ওই চেকের চিমত্মা ছাড়ার পরামর্শ দিলেন, বোঝালেন যে কলকাতায় তাঁর নিজস্ব দোতলা বাড়ি আছে, দার্জিলিং থেকে তাঁর সোজা কলকাতায় নিজের বাড়িতেই যাওয়া উচিত, যাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু মা তাঁদের যুক্তিবুদ্ধি মানতে রাজি নন। কলকাতার বাড়ি তিনি দাদাকে দেবেন বলে কবুল করেছেন। অন্য ছেলেকে কিছু দেবেন না? অমত্মত গ্র্যাচুইটির টাকাটুকু তো দেবেন। তিনি অমত্মত একবার জলপাইগুড়ি গিয়ে চেকটা খোঁজার চেষ্টা করবেনই। একবার পায়ে হেঁটে গেছেন, আবার একবার যাবেন হেঁটেই। দাদারা হতাশ হয়ে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে গেলেন। আর পার্থ দুদিন বাদে মা ও আমার শিলিগুড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা আসন্ন সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে টর্চ, মোমবাতি, দেশলাই ইত্যাদি নিয়ে জলপাইগুড়িতে মায়ের কোয়ার্টার্সে ঢুকলাম। আমাদের পিছু-পিছু ঢুকল রমুনা। এই রমুনা বহুদিনের মায়ের প্রিয় একজন, চাকরি তার হাসপাতালের, কিন্তু মায়ের সাত-আটটা গরম্নও সে দেখত। সে এসেই কাঁদতে-কাঁদতে দুটো গরম্ন ভেসে যাওয়ার খবর দিলো। দড়ি দিয়ে বাঁধা দরজা খুলে ঢুকলাম বাইরের ঘরে। মেঝে থেকে চেঁছে পাঁক সাফ করা হলেও ঘরের মেঝে তখনো কাদায় পিছল। ঢোকার দরজার বরাবর ওদিকে বারান্দায় বেরোবার দরজা। এ-দরজা দিয়ে ঢুকে ও-দরজা দিয়ে বেরিয়েই মা আধ-হাঁটু-সমান কাদায় পিছলে পড়লেন। আমি ও রমুনা তাড়াতাড়ি যখন কাদা-মাখামাখি মাকে টেনে তুললাম তখন মায়ের হাতে সেই অসীম অভিলষিত কর্দমাক্ত চেক। যাকে বলে ভোঁজবাজি। সেই বন্যাতে ট্রেজারির পর্যমত্ম সব মূল্যবান কাগজপত্র বিধ্বসত্ম হয় এবং শহরের ব্যাংকগুলোতে আলাদা কাউন্টার খোলা হয় ক্ষতিগ্রসত্ম চেক ও নোট নেওয়ার জন্য। চেকটার টাকা পাওয়া গেলে মা টাকাটা হিতৈষীদের পরামর্শ অগ্রাহ্য করে মঞ্জুকেই দেন, যা দিয়ে রিজেন্ট এস্টেটের জমিটা কেনা হয়। এমনই ছিল ছোট বৌমার ওপর শাশুড়ির আস্থা ও আকর্ষণ।
কারণ ‘তপোবন’ বাড়িটা কেনার চিমত্মা আমরা ধসের পরিণাম দেখে মাথা থেকে বের করে দিয়েছিলাম। ওই ধসে বাড়িটার বাগান, বারান্দা ও বসবার ঘরের একদিকের দেওয়ালসহ প্রায় আদ্ধেকটা ধসে গিয়েছিল। ধস সম্বন্ধে দুবার ফলাফল দেখে-দেখে দার্জিলিংয়ে পাকাপাকি বাস করার বাসনা ধসে গিয়েছিল। শীতের ছুটিতে কলকাতায় এসে যখন প্রেমেন্দ্র মিত্রকে কথাটা জানালাম (স্কুলের জীবন থেকেই তাঁকে মনের মতো দাদা বলে গণ্য করতাম) তখন তিনি বললেন, এ তো সুকুমার রায়ের গল্প হয়ে গেল – বাড়ির নাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় রাখার ফলে বাড়িটাই ভেঙে পড়ল তাসের ঘরের মতো আর তোমরা তপোবনে বাস করতে চাও বুঝতে পেরেই তপোবন ভেঙে পড়ল হুড়মুড় করে। আমাদের নতুন পস্ন্যানের ফলে তাঁর একটা বেড়াতে যাওয়ার জায়গা গেল কমে বলে তিনি আক্ষেপও করলেন। তবু ছেড়ে আসতে হলো চোখের জলে। কী আনন্দে যে দার্জিলিংয়ে কাটিয়েছি কয়েকটা বছর তা বোঝাতে পারব না।
ছেড়ে এসেও ছাড়তে পারিনি। সেই ধসের এক বছর পুরতে না পুরতে আবার দার্জিলিংয়ে। উঠলাম অধ্যাপক দীপক দাশের ফ্ল্যাটে। স্টেশনের ঘাড়ের ওপরেই ছিল তাঁর সরকারি আবাসনের
ফ্ল্যাট। পুজোর ছুটিতে অধ্যাপক দাশ গেলেন কলকাতায়
বাবা-মায়ের কাছে। আমরা সেই ফুরসতে দখল করলাম তাঁর ফ্ল্যাট। খেয়াল করিনি যে, ফ্ল্যাটটার কোথাও হাওয়া বেরোবার জন্য কোনো ফাঁক-ফোকর ছিল না। আমরা ওই ফ্ল্যাটে অধিষ্ঠিত হলে জলপাইগুড়ি থেকে বাচ্চুদাও এসে পড়েন। মঞ্জুর ছিল রান্নার ও লোক খাওয়ানোর নেশা বা শখ। কয়লার আগুনে খুব জমিরোন্না করার পর তাঁর খুব ঘুম পেল। আশ্চর্যের ব্যাপার! তাঁর ঘুম পাওয়া দেখে আমারও কেমন ঘুমে বিবশ বোধ হতে লাগল। আমার কথা শুনে বাচ্চুদাও বললেন, তাঁরও শরীর কেমন অবশ-ক্লামত্ম লাগছে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে হাত-পা নাড়তে। মনে হচ্ছে মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়বেন। মেঝেতে নয়, বাচ্চুদা হেলে পড়লেন খাবার জায়গার জানলার ওপরে আর জানলার পালস্না খুলে গেল বাইরের দিকে।
বাইরের আকাশ তখন ভেসে যাচ্ছে চাঁদের অনমত্ম মায়ায়। অমনই বাচ্চুদা অনুভব করলেন এক আশ্চর্য অনুভব। বুক ভরে চাঁদের আলো পান করতে-করতে ইচ্ছে হলো ডানা মেলে উড়ে যেতে। যে আমি খাবার টেবিলে মাথা রেখে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম সেই আমি মাথা তুলে চোখ মুছে অবাক হয়ে দেখছিলাম খোলা জানলার সামনে সটান দাঁড়ানো বাচ্চুদাকে। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ডাকলেন আমাকে, ‘এসো, দ্যাখো, কী সুন্দর।’ আশ্চর্য! উঠে দাঁড়ালাম! কোথা থেকে শক্তি পেলাম জানিনে। তাঁর পাশে গিয়ে জানলা দিয়ে দেখলাম মায়ের
হাসি-ছড়ানো সমসত্ম পাহাড়ে আকাশে। দেখাব বলে ডাকলাম মঞ্জুকে। বিছানা ছেড়ে তিনিও এসে দাঁড়ালেন আমাদের কাছে। অন্য জানলাটাও খুলে দিলাম! আহ, কী ভালো লাগছে! তিনজনের মনেই তখন একই জিজ্ঞাসা। কী হয়েছিল আমাদের? কেন হঠাৎ অমন কালঘুম পেয়েছিল? কেনই-বা সে-ঘুম কেটে গেল?
পরদিন ম্যালে গিয়ে দেখা হলো দীপক চৌধুরীর সঙ্গে। সবটা শুনে বললেন, ‘খুব বেঁচে গেছ। বাচ্চুদার পড়ে যাওয়ার ধাক্কায় ওরকম মিরাকুলাসলি জানলাটা খুলে না গেলে তোমরাই মরে পড়ে থাকতে। দীপক ফিরে এসে তোমাদের লাশ আবিষ্কার করত।’ আসেত্ম-আসেত্ম রহস্য ভেদ হলো। দার্জিলিংয়ে থাকাকালে
বসিত্মতে-বসিত্মতে এরকম ঘটনার কথা আরো শুনেছি বটে। বিশেষত শীতের মরশুমে। শীতের চোটে বদ্ধঘরে আগুন জ্বালিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়লে আর রক্ষে নেই। আগুনের থেকে দৈত্যের মতো কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস জেগে উঠে গলা চেপে ধরত ঘুমমত্ম মানুষের। দীপকের সরকারি ফ্ল্যাটে ভেন্টিলেশনের কোনো ব্যবস্থা না থাকাতে বদ্ধঘরে রান্নার উলস্নাসে রান্না করার জন্যেই যত বিপত্তি! যেভাবে বেঁচে গেলাম তা শুধু বানানো গল্পেই ঘটতে পারে।
অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে কলকাতায় ফিরে ১৯৭০ থেকে পাকাভাবে ৯৭-এ রিজেন্ট এস্টেটে বাস শুরম্ন করলাম। মা এসে দেখে গেলেন যে আমাদের মাথা গোঁজার জায়গা হয়েছে, তারপর ৪ মে তারিখের ঘোর দুর্যোগের রাতে একা বেরিয়ে পড়লেন চিরযাত্রায়। আমি মঞ্জুর বড়দা শামিত্মপ্রসাদ চৌধুরীর সঙ্গে সিনেমার টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ শুরম্ন করলাম। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে বরাত দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গের ওপর পর্যটনমূলক একটি মুভি করার জন্য। আমরা দেড় ঘণ্টার যে-ছবি করেছিলাম তার নাম পাহাড় থেকে সাগর। সেই ছবির শুটিংয়ের আগের ব্যবস্থা করতে ও মূল শুটিংয়ের কাজে সাহায্য করতে কয়েকবার দার্জিলিংয়ে যাই। প্রত্যেকবারই দেখি দার্জিলিং শহর একটু-একটু পালটে যাচ্ছে অথচ দূরের সবুজ পাহাড়ের মাথায় শুভ্র তুষার মৌলি তেমনই দাঁড়িয়ে আছে কালের অটল প্রহরীর মতো। এদিকে আমাদের ওপর দিয়ে খলখল করে বয়ে যাচ্ছিল কালস্রোত। কোনো সময় হয়তো হায়দ্রাবাদবাসী বড় ছেলের কাছে গোপন ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলাম। আমাদের অবাক করে দিয়ে ২০১১-এর ২৬ ডিসেম্বর বিনাখবরে শুভরূপ ও মাধবী এসে হাজির। পরদিনই আমরা চারজনে পৌঁছোলাম বাগডোগরা। কে শোনে যে আমাদের আর সে বয়স নেই। কালিম্পংয়ের হোটেলে পৌঁছোলাম ২৭ তারিখের সন্ধে সাতটায় শীতে কাঁপতে-কাঁপতে। রম্নম হিটার চালু থাকা সত্ত্বেও গায়ের ওপর হোটেলের ছেলেরা চাপিয়ে দিলো কম্বলের পাহাড়। তার নিচে নড়াচড়া করাই এক কঠিন কুসিত্মকা-। কলকাতা থেকে কালিম্পং যাওয়ার ধকল কাটাতে গেল একটা দিন। পরদিন রবিতীর্থ গৌরীপুর ভবনে। আগেই বলেছি আমার ধারণার বা বিশ্বাসের কথা। মৈত্রেয়ী দেবীর আগ্রহে তিনি মংপুতে যেতেন, কিন্তু ভালোবাসতেন কালিম্পংয়ে যেতে। কারো আহবানে নয়, নিজের প্রেরণায় তিনি যেতেন। কালিম্পং বাজার থেকে বেশ উঁচুতে অনেকটা জায়গা নিয়ে এই বিশাল গৌরীপুর ভবন। একটা আমত্মর্জাতিক সংস্থার দপ্তরের পাশে পোড়োবাড়ির মতো এই বাড়ি। পাকা রাসত্মা থেকে ইংরেজি জেড (ত) অক্ষরের মতো আগুপিছু করে নিচে নেমে গেছে যে-রাসত্মা তার মাঝপথে একটা বিঘে দুয়েক সমতল ক্ষেত্রের ওপরে বাড়িটা। অমত্মত তিরিশ গজ লম্বা বারান্দাতেই বেশ পায়চারি করা যায়। বারান্দা থেকে নেমেই ডান পাশে টেনিস কোর্টের চেয়েও বড় সমতল জমি। বাড়িটার গায়ে একটা ফলকে লেখা আছে যে, ১৯৩৮ সালের পঁচিশে বৈশাখ এই বাড়ি থেকেই রবীন্দ্রনাথ ‘জন্মদিন’ (‘আজ মম জন্মদিন’) 888sport app download apkটি পড়েছিলেন আর তাঁর আবৃত্তির কণ্ঠ সারাবিশ্বে সঙ্গে-সঙ্গে সম্প্রচারের বিশেষ ব্যবস্থা করেছিল অল ইন্ডিয়া রেডিও। রবীন্দ্রনাথ খেপে-খেপে মংপুতে কাটিয়েছিলেন মোট প্রায় ৮০ দিন আর কালিম্পংয়ে মোট ৭০ দিনেরও বেশি। শেষবার তিনি কালিম্পং যান ১৯৪০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। সবাই বারণ করেছিলেন, ডাক্তারদের মধ্যে নীলরতন সরকার ও বিধানচন্দ্র রায় বিশেষভাবে বারণ করেছিলেন। কিন্তু বৃদ্ধের মাথায় জেদ চাপলে তাঁকে রোখা অসাধ্য। অমিয় চক্রবর্তীকে ২৫ সেপ্টেম্বরও কালিম্পংয়ে আসার জন্য লিখছেন আর জানাচ্ছেন যে, নিজের রক্তে অনুভব করছেন জোয়ার আর সামনের পাহাড় পরেছে সোনার মুকুট। ‘অসংখ্য ভাষার শব্দরাজি ছাড়া পেল আজি’ এবং ‘আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ জানে তা কি এ কালিম্পঙ’ – এই 888sport app download apk দুটি লিখে ফেললেন পরপর। সেদিনই সন্ধ্যা থেকে অন্ধকার নামতে লাগল তাঁর চেতনার ওপরে। ফলে ডিসেম্বর পর্যমত্ম তাঁর কালিম্পংয়ে থাকার স্বপ্ন ভেঙে গেল। অর্ধচৈতন্য অবস্থায় তাঁকে কলকাতায় নামিয়ে আনা হয় ২৯ সেপ্টেম্বর।
কালিম্পং থেকে আমরা গেলাম দার্জিলিংয়ে। তিসত্মা বাজার থেকে পেশোক রোড ধরে ঘুম পাহাড়ের জোড়বাংলার পথে নামলাম লাভার্স মিট নামের জায়গাতে। এখান থেকে নিচে তাকালে দেখা যায় তিসত্মা ও রঙ্গিতের মিলনলীলা। একটা স্রোত নীল, অন্যটা সবুজ। স্থানীয় কাহিনি আছে তিসত্মা ও রঙ্গিতের প্রেম। বাল্যপ্রেম দুজনের। তিসত্মা মেয়ে আর রঙ্গিত ছেলে। বাল্যপ্রেম হলেও রঙ্গিত ছেলে তো বটে, তাই সে চঞ্চল, দুরমত্ম। তিসত্মার বাঁধন কাটিয়ে সে এ-পাহাড়ে ও-পাহাড়ে ছুটে-ছুটে যায়। বহুকাল পরে ছুটে-ছুটে ক্লামত্ম হয়ে অবশেষে একদিন রঙ্গিত ফিরে আসে তিসত্মার বুকে। তাই জায়গাটার নাম হয়েছে লাভার্স মিট। গাড়িতে উঠে আবার যাত্রা দার্জিলিং অভিমুখে। দু-তিন বছর আগে মিরিক এসেছিলাম, কিন্তু ‘সাগর থেকে পাহাড়ে’র পরে আর দার্জিলিং আসিনি। মাঝখানে প্রায় পঁয়ত্রিশ বছরের ব্যবধান। শুভরূপ আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল পস্ন্যান্টার্স ক্লাব আর সার্কিট হাউসের মাঝামাঝি একটা হোটেলে। নতুন হোটেল, নতুন শহর। কিন্তু সবই ধূসর মলিন। একদা দার্জিলিংয়ের গৌরব মাউন্ট এভারেস্ট হোটেল যেন কাউন্ট ড্রাকুলার ভয়ংকর প্রাসাদের কংকাল। পস্ন্যান্টার্স ক্লাব থেকে যে-ম্যাল রোড ম্যাল পর্যমত্ম গেছে সেই রাসত্মা বড়দিনের ভিড়ে থিকথিক করছে, পুবের ফাঁকা পথের ওপর বসেছে সসত্মার বাজার। গেস্ননারিজের একতলা জুড়ে সাইবারের অমত্মর্জাল, দোতলায় লাঞ্চ খেতে ঢুকে মাছের হাটে মাছির ভনভন শুনি, তবে খাবার এখনো যথেষ্ট উন্নত মানের। অজিত ম্যানশন’স অ্যানেকসের যে-ফ্ল্যাটগুলোতে আমরা থাকতাম সেগুলোতে যাওয়ার সিঁড়িপথের মুখ আটকানো। যাওয়া বারণ। কারণ নিচের ফ্ল্যাটগুলোর শুধু কিছু বিপজ্জনক জীর্ণ কাঠামো ছাড়া কিছু নেই। তবে সিঁড়ির পাশের মুখটাতে এখনো আছে শামসু সাহেবের দোকান, ছোটো আকারে, কিংবদমিত্মর মাস্টার টেলরের ছেলের হেফাজতে, সে একটু-একটু মনে করতে পারল তারই সমান বয়সের শুভরূপের কথা। তার দোকানের পাশে নেপাল কিউরিয়োর দোকান, কিন্তু দোকানি নবীন যুবক। কয়েক পা উঠে গেলেই ম্যাল, এখনো অনেকটাই আগের মতোই আছে, পশ্চিমের দোকানগুলোর ত্রিকোণ মুখ যেন একই রকম আছে, একই রকম স্থাপত্য, একই রকম দৃশ্য888sport live chat। ম্যাল থেকে লরেটো কলেজের সামনে দিয়ে পশ্চিমের যে-রাসত্মাটা গেছে রাজভবনের দিকে তার ডান হাতের পাহাড় এখনো অনেকটা একই রকম থাকলেও বাঁ হাতের বার্চ হিল পার্ক-টার্কের দিকে উঠেছে অনেক বাড়ি। কেডেন্টার্স-ক্যাপিটলের মোড়েও উঁচু-উঁচু বাড়ি আড়াল করে দিয়েছে দূরের পাহাড়ের সাদা তুষারের শোভা।
পরদিন সকাল-সকাল বেরিয়ে পড়লাম। মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে হিল কার্ট রোডে নেমে দেখি আমাদের বিদায় জানাবার জন্য কখন নীরবে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন আবহমান তুষার মৌলি মুকুটিত মহান নগাধিরাজ। বিদায়, বিদায়! এ-পথে কতবার যে গেছি, বারবার বলেছি, আবার আসব। পুনর্দর্শনায় চ। হায়, আজ সে-কথা বলতে পারলাম কোথায়! আজ কেন বারবার চোখে জল এসে যায়? বিদায়, বিদায়!

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.