আইভি রহমান
‘লেখাটা শুরু হয়েছিল বেশ আনন্দিতভাবে উচ্ছল আনন্দ প্রজাপতির সখ্যের সঙ্গে রংধনুর রং মেশানো আবিরের মুগ্ধতায় :
আমরা যারা নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে দূর প্রবাসে বাস করি, তারাই শুধু জানি ‘জন্মভূমি’ শব্দটা কতটা আন্দোলিত করে গভীর এক টানে আমাদের প্রবাসীদের সবার প্রাণে।
ওই মাটির সোঁদা গন্ধ, ওই গর্বিত অহংকারী পতাকার সবুজ প্রাণ আর রক্তলাল টিপ, ওই দেশের মানুষের সরল-স্নিগ্ধ ভালোবাসার চুম্বক-টান আমাদের উত্তাল করে, 888sport sign up bonusকাতর করে কাঁদায়, ভাবায়, কখনো হাসায় অনাবিল এক আনন্দে।
তেমনি এক উচ্ছ্বাস-আনন্দজোয়ারে ভাসিয়েছিল সাম্প্রতিককালের এক 888sport live chatকর্ম প্রদর্শন এবং 888sport live chatীদের সমাবেশ আয়োজনের ঘোষণা।
আমাদের এই অস্ট্রেলিয়ার তিনটি প্রধান শহর যখন ঘোষণা দিয়েছিল 888sport appsের খ্যাতিমান চিত্র888sport live chatীদের একটি দল আমাদের এই শহরগুলোতে তাদের মূল্যবান এবং অনুপ্রেরণাময় 888sport live chatকর্ম প্রদর্শন করতে আসছেন, উৎফুল্ল ফুল ফুটেছিল সবকিছু আলো করে।
সেই থেকে আমার দিন গোনা শুরু।
মার্চ মাস আমাদের জীবনের এক অবি888sport app download for androidীয় স্পর্ধিত অহংকারের মাস। আমাদের একান্ত নিজস্ব স্বাধীনতা, সুস্থতা ও স্থিতিশীলতার মাস। এই মার্চেই আমাদের মাঝে আসছে ‘জন্মভূমির গান’।
দিন গোনা শেষ লগ্ন এসে গেল, ২৮ মার্চ শুক্রবার কাজের শেষে পড়ন্ত বিকেলে দুরন্ত বৃষ্টি আর কুয়াশাময় আলোয় নিজেকে হালকা মেঘের পালকিতে তুলে চললাম সিডনি।
বুকের ভেতরে দেশের গান। চোখের তারায় দেশের ছবি। কণ্ঠে গুনগুন গুঞ্জন – আমারও দেশেরও মাটিরও গন্ধে ভরে আছে সারা মন… তুমুল বৃষ্টির মধ্যেই চলল গাড়ি। কে পরোয়া করে ঝড়-তুফান বা অন্য কিছুর। জন্মভূমি ডাকছে। আমি ছুটছি।
বারবার ফোন আসতে থাকল আমাদের দেরি হচ্ছে দেখে। বারবিকিউ হচ্ছে 888sport live chatীদের নিয়ে রহমতভাইয়ের বাসায়। তিনিই আমাদের নিমন্ত্রণ করেছেন খুব আগ্রহভরে। সঙ্গে আছেন রানাভাই।
তীব্র বাতাস আর বৃষ্টির ছাঁটকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবশেষে যখন রাত প্রায় ১০টার দিকে পৌঁছে গেলাম নির্ধারিত জায়গায়, তখনো জানি না, আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান বয়োজ্যেষ্ঠ 888sport live chatী কাইয়ুম চৌধুরীকেই ভিসা দেয়নি 888sport appsের অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশন।
ভেতরে ঢুকতেই অনেক পরিচিত মুখের অভ্যর্থনা। হাসিমুখের শুভেচ্ছা। ভেতরের ঘরে ঢুকতেই দেখি অনেক অনেক প্রিয় সেই হাসিমুখ মানুষটি – রফিকুন নবী। আশ্চর্য সুন্দর সেই অভিব্যক্তি আজো তেমনি আছে, বয়সের ছাপ পড়লেও কমেনি এতটুকু উজ্জ্বলতা। দেখলাম সুবীর চৌধুরী দাদাকে।
শেষবার 888sport appয় দেখে এসেছিলাম ২০১৩-র আটাশে জানুয়ারি বেঙ্গল গ্যালারিতে কবি কামাল চৌধুরীর (আমার কামালভাই) জন্মদিনে। নির্মল হাসিমুখের সপ্রতিভ একজন মানুষ। স্মিত হেসে বললেন, ভালো আছো তুমি? অনেক কষ্ট করে ড্রাইভ করে এলে, আগে খাও।
ভেতরের দিকে ছিলেন কনক চাঁপা চাকমাদি, রোকেয়া সুলতানা আপা, ফরিদা জামান আপা, ইকবালভাই, রণজিৎ দাস দাদা। অনেক রাত অবধি খাবার, গল্প, আড্ডা ইত্যাদির পর 888sport live chatীদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে নামমাত্র ঘুমিয়ে নিলাম।
পরদিন সকালে ‘জন্মভূমির গান’ শীর্ষক চিত্রকলা প্রদর্শনীর উদ্বোধন হলো। 888sport appsের বেঙ্গল গ্যালারি, অস্ট্রেলিয়ার 888sport apps দূতাবাস এবং অস্ট্রেলিয়ান ফ্রেন্ডস অব 888sport appsের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এ-অনুষ্ঠানে 888sport appsের স্বনামধন্য দশজন 888sport live chatীর চল্লিশটি চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হবে দুদিন ধরে। প্রচুর লোকসমাগম হয়েছে এ-প্রদর্শনী দেখতে। বিশেষ করে আমাদের 888sport live chatীদের সঙ্গে আলাপ করতে, ছবি তুলতে। অন্যরকম এক সুন্দর পরিবেশের ভেতর মেতে রইলাম সারাদিন।
আমার 888sport app download apkর বই আর সিডি 888sport live chatীদের সবাইকে দিলে তাঁরা খুব খুশি হলেন।
সুবীরদা আমার হাত থেকে বইটা নিয়ে হাত ধরে বললেন, এবার 888sport app download apk নয়, এবার আমাদের এই সফর নিয়ে একটা গদ্য লিখে আমাকে দেবে আমাদের পত্রিকা কালি ও কলমের জন্য।
আমি বললাম, দেবো দাদা।
বিকেলের আগে আগে আমরা বেশ কজন মিলে 888sport live chatীদের নিয়ে ছুটলাম আমাদের প্রাণের মিনার ভাষাশহীদের জন্য আমাদের এই প্রবাসের বুকেও নির্মিত শহীদ মিনারে।
একসঙ্গে সবাই মিলে মজা করে আড্ডা মেরে বিকেলের হালকা নাস্তা করলাম। সুবীরদার বারবার যেখানে-সেখানে ঘুমে ঢলে পড়া নিয়ে আমি কৌতুক করলে রনবী ভাইয়া হেসে বললেন, আইভি, তুমি কিচ্ছু জানো না, সুবীর ঘুমায় কই, ও মাঝে মাঝে জেগে ওঠে। সবাই হাসলাম প্রাণখোলা হাসি।
আচানক খবর পাওয়া গেল, আর্ট গ্যালারিতে যাঁর তত্ত্বাবধানে রেখে আসা হয়েছিল প্রদর্শনীর সব ভার, তিনি থাকতে পারবেন না, বিশেষ কারণে তাঁকে যেতে হবে। রহমতভাই তাঁকে বলে দিলেন, গ্যালারি তালা মেরে চলে যেতে। বিকেল পাঁচটার বেশি বাজে, তার ওপর ছুটির দিন আর কেউ তেমন আসবে না এই ভেবে।
একটু দূরের টেবিলে সুবীরদা ছিলেন। তাঁর কানে কথাটা যেতেই উত্তেজিত হয়ে গেলেন। ওনার এক কথা, সময়সীমা বেঁধে দেওয়া আছে – সকাল দশটা থেকে রাত আটটা – ঠিক সেইমতোই প্রদর্শনী চলবে। কেউ আসুক বা না আসুক।
দলপতির প্রবল একনিষ্ঠতা, সময়ানুবর্তিতা এবং সর্বোপরি তাঁর নেতৃত্বদানের প্রজ্ঞার সামনে সবাই কুঁকড়ে গেল।
সুবীরদা, ইকবালভাই, রণজিৎদা, রহমতভাইকে নিয়ে মুনির আবার ছুটল শহরের আরেক প্রান্তের গ্যালারিতে।
আমরা বাকিরা গেলাম রোকেয়া আপার মেয়ে লরার বাসায়। রাতের খাবারের আয়োজন ছিল ওর বাসায়। রাত আটটার পর প্রদর্শনী শেষ করে ওনারা এসে যোগ দিলেন আমাদের সঙ্গে। জানা গেল, ওই সন্ধ্যায়ও বেশকিছু দর্শক এসেছে এবং আগ্রহভরে দেখেছে এই আয়োজন।
লরার বাড়িতে প্রচুর আনন্দ করে আমার গাড়িতে করে রফিকুন নবী, ফরিদা আপা আর কনক চাঁপা আপাকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে পরদিন ক্যানবেরা ফিরে এলাম।
ক্যানবেরায় প্রদর্শনী উদ্বোধনীর দিনেই সুবীরদা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। রাতে প্রদর্শনী শেষে বাড়ি না ফিরে সোজা হাসপাতালে গেলাম। কেউ ছিল না, দাদা একাই ছিলেন। আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, কেমন হলো আজকের অনুষ্ঠান, দর্শক কেমন হয়েছে, ছবি বিক্রি হয়েছে কিনা – এসব। ডাক্তার এলেন আমাদের সামনেই। জানালেন তখনি পাওয়া সিটি স্ক্যান রিপোর্টের কথা।
ব্রেনে টিউমার!
এই পর্যন্ত লিখে আর লেখা হয়ে ওঠেনি। থেমে গিয়েছিল কলম, দাদার জন্য মন খারাপের উদাস হলদে পাতায় কলম আর চলেনি।
কেন যেন থেমে গিয়েছিল আমার শব্দের শহর। অজানা এক স্থবিরতা গ্রাস করেছিল আমাকে। আমি নিস্তেজ নিষ্প্রভতায় ডুবে গিয়েছিলাম বেশ কিছুটা সময়। কারণ জানা নেই।
খুব বেশি আবেগী মানুষদের এটাই বুঝি এক বড় সমস্যা। না বলা যায়, না সওয়া যায়, শুধু ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাওয়া।
দাদাকে দেখতে গেছি যতদিন ক্যানবেরা হাসপাতালে ছিলেন। দাদার একমাত্র ছেলে ইমন এলো। ব্রিসবেন থেকে তাকে বাসায় নিয়ে এলাম। ইমনের সঙ্গে অল্প কিছুদিনের ভেতরেই গড়ে উঠল আন্তরিক এক আত্মিক সখ্য।
তারপর ক্যানবেরা হাসপাতালের ডাক্তারদের বিভিন্ন জটিলতার কারণে সিডনি নিয়ে যাওয়া হলো দাদাকে। প্রতিদিন ইমনের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে খবর নিয়েছি।
প্রতিবার ফোন রাখার পর ভেবেছি, আজকেই দাদাকে কথা দেওয়া লেখাটা শেষ করে ফেলব। হয়ে ওঠেনি বিভিন্ন কারণের বেড়াজালে আটকে গিয়ে। তবু ভেবেছি, বারবার ভেবেছি। ইমনকে বলেছি, বাবার অনুরোধে একটা লেখা শুরু করেছি। সে বলেছে, আন্টি, লেখেন। কথা ছিল শেষ করে ইমনকে মেইল করে দেবো।
সিডনি যাওয়ার পর সেখানের ম্যাকুরি ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে আবার বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেওয়ায় দাদাকে নিয়ে যাওয়া হয় ওয়েস্টমিড হাসপাতালে।
দাদার বোনের মেয়ে আর তার বর সাজু কাছেই থাকে। সেও ছিল অন্যতম কারণ সিডনি যাওয়ার পেছনে। সাজুর সঙ্গেও ফোনে কথা বলে দাদার খবর নিয়েছি। ইমনের পক্ষে মাঝে মাঝে বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে যেত বাবার পাশে থাকা। সেও মাত্র ব্রিসবেন এসেছে তার পিএইচডি করতে। তারও ক্লাস থাকে। পড়াশোনা থাকে।
এসব নানা ধরনের কষ্ট এবং তার সমাধানের উপায় খুঁজে খুঁজেই চলছিল দাদার একাকী বেদনার্ত অসহায় হাসপাতাল-জীবন।
একাকী বলতে আপন স্বজনের অনুপস্থিতি। একমাত্র কন্যার হাত ধরে কিছু বলা বা বউদির সঙ্গে একান্ত কিছু কথার অবকাশ যে একেবারেই ছিল না দাদার জীবনের এ-অধ্যায়ে।
তিরিশে এপ্রিল দুপুরের দিকে বুকে তীর বেঁধার মতো মারাত্মক যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলাম। সেদিন অন্যরকম এক তীক্ষ্ণ শব্দ করে আমার মোবাইলে ইমনের পাঠানো টেক্সট এলো, ‘বায়োপ্সি’র ফলাফল পাওয়া গেছে, আন্টি, বাবার এক ধরনের ক্যান্সার ধরা পড়েছে, কেমোথেরাপি শুরু হবে কাল থেকে।’
এর নাম কী আমার জানা নেই। আত্মার গভীরে কান্না জমে যেতে থাকে। প্রার্থনার বেগ ক্রমশ বাড়তে থাকে দুরন্ত ঘূর্ণির মতো।
কিছু মানুষের জন্য একটা জায়গা অজান্তেই আসন গড়ে নেয় অন্তরের খুব গভীরে। সুবীরদাও তেমনি একজন মানুষ। তাঁর এই ভয়াবহ দুঃসময়ে আমাদের কারো কিচ্ছু করার নেই। শুধু উত্তোলিত হাতের প্রার্থনার নিবেদন ছাড়া।
আমরা যারা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি বা কাছে থেকে তাঁকে জেনেছি, তারা মগ্ন হই এক প্রার্থনায়।
আমাদের সবার মিলিত প্রার্থনার জোয়ারে যদি ভেসে যায় ওই ভয়ানক কালব্যাধি!
আমরা আশায় বুক বেঁধে অপেক্ষায় থাকি, কেমো দিলে নিশ্চয় ধীরে ধীরে দাদা আবার আগের পর্যায়ে ফিরে যাবেন। সময় লাগুক।
কেমো শুরু হওয়ার কথা তিরিশে এপ্রিল থাকলেও শারীরিক দুর্বলতার এবং আনুষঙ্গিক আরো অনেক কারণে সেই কেমো শুরু হলো বেশ দেরিতে।
মে মাসের চার তারিখে ইমনের টেক্সট আবার অন্ধকার ঘনিয়ে দিলো চোখের চারপাশ। সে লিখেছিল, ‘বাবা ভালো নেই’ বুকের ভেতরে হাতুড়ি পিটেছিল। তৎক্ষণাৎ ফোন দিয়ে শুধাই – উত্তর মেলে, অবস্থা বেশ খারাপ। কিছুই বলা যাচ্ছে না।
মাঝে মাঝেই ইমন আলাপ করত। জানাত বাবাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টার কথা। খুব চেয়েছিল সে; কিন্তু সিডনির ডাক্তারদের পক্ষ থেকে সেই ছাড়পত্রই মেলে না।
অবশেষে মে মাসের তেরো তারিখে প্রথম কেমো দেওয়া হলো দাদাকে দুপুর একটা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত। কিন্তু অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন মনে হলো না।
এই ভালো, এই আবার বেশ খারাপ – এভাবেই চলছিল। এর মাঝে দেওয়া হলো আরো একটা কেমো।
888sport app থেকে বেঙ্গল গ্যালারির কর্ণধার আবুল খায়ের ভাই ছুটে এলেন দাদাকে দেখতে মে মাসের এগারো তারিখের দিকে। নিজের চোখে দেখে জেনে এবং বুঝে গেলেন দাদার অবস্থা। যা কিছু প্রয়োজন মনে করলেন দাদার ভালোর জন্য তার ব্যবস্থা করে গেলেন।
অলক্ষে কেউ নির্দেশ দেয়। অজান্তে কেউ সব পাই পাই হিসাব করে রাখে। কবে কখন কীভাবে কোথায়। আমাদের কোনো পরিকল্পনাই কাজে আসে না।
আমাদের নিয়তির কাছে আমরা অসহায়। বড় বেশি অসহায়।
আমাদের কারো হাতেই কিছু নেই। কেউ কিচ্ছু করতে পারছে না। পারা যায় না।
উনিশে মে দুপুরের দিকে ক্যানবেরা থেকে দাদাকে দেখতে গেলাম সিডনির ওয়েস্টমিড হাসপাতালে। বেশ খানিকটা দুর্বল হয়ে গেছেন। আমাকে দেখে হাসলেন খুব মলিন এক টুকরো হাসি। জিজ্ঞাসা করলাম, খেতে পারছেন দাদা। বললেন, না। সলিড খাবার খেতে পারছি না।
বেশ খানিকটা সময় দাদা আমার হাত ধরে রইলেন চুপ করে। আমার মনে হলো তাঁর অনেক কিছু বলার আছে। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, দাদার চোখ ভেজা বাষ্পে জমে আসছে। আমার মনে হলো, এ-মুহূর্তে বউদিকে ভীষণ দরকার দাদার পাশে। একমাত্র মেয়েটি যদি বাবার মাথায় আলতো করে হাত রাখত, হয়তো অন্যরকম এক অনুভব পেতেন দাদা। শুকিয়ে যাওয়া মুখটাতে হয়তো একটু মলিন আলো জ্বলে উঠতেও পারত। সে-আলো আর জ্বলল না। একেবারেই না।
এর আগে ক্যানবেরাতে ইমনকেও বউদিকে আনানোর কথা বলেছি। ইমন জানিয়েছে, সেটা সম্ভব নয়। কারণ বউদির নিজেরও রয়েছে বেশকিছু শারীরিক সমস্যা। অত লম্বা সময় বিমান 888sport slot game তাঁর দ্বারা হবে না।
ভেতরে ভেতরে কান্না চেপে রেখে বললাম, দেশে কথা বলেছেন কবে। খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বললেন, মনে নেই। পরক্ষণেই বললেন, দেশে যাব একটু ভালো হলেই।
ফিরে আসার সময় ফিরে ফিরে তাকিয়েছি। মনে মনে আপ্রাণ প্রার্থনা করেছি – এই দেখাই যেন শেষ দেখা না হয়।
সময় গড়িয়ে গেছে। দাদার অবস্থা দিনে দিনে খারাপের দিকেই যেতে থেকেছে। মাঝে হয়তো একটু ভালো হয়, কিন্তু থাকে না বেশিক্ষণ। এভাবেই চলে যাচ্ছিল।
জুন মাসের প্রথম দিকে ইমন আবারো খুব চেষ্টা করা শুরু করল দাদাকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার। ডাক্তার জানিয়েছিলেন, দেখা যাক যদি এরকম থাকে আর সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের সব কাগজপত্র যদি যথাযথভাবে পূরণ করা যায় ওদের শর্তমাফিক, তবে নেওয়া যেতে পারে ওদের রোগী বহনকারী বিশেষ স্ট্রেচারে করে।
দাদা নাকি মাঝে মাঝেই ইমনকে জিজ্ঞাসাও করতেন তাঁর ফ্লাইট কবে। প্রথম দিকে অস্ট্রেলিয়া ছেড়ে যেতেই চাইতেন না, ভাবতেন এখানে থাকলেই সুস্থ হয়ে বাড়ি যেতে পারবেন। কিন্তু পরের দিকে নানা রকম জটিলতাজনিত ধকলে তিনিও চাইছিলেন না আর এখানে থাকতে।
জুনের বিশ তারিখে কেন যেন মনে হলো দাদাকে দেখতে যাব। বিকেলের দিকে কাজ শেষ করে আবার সেই তিন ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে গেলাম ওয়েস্টমিড হাসপাতালে। বেশ রাত হয়ে গিয়েছিল। কোনোমতেই ঢুকতে দেবে না। রোগী দেখার নির্ধারিত সময়সীমা পেরিয়ে গেছে খানিক আগে এই বলে ফিরিয়ে দিলো। অথচ আমার কপালে হয়তো লেখা ছিল, শেষবারের মতো আবার দেখা। ভেতর থেকে একজন বেরিয়ে আসতেই প্রবেশপথের স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে গেল; আর আমাকে রোখে কে! সোজা মাথা নিচু করে কোনোদিকে না তাকিয়ে হন-হন করে ঢুকে গেলাম। সাজু ছিল হাসপাতালে। তার থেকে ঠিক কোথায় যেতে হবে জেনে নিয়ে যখন সেখানে পৌঁছলাম, সেখানেও বাধা।
দাদাকে আইসিইউতে রেখেছে। ডাক্তার নাকি জানিয়ে দিয়েছেন যাকে যাকে জানানোর জানাতে। আজকের রাত মনে হয় কাটবে না।
আইসিইউর নার্সদের অনুরোধ করা হলো যে, আমরা সুদূর ক্যানবেরা থেকে এসেছি একটু যেন দেখতে দেওয়া হয়। তারা অনুমতি দিলেন।
ভেতরে গেলাম। কী করুণ এক অকল্পনীয় দৃশ্য! আমার চোখে আমি কাকে দেখলাম নিজেই জানি না। অবশ হয়ে গেল পায়ের পাতা। ওই শীতের রাতেও বুঝতে পারলাম হাতের তালু ভিজে যাচ্ছে।
নেতিয়ে পড়ে থাকা শরীরে যেন এক বিন্দুও শক্তি অবশিষ্ট নেই আর। দাদার বাঁ-হাতের দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা হু-হু করে উঠল। টকটকে লাল ক্ষত-বিক্ষত পুরোটা হাত অবশ পড়ে আছে। নাকে-মুখে-হাতে নল দিয়ে রক্ত, অক্সিজেন আর স্যালাইনের অবিরাম চলমান প্রক্রিয়া চলছে।
বিছানার পাশে একটু দাঁড়ালাম। দাদা খুব ধীরে ধীরে কেন যেন চোখ খুললেন, সোজা তাকালেন আমার দিকে – খুব কষ্টের ছায়া সে চোখের ঘোলাটে পাতায়। কোনো ভাষা নেই আমার সেই ক্ষণের বিবরণ প্রকাশের। আমার কষ্টের নোনা লবণ গলে যাওয়ার আগেই বেরিয়ে এলাম খুব আস্তে আস্তে।
পরদিন বিকেল নাগাদ ইমনের কাছ থেকে কোনো টেক্সট না পেয়ে সন্ধ্যায় কাঁপাকাঁপা হাতে ওকে ফোন দিলাম। জানলাম কাল রাতের ওই ভয়াবহ নীল বিষাক্ত মৃত্যু দানবের ছোবল কামড়াতে পারেনি দাদাকে। স্বস্তির চাপা নিশ্বাস জানিয়ে দিলো, আমাকে আমার ভয়ের তীব্র কাঁপুনি আপাতত থামাতে হবে।
এর মধ্যে শুরু হয়ে গেল আমাদের রোজার মাস। দ্বিতীয় রোজার দিন তিরিশে জুন সকালে এলো সেই খবর। সেই বুক-কাঁপানো চোখ-ভাসানো খবর। দাদা আর নেই। থম মেরে থাকা আমার ভেতরে তখন আর কিছু করতে মন চাইল না। নিস্তেজ আমার মনে হলো আমি খুব কাছের, খুব আপন কাউকে হারিয়েছি। আমার সমগ্রতায় কালচে বিষণ্ণতা ছেয়ে গেল।
সন্ধ্যায় ইফতার খেয়ে ইমনের নাম্বার ডায়াল করি। ইমন ফোন ধরে। মিনিটখানেক কিছু বলতে পারি না। তারপর জিজ্ঞাসা করি, তুমি দেখতে পেয়েছিলে? সে জানাল, না। তাকে ভোররাতেই হাসপাতাল থেকে ফোন করেছে। অবস্থা মারাত্মক অবনতির দিকে।
ছেলেটা কাঁপা-কাঁপা হাতে টিকিট বুক করতে যেয়ে ভুল করে বসে। এয়ারপোর্টে গিয়ে দেখে, সে সকালের বদলে দুপুরের টিকিট কেটেছে। ইমন যখন সিডনি পৌঁছায়, তার বেশ আগেই তার বাবা চলে গেছেন অজানা গন্তব্যে। না ফেরার দেশে। চলে গেছেন অন্য কোথাও, অন্য এক তুলির অাঁচড়ে অন্য কোনো ভুবনের ছবি অাঁকতে।
জিজ্ঞাসা করলাম, বাবার ডেডবডি নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে কিনা। জানাল, হচ্ছে। চার তারিখে 888sport app পৌঁছাবে। শুধালাম, এখন কোথায় ডেডবডি, সে জানাল এখনো বেডেই পড়ে আছে।
আমি যেন চিৎকার করে উঠলাম, মানে কী, সেই সকালে যিনি মারা গেছেন তার বডি এখনো কেন বিছানায় পড়ে থাকবে। ইমন বলল, আন্টি, এটা তো আমিও ভাবিনি, সত্যি তো এখনো কেন ফ্রিজে বা যেখানে ডেডবডি রাখে সেখানে নেওয়া হয়নি। তারপর নার্সদের বললে তারা ব্যবস্থা করে।
দাদা চলে গেলেন, শুধু সিডনি ছেড়েই না, চলে গেলেন এই আলোকিত পৃথিবীর আলো-ছায়া থেকে দূরে অন্য কোনো এক অজানা হলদে আলোর দেশে।
আমরা যারা তাঁকে দেখেছি, জেনেছি কাছে থেকে, তাদের কাছে রেখে গেলেন 888sport sign up bonusর জ্বলজ্বলে এক জোনাকি সমুদ্র। আমরা তাতে মাঝে মাঝেই সাঁতরাবো, মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যাব, মাঝে মাঝে জ্বলে উঠব তাঁর 888sport sign up bonus-বেদনায় আনন্দে। আমাদের কারো কারো চোখ ছলছল করে উঠবে। কারো মন বেদনায় মলিন হবে।
এই লেখা যখন শেষ করতে বসেছি, 888sport appয় তখন দাদার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়ে গেছে। একমাত্র পুত্রের হাতে মুখাগ্নিতে ভস্মীভূত হয়ে দাদার দেহ জ্বলে জ্বলে উজ্জ্বল আলো জ্বেলে গেছে।
জীবনের জলজ্যান্ত ছবি হুট করে ওই দূর আকাশের বুকে স্থির নক্ষত্র হয়ে গেছে।
অজানা সেই দেশের মাটিতে হয়তো তিনি ভালোই আছেন। এই ভেবে আমিও ভালো থাকার চেষ্ট করি লেখাটা শেষ করার মধ্য দিয়ে।
আমার মনের আকাশে জেগে ওঠে শেষবার দেখা দাদার ঘোলাটে মলিন বিবর্ণ সেই চোখজোড়া।
আমি মনে মনে বলি, ভালো থাকবেন দাদা। অনেক ভালো।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.