শঙ্করলাল ভট্টাচার্য
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষের উদ্যাপনে বাঙালি কেমন করেই জানি ভুলে রইল যে, এ-বছরটায় ১৫০তম জন্মদিন 888sport apkী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়েরও। এই বাইশে শ্রাবণে কবির সপ্ততিতম মৃত্যুবার্ষিকীও 888sport app download for android করল বাঙালি; কিন্তু এখনো কীরকম সে ভুলে থাকছে ৬ ভাদ্র তারিখটা (ব্রাহ্ম সমাজের পত্তনের তারিখও এটা), যেদিন এ-বছর শতবর্ষে পা দিচ্ছেন কবির গানের সেই যুগন্ধর 888sport live chatীটি – দেবব্রত বিশ্বাস। জীবনে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়ে ১৯৮০-র এক শ্রাবণ দিনে (২৮ আগস্ট) যেদিন তিনি তাঁর ১৭৪ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউর বাসা খালি করে চলে গেলেন চিরদিনের মতো, সেদিন থেকেই তিনি আস্তানা গাড়লেন এপার বাংলা-ওপার বাংলার কোটি মানুষের বক্ষস্থলে। মানুষের বুকের যে-অঞ্চলে অমর মানুষের বসবাস। জানি না, জীবনে তিনি কবির এই কথাগুলো সেভাবে কখনো উচ্চারণ করেছিলেন কিনা, কিন্তু করলে এই হতে পারত তাঁর সেরা আত্মপরিচিতি – ‘করি না ভয় তোমারি জয় গাহিয়া যাবো চলিয়া, দাঁড়াবো আমি তব অমৃতদুয়ারে।’ শুধু মনে আছে সেদিন রাতে বাড়িতে বেজেছিল ওঁর কণ্ঠে চিরস্থায়ী করা কবির সেই গান যা একবার শোনানোর অনুরোধ করায় হেসে বলেছিলেন, ‘বেশ তো হাসতাছি, আমারে কান্না করাইয়া কী মজা পান কন তো?’ – ‘মম দুঃখের সাধন যবে করিনু নিবেদন তব চরণতলে/ শুভলগন গেল চলে’।
তাঁর শতবার্ষিকীতে বাঙালির হেলদোল নেই দেখে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন জর্জদাই (ওঁকে নিয়ে এভাবে বলার অনুমতি চেয়ে নিচ্ছি), কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতার প্রতি কী বিরোধ ছিল মানুষটার! জীবনের শেষবেলায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের অনুরোধ ফেলতে না পেরে মঞ্চে সংবর্ধনা নিতে বসেছিলেন। ১৯৭১-এ গান রেকর্ড করা বন্ধ করার পর থেকে গোটা দশকজুড়ে নিজের ছোট্ট বসার ঘর কাম গানের ঘর কাম অফিস ঘরটাকেই এক মঞ্চ করে সাজিয়ে বসেছিলেন জর্জদা। সেখানে বসেই আড্ডা, চিঠি লেখালেখি-পড়াপড়ি, তাস, চা, পান-জর্দা, গান, অভিমান, 888sport sign up bonus রোমন্থন সব চলছে। যাকে ভালো বুঝছেন বাজিয়ে দেখছেন মানুষ ওঁকে ভালোবাসে কী বাসে না। বাসলে কতটুকু বা ক-তখানি। একদিন ওঁর লেখা দশটা চিঠির পাঠ শোনার পর একটা গানের অনুরোধ করায় কী অভিমান! – ‘আপনে তো ফ্রিতে গান শোনতে আসেন, আমার জন্য আসেন না!’ গিয়ে গিয়ে ক্রমশ বুঝছিলাম যে, এতবড় একজন 888sport live chatী যাঁর গানের টিকিটের জন্য লাইন পড়ে, তিনি গানকে কীভাবে মঞ্চ থেকে বার করে নিজের খোলামেলা দৈনন্দিন জীবনের ভাষা ও ভাষ্য করেছেন, বলতে গেলে এক নিত্যব্যবহার্য 888sport live chat করেছেন। ফতুয়া আর লুঙি পরে পান চিবোতে চিবোতে হারমোনিয়ামের রিডে খেলা করছেন, আড়চোখে দেখলেন বাইরে মেঘ হচ্ছে, বললেন, ‘ভাবতাছেন আমি বর্ষার গান গামু? না, গামু না।’ বলেই ধরলেন ‘নয়ন ছেড়ে গেলে চলে, এলে সকল মাঝেÑ/ তোমায় আমি হারাই যদি তুমি হারাও না যে ॥’
আমি শুনছি আর ভাবছি, এ কী মানুষ রে ভাই! কী প্রেম! ঔদ্ধত্য! গান দিয়ে তো যা খুশি করতে পারে!
গান শেষ করে বললেন, ‘মনটা একটু ভালো হইল। অ শ্রীকান্ত, আমাগরে চা দ্যাও।’
জিজ্ঞেস করতেই হলো, ‘মন ভালো হল কেন?’
বললেন, ‘বোঝলাম আপনে আমার শত্তুর নন।’
বললাম, ‘তাই? কীভাবে বুঝলেন?’
বললেন, ‘এই বাদলার দিনে একখান পূজার গান এই হাঁইপ্পো গলায় শুইন্যা ফালালেন।’ বলেই হাঁপানির েস্প্র বার করে মুখে পাম্প করতে লাগলেন।
১৪১৮-র ৬ই ভাদ্রর পাশে এসে এই মানুষটাকেই আজ সবচেয়ে রাবীন্দ্রিক বলে ঠাহর হচ্ছে আমার। রবীন্দ্রসংগীতকে প্রেম ও প্রতিবাদ, বিরহ ও বিদ্রোহ, জয় ও পরাজয় – সব মুহূর্তেই এমন সফরসঙ্গী করার আদত আর তো দ্বিতীয়টি দেখলাম না অ্যাদ্দিনে। বব ডিলানের মতো উনি গানকে লাইফস্টাইলে বেঁধেছিলেন, অ্যাকসেসরি বা অনুষঙ্গ করে নয়, হাতের হাঁপানির ¯েপ্রর মতো জীবনদায়ী শ্বাস হিসেবে। কোনো আদিখ্যেতা ছাড়াই, অনুরোধ-উপরোধ ছাড়াই, একটু গলা সাধার প্রয়োজন ছাড়াই, অদ্ভুত অদ্ভুত সব গান গেয়ে ফেললেন শুধু, ওঁর ভাষায়, ‘একটু খুলে দেখার জন্য।’ অর্থাৎ গানটাকে একটু কাছ থেকে দেখা!
একটা প্রশ্ন অনেকের মনেই উঠেছিল রবীন্দ্রনাথের কপিরাইট এবং ওঁর গানের বোর্ড যখন উঠে গেল। প্রশ্নটা হলো : এই মুহূর্তে দেবব্রত বিশ্বাস বেঁচে থাকলে নতুন কী করতেন যা আগে করা সম্ভব ছিল না। তাতে ঘুরেফিরে একটাই উত্তর আসছিল : যা তিনি করেছেন ছয় এবং সাতের দশকে অবিকল তাই। প্রাণ দিয়ে স্বরলিপির মধ্যে গান প্রতিষ্ঠা করা। স্বরলিপি ভাঙার কথা তিনি কদাচ ভেবেছেন, স্বরলিপির মধ্যে গান খুঁজেছেন, গান গেয়ে গেয়ে তাদের একটু ‘খুলে দেখেছেন’। একদিন প্রবল উত্তেজনার মুখে ওঁর মুখে কঠিনতম কথাটা শুনে ফেলেছিলাম যা ওঁর প্রয়াণে আনন্দলোকের 888sport app download for androidরচনায় উল্লেখ করেছিলাম; বলেছিলেন, ‘নিছক স্বরলিপিচর্চা (পড়–ন নি®প্রাণ স্বরলিপি পরিবেশন) পরের বাড়ির বাসন মাজার মতন।’ যার অর্থ অবিশ্যি নিজের ইচ্ছে ও সুবিধে মতো স্বর লাগানো নয়, স্বরকে নিজের মতো করে বোঝা, আত্মস্থ করা, তাকে নিজের কণ্ঠ ও মেধা দিয়ে রূপদান করা। রবীন্দ্রসংগীতে প্রায় স্বশিক্ষিত দেবব্রত বিশ্বাসের প্রবল আকর্ষণ ছিল স্বরলিপির প্রতি, স্বরলিপির বই দেখে গান তুলেছেন গলায়। কিন্তু গান শিখেছেন ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর কাছে, যিনি রবীন্দ্রনাথের কিছু গান পিয়ানো বাজিয়ে গাইতেন, কোনোটি বা হারমোনাইজ করে নিতেন। নিজের অনুষ্ঠানে দেবব্রতকে দিয়ে গানও গাইয়েছেন ইন্দিরা দেবী। ধরাবাঁধা নিয়মের বাইরে যে-কয়েকটি উপায়ে রবীন্দ্রসংগীতে প্রাণ সঞ্চার করা যায় তার একটি দেবব্রত শিখেছিলেন ইন্দিরা দেবীর কাছে।
পণ্ডিতি করার জন্য নয়, একেবারেই কার্যকারণ হেতুতে চিত্রপরিচালক জ্যঁ লুক গোদারের একটা উক্তির 888sport app download for android নিচ্ছি। যখন বলেছিলেন নিজের সময় ও মানুষের পরিচয় দিতে, ‘উই আর দ্য চিল্ড্রেন অব মাক্স অ্যান্ড কোকাকোলা।’ আজকের প্রজন্মের রবীন্দ্রসংগীত888sport live chatীরা হয়তো জানেন, হয়তো জানেন না, যে, তাদেরও এক সার্থক, সম্যক পরিচিতি এই যে, তাঁরা রবিঠাকুর আর জর্জদার সন্তান। কবির গান আর জর্জদার গায়নই তো তাঁদের ঘোর আচ্ছন্ন করে আছে। খোলা গলা, উদাত্ত স্বরক্ষেপ, মার্জিত দরদ, প্রসন্ন মেজাজ, আনন্দ ও বিরহের প্রতি সমান আনুকূল্য এবং গভীর প্রেম – জর্জ বিশ্বাসের এই যে এক প্যাকেজ ওঁর গানকে ছয় ও সাতের দশকে টপ অব দ্য চার্ট করে রেখেছিল (আটের দশকের গোড়ায়ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আমাকে বলেছিলেন, রবীন্দ্রসংগীতের সেল রিপোর্ট যা দেখছি তাতে আমাদের সবার চেয়ে জর্জের বিক্রিই বেশি। এবং আজও প্রায় অম্লান রেখেছে তা দশকে দশকে নতুন নতুন ভক্তবাহিনী গড়ে নিয়েছে। শুধু রবীন্দ্রসংগীতের উঠতি শ্রোতাদের মধ্যেই নয়, আধুনিক, ফিল্মি গান, বিলিতি পপ, দেশি উচ্চাঙ্গ, লোকগান কী ব্যান্ডগীতির ভক্তসমাজ থেকেও আজকের রবীন্দ্রসংগীত888sport live chatীর সত্যিই যদি কোনো ভগীরথ থেকে থাকেন তবে তা ওই এক ও অদ্বিতীয় জর্জদা।’ শুধু ভয়, এই নবীনদের অধিকাংশই হয়তো সেটা মেনে উঠতে পারেননি, নাহলে স্বাধীনতার নামে, পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে এতো লণ্ডভণ্ড রবীন্দ্রসংগীত আমাদের শুনতে হতো না।
গোটা রবীন্দ্রসংগীতকেই ‘প্রান্তরের এ গান আমার’ বলে ঘোষণা করে দিতে পারতেন জর্জদা। কারণ গানকে চার দেওয়ালের বাইরে, নয়তো হৃদয়ের গভীরে দেশে নিয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা ছিল জর্জদার। মেস থেকে মেসে, এখান থেকে ওখানে, শেষে ১৭৪ই রাসবিহারীতে টানা দীর্ঘকাল এক শহুরে বাউলের জীবন কাটিয়ে গেছেন জর্জদা। এক সময় একটা হিলম্যান গাড়িও কিনে ফেলেছিলেন, সেটা কিছুদিন চড়ে কাকে একটা দানও করে দিলেন। যতদিন না পড়ে পা ভেঙেছেন ততদিন দিব্যি হু-হু করে চালিয়ে বেড়িয়েছেন একটা মোটরসাইকেল। নিজের মধ্যে থুম হয়ে বসে থাকা জর্জদা বহিরঙ্গে এভাবে গতি আনার চেষ্টা করেছেন। আজকে যখন কোনো নবীন যুবাকে পিলিয়নে বান্ধবীকে বসিয়ে মোটরবাইকে ছুটতে দেখি আমার প্রশ্ন জাগে, ও কানের হেডফোনে কী শুনছে? ও কি জর্জদার ‘আমি চঞ্চল হে,/ আমি সুদূরের পিয়াাসি’ শুনছে? হয়তো এ-গানের অস্তিত্বের কথা ও জানেও না, কিন্তু এ-মুহূর্তে, এই দৃশ্যে আমার ওকে জর্জদার এক নবীন সংস্করণ বলে মনে হচ্ছে। এমনই ভাবে আজকের যুবশ্রেণির মধ্যে জর্জদা ভর করেছেন। বুকভরা প্রেম নিয়ে নবীনদের ওপর কীভাবে ভর করতেন ভদ্রলোক তার একটা উদাহরণ দিই তাহলে?
তখন বাজারে ব্রয়লার চিকেনের রব উঠেছে, উনি তাই রেঁধে খাওয়ানোর নেমন্তন্ন করলেন। কাগজের শিফটের ডিউটির দরুন গিয়ে উঠতে পারিনি, দুদিন পর অফ ডেতে যেতে দেখি কী অভিমান ভদ্রলোকের! ‘আপনারা টাকার মর্ম কবে বুঝব্যান কন দিকি? আমি ব্রয়লার চিকেন আইন্যা রাঁইধলাম সারা সকাল ধইর্যা আর আপনাগোর পাত্তা নাই। আর সামনে আইয়া তো ‘জর্জদা’, জর্জদা’ কইয়্যা হ্যাদাইয়া যান। আমি সব বুঝতাছি।’
কঠিন অবস্থা সামাল দেওয়ার কিছু টেকনিক রপ্ত আছে আমার। আমি তার একটা ব্যবহার করলাম। যেন কিছুই ঘটেনি এমনভাব করে বললাম, ‘আচ্ছা জর্জদা ইদানীং ভীষণ দুঃখের গান শোনার নেশা হয়েছে আমার। দুঃখের গান ছাড়া দেখি কিছুই ভালো লাগে না। এটা কি কোনো ডিপ্রেশনের লক্ষণ?’ একথার সঙ্গে সঙ্গে জর্জদার সারামুখে ‘আহা বেচারি!’ ভাব একটা ছড়িয়ে পড়ল, উনি অনেকক্ষণ একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে শেষে বললেন, ‘আপনে কি প্র্যামে পড়তাছেন নাহি?’ আমি কিছু উত্তর করলাম না। উনি তখন হারমোনিয়াম বাগিয়ে গান ধরলেন ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’। এক ফাঁকে জানলার বাইরে চোখ চালিয়ে দেখে নিলেন আকাশজুড়ে কীরকম ঘন কালো মেঘ এবং তুমুল বৃষ্টির সম্ভাবনা। আমার কল্পিত দুঃখ এবং ওঁর ধূর্ত চিকিৎসা মিলেমিশে এক হয়ে এক অসাধারণ দ্বিপ্রহর সৃষ্টি হলো। আমার বয়েস তখন ২৬, ওঁর ঠিক তার উলটো ৬২। যে-বয়েসে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর মধ্যে ওঁর বিজয়াকে খুঁজে পাচ্ছেন।
জর্জদাকে তাঁর শেষ বছরগুলোয় দেখে একটা কথা বারবার মনে হয়েছে যে, রবীন্দ্রসংগীত শুধু গাওয়ার গান নয়, গুরুমন্ত্রের মতো ধারণ করার গান, যে-গান জীবনকে তার কড়ি মধ্যম, কোমল গান্ধার, শুদ্ধ ধৈবত চেনাবে; অর্থাৎ গান জীবনকেই একটা গানের মতো সঠিক সুরে বাঁধবে। জর্জদাকে দেখেছি বোর্ডের ওপর একশ অভিমান বর্ষণ করে অনুতাপে আক্রান্ত মন নিয়ে যেন রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছেন। কীভাবে? না খাতা খুলে কিছুক্ষণ শব্দগুলোর ওপর ধ্যান করে দরদে ও কান্নায় সিক্ত কণ্ঠে গেয়ে ওঠা ‘যতবার আলো জ্বালাতে চাই, নিবে যায় বারে বারে।/ আমার জীবনে তোমার আসন গভীর অন্ধকারে।’ যখন শুনছি খেই হারিয়ে ফেলছি জর্জদাকে শুনছি, না স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকে।
প্রতিবাদই বলুন, আন্দোলনই বলুন, স্বাধীনতা বলুন চাই পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আজকের প্রজন্মের রবীন্দ্রসংগীতকারদের চে গুয়েভারা হলেন জর্জ বিশ্বাস। গান দিয়ে জীবন এবং জীবন দিয়ে গানকে ব্যাখ্যা করেছেন। নতুন নতুন সুর যোগ করলে কি তানবিস্তার করলে, তাল বদলালে কি বর্জন করলে, বিলিতি যন্ত্র বা স্ট্রোব লাইট জুড়লে, আলাপ লাগালে বা গানকে গজল বানালে তা হবে না, কারণ এর কোনো কিছুরই সুযোগ ও পরিসর রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে রাখেননি। একটু মনোযোগ দিয়ে শুনলে দেখা যাবে প্রচলিত স্বরলিপি থেকে দেবব্রত বিশ্বাস তেমনভাবে কোথাও কিন্তু বিচ্যুত হননি, বরঞ্চ অনেক গায়ক-গায়িকার চেয়ে বেশি স্বরলিপি অনুগ ছিলেন। ‘এসেছিলে তবু আস নাই’ গানের অন্তরাতে ‘চঞ্চল’ কথাটায় সুর ‘ভুল’ হয়েছে বলে মিউজিক বোর্ডের অভিযোগের উত্তরে তিনি শান্তিদেব ঘোষের কাছ থেকে মধ্যমযুক্ত স্বরলিপির লিখিত সমর্থন উল্লেখ করেছেন সন, তারিখ স্বাক্ষর সমেত। এই সব পুরনো কাঁসুন্দি ঘাঁটার কোনো কারণ নেই আজ আর। নতুন সহস্রাব্দে পুরাতন চেহারাতেই এক নতুন আন্দোলন বয়ে আনছেন যখন জর্জদা।’
আজ তাঁর শতবর্ষ লগ্নে জর্জদাকে নিয়ে ভাবতে বসে বার বার যে মূর্তিটি চোখের সামনে ভেসে উঠছে সেটি রবীন্দ্রনাথের। মৃত্যুর কিছুকাল আগে যে রবীন্দ্রনাথ রানী মহলানবিশকে বলছেন, ‘…আমি প্রতিদিন শেষরাতে উঠে চুপ করে বসে নিজের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করি। এক-একদিন পারিনে, শক্ত হয়। কিন্তু আবার কোনো-কোনো দিন দেখি ফস্ করে বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। যেন স্পষ্ট দেখতে পাই আমার ছোট Ñ আমিটা ঐ দূরে আলগা হয়ে বসে রয়েছে, যাকে তোমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলো সেই মানুষটা। সেই লোকটা অতি তুচ্ছ! তার রাগ আছে, ক্ষোভ আছে, আরো কত ক্ষুদ্রতা…; ‘তার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, আমি তার চেয়ে অনেক বড়ো।’ এই শেষবেলাকার রবীন্দ্রনাথে আক্রান্ত ছিলেন জর্জদা। কবির গান গেয়ে গেয়ে অবিরত আত্মশুদ্ধির এক প্রক্রিয়ায় মাতোয়ারা এক অত্যাধুনিক মানুষ।
ভারতীয় জীবনে এখন ঘণ্টায় চারটে করে আইকন ঝরে পড়ছে। পরপর দুটো ছবি লাগলে, দুটো সেঞ্চুরি হলে, একটা গানের অ্যালবাম হিট করলেই আইকন। পনেরো মিনিটের প্রখ্যাতির জন্য পাগল গোটা যুবসমাজ। এদের পক্ষে জজর্দার শতবার্ষিকী ভুলে যাওয়া আশ্চর্যের নয়। হয়তো এও সত্যি যে, যাঁর গান আমাদের ঘিরে আছে না-দেখা ছায়ার মতো তিনি যে আছেন বা একশয় পড়লেন তা না-ই বা এলো মনে। তিনি যদিও রেকর্ড করে যাননি তাঁর প্রিয় হেমন্তর মতো, তবু আজকের কাউকে সামনে পেলে গেয়ে উঠতেই পারতেন :
মনে রবে কি না রবে আমারে সে আমার মনে নাই।
ক্ষণে ক্ষণে আসি তব দুয়ারে, অকারণে গান গাই ॥’

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.