জালিয়ানওয়ালাবাগ

এক

জালিয়ানওয়ালাবাগ। সন্ধে। দু-চারটি ল্যাম্প-পোস্টে টিম্টিম্ বাতি জ্বলছে। এদিক-ওদিক লাশ পড়ে আছে।

প্রথম ব্যক্তি।    এখানে আমার ভাই মরে পড়ে আছে।

দ্বিতীয় ব্যক্তি।  এখানে আমার বোন মরে পড়ে আছে।

তৃতীয় ব্যক্তি।   এখানে আমার বাবা মরে পড়ে আছে।

চতুর্থ ব্যক্তি।     এখানে আমার ছেলে মরে পড়ে আছে।

পঞ্চম ব্যক্তি।   না, না, ও এখনও বেঁচে আছে।

            কাঁধ থেঁতলে গ্যাছে। হাত ছিঁড়ে গ্যাছে।

            রক্ত ঝরছে। তবু বেঁচে আছে।

            পানি দাও। এক ফোঁটা পানি দাও।

            ওই কুয়ো, তা-ও রক্তে ভেসে গ্যাছে,

            লাশে ভরে গ্যাছে।

ওই পাঁচ জনকে নিয়ে কোরাস তৈরি হবে। সংলাপের মধ্যখানে যেখানে ফাঁক দেয়া আছে, সেখানে অল্প একটু সময়ের জন্য সবাই চুপ করে থাকবে। নেপথ্যে ড্রামে একটি কি দুটি আঘাত শোনা যাবে।

কোরাস।          ভয় করে,

            আমাদের ভয় করে,

            আমাদের খুব ভয় করে।

            তেরোই এপ্রিল আজ, ১৯১৯।

            এই দিন আমাদের বৈশাখের দিন।

            গ্রাম থেকে, গঞ্জ থেকে, দূরে থেকে, কাছে থেকে

            এসেছি এখানে, এই মাঠে, এই

            ফুল-ফোটা মাঠে।

            নানা দুঃখে কেটে যায় সমস্ত জীবন।

            কখনও আকাল-

            জমিদার কেড়ে নেয় ফসল কখনও।

            লাল সায়েবেরা চলে আসে

            হঠাৎ-হঠাৎ

            লাল ঘোড়া চড়ে।

            বছরের এই দিন, একটি দিন

            আমাদের ইচ্ছে করে

            সব ভুলে যেতে।

            এমন মৃত্যুর কথা ছিলো না কখনও।

            ভয় করে,

            আমাদের খুব ভয় করে।

মঞ্চের এক কোণে ধীরে-ধীরে স্পট-লাইট জ্বলে ওঠে। স্পট-লাইটের নিচে রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ।      ভয়?

            মানুষের সমস্ত জীবন

            ভয়ের ভেতর কেটে যায়।

            কিন্তু তবু মানুষই কেবল

            ভয় জয় করে,

            ভয় জয় করতে পারে।

প্রথম ব্যক্তি।    আমরা তো সামান্য মানুষ।

            খেটে খাই, ক্ষেতে কাজ করি।

            কারও-কারও ছোটোখাটো

            ব্যবসাও আছে।

            আমরা কী করে পারবো

            জয় করতে ভয়?

            আবার কখন …

দ্বিতীয় ব্যক্তি।  আবার কখন গুলি ছোটে।

            উর্দি-পরা, মার্চ-করা, কাঁধে

            বন্দুক ঝোলানো

            সৈন্যরা হঠাৎ এসে আবার কখন

            কোনও দিকে না তাকিয়ে, ভ্রƒক্ষেপ না করে,

            মুহূর্তের জন্যও না থেমে

            গুলি ছুড়তে থাকে,

            চারদিকে দেয়াল, লোকজন

            ডিঙিয়ে পালাতে চায়,

            সেই দিক লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে,

            মাটিতেও গুলি ছোড়ে,

            ঘাসের ওপর গুলি ছোড়ে,

            যেন ওই বন্দুকের মতো

            তারাও যন্ত্রই শুধু,

            মায়ের সন্তান নয়,

            মানুষের রক্ত নেই তাদের শরীরে।

তৃতীয় ব্যক্তি।   আবার কখন

            ওদের চাবুক এসে এই পিঠ

            ঝাঁঝরা করে দ্যায়,

            মঞ্চ তৈরি হয়

            একটু দূরে দুর্গ থেকে,

            শহরের পথে-পথে

            বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়

            অসংখ্য ত্রিভুজ-

            সবই-

            চাবকাতে মানুষকে,

            মানুষের চিৎকার শুনে

            হো হো করে হেসে ওঠে

            সৈন্যদল – এ দেশেরই লোক,

            কিছু গোরা ছাড়া।

চতুর্থ ব্যক্তি।     আবার কখন

            দুই হাতে দুই পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে,

            হেঁচড়ে-হেঁচড়ে শরীর মাটিতে,

            পথ চলতে হয়।

            সৈন্যরা কখন বলে,

            ‘এইখানে মেম ধাওয়া

            করেছিলি, গায়ে হাত তুলেছিলি,

            ফুটপাতে ফেলে রেখেছিলি।

            বড্ডো বাড় বেড়েছিল।

            দে, নাকে খৎ দে,

            রাস্তার ঘোড়ার নাদ

            খা, চেটেপুটে খা।’

            ওই ঘটনার আমি, ঈশ্বর জানেন,

            জানি না কিছুই।

            নাকে খৎ দেয়া ছাড়া

            তবু পথ নেই।

পঞ্চম ব্যক্তি।   কখন আবার

            পানি বন্ধ করে দ্যায়,

            পিপাসায় কাৎরাতে থাকি।

            বিদ্যুতের তার কেটে দ্যায়।

            ভীষণ গরমে, অন্ধকারে, ভয়ে

            হাহাকার করতে থাকে

            মেয়েরা, শিশুরা। আমরা

            চুপ করে বসে থাকি, আমাদের

            কিছুই করার

            থাকে না,

            হাহাকারও নয়।

প্রথম ব্যক্তি।    কিংবা, এমনও হতে পারে,

            পুলিশ হঠাৎ এসে আমাদের ধরে নিয়ে যাবে,

            রেলের স্টেশন থেকে ধরে নিয়ে যাবে,

            বাসের স্টেশন থেকে, বাড়ি ও দোকান থেকে,

            নদী থাকলে ধরে নিতো লঞ্চ-ঘাট থেকে,

            ধরে নিয়ে যাবে দিনের বেলায়, গভীর রাতেও।

            বন্দি হবে প্রতি দিন

            কয়েক হাজার লোক।

            হাজার-হাজার

            দেখতে, না, দেখতেই

            জেলে চলে যাবে,

            দাঁড়াবারও জায়গা যেন

            থাকবে না জেলের ভেতর।

            আমাদের

            বাপ, ভাই, বউ, বোন

            থানা থেকে ছুটবে থানায়,

            জেলের দরোজা জুড়ে বসে থাকবে

            সারাদিন সারারাত ধরে,

            সামান্য সম্বল যা কিছুই আমাদের,

            তা-ও বেচে দেবে,

            ঘুস দিতে বেচে দেবে,

            উকিলের পয়সা দিতে বেচে দেবে,

            জেলের ভেতরে সামান্য খাবার

            পৌঁছে দিতে বেচে দেবে।

            তবু আমরা

            জেলে – জেলে পচবোই কেবল,

            কী যে অপরাধ তা-ও

            জানতে পাবো না,

            জানবে না কেউই।

এই অংশে দ্বিতীয় ব্যক্তির সংলাপ থেকে শুরু করে পঞ্চম ব্যক্তির সংলাপ চলা পর্যন্ত মঞ্চের সামনে ডানে ও বাঁয়ে বড়ো পর্দায় এদের বর্ণনা-করা দৃশ্যসমূহ ভিডিও-তে দেখানোর কথা নির্দেশক ভেবে দেখতে পারেন।

রবীন্দ্রনাথ।      ঘটবে এর সবই।

            হয়তো এখন নয়,

            হয়তো এখনই।

            হয়তো এখানে নয়,

            হয়তো এখানে।

            ঘটবে তবু।

            আমি জানি,

            আমি দেখতে পাই।

            কিন্তু

            ভয় জয় করতে হবে।

            তোমাদের করতে হবে,

            করতে হবে আমাকেও।

দ্বিতীয় ব্যক্তি।  কিন্তু, কে আপনি?

তৃতীয় ব্যক্তি।   আপনি কি সন্ত কোনও?

চতুর্থ ব্যক্তি।     কিংবা, দেবদূত?

পঞ্চম ব্যক্তি।   কিংবা, রাজা?

রবীন্দ্রনাথ।      না, আমি এর কোনওটিই নই।

            আমি কবি।

            বহু দূরে এক দেশ আছে।

            সেখানে নতুন মেঘ নীল হয়ে আসে।

            ঢেউ ওঠে, ঢেউ নামে,

            নদীতে মেঘের ছায়া পড়ে।

            888sport apps।

            আমি

            সে-দেশের কবি।

প্রথম ব্যক্তি।    কবি? আরে, ছোঃ।

দ্বিতীয় ব্যক্তি।  কবি? হো, হো, হো !

তৃতীয় ব্যক্তি।   বানিয়ে-বানিয়ে কথা লেখো?

চতুর্থ ব্যক্তি।     চাঁদ দ্যাখো শুধু? শুধু মেয়েদের মুখ দ্যাখো?

পঞ্চম ব্যক্তি।   তোমাকে কোনও-ই দরকার নেই

            আমাদের।

            মশ্করার সময় নয় এটি।

            ইয়ার্কি মারার দিন নয়।

রবীন্দ্রনাথ।      আমাকেই তোমাদের সবচেয়ে

            বেশি প্রয়োজন।

            আমি কবি। তোমাদের কথা

            বলতে হবে আমাকেই।

            সবাই পিছিয়ে যাবে,

            ভয়ে সিটকে যাবে।

            আমি একা

            তোমাদের কথা বলে যাবো।

            ওই তো তোমার ভাই

            ওই তো তোমার বোন

            ওই তো তোমার বাবা

            ওই তো তোমার ছেলে

            মরে পড়ে আছে।

            যারা খুন করলো আজ এই সব

            মানুষ, একদিন

            যে-সম্মান আমাকে দিয়েছে তারা,

            আঁস্তাকুড়ে, নর্দমায়, ভাগাড়ে তা

            ছুড়ে ফেলে দেবো।

            ব্রিজের ওপর দিয়ে যেতে-যেতে

            হঠাৎ যেমন

            রেল-গাড়ি মুখ থুবড়ে

            খাদে পড়ে যায়,

            টুকরো-টুকরো হয়ে যায়,

            এঞ্জিনের টুকরো, নাট-বল্টু, লোহা

            এদিক-ওদিক পড়ে থাকে,

            স্তূপের ওপর স্তূপ তৈরি হয়,

            তোমাদের ভাই-বোন

            তোমাদের মায়েরা-ছেলেরা

            এখন তেমন পড়ে আছে।

            এমনি স্তূপ

            আরও তৈরি হবে।

            ছোটো একটি জায়গা, এ মাঠেরই মতো,

            সেখানে হাজার লোক জড়ো হবে খর রৌদ্রে

            কোনও এক দিন,

            সমস্ত শরীর কালো হয়ে যাবে, ঘাম ঝরবে,

            বাচ্চারা, মেয়েরা অস্থির, উদ্ভ্রান্ত হয়ে যাবে,

            তবু তারা দাবি তুলবে ঠিকমতো বেঁচে থাকবার,

            আর ঠিক সে-সময়

            সৈন্যদল চলে আসবে বন্দুক উঁচিয়ে।

রবীন্দ্রনাথ অদৃশ্য হয়ে যাবেন। কুচকাওয়াজ করতে-করতে সৈন্যরা মঞ্চে ঢুকবে। দর্শকদের দিকে মুখ করে সেনাপতি গর্জন করে উঠবেন। তার পেছনে সৈন্যরা হাঁটু গেড়ে দর্শকদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরবে।

সেনাপতি।       এই শুয়োরের বাচ্চা সব, হারামজাদার দল,

            কুত্তাও তোদের চাইতে বহু গুণ ভালো।

            মাগ্না খাস সব? সন্ধ্যার সময়-

            কোন দিন বাদ যায়? – মদ, ভাঙ, আফিম খাওয়ার

            পয়সা দিই না? তোদের আবার সমস্যা কিসের?

            কলা গাছ বুনবি, বড়ো করবি, কলার বাগান

            ঠিক-ঠাক রাখবি,

            এটুকুই তো কাজ।

            এই কলা বিক্রি হবে হাজার-হাজার,

            দেশে-দেশে চলে যাবে, চলে যাবে

            বন্দরে-বন্দরে,

            দুটো পয়সা চলে আসবে আমাদের ঘরে।

            তোদের কী এসে-যায় তাতে?

            আমাদের ঘরে

            পয়সা আসা মানে

            পয়সা চলে আসা এই দেশে।

            এ-দেশের প্রত্যেকের তাতে লাভ।

            তার পরও

            বেশি পয়সা চাস তোরা, বেশি ছুটি চাস?

            ব্যাঙ ফুলে হাতি হতে চাস?

            আরেক নালিশ,

            তোদের মাতারি নিয়ে আমরা নাকি

            স্ফুর্তি করে যাই !

            ভালোই তো – সুসন্তান জন্ম নেয়

            তোদের ঘরেই।

            ধর্মঘট? খেয়ে-দেয়ে কাজ নেই-

            ধর্মঘট!

            এই ধর্মঘট বেআইনি-

            পাঁচ মিনিটের মধ্যে এই জায়গা ছেড়ে

            চলে যাবি। আমার হুকুম।

সেনাপতি সৈন্যদের দিকে ফেরেন।

সেনাপতি।       সৈন্যরা, প্রস্তুত।

দর্শক ও মঞ্চের মাঝখানের জায়গায় বহু লোক হুড়োহুড়ি করে পালাবার চেষ্টা করবে। মেয়েদের, বাচ্চাদের কান্না।

সেনাপতি।       ফায়ার!

রবীন্দ্রনাথকে আবার দেখা যাবে।

রবীন্দ্রনাথ।      দক্ষিণ অ্যামেরিকায় ঘটবে এই সব-

            কলাম্বিয়ায়, ১৯২৮-এ।

            কত জন

            মারা যাবে,

            কত জন ধুঁকে-ধুঁকে বেঁচে থাকবে,

            জানে না কেউই।

            তোমাদেরই জীবন যেন বা

            দেশে-দেশে ফিরে-ফিরে

            আসবে বারে-বারে।

            বলা যাক, ফিরে আসবে ভাগ্য তোমাদের-

            ফিরে আসবে অমোঘ নিয়তি।

            এই যে আমার পদ্মা,

            পুরানে প্রসিদ্ধ যার নাম,

            এক দিন বয়ে যাবে নতুন, স্বাধীন

            এক দেশে, হবে 888sport appsই

            যার নাম।

            এই যে বৈশাখ তোমাদের,

            ফিরে আসবে নতুন, স্বাধীন

            সেই দেশে।

            খুব ভোর; সবাই তো এসে গ্যাছে মাঠে।

            খুব ভোর; এখনই তো গান শুরু হবে।

            কিছুতেই আর কোনও মূঢ় পরাভবে

            যাবে না মানুষ-সূর্য তার সঙ্গে হাঁটে।

মঞ্চের এক কোণে রমনায় পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান। গান : ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।’ হঠাৎ বোমার আওয়াজ। ছুটোছুটি। একজন 888sport live chatী গেয়েই চলেছেন।

রবীন্দ্রনাথ।      হঠাৎ ধোঁয়ায় সব গ্যালো ওই ঢেকে।

            কী আওয়াজ! কী যে ভয়! কী যে ছোটাছুটি-

            টুকরো ছুরি সারা মাঠে হেসে লুটোপুটি।

            মানুষের রক্ত যায় ঘাসে এঁকেবেঁকে।

            এ বৈশাখ তোমাদের,

            ভয়ের বৈশাখ,

            রক্তের, হত্যার, হিংসার বৈশাখ

            ফিরে আসবে আরও একবার,

            ফিরে আসবে যে-দেশ আমার,

            সেই দেশে।

            আমি কবি।

            ভবিষ্যৎ দেখতে পাই আমি।

            এবং অতীত।

            দূরে দেখতে পাই,

            দেখতে পাই কাছে।

নেপথ্যে গান :

            আর্তের ক্রন্দনে হেরো ব্যথিত বসুন্ধরা,

               অন্যায়ের আক্রমণে বিষবাণে জর্জরা-

            প্রবলের উৎপীড়নে কে বাঁচাবে দুর্বলেরে,

                              কে!

গানটি, সম্ভব হলে, প্রেক্ষাগৃহের চারদিক থেকে শোনা যাবে। ‘কে!’ কথাটি প্রতিধ্বনিময় হবে।

রবীন্দ্রনাথ।      প্রতিবাদ করবো শুধু আমি-

            একা আমি।

            যেখানে আমাকে প্রয়োজন,

            আমি ঠিকই এসে যাই।

            আমাকেই দরকার

            তোমাদের।

মঞ্চ অল্প সময়ের জন্য অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে রবীন্দ্রনাথ মঞ্চ ছেড়ে চলে যান। আলো জ্বলে ওঠে।

এই দৃশ্যে আবারও কজন নামহীন ব্যক্তিকে দেখা যাবে। আগের প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম ব্যক্তি থেকে আলাদা করার জন্য এদের পরিচয় হবে ক, খ, গ ও ঘ।

গান্ধী।  এ-ই করতে হবে।

ক।       বাপুজি, ভারতবর্ষ কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা নয়।

খ।        বাপুজি, সেখানে আপনি কাজ করেছেন

            সামান্য কজন লোক নিয়ে। আপনার কথায় তারা

            হাসিমুখে মার খেয়ে গ্যাছে,

            হাসিমুখে জেলে গ্যাছে,

            একটুও টলেনি।

            এখানে তো লোক কোটি-কোটি।

গ।        সেখানে ইংরেজ বলেছিল, খ্রিষ্টধর্মমতে ছাড়া

            আর কোনও বিয়ে বৈধ নয়। সে-মুহূর্তে

            বেশ্যা হয়ে গিয়েছিল প্রত্যেকের বউ;

            খানকি হয়ে গিয়েছিল

            মায়েরা, বোনেরা;

            মুসলিম, হিন্দু, শিখ

            সবাই জারজ

            হয়ে গিয়েছিল।

            এখানে এমন কিছু এখনও ঘটেনি;

            আহত, অপমানিত নয় প্রতিটি মানুষ;

            ব্যক্তিগত ক্ষোভ

            নেই যে এমন নয়,

            কিন্তু কজনের?

গান্ধী।  তবু এ-ই করতে হবে।

ঘ।        আর কোনও পথ নেই?

গান্ধী।  হয়তো আছে। কিন্তু,

            সে-পথ আমার নয়।

ক।       কেন নয়?

            আদেশ করুন আপনি,

খ।        উত্তরের হিমালয় থেকে

গ।        দক্ষিণের বঙ্গোপসাগর অব্দি

ঘ।        আগুন জ্বালিয়ে দেবো

ক।       গ্রামে-গ্রামে,

খ।        শহরে-শহরে।

গ।        পুড়বে সব,

ঘ।        সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।

ক।       কজন ইংরেজ আর

খ।        আছে এই দেশে?

গ।        কয়েক হাজার, কিংবা,

ঘ।        ধরা যাক, কয়েক লক্ষই।

ক।       কোথায় পালাবে তারা?

খ।        বঙ্গোপসাগরে ঝাঁপ দেবে?

গ।        আরশোলার মতো তারা

ঘ।        থেৎলে যাবে পায়ের তলায়।

ক।       ১৮৫৭-তে – এই তো সেদিন-

খ।        সিপাহীরা গর্জে উঠেছিল।

গ।        এবার সিপাহী নয় শুধু,

ঘ।        এ দেশের সমস্ত মানুষ

ক, খ, গ ও ঘ।  গর্জে উঠবে।

            বেনিয়া ইংরেজ দেখবে যেখানেই,

            চুল ছিঁড়ে ফেলবে,

            চোখ উপড়ে নেবে,

            হাত-পা গুঁড়িয়ে দেবে,

            বুক

            এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেবে।

এর পরের অংশটুকুতে ক, খ, গ ও ঘ ঘুরে-ঘুরে নাচতে থাকবে। হাতে লাঠি থাকলে ভালো হয়।

ক।       আমি একা খুন করবো দশজন সাহেব।

খ।        আমি করবো বিশজন।

গ।        তোমাদের চাইতে বেশি

            খুন করবো আমি।

ঘ।        হাঃ, হাঃ, হাঃ,

            খুন করবো, খুন করবো,

            খুন করে যাবো।

গান্ধী তাদের দিকে কড়া চোখে তাকাবেন। সে-দিকে চোখ পড়তে উদ্দাম নাচ হঠাৎ থেমে যাবে।

গান্ধী।  না, এ রকম

            হবে না কিছুই।

            অনশন করবো আমি না মরা অবধি,

            তোমরা যদি এ রকম করো,

            কিংবা যদি করে

            অন্য কেউ।

            হিংসাই প্রবল হয় যদি,

            কী লাভ জীবন রেখে,

            হানাহানি কাটাকাটি দেখতে

            বেঁচে থেকে?

            সহিংসতা নয়, কখনও-ই নয়,

            উদ্দেশ্য মহৎও যদি হয়,

            তবু নয়।

            আবারও নতুন করে জাগাতেই হবে

            এই দেশে শক্তি

            অমোঘ-সত্যাগ্রহের।

ক।       সত্যাগ্রহ?

            তার মানে, শুধু মার খাওয়া?

খ।        সত্যাগ্রহ?

            তার মানে, এক দিন-দু দিন

            হরতাল?

গ।        সত্যাগ্রহ?

            তার মানে, দুর্বলের

            আরও নত হওয়া?

ঘ।        চুপ করে বসে থাকা?

            কিছুই না করা?

গান্ধী।  সত্যাগ্রহ

            এর কোনওটিই নয়।

            দুর্বলের অস্ত্র নয় সত্যাগ্রহ-

            অস্ত্র শুধু তারই,

            শক্তি যার সব চাইতে বেশি।

            দুর্বল সুযোগ খোঁজে সহিংসতার, হিংসার

            কোনও-ই জায়গা নেই

            সত্যাগ্রহে।

            সম্পূর্ণ নিষ্পাপ হওয়া-

            তারই নাম সত্যাগ্রহ।

            সত্য দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে

            জয় করা-

            তারই নাম সত্যাগ্রহ।

            আমাদের ঋষিরা একদিন

            অহিংসা দিয়েই

            সব জয় করেছেন।

            আমি মনে করি, তাঁরা বড়ো

            নিউটনের চেয়েও।

            অহিংসা কেবল

            ঋষিদেরই শক্তি নয়,

            শক্তি

            সব মানুষের।

এক দল ছেলে ও মেয়ে নাচতে-নাচতে মঞ্চের এক দিক দিয়ে ঢুকে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যাবে। নেপথ্যে গান শোনা যাবে।

গান :

            শাসনে  যতই ঘেরো  আছে বল  দুর্বলেরও,

               হও না  যতোই বড়ো  আছেন ভগবান।

ততোক্ষণে মঞ্চের পেছন দিক অন্ধকার হয়ে যাবে। গান্ধী ও অন্যরা মঞ্চেই থাকবেন, কিন্তু তাদের দেখা যাবে না। নাচের ছেলে-মেয়েরা বেরিয়ে যাবার পর মঞ্চে রবীন্দ্রনাথকে দেখা যাবে।

রবীন্দ্রনাথ।      একদিন লিখবো আমি :

            ওরা হিসাব রাখবে মরে পড়ল কত মানুষ,

                        পঙ্গু হয়ে গেল কয়জনা।

            তারি হাজার 888sport free betর তালে তালে

                        ঘা মারবে জয়ডঙ্কায়।

            পিশাচের অট্টহাসি জাগিয়ে তুলবে

            শিশু আর 888sport promo codeদেহের ছেঁড়া টুকরোর ছড়াছড়িতে।

            ওদের এই মাত্র নিবেদন, যেন বিশ্বজনের কানে পারে

                                                                                    মিথ্যামন্ত্র দিতে,

                                    যেন বিষ পারে মিশিয়ে দিতে নিশ্বাসে।

            সেই আশায় চলেছে ওরা দয়াময় বুদ্ধের মন্দিরে

                                    নিতে তাঁর প্রসন্ন মুখের আশীর্বাদ।

                                    বেজে উঠছে তূরী ভেরি গরগর শব্দে,

                                                 কেঁপে উঠছে পৃথিবী।

            লিখতে হবে :

            হে ধর্মরাজ, ধর্মবিকার নাশি

            ধর্মমূঢ়জনেরে বাঁচাও আসি।

                        যে পূজার বেদি রক্তে গিয়েছে ভেসে

                   ভাঙো ভাঙো, আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে-

            ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,

            এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো।

            আরও লিখবো :

            মানুষের সাজে কে যে সাজিয়েছে অসুরে,

            আজ দেখি ‘পশু’ বলা গাল দেওয়া পশুরে।

            মানুষকে ভুল করে গড়েছেন বিধাতা,

            কত মারে এত বাঁকা হতে পারে সিধা তা।

            দয়া কি হয়েছে তাঁর হতাশের রোদনে,

            তাই গিয়েছেন লেগে ভ্রমসংশোধনে।

            আজ তিনি নবরূপী দানবের বংশে

            মানুষ লাগিয়েছেন মানুষের ধ্বংসে।

            তার পরও

            জীবনের শেষ দিনে

            বলে যেতে হবে :

            বিশ্বাস হারানো পাপ

            মানুষের ওপর।

মঞ্চের অন্ধকার অংশে আলো জ্বলে উঠবে। রবীন্দ্রনাথকে আর দেখা যাবে না। গান্ধী ও অন্যদের দেখা যাবে।

ক।       এই সব ছেঁদো কথা।

খ।        ভণ্ডামি! নিছক ভণ্ডামি!

গ।        মানুষ আপনার কথা

            শুনতে যাবে কেন?

ঘ।        মহাযুদ্ধের সময়

            ব্রিটিশের পক্ষ

            নিয়েছেন আপনি।

            লন্ডনের ভারতীয়দের

            হাতে-পায়ে ধরেছেন

            পক্ষ নিতে

            ব্রিটিশের।

ক।       অ্যাম্বুলেন্স-বাহিনীও

            তৈরি করেছেন।

গান্ধী।  সত্য। সবই সত্য

            এই সব কথা।

খ।        আফ্রিকায় ব্রিটিশ-বিরোধী;

            লন্ডনে তাদের মিত্র,

            অনুগত দাস।

গ।        কী চমৎকার!

ঘ।        ওই সত্যাগ্রহ-

            ছল শুধু, ফাঁকি, ফাঁকি,

            নতুন কৌশল এক

            প্রভুদের সাহায্য করার।

গান্ধী।  যখন বিপদে পড়ে কেউ, তাকে

            সাহায্য করাই

            সত্যিকার মানুষের কাজ-

            বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নয়,

            অসহায় অবস্থায় তার।

ক।       ভালো কথা! খুব ভালো কথা!

            বাঘ যদি ফাঁদে পড়ে,

            আমরা তবে সেবা-শুশ্রƒষায়

            লেগে যাবো তার?

খ।        ইংরেজ হটাবো আমরা-

            যে করেই পারি।

গ।        স্বরাজ! স্বরাজ চাই আমরা-

            যে করেই হোক।

গান্ধী।  স্বরাজ আমিও চাই,

            চাই এই দেশ মুক্ত হোক

            বিদেশি শাসন থেকে,

            নিপীড়ন, নির্যাতন থেকে।

            কেবল মুখের কথা নয়,

            দ্ব্যর্থহীন রূপরেখা

            চাই স্বরাজের, চাই

            এ মুহূর্তে, দেরি

            না করে একটুও আর।

            আমাদের নিজেদের

            ভেদাভেদ ভুলে যেতে

            বলেছেন ভাইস্রয়।

            তার মানে যদি এ-ই হয়,

            ব্রিটিশ ও ব্রিটিশের লোকজন

            অত্যাচার, অবিচার করে যাবে,

            আর আমরা চুপ করে

            সব মেনে নেবো,

            এ রকম কখনও হবে না।

            আমার উত্তর এ-ই

            তাঁর কাছে।

            রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস যদি হয়,

            শুধু প্রতিবাদ নয়,

            প্রতিরোধ করবো আমি

            সব শক্তি দিয়ে।

রবীন্দ্রনাথকে মঞ্চের কোণায় দেখা যাবে।

রবীন্দ্রনাথ।      পারবেন? পারবেন আপনি?

গান্ধী।  কে ওখানে?

            এই প্রশ্ন কেন? কেন

            এমন সময়?

গান্ধী ও অন্যরা রবীন্দ্রনাথকে দেখতে পান না।

ক।       কই? কেউ তো এখানে নেই

            শুধু আমরা ছাড়া।

খ।        কেউ নেই।

গ।        কেউ নেই।

ঘ।        কেউ নেই।

রবীন্দ্রনাথ।      মর্ত্যচোখে

            আমাকে দ্যাখে না কেউ।

            আমি কবি।

            আমি বেঁচে থাকি

            মানুষের গভীর হৃদয়ে।

            আমি বেঁচে থাকি

            মানুষের বাঁচার ভাষায়।

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। আবার যখন আলো জ্বলে উঠবে, মঞ্চের পেছনে চারজনকে অর্ধবৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যাবে। তারা দেখতে এক রকম, তাদের পোশাক এক – প্রত্যেকে নিখুঁত কালো স্যুট, সাদা শার্ট ও টাই পরা। তারা এক সাথে পা ফেলে-ফেলে পুতুলের মতো মঞ্চের সামনে এগিয়ে আসবে। এগিয়ে আসতে-আসতে তারা একসাথে কথা বলবে – প্রতিটি শব্দ থেমে-থেমে যন্ত্রের মতো বলবে। মঞ্চের সামনে এসে থেমে যাবে। তার পর রক্ত-মাংসের মানুষের মতো কথা বলবে। এরা ইন্ডিয়ান লেজিস্লেটিভ কাউন্সিলের ভারতীয় সদস্য।

কা-স ১, ২,

৩ ও ৪। আমরা/ ইন্ডিয়ান/ লেজিস্লেটিভ/ কাউন্সিলের/

            ভারতীয়/ সদস্য।/ আরও/ সদস্য/ আছেন/

            কাউন্সিলে-/ ইংরেজ,/ ও/ ভারতীয়,/দুই-ই।/

            আমাদের/ কাজ/ আইন/ তৈরি/ করা।/ এ/ দেশের/

            মানুষের/ মঙ্গলের/ জন্য/ আইন/ তৈরি/ করা।/

            কিন্তু/ আমরা/ ব্রিটিশ/ সাম্রাজ্যের/ সম্রাটের/

            অনুগত।/ কিন্তু/ তাই/ বলে

কা-স ১।           আমরা কি বিবেকহীন?

কা-স ২।          বেঈমান?

কা-স ৩।          বিশ্বাসঘাতক? কিংবা

কা-স ৪।          নিতান্ত গবেট?

কা-স ১।           এ দেশের মানুষ আমরা, এ

            মাটিরই লোক।

            যারা কারখানায় মেশিন চালায়,

            রাত জেগে

            বাস নিয়ে, ট্রাক নিয়ে,

            এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে

            চলে যায়,

            আগুন জ্বালিয়ে রাখে বয়লারে,

            সার দিয়ে, পানি দিয়ে গোলাপ ফোটায়,

            নদী থেকে মাছ তোলে,

            মাছ তোলে

            সমুদ্র থেকেও,

            খনির ভেতর থেকে কয়লা তুলে আনে,

            একই রক্ত বয়ে যায়

            তাদের ও আমাদের

            শিরায়-শিরায়।

কা-স ২।          এ কেমন আইন? আইন,

            আমি যতো দূর জানি,

            তৈরি হয়

            বাঁচানোর জন্য অধিকার

            মানুষের।

কা-স ৩।          রাউলাট কমিটি কি

            তৈরি হয়েছিল

            কেড়ে নিতে ওই অধিকার?

কা-স ৪।          ওরা বলবে, আর আমরা

            সুড়-সুড় করে,

            আইনের নামে যা-কিছুই

            লিখে দেবে ওরা,

            পাস করে দেবো?

কা-স ১।           সন্ত্রাসের জন্য এ আইন।

কা-স ২।          ঠিক কথা।

কা-স ৩।          ঠিক কথা।

কা-স ৪।          ঠিক কথা।

            নতুন সন্ত্রাস তৈরি করে এ আইন।

কা-স ১।           আবার বড়াই করে বলা হচ্ছে, সন্ত্রাস

            দমনের জন্য এ আইন।

            আমি সন্ত্রাসের সমর্থক নই,

            কখনও-ই নই।

            তাই বলে-

কা-স ২।          চুরি করা, রাহাজানি করা,

            পথের লোকের বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে

            সব কেড়ে নেয়া,

            ঘরের ভেতর লোক আটকে রেখে

            আগুন জ্বালিয়ে দেয়া,

            দোকানে-দোকানে ঘুরে চাঁদা তোলা,

            খুন করা,

            নিজের লাভের জন্য খুন করা,

            দলের লাভের জন্য খুন করা,

            ক্ষমতা রাখার জন্য খুন করা,

            ক্ষমতা পাবার জন্য খুন করা,

            অস্ত্রের বেসাতি করা,

            রাতে-রাতে জাহাজ-বোঝাই

            অস্ত্র নিয়ে আসা,

            রগ কেটে দেয়া,

            মসজিদে খুন করা,

            মতে না মিললেই খুন করা,

            এই সব,

            আর,

            দেশের মুক্তির জন্য কাজ করা,

            বিদেশির হাত থেকে,

            রাত-দিন অত্যাচার থেকে,

            মানুষকে বাঁচানোর জন্য

            কাজ করা

            এক কথা নয়।

কা-স ৩।          এ পার্থক্য বোঝে না ইংরেজ।

কা-স ৪।          বুঝুক, বা, না বুঝুক,

            মানুষের বেঁচে থাকা নিয়ে

            ছিনিমিনি খেলতে দেয়া

            যায় না কখনও।

কা-স ১।           সন্ত্রাসের নাম করে,

            বিপ্লবের ও অরাজকতার নাম করে,

            যাকে খুশি ধরে নিয়ে যাবে,

            জেলে পুরবে, পেটাবে, না খাইয়ে রাখবে,

            জবানবন্দির জন্য হাত মুচড়ে দেবে,

            ইলেক্ট্রিকের শক দেবে,

            মহিলা হলেও রেহাই পাবে না,

            এ কেমন কথা?

কা-স ২।          প্রতিবাদ জানানোর অধিকার

            মানুষের আছে।

কা-স ৩।          অধিকার আছে

            সুবিচার পাবারও।

কা-স ৪।          সাধারণ আদালত নয়,

            এদের বিচার হবে দ্রুত আদালতে।

            এ কেমন কথা?

কা-স ১।           মগর আইছেন বড়ো তাড়াতাড়ি।

কা-স ২।          মগর আইছেন বড়ো তাড়াতাড়ি? তার মানে?

কা-স ১।           আমি তো 888sport appর লোক।

            বড়োই রসিক 888sport appর লোকেরা।

কা-স ৩।          কি রকম?

কা-স ১।           এক লোক সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে

            পা পিছলে পড়ে গ্যাছে, গড়াতে-গড়াতে

            একেবারে দশ ধাপ নিচে।

            888sport appইয়া তা দেখে বলছে

            ‘চোট-টোট জবর পাইছেন,

            মগর আইছেন বড়ো তাড়াতাড়ি।’

কা-স ৪।          দ্রুত বিচারের আইন এ রকম হওয়া

            অসম্ভব নয়।

কা-স ৩।          বছর-বছর ধরে ঝুলে থাকবে মামলা,

            এ রকম কেউই চায় না।

            তাই বলে বিচারের নামে প্রহসন হবে,

            এ-ও কেউ চাইতে পারে না।

কা-স ১।           আপিল করারও কোনও

            সুযোগই থাকবে না।

            এ কেমন কথা?

কা-স ২।          গোপনে বিচার করবে আদালত,

            সবার চোখের আড়ালে।

            কেউই পারবে না থাকতে

            হাজির সেখানে।

            এ কেমন কথা?

কা-স ৩।          যে-সাক্ষ্য যায় না নেয়া

            সাক্ষ্যের আইন অনুযায়ী,

            তা-ও নেয়া যাবে।

            এ কেমন কথা?

কা-স ৪।          পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেফতার করা যাবে,

            যে-কাউকে যখন-তখন বন্দি করা যাবে।

            এ কেমন কথা?

কা-স ১।           উকিল নিয়োগ করার কোনও-ই অধিকার

            থাকবে না অভিযুক্ত মানুষের,

            এ কেমন কথা?

কা-স ২।          প্রত্যেক ব্যক্তির অধিকার আছে

            আত্মপক্ষ সমর্থন করার – খুনের

            অভিযোগে অভিযুক্ত যে, তারও।

কা-স ১।           তল্লাশি চালানো যাবে

            যে-কোনও জায়গায়-

            যখন-তখন।

            আদালতের হুকুম লাগবে না, লাগবে না

            কোনও পরোয়ানা।

            এ কেমন কথা?

কা-স ২।          যে-কাউকে বলা যাবে থানায় হাজিরা দিতে,

            মুচলেকা দিতে, বাড়ির ঠিকানা লিখে দিতে,

            পুলিশ যেখানে বলবে, শুধু সে-সীমানায়

            থেকে যেতে, তার বাইরে না বাড়াতে

            এক পা-ও।

            এ কেমন কথা?

কা-স ৩।          মানুষের অধিকারের বিরুদ্ধে

            এ আইন।

            অপমানের,

            দারুণ অসম্মানের।

কা-স ৪।          যুদ্ধ শেষ হলে

            সরকার নমনীয় হবে,

            স্বরাজের দাবি মেনে নেবে,

            এই ছিলো আমাদের আশা।

কা-স ১।           নমনীয়? নমনীয়তার এই তো

            লক্ষণ !

কা-স ২।          এ আইন আমরা মানি না।

কা-স ৩।          রাউলাট কমিটির আইন

            আমরা মানি না।

কা-স ৪।          মানুষের বিরুদ্ধে আইন

            আমরা মানি না।

চার কাউন্সিল-সদস্য আবার আগের মতো অর্ধবৃত্তাকার দাঁড়াবেন। দর্শকদের দিকে আগের মতো এগিয়ে আসবেন।

কা-স ১, ২,

৩ ও ৪। আমরা/ পদত্যাগ/ করলাম।

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। আবার গান্ধীকে দেখা যাবে। গান্ধী সবসময়ই শান্ত, অনুত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলেন। গান্ধী তাঁর লোকজনের উদ্দেশে কথা বলছেন। দর্শকরাই সেই লোকজন।

গান্ধী।  ভাইস্রয়কে আমি বলেছিলাম

            কাউন্সিল থেকে এ বিল ফিরিয়ে নিতে।

            সে-কথা শোনেননি তিনি।

            বলেছিলাম, যদি এ বিল

            আইন হয়েই যায় কোনও দিন,

            আমার কর্তব্য হবে

            তা অমান্য করা।

            আমার কেবল নয়, আমাদের-

            এ দেশের সব মানুষের।

            আইন অমান্য করবো আমরা, কিন্তু

            কেবল সত্যের জন্য,

            মানুষের মর্যাদার জন্য,

            888sport apk download apk latest version থেকে

            মানুষের প্রতি।

            সহিংসতার আশ্রয় আমরা নেবো না কখনও,

            বিদ্বেষ থাকবে না কারও প্রতি,

            কাউকে আঘাত করবো না কখনও-ই,

            জ্বালিয়ে দেবো না কোনও ঘর-বাড়ি-

            এ কথাও ভাইস্রয়কে

            বলেছিলাম আমি।

            এ দেশের প্রত্যেক সদস্য কাউন্সিলে,

            প্রতিবাদ করেছেন এ বিলের।

            চারজন-দেখলেন আপনারা-

            পদত্যাগ করেছেন।

            কিছুই শোনেনি সরকার,

            কোনও-ই আপত্তি মানেনি।

            আমার বিশ্বাস ছিলো,

            আর যা-ই করুক, বা, না করুক,

            ব্রিটিশ বিশ্বাস করে সুবিচারে,

            আইনের নেই পক্ষপাত

            কারও প্রতি-

            এই ধারণায় তারা অবিচল থাকে।

            সেই স্বপ্ন আজ ভেঙে গ্যালো।

            জারি হতে পারতো কোনও দিনও

            এমন আইন

            ইংল্যান্ডে, স্কট্ল্যান্ডে, ওয়েল্স্-এ বা আয়ারল্যান্ডে?

            এখন সময়

            প্রতিবাদ করার-

            প্রতিবাদ শুধু নয়,

            প্রতিরোধ করার।

            প্রত্যেকের।

            মার্চের 888sport cricket BPL rate আজ, ১৯১৯-

            আজ থেকে এই বিল আইন হয়ে গ্যাছে।

            এ আইন আমরা মানি না,

            মানতে পারি না।

            হরতাল-

            মার্চের তিরিশে হরতাল,

            সারা দেশ জুড়ে হরতাল।

            ওই দিন হবে

            স্বেচ্ছায় উপবাসের,

            ওই দিন হবে

            প্রার্থনার।

            কাজ করতে যাবে না কেউই-

            কোনও গাড়ি চলবে না, বন্ধ থাকবে

            সমস্ত দোকান।

            সারা দেশ থমকে যাবে-

            অচল, স্থবির হয়ে যাবে।

এর পরের অংশে কিছু ঘটনা দেখানো হবে। এটি দুভাবে উপস্থাপিত হতে পারে। এক, মঞ্চের বাইরে, দর্শকদের সারির কাছে এক কোণায়, সংবাদ-পাঠক খবর পড়ে যাবেন, যেন তিনি রেডিয়োতে খবর পড়ছেন। ঘটনাগুলো এই সময় মঞ্চে দেখা যাবে। কিংবা, দুই, সংবাদ-পাঠক মঞ্চে বসে খবর পড়বেন, তাঁর জায়গাটুকু ছাড়া পুরো মঞ্চ অন্ধকার থাকবে, ঘটনাগুলো দেখা যাবে মঞ্চের বাইরে দু পাশের বড়ো পর্দায়, যেন সংবাদ-পাঠক টেলিভিশনে খবর পড়ছেন।

সংবাদ-পাঠক ১।         আজ তিরিশে মার্চ, ১৯১৯। খবর পড়ছি …। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে আজ সারা দেশে হরতাল পালিত হয়েছে। কোথাও বাস, ট্রেন বা অন্য যানবাহন চলেনি, দোকান-পাট সব বন্ধ ছিলো, আপিসে-আদালতে কাজ হয়নি, হাজার-হাজার লোক রাস্তায় বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। এই হরতালে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিলো। হরতাল চলার সময় দিল্লীতে জনতার সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। পুলিশ গুলি ছুড়লে বেশ কয়েকজন নিহত ও বহু সংখ্যক আহত হন বলে জানা গেছে। আহতদের অনেককে চিকিৎসার জন্য পুলিশ-হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কারও-কারও অবস্থা আশংকাজনক বলে বলা হয়েছে।

পুলিশ হাসপাতাল। লোকজন আহতদের ধরাধরি করে আনছে। ডাক্তার ও নার্সরা ছোটাছুটি করছে। এরা সবাই ভারতীয়। কয়েকজন মহিলা ব্রিটিশ নার্স এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। তারা কাউকে কোনও সাহায্য করছে না।

ব্রিটিশ নার্সরা। আমরা নার্র্স। মানুষের সেবা করা

            আমাদের কাজ।

ব্রিটিশ নার্স ১।  নিজেদের দেশ ছেড়ে, জন্মভূমি ছেড়ে

            অচেনা, অজানা এই দেশে-

            ভীষণ গরম এই দেশ,

            ধুলোয়-কাদায় ভরা পথ-ঘাট-

            এখানে এসেছি আমরা

            সেবা করতে মানুষের,

            পীড়িত জনের।

ব্রি-না ২।          কিন্তু শুধু মানুষের,

            কুকুরের নয়।

ব্রি-না ৩।          এই যে এদের আনছে ধরাধরি করে,

            কারও বুকে, কারও হাতে, কারও কাঁধে

            গুলি লেগে আছে,

            কিংবা তা বেরিয়ে গ্যাছে ঠ্যাং ফুটো করে,

            বিষম পিটুনি খেয়ে পড়ে আছে কেউ,

            এরা কি মানুষ?

            কুকুরের চেয়েও অধম।

ব্রি-না ৪।          কী না দিয়েছে তোদের

            ইংরেজ সরকার?

            রেলগাড়ি এর আগে কোনও দিন

            চোখে দেখেছিস? স্কুল দেখেছিস?

            হাসপাতাল দেখেছিস এ রকম?

ব্রি-না ১।           নিমকহারাম সব! অকৃতজ্ঞ!

            কুকুরের দল!

ব্রি-না ২।          পুলিশ তোদের ঠেঙিয়েছে-

            ঠিক কাজ করেছে একদম।

ব্রি-না ৩।          ঠেঙানো উচিত ছিলো আরও বেশি করে।

ব্রি-না ৪।          বিদ্রোহ!

            ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ!

            দুঃসাহস কত!

ব্রি-নার্সরা।       এখানে উচিত ছিলো শুধু লাশ আসা।

            কোনওই সাহায্য আমরা

            করবো না এদের।

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। আলো জ্বলে উঠলে গান্ধীকে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে পাঞ্জাব থেকে আসা কয়েকজন লোক। মঞ্চ দু ভাগে ভাগ করা-এক ভাগে আলো, অন্য ভাগ অন্ধকার। গান্ধী মঞ্চের আলোকিত অংশে।

পাঞ্জাবের লোক ১।      পাঞ্জাব যেতেই হবে

            আপনাকে, বাপুজি।

পা-লো ২।        পাঞ্জাব থেকেই আমরা এসেছি, আপনাকে

            লাহোরে, অমৃতসরে, পাঞ্জাবের গ্রামে-গ্রামে

            নিয়ে যেতে।

পা-লো ৩।       সেখানে আগুন জ্বলছে।

পা-লো ৪।        মানুষ পাগল হয়ে গ্যাছে।

পা-লো ১।        আপনাকে একবার দেখতে চায় তারা।

পা-লো ২।        আপনিই পারবেন হটাতে ইংরেজ

            এই দেশ থেকে।

গান্ধী।  আমি নই, যদি কেউ পারে,

            পারবে এ দেশের লোক।

পা-লো ৩।       বাপুজি, আগুন জ্বলছে চার দিকে,

            এই তো সময়।

গান্ধী।  আগুন জ্বলুক আরও, তা আমার

            কাজ নয়, ইচ্ছে তো নয়ই।

            আমি চাই আগুন নেবাতে।

            মানুষকে শান্ত হতে হবে।

            নিপীড়ন সইতে হবে।

            নিপীড়ন সয়ে-সয়ে,

            যে অন্যায় করে, তাকে

            জয় করতে হবে।

            যে অন্যায় করে, সে-ও তো মানুষ।

            তারও মধ্যে সুপ্ত আছে

            ভালোর চেতনা।

পাঞ্জাবের লোকেরা।   আর কত নিপীড়ন

            সইবো আমরা?

মঞ্চের আলোকিত অংশে আলো নিবে যাবে। অন্ধকার অংশে আলো জ্বলে উঠবে। বম্বেতে ১৯১৮ সালের কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে। পাঞ্জাবের প্রতিনিধি বক্তৃতা করছেন।

পাঞ্জাবের প্রতিনিধি।    আর কত নিপীড়ন

            সইবো আমরা?

            ১৯১৮ পার হয়ে যায়-যায়,

            এ বছর শেষ না হতেই, কিংবা,

            আগামী বছর, ১৯১৯-এ,

            কী যে ঘটবে, কেউই বলতে পারে না।

            কী লাভ কংগ্রেসের এই সব সভা করে,

            যদি ইংরেজকে তাড়াতেই না পারি আমরা,

            অত্যাচার থেকে মানুষকে বাঁচাতেই

            না পারি।

            এ বম্বে শহরে বসে ভাবতেই পারবেন না

            আপনারা, কী যে ঘটছে পাঞ্জাবে, আমার প্রদেশে।

            হাজার-হাজার লোক জেলে পুরেছেন

            পাঞ্জাবের গভর্নর মাইকেল সাহেব।

            যে-সব পত্রিকা বের হয় পাঞ্জাবি ভাষায়,

            কণ্ঠরোধ করেছেন তার প্রতিটির।

            বাইরের পত্রিকা পাঞ্জাবে ঢোকা

            সম্পূর্ণ নিষেধ, যদি তাতে

            ইংরেজের বিরুদ্ধে লেখা হয় কিছু।

            চলেছে আদায় করা চাঁদা

            জোর করে প্রতি দিন-

            যে-কোনও লোকের কাছ থেকে।

            জোতদারদের বলেছেন

            ব্রিটিশের সেনাবাহিনীতে ভর্তি করে দিতে লোক,

            তা নইলে জোতদারি কেড়ে নেয়া হবে।

            আগুন এখন প্রতিটি মানুষ।

            আগ্নেয়গিরির মুখে আমরা বসে আছি।

            আরও যদি অত্যাচার হয়,

            কখন যে ফেটে পড়বে,

            কে যে বলতে পারে!

            ধন্যবাদ,

            মাননীয় সভাপতি।

মঞ্চের এ অংশের আলো নিবে যাবে। অন্ধকার অংশে আলো জ্বলে উঠবে। গান্ধী ও পাঞ্জাবের লোকদের আবার দেখা যাবে।

গান্ধী।  আমি যাবো।

পা-লো ১।        যাবেন?

            পাঞ্জাবে যাবেন আপনি,

            বাপুজি?

গান্ধী।  যাবো।

            প্রতিবাদ করতে হবে

            এ অত্যাচারের।

            ইংরেজ ন্যায়ের কাজ যদি করে,

            তার পক্ষে আমি,

            অন্যায়ের নয়।

পা-লো ২।        বাপুজি,

            তৈরি আপনি যেতে?

গান্ধী।  তৈরি আমি সমস্ত সময়।

            কখন সময় আসবে মানুষের পক্ষে দাঁড়াবার,

            কখন বিদ্যুত চমকে উঠবে

            অন্ধকার ছিঁড়ে-খুঁড়ে ফেলে,

            কখন মুমূর্ষু রোগী নতুন জীবন ফিরে পাবে,

            বলবে, যতোই আঘাত করো, এ শরীর ছাড়া

            কিছুই পাবে না আর, মৃত্যু নেই

            আমার কোনও-ই,

            তার জন্য আমাদের তৈরি থাকতে হয়

            জীবনের প্রতিটি সময়।

পা-লো ৩।       পাঞ্জাবের ট্রেন এসে গ্যাছে।

            এ ট্রেনেই আমরা যেতে পারি।

রেলগাড়ি আসার আওয়াজ, বাঁশি, স্টেশনে লোকজনের হাঁক-ডাক ইত্যাদি শোনা যাবে। মঞ্চের দু পাশের বড়ো পর্দায়ও স্টেশনের দৃশ্য দেখানো যেতে পারে। গান্ধী গাড়িতে উঠতে যাবেন, এমন সময় দুজন পুলিশ অফিসার উপস্থিত হবেন। সঙ্গে কিছু পুলিশ থাকবে। পুলিশ গান্ধীকে ঘিরে ফেলবে। পুলিশ অফিসাররা গান্ধীর দিকে এগিয়ে আসবেন।

গান্ধী।  আপনারা কি আমাকে আটক করতে এসেছেন?

            আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী?

পুলিশ অফিসার ১।     না, আপনাকে গ্রেফতার করতে আমরা আসিনি।

পু-অ ২।          আপনার বিরুদ্ধে কোনও পরোয়ানা

            আমাদের হাতে নেই।

গান্ধী।  তাহলে?

পু-অ ১।           পাঞ্জাবে যেতে পারবেন না আপনি।

পু-অ ২।          নিষেধ পাঞ্জাবে যাওয়া আপনার।

গান্ধী।  কিন্তু, কেন?

            আমাকে আটক যদি না-ই করা হয়,

            আমার অধিকার আছে

            যেখানে যখন খুশি যাবার।

পু-অ ১।           আমাদের কাজ

            আদেশ পালন করা।

পু-অ ২।          আপনাকে অন্য কোনও ট্রেনে

            তুলে দিতে এসেছি আমরা।

পু-অ ১।           বম্বে যেতে পারেন আপনি।

            বম্বের ট্রেন স্টেশনে দাঁড়ানোই আছে।

গান্ধী।  না, আমি যাবো না।

পু-অ ১।           আপনাকে যেতেই হবে।

            আমাদের লোক থাকবে ট্রেনে,

            যাতে আপনি নেমে যেতে না পারেন

            মাঝ-পথে কোনও জায়গায়।

পুলিশ জোর করে গান্ধীকে ট্রেনে তুলে দেয়।

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। যখন আলো জ্বলে উঠবে, অমৃতসরের রাস্তায় উত্তেজিত জনতা দেখা যাবে। এরা স্লোগান দেবে। এদের কেউ-কেউ কথা বলবে। যারা কথা বলবে, তাদের পরিচয় হবে জনতার লোক ১, জনতার লোক ২ ইত্যাদি।

জনতা।            জয়, ডাক্তার সত্যপালের জয়।

জনতা।            জয়, ডাক্তার কিচ্লু-র জয়।

জনতা।            ডাক্তার সত্যপাল আমাদের ভাই।

জনতা।            ডাক্তার কিচ্লু আমাদের ভাই।

জনতা।            আমাদের ভাইদের পাঞ্জাবে

            ফিরিয়ে আনতে হবে।

জনতা।            ডাক্তার সত্যপালকে পাঞ্জাবে

            ফিরিয়ে আনতে হবে।

জনতা।            ডাক্তার কিচ্লু-কে পাঞ্জাবে

            ফিরিয়ে আনতে হবে।

জনতার লোক ১।        কিছুই হয়নি এ অমৃতসরে

            তিরিশে মার্চের হরতালে।

জ-লো ২।        কিছুই হয়নি এ অমৃতসরে

            ছয়ই এপ্রিলের হরতালে।

জ-লো ৩।        কিচ্লু ভাই, সত্যপাল ভাই

জ-লো ৪।        আমাদের বলেছেন,

জ-লো ১।         কোনও গন্ডগোল হোক,

জ-লো ২।        চান না বাপুজি।

জ-লো ৩।        আমরা তাঁদের কথা

জ-লো ৪।        চোখ বন্ধ করে

            পালন করেছি।

জ-লো ১।         লোকজন সামলে রেখেছি,

জ-লো ২।        উচ্ছৃঙ্খল হতে দিইনি কাউকে,

জ-লো ৩।        যদিও অশান্ত হবার

জ-লো ৪।        কারণ যথেষ্ট ছিলো।

জ-লো ১।         এখন, দু দিন যেতে-না-যেতেই-

জ-লো ২।        আজ তো কেবল ন তারিখ-

জ-লো ৩।        সেই ডাক্তার সত্যপালকে,

জ-লো ৪।        সেই ডাক্তার কিচ্লুকে

জ-লো ১।         গভর্নর মাইকেল সাহেব

জ-লো ২।        পাঞ্জাব থেকে

            বের করে দিয়েছেন।

জ-লো ৩।        নিষেধ তাঁদের পাঞ্জাবে ঢোকা।

জ-লো ৪।        নিষেধ তাঁদের পাঞ্জাবে থাকা।

জনতা।            এক কথা, এক দাবি-

            ইংরেজ, তুই কবে যাবি।

জ-লো ১।         হরতাল! হরতাল!

            আজ হরতাল!

কয়েকজন লোক ছুটতে-ছুটতে মঞ্চে ঢুকবে। এদেরও পরিচয় হবে জনতার লোক।

জ-লো ৫।        ভাই সব, শুনুন, শুনুন,

            এইমাত্র খবর এসেছে,

            বাপুজি গ্রেফতার হয়েছেন-

            পাঞ্জাবে আসার জন্য

            দিল্লিতে যখন স্টেশনে গেছেন,

            পুলিশ আটকেছে তাঁকে, অন্য ট্রেনে

            কোথায় যে নিয়ে গ্যাছে, কেউই জানে না।

জ-লো ১।         কী! বাপুজি গ্রেফতার হয়েছেন!

জনতা।            মানি না! মানি না!

            এ গ্রেফতার মানি না!

জ-লো ২।        যেখানেই নিয়ে যাক তাঁকে,

            ছাড়িয়ে আনবোই আমরা।

জনতা।            আনবোই! আনবোই!

            জয়, বাপুজির জয়।

জ-লো ৩।        উত্তেজিত হবার সময় এটি নয়।

            শান্ত হোন। শান্ত হোন

            সবাই। বাপুজি শিখিয়েছেন আমাদের,

            হিংসার আশ্রয় কখনও না নিতে।

জ-লো ৪।        তাঁর কথা মানতে হবে আমাদের,

            মানবো আমরা।

জ-লো ১।         প্রতিবাদ করবো, কিন্তু

            কারও গায়ে হাত তুলে নয়।

জনতা।            কারও গায়ে হাত তুলে নয়।

            জয়, বাপুজির জয়।

জ-লো ১।         তৈরি হোন আপনারা, দাঁড়িয়ে যান

            সার বেঁধে।

            এখন মিছিল করে

            হল গেট ব্রিজ পার হয়ে

            শহরের পথে-পথে

            প্রতিবাদ করবো আমরা।

মিছিল এগিয়ে যায় ও একটু পরে হল গেট ব্রিজের রেল-ফটকে পৌঁছে যায়। এখানে পুলিশ মিছিলকে বাধা দেয় ও গুলি ছোড়ে।

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। আলো জ্বললে আগের মতো সংবাদ-পাঠককে দেখা যায়। খবরের ঘটনাগুলো বড়ো পর্দায় দেখানো যেতে পারে।

সংবাদ-পাঠক ২।        আজ নয়ই এপ্রিল, ১৯১৯। খবর পড়ছি …। পুলিশ আজ অমৃতসরে এক মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। মহাত্মা গান্ধীর কথিত গ্রেফতারের প্রতিবাদে এ মিছিল বের করা হয়। মিছিলটি শহরের হল গেট ব্রিজের রেল-ফটকে পৌঁছুনোর পর পুলিশ মিছিলকারীদের বাধা দেয় এবং কোনও রকম উস্কানি ছাড়াই হঠাৎ করে তাদের ওপর গুলি ছুড়তে শুরু করে। এতে মিছিলের কিছু লোক উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং পাল্টা আক্রমণ চালায়। এ পাল্টা আক্রমণে পাঁচজন য়ুরোপীয় নিহত হন বলে জানা যায়। এঁদের মধ্যে তিনজন ন্যাশনাল ব্যাংক-এর ও চার্টার্ড ব্যাংক-এর কর্মকর্তা। জনতা টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, দুটি ব্যাংক-এর অফিস, টাউন হল ও ইন্ডিয়ান ক্রিশ্চিয়ান চার্চসহ কয়েকটি ভবন ভাঙচুর করে ও আগুন ধরিয়ে দেয়। এ ছাড়া মিস্ র্শেউড্ নামে এক ইংরেজ মিশনারি ডাক্তারকে …

অমৃতসরের রাস্তায় জনতা মহিলা ডাক্তারকে ধাওয়া করছে।

মিস র্শেউড্।   বাঁচাও, বাঁচাও, কে কোথায় আছো,

            বাঁচাও।

জ-লো ৬।        আপনাকে এখন কেউ বাঁচাতে আসবে না।

জ-লো ৭।        তোদের পুলিশ যখন আমাদের গুলি করে,

            তখন আমাদের কে বাঁচাতে আসে?

মিস র্শেউড্।   আমি পুলিশ নই। আমি ডাক্তার। মহিলা ডাক্তার।

জ-লো ৮।        মহিলা ডাক্তার? ইংরেজের বাচ্চা বিয়ানোর ডাক্তার?

            আমাদের মারার জন্য

            তোর হাত দিয়েই জন্ম নেবে

            শুয়োরের বাচ্চা কতগুলো আরও।

জ-লো ৯।        পেটা, হারামজাদীকে পেটা।

পিটুনি খেয়ে ইংরেজ মহিলা ডাক্তার অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় পড়ে যাবেন। আক্রমণকারীরা পালিয়ে যাবে।

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। যখন আলো জ্বলবে, দুজন ঢ্যাঁড়া দেয়ার লোক চোঙা হাতে দেখা যাবে। এদের একটু ভাঁড়ের মতো দেখালে ভালো হয়। এদের একজন ঠিকমতো ঢ্যাঁড়া দেবে, অন্যজন দেবে নিচু গলায়।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। জরুরি ঘোষণা ! জরুরি ঘোষণা!

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           জরুরি ঘোষণা ! জরুরি ঘোষণা!

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। সর্বসাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে,

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           সর্বসাধারণের অবগতির জন্য জানানো যাইতেছে যে,

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার বাহাদুর

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার বাহাদুর

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। অমৃতসর শহরে শুভাগমন করিয়াছেন এবং

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           অমৃতসর শহরে শুভাগমন করিয়াছেন এবং

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। অ্যাই হারামজাদা, তুই এতো গলা নামাইয়া ঢ্যাঁড়া দিতেসছ ক্যান?

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           আমি কি জ্যাতা মানুষ নাকি যে, জোরে ঢ্যাঁড়া দিমু?

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। জ্যাতা না তো কী? মইরা গ্যাছস?

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           তুই জিন্দা আছস? তুই মুর্দা না?

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। ক্যান? ক্যান? মুর্দা হইতে যামু ক্যান?

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           তরে পিটায় নাই? ছাল-চামড়া তুইলা নেয় নাই?

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। তা নিছে। কিন্তু উপায় কী? আমরা গরিব মানুষ, আমাগো মাইর খাইতেই অইবো।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           হ্যারা মাইর দিবো, আর হ্যাগো কথামতো কাম করুম? ঢর্্যাঁড়া দিতে কইসে, ঢ্যাঁড়া দিতাসি – জোরে দিমু, না, আস্তে দিমু, হেইডা আমার ব্যাপার।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। ট্যার পাইলে জান আস্তা রাখবো না।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           আরে, ধুর, ধুর। তুই জানস না, হ্যারা কানে-কানে কইয়া দিছে, ঢ্যাঁড়া আস্তে দিতে।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। তাইলে মাইনষে জানবো ক্যামনে?

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           হেইডা হ্যারা বুঝবো। ঢ্যাঁড়া দেওন দরকার, ঢ্যাঁড়া দিছে। আমার কেমুন জানি লাগে, হ্যারা চায় না, বেশি মাইনষে শুনুক। আমাগো কী? দে, দে, ঢ্যাঁড়া দে।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার বাহাদুর

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার বাহাদুর

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। অমৃতসর শহরে শুভাগমন করিয়াছেন এবং

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           অমৃতসর শহরে শুভাগমন করিয়াছেন এবং

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। শহরের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে লইয়াছেন।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           শহরের নিয়ন্ত্রণ নিজ হাতে লইয়াছেন।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। তিনি আজ বারোই এপ্রিল ১৯১৯ হইতে

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           তিনি আজ বারোই এপ্রিল ১৯১৯ হইতে

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। শহরে সকল সভা-সমাবেশ ও মিছিল

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           শহরে সকল সভা-সমাবেশ ও মিছিল

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। নিষিদ্ধ ঘোষণা করিয়াছেন।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           নিষিদ্ধ ঘোষণা করিয়াছেন।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে ইতোমধ্যে বহু ব্যক্তিকে

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে ইতোমধ্যে বহু ব্যক্তিকে

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। গ্রেফতার করা হইয়াছে।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           গ্রেফতার করা হইয়াছে।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। শাস্তি হইতে বাঁচিতে হইলে এই নির্দেশ মানিয়া চলিবার জন্য

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           শাস্তি হইতে বাঁচিতে হইলে এই নির্দেশ মানিয়া চলিবার জন্য

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। বলা হইল।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           বলা হইল।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। চল, এখন বড়ো রাস্তার মোড়ে যাই। ওইখানে ঢ্যাঁড়া দেই।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           কুনও দরকার নাই।

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ১। কুনও দরকার নাই? ক্যান?

ঢ্যাঁড়াওয়ালা ২।           হ্যারা কইয়া দিছে, এক জায়গায় ঢ্যাঁড়া দিলেই চলবো। সারা শহরে দেওনের কাম নাই।

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। অন্ধকারে মঞ্চের পেছনে বড়ো সাদা পর্দা দেখা যাবে। এ পর্দায় পেছন থেকে আলো ফেলে ছায়া-নাটক অভিনীত হবে। ছায়া-নাটকে একটি জনসভা দেখা যাবে। জনসভায় এক বক্তা উত্তেজিত বক্তৃতা করছেন। ছায়া-বক্তার কথা শোনা যাবে।

ছায়া-বক্তা।      ইংরেজের এই অত্যাচার

            কত দিন আর

            মানবো আমরা?

            অতোই সস্তা

            আমাদের গায়ের চামড়া?

            তেরোই এপ্রিল আজ, ১৯১৯।

            আমাদের বৈশাখের দিন।

            আনন্দের দিন নয় আজ-

            আজ দিন রুখে দাঁড়াবার।

            বাপুজি কোথায়, জানা নেই আমাদের-

            তাঁকে

            ধরে নিয়ে গ্যাছে।

            আমাদের নেতা, আমাদের ভাই

            সত্যপাল ভাই, কিচ্লু ভাই

            এ সভায় নেই।

            নিষেধ পাঞ্জাবে ঢোকা তাঁদের – আমার,

            আপনার ভাইয়ের।

            নিরস্ত্র মিছিলে তারা গুলি চালিয়েছে।

            যেখানে-সেখানে যাকে-তাকে

            যখন-তখন

            গ্রেফতার করেছে।

            পিটিয়েছে – হাড়-গোড় গুঁড়ো করে

            ফুটপাতে ফেলে রেখে গ্যাছে।

            মিছিল করা কি অন্যায়? অন্যায়

            প্রতিবাদ করা?

            ইংরেজের দুঃশাসন আমরা মানি না।

            ইংরেজের কালো আইন আমরা মানি না।

            আমরা স্বরাজ চাই,

            আমরা চাই

ছায়া-বক্তার বক্তৃতা চলার সময় সৈন্যরা মঞ্চে ঢুকবে। তারা দর্শকদের দিকে পেছন ফিরে সাদা পর্দার দিকে মুখ করে হাঁটু গেড়ে বসবে ও পর্দার দিকে বন্দুক উঁচিয়ে ধরবে। বক্তৃতার শেষ দিকে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার মঞ্চে ঢুকে সৈন্যদের পেছনে দাঁড়াবেন। খানিকক্ষণ ছায়া-বক্তার দিকে তাকিয়ে থাকবেন। ছায়া-বক্তা যখন তাঁর শেষ অসমাপ্ত বাক্যে পৌঁছুবেন, তখন ডায়ারের কথা শোনা যাবে।

ডায়ার। ফায়ার।

সৈন্যরা গুলি ছুড়তে শুরু করবে। গুলিতে তাদের সামনের সাদা পর্দা ছিঁড়ে যাবে। খানিকক্ষণ অবিশ্রাম গুলির শব্দ ও লোকজনের আর্তনাদ শোনা। তারপর মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। সব চুপ। অন্ধকারে নেপথ্যে শোনা যাবে।

নেপথ্যে গান :

            সব যে হয়ে গেল কালো,

                 নিবে গেলো দীপের আলো

প্রেক্ষাগৃহে আলো জ্বলে উঠবে।

বিরতি।

দুই

নাচ। সঙ্গে গান।

গান :

            সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান,

            সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।

            মুক্ত করো ভয়,            আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়।

            দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,

            নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।

            মুক্ত করো ভয়,            নিজের ’পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়।

            ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান

            নীরব হয়ে, নম্র হয়ে, পণ করিয়ো প্রাণ।

            মুক্ত করো ভয়, দুরূহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয় ॥

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা তদন্তের জন্য হান্টার কমিটি গঠিত হয়। মঞ্চে আলো জ্বলে উঠলে হান্টার কমিটির সামনে জেনারেল ডায়ার-কে দেখা যাবে। সভাপতি লর্ড হান্টার ছাড়া এই কমিটিতে চারজন ব্রিটিশ ও তিনজন ভারতীয় সদস্য ছিলেন। এখানে সভাপতিসহ পাঁচজন সদস্য থাকতে পারেন। এ চারজনের দুজন ব্রিটিশ ও দুজন ভারতীয় হতে পারেন।

তদন্ত কমিটির

সভাপতি।        আপনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেজানাল্ড ই এইচ ডায়ার?

ডায়ার। হ্যাঁ।

সভাপতি।        আপনি জানেন, তেরোই এপ্রিল ১৯১৯ তারিখে অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে যে-ঘটনা ঘটে, সে-ঘটনা সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য ভাইস্রয় একটি কমিটি গঠন করেছেন?

ডায়ার। হ্যাঁ, লর্ড হান্টার।

সভাপতি।        আপনি জানেন, এ-ই সেই কমিটি?

ডায়ার। হ্যাঁ, মিলর্ড।

সভাপতি।        ওই ঘটনার সঙ্গে আপনার কি কোনও সম্পর্ক ছিলো?

ডায়ার। আমারই নির্দেশে ওই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল।

সদস্য-১।         আপনার নির্দেশে?

ডায়ার। ঘটনার সময় আমি নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলাম ও সৈন্যদের গুলি করার আদেশ দিয়েছিলাম। সমস্ত বিষয়টি আমি নিজে তদারক করেছিলাম।

সদস্য-২।         ওই ঘটনার কত দিন আগে থেকে আপনি অমৃতসরে দায়িত্বপালন করে আসছিলেন?

ডায়ার। আমি ঘটনার দুদিন আগে এগারোই এপ্রিল অমৃতসর পৌঁছুই।

সদস্য-৩।        অমৃতসর পৌঁছে আপনি সেখানকার অবস্থা কি রকম দেখতে পান?

ডায়ার। সম্পূর্ণ অরাজক।

সদস্য-৩।        অরাজক?

ডায়ার। হ্যাঁ।

সদস্য-৩।        আপনি কি নিশ্চিত, আপনি ঠিক বলছেন?

ডায়ার। নিশ্চিত।

সদস্য-৪।         আমরা যতো দূর জানি, এগারোই এপ্রিল অমৃতসরে কোনও গন্ডগোল হয়নি।

ডায়ার। জনতা য়ুরোপীয়দের খুন করেছিল, বাড়ি-ঘরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।

সদস্য-৪।         সেটা তো ন তারিখের ঘটনা।

ডায়ার। তার রেশ তখনও ছিলো।

সদস্য-৩।        তখনও ছিলো?

ডায়ার। হ্যাঁ।

সদস্য-১।         পুলিশের গুলিতে যারা মারা গিয়েছিল, তাদের লাশ নিয়ে এগারো তারিখ বিশাল মিছিল বের হয়েছিল। সে-মিছিলে কি কোনও গন্ডগোল হয়েছিল?

ডায়ার। আমি বলতে পারবো না।

সদস্য-১।         না, সে-মিছিলে কোনও গন্ডগোল হয়নি। এগারো তারিখ অমৃতসর শান্ত ছিলো। এটি ভুল, না, ঠিক?

ডায়ার চুপ করে থাকবেন।

সদস্য-২।         এই যে আপনি খুনের কথা, ঘর-বাড়ি ক্ষতি করার কথা বললেন, তার জন্য কারা দায়ী বলে আপনি মনে করেন?

ডায়ার। কেন, কালা আদমিরা। এ দেশের লোকজন।

সদস্য-২।         কিন্তু মানুষ তো শান্তিপূর্ণভাবে মিছিল করেছিল।

ডায়ার। মিছিল শান্তিপূর্ণ হলে এ সব ঘটনা ঘটতে পারতো না।

সদস্য-২।         এ সব ঘটনা ঘটেছে পুলিশ মিছিলে গুলি করার পর, আগে নয়। পুলিশ গুলি না করলে এই সব ঘটনা ঘটতো বলে মনে হয় না। এ সম্পর্কে আপনার কী মত?

ডায়ার। ওই সময় আমি অমৃতসরের দায়িত্বে ছিলাম না।

সভাপতি।        জেনারেল ডায়ার, অমৃতসর পৌঁছে আপনি প্রথম কী করলেন?

ডায়ার। আমার লোকজনের কাছ থেকে খোঁজখবর নিলাম। শহরের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলাম।

সভাপতি।        পর্যবেক্ষণ করে আপনি কী সিদ্ধান্তে এলেন?

ডায়ার। এ রকম অবস্থা চলতে দেয়া যায় না।

সভাপতি।        আপনার বিবেচনায় যে-অবস্থা চলতে দেয়া যায় না, সে-অবস্থা চলতে না দেয়ার জন্য আপনি কী ব্যবস্থা নিলেন?

ডায়ার। আমি ঠিক করলাম, সবরকম সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে।

সভাপতি।        আপনি তা করেছিলেন?

ডায়ার।্          হ্যাঁ।

সভাপতি।        কীভাবে?

ডায়ার। ঢ্যাঁড়া দেয়ার ব্যবস্থা করে।

সভাপতি।        সে-ঢ্যাঁড়া কি শহরের লোকজন শুনতে পেয়েছিল?

ডায়ার। তা আমি জানি না।

সদস্য-১।         আমরা শুনেছি, আপনি নাকি কেবল শহরের এক জায়গায় ঢ্যাঁড়া দিতে বলেছিলেন, তা-ও খুব আস্তে। এ কথা কি ঠিক?

ডায়ার। ঢ্যাঁড়া দেয়া নিয়ম। আমি নিয়ম পালন করেছি।

সদস্য-১।         নিয়ম মানাই কি সব?

ডায়ার। আমি নিয়মের বাইরে যেতে পারি না।

সদস্য-২।         জালিয়ানওয়ালাবাগে তেরোই এপ্রিলের জনসভার কথা কি আপনি আগে থেকে জানতেন?

ডায়ার। জানতাম।

সদস্য-৩।        ওই সভা যে অবৈধ, তা কি আপনি জানিয়ে দিয়েছিলেন?

ডায়ার। না, দিইনি।

সদস্য-৩।        আপনি তো তা জানিয়ে দিতে পারতেন।

ডায়ার। পারতাম।

সদস্য-৪।         আপনি তো জালিয়ানওয়ালাবাগের সামনে সৈন্য মোতায়েন করতে পারতেন। তাহলে তো কেউ সেখানে ঢুকতে পারতো না।

ডায়ার চুপ করে থাকবেন।

সভাপতি।        আপনি তা করলেন না কেন?

ডায়ার। আমি চেয়েছিলাম ওই সভা অনুষ্ঠিত হোক।

সভাপতি।        আপনি চেয়েছিলেন ওই সভা অনুষ্ঠিত হোক?

ডায়ার। হ্যাঁ।

সভাপতি।        কেন?

ডায়ার। আমি একটি সুযোগ খুঁজছিলাম।

সভাপতি।        সুযোগ খুঁজছিলেন?

ডায়ার। যারা ব্রিটিশের বিরোধিতা করে, আমি তাদের এমন শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম যেন তারা জীবনেও আর ব্রিটিশের বিরোধিতা করার সাহস না পায়।

সভাপতি।        তাই নাকি?

ডায়ার। আমি চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলাম।

সভাপতি।        এমনটি করার কথা কি আপনার হঠাৎ করে মনে হয়েছিল?

ডায়ার। না।

সভাপতি।        ওই সভায় গুলি করার কথা কি তাহলে আপনি আগে থেকেই ভেবে রেখেছিলেন?

ডায়ার। হ্যাঁ।

কিছুক্ষণ সবাই চুপ।

সদস্য-১।         আপনার সঙ্গে কত জন সৈন্য ছিলো?

ডায়ার। পঞ্চাশ জন।

সদস্য-১।         তাদের হাতে কী অস্ত্র ছিলো?

ডায়ার। তিন-শ-তিন রাইফেল।

সদস্য-২।         জালিয়ানওয়ালাবাগ কি খোলা মাঠ?

ডায়ার। না।

সদস্য-২।         তাহলে?

ডায়ার। চারদিকে দেয়াল দেয়া।

সদস্য-২।         উঁচু দেয়াল?

ডায়ার। বেশ উঁচু।

সদস্য-২।         বাগে ঢোকার দরোজা কটি?

ডায়ার। সদর দরোজা একটি।

সদস্য-১।         আরও কি দরোজা আছে?

ডায়ার। ছোটো-খাটো দু-একটি আছে।

সদস্য-১।         কত ছোটো?

ডায়ার। দুজন-তিনজন এক সঙ্গে যেতে পারে। তার বেশি নয়।

সদস্য-৩।        আপনি কি সৈন্যদের নিয়ে সদর দরোজা দিয়ে ঢুকেছিলেন?

ডায়ার। হ্যাঁ।

সদস্য-৩।        বাগে ঢুকে আপনি কী করলেন?

ডায়ার। সদর দরোজার কাছেই একটি উঁচু জায়গা আছে। সেখানে সৈন্যদের সার বেঁধে দাঁড় করালাম। তারপর হাঁটু গেড়ে তৈরি হতে বললাম।

সদস্য-২।         আপনাদের এড়িয়ে তাহলে কারও পক্ষে সদর দরোজা দিয়ে বাগ থেকে বেরুনো সম্ভবপর ছিলো না?

ডায়ার। না।

সদস্য-৪।         সৈন্যদের আপনি কোন দিকে রাইফেল তাক করতে বলেছিলেন?

ডায়ার। সভার দিকে।

সদস্য-৪।         সভার লোকজন কত দূরে ছিলো?

ডায়ার। পঞ্চাশ-ষাট গজ হবে। একশ গজের বেশি নয়।

সদস্য-৪।         তার মানে, গুলির আওতার মধ্যে?

ডায়ার। হ্যাঁ। পুরোপুরি।

সদস্য-১।         সভায় কত লোক হয়েছিল?

ডায়ার। আমার জানা নেই।

সদস্য-১।         পাঁচ হাজার? দশ হাজার?

ডায়ার। হবে।

সভাপতি।        আপনি কি কোনও ফাঁকা আওয়াজ করেছিলেন?

ডায়ার। না।

সভাপতি।        কোনওভাবে লোকজনকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন?

ডায়ার। না।

সভাপতি।        তাদের চলে যেতে বলেছিলেন?

ডায়ার। না।

সভাপতি।        আপনি একটু আগে বলেছেন, আপনি নিয়ম মেনে চলেন। লোকজনকে সাবধান করে দেয়া, চলে যেতে সময় দেয়া, এগুলো কি নিয়মের মধ্যে পড়ে না?

ডায়ার চুপ করে থাকবেন।

সদস্য-২।         তাহলে কাউকে কোনওভাবে সতর্ক করে না দিয়ে আপনি সভার লোকজনের দিকে সৈন্যদের গুলি ছুড়তে বলেছিলেন?

ডায়ার। হ্যাঁ।

সদস্য-৩।        তারা কতক্ষণ গুলি ছুড়েছিল?

ডায়ার। দশ মিনিট, বা তার একটু বেশি।

সদস্য-৪।         কত রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছিল?

ডায়ার। ১৬৫০ রাউন্ড।

সদস্য-১।         যে-দিকে লোকজনের ভিড় সব চাইতে বেশি ছিলো, সে-দিকে গুলি করতে আপনি নিজে নাকি সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন?

ডায়ার। হ্যাঁ।

সদস্য-২।         লোকজন যখন দেয়াল টপকে কিংবা ছোটো-ছোটো দরোজা দিয়ে বেরুনোর চেষ্টা করছিল, আপনি কি তখন তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে বলেছিলেন?

ডায়ার। হ্যাঁ।

সদস্য-৩।        লোকজন যখন কুয়োয় ঝাঁপ দিয়ে পড়ছিল, আপনি কি সেদিকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে বলেছিলেন?

ডায়ার। হ্যাঁ।

সদস্য-৪।         আপনি কি জানতেন, ওই সভায় বয়স্করা, মেয়েরা ও বাচ্চারাও ছিলো?

ডায়ার। আমি তা নিজের চোখেই দেখেছি।

সদস্য-১।         আপনি কি তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন?

ডায়ার। অন্যদের থেকে তাদের আলাদা করা সম্ভবপর ছিলো না।

সদস্য-২।         যদি সম্ভবপর হতো, আপনি কি তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করতেন?

ডায়ার। না।

সদস্য-৩।        কতজন মারা গিয়েছিল, আপনি জানেন?

ডায়ার। সরকারি হিসেব মতে, পাঁচশ জন।

সদস্য-৪।         সরকারি হিসেব তো কখনও বলে আড়াই শ জন; কখনও বলে তিন শ ঊনাশি জন; কখনও পাঁচ শ জন।

ডায়ার। এ বিষয়ে আমার কোনও বক্তব্য নেই।

সদস্য-১।         আমরা শুনেছি, এক হাজারের বেশি লোক মারা গিয়েছিল। আহত পাঁচ-ছ শ-র কম নয়। আপনার কী মনে হয়?

ডায়ার চুপ করে থাকবেন।

সদস্য-২।         আহতদের চিকিৎসার জন্য আপনি কিছু করেছিলেন?

ডায়ার। তারা হাসপাতালে যেতে পারতো। হাসপাতাল

খোলা ছিলো।

সদস্য-৩।        হাসপাতাল তো খোলাই থাকে।

ডায়ার। আমি ইচ্ছে করলে বন্ধ করে দিতে পারতাম।

সদস্য-৩।        অ।

সদস্য-৪।         কিন্তু আপনি তো তেরো তারিখ সন্ধে থেকে অমৃতসরে সান্ধ্য-আইন জারি করেছিলেন।

ডায়ার। করেছিলাম।

সদস্য-৪।         যে কেউ ঘর থেকে বেরুলেই তাকে গুলি করা হতো?

ডায়ার। হ্যাঁ।

সদস্য-৪।         তাহলে আহতরা হাসপাতালে যেতো কী করে?

সদস্য-৩।        মৃতদেহের সৎকার হতো কী করে?

সদস্য-২।         ওই সব লাশ গরমে পচেছে, দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে, কুকুর-শেয়াল তা ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেয়েছে।

ডায়ার চুপ করে থাকবেন।

সদস্য-১।         দশ মিনিট পর আপনি গুলি ছোড়া বন্ধ করে দিলেন কেন?

ডায়ার। গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল বলে।

সদস্য-১।         এতে কি আপনি দুঃখিত বোধ করেছিলেন?

ডায়ার। আমি মেশিন-গান ব্যবহারের কথা ভেবেছিলাম।

সদস্য-৪।         ব্যবহার করলেন না কেন?

ডায়ার। বাগে যাওয়ার পথটি খুব সরু। আমার সাঁজোয়া গাড়ি সেখানে ঢুকতে পারেনি।

সদস্য-২।         মেশিন-গান ব্যবহার করলে তো আরও বহু লোক

মারা যেতো।

ডায়ার। যেতো।

সদস্য-৪।         আপনি কি সৈন্যদের আগে থেকে বলেছিলেন যে, আপনি জনসভায় গুলি করতে যাচ্ছেন?

ডায়ার। না।

সদস্য-৪।         কেন নয়?

ডায়ার। তারা বিদ্রোহ করতে পারতো।

সদস্য-১।         গুলির পর আপনি কী করলেন?

ডায়ার। ছাউনিতে ফিরে গেলাম।

সদস্য-২।         ফিরে গিয়ে?

ডায়ার। হুইস্কি খেলাম। ব্ল্যাক লেবেল। রোজ যেমন খাই। রাতের খাবার খেলাম।

সদস্য-৩।        তারপর?

ডায়ার। ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমুনোর আগে খানিকক্ষণ গ্রামোফোনে বাজনা শুনলাম।

নেপথ্যে বাজনা শোনা যাবে। স্ট্রাউসের ওয়াল্জ্-এর কোনও দ্রুতগতির অংশ।

সদস্য-৪।         কী বাজনা?

ডায়ার। ওয়াল্জ্। স্ট্রাউস্। আমার খুব পছন্দ।

সদস্য-১।         ঘুম কেমন হয়েছিল?

ডায়ার। খুব ভালো।

সভাপতি।        যে-উদ্দেশ্য নিয়ে আপনি গুলি ছুড়েছিলেন, অন্য কোনও কম বেদনাদায়ক উপায়ে তা অর্জন করা যেতো না?

ডায়ার। যেতো।

সভাপতি।        তাহলে তা করলেন না কেন?

ডায়ার। আইন-শৃঙ্খলা-রক্ষাকারী হিসেবে তা আমার মর্যাদার জন্য হানিকর হতো।

সভাপতি।        আপনি কি মনে করেন না যে, আপনার এই কাজ ব্রিটিশ জাতির মুখে দুরপনেয় কলঙ্ক এঁকে দেবে?

ডায়ার। না। ব্রিটিশ জাতি এতে গৌরব বোধ করবে। এ দেশের বহু মানুষও আমাকে সমর্থন করবে।

সভাপতি।        আপনার আর কিছু বলার আছে?

ডায়ার। না।

সভাপতি।        আপনাদের আর কারও কোনও প্রশ্ন?

সদস্যরা চুপ করে থাকবেন।

সভাপতি।        ধন্যবাদ, জেনারেল ডায়ার।

ডায়ার। ধন্যবাদ, মিলর্ড।

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। যখন আলো জ্বলে উঠবে, রবীন্দ্রনাথকে দেখা যাবে। লিখছেন। সি.এফ. এন্ড্রুজ এসে ঘরে ঢুকবেন।

রবীন্দ্রনাথ।      কে? এন্ড্রুজ? আরে, এসো, এসো।

এন্ড্রুজ।         গুরুদেব, আপনি কাজ করছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ।      কী যে বলো! আমার আবার কাজ কোথায়? কাজ তো করো তোমরা। কত রাজ্যের কাজ তোমাদের।

অ্যান্ড্রুজ।      লেখা কি কাজ নয়? লেখাও তো কাজ।

রবীন্দ্রনাথ।      তুমি কাজ বলতে চাও, বলো। আমি কিন্তু একে কাজ বলি নে। সারা পৃথিবীর লোক যাকে কাজ বলে, লেখা, ছবি আঁকা, এগুলো তো সে-রকম নয়।

অ্যান্ড্রুজ।      তা অবশ্য এক দিক থেকে ঠিক।

রবীন্দ্রনাথ।      শুধু ঠিক নয়, পুরোপুরি ঠিক। তোমাদের কাজ আছে বলে ছুটিও আছে। আমার কাজও নেই, ছুটিও নেই।

রবীন্দ্রনাথ গান করবেন।

গান :

            রাতের বাসা হয়নি বাঁধা দিনের কাজ ত্রুটি,

            বিনা কাজের সেবার মাঝে পাইনে আমি ছুটি।

            শান্তি কোথায় মোর তরে হায় বিশ্বভুবন-মাঝে,

            অশান্তি যে আঘাত করে তাই তো বীণা বাজে।

            নিত্য রবে প্রাণ-পোড়ানো গানের আগুন জ্বালা-

অ্যান্ড্রুজ।      গুরুদেব, এ গান কি আপনি এখনই লিখলেন?

রবীন্দ্রনাথ।      না। গানটি এখনও লেখা হয়নি। কিন্তু একদিন লিখতে হবে। … তারপর, বলো, কী ব্যাপার? তোমারও ছটফটানি কমুক, আমারও ভয় কাটুক।

অ্যান্ড্রুজ।      গুরুদেব, আপনার ভয়?

রবীন্দ্রনাথ।      ওই, হলো আর কি। তোমরা ভয়াবহ বলেই তো তোমাদের অতো পছন্দ করি। বলে ফেলো।

অ্যান্ড্রুজ।      না … মানে … ওই … দিল্লি থেকে একটা চিঠি এসেছে।

রবীন্দ্রনাথ।      ওরেব্ বা বা ! একেবারে দিল্লি থেকে? বড়োলাট পাঠাননি তো? তাহলে তো ভারি বিপদ।

অ্যান্ড্রুজ।      বিপদ? বিপদ কেন হতে যাবে, গুরুদেব?

রবীন্দ্রনাথ।      আহা, বড়োলাট যদি ডেকে পাঠান, তাহলে কি আর তুমি এখানে পড়ে থাকবে? তোমাকে তো দিল্লি যেতেই হবে। আমার ঠাট্টা করার লোক একজন কমে যাবে।

অ্যান্ড্রুজ।      না, ঠিক বড়োলাট নন। তবে তাঁর পক্ষ থেকে

একজন …

রবীন্দ্রনাথ।      কী চান সেই একজন? মাথা না চাইলে ভেবে দেখা যেতে পারে, তাঁর ইচ্ছে পূরণ করা যায় কিনা।

অ্যান্ড্রুজ।      বড়োলাট আপনাকে ‘স্যার’ উপাধি দিতে চান, যদি অবশ্য আপনার আপত্তি না থাকে।

রবীন্দ্রনাথ।      তার মানে, নাইট্হুড?

অ্যান্ড্রুজ।      হ্যাঁ, গুরুদেব। লর্ড হার্ডিঞ্জ তো আপনার বিশেষ ভক্ত। আপনি নোবেল 888sport app download bd পাবার আগেই তো তিনি বলেছিলেন, আপনি হলেন পোয়েট লরিয়েট অব এশিয়া।

রবীন্দ্রনাথ।      তা বলেছিলেন। কিন্তু এটা নেয়া কি ঠিক হবে? তা, কবে নাগাদ জানাতে হবে? হাতে ভেবে দেখার সময় আছে তো?

অ্যান্ড্রুজ।      খুব একটা নেই। এ বছরই, মানে এই ১৯১৫-য় সম্রাট পঞ্চম জর্জের জন্মদিন যেদিন পড়বে, সেদিনই এটি তাঁরা ঘোষণা করতে চান।

রবীন্দ্রনাথ।      সেটি কবে?

অ্যান্ড্রুজ।      জুনের তিন-চার তারিখের দিকে হবে।

রবীন্দ্রনাথ।      এখন তো সবে ফেব্রুয়ারি।

অ্যান্ড্রুজ।      এ সব ঠিকঠাক করতে সময় লেগে যায়। অনেক কাগজ-টাগজ তৈরি করার ব্যাপার আছে।

রবীন্দ্রনাথ।      তা তো আছে। কিন্তু বললেই কি আর হুট করে রাজি হওয়া যায়? … আচ্ছা, আগে কেউ মানা করেছেন?

অ্যান্ড্রুজ।      মানে, গুরুদেব, নাইট্হুড নিতে?

রবীন্দ্রনাথ।      হ্যাঁ।

অ্যান্ড্রুজ।      গোখলে রাজি হননি। গোপালকৃষ্ণ গোখলে।

রবীন্দ্রনাথ।      শুনেছিলাম তাঁর শরীরটা …

অ্যান্ড্রুজ।      তেমন ভালো যাচ্ছে না। এ মাসটা যায় কিনা …

রবীন্দ্রনাথ শেষের কথাগুলো শুনবেন না। তিনি গভীরভাবে ভাবছেন।

অ্যান্ড্রুজ।      গুরুদেব।

রবীন্দ্রনাথ।      হুঁ।

অ্যান্ড্রুজ।      আমাদের স্কুলে …

রবীন্দ্রনাথ।       ব্রহ্মচর্যাশ্রমে? সেখানে আবার কী হলো?

অ্যান্ড্রুজ।      না, নতুন কোনও সমস্যা নয়। সরকারি কর্মচারীদের ছেলেদের সেখানে পড়া তো সরকার আগে নিষেধ করে দিয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথ।      সে-নিষেধাজ্ঞা তো আর নেই।

অ্যান্ড্রুজ।      না, নেই। হার্ডিঞ্জ সাহেবই তা রদ করার ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি না হলে …

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। আলো জ্বললে গান্ধীকে দেখা যায়। তাঁর সঙ্গে কয়েকজন সাংবাদিক।

গান্ধী।  এ এক দারুণ ভুল ছিলো-

            এই আন্দোলন, এই সত্যাগ্রহ।

            মানুষ এমন

            ক্ষুব্ধ, মর্মাহত, অসহিষ্ণু – আমি

            স্বপ্নেও ভাবিনি।

            আহ্মেদাবাদে তারা আগুন জ্বেলেছে,

            ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে,

            বম্বেতে থেকেও আমি

            থামাতে পারিনি।

            শুধু আহ্মেদাবাদে নয়। আগুন লাগেনি

            কোথায় এ দেশে? আমি

            থামাতে পারিনি।

            মানুষ টেলিগ্রাফের তার উড়িয়ে দিয়েছে, ট্রেন

            থামিয়ে দিয়েছে, বাজার-দোকানপাট

            তছনছ করেছে – আমি

            থামাতে পারিনি।

            পুলিশের হাতিয়ার ছিনিয়ে নিয়েছে,

            লুটপাট চালিয়েছে ঘরে-ঘরে,

            নিরীহ মানুষ খুন করে

            উল্লাসে মেতেছে? আমি

            থামাতে পারিনি।

            এর নাম সত্যাগ্রহ?

            সত্যাগ্রহে

            অশুভর কোনও জায়গা নেই।

            আমি – আমি এর জন্য দায়ী।

            এর জন্য যদি জেলে যেতে হয়,

            যাবো ;

            যদি ফাঁসি হয়,

            হবে।

            হিমালয়ের সমান ভুল ছিলো

            এই সত্যাগ্রহ।

সাংবাদিক-১।   এখন কী করবেন আপনি?

গান্ধী।  যা ঘটেছে, তা তো আর

            ফেরানো যাবে না।

সাংবাদিক-২।  তা যাবে না। কিন্তু তাই বলে

            এইখানে

            থামাও যাবে না।

সাংবাদিক-৩।  কাল পত্রিকায় কী লিখবো আমরা?

গান্ধী।  আপনারা সাংবাদিক।

            আমি যা বলেছি,

            লিখবেন তা-ই।

            আর ভাষ্য? সে তো

            আপনাদের নিজস্ব ব্যাপার।

সাংবাদিক-৪।  কিন্তু কিছুই তো বলেননি আপনি।

            কোনও সমাধান দেননি এখনও।

গান্ধী।  সমাধান মানুষের হাতে নয়,

            সমাধান ঈশ্বরের হাতে।

সাংবাদিক-১।   নিশ্চয়ই। কিন্তু মানুষকেই

            সমাধান খুঁজে ফিরতে হয়।

সাংবাদিক-২।  কী সিদ্ধান্ত আপনার?

গান্ধী।  এই সত্যাগ্রহ, এই আন্দোলন আমি

            আজ থেকে ফিরিয়ে নিলাম।

সাংবাদিক-৩।  ফিরিয়ে নিলেন?

            এতো দূরে অগ্রসর হয়ে?

সাংবাদিক-৪।  ব্রিটিশ তো ভয়ে কাঁপছে

            ভেতরে-ভেতরে।

গান্ধী।  ফিরিয়ে নিলাম।

সাংবাদিক-১।   হাজার-হাজার লোক

            আপনার মুখের দিকে

            তাকিয়ে রয়েছে।

গান্ধী।  আমিও তাদের

            মুখের দিকেই

            তাকিয়ে রয়েছি।

            যখন সময় হবে, তারা তৈরি হবে, বুঝবে,

            আইন অমান্য করা, অন্যায় আইন, আর

            সব কিছু তছনছ করা, খুন করা, রাহাজানি করা

            এক নয়,

            সেদিন সত্যাগ্রহের ডাক দেবো আমি

            আরও এক বার।

সাংবাদিক-২।  সে তো

            অনেক পরের কথা।

            এখন কি

            কিছুই করার নেই

            আপনার?

গান্ধী।  উপবাস করবো আজ থেকে-

            তিন দিন ধরে।

            প্রায়শ্চিত্ত আমার পাপের।

            প্রায়শ্চিত্ত সবার পাপের।

সাংবাদিক-৩।  প্রায়শ্চিত্ত হবে উপবাসে?

            তা-ও শুধু আপনার একার?

            যারা মারা গ্যাছে, তারা শান্তি পাবে?

            যারা বেঁচে আছে,

            বাঁচার নতুন পথ খুঁজে পাবে?

গান্ধী উত্তর দেবেন না। চলে যেতে উদ্যত হবেন।

সাংবাদিক-৪।  বাপুজি।

গান্ধী ফিরে তাকাবেন।

সাংবাদিক-৪।  জালিয়ানওয়ালাবাগের কথা শুনেছেন আপনি?

গান্ধী চুপ করে থাকবেন।

সাংবাদিক-৩।  ডায়ার সেখানে

            গুলি করে হাজার মানুষ

            হত্যা করেছে।

গান্ধী চুপ করে থাকবেন।

সাংবাদিক-২।  কুকুর-শেয়াল লাশ

            ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেয়েছে।

গান্ধী চুপ করে থাকবেন।

সাংবাদিক-১।   এ বিষয়ে কিছুই বলার নেই

            আপনার?

গান্ধী চুপ করে থাকবেন।

সাংবাদিক-৪।  প্রতিবাদ করবেন না আপনি?

গান্ধী চুপ করে থাকবেন।

আলো নিবে যাবে। আলো জ্বললে কয়েকজন সৈন্যকে দেখা যাবে। ডায়ারের নির্দেশে এরা জালিয়ানওয়ালাবাগে গুলি ছুড়েছিল।

সৈন্য-১।          এ কী করলাম আমি!

সৈন্য-২।          এ কী করলাম আমি!

সৈন্য-৩।         এ কী করলাম আমি!

সৈন্য-৪।          সেদিন আমার ভাই

            জালিয়ানওয়ালাবাগের সভায়

            সামনের সারিতে বসে ছিলো।

সৈন্য-১।          সেদিন আমার বোন

            শুনেছিল বৈশাখের মেলা বসবে

            জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঠেই।

সৈন্য-২।          সেদিন আমার বাবা-

            চিরদিন বক্তৃতা-পাগল-

            শুনতে গিয়েছিল কে কী বলে

            জালিয়ানওয়ালাবাগে।

সৈন্য-৩।         বক্তৃতা দেবার কথা ছিলো

            আমার ছেলের

            ওই দিন

            জালিয়ানওয়ালাবাগের সভায়।

সৈন্য-৪।          এখানে আমার ভাই মরে পড়ে আছে।

সৈন্য-১।          এখানে আমার বোন মরে পড়ে আছে।

সৈন্য-২।          এখানে আমার বাবা মরে পড়ে আছে।

সৈন্য-৩।         এখানে আমার ছেলে মরে পড়ে আছে।

সৈন্য-১।          সেদিন উচিত ছিলো গুলি করা

            শুয়োরের বাচ্চা ওই জেনারেলকেই।

সৈন্য-২।          আমরা কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি,

            কী কাজ আমাদের,

            শুয়োরের বাচ্চা কিছুই বলেনি।

সৈন্য-৩।         শুয়োরের বাচ্চা ওই জেনারেল নয়।

            শুয়োরের বাচ্চা আমি।

            নিজের সন্তান আমি

            নিজ হাতে হত্যা করেছি।

সৈন্য-৪।          ব্রিটিশ তো আমাদের কেউ নয়।

            দুটো পয়সার জন্য এ কাজে এসেছি।

সৈন্য-৩।         নিজের ছেলেকে

            খুন করতে আসিনি।

সৈন্য-২।          নিজের বাবাকে

            খুন করতে আসিনি।

সৈন্য-৪।          নিজের ভাইকে

            খুন করতে আসিনি।

সৈন্য-১।          নিজের বোনকে

            খুন করতে আসিনি।

সৈন্য-৪।          এখন কী হবে?

সৈন্য-৩।         ডায়ারের ফাঁসি হবে।

সৈন্য-২।          হোক। একশ বার হোক।

সৈন্য-১।          হতেই হবে। হোক।

সৈন্য-৪।          সেই সঙ্গে আমাদেরও।

সৈন্য-৩।         আমাদেরও?

সৈন্য-২।          আমাদেরও?

সৈন্য-১।          আমাদেরও?

সৈন্য-৪।          ডায়ারের আদেশ

            আইন-সঙ্গত ছিলো না।

            সে-আদেশ পালন করা

            আমাদের কর্তব্য ছিলো না।

            এটি যুদ্ধ নয়, যুদ্ধক্ষেত্র নয়।

            যাকে-তাকে গুলি করতে

            আমরা পারি না।

এই কথাগুলো বলা হওয়ার সময় ডায়ার নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়াবেন।

ডায়ার। এটেন্শন।

সৈন্যরা যে যেখানে আছে, মুহূর্তে এটেন্শন হয়ে দাঁড়াবে।

ডায়ার। তোমাদের জন্য সুখবর আছে। তোমরা প্রকৃত বীর, প্রকৃত দেশপ্রেমিক। একমাত্র সৈন্যরাই দেশপ্রেমিক হতে পারে। তোমরা ভালো কাজ করেছো। তোমাদের কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সরকার দায়মুক্তি আইন জারি করেছে। সমস্ত দায় থেকে তোমাদের মুক্তি দেয়া হয়েছে। তোমরা যা করেছো, তার জন্য কোনও বিচার হতে পারবে না। কোনও আদালত তোমাদের স্পর্শ করতে পারবে না। তোমাদের কোনও শাস্তি হতে পারবে না। ভালো কাজের এ-ই 888sport app download bd।

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। স্পটলাইট জ্বলে উঠলে তার নিচে রবীন্দ্রনাথকে দেখা যাবে।

রবীন্দ্রনাথ।      দায়মুক্তি? ইন্ডেম্নিটি?

            মানুষ শ্বাপদ হয়ে যাবে, খুন করবে,

            একজন-দু জন নয়, অসংখ্য মানুষ

            খুন করবে, বন্দুক উঁচিয়ে ধরবে

            জেনেশুনে, একেবারে ঠাণ্ডা মাথায়, নিরীহ,

            নিরস্ত্র মানুষ মুহূর্তে লুটিয়ে পড়বে,

            মাটির শ্যামল রঙ পাল্টে যাবে, লাল হয়ে যাবে,

            আহত মানুষ চিৎকার করতে-করতে

            এক সময় চিৎকারও করতে ভুলে যাবে,

            এক ফোঁটা জলও পাবে না,

            তাদের শুশ্রƒষা করতে এগিয়ে আসারও

            কারও কোনও পথ থাকবে না,

            মানুষের হিংস্র মুখ দেখে শ্বাপদ প্রাণীরা

            ভয়ে কুঁকড়ে যাবে,

            আর

            ওই সব খুনিদের কারও কোনও বিচার হবে না,

            কেউই পারবে না আদালতে

            কিংবা অন্য কোথাও

            প্রতিকার চাইতে,

            নালিশ করতে বিরুদ্ধে তাদের,

            কোনও শাস্তি হবে না কারও-ই,

            দিব্যি হেসে-খেলে, ফুর্তি করে, মহানন্দে

            খুনিদের দিন কেটে যাবে,

            আরও খুন করবে তারা, কিংবা অন্য কেউ

            তাদের মতোই,

            এ রকম হতে দেয়া যায় না কখনও।

            মানুষ এভাবে তার দায় থেকে, কাজ

            ও কাজের পরিণাম থেকে

            মুক্তি পেতে পারে না কখনও।

            আইনের কোনও অর্থ থাকে না তাহলে,

            সমাজের কোনও ভিত্তি থাকে না তাহলে,

            রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়।

            কেউ খুন করলে তার ফাঁসি হবে,

            কেউ খুন করলে তার কিছুই হবে না,

            এ যদি নিয়ম হয়,

            রাষ্ট্রের ক্ষমতা যার হাতে,

            যাকে-তাকে ধরে নিয়ে যাবে,

            যখন-তখন ধরে নিয়ে যাবে,

            রাতের বেলায় ধরে নিয়ে যাবে,

            দিনের বেলায় ধরে নিয়ে যাবে,

            পিটিয়ে গায়ের চামড়া তুলে নেবে,

            গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধে রাখবে,

            যতো কষ্ট হোক, এক ফোঁটা পানিও দেবে না,

            পঙ্গু করে দেবে, হাসপাতালে নিয়ে যাবে

            যখন আসন্ন মৃত্যু, বাঁচার আশাই নেই কোনও,

            বলবে, ভয়ে মারা গ্যাছে,

            হৃদযন্ত্র হঠাৎ বিকল হয়ে গ্যাছে।

            এই দেশ শুধু

            কেঁচো ও কৃমির,

            আরশোলা ও চামচিকের

            বাসযোগ্য হয়ে যাবে?

            নৃশংসতার দিকেই সুনিশ্চিত

            আমরা এগিয়ে চলেছি?

            জালিয়ানওয়ালাবাগের সভায় সেদিন

            গুলি ছুড়লো যারা,

            পুরস্কৃত করা হোক তাহলে তাদের।

            কী মহৎ কাজ, কী বীরত্বময়-

            তুলনাই নেই ইতিহাসে!

            দুর্ভাগ্যবশত, এ দেশ স্বাধীন নয় আজও-

            যদি হতো, ওই খুনিদের কেউ-কেউ

            রাষ্ট্রদূতও পারতো হয়ে যেতে।

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। আলো জ্বললে পরে খবরের কাগজ হাতে পরপর কয়েকজন হকারকে দেখা যাবে। তারা মঞ্চের এক দিক থেকে অন্য দিকে ছুটে যাবে। এরা বিভিন্ন দিনের কাগজ বিক্রি করছে। ভিন্ন-ভিন্ন দিন বোঝানোর জন্য একেকজন হকার বেরিয়ে যাবার পর মঞ্চে অল্প সময়ের জন্য খুব দ্রুত আলো জ্বলবে-নিববে – যেন রাতের অন্ধকারে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে।

হকার-১।          জেনারেল ডায়ার সক্রিয় দায়িত্ব থেকে অপসারিত। জেনারেল ডায়ার সক্রিয় দায়িত্ব থেকে অপসারিত।

হকার-২।         জেনারেল ডায়ার-কে ভারত সরকারের মৃদু তিরস্কার। জেনারেল ডায়ার-কে ভারত সরকারের মৃদু তিরস্কার।

মঞ্চে বিদ্যুৎ ঝলক।

হকার-১।          ডায়ারের বিরুদ্ধে গৃহীত সরকারের ব্যবস্থা হাউস অব কমন্স্্-এ অনুমোদন।

হকার-২।         পক্ষে ২৩২ ভোট। বিপক্ষে ১৩১ ভোট।

মঞ্চে বিদ্যুৎ ঝলক।

হকার-১।          হাউস অব কমন্স্-এর সিদ্ধান্তে য়ুরোপিয়ান এসোসিয়েশন-এর তীব্র ক্ষোভ।

হকার-২।         জেনারেল ডায়ার-কে চাকরিতে পুনর্বহালের দাবি।

মঞ্চে বিদ্যুৎ ঝলক।

হকার-১।          ডায়ার-এর জন্য চাঁদা আদায় শুরু।

হকার-২।         লন্ডন-এর মর্নিং পোস্ট পত্রিকার মহতী উদ্যোগ।

মঞ্চে বিদ্যুৎ ঝলক।

হকার-১।          আগামী কাল জালিয়ানওয়ালাবাগ নিয়ে হাউস অব লর্ডস্্-এ বিতর্ক।

হকার-২।         আগামী কাল জালিয়ানওয়ালাবাগ নিয়ে হাউস অব লর্ডস্্-এ বিতর্ক।

আলো নিবে যাবে। আবার যখন আলো জ্বলে উঠবে, হাউস অব লর্ডস্-এর অধিবেশন দেখা যাবে। হাউস অব লর্ডস্্-এর অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন লর্ড চান্সেলর।

লর্ডরা। হিয়ার! হিয়ার!

লর্ড চান্সেলর। অর্ডার! অর্ডার!

লর্ড-১। আমি আমার বক্তব্য আর দীর্ঘ করতে চাই না।

লর্ড চান্সেলর। আপনার সময় আর মাত্র দু মিনিট।

লর্ড-১। ধন্যবাদ, মিলর্ড। এর চেয়ে বেশি সময় আমার প্রয়োজন হবে না। আমি এতোক্ষণ যা বলেছি, তা থেকে, আশা করি, স্পষ্ট হবে যে, আমাদের – শুধু এই হাউস অব লর্ডস্-এর মাননীয় সদস্যদের নয়, সমগ্র ব্রিটিশ জাতির – জেনারেল ডায়ার-কে নিয়ে গৌরব বোধ করার কারণ আছে। এই ব্রিটিশ জাতি সুমহান ঐতিহ্যের অধিকারী। আমরা সভ্যতার পথ-প্রদর্শক। আমাদের এই ঐতিহ্যকে জেনারেল ডায়ার নিঃসন্দেহে আরও উজ্জ্বল করেছেন, আরও দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমার আর কিছু বলার নেই। ধন্যবাদ, মিলর্ড।

লর্ডদের হর্ষধ্বনি।        হিয়ার! হিয়ার!

লর্ড চান্সেলর। ধন্যবাদ, মিলর্ড। আমাদের হাতে সময় অল্প। আমি এর পরের সম্মানিত বক্তাকে তাঁর বক্তব্য অনুগ্রহপূর্বক সংক্ষিপ্ত করতে অনুরোধ করবো।

লর্ড-২। ধন্যবাদ, মিলর্ড। আমার কথা সামান্যই। ভারতে বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এবং বিশেষ করে জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা সম্পর্কে আপনারা সবাই সম্যক অবহিত আছেন। সুতরাং সে-বিষয়ে আমার আর বিস্তারিত বলার প্রয়োজন নেই। আমার শুধু একটিই প্রশ্ন, আর তা হলো : মিস্টার গান্ধীর ভূমিকা হঠাৎ করে পরিবর্তিত হয়ে গেলো কেন? মহাযুদ্ধের সময় তিনি আমাদের পক্ষে ছিলেন – আমাদের সাহায্য দেয়ার জন্য, সহযোগিতা করার জন্য ভারতের জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর পর তিনি হঠাৎ করে সত্যাগ্রহ নামের আন্দোলনের ডাক দিলেন কেন? হ্যাঁ, আমরা রাউলাট কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে দ্য অ্যার্নাকিক্যাল অ্যান্ড রেভোলিউশনারি ক্রাইম্স্ অ্যাক্ট ১৯১৯ পাস করেছিলাম। কিন্তু তা আমরা করেছিলাম ভারতের জনগণের মঙ্গলের জন্য – আমাদের নিজেদের স্বার্থে নয়। ভারতের জনগণের মঙ্গল ছাড়া আমাদের আর কোনও স্বার্থ নেই। তারা যাতে অযথা হয়রানির মুখোমুখি না হয়, তাদের শারীরিকভাবে যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, তাদের বিষয়-আশয়ের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সেজন্যই এ আইন প্রণয়ন করা হয়। মিলর্ড, এই আইনের শিরোনামে ‘ক্রাইম্স্’ কথাটির দিকে আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমরা আইনের শাসনে বিশ্বাসী, আমরা সবসময় আইন সমুন্নত রাখতে চাই। কেউ যদি আইন ভঙ্গ করে, অপরাধ করে, তাহলে তার শাস্তি তাকে পেতেই হবে। একই সঙ্গে আমরা মন্টেগু-চেম্স্ফোর্ড শাসন সংস্কার প্রস্তাব ভারতীয় নেতাদের কাছে উপস্থাপন করেছিলাম। সত্যি বলতে কি, এই প্রস্তাব রাউলাট অ্যাক্ট পাসের অনেক আগেই করা হয়েছিল। রাউলাট অ্যাক্ট পাস হয় ১৯১৯-এর 888sport cricket BPL rateে মার্চ, আর মন্টেগু-চেম্স্ফোর্ড শাসন-সংস্কার পরিকল্পনা প্রকাশ করা হয় ১৯১৮-র বারোই জুলাই, প্রায় ন মাস আগে। এ দুয়েরই মধ্য দিয়ে আমাদের সদিচ্ছার প্রকাশ ঘটেছে। মিস্টার গান্ধী যদি আন্দোলনের ডাক না দিতেন, তাহলে অরাজকতা দেখা দিতো না। অরাজকতা দেখা না দিলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার জন্য কোনও ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়োজন হতো না। সুখের বিষয়, মিস্টার গান্ধী এখন তাঁর ভুল বুঝতে পেরেছেন। তিনি তাঁর আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। জেনারেল ডায়ার সুশাসনের প্রতি আমাদের দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকারের উজ্জ্বল প্রতীক। এ পরিপ্রেক্ষিতে, মিলর্ড, আমি মনে করি যে, জেনারেল ডায়ার-এর বিরুদ্ধে গৃহীত ভারত সরকারের শাস্তিমূলক ব্যবস্থাকে অন্যায্য বলে ঘোষণা করে ও চাকরি থেকে তাঁর অপসারণের নিন্দা করে এই হাউস অব লর্ডস্্-এ একটি প্রস্তাব গৃহীত হওয়া উচিত। জেনারেল ডায়ার-কে পুনর্বহাল করা উচিত। তা করা না হলে চাকরি থেকে তাঁর অপসারণ একটি অতি বাজে ও বিপদজনক পূর্বদৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। ধন্যবাদ, মিলর্ড।

লর্ডদের বিপুল

হর্ষধ্বনি।          হিয়ার! হিয়ার!

লর্ড চান্সেলর। অর্ডার! অর্ডার! মিলর্ড, আপনাকে ধন্যবাদ। এই

প্রস্তাব আমি এখন ভোটে দেবো। তার আগে এ সম্পর্কে যদি আর কেউ কিছু বলতে চান …

লর্ড-৩।            মিলর্ড।

লর্ড চান্সেলর। আপনি এ বিষয়ে কিছু বলতে চান?

লর্ড-৩।            আপনার অনুমতি পেলে …

লর্ড চান্সেলর। বলুন। আশা করি, আপনার বেশি সময় লাগবে না।

লর্ড-৩।            ধন্যবাদ, মিলর্ড। আমার যা বলার, আমি সংক্ষেপেই বলবো। জেনারেল ডায়ার যা করেছেন, তা এক জঘন্য অপরাধ। নিরস্ত্র মানুষের ওপর তিনি গুলি চালিয়েছেন, তাদের কোনও অপরাধ ছাড়াই গুলি চালিয়েছেন। কত জন মারা গেছে, কত জন আহত হয়েছে, তা পর্যন্ত আমরা সঠিক জানি না। এর চাইতে কলঙ্কময় ঘটনা ব্রিটিশ জাতির ইতিহাসে আর কখনও ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। মানবিক মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার, আইনের প্রতি 888sport apk download apk latest versionবোধের, ন্যায়পরায়ণতার যে-ঐতিহ্য আমাদের এতো দিনের গর্বের বিষয় ছিলো, তা আজ ধুলোয় লুটিয়ে গেছে। হান্টার কমিটির রিপোর্ট সর্বসম্মত নয়। ওই কমিটির ব্রিটিশ সদস্যরা একরকম রিপোর্ট দিয়েছেন, ভারতীয় সদস্যরা অন্যরকম রিপোর্ট দিয়েছেন। লর্ড হান্টার ভারতীয় সদস্যদের মুখের ওপর অপমান করেছেন, তাঁদের সঙ্গে লর্ড হান্টার-এর মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ। দায়মুক্তি আইন জারি করা হয়েছে। ডায়ার ও তাঁর সহকর্মীদের তাঁদের দায় থেকে যদি আইন করে মুক্তিই দেয়া হয়, তাহলে তদন্ত-কমিটি গঠনের মানে কি? এটি একটি লোক-দেখানো ভড়ং মাত্র। বিদ্রোহের বা যুদ্ধ ঘোষণার বা সরকার উৎখাতের জন্য ষড়যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু তার কোনওটিই হান্টার কমিটির সামনে প্রমাণিত হয়নি। ভারতে ব্রিটিশ সরকার একটি কাজ করতেই খুব পটু। তা হলো, যেখানে-সেখানে ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজে পাওয়া – ষড়যন্ত্রের নাম করে লোকজনকে জেলে পোরা, হাজতে পোরা, ঠেঙানো, পিটিয়ে আধ-মরা করা। এই যে এতোগুলো লোক মারা গেলো, তার দায়িত্ব কে নেবে? জেনারেল ডায়ার-এর বিচার হওয়া উচিত ও বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে, ফাঁসি হওয়া উচিত। ধন্যবাদ, মিলর্ড।

লর্ড-৪। আমি কিছু বলতে চাই, মিলর্ড।

লর্ড চান্সেলর। বলুন। আশা করি, আপনার বক্তব্য আপনি সংক্ষেপে উপস্থাপন করবেন।

লর্ড-৪। ধন্যবাদ, মিলর্ড। আমি আমার বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করবো। আমি প্রথমেই বলতে চাই যে, জেনারেল ডায়ার-এর বিরুদ্ধে গৃহীত ভারত সরকারের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে ও সে-ব্যবস্থার নিন্দা করে আমার সহকর্মী-বন্ধু যে-প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন, আমি মনে করি তা খুবই ভালো প্রস্তাব এবং এ প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য আমি তাঁর কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। যেখানে জেনারেল ডায়ার-কে পদোন্নতি দেয়া উচিত ছিলো, তাঁর কীর্তির জন্য তাঁকে পুরস্কৃত করা উচিত ছিলো, সেখানে তাঁকে তিরস্কৃত করা হয়েছে – যতোই মৃদু হোক, তিরস্কার তিরস্কারই – তাঁর চাকরি কেড়ে নেয়া হয়েছে। এর নিন্দা করার ভাষা আমার জানা নেই। কেউ-কেউ বলতে পারেন, সেদিন জালিয়ানওয়ালাবাগে বহু লোকের মৃত্যু হয়েছে ও বহু লোক আহত হয়েছে। এর সত্যতা অস্বীকার করার উপায় নেই এবং আমরা তা অস্বীকার করতেও চাই না। এটি যদি পরিহার করা যেতো, তাহলে আমিই সব চাইতে বেশি সুখি হতাম। কিন্তু তা পরিহার করার কোনও উপায় ছিলো কি? জেনারেল ডায়ার-এর সামনে কোনও বিকল্প ছিলো কি? ছিলো না। মিলর্ড, মনে করুন, আমাদের মধ্যে কেউ উঁচু-নিচু আঁকা-বাঁকা পথে বাস চালানোর দায়িত্ব পেলেন। বাসটি চালানোর সময় হঠাৎ বাসের সামনে কোত্থেকে একটি কুকুর এসে পড়লো। সরু পথ; দু দিকে গভীর খাদ; সরে দাঁড়াবার কোনও জায়গা নেই। বাসের চালক এ অবস্থায় কী করবেন? বাসের আরোহীদের মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে কুকুরকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন? নাকি, কুকুরকে চাপা দিয়ে বাসের লোকজনকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন? বাসের ভেতর বয়স্করা, মেয়েরা ও বাচ্চারাও আছে। জেনারেল ডায়ার-এর সামনে কোনও বিকল্প ছিলো না। যদি থাকতো, তাহলে তিনি নিশ্চয়ই সেই বিকল্প পথই বেছে নিতেন। তিনি ভারতের অসহায় মানুষকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। তিনি বীর; তিনি সাহসী; তিনি মহানুভব। ব্রিটিশ হলেও তিনি ভারতেরও লোক – পাঞ্জাবেই তাঁর জন্ম হয়েছিল। আরেকটি বিষয়ের প্রতি, মিলর্ড, আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। তা এই যে, জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার কোনও প্রতিবাদ মিস্টার গান্ধী করেননি, কোনও নিন্দাও নয়, এ বিষয়ে কোনও বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। এ থেকে কী প্রমাণিত হয়? মিস্টার গান্ধী আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। আমরা যেমন অরাজকতা চাই না, তিনিও তেমনি অরাজকতা চান না। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, মিলর্ড।

লর্ড চান্সেলর। ধন্যবাদ। আমি এখন প্রস্তাবটি ভোটে দেবো। যাঁরা এ প্রস্তাবের পক্ষে, তাঁরা ‘হ্যাঁ’ বলবেন।

খুব জোরে ‘হ্যাঁ’ শোনা যাবে।

লর্ড চান্সেলর। যাঁরা এ প্রস্তাবের বিপক্ষে, তাঁরা ‘না’ বলবেন।

ক্ষীণ কণ্ঠে ‘না’ শোনা যাবে।

লর্ড চান্সেলর। প্রস্তাবের পক্ষে ১২৯টি ও বিপক্ষে ৮৯টি ভোট পড়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে, জেনারেল ডায়ার-এর বিরুদ্ধে গৃহীত ভারত সরকারের ব্যবস্থাকে অন্যায্য ঘোষণা করে ও চাকরি থেকে তাঁর অপসারণের নিন্দা করে উত্থাপিত প্রস্তাবটি হাউস অব লর্ডস্্-এ গৃহীত হলো। আপনাদের ধন্যবাদ।

মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যাবে। আলো জ্বললে কয়েকজন ব্রিটিশ মহিলাকে

দেখা যাবে।

ব্রিটিশ মহিলা ১।          হাউস অব লর্ডস্ ঠিক কাজ করেছে।

ব্রি-ম ২।           কিন্তু হাউস অব কমন্স্ তা করলো না কেন?

ব্রি-ম ৩।           হাউস অব কমন্স্ ডায়ার-এর পক্ষ না নিয়ে ভারত সরকারের পক্ষ নিলো কেন?

ব্রি-ম ৪।           আসল দোষ তো ভারত সরকারের। তারা ডায়ার-কে শাস্তি দিতে গেলো কেন? তাঁকে তিরস্কার করলো কেন? চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিলো কেন?

ব্রি-ম ৫।           অকৃতজ্ঞ! অকৃতজ্ঞ!

ব্রি-ম ১।            মর্নিং পোস্ট-এর আবেদনে খুব সাড়া পড়েছে।

ব্রি-ম ২।           দশ হাজার পাউন্ড তো এরই মধ্যে উঠে গেছে।

ব্রি-ম ৩।           আরও উঠবে।

ব্রি-ম ৪।           ব্রিটেনের লোক দেখিয়ে দিলো, তারা বীরের সম্মান করতে জানে।

ব্রি-ম ৫।           কম করে হলেও মর্নিং পোস্ট ডায়ার-কে ত্রিশ হাজার পাউন্ড তুলে দেবেই।

ব্রি-ম ১।            আমরা কিছু করতে পারি না?

ব্রি-ম ২, ৩,

    ৪ ও ৫।         আমরা?

ব্রি-ম ১।            মর্নিং পোস্ট-এ তো ডায়ার-এর জন্য চাঁদা দিচ্ছে ব্রিটেনে যারা আছে, তারা। আমরা ভারতবর্ষে আছি বলে আমরা কিছু করতে পারবো না?

ব্রি-ম ২।           আমরাও চাঁদা দেবো।

ব্রি-ম ৩।           ঠিক কথা।

ব্রি-ম ৪।           খুব ভালো কথা।

ব্রি-ম ৫।           আমরা কেন পেছনে পড়ে থাকবো? আমরাও ডায়ার-এর জন্য চাঁদা তুলবো।

ব্রি-ম ১।            কিন্তু, কিভাবে?

ব্রি-ম ২।           আমরা এখানে তহবিল গঠন করবো।

ব্রি-ম ৩।           নাম দেবো, ‘ডায়ার এপ্রেসিয়েশন ফান্ড’।

ব্রি-ম ৪।           চমৎকার !

ব্রি-ম ৫।           আমরা কম করে বিশ হাজার পাউন্ড ডায়ার-কে উপহার দেবো।

ব্রি-ম ১।            সঙ্গে একটি তলোয়ারও দেবো।

ব্রি-ম ২।           আজ থেকে, এই মুসৌরি থেকে, আমাদের কাজ শুরু হলো।

ব্রি-ম ৩।           এই যে আমার ব্রেস্লেট – এটি আমি এই তহবিলে দিলাম।

ব্রি-ম ৪।           এই যে আমার চুড়ি – এটি আমি এই তহবিলে দিলাম।

ব্রি-ম ৫।           এই যে আমার নেক্লেস – এটি আমি এই তহবিলে দিলাম।

ব্রি-ম ১।            এই যে আমার কানের দুল – এটি আমি এই তহবিলে দিলাম।

ব্রি-ম ২।           এই যে আমার হীরের আঙটি – আমার বিয়ের আঙটি – এটি আমি এই তহবিলে দিলাম।

ব্রি-ম ১।            ডায়ার দীর্ঘজীবী হোন।

ব্রি-ম ২, ৩,

    ৪ ও ৫।         ডায়ার দীর্ঘজীবী হোন।

আলো নিবে যাবে। আলো জ্বললে গান্ধীকে মাটিতে বসে উপাসনা করতে দেখা যাবে। তাঁর সঙ্গে কয়েকজন ছেলে-মেয়ে। সবাই মিলে গান করছেন।

গান :

            আল্লা তেরো নাম।

            ঈশ্বর তেরো নাম।

            সব কো সৎ মতি

            দে ভগবান।

গান চলতে-চলতে অ্যান্ড্রুজ এসে ঢুকবেন। গান্ধী হাত দিয়ে ইশারা করে তাঁকে বসতে বলবেন। অ্যান্ড্রুজ মাটিতে বসবেন ও গানে যোগ দেবেন। গান শেষ হয়ে যাবে। গান্ধী সবাইকে চলে যেতে ইশারা করবেন। শুধু অ্যান্ড্রুজ থাকবেন।

গান্ধী।  অ্যান্ড্রুজ, মাফ করবেন, আপনাকে বসিয়ে রাখলাম।

অ্যান্ড্রুজ।      না, না, তাতে কী হয়েছে। আপনি তো উপাসনা করছিলেন, বাপুজি।

গান্ধী।  তারপর বলুন, কী খবর। কলকাতা থেকে দিল্লি তো অনেক দূরের পথ। আসতে কষ্ট হয়নি তো?

অ্যান্ড্রুজ।      তা একটু হয়েছে বৈকি! কী আর করা যাবে।

গান্ধী।  দিল্লিতে গরমও কলকাতার চাইতে একটু বেশি।

অ্যান্ড্রুজ।      একটু নয়, বাপুজি। বেশ বেশি।

গান্ধী।  গুরুদেব কেমন আছেন?

অ্যান্ড্রুজ।      শরীরটা একেবারেই ভালো যাচ্ছে না। সারা দিন লম্বা চেয়ারে শুয়ে থাকেন। দোতলা থেকে তিন তলায় উঠতেও কষ্ট হয়। আর খুব অস্থির হয়ে আছেন।

গান্ধী।  অস্থির হয়ে আছেন?

অ্যান্ড্রুজ।      পাঞ্জাবে যা ঘটলো, তা শুনে …

গান্ধী।  ও।

অ্যান্ড্রুজ।      সে-দিন একজনকে বলছিলেন, ‘যে-রকম চারদিক উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, ভিতরে-ভিতরে পুড়ে-পুড়ে কী করে ভালো থাকব?’

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ।

অ্যান্ড্রুজ।      গুরুদেবই আমাকে পাঠিয়েছেন।

গান্ধী।  আপনার জরুরি তার দেখে আমার সে-রকমই মনে হয়েছিল।

অ্যান্ড্রুজ।      পাঞ্জাবের ঘটনার প্রতিবাদ করা উচিত।

গান্ধী চুপ করে থাকবেন।

অ্যান্ড্রুজ।      এখন তো পাঞ্জাবে বাইরে থেকে লোক ঢোকা নিষেধ। গুরুদেবের ইচ্ছে, তিনি দিল্লি আসবেন এবং আপনাকে নিয়ে পাঞ্জাবে যাবেন।

গান্ধী।  ওরা তো যেতে দেবে না। গ্রেফতার করবে।

অ্যান্ড্রুজ।      গুরুদেব মনে করেন সেটিই হবে প্রতিবাদ। আপনি রাজি হলে গুরুদেব এক্ষুনি রওয়ানা হতে পারেন।

গান্ধী।  এটি হতে পারে না। গুরুদেবকে আমার নমস্কার জানিয়ে বলবেন, এটি সম্ভব নয়।

অ্যান্ড্রুজ।      কেন নয়, বাপুজি?

গান্ধী।  আমি এখন সরকারকে কোনওভাবে বিব্রত করতে চাই না।

অ্যান্ড্রুজ চুপ করে থাকবেন।

গান্ধী।  পাঞ্জাবের ঘটনা সম্পর্কে আমি কোনও বিবৃতি দিইনি। পাঞ্জাবে কী ঘটেছে, তা আমি ঠিক মতো জানি না। কোনও কিছু না জেনে সে-সম্পর্কে কোনও ধারণা করা ঠিক নয়।

অ্যান্ড্রুজ।      কিন্তু পাঞ্জাবে তো সামরিক আইন জারি করা হয়েছে।

গান্ধী।  সামরিক আইনের নিন্দে করতেই হবে, আমি এমনটি মনে করি না। আমি এমন কিছু করতে চাই না যা স্থানীয় প্রশাসনকে অযথা উস্কে দেবে। হ্যাঁ, পাঞ্জাবের ছোটোলাট কিছু কড়া ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বলে আমি শুনেছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সামরিক আইনও কড়া হবে, লোকজনকে অযথা দুর্ভোগের শিকার

হতে হবে।

অ্যান্ড্রুজ।      আপনি যদি, বাপুজি, পাঞ্জাবে যেতে রাজি না-ই হন, গুরুদেব হয়তো প্রতিবাদের অন্য কোনও পথ

বেছে নেবেন।

গান্ধী।  কী পথ?

অ্যান্ড্রুজ।      তা আমি জানি না।

গান্ধী।  এখন কোনও কিছু করা ঠিক হবে না। আরও অপেক্ষা করা প্রয়োজন।

অ্যান্ড্রুজ।      আপনি তাহলে কিছু করার কথা ভাবছেন না?

গান্ধী।  না। আমি বরং ভাবছি, কিছু দিনের মধ্যে একটি ঘোষণা দেবো। ঘোষণা দিয়ে বলবো যে, ব্রিটিশ সরকারের সদিচ্ছার যে-আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে ও আমার বন্ধুদের পরামর্শ অনুযায়ী, আমি আর নতুন করে আইন অমান্য আন্দোলন করবো না। আমি বরং সত্যাগ্রহীদের বলবো, দেশীয় পণ্য ব্যবহারে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে; বলবো, হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের জন্য কাজ করতে।

মঞ্চ প্রায় অন্ধকার। রবীন্দ্রনাথ অস্থিরভাবে পায়চারি করছেন। নেপথ্যে গান শোনা যাচ্ছে।

গান :

            প্রচ-

            দারুণ ঘনঘটা, অবিরল অশনিতর্জন ॥

            ঘন ঘন দামিনী-ভুজঙ্গ-ক্ষত যামিনী,

            অম্বর করিছে অন্ধনয়নে অশ্রু-বরিষণ ॥

গান যখন প্রায় শেষ হয়ে আসছে, তখন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ মঞ্চে ঢুকবেন।

রবীন্দ্রনাথ।      কে? প্রশান্ত? অ্যান্ড্রুজ-এর কাছ থেকে কোনও খবর এসেছে?

প্রশান্তচন্দ্র।      অ্যান্ড্রুজ ফিরে এসেছেন, গুরুদেব।

রবীন্দ্রনাথ।      অ্যান্ড্রুজ ফিরে এসেছে?

চিত্তরঞ্জন দাশের বসার ঘর। চিত্তরঞ্জন খবরের কাগজ পড়ছেন। হঠাৎ ঝড়ের বেগে রবীন্দ্রনাথ ঘরে ঢুকবেন।

চিত্তরঞ্জন।       এ কি, গুরুদেব, আপনি?

রবীন্দ্রনাথ।      হ্যাঁ, আমি। তোমার সঙ্গে খুব জরুরি কথা আছে।

চিত্তরঞ্জন।       আমাকে খবর দিলেই তো পারতেন।

রবীন্দ্রনাথ।      তোমাকে খবর দেবার আর সময় পেলুম কোথায়। হঠাৎ মনে হলো, তোমার সঙ্গে এক্ষুনি কথা বলা দরকার। দেরি না করে বেরিয়ে পড়লুম।

চিত্তরঞ্জন।       তা, গুরুদেব, আপনি এলেন কী করে?

রবীন্দ্রনাথ।      ইচ্ছে থাকলে কি আর উপায়ের অভাব হয়? বাড়ি থেকে বেরিয়েই একটা ঠিকে গাড়ি পেয়ে গেলুম, সেটি ভাড়া করেই চলে এলুম।

চিত্তরঞ্জন।       এ সব কাজ তো প্রশান্তচন্দ্র করে থাকেন। তিনি জানেন তো আপনি আমার এখানে এসেছেন?

রবীন্দ্রনাথ।      না, জানে না। ও সময় ও ওখানে ছিলো না। ও কেন, কেউই জানে না। কাউকেই বলে আসা হয়নি।

চিত্তরঞ্জন।       তাহলে তো জোড়াসাঁকোয় সবাই দুশ্চিন্তা করবে।

রবীন্দ্রনাথ।      দুশ্চিন্তা করার সময়ই তো এটি। তবে আমাকে নিয়ে নয়, দেশকে নিয়ে। পাঞ্জাবের কথা শুনেছো তো?

চিত্তরঞ্জন।       কিছু-কিছু শুনেছি। বেশির ভাগই উড়ো খবর। সরকার তো খবর বেরুতেই দেয় না – খবরের কাগজের গলা চেপে রেখেছে।

রবীন্দ্রনাথ।      তা তো রেখেছো। তাই বলে খবর তো আর চাপা থাকে না।

চিত্তরঞ্জন।       তা থাকে না।

রবীন্দ্রনাথ।      জালিয়ানওয়ালাবাগে অন্তত এক হাজার লোককে গুলি করে মেরেছে, রাস্তায়-রাস্তায় মঞ্চ তৈরি করে লোকজনকে চাবকাচ্ছে, যাকে খুশি যখন খুশি ধরে নিয়ে জেলে পুড়ছে, কোনও-কোনও রাস্তা লোকজনকে হামাগুড়ি দিয়ে, নাকে খৎ দিয়ে পেরুতে হচ্ছে, জলের লাইন কেটে দিয়েছে, বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়েছে, গুজরানওয়ালায় মেশিনগান থেকে কম করে আড়াই শ রাউন্ড গুলি ছোড়া হয়েছে, এরোপ্লেন থেকে বোমা ফেলা হয়েছে, গ্রাম, গঞ্জ, শহর, এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে গুলি ছোড়া হয়নি।

চিত্তরঞ্জন।       পাঞ্জাবে তো এখন মার্শাল ল চলছে।

রবীন্দ্রনাথ।      জালিয়ানওয়ালাবাগে যখন গুলি ছোড়া হয়, তখন তো অমৃতসরে মার্শাল ল ছিলো না।

চিত্তরঞ্জন।       তা ছিলো না।

রবীন্দ্রনাথ।      জালিয়ানওয়ালাবাগে গুলি ছোড়া হয় এপ্রিলের তেরো তারিখে, আর মার্শাল ল জারি করা হয় দু দিন পরে – পনেরো তারিখে।

চিত্তরঞ্জন।       সে-রকমই তো শুনেছি।

রবীন্দ্রনাথ।      মার্শাল ল থাকলেই সব কিছু শুদ্ধ হয়ে যায় না, সরকার যা খুশি তা-ই করার অধিকার পায় না, মানুষকে নির্যাতন করতে পারে না, খুন করতে পারে না। মার্শাল ল বর্বরের আইন – যে-দেশে মার্শাল ল হয়, মানুষের সে-দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।

চিত্তরঞ্জন।       এ সব তো পাঞ্জাবে ঘটছে। আমরা কী করতে পারি?

রবীন্দ্রনাথ।      আমরা কী করতে পারি? আর কিছু না পারি, প্রতিবাদ করতে পারি।

চিত্তরঞ্জন।       প্রতিবাদ?

রবীন্দ্রনাথ।      হ্যাঁ, প্রতিবাদ। তুমি কি মনে করো না, এ সবের প্রতিবাদ হওয়া উচিত?

চিত্তরঞ্জন।       প্রতিবাদ? … ও … হ্যাঁ … তা … তা তো নিশ্চয়ই। প্রতিবাদ হলে তো ভালোই হয়।

রবীন্দ্রনাথ।      আমি এ জন্যই তোমার কাছে এসেছি।

চিত্তরঞ্জন।       গুরুদেব, আপনি ভাবছেন, আমার কিছুর করার আছে? আপনি বলুন, আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করে দেখবো।

রবীন্দ্রনাথ।      এ সময় সমস্ত দেশ মুখ বন্ধ করে থাকবে, এ অসহ্য। তোমরা প্রতিবাদ-সভা ডাকো।

চিত্তরঞ্জন।       তা, আপনি বললে …

রবীন্দ্রনাথ।      আমি নিজেই বলছি, আমি সভাপতি হবো।

চিত্তরঞ্জন একটু ভাববেন।

চিত্তরঞ্জন।       বেশ। আর কে বক্তৃতা দেবেন?

রবীন্দ্রনাথ।      সে তোমরা ঠিক করো।

চিত্তরঞ্জন আরও ভাববেন।

চিত্তরঞ্জন।       গুরুদেব, আপনি যদি সভাপতি হন, তবে তার পরে আর কারও বক্তৃতা দেয়া দরকার হয় না। আপনি একা বললেই যথেষ্ট।

রবীন্দ্রনাথ।      তা-ই হবে। এবার তবে সভা ডাকো।

চিত্তরঞ্জন।       গুরুদেব, আপনি একা যখন বক্তৃতা দেবেন, আপনিই সভাপতি, তখন সব চেয়ে ভালো হয় শুধু আপনার নামে সভা ডাকা।

রবীন্দ্রনাথ চিত্তরঞ্জনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকবেন।

মঞ্চ পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে। অন্ধকারে নেপথ্যে গান শোনা যাবে। গান চলার সময় মঞ্চ অন্ধকারই থাকবে। সরোদ ও কণ্ঠস্বরের যুগলবন্দি হলে ভালো হয়।

গান :

যদি তোর  ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।

একলা চলো,  একলা চলো,  একলা চলো,  একলা চলো রে॥

যদি   কেউ কথা না কয়,  ওরে ওরে ও অভাগা,

যদি   সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে  সবাই করে ভয়-

          তবে পরান খুলে

ও তুই   মুখ ফুটে তোর মনের কথা   একলা বলো রে॥

অন্ধকার একটু ফিকে হয়ে আসবে। আধো-অন্ধকারে রবীন্দ্রনাথকে দেখা যাবে।

রবীন্দ্রনাথ।      কেউ প্রতিবাদ করবে না?

            কেউ না?

            কেউ না?

            এ কেমন করে হতে পারে?

            ভয়?

            সবার মনেই ভয়?

            অথচ মানুষ তার

            সব কীর্তি স্থাপন করেছে

            ভয় জয় করে।

            জয় করেছে সমুদ্রের ভয়-

            নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করেছে।

            জয় করেছে পাহাড়ের ভয়-

            তার চুড়োয় উঠেছে।

            জয় করেছে মরুর ভয়-

            ফুলে ফলে পল্লবে

            তাকে ভরিয়ে দিয়েছে।

            অন্ধকারকে ভয় পায়নি-

            চকমকি ঠুকে আগুন জ্বেলেছে।

            এখন মানুষ কুঁকড়ে যাবে

            শুধু

            মানুষেরই ভয়ে?

            শক্তিকে, বীভৎসতাকে

            ভয় করতে পারে না মানুষ-

            ভক্তি তো নয়ই।

            উপেক্ষাই শুধু

            করা যায় তাকে।

নেপথ্যে গান শোনা যাবে।

গান :

            ভয় হতে তব অভয় মাঝে  নূতন জনম দাও হে॥

            দীনতা হতে অক্ষয় ধনে,  সংশয় হতে সত্যসদনে,

            জড়তা হতে নবীন জীবনে  নূতন জনম দাও হে॥

রবীন্দ্রনাথ।      আমি কবি-

            আর কেউ করুক, বা না করুক,

            আমাকে প্রতিবাদ করতেই হবে।

            888sport live chatের সমস্ত কাজ প্রতিবাদ,

            888sport app download apkর প্রতিটি পঙ্ক্তি প্রতিবাদ,

            সমস্ত ভাস্কর্য প্রতিবাদ,

            সমস্ত স্থাপত্য প্রতিবাদ,

            সমস্ত সংগীত প্রতিবাদ।

            পৃথিবীটা যদি স্বর্গ হতো,

            888sport live chatের প্রয়োজন হতো না কোনও-ই।

            প্রতিবাদ করতেই পারি যদি

            888sport app download apkয়, সংগীতে, ছবিতে,

            রঙে-রঙে, রেখায়-রেখায়,

            মিলে-মিলে, সুরের দোলায়,

            পারবো না কেন করতে তা

            জীবনের কাজে?

            কবিকেই মানুষের

            সব চাইতে বেশি দরকার।

            প্রতিবাদ করতেই হবে

            আমাকে।

            কিন্তু, কিভাবে?

ভোর হতে শুরু করেছে। পুবের জানালায় আলো ফুটে উঠছে। জানালার পাশে টেবিল। রবীন্দ্রনাথ হঠাৎ ছুটে গিয়ে টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে পড়বেন। টেবিল-বাতিটি জ্বেলে দেবেন। তারপর লিখতে শুরু করবেন। খুব দ্রুত লিখছেন।

একটু পর প্রশান্তচন্দ্র এসে নিঃশব্দে ঘরে ঢুকবেন।

রবীন্দ্রনাথ।      কে? প্রশান্ত? আর একটু বাকি। এক্ষুণি হয়ে যাবে।

প্রশান্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবেন।

রবীন্দ্রনাথ।      আচ্ছা, এক কাজ করো। অ্যান্ড্রুজ-কে ডেকে নিয়ে এসো।

প্রশান্তচন্দ্র বেরিয়ে যাবেন। একটু পরে অ্যান্ড্রুজ-কে নিয়ে ফিরে আসবেন। ততোক্ষণে রবীন্দ্রনাথের লেখা শেষ। ঘরে ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে।

রবীন্দ্রনাথ।      কি, অ্যান্ড্রুজ-কে কি ঘুম থেকে তুলে নিয়ে এলে নাকি?

অ্যান্ড্রুজ।      না, গুরুদেব, আমি জেগেই ছিলাম।

প্রশান্তচন্দ্র।      কাল সন্ধ্যায় আপনি যখন চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়ি থেকে ফিরে এলেন, তখন আপনার অবস্থা দেখে আমরা কেউ সারা রাত ঘুমুতে পারিনি।

রবীন্দ্রনাথ।      তোমাদের এমনি জাগিয়ে রাখা তো ভারি অন্যায় হয়ে গেছে। যাক গে। আমিও সারা রাত ঘুমুতে পারিনি। বাস্, এখন চুকলো। আমার যা করবার, তা হয়ে গিয়েছে।

প্রশান্তচন্দ্র।      কী হয়ে গিয়েছে, গুরুদেব?

রবীন্দ্রনাথ।      এই দ্যাখো।

অ্যান্ড্রুজ।      আপনার নতুন 888sport app download apk?

রবীন্দ্রনাথ।      না, চিঠি।

প্রশান্তচন্দ্র।      চিঠি?

রবীন্দ্রনাথ।      অ্যান্ড্রুজ, তুমি প্রশান্তকে পড়ে শোনাও।

রবীন্দ্রনাথ অ্যান্ড্রুজ-কে টেবিল থেকে একটা কাগজ দেবেন। তারপর তা ফিরিয়ে নেবেন।

রবীন্দ্রনাথ।      আচ্ছা, ঠিক আছে, আমিই পড়ে শোনাচ্ছি। বড়োলাটকে লিখলাম।

            ৫, দ্বারকানাথ ঠাকুর লেন,

            কলকাতা, ৩১শে মে, ১৯১৯

            মান্যবর,

            পাঞ্জাবে কিছু-কিছু স্থানীয় অস্থিরতা প্রশমিত করার জন্য পাঞ্জাব সরকার যে-ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, তার প্রচণ্ডতা আমাদের দারুণ আঘাত দিয়েছে এবং ভারতে ব্রিটিশ প্রজা হিসেবে আমরা যে কত অসহায় অবস্থায় আছি, সেই বোধ আমাদের মনে জাগিয়ে তুলেছে। আমাদের মনে কোনও-ই সন্দেহ নেই যে, সাম্প্রতিক ও দূর অতীতের কিছু-কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, অসহায় ও হতভাগ্য মানুষের ওপর যে-শাস্তি আরোপ করা হয়েছে, তার অপরিমিত নির্মমতা এবং যে-ভাবে তা প্রদান করা হয়েছে, তা সভ্য সরকার-ব্যবস্থার ইতিহাসে নজিরবিহীন। যেহেতু এই শাস্তি এমন জন-মানুষকে প্রদান করা হয়েছে যারা নিরস্ত্র ও নিঃসহায় এবং যেহেতু এমন এক শক্তি এই শাস্তি প্রদান করেছে, মানুষের জীবন ধ্বংস করার কাজে যে-শক্তি সাংঘাতিক দক্ষ ও সুসংগঠিত, সেহেতু আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে বাধ্য যে, এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ কোনও রাজনৈতিক প্রয়োজনীয়তার কারণে বা অজুহাতে সিদ্ধ হতে পারে না, কোনও নৈতিক যৌক্তিকতার কারণে তো নয়ই। পাঞ্জাবে আমাদের ভ্রাতৃবৃন্দকে যে-অপমান ও নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে, কণ্ঠরোধ করার মধ্য দিয়ে তা চাপা দেয়ার চেষ্টা করা সত্ত্বেও তার বিবরণ ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছেছে, সর্বত্র মানুষের মনে ধিক্কার ও ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, অথচ আমাদের শাসনকর্তারা তা সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছেন – তাঁরা যা সমুচিত শিক্ষা বলে মনে করেন, তা দিতে পেরেছেন বলে সম্ভবত নিজেদের অভিনন্দিত করতে ব্যস্ত রয়েছেন। অধিকাংশ ইঙ্গ-ভারতীয় পত্রিকায় এই অসংবেদনশীলতা ও উদাসীনতা প্রশংসিত হয়েছে। কোনও-কোনও পত্রিকা এতোটুকু নিষ্ঠুর পর্যন্ত হয়েছে যে, সেগুলোতে আমাদের দুঃখ-কষ্ট ও দুর্ভোগ নিয়ে পরিহাস ও বিদ্রƒপ করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তারা বিন্দুমাত্র বাধাপ্রাপ্ত হয়নি। যে-সব সংস্থা নিপীড়িত ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব করে, সুবিচার দাবি করে, নিপীড়িতের যন্ত্রণার কথা বলে, তাদের নিষ্পিষ্ট করতে ওই কর্তৃপক্ষ সবসময়ই দারুণ তৎপর। আমি জানি, আমাদের সব আবেদন ব্যর্থ হয়েছে। আমি জানি, প্রতিহিংসার মূঢ় শক্তি আমাদের সরকারের রাষ্ট্র-প্রাজ্ঞ মহৎ দৃষ্টিকে অন্ধ করে দিয়েছে। সরকার তো কত সহজেই উদার হতে পারতো এবং যদি তা হতো, তাহলে তা তার নীতিবোধের ঐতিহ্যের সঙ্গে এবং তার শক্তিমত্তার সঙ্গে তা সঙ্গতিপূর্ণ হতো। এ পরিস্থিতিতে, আমার দেশের জন্য আমি ন্যূনতম যা করতে পারি, তা হলো, আমার দেশের এই যে কোটি-কোটি মানুষ ভয়ে মুখ খুলতে পারছে না, তাদের প্রতিবাদকে আমার নিজের কণ্ঠে তুলে নেয়া এবং এ কাজের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন হয়েই তা করা। এ এমন এক সময় যখন চারদিকে কেবল অবমাননাই দেখতে পাই। আমাদের ব্যক্তিগত সম্মানের প্রতীকগুলো এ অবস্থার সঙ্গে কোনওভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়- আমাদের জন্য এগুলো এখন দারুণ লজ্জার বিষয়। আমার দেশের যে-সব মানুষের কোনওই মূল্য নেই বলে মনে করা হয়, যে-সব মানুষ এমন অসম্মানের মধ্য দিয়ে জীবন কাটায়, যা মানুষ নামের কারও প্রাপ্য হতে পারে না, আমার ব্যক্তিগত সব কৃতিত্বের চিহ্ন পরিত্যাগ করে আমি আজ তাদের পাশে এসে দাঁড়াতে চাই। এ কারণে, পরিতাপের সঙ্গে ও আপনার প্রতি যথোচিত সম্মান প্রদর্শন করে, মান্যবর, আমি বেদনার্ত চিত্তে আমাকে আমার নাইট্হুড থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে আপনাকে অনুরোধ করছি। এ উপাধি আমি আপনার পূর্বসূরির হাত দিয়ে মহামান্য রাজার কাছ থেকে গ্রহণ করেছিলাম, আপনার সে-পূর্বসূরির মহানুভবতার প্রতি আমি এখনও গভীরভাবে 888sport apk download apk latest versionশীল। তবু নাইট্হুড থেকে আমাকে অব্যাহতি দিতে আপনাকে অনুরোধ করতে আমি বাধ্য হচ্ছি।

            আপনার বিশ্বস্ত,

            রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

প্রশান্তচন্দ্র।      গুরুদেব, আপনি ‘স্যার’ উপাধি ছেড়ে দিচ্ছেন?

রবীন্দ্রনাথ।      দিচ্ছি নয়, দিয়েছি। ওই ছার উপাধিটা থেকে মুক্তি পেয়ে বড়োই হাল্কা লাগছে।

নেপথ্যে গান।

গান :    আমার মুক্তি সর্বজনের মনের মাঝে,

            দুঃখবিপদ-তুচ্ছ-করা কঠিন কাজে।

            আমার মুক্তি আলোয় আলোয় …

প্রশান্তচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে প্রণাম করবেন।

প্রশান্তচন্দ্র।      গুরুদেব, আপনি খুব একটা মহৎ কাজ করলেন। আপনার জন্ম-শতবার্ষিকীর সময় মানুষ এ ঘটনা বিশেষ করে মনে করবে।

রবীন্দ্রনাথ।      শত বার সিকি? সে তো কেবল পঁচিশ টাকা। ওর মোহ আমার নেই।

অ্যান্ড্রুজ।      গুরুদেব।

রবীন্দ্রনাথ।      বলো।

অ্যান্ড্রুজ।      না, মানে …

রবীন্দ্রনাথ।      তোমার মনে যখন একটা কিছু খচ্-খচ্ করছে, তখন তা বলে ফেলাই ভালো। হৃদয় বড়ো চঞ্চল জিনিস। কথাটি কখন যে হারিয়ে যাবে, তুমি টেরও পাবে না।

অ্যান্ড্রুজ।      আপনি নাইট্হুড ছেড়ে দিতে চান, দেবেন। কিন্তু …

রবীন্দ্রনাথ।      কিন্তু? বলো। বলে ফেলো।

অ্যান্ড্রুজ।      চিঠিটা, গুরুদেব, একটু নরম করে দিলে হতো না?

রবীন্দ্রনাথ কিছু বলবেন না – কেবল অ্যান্ড্রুজ-এর দিকে কড়া চোখে তাকাবেন। অ্যান্ড্রুজ ভয় পেয়ে একটু পিছিয়ে আসবেন। তারপর মঞ্চের সামনের দিকে এসে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলবেন :

অ্যান্ড্রুজ।      গুরুদেবের চোখে অমন ক্রোধের দৃষ্টি আমি এর আগে বা পরে আর কখনও দেখিনি। দু পাশের বড়ো পর্দায় রবীন্দ্রনাথের ক্রোধের দৃষ্টি ক্লোজ-আপ-এ দেখা যাবে। সারা প্রেক্ষাগ্রহে প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে, ‘কখনও দেখিনি’, ‘কখনও দেখিনি’, ‘কখনও দেখিনি’।