বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে গত ৫ই জুন 888sport appর পান্থপথে দৃক গ্যালারির নবনির্মিত প্রদর্শশালায় মেধাবী ও সংবেদনশীল আলোকচিত্রী হাবিবুল হকের `Trunk Call’ শিরোনামে দশ দিনব্যাপী একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন হয়। প্রদর্শনীটির মূল উপজীব্য ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ : তার শোভা ও সৌন্দর্য, মূল্য ও তাৎপর্য, সংকট ও সম্ভাবনা, বিনাশ ও বিপর্যয়ের মতো অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আলোকচিত্রী হাবিবুল হক তাঁর হৃদয়ের খুব কাছের এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিন্তাভাবনা করে আসছেন এবং সারাদেশ ঘুরে মূল্যবান রসদ সংগ্রহ করেছেন তাঁর সূক্ষ্মদর্শী, সৃজনশীল ক্যামেরায়। বস্তুত বিগত বিশ বছর ধরে তোলা তাঁর সেই অগুনতি ছবির সাঁজি থেকে মোট তেত্রিশটি ছোট-বড় আলোকচিত্রের সমাহারে তিনি এই অত্যন্ত মহৎ ও মহার্ঘ প্রদর্শনীটির পসরা সাজিয়েছিলেন।
প্রদর্শনীর জন্য হাবিব বেছে নিয়েছেন এমন একটি মৌলিক ও বুদ্ধিদীপ্ত নাম, যে-তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারা যায় না। কেননা এই ‘ট্রাঙ্ক কল’ শব্দবন্ধটির সঙ্গে আমাদের অতীত, ঐতিহ্য, নস্টালজিয়া ও 888sport sign up bonusকাতরতার সুগভীর সংযোগ; যে লুপ্ত প্রযুক্তিটির ওপর ভর করে একদা দূরদূরান্ত থেকে ভেসে আসত কত না সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা আর স্বপ্ন-সম্ভাবনার খবর আমাদের দৈনন্দিন জীবনের চৌহদ্দিতে, তেমনি আবার এই একই শব্দের ভিন্নতর ব্যঞ্জনায় ধ্বনিত হয় আমাদের চতুষ্পার্শ্বের ক্রমবিলীয়মান নিসর্গের বুক চিরে উঠে আসা বৃক্ষদের কর্তিত কাণ্ডের বুকফাটা আর্তনাদ, তাদের বাঁচবার তীব্র আকুতি। হাবিব মূলত আমাদের গ্রাম-নগরের চিরচেনা পরিপার্শ্ব থেকে দ্রুত হারিয়ে যেতে থাকা এই গাছ, গুল্ম আর সবুজে ছাওয়া সুনন্দ প্রকৃতির হাসি-কান্না আর আনন্দ-বেদনার কাব্যকেই ধরতে চেয়েছেন তাঁর ক্যামেরার বাক্সময় ও বহুমাত্রিক আলোছায়ায়।
হাবিবের ছবিতে একদিকে যেমন উঠে এসেছে রাজধানীর রমনা, চন্দ্রিমা, ওসমানী ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, বোটানিক্যাল গার্ডেন, বুয়েট, কার্জন হল, বলধা গার্ডেন, ধানমন্ডি লেক, চারুকলা অনুষদ ইত্যাদির সৌন্দর্য ও সর্বনাশের গল্প, তেমনি দূর ও দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রাম, গঙ্গামতীর চরাঞ্চল, কুয়াকাটা ও পতেঙ্গার সমুদ্রসৈকত, সিলেটের রেমা-কালেঙ্গা অভয়ারণ্য এবং জলবায়ু পরিবর্তনের নির্মম শিকার উপকূলীয় নিম্নভূমির নিসর্গ ও মানুষের লড়াই-সংগ্রামের মহাকাব্যিক আখ্যানও বাদ যায়নি তাঁর দৃষ্টিসীমা থেকে। পরিবেশ বিপর্যয় আর যথেচ্ছ 888sport live chatায়নের আগ্রাসনে সম্ভাব্য বিলুপ্তির ভয়ে ভীত এই বৃক্ষরাজি সবাই মিলে আমাদের একটি বার্তাই বুঝি দিতে চেয়েছে : মানুষ ও পৃথিবীর আর সব প্রাণীরই মতো আমাদেরও রয়েছে প্রাণ, আবেগ ও অনুভূতি; আমরা যেমন এই জগতের শোভা বর্ধন করি, তেমনি তাকে জোগাই বাঁচার অনিবার্য রসদ, বুক দিয়ে আগলে রাখি তাকে যাবতীয় প্রাকৃতিক বিপদ ও বিপর্যয় থেকে; আমাদেরও রয়েছে আর সবারই মতো নিজস্ব সুরে ও ছন্দে, নিজের মতো করে বাঁচার সমান অধিকার।
লক্ষণীয়, গভীর সংকটাপন্ন আমাদের প্রকৃতিমাতার এই ব্যাকুল বার্তাটির বাহক হিসেবে হাবিব তাঁর প্রদর্শনীর শুরুতেই এবং এ উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকার প্রচ্ছদপটেও, বৃক্ষপুরাণ নামে যে-ছবিটি ব্যবহার করেন সেটি আর কারো নয়, আশু বিপদ ও বিপর্যয়ের মুখোমুখি চাটগাঁর ফুসফুস বলে খ্যাত ঐতিহ্যবাহী সিআরবি অঞ্চলের একটি শতবর্ষী বৃক্ষের সুবিশাল কাণ্ডের। হাবিবের সংবেদনশীল ক্যামেরার চোখে তাকে দেখায় ঠিক যেন এক মানবের মুখচ্ছবির মতো, যে আমাদের আকুল আহ্বান জানায় নির্বিচার নগরায়ণ ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের আত্মঘাতী খড়্গাঘাত থেকে তার প্রাণরক্ষার জন্য।
এরকমই আরেকটি প্রতীকী ছবি চট্টগ্রামের একদা দৃষ্টিনন্দন টাইগার পাস অঞ্চলের। অনেকেরই জানা, এই সবুজে ছাওয়া অপরূপ রাস্তাটির দুপাশে দুটো বাঘের ভাস্কর্য রয়েছে, বুঝিবা এর নামকরণের সার্থকতা প্রমাণের জন্যই। আলোকচিত্রী হাবিব সেখানকার একটি কংক্রিটের বাঘকে এমন এক অ্যাঙ্গেল থেকে তাঁর ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি করেন যে, মনে হয় বুঝি এই বাঘটি চারপাশের সবুজকে গিলে খেতে উদ্যত হয়েছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাস্তবেও কিন্তু ঘটছে ঠিক তা-ই; এই অনিন্দ্যসুন্দর অরণ্যপথের বুক চিরে বর্তমানে একটি সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়, অতিকায় ও অসুন্দর ফ্লাইওভার নির্মিত হচ্ছে, সেটি যে ঠিক সেই উদ্যত ব্যাঘ্রের মতোই এই অঞ্চলের সবটুকু শোভা ও সৌন্দর্যের সর্বনাশ ঘটাবে অচিরেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আলোকচিত্রটির শিরোনাম ‘কংক্রিট বনাম প্রকৃতি’ সেই বাস্তবতায় খুবই মোক্ষম ও লাগসই হয়েছে, বলাই বাহুল্য। প্রদর্শনীতে ‘বধ্যভূমিতে ভোরের প্রার্থনা’ শীর্ষক একটি ছবি রয়েছে। এটি তোলা হয়েছে কুয়াকাটার ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল পরিবৃত সমুদ্রসৈকতে। ছবিটির একদিকে দেখা যায় ভোরের সৈকতে অসংখ্য ডালভাঙা, বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত গাছের করুণ উপস্থিতি; অন্যপ্রান্তে সকালের স্নিগ্ধ ও সুন্দর অরুণোদয়ের দৃশ্য। এই দুই দৃশ্যের আপাত বৈপরীত্যের মধ্যে 888sport live chatী যে-বার্তাটি আমাদের দিতে চান সেটি সম্ভবত এই যে, নিজের বুকে আগলে, এমনকি প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যে-প্রকৃতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের কবল থেকে আমাদের নিয়ত রক্ষা করে চলেছে, আমরাও যেন সর্বদা তার সুরক্ষায় তৎপর হই, তাকে এনে দিতে পারি তার প্রার্থিত ভোরের আলোর উত্তাপ ও উদ্ভাসন। সত্যি বলতে কী, গোটা প্রদর্শনীর মূলমন্ত্রটিই যেন মূর্ত হয়েছে এই একটি মাত্র ছবির মহাকাব্যিক পরিসরে।
প্রদর্শনীতে আরো কিছু আলোকচিত্র ঠাঁই পেয়েছে, যেগুলিতে 888sport live chatীর পরিবেশ-চেতনার পাশাপাশি উঠে এসেছে প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্য ও স্নিগ্ধতার রূপ, তার অদম্য প্রাণশক্তি আর ভালোবাসার নিজস্ব ভাষা ও ভঙ্গিটুকু। রোদ-বৃষ্টি-হাওয়ার আদরে ও আঘাতে গাছের কাণ্ড থেকে ছাল-বাকল উঠে গিয়ে যে স্বতঃস্ফূর্ত চিত্রকল্প ও রূপবিভঙ্গের জন্ম হয় তারও বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন নমুনা উপস্থাপিত হয়েছে এই প্রদর্শনীতে, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পেচক, প্রেমপত্র, জলছবি, চাহনি, অদম্য প্রাণ, আশ্রয়, অন্তরঙ্গ ও প্রহেলিকা সিরিজের কয়েকটি ছবি। এসবের বাইরে আরেকটি ছবির কথা না বললেই নয়। এর শিরোনাম ‘মুক্তির ডাক’। এটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে তোলা একটি পত্রপল্লববিহীন, বিক্ষত বৃক্ষের সিলুয়েটের ছবি, যাকে দেখতে লাগে ঠিক সেই ঐতিহাসিক উদ্যত-হস্ত, আঙুল-উঁচানো দীর্ঘকায় মানুষটিরই মতো, যাঁর বজ্রকণ্ঠ থেকে একদা এই উদ্যানেই ধ্বনিত হয়েছিল আমাদের মুক্তির ডাক ও স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান। আর তার অর্ধশতক বাদে আলোকচিত্রী হাবিব তাঁর তোলা এই আশ্চর্যরকম সদৃশ ছবিটির মাধ্যমে যেন ডাক পাঠালেন আরেকবার, আরো এক বৃহত্তর, গভীরতর মুক্তির ডাক : জগতের সকল প্রাণ, প্রকৃতি ও প্রতিবেশের, এক কথায় সমগ্র পৃথিবীর মুক্তির আহ্বান। তাঁর এই 888sport live chatিত আহ্বানটুকু দ্রুত ছড়িয়ে যাক দিক হতে দিগন্তে, ধ্বনিত হোক বিশ্বের প্রতিটি সচেতন, সংবেদনশীল ও বিবেকবান মানুষের বোধের অলিন্দে, এই প্রত্যাশা আমাদের।
সতত পরিশ্রমী, চিন্তাশীল ও দায়বদ্ধ আলোকচিত্রী হাবিবুল হককে আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন, একইসঙ্গে এমন আকর্ষণীয় ও অভিঘাতসম্পন্ন একটি আলোকচিত্র প্রদর্শনী আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.