সালেহা চৌধুরী
লিলিকে অয়ন প্রথম দেখেছিল ভিনসেন্ট বুলাভার্ডে। একটি ফুলের দোকানে ফুল কিনছিল লিলি। অয়ন তখন পড়াশোনা করত প্যারিসে। অয়নের পরীক্ষা হয়ে গেছে। দুদিন পরে সে দেশে ফিরে যাবে। ঠিক তখনই। চমৎকার ফরাসি মেয়ে। ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি বলে। একরাশ লম্বা চুল। আর একটি কিউট মুখ এবং অড্রে হেপবার্নের মতো হাসি। সেই হাসি থেকেই কাছাকাছি আসা। অয়ন আর লিলি। অয়নের পুরো নাম ফরিদ হোসেন অয়ন।
কোথায় থাকো তুমি। ও দেখিয়ে দিয়েছিল সেই বাড়িটা, যেখানে ও থাকে। বলেছিল – এসো এককাপ চা খাবে। আমন্ত্রণ এত আকস্মিক, অয়ন অবাক হয়েছিল। এমন করে পশ্চিমে কেউ কাউকে ডাকে না।
ছোট একটি ফ্ল্যাট। ‘আল কার্টা’ নামের দশতলা দালানের শেষ মাথায়। একটি কেকের দোকানে কাজ করে লিলি। মায়ের সঙ্গে কী কারণে মন-কষাকষি বলে ও তখন নিজের মতো থাকছে। মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। মা ফরাসি। বাবা ভারতীয়। লিলি এক ব্রোকেন ফ্যামেলির মেয়ে। মিশেল চেহারার লিলি অপরূপ। জলপাইয়ের মতো গায়ের রং এবং ঘন বড়-বড় পল্লবে কালো চোখ। চুলও কালো। সব মিলিয়ে লিলি ক্ল্যাসিক। চা পান আর দোকানের পেস্ট্রি খেতে-খেতে নানা গল্প। অয়ন বলেছিল – লিলি তোমার হাসি থেকেই তোমাকে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে; কিন্তু তুমি যে আমাকে বাড়িতে ডাকলে তার কারণ কী?
তুমি কি কখনো আয়নায় দেখেছ তোমার হাসিটাও কত মিষ্টি। আর থুতনির টোল! কিউট। এই বলে লিলি মুখ নিচু করে হাসছিল। অয়ন তাকিয়ে দেখছিল ওকে। যেন কোনো এক ওল্ড মাস্টার্সের ক্ল্যাসিক ছবি ও। চোখ ফেরাতে পারছিল না। লিলির সরল চোখে এক ধরনের প্রশংসা।
তোমার চোখ দিয়ে আমি তো কখনো আমাকে দেখিনি। কেউ বলেওনি এমন কথা। বলেছিল অয়ন। দশতলার ছোট ফ্ল্যাট থেকে পুরো প্যারিস শহর চোখে পড়েছিল। ছড়ানো প্যারিস ডানা মেলে ছড়িয়ে আছে অনেকটা জায়গা নিয়ে। ব্যালকনিতে ছোটখাটো দু-একটা ফুলের গাছ। বলেছিল – ফুলের বাগানের আমার বড় শখ; কিন্তু বলো তো, এই দশতলার ফ্ল্যাটে কী করে বাগান করি। তাই দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। আমি সময় পেলেই বাগানে ঘুরতে যাই। জানো তো, এখানে কতসব বড়-বড় বাগান আছে।
একটা বড় বাড়ির মালিককে বিয়ে করে ফেলো। তাহলে একটা বড় বাগান করতে পারবে সেখানে।
কে আমাকে বিয়ে করবে। তা ছাড়া এমন কোনো বড়লোকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বড় শান্তভাবে উত্তর দিয়েছিল লিলি।
অয়নের তখন বলতে ইচ্ছা করছিল – আমার বড় বাড়ি নেই; কিন্তু একটু অপেক্ষা করলে আমি একটা বড় বাড়ি ভাড়া নিতে পারব। তবে ইতোমধ্যে আমাকে একবার দেশে যেতে হবে। তুমি কি ততদিন অপেক্ষা করবে?
লিলিকে বলেছিল কেবল – আমি দেশ থেকে ফিরে এসে তোমার খোঁজ করব।
ঠিক আছে। তখন আবার কথা হবে। কবে যাবে তুমি দেশে?
পরশু দিন।
এই শেষ সময়ে তোমার সঙ্গে আমার দেখা হলো? পরিচয় হলো। লিলি মুখটা একটু বিষণ্ণ করেছিল।
লিলি একসময় প্যারিসে ঘুরতে-ঘুরতে একটা ভিনসেন্ট বস্নু টাই উপহার দিয়েছিল অয়নকে। প্যারিসে ঘোরার ঘটনা সেও তো এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। অয়ন লিলির পছন্দের জায়গা দেখতে-দেখতে প্যারিসের প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। বোধকরি লিলিও। এসব জায়গা হয়তো আগেও দেখেছিল কিন্তু লিলির সঙ্গে নয়। যখন পরদিন অয়ন দেশে যাবে ঘটনা ঘটেছিল তার আগের দিন। বলেছিল লিলি – এই টাইটা খুব পছন্দ হয়েছে। তুমি পরবে স্যুটের সঙ্গে। বলেছিল ও – ভিনসেন্ট ভ্যান গঘের সব কিছুই আমার ভালো লাগে। ইস! কত অল্প বয়সে মারা গেল ও বলো তো। ওর ছবি দেখতে-দেখতে আমার চোখে পানি চলে আসে। ভালোবাসার কাঙাল ছিল; কিন্তু সারাজীবন সত্যিকারের ভালোবাসা পায়নি। এই বলে লিলি স্টার স্টারি নাইটের কয়েক লাইন গান গেয়ে শুনিয়েছিল। হাউ ইউ ট্রাই টু সে টু মি/ সাফারড ফর ইয়ের স্যানিটি। ইস! কেবল আমি পাগল নই এটা প্রমাণ করার জন্য যুদ্ধ। কেবল স্যানিটি বজায় রাখতে ওকে কতসব অপরূপ ছবি আঁকতে হয়েছিল। কতসব ছবি! এখন ভিনসেন্ট বেঁচে থাকলে আমি ওকে অনেক ভালোবাসতাম। অনেক। বলতে-বলতে লিলি আরেক জগতে চলে গিয়েছিল। অয়ন হাত ধরে বলেছিল – ভিনসেন্ট নেই তো কী হয়েছে। আর কেউ হয়তো ভালোবাসার জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। কখন একফোঁটা ভালোবাসা বৃষ্টি হয়ে নামে। নির্মল পিপাসার জল। কিংবা সকালের শিশির। লিলি হেসেছিল। এ-কথার কোনো উত্তর না দিয়ে। একটু কাছে সরে এসেছিল কেবল।
প্রথম দিন লিলি আট ফুট বাই দশ ফুট রান্নাঘরের চুলোতে কী সব রান্না করে খাইয়েছিল। কুচি-কুচি মাশরুম-ভরা ফ্রেঞ্চ অমলেট। বেশ হয়েছিল খেতে। বলেছিল – আমি প্রায়ই বাইরে খাই। আজ তোমার জন্য আমি রান্না করলাম। কাল আমি ছুটি নেব। তুমি আর আমি ঘুরব। বিষাদ গ্রাস করতে চেয়েছিল অয়নকে। কারণ পরদিনই ওর চলে আসার কথা। 888sport sign up bonus! এক বোতল 888sport sign up bonus নিয়ে দেশে চলে যাও অয়ন। দুজনে মুখোমুখি একটা ছোট ডাইনিং টেবিলে বসেছিল। তাকিয়েছিল মুখের দিকে অনেকবার। এক বোতল স্পার্কলিং ওয়াইন আর দুই পেস্নট ফ্রেঞ্চ অমলেট। কী অপরূপ সে সময়! তারপর আসার আগে চা আর পেস্ট্রি। কিন্তু লিলি বলেছিল – ওয়াইন নয়, আমি স্প্রিং ওয়াটার পান করছি। তুমি, পছন্দ হলে, একটু ওয়াইন নাও। আজকের 888sport sign up bonus বেশ। আমার খুব ভালো লাগছে।
বলতে চেয়েছিল অয়ন কেবল 888sport sign up bonus নয়, তোমাকেই নিয়ে যেতে চাই। বলা হয়নি। একদিনের পরিচয়ে কাউকে এমন কথা বলা যায়? না, যায় না।
ও বলেছিল, আমরা নৌকায় সেন নদীতে ঘুরব। প্যারিস দেখব নৌকা থেকে। বরং তার আগে কিছু ভালো জায়গা দেখে নিয়ে আমরা নৌকায় উঠব। আমার সঙ্গে চলো। প্যারিস শহরের সব আমার জানা। অলিগলি তস্য গলি। বড় রাস্তা অ্যাভিনিউ, ল্যান্ডমার্ক, বাগান, সব।
কোন এক পার্ক এখন নাম মনে নেই। সেটা ছিল একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন। যেখানে গাছের নিচে বসে চা আর কুকিজ খাওয়া। গাছেদের মতো এত সুন্দর আর কিছু নেই মনে হয়েছিল তখন। দিনটি ছিল প্রসন্ন। তেমন শীতও নয় আবার তেমন গরমও নয়। ওর গায়ে মিষ্টি বেগুনি রঙের একটা কার্ডিগান ছিল প্রথমে। এরপর সেটা খুলে কোমরে বেঁধে নিয়েছিল লিলি। চুলগুলো একটা ব্যান্ডে কপালে আসতে না দেওয়ার শাসনে অবারিত হাওয়ায় বারবার উড়ে-উড়ে ঘুরে-ঘুরে ওর মুখের চারপাশে খেলা করছিল। এবং একসময় হাত দিয়ে সেগুলো পেছনে ঠেলে আর একটি ব্যান্ড বেঁধে নিয়েছিল লিলি। কিউট মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছিল তখন। এবং হাসি।
আইফেল টাওয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিল ও – ফিরে এসে রাতের আইফেল টাওয়ার দেখে তারপর নিজ ডেরায় ফিরে যাবে। আইফেল টাওয়ার বাই নাইট একটি অসাধারণ দৃশ্য।
আমি দেখব। দরকার হলে সারারাত ঘুরে-ঘুরে তুমি যেখানে নিয়ে যাবে সেখানে যাব। বলেছিল ও – ল্যুভে কেবল মনের বাগান আর ভিনসেন্টের ছবি দেখব কেমন?
ও জানত কোন মেট্রো কোথায় খুব তাড়াতাড়ি ওদের নিয়ে যায়। মনের বাগানে চোখ ছলছল হয়েছিল লিলির। আর ভিনসেন্টের ছবির তলায় হাঁটু মুড়ে বসেছিল ও। সৌন্দর্যের পাদদেশে সব ভুলে মানুষ যখন হাঁটু মুড়ে বসে। অয়নের কাছে কোনো ক্যামেরা ছিল না। মোবাইল বা সেলফির যুগ নয় তখন। হাত ধরে তুলেছিল ওকে। বলেছিল – এখানে সারাদিন বসে থাকবে লিলি!
চলো।
‘আর্ক দি ট্রায়াম্পে’র কাছে আইসক্রিম খেয়েছিল ওরা দুজন। টুটি ফ্রুটি।
বেশ খাওয়া হলো আজ। বলেছিল লিলি।
তা হলো। তুমি সঙ্গে তাই।
‘অপেরা গারনিয়ের’ ছাদে দেখেছিল অয়ন মার্ক সাগালের ছবি। আগে এখানে এলেও মার্ক সাগালের ছবি দেখা হয়নি তেমন করে। অয়ন বুঝতে পেরেছিল লিলি 888sport live chat ভালোবাসে এবং 888sport live chatের জ্ঞান ওর ভয়ানক। একটা বড় ল্যান্ডস্কেপের সামনে এসে বলেছিল ও আমাকে – এখানে থাকে অসহায় মানুষ। এবং আহত সৈনিক।
পম্পিডু সেন্টারে ঝটিকা সফর। বলেছিল ও – এখানে এসে কেউ সারাদিন কাটাতে পারে। আমাদের সময় নেই। আমরা এক ঘণ্টা থাকব। প্যানথিওন নামের চার্চের বাড়িটাই বা কী আশ্চর্য সুন্দর! অয়ন তাকিয়ে থাকতে-থাকতে ওর ক্লান্ত চোখ লিলির মুখের ওপর মেলে দেয়। আকাশের দিকে তাকিয়ে অয়ন যখন একবিন্দু নির্মল পিপাসার জলের কথা ভাবছিল তখনো জানে না লিলি নামের সুপেয় পেরিয়ার ওয়াটারের সান্নিধ্যে একদিন সারাদিন ও কাটিয়ে দেবে। প্যারিসে এমন কেউ থাকে? যার দিকে কোনো কামনা-বাসনায় হাত বাড়ানোর কথা মনে হয় না। কেবল পাশাপাশি হাঁটতে-হাঁটতে ভালোবাসার মতো কোনো অনুভব। কে জানে একি লিলির ভারতীয় টাচ। টেনে বাঁধা চুলের নিচে মসৃণ কপালে রোদ পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে অয়নের মনে হয়েছিল – এ-দৃশ্য সবচেয়ে সুন্দর। কোনো এক বাসিলিকার চুড়ো দেখে মনে হয় কফির ওপরের সেই নরম সাদা ফেনা। আর লিলির দুচোখে ছিল কালো কফির আলো। – আসলে পৃথিবীর সব বড় সৃষ্টি ধর্মের কারণে। বড়-বড় মন্দির, মসজিদ, চার্চ, বাসিলিকা এই কারণেই সৃষ্টি হয়। লিলি বলেছিল অয়নকে – জানো অয়ন, মানুষ বড়ই দুর্বল তাই ঈশ্বরের জন্য বড়-বড় দালান, ছবি আর বাগান তৈরি করে। আবার টাকা-পয়সাও রাখা হয় ঈশ্বরের কথা ভেবে।
ঠিক তাই। বলেছিল অয়ন।
আসলে আমরা সত্যিই দুর্বল। জানো এবার নটর ডেমে গিয়ে আমি একটা বিশেষ প্রার্থনা করব। দেখি নটর ডেমের ঈশ্বর তা মঞ্জুর করেন কিনা।
চাইবে তো দেশে গিয়ে যেন এক অপরূপ সুন্দরীর সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়। মজা করে বলেছিল লিলি।
হলো না। বলেছিল অয়ন।
তাহলে একটা ভালো চাকরি।
তাও হলো না।
ঠিক আছে। অন্যকিছু।
চল আমরা নটর ডেমের পাশে কোনো এক রেসেত্মারাঁয় দুপুরের খাবার খেয়ে নৌকায় উঠে সেন নদীতে প্যারিস দেখব আবার। ঠিক আছে।
আসলে খাওয়া নয়। কাছাকাছি বসা। এবং সময় কাটানো। খাওয়াটা উপলক্ষ।
তুমি বলছ তারপরও ঠিক থাকবে না লিলি?
খেতে-খেতে প্রশ্ন করেছিল অয়ন – লিলি তুমি কি কখনো কাউকে ভালোবেসেছ?
অবশ্যই। সেসব শুনে কী হবে। এই বলে ও দুষ্টুমির হাসি হেসেছিল। আর একদিন বলব। বলে দূরে তাকিয়ে ছিল লিলি।
ইস!
ইস কেন? আরে মাছ খেতে টার্টলসস নেবে না, তাই কি হয়? ও অয়নের পাতে খানিকটা টার্টলসস তুলেদিয়েছিল। দূরের দৃষ্টি থেকে চলে এসেছিল কাছের মানুষের কাছে।
আর সেন নদীতে শুনিয়েছিল ছোটখাটো দু-একটি 888sport app download apk। ওর চোখ বাঁচিয়ে অয়ন একটা নিনা রিচি পারফিউম কিনেছিল। বলেছিল – তোমার তুলনা। তারপর নদীতে নেমে এসেছিল বিকেল থেকে সন্ধ্যা। নৌকায় ওঠার সময় ক্যামেরাম্যান ওদের ছবি তুলেছিল। বলেছিল – লাভলি কাপল। তবে সবচেয়ে ভালো লেগেছিল যে ফুলের বাগান সেখানে কোনো ছবি উঠল না বলে অয়নের মন খারাপ হয়েছিল একটু। কিন্তু সেন নদীতে ওঠার আগের সে-ছবিটা বেশ হয়েছিল। অয়ন আর লিলি সে-ছবির দুটো কপি নিয়েছিল যে যার সংগ্রহে রাখবে বলে। দুজনে পাশাপাশি বসে জানল, কোনো প্রিয় সান্নিধ্য পাশে থাকলে সবকিছুই কত অপরূপ হয়ে ওঠে। যখন ওরা কথা বলছিল ছোট-ছোট শব্দে এবং গভীর কোনো আনন্দবোধে। অয়ন বুঝতে পারেনি হঠাৎ খুঁজে-পাওয়া এই লিলি নামের মেয়ে এত তাড়াতাড়ি এত গভীর করে ওর মনের ভেতরে জায়গা করে নেবে। এটা এক ধরনের মিরাকল – বলেছিল ও।
একটা দিন ফুরোতে কতক্ষণ লাগে? অতবড় সূর্যটাও তো একদিন বস্ন্যাকহোল হয়ে সূর্যত্ব নাম মুছে ফেলবে। পৃথিবীটা একদিন কোথায় যে মিশে যাবে কে জানে। দিন শেষ হলো। রাতের আইফেল টাওয়ার দেখে বাড়ি ফিরতে-ফিরতে অয়ন বলেছিল – তোমার সঙ্গে কি আমার আর কোনোদিন দেখা হবে না?
ও নিজের ব্যাগ থেকে একটা একশ ফ্রাংকের নোটে ওর বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নম্বর লিখে দিয়েছিল। বলেছিল – অ্যানি টাইম অয়ন।
খুব ইচ্ছা করছিল আসার আগে অনেক সময় ধরে ওকে বুকের ভেতর রেখে দেয় অয়ন। যেতেই দেব না তোমাকে আজ রাতে। কিন্তু সে-ইচ্ছা পূরণ তখন সত্যিই মুশকিল। আগামীকাল অয়নকে দেশে ফিরতে হবে। একটু চুমু রেখেছিল অয়ন ওর ঠোঁটে। এর চেয়ে বেশি কিছু আজকের সুর কেটে দেয় এই ভেবে বেশি কিছু করতে ভয় হয়েছিল ওর। লিলি বলেছিল – এর পর এলে সোজা ভার্সাইয়ের প্যালেস। ওখানে সারাদিন। ও টিস্যুতে কাজল ঠিক করছিল না চোখের পানি মুছছিল বুঝতে পারেনি অয়ন। বলেছিল – যোগাযোগ রেখ অয়ন। আমি তোমাকে ভুলব না। কারণ? সব কারণ শুনতে নেই।
ওর হাত ধরে বলেছিল অয়ন – অবশ্যই যোগাযোগ রাখব। সেই একশ ফ্রাংকের নোটটা ওর পার্সে সযতনে রেখেছিল। বলেছিল ফরাসি ভাষায় – জে লা আডোরে। কোথায় যেন শুনেছিল ও এমন কোনো বাক্য। আর এক লাইন ফরাসিতে হেসে উঠেছিল লিলি। বলেছিল কেবল – মেস চেরি! মাই ডার্লিং। ঝু টে ডোর। এই ব্যাক্যের অর্থ জানত অয়ন। বুঝেছিল লিলি ওকে বলছে – আই লাভ ইউ। আমি তোমাকে ভালোবাসি।
তারপর একটা মেঘ যখন আকাশ থেকে নেমে দশতলা বাড়ির ছাদে, বলেছিল লিলি – এখন যাই।
সেই বিচ্ছেদের কষ্ট তখন অয়নের বুকে। অনেক দিন ব্যথার মতো লেগেছিল সেই অনুভব।
তার পর যখন পেস্ননে ওঠার আগে ওকে ফোন করতে চেয়েছিল বুঝতে পেরেছিল পার্সটা হারিয়ে গেছে। যেখানে সযতনে রাখা ছিল একটি একশ ফ্রাংকের নোট। ওখানে আর কোনো টাকা-পয়সা রাখেনি। পাছে ভুল করে খরচ হয়ে যায়। তার পরও শেষ রক্ষা হলো না। হিপ পকেট থেকে টুক করে কেউ তুলে নিয়েছিল সেই পার্স। দুঃখে, বেদনায় ও কেবল পাগলের মতো ফোন নম্বর মনে করার চেষ্টা করেছিল। পারেনি। মনে-মনে বলেছিল ভিনসেন্ট বুলাভার্ড, উচ্চারণ করেছিল বারবার। ভিনসেন্ট ভিনসেন্ট। তারপর স্টার স্টারি নাইট। অয়ন জেনে গেছে কখনো ও এ-নাম ভুলবে না। যেন এ-নামটা কখনো মন থেকে মুছে না যায় লিখে রেখেছিল ডায়েরির অনেক পাতায়।
আল কার্টার দশতলা বাড়ি। ডিস মানে দশ, এটাও জানা ছিল ওর। মনে-মনে ভেবেছিল, সামনের বছর ফিরে আসব এবং সোজা ওর বাড়িতে চলে যাব। দশতলার শেষ বাড়ি। যেখানে ব্যালকনিতে দাঁড়ালে পুরো প্যারিস দেখা যায়। যে-দালানের নিচে একটি ফুলের দোকান আছে। যে-দোকানে ও প্রথম দেখেছিল লিলিকে।
কিন্তু আসা হয়নি। প্রথমে বাবা ছিলেন অসুস্থ। বড় ছেলে অসুস্থ বাবাকে ফেলে আসতে পারে না। এর পর বাবা চলে গেলে তার ব্যবসাপত্র বুঝে নিতে-নিতে সময় চলে গিয়েছিল। মা বউ ঠিক করলেন। বিয়েও করে ফেলল অয়ন; কিন্তু হৃদয়ের ভেতরে লিলির মুখটা রইল অমস্নান। যখন সে প্রথম দশতলা দালানের নিচে ফুল কিনতে দেখেছিল। ঠিক সেই ছবিটা। হঠাৎ মুখ ঘুরিয়ে লিলি যখন ওকে দেখছিল। একরাশ চুলের ভেতরে ওল্ড মাস্টার্সের ক্ল্যাসিক ছবি, এমনই দেখতে ছিল কিনা ও।
রপসা বেশ মেয়ে। সুন্দর মেয়ে। সংসারে সুখী বলতে যা বোঝায় তেমনই তো ছিল ও। তাহলে লিলিকে কেন মনে পড়ত সময়ে-অসময়ে কে জানে।
এবার অয়ন প্যারিসে এসেছে বিশ বছর পর। মনের ভেতর সেই ছবিটা স্পষ্ট। লিলি দোকানে ফুল কিনছে। লিলির বয়স কত ছিল তখন? উনিশ-কুড়ি। ব্রোকেন ফ্যামিলির ও মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে কেবল নিজের এক ছোট ফ্ল্যাটে বাস করছে। স্বাধীনতায় পাখির মতো চঞ্চল। বাড়িটা খুঁজে পেল কেবল এই জানতে লিলি ওখানে থাকে না। লিলি রায়। কোথায় থাকে ওই দালানের কারো জানার কথা নয়। কবে সে ছিল, কবে সে চলে গিয়েছিল, সে-খবর কে রাখে। পাগলের মতো খুঁজছিল অয়ন লিলিকে। একটি দিন একসঙ্গে কাটানোর সেই আবেশটা এখনো ওকে অস্থির করে। কোথায় গেল লিলি। কোথায়? প্যারিস শহরে ঠিকানাবিহীন একজনকে খুঁজে বের করা খড়ের গাদায় সুচ খুঁজে পাওয়ার মতো কঠিন। ওর বাড়ি ছিল ‘বেল এয়ার’ মেট্রো স্টেশনের খুব কাছে। এখন তার পাশে অনেক পরিবর্তন হলেও ওর সেই দশতলা বাড়িটা আছে।
আসার আগের দিন চলে এলো। লিলিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। ডানিয়ুব নামের মেট্রোর স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে অয়ন। ওকে যেতে হবে ভিক্টর হুগো স্টেশনে। চুপচাপ ভাবছে, কোথায় হারিয়ে গেল আমার সেই লিলি। হঠাৎ চমকে মুখ তুলে তাকায়। ওই তো লিলি। একটা কালো ব্যান্ড মাথায় আর একটি ছোট হেয়ারব্যান্ডে এক বন্য দুরন্ত চুলকে বাতাসের শাসন থেকে বাঁচাতে বেঁধে রেখেছে। অয়ন ওর দিকে ছুটে যেতেই ডানিয়ুব স্টেশনে ট্রেনটা থেমে গেল। লিলি নেমে পড়েছে। কাঁধে একটা বড় ঢাউস ব্যাগ। হাতে একটা ফুলের ব্যুকে। অয়ন নানাসব জিনিসপত্র সামলিয়ে ওকে খুঁজতে থাকে। এসকেলেটর বেয়ে ও ওপরে উঠছে। অয়ন চিৎকার করে ওর নাম ধরে ডাকবে, কেমন হবে সেটা। কেবল দ্রুত ওপরে উঠতে থাকে। অয়ন জানে, লিলি খুব জোরে হাঁটতে পারে। এবার ও হাঁটতে-হাঁটতে সোজা বড় রাস্তায়। অয়ন প্রায় ছুটে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়ায়। ওর হাতের জিনিসপত্র নিয়ে হাঁফাতে-হাঁফাতে বলে – লিলি লিলি। তখন থেকে আমি তোমার পেছনে ছুটছি। লিলি মুখ ফেরায়। মসৃণ কপালে দুপুরের আলো। দুই চোখে অপার বিস্ময়। কালো বড়-বড় চোখ। কালো চুলের রাশ। এই তো লিলি! লিলি তাকিয়ে আছে মুখের দিকে। তারপর হেসে ওঠে। বলে – আমি লিলি নই।
কে তুমি?
আমি শিভন।
তুমি লিলি না?
মেয়েটি বলে – চলুন ওই বেঞ্চটায় বসি।
একটা বিশাল গাছের নিচে বেঞ্চ পাতা। শিভন ওর কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রাখে। হাতে একঝাড় ফুল। অয়ন বসে। তারপর বলে ও – আপনি অয়ন, তাই না?
আমি অয়ন। তুমি যদি লিলি না হও কেমন করে জানলে আমি অয়ন। শিভন আবার হাসছে। বলে, আজ থেকে বিশ বছর আগে আপনি লিলিকে দেখেছিলেন তাই না? কেমন করে ভাবলেন বিশ বছর পরেও লিলি ঠিক আগের মতো আছে।
অয়ন বোকা হয়ে যায়। ঠিক! কি করে একজন বিশ বছর পরেও একরকম থাকে? তার মুখের রেখায় হয় না কোনো পরিবর্তন! কেমন করে। এবার অয়ন অসহায়ের মতো হাসে। ঠিক বলতে পারে না, হৃদয়ের ভেতর যে-ছবিটা আছে তার তো কোনো বয়স বাড়েনি। ঠিক তেমনি একটি মুখ।
মায়ের নোটবইয়ে একটা ছবি ছিল। সেন নদীতে নৌকায় ওঠার ছবি। ছবিটা মা বড় সযতনে রেখেছিলেন। আর আপনার সঙ্গে ঘোরার পুরো ঘটনা সেই নোটবইয়ে যত্ন করে লেখা ছিল। মা অনেক দিন আপনার জন্য প্রতীক্ষাও করেছিলেন বলে জানি। আসলে আমি সেদিন কিন্তু আপনাদের সঙ্গে ছিলাম।
তুমি ছিলে?
আপনি যখন আমার মাকে দেখেন তার কিছুদিন আগে একজন তাকে নির্দয়ভাবে ফেলে চলে যান। ফরাসি মেয়ে কেবল ভোগের জিনিস, এই ছিল তার ধারণা! যা আমার সরল মা বুঝতে পারেননি। ওই মানুষটার কারণে মা নিজের মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে নিজের মতো বাঁচতে চেয়েছিলেন। মা শেষ পর্যন্ত সেটা পারেননি। ওদের ভালোবাসার সন্তান আমি।
আমাকে তো কিছু –
আপনি ফিরে এলে বলতেন। সেদিন না বললেও। তারপর থেকে আমার মা একা। আর কারো সঙ্গে কোনো সম্পর্ক করতে চাননি।
অয়ন অবাক হয়ে শিভনের কথা শুনছে। শিভন একটু থেমে বলে – আমি সেই ভালোবাসার সন্তান। আমি আর মা বেশ ছিলাম আমরা। এরপর অনেক সময় ও চুপ করে থাকে। তারপর বলে – আসলে হয়েছে কি জানেন, আজ আমি আমার মায়ের কবরে ফুল দিতে চলেছি। গত বছর এই দিনে আমার মা ক্যান্সারে মারা যান।
ওর বুকের ব্যথা আবার তীক্ষন সুচের মতো অয়নকে আঘাত করে। শিভন বলে – সবাই বলে, আমি নাকি আমার মায়ের কার্বন কপি। আপনি লজ্জা পাবেন না ভুল করার জন্য।
একরাশ ‘লিলি অব দ্য ভ্যালি’ কিনেছিল অয়ন। পরেছিল সেই ভিনসেন্ট বস্নু টাই, যা লিলি একদিন ওকে উপহার দিয়েছিল। এমন একটি দিনের জন্য যে-টাই সযতনে রাখা ছিল। লিলির কবর একটা নির্জন জায়গায়। সেখানে গাছ আছে, চারপাশে ফুলের বাগান আছে। এ-কবর নয়, মনে হয় কোনো এক ফুলভরা পার্কের অংশ। যেমন প্রকৃতি লিলির খুব পছন্দ ছিল।
সরসর শব্দে গাছটা কী বলেছিল অয়নকে – এতদিন পরে তোমার সময় হলো অয়ন? দুলে উঠেছিল ঝুলে-থাকা একটি ফুলভরা শাখা। অয়ন অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকেছিল সেই সমাধির পাশে। তারপর বলেছিল – এতে আমার কিছু এসে-যায় না লিলি। তোমার শিভন? সেটা এমন কি ঘটনা বলো? আমি তোমাকে ভালোবেছিলাম জানো। আমার এতদিনের প্রতিটি মুহূর্তে তুমি আমার সঙ্গে ছিলে। তোমাকে দেখার একটা গভীর প্রত্যাশা ছিল। সময়মতো আমি আসতে পারিনি লিলি। ক্ষমা করো তুমি। কবরে লেখা ‘লিলি রায়’। তারপর তার জন্ম-মৃত্যুর তারিখ। আর ফরাসি ভাষায় এক পঙ্ক্তি 888sport app download apk। কোনো এক ফরাসি কবির 888sport app download apkর এক লাইন। পাশের কবরে একজন ফুল দিতে এসে সেই 888sport app download apkর মানে করে দিয়েছিল – এমন ফুলভরা বাগানে আমার সময় কাটবে কে কবে ভেবেছিল।
সত্যিই ফুলভরা বাগান। অয়ন শিভনের কোনো ঠিকানা নোটবইয়ে লিখে রাখেনি। লিলির কার্বন কপি হলেও শিভন লিলি নয়।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.