তিরিশটি বছর পার হয়ে গেল। তিনটি দশক! জীবনের ভেতরে আরেকটি জীবনের মতো সময়কাল। তিরিশ বছর আগে এক দগ্ধ দিনে শিকার করতে বের হয়ে খড়ম-পেয়ে বুড়োর দেখা পেয়েছিলাম। তারপর তিরিশটি বছর সেই বুড়ো আমার বুকের মধ্যে হেঁটে বেড়িয়েছে। আমার করোটির ভেতরে এঁকে দিয়েছে বিচিত্র জঙ্গম চিত্র …। … শেয়াল শিকারে বের হয়েছিলাম। গ্রামের গরিব লোকেরা পাগলা শেয়ালের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমাকে শেয়াল মেরে দিতে বলল। জীর্ণ বেড়ার ফোকর দিয়ে ঘরে ঢুকে ওরা মানুষকে কামড়ে দিচ্ছিল।
গাঁয়ের মানুষ হামলে পড়ল আমার ওপর। যে করেই হোক শেয়ালগুলো মেরে ফেলতে হবে। ওদের আর্তিতে সাড়া দিয়ে জিম করবেটের মতো প্রথমে গ্রামটা ঘুরে দেখলাম। বিশাল বেগুন ক্ষেতের ভেতর একটা বাছুরের ভুক্তাবশেষ খুঁজে পেলাম। কিন্তু শেয়ালের টিকিটির নাগাল পেলাম না। ওলোটকম্বল আর লজ্জাবতীর ঝোপ মাড়িয়ে অনেকটা সময় জঙ্গল চষলাম। শেষে একটা ঢিবিমতো স্থানে এসে থামলাম।
আমার কাঁধে ছিল দোনলা বন্দুক। গাঁয়ের সবচেয়ে বড় কলাবাগানটা চষে বেরিয়েও শেয়ালের দেখা পেলাম না। আশেপাশে কয়েকটি গুঁইসাপ দেখলাম। ওদেরকে মারা আমার উদ্দেশ্য নয়। কখনো মারিনি। বন্দুক দিয়ে হাওর অঞ্চলে শীতকালে পাখি শিকার করেছি একসময়। এখন তা-ও ছেড়ে দিয়েছি। জীবজন্তু, জঙ্গল আর গাছপালা কমে যাচ্ছে।
দুপুরের তেজী রোদ পড়তির দিকে। তখনো সূর্য ডোবার সময় হয়নি; কিন্তু হঠাৎ করেই সে ডুব দিলো। প্রকৃতি গুমোট রূপ ধারণ করল। হাঁটতে হাঁটতে বেগুন ক্ষেতের শেষপ্রান্তে চলে এলাম। ততক্ষণে আমার পেছনে থাকা ছেলেবুড়োর দল হারিয়ে গেল। তাদের সার্বক্ষণিক কোলাহল থেমে গেল চারপাশ নীরব-নিথর করে দিয়ে। আকাশটা কালো হয়ে গেছে। কোনো পাখি উড়ছিল না। সহসা বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। একটা ঝড় আসছে, স্থল ঘূর্ণিঝড়। বাঁচতে হলে এখনই দৌড়াতে হবে। ঠান্ডা ও গরম মিশেল হাওয়া শরীরে বিচিত্র দোলা দিয়ে গেল। পালাতে হবে। পুরনো আমলের রেলইঞ্জিনের ধোঁয়ার মতো আজদাহা কুণ্ডলি আসমান আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। এক চাষা ক্ষেতের কাজ ফেলে দৌড় লাগাল।
ঢিবিমতো স্থানটায় লাফ দিয়ে উঠলাম। কাঁধ থেকে পড়ে গেল বন্দুক। দৌড়ে এসে একটা বেড়ায় ঘেরা স্থানে ঢুকলাম। মাঝখানে এক চিলতে উঠোন। মাথার ওপর নাম-না-জানা গাছের সারি। একপাশে চালাঘর, অন্যদিকে একটা টিনের ঘর। দরজায় কড়া নাড়লাম। ভেতর থেকে একটা খটখটে শব্দ পেলাম। শব্দটা আমার অনুভূতির মধ্যে থাকলেও ব্যক্ত করতে পারব না। চেনা-অচেনার মাঝামাঝি কোনো শব্দ। কেউ দরজা খুলল না। ফের কড়া নাড়লাম। সাড়া পেলাম না এবারো। শেষে ধাক্কা দিলাম দরজায়। নড়বড়ে দরজা খুলে গেল। প্রায়ান্ধকার ঘরটায় কাউকে দেখতে পেলাম না।
ঘরে একটা হাতলভাঙা চেয়ার আর একটা তক্তপোষ। চালার নিচের কাঠের তাকে কিছু তৈজসপত্র আর পাটখড়ির গাদাগাদি অবস্থান। চালা থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলছে কয়েকটি শিকে। শব্দটা আবার ভেসে এলো। এক বুড়ো পায়ে খটাখট শব্দ তুলে একটা হারিকেন রাখল চেয়ারে। বললাম, ‘ঝড় শুরু হয়ে গেছে।’ আমাকে দেখে বুড়ো চমকাল না, কেমন ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
মনে হলো, ঝড়ের মূল ঝাপ্টা বোধহয় এদিক দিয়ে যায়নি। গেলে এই নড়বড়ে টিনের ঘর, বুড়োর নির্বিকার ভঙ্গি আর প্রাণ রক্ষায় আমার ভেতরের তাগাদা চিরতরে মুছে যেত।
দুই
বুড়ো এগিয়ে এসে তার কানটা আমার মুখের সামনে ধরল।
কথাটার পুনরাবৃত্তি করলাম। বুড়ো মাথা নাড়ল। তারপর বিড়বিড় করে কিছু বলল।
ততক্ষণে ঝড় থেমে গেলেও ঝড়ো হাওয়া থামল না। ঠান্ডা হাওয়া আর বৃষ্টি চলল। বুড়ো খটরমটর করে ঘরময় পায়চারি করছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। চলে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করলাম। কিন্তু আমার আস্তানা অনেক দূরে। নিকষ কালো আঁধার আর প্রবল বৃষ্টিতে যাব কেমন করে?
বুড়ো চেয়ে আছে আমার দিকে। গ্রিক পুরাণের চ্যারন মাঝির মতো বুড়োর কুতকুতে চোখে জুগুপ্সিত চাহনি। বৃষ্টির প্রকোপ বোঝার জন্য জানালার দিকে তাকালাম। কিন্তু জানালা বন্ধ। ঘরটা গুমোট। একটা আঁশটে, ভেজা কুকুরের গায়ের মতো অরুচিকর গন্ধ নাকে লাগছিল থেকে থেকে। আমার সামনে যে দণ্ডায়মান সে চ্যারন মাঝি, যার কাজ হলো সদ্য মৃতদের স্টাইক্স ও অ্যাকেরন নদী পার করে জীবিত দুনিয়া থেকে মৃতদের দুনিয়ায় পৌঁছে দেওয়া। মনে হলো তক্তপোষটা একটা নৌকা, বুড়োটা মাঝি আর আমি সদ্য দেহচ্যুত কোনো আত্মা।
বুড়োর পরনে লুঙ্গি ও শতচ্ছিন্ন তেলতেলে কোট। বুড়োকে জিজ্ঞেস করলাম, সে এখানে একা থাকে কি না। বুড়ো ঘাড় নাড়ল।
পায়ে আঠালো কী একটা শীতল অনুভূতি সুড়সুড়ি দিয়ে যাচ্ছিল। হারিকেনের স্বল্প আলোয় দেখলাম মোটা ঘিনঘিনে কেঁচোটাকে। আমি কেঁচো খুব ভয় পাই। স্যান্ডেল ছুড়ে ফেলে একলাফে চৌকিতে পা উঠিয়ে বসলাম। দেখলাম, সারা ঘরে কেঁচোর মেলা বসেছে। ঘরের অন্ধকার কোণে কতগুলো কেঁচো দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ঘরের মেঝে জুড়ে ফাটল আর ঢিবি। কেঁচোর জমা করা গুটিমাটি। এই ঘরটা কতকাল সারাই হয় না কে জানে। বুড়ো ইশারা করল বসতে। কিন্তু বসব কোথায়? যদি কেঁচোগুলো চৌকির পায়া বেয়ে ওপরে উঠে আসে!
বাইরের বর্ষণ থামছে না; বরং যেন আরো বেড়ে গেল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে এবার শুনতে পেলাম ফ্র্যাংকো – ঘ্যাঙর ঘ্যাং রাগসংগীত। ততক্ষণে বুড়ো ঘরের ভেতরকার একটা বেড়ার আড়ালে চলে গেল। বেড়ার ভাঙা অংশ দিয়ে উনুন দেখা যাচ্ছিল। পোলাও চালের গন্ধ পেলাম। বুড়ো কি পোলাও-কোরমা রাঁধতে শুরু করল? আমার খিদে পেয়েছিল। সেই সকালে সামান্য চা-বিস্কিট খেয়ে বেরিয়েছিলাম। তারপর পেটে আর দানাপানি পড়েনি। এই সময় বস্তুটা দেখতে পেলাম। ঘরের তাকের ওপর থেকে ঝুলছে। একটা ধূসর-কালো মোটা দড়ি। কাছে গিয়ে দড়ির মালিকের চেহারাটা দেখতে পেলাম। ধূসর-কালচে একটা গন্ধগোকুল। পোলাও চালের গন্ধের উৎস খুঁজে পেলাম। দুই চোখের ওপর সাদা দাগ। বাদুড়ের মতো চেহারাটা মেলে সে আমার দিকে বিজাতীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
তিন
বুড়ো কোথায়? তার খড়মের আওয়াজ আর পাচ্ছি না। ঘরের কিনারাগুলো বৃষ্টিতে ভিজে নরম হয়ে আছে। মেঝের কিনারাগুলো স্যাঁতসেঁতে হয়ে দৃঢ়তা হারিয়েছে; ভ্যাপসা ও সোঁদা গন্ধে ভরপুর। খড়মের আওয়াজটা হারিয়ে গেছে।
বুড়ো এক সানকি মুড়ি এনে বিছানায় রাখল। জিজ্ঞেস করলাম তার ঘরে চা আছে কি না। বুড়ো নিবিষ্টচিত্তে মুড়ি চিবোতে লাগল। বুড়োর বয়স কত? আশি, নব্বই, নাকি একশ? আরো দুয়েকটি প্রশ্ন করলাম। বুড়ো শুনতে পেল না। শেষে হেঁসেলে গিয়ে বাঁশের তৈরি ভারী ফুঁকনিটা কুড়িয়ে আনলাম। তার একপ্রান্তে মুখ রেখে অন্যপ্রাপ্ত বুড়োর কানের ভেতরে প্রায় সেঁধিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘ঘরে চা আছে?’
‘না।’
আমার এই প্রশ্নে বুড়ো অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে যেতে লাগল। ভাবলাম এমন একটা প্রশ্ন করা যাক, যাতে বুড়ো আদ্যন্ত বলে যেতে পারে। কিন্তু কীভাবে প্রশ্নটা করা যায়? বাঁশের চোঙাটা তেমনিভাবে বুড়োর কর্ণে স্থাপন করে বললাম, ‘আপনার কাহিনি আমাকে বলে যান, কবে জন্ম, আদি নিবাস কোথায়।’
বুড়ো আবার বলল, ‘সেই কোনকালে চা ছেড়ে দিয়েছি। যৌবনে খুব চা খেতাম। চা খেয়ে রাত জাগতাম আর তাস খেলতাম …।’
চোঙাটা আবার বুড়োর কানের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম। বললাম, ‘চা প্রসঙ্গ থাক। আপনার কথা বলুন।’
‘ব্রিটিশ আমলে একটা দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। তখন ম্যালা লোক মারা যায়।’
‘পঞ্চাশ লাখ’, বললাম। বুড়ো ইশারা করল তার কানের পাশ থেকে চোঙাটা সরিয়ে নিতে। চোঙা সরিয়ে নিলাম। মনের ভুলে সেটা ধরে রেখেছিলাম তার কর্ণদেশে।
‘দুই দুইটা জোয়ান ছেলে আর একটা মেয়ে মরে গেল খাদ্যের অভাবে। আমি, আমার স্ত্রী, আরো দুই মেয়ে নোংরা আবর্জনা খেয়ে বেঁচে রইলাম। কিছুদিন পর আমার স্ত্রী মরে গেল। আমি দুই মেয়ে নিয়ে কলকাতা ছেড়ে চলে এলাম 888sport appয়। কলকাতায় বৌবাজারে বাপদাদার আমলের চালের দোকান ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান বর্মা মুলুক দখল করে নেয়। বর্মা থেকে চাল আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। চালের বাজার পড়ে যায়। তারপর যে কয়টা কানাকড়ি ছিল, তা খরচ হয়ে যায় দুর্ভিক্ষের সময়। ভাদ্র-আশ্বিন মাসে শয়ে শয়ে মানুষ মরতে লাগল। একসময় 888sport appয় আসি, সঙ্গে দুটি মাত্র কাঁথা, কয়েকটা হাঁড়িপাতিল আর এই একজোড়া খড়ম। এই খড়ম পায়ে আমার বাবা চালের দোকানে বসত। খড়ম জোড়া আমার দাদার বাপের ছিল।’
বৃদ্ধের খড়ম জোড়ার দিকে তাকালাম। কালো। এটা রং নয়, বহু ব্যবহারে খড়ম জোড়া লোহার মতো কালো ও মসৃণ হয়ে গেছে। বললাম, ‘সব ইংরেজদের দোষ। এরাই সব নষ্টের মূল। এখন ভাবি, জাপানিরা যদি ভারতের সব ইংরেজকে মেরে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিত তখন!’
বৃদ্ধ কী বুঝল জানি না, তবে সে মাথা নাড়ল। তারপর বলে চলল, ‘888sport appয় এসে কয়েকদিন ভিক্ষা করলাম। সব জায়গায় একই অবস্থা। লাশ পড়ে আছে এখানে-ওখানে। তারপর দুর্ভিক্ষ আস্তে আস্তে কমে গেলে আমি একটা কাপড়ের দোকানে কাজ জুটিয়ে নিলাম। কিছু পুঁজি জমিয়ে পরে নিজেই একটা কাপড়ের দোকান দিলাম। মেয়েদের বিয়ে হলো একসময়। টানা 888sport cricket BPL rate বছর দোকান চালিয়ে তারপর নাতিকে কাপড়ের দোকানের দায়িত্ব দিয়ে অবসর নিলাম।’
‘আপনার আদিনিবাস কোথায়? এই গ্রামে এলেন কী করে?’
‘কলকাতায় ছিলাম। যদ্দূর মনে পড়ে, আমার বাপদাদার ভিটা ছিল চিৎপুরে। সেই ভিটা দাঙ্গার সময় দখল হয়ে যায়। 888sport appয় থাকতে বড় মেয়ের বিয়ে দিলাম এই গ্রামে। কিছুদিন মেয়ে আর মেয়ের শ্বশুরের হেফাজতে ছিলাম। তারপর জামাইয়ের বাপের কাছ থেকে তাদের দক্ষিণের এই ভিটা আর ঘর জমানো টাকায় কিনে এখানেই বসবাস করতে লাগলাম।’
চোঙাটা বুড়োর কানে ভালোভাবে বসিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আপনার বয়স কত?’
‘অতশত কি আর মনে আছে?’ বুড়ো বলল। দেখলাম বুড়ো বিড়বিড় করে কিছু বলছে। চটজলদি চোঙাটা এবার বুড়োর মুখের কাছে ধরে তার অপরপ্রান্ত আমার কানের কাছে ঠেকালাম। বুড়ো অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করছে! কাকে গালি দিচ্ছে, কী কারণে এমন বেমক্কা গালমন্দ বুঝতে পারলাম না। কান থেকে চোঙাটা সরিয়ে ফেললাম।
চার
ঘড়ি দেখলাম, ভোর সাড়ে ছয়টা। থেকে থেকে মাথা পাক দিচ্ছিল। একটু তন্দ্রামতো এসেছিল। তন্দ্রায় আমি হোর্হে লুই বোর্হেসের গল্পরাজ্যে বিচরণ করছিলাম। বুড়োর অবয়ব ভয়জাগানিয়া অনুভূতির সঞ্চার করছিল আমার মাঝে। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল কারো স্পর্শে।
চোখ মেলে খুবসুরত মেয়েটিকে দেখলাম। কালো মেয়ে, কিন্তু খুবসুরত। কোমরে আঁচল জড়ানো। এক হাতে তার ঝাঁটা। আমাকে চোখ মেলে চাইতে দেখে মেয়েটি চোখ আর ভুরু নাচাল, ‘ঘুম হইছে?’
ঘাড় নাড়লাম। তারপর আদ্যোপান্ত খুলে বললাম। মেয়েটি কাচভাঙা হাসিতে গড়িয়ে পড়ল। বলল, ‘ভালোই করছেন। নাইলে গাছের ডাইল মাথায় পড়ত।’
মেয়েটি বলল, ‘দিনে বুড়ার খেদমত করি। বুড়ারে রাইন্ধাবাইড়া দিই। সন্ধ্যায় চইলা যাই। আমার বাজানের অসুখ। রাইতে তাইনের সেবা করি।’
‘বুড়ো তোমাকে বেতন দেয়, নাকি এমনি করে দাও?’
‘বেতন! সোয়ামির কাছ থেইকা বেতন নিতাম!’
এই আমার মুখটা বোধহয় পুরনো মজা পুকুরের রূপ ধারণ করেছিল। সেদিকে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, ‘ঘাটের মড়ার সঙ্গে আমার বিবাহ হইছে দুই বছর আগে। বাজান কামলা মানুষ। রোজগারপাতি তেমন আছিল না। বিনা চিকিৎসায় মা মইরা গেল। একটা ছোটোভাই আছিল। হা-ও মইরা গেল। আমি বাড়ি-বাড়ি ঝিয়ের কাজ কইরা সংসার চালাইতাম। এইখানে একদিন কাম করতে আইসা বুইড়ারে মনে ধরল। আহা, কত বছর ধইরা বুইড়া কষ্ট করতাছে …।’
‘ঠিক মেলানো যাচ্ছে না। তোমার বয়স কম। রূপযৌবনে ভরপুর …।’
‘আপনের লগে একটু ইংরেজি কইতে ইচ্ছা করতেছে। যদি অনুমতি দেন তো কৃতার্থ হই।’
‘নিশ্চয়, নিশ্চয়। তুমি ইংরেজি জানো?’
‘কিছু জানি। আমি ম্যাট্রিক পাশ। তারপর বাজান আর পড়াইতে পারে নাই। বুইড়ার সঙ্গে সাঙ্গা বসবার পার থেকে হা-র মুখে ইংরেজি শুইনা শরীর রি-রি করত। বাসর রাইতে তাইনে আমার কাছে তার যৌবনকালের গল্প করল। সে বলে ব্রিটিশ। আমি শুদ্ধ কইরা দিয়া বললাম, ব্রিটিশ। তারপর একদিন সারাবেলা খালি দুর্ভিক্ষের গল্প বলল। জিজ্ঞাসা করলাম, কোন সালে দুর্ভিক্ষ হইছিল? কইতে পারল না। কইলাম, বাংলা তেরেশো পঞ্চাশ সনে। যাকগা। আফটারঅল সে আমার সোয়ামি। রাতের বেলায় থাকতে পারি না বাজানের জন্য। তাই দিনের বেলা যদি সারাদিন না থাকি তাইলে মাইনষে মন্দ কইব। বুইড়া বেলা দুইটা পর্যন্ত ঘুমাইব। ওই যে দেহেন।’ মেয়েটির ইশারায় ঘরের আরেক প্রান্তে তাকিয়ে অবাক হলাম। এমন বিজাতীয় ভঙ্গিতে কোনো মানুষকে আমি ঘুমোতে দেখিনি। বুড়ো মুদ্রা আসনের ভঙ্গিতে মেঝেতে উবু হয়ে আছে। মেয়েটি বলল, ‘ঘুম থেকে উইঠা আমার সোহাগ চাইব।’
‘নামটা কী?’
‘পুরা নাম কইতারে না। খালি কয় মুন্সি।’
‘না, না। তোমার নাম।’
‘আমার নাম মোছাম্মাৎ হেনোরা বেগম ওরফে কাকলি। আমি সারাদিন খালি বকবক করি। আড়িয়াল খাঁ নদীর ধারে বাড়ি। গেরামের মানুষজন আমার নাম দিছে কাকলি। গায়ের রং কাউয়ার মতো হইলেও দেখতে আমি পরীর মতো। আর কণ্ঠ কোকিলের মতো।’
‘স্বীকার করছি।’ বললাম, ‘কিন্তু তুমি জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দিলে কেন?’
‘কী বলতে চাইতেছেন?’
‘তুমি তো লেখাপড়া ভালোই শিখেছ। শহরে গিয়ে কারখানায় চাকরি নিতে পারতে। তারপর তোমার বাজানকে নিয়ে চিকিৎসা করাতে পারতে। ইচ্ছে করলে আরো লেখাপড়া শিখতে পারতে।’
কাকলি ঝাড়ুটা ছুড়ে মারল ঘরের অন্যপ্রান্তে। তারপর বিছানায় আসন করে বসে আমার মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘কী যে কন। চেষ্টা কি কম করছি। আমার সোয়ামি চায় নাই। সে কামলা, আমারেও কামলা কইরা রাখতে চাইল।’
‘এই বুড়োর এত তেজ!’
‘আপনে না ধুন্দা। এই বুইড়া না। আমার একটা জোয়ান স্বামী আছিল। সেই স্বামী আমারে মারত। খাইতে দিত না। শেষে তালাক দিলো। আমি ফিরা আসলাম গ্রামে। কিছুদিন গ্রামে বাড়ি-বাড়ি কাম কইরা বাজানরে খাওয়াইলাম। মানুষজন নজর দিতে লাগল। আমি এহন কী করি। শেষে তাইনের এহানে কাম নিলাম। পাক করার কাম। তারপর একদিন বুইড়া আমারে প্রস্তাব দিলো। পয়লা তো আমি হাসতে হাসতে সাতবার বেহুঁশ হইছিলাম। তালাবে গিয়া সাত-আটবার ডুব দেওনের পর আমার বুদ্ধি খুলল। গ্রামের মাতবর চাচা মানুষটা খারাপ অইলেও আমারে ভালা পায়। তার পরামর্শ নিলাম। তাইনে আমারে ‘খুব গোপন কথা’ বইলা ধানক্ষেত আর নামা পার কইরা এক কলাবাগানে আইনা এরপর বুদ্ধিটা দিলো। কী কইতাম, লোকটা খাডাস হইলেও শলাটা ভালোই দিলো।’
‘কী শলা!’
‘কইল, বুইড়া যেন আমারে তার ভিটাভূমিডা লেইখা দেয়। আমি দৌড়াইয়া গিয়া ধাব্বুস-ধুব্বুস বুকে কথাটা পাড়লাম। বুড়া সঙ্গে সঙ্গে রাজি হইয়া গেল। রাজি তো হইলই। রীতিমতো দলিলপত্তর কইরা দিলো।’
‘তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে।’
‘যাক গিয়া। আপনে নাস্তা খাইবেন? দিতাম? আটার রুটি আর রামশিঙ্গা ভাজি। রামশিঙ্গা বুঝেন তো? আপনে তো আবার শহরে মানুষ অইছেন। মানে হইল চিচিঙ্গা।’
শুনে আমার জিভে পানি এসে গেল। খিদেয় নাড়িভুঁড়ি পাকিয়ে উঠছিল। বললাম, ‘বেশ তো দাও না নাস্তা। জম্পেশ করে খাই। আর একটু চা হবে?’
‘চা এই বাড়িতে নাই। তবে কুসুমদের বাড়িতে আছে। সে আমার ফ্রেন্ড। তার কাছ থেকে চাইয়া আনতে পারি। বেশি দূরে না।’
প্রীত হয়ে বললাম, ‘বেশ তো তাই করো। চায়ের জন্য প্রাণটা আইঢাই করছে। চা-নাস্তা খেয়ে শরীরটা তাজা করে তারপর না হয় রওনা দেব।’
‘ঠিক আছে চা, রুটি, রামশিঙ্গা ভাজি আর বন্দুক একসঙ্গে হাজির করতেছি।’
‘চা-রুটি-শিঙ্গা ভাজি বুঝলাম, কিন্তু বন্দুকটা!’
‘আপনে মানুষটা আসলেই বুন্দা …। তুফানের সময় বন্দুক ফালাইয়া দৌড়াইয়া এই বাড়িতে আসেন নাই? আমি জানি এই গ্রামে হিয়াল মারতে একজন শিকারি আইছে। এখানে আসার পথে বন্দুক দেইখা ভাবলাম হয় আপনেরে তুফান উড়াইয়া নিয়া আইছে, না হয় আপনে উইড়া আইসা এই বাড়িতে উঠছেন।’
‘ঠিক’, মুগ্ধ চোখে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বললাম। তারপর পেটের মধ্যে জমানো জিজ্ঞাস্যটা উগড়ে দিলাম, ‘বুড়ার বয়স কত কাকলি?’
‘আপনে না একটা উন্দা …। একটু মাথা খাটাইলেই তো বয়সটা হিসাব করতে পারেন।’
‘কী জানি, আমার মাথায় খেলছে না। উন্দা কী?’
‘আগের সোয়ামির বাড়ি আছিল ব্রহ্মপুত্রের ওই পাড়ে, তারা বনবিলাইরে কয় উন্দা। আমরার গ্রামেও অনেক জীব আছে। যেমন ধরেন বনখাডাস, গুঁইসাপ, আরো কত কিসিমের জীব।’
‘আমি বুঝি বনবিড়াল? যা হোক ওই নামটা খাডাস না। খাটাস, মানে গন্ধগোকুল। সেটা এই ঘরেই আছে।’
‘ও আপনে বুঝি টের পাইছেন? ঠিক আছে, আপনার নাস্তা নিয়া আসি।’
‘বয়সটা বললে না?’
‘আগে নাস্তা আনি। তারপরে হিসাবটা করতাছি।’
পাঁচ
‘বাংলা তেরোশো পঞ্চাশ সনেই তো দুর্ভিক্ষ হইছিল, তাই না?’ কাকলি শিক্ষকের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকাল। আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, ‘বোধহয়।’ কাকলির প্রশ্নে আমার অনেকদিনের জানা সনটা কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। ওর দিকে তাকালাম নিরক্ষর দৃষ্টিতে। এই সুযোগে কাকলি কর্তৃত্বের আসন নিয়ে নিল। রুটি আর শিঙ্গা ভাজি মুখে পুরে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘দুর্ভিক্ষের সঙ্গে বয়সের কী সম্পর্ক?’
‘সেই সময় বুড়ার জোয়ান দুই ছেলে আর এক মেয়ে মারা যায়। জোয়ান বলতে বুড়া কী বুঝাইতেছে জানি না। আঠারোও হইতে পারে, আবার আটাইশও হইতে পারে। যদি আঠারোও হয়, তাইলে বাপ হিসাবে তার বয়স কত ছিল? ধরেন, চল্লিশ কি বিয়াল্লিশ। তেরোশো পঞ্চাশ সন কত বৎসর আগের সন? একাশি বৎসর আগের। তাইলে একাশি আর বিয়াল্লিশ যোগ করেন। একশ তেইশ বৎসর।’
‘বুড়োর বয়স একশ তেইশ বছর!’ আমি বিরাট ধাক্কা খেলাম।
‘চান্দি গরম হইয়া গেল? আরো আছে। আমার মতে, বুড়ার বয়স একশ আটাইশ বৎসর। আমি তো কমটা ধরলাম। শুনছি, তার মেয়ে মারা গেছে সাতাত্তর বৎসর বয়সে। তার মানে বুড়ার 888sport app download for androidশক্তিতে গণ্ডগোল হইছে।
জোয়ান দুই ছেলে মইরা গেছে অনাহারে, এইটা তার মনে দাগ কাইটা আছে। তার দুই ছেলের বহু আগে জন্মাইছিল বড় মেয়ে। এরপর আরো দুই মেয়ে।’
‘হুম।’ আমি বললাম, ‘বৃদ্ধ তবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে স্থান পাওয়ার মতো।’
কথাটা বুঝল না কাকলি। বুঝিয়ে দিলাম।
এইসময় উঠোনে জবর হট্টগোল শুনতে পেলাম। বৃষ্টি ধরে এসেছিল। বাইরে এসে দেখলাম আমার দোস্ত বারিক আলি জনাদশেক লোক নিয়ে হাজির। তারা আমার আকস্মিক অন্তর্ধানে প্রবল উদ্বিগ্ন। বারিক আলি একগাল হাসল আমাকে দেখে। সব শুনে সে আরো একচোট হাসল। সে আমার বন্ধু। ছোটকালে এক পাঠশালায় পড়তাম। একসঙ্গে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলাম। আঠারো বছর বয়সে আমি চলে যাই 888sport appয়। ডিগ্রি পাশ করলাম। তারপর পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরিতে ঢুকলাম। চব্বিশ বছর টানা চাকরি করলাম। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। মনে পড়ল দোস্তর কথা। ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীর অনুমতি নিয়ে চলে এলাম গ্রামে। উঠলাম বারিকের বাড়িতে। আমাদের বাড়িতে তো কেউ নেই। বারিক ভালো মনের মানুষ। সুখী ও সমৃদ্ধ।
ছয়
বারিকের বাড়ির সন্ধ্যাটি অনেকদিন মনে থাকবে আমার। বারিক, তার স্ত্রী, তাদের দুই কিশোরী মেয়ে, বারিকের বিধবা শালি ও এই গাঁয়ে আমাদের আরেক বন্ধু আজগর আড্ডা বসিয়েছিলাম …।
… আজ এই জীবনসায়াহ্নে এসে বড় বেশি মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা। ছেলেমেয়ে আর নাতিরা হাসপাতালে এনেছে আমাকে। বারিকের মৃত্যুসংবাদ পেলাম দুদিন আগে। মৃত্যুসংবাদ শুনে বুকের পুরনো ব্যথাটা চাগিয়ে উঠেছিল। যখন কোনো মৃত্যুসংবাদ শুনি, তখন আমার চোখে ভেসে ওঠে অন্ধকার এক কুঠুরি। হলদেটে সাদা করোটি আর অস্থি। আমি ঘুমে কিংবা জাগরণে আমার অস্থিগুলোকে দেখি। আমি নাড়াতে চাই আমার অস্থিকে, কিন্তু পারি না।
এই দুদিনে মরিনি। হয়তো আরো দুই-চারদিন বেঁচে
থাকব। কিংবা আজ রাতটিই শেষ রাত হবে। সকাল থেকে ভালো বোধ করছিলাম। প্রদীপ নেভার আগে দপ করে জ্বলে ওঠার মতো। কেবিন থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। শহরের ধোঁয়াশা আর বিবর্ণ গাছপালা ঠেলে কোনোক্রমে উঁকি দিলো চাঁদ। অভিভূত হয়ে তাকিয়ে থাকলাম সেদিকে। বড় ভালো লাগছে পৃথিবীটাকে, এই বেঁচে থাকাটাকে। পত্রিকায় দেখলাম শত শত ইউএফও নাকি দেখা গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। যাক দেখা, এসব দেখার আমার কোনো আগ্রহ নেই। আমি শুধু অতীত দেখি। আমি অতীত ভালোবাসি। অতীতের মতো মধুর কোনো কাল হতে পারে না। তিরিশ বছর আগের উনিশশো পঁচানব্বই সাল আমার কাছে মধুময়। তার আগের কালটা মধুরতর। এরও আগেরটা মধুরতম।
… বারিকের বউ মজাদার পিঠে তৈরি করে আড্ডায় সরবরাহ করেছিল। বারিকের পাকা বাড়ির বারান্দায় পাটি পেতে বসে ছিলাম। খেতে খেতে আড্ডা জমে উঠল। আগের রাতের ঝড় আর সেদিনের সারাদিনের বর্ষণ থামিয়ে যেন কিছুই হয়নি এমনিভাবে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছিল নিসর্গ।
আড্ডায় খড়ম-পেয়ে বুড়োর প্রসঙ্গ চলছিল। বললাম, ‘অবাক কাণ্ড, বুড়োর ঘরে বসে তোকে অনেক ট্রাই করলাম সেলফোনে, কিছুতেই পেলাম না। মনে হয় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল যন্ত্রটা।’ আমার কথায় বারিকের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। বারিকের বউ কিছু একটা ইশারা করল। আজগর একটা পিঠে মুখে দিতে গিয়েও দিলো না। বারিকের দুই মেয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসল। জঙ্গলে মানুষখেকো বাঘের চলার সময় চারপাশটা যেমন স্তব্ধ হয়ে যায়, এমনকি ঝিঁঝিরা পর্যন্ত কলরব থামিয়ে দেয়, তেমনি একটা রূপ ধারণ করল পরিবেশটা। বিস্ময়মাখা চোখে সবার দিকে তাকালাম। বারিক নড়েচড়ে বসে শেষে বলল, ‘আমরার গ্রামে মোবাইলের নেটওয়ার্ক সবচাইতে তেজী। কিন্তু …।’
‘কিন্তু কী!’
‘ওই ঘরের ভিতরে মোবাইল কাজ করে না।’
‘আমার মোবাইলটা কোনো কারণে হয়তো কাজ করেনি’, বললাম।
‘না’, বারিক বলল, ‘তোর মোবাইল ঠিকই ছিল। বিষয়টা হইল, ওই ঘরে মোবাইল কাজ করে না।’
‘বাজে কথা।’ বললাম।
‘মোটেও বাজে কথা নয়।’ বারিক উষ্ণ কণ্ঠে বলল, ‘কাকলি কেন রাতে ওই ঘরে থাকে না? শত হইলেও বুড়া তো তার স্বামী। সে কেন একটা রাত্রিও ওই ঘরে থাকে নাই?’
‘ওর বাবা অসুস্থ, রাতে সে বাপের সেবা করে। দিনে তো সে যায়।’ বললাম, ‘তোদের কুসংস্কার আর গেল না।’
‘কুসংস্কার না’, বারিক বলল, ‘কাকলি একদিন মোবাইল নিয়া সেই ঘরে ঢুকছিল। একটা জরুরি ফোন করার জন্য মোবাইলটা হাতে নিয়া দেখল, নেটওয়ার্ক নাই। কিছুক্ষণ পর ফোন বন্ধ হইয়া গেল।’
‘বোধহয় ব্যাটারির চার্জ ছিল না।’
‘ছিল।’ বারিক বলল, ‘কাকলি তার বাড়িতে ফিরা আইসা দেখল মোবাইল চালু হইয়া গেছে। প্রথমে সে আমলে আনে নাই। হয়তো কোনো কারণে মোবাইল কাজ করে নাই। কিন্তু পরদিনও একই ঘটনা ঘটল। বুড়ার ঘরে ঢুকতেই অফ হইয়া গেল মোবাইল। অনেক চেষ্টা কইরাও সে চালু করতে পারল না।’
‘আশ্চর্য!’ আমার মুখ দিয়ে শুধু এই শব্দটাই বেরুল।
‘তাছাড়া …।’
‘তাছাড়া কী?’
‘কাকলি নিজে দেখছে।’
‘কী দেখেছে!’
বারিকের বলার ভঙ্গিতে ভয় পেল তার দুই মেয়ে। তারা তাদের মায়ের শরীর ঘেঁষে বসল। আজগর একটা বিড়ি ধরিয়েছিল। সেটায় টান দিতে ভুলে গেছে সে। আমি চায়ে চুমুক দিতে ভুলে গেলাম। আমার অস্বস্তি লাগছিল। বুড়োর ঘরের ভেতরের সেই গন্ধগোকুলটার নির্বিকার চাহনি ভেসে উঠল মানসপটে। আমার নাকে ভেসে আসছিল পোলাও চালের গন্ধ।
‘সেইদিনটা রান্নাবান্না আর ঘরের কাজ সাইরা সাঁঝের বেলা কাকলি সবে ঘরের বাইরে পা দিছে’, বারিক বলে চলল, ‘এইসময় খটাখট খড়মের শব্দে কৌতূহলী হইয়া ফিরবার সে ঘরে উঁকি দিলো। ঘরের মধ্যে বুড়া নাই! ভাবল, বুড়া বোধহয় হেঁসেলে ঢুকছে। কাকলি সাহস কইরা ঘরে ঢুকতেই খড়মের শব্দ মিলাইয়া গেল। হারিকেনের আলো বাড়াইয়া সে ঘরময় খুঁজল বুড়াকে। কিন্তু বুড়া নাই! হঠাৎ সে দেখতে পাইল ঘরের তাক থেইকা অর্ধেক জালক অজগর অর্ধেক মানব শরীরের বুড়া নামতেছে পিছলাইয়া! কাকলি এক দৌড়ে বাইরে আইসা জ্ঞান হারিয়ে লুটাইয়া পড়ে উঠোনে।’
সেই সন্ধের আড্ডাটা শেষ হলো রাতে ভূরিভোজনের মধ্য দিয়ে। রাতে খাবারের সময় বুড়ো প্রসঙ্গ ছিল। না। ছিল ফসল, মাটি, দেশ ও দশের গল্প। স্ত্রীর অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে পরদিন সকালে আমি ফিরে এসেছিলাম শহরে।
স্ত্রীর প্রলম্বিত অসুস্থতা, শেষে তার মৃত্যু আমাকে ডিডেলাসের সুড়ঙ্গে প্রবিষ্ট করিয়ে দিয়েছিল। সেই গোলকধাঁধা থেকে কখনো বের হতে পারিনি আর। তাই অতীত দেখি আমি। ডিডেলাসের সুড়ঙ্গে দেখি মাইনোটরকে, সে তেড়ে আসছে আমার দিকে। আমি যুঝে চলি। বারবার মৃত্যু হয় আমার। বারবার বেঁচে উঠি।
তিরিশটি বছর অজগর বুড়ো হেঁটে বেড়িয়েছে আমার চেতনায়।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.