888sport app download apk latest version : মেহবুব আহমেদ
একটি সুন্দর দিনে মাদাম ভ্যালমন্ড ডেজিরে আর শিশুটিকে দেখতে লা’আব্রি গেলেন।
‘ডেজিরের শিশু’ – ভেবে হাসলেন তিনি। এই তো মাত্র সেদিন ডেজিরে নিজেই শিশুর চেয়ে সামান্য বড় ছিল। ভ্যালমন্ডের প্রধান দরোজা দিয়ে ঢুকছিলেন অশ্বারোহী মঁসিয়ে ভ্যালমন্ড, দেখলেন দরোজার প্রস্তর থামের ছায়ায় একটি বাচ্চা শুয়ে ঘুমিয়ে আছে।
বাচ্চাটি তার কোলে জেগে উঠে ‘ড্যাডা’ বলে কাঁদতে লাগল আর কেবল ওটুকুই ও বলতে পারছিল, তবে হাঁটতে শিখেছিল তখন, অনেকেই ভাবল ও নিজেই হেঁটে হেঁটে চলে এসেছিল। সাধারণ সবার ধারণা ছিল, টেক্সাসের একটি দল ক্যানভাস ঘেরা ওয়াগানে চড়ে যাবার সময় ইচ্ছে করেই শেষবেলায় ওকে ফেলে রেখে খামারের নিচেই কটন মাইসে অপেক্ষমাণ ফেরিতে পার হয়ে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এসব চিন্তাভাবনা মাদাম ভ্যালমন্ড একসময় বাদ দিলেন; তিনি বিশ্বাস করতেন, নিজের রক্ত-মাংসের কোনো সন্তান নেই বলে করুণাময় ঈশ্বর ডেজিরেকে স্নেহের ধন হিসেবে তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ডেজিরে বড় হলো সুশীল, স্নেহময়ী, সৎ ও সুন্দর একটি মেয়ে হয়ে ঠিক যেন ভ্যালমন্ডের প্রতিমা।
একদিন ভ্যালমন্ড খামারের প্রধান দরোজার প্রস্তর থামে ডেজিরেকে ঘুমন্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। আঠারো বছর পর সেই প্রস্তর থামেই ও যখন হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল তখন আরেক অশ্বারোহী আরমান্ড অবিনি ওর প্রেমে পড়ে গেল। ব্যাপারটা বিস্ময়ের ছিল না, অবিনিরা গুলিবিদ্ধ হবার মতোই প্রেমে পড়ত, কিন্তু আরমান্ড আগে ডেজিরের প্রেমে পড়েনি, বিস্ময় ওখানেই। আট বছর বয়সে ফ্রান্সে মা মারা যাবার পর ওর বাবা ওকে এখানে নিয়ে আসেন আর তখন থেকেই ডেজিরের সঙ্গে এর পরিচয়; কিন্তু সেদিন ডেজিরেকে প্রস্তর থামে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখে ওর ভেতরে জেগে ওঠা আবেগ যেন প্রচণ্ড শক্তিতে ভাসিয়ে নিল ওকে, যেন প্রেইরির সর্বগ্রাসী দাবানলের মতো প্রবাহিত হলো ওর মনে-প্রাণে, অথবা বলা যায়, সমস্ত বাধা ডিঙিয়ে দুর্বার গতিতে এগিয়ে নেবার শক্তি সঞ্চার করল।
মঁসিয়ে ভ্যালমন্ড সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে চিন্তা করলেন এবং মেয়েটির যে কোনো পরিচিতি নেই সেদিকটা বিবেচনা করে দেখতে বললেন; কিন্তু ডেজিরের চোখের দিতে তাকিয়ে বিষয়টিকে আরমান্ড বিবেচনার গণ্য মনে করল না। তারপরও ও যে নামগোত্রহীন সে-কথাও আরমান্ডকে মনে করিয়ে দেওয়া হলো। কী আসবে-যাবে নাম থাকা-না থাকায়, আরমান্ড ওকে আখ্যায়িত করতে পারবে লুইজিয়ানার বিখ্যাত বনেদি নামটিতে! প্যারিস থেকে ও বিয়ের উপহারসামগ্রী আনাবার ব্যবস্থা করল – তার মধ্যে ছিল বিভিন্ন ধরনের অতি মূল্যবান পোশাক এবং পাথরের তৈরি ফুলের ঝুড়ি। উপহার এসে পৌঁছান পর্যন্ত যথাসম্ভব ধৈর্য ধারণ করে রইল, তারপর তাদের বিয়ে হলো।
চার সপ্তাহ হয়ে গেছে মাদাম ভ্যালমন্ড ডেজিরে আর শিশুটিকে দেখেননি। যতবার তিনি লা’আব্রির সামনে এসে পৌঁছাতেন ততবারই কি এক আশঙ্কায় তার ভেতরটা ভয়ানকভাবে কেঁপে উঠত। এবারো সেই একই অনুভূতি হলো। জায়গাটা বিষাদে মন ভারাক্রান্ত করে তোলে। বহু বছর এখানে কোনো গৃহকর্ত্রীর সহৃদয় উপস্থিতি ছিল না। আরমান্ডের বাবা ফ্রান্সে যাকে বিয়ে করেছিলেন তিনি জন্মভূমিকে এতটাই ভালোবাসতেন যে কোনোদিনই এখানে আসেননি। ওখানেই তার মৃত্যু হয়। হলুদ প্লাস্টার করা বাড়ির থাম বসানো প্রশস্ত বারান্দাটিকে ঘোমটার মতো ঢেকে ছাদ থেকে নেমে আসা ঢালু অংশটা সম্পূর্ণ কালো হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির দুপাশ থেকে শুরু করে প্রধান দরোজা পর্যন্ত ছিল দীর্ঘ ঋজু ওকগাছের সারি, এদের ঘন পল্লবিত, সুদূর প্রসারিত শাখা-প্রশাখা ভীতিকর, বিষণ্ন ছায়াচ্ছন্নতা সৃষ্টি করেছিল। আরমান্ডের শাসনও কড়া ছিল, আনন্দ ভুলে গিয়েছিল তার নিগ্রো দাস-দাসীরা। আরমান্ডের বাবা কিন্তু সহজ মানুষ ছিলেন, তাদের দোষত্রুটি তিনি ক্ষমার চোখে দেখতেন এবং তারা সুখেই ছিল তখন।
ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছিল তরুণী মা, লেসের পাড় বসানো সাদা নরম মসলিনের পোশাক পরে ও সোফায় শুয়েছিল, পাশেই শিশুটি ওর বাহুর ওপর মায়ের দুধ খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। জানালার পাশে বসে নার্স হাতপাখা দিয়ে নিজেকে বাতাস করছিল।
মাদাম ভ্যালমন্ড তার ভারী শরীরটা ডেজিরের ওপর নামিয়ে চুমু দিয়ে দুহাতে ওকে জড়িয়ে রাখলেন একটুক্ষণ। তারপর শিশুর দিকে ফিরে হঠাৎ চমকে ওঠা বিস্ময়ের সুরে বলে উঠলেন, ‘এ তো সেই শিশু নয়!’ সেই সময় ভ্যালমন্ডে ফরাসি ভাষায় কথা বলা হতো।
ডেজিরে হেসে উঠে বলল, ‘আমি জানতাম তুমি আশ্চর্য হয়ে যাবে, এই দুধের শিশু, কিভাবে যে বড় হয়েছে; ওর পা-দুটো দেখো মা, হাত আর নখ দেখো, একেবারে আসল নখ, আজ সকালেই তো জ্যানড্রিন কেটে দিলো। সত্যি না জ্যানড্রিন?’
পাগড়ির মতো করে পেঁচানো, টুপি পরা মাথাটা রাজসিক ভঙ্গিতে ঝুঁকিয়ে জ্যানড্রিন বলল, ‘হ্যাঁ, মাদাম।’ ডেজিয়ে আরো বলল, ‘আর যেভাবে ও কাঁদে, কানে তালা লেগে যায়। সেই কত দূরে লা’ব্লাশের কেবিন, আরমান্ড একদিন সেখানে গিয়ে শুনতে পেয়েছে ওর কান্না।’
মাদাম ভ্যালমন্ড দেখতেই লাগলেন শিশুটিকে, তারপর কোলে তুলে তিনি সবচেয়ে আলোকিত জানালার কাছে গিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন, তারপর অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে জ্যানড্রিনের দিকে তাকালেন, মাঠের ওপারে তাকিয়ে ছিল জ্যানড্রিন, ওর মুখটা জ্বলজ্বল করছিল।
মাদাম ভ্যালমন্ড শিশুটিকে মায়ের পাশে নামিয়ে দিতে দিতে ধীর গলায় বললেন, ‘হ্যাঁ, বাচ্চাটা বড় হয়েছে, বদলে গেছে, আরমান্ড কী বলে?’
আলো ছড়িয়ে পড়তে লাগল ডেজিরের মুখের ওপর, সে-আলো সুখেরই অপর নাম।
‘ওহ মা! কি যে গর্ব আরমান্ডের, এরকম বাবা সহজে দেখা যায় না, ছেলে হয়েছে, বংশের নাম নেবে বলেই হয়তো আমার বিশ্বাস, যদিও কথাটা ও বলে না, বলে মেয়ে হলেও একইরকম ভালোবাসত, কিন্তু আমি জানি সত্যিটা ও বলে না, আমাকে খুশি করার জন্যই ওরকম বলে।’ তারপর ও মাদাম ভ্যালমন্ডের মাথাটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ‘আর শোনো মা, ওর জন্মের পর আরমান্ড কাউকে কোনো শাস্তি দেয়নি, একজনকেও না, এমনকি নেগ্রিয়ন যে কাজ ফাঁকি দেবার জন্য পা পুড়িয়ে ফেলার ভান করল – তবুও কেবল হেসে বলল, নেগ্রিয়ন দুষ্টুমিতে ওস্তাদ। মাগো, আমি যে কি খুশি, আমার ভয় করত ওর ব্যবহারে।’
যথার্থই বলেছিল ডেজিরে, বিয়ে এবং শিশুর জন্ম – এ-দুটি বিষয় আরমান্ড অবিনির মনটাকে নরম করে দিয়েছিল। আগে ও দাসদাসীদের কাছে মাত্রাতিরিক্ত দক্ষতা ও শ্রম দাবি করত এবং প্রশ্নাতীতভাবে তার কথা না মানলে ভয়ঙ্কর রেগে যেত। ওর পরিবর্তনে খুশি হয়েছিল সহৃদয় ডেজিরে; আরমান্ডকে ও পাগলের মতো ভালবাসত, ওর ভ্রুকুটিতেও কেঁপে উঠত ডেজিরে; কিন্তু তাতে ভালোবাসা কমে যেত না। ওর জন্য ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠতম আশীর্বাদ ছিল আরমান্ডের হাসি। তেমন সাদা ছিল না সুপুরুষ আরমান্ড আর প্রেমে পড়ার পর থেকে ওর সুন্দর চেহারাটা ভ্রুকুটিতে বেঁকেচুরে যেতেও বিশেষ দেখা যায়নি।
শিশুটি তিন মাসের হতে চলেছিল; কিন্তু ইতোমধ্যেই ডেজিরে অনুভব করল বাতাসে অশনিসংকেত। তারপরই প্রত্যক্ষ করল ওর শান্তির পথে চরম হুমকিস্বরূপ পরিস্থিতি।
প্রথমদিকে প্রায় না বোঝার মতো কেবল অস্বস্তিকর ইঙ্গিতে সীমাবদ্ধ ছিল বিষয়টা, কালোদের মধ্যে রহস্যের বাতাস খেলছিল, অযাচিতভাবে এবং কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই বহুদূরের প্রতিবেশীরা এসে উপস্থিত হচ্ছিল। তারপর ওর স্বামীর ব্যবহারও অদ্ভুত যন্ত্রণাদায়কভাবে বদলে যেতে লাগল, কিন্তু কেন – তা জিজ্ঞেস করার সাহস ডেজিরের ছিল না। ওর দিকে না তাকিয়ে কথা বলত আরমান্ড, সে-চোখ থেকে যেন আগের সেই ভালোবাসার আলো নিভে গিয়েছিল। প্রায়ই আরমান্ড বাড়ি আসত না, যখন আসত তখনো ডেজিরে আর শিশুটিকে এড়িয়ে চলত, বলত না কেন বা কী হয়েছে। দাসদাসীদের সঙ্গে ব্যবহারে হঠাৎ মনে হলো যেন আসল শয়তান ভর করল ওকে। হতাশার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল ডেজিরে। মৃত্যু – সে আর কত বা কঠিন।
সেদিন বিকেলে গরম পড়েছিল। নিজের ঘরে হালকা পোশাক পরে কাঁধ ঘিরে নেমে আসা দীর্ঘ রেশম বাদামি চুলে নিরাসক্ত হাত রেখে বিছানার পাশে বসেছিল ডেজিরে। সিংহাসনের মতো কারুকার্যখচিত, মেহগনি কাঠের মহামূল্যবান সে-বিছানা, তার ওপরের অর্ধেকে স্যাটিনের ঝালর দেওয়া সামিয়ানা। বাচ্চাটা খালি গায়ে মায়ের বিছানায়ই ঘুমাচ্ছিল। লা’ব্লাশের দ্বিজাতিক ছোট ছেলেদের একজন – তারও গায়ে কাপড় ছিল না – পাশে দাঁড়িয়ে ময়ূর পালকের পাখা দিয়ে শিশুটিকে ধীরে বাতাস করছিল। ডেজিরের বিষণ্ন চোখদুটো স্থির ছিল শিশুর দিকে কিন্তু দৃষ্টি ছিল না, যে ভীতিকর কুয়াশা ওকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছিল তারই জাল ভেদ করার সংগ্রাম চলছিল ওর ভেতর। একসময় নিজের বাচ্চার দিকে তাকিয়ে পাশে দাঁড়ানো ছেলেটির দিকে তাকাল ডেজিরে, আবার তাকাল, বারবার একইভাবে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখতে দেখতে ওর অজান্তে আর্তনাদের মতো বেরিয়ে এলো ‘আহ!’ এ-শব্দ সচেতন উচ্চারণ ছিল না। ওর শিরায় শিরায় রক্ত যেন বরফের মতো জমাট বেঁধে গেল – ঠান্ডা, চটচটে ঘাম জমা হলো সারামুখে।
ছেলেটির সঙ্গে কথা বলতে চেষ্টা করল ডেজিরে, প্রথমে কোনো শব্দ বেরোল না, পরে নিজের নাম শুনে ছেলেটি চোখ তুলে দেখল গৃহকর্ত্রী ওকে দরোজা নির্দেশ করছেন। তখন ও বিশাল নরম পাখাটা নামিয়ে রেখে পালিশ করা মেঝের ওপর খালি পায়ের আঙুলে ভর করে বাধ্য ছেলের মতো চুপিসারে যেন পালিয়ে গেল। ভীতসন্ত্রস্ত চেহারায় বাচ্চার দিকে দৃষ্টি নিবন্ধ করে অনড় বসে রইল ডেজিরে।
কিছুক্ষণ পরেই ওর স্বামী ঘরে এলো, ওর দিকে না তাকিয়ে কাগজপত্রে বোঝাই টেবিলটাতে গিয়ে একটা কাগজ খুঁজতে লাগল সে।
ডেজিরে ডাকল, ‘আরমান্ড’। মনুষ্যত্ব অবশিষ্ট থাকলে বুকে ছুরি বসিয়ে দেবার মতো ওর গলার স্বর। আরমান্ড কিন্তু লক্ষ করল না। ও আবার ডাকল, ‘আরমান্ড।’ তারপর উঠে টলতে টলতে আরমান্ডের কাছে গেল। ওর শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট হচ্ছিল, আরমান্ডের বাহু চেপে ধরে বলল, ‘আরমান্ড, আমাদের বাচ্চাটাকে দেখো, এর মানে কী? বলো আমাকে?’
ধীরে, নিস্পৃহভাবে আরমান্ড নিজের বাহু থেকে ওর আঙুলগুলো ছাড়িয়ে হাতটা ছুড়ে সরিয়ে দিলো। ভগ্নকণ্ঠে ডেজিরে আর্তনাদ করে উঠল, ‘এর মানে কী বলো?’
‘এর মানে বাচ্চাটা সাদা হয়নি, এর মানে তুমি সাদা নও’, হালকা স্বরে উত্তর দিলো আরমান্ড।
এ দোষারোপের অর্থ কী হতে পারে সে-ধারণা দ্রুত অনুধাবন করে প্রতিবাদ করার জন্য এক অভূতপূর্ব সাহস সঞ্চারিত হলো ওর মনে। ‘মিথ্যে কথা, এ-কথা সত্যি নয়, আমি সাদা! দেখো আমার চুল – বাদামি; আর আমার চোখ তো ধূসর; আরমান্ড, তুমি জানো আমার চোখের রং ধূসর, আর আমার ত্বক সাদা’। ওর একটি কব্জি হিঁচড়ে টেনে ধরে বলল, ‘দেখো, আমার হাত, তোমার হাতের চেয়ে সাদা আরমান্ড’, বলে পাগলের মতো হাসতে লাগল ডেজিরে। ‘লা’ব্লাশের মতোই সাদা তুমি’, নিষ্ঠুরভাবে উত্তরটা দিয়ে ওকে আর শিশুটিকে ফেলে বেরিয়ে গেল আরমান্ড।
হাতে কলম ধরার শক্তি ফিরে এলে মাদাম ভ্যালমন্ডকে ও চরম হতাশার এক চিঠি লিখল : ‘মাগো, ওরা বলে আমি সাদা নই। আরমান্ড বলেছে আমি সাদা নই। একথা যে সত্যি নয় তুমি তো জানো। ঈশ্বরের দোহাই ওদের বলো এ-কথা সত্য নয়। আমি মরে যাব। আমাকে মরতেই হবে। এত দুঃখ নিয়ে আমি বেঁচে থাকতে পারব না।’
একই রকম সংক্ষিপ্ত উত্তর এলো : ‘ডেজিরে আমার, তোমার বাড়িতে মায়ের কাছে ফিরে এসো, মা তোমাকে ভালোবাসে। বাচ্চাকে নিয়ে চলে এসো।’
চিঠিটা হাতে এলে ডেজিরে ওর স্বামীর অফিসঘরে গেল। ডেস্কের অপরদিকের চেয়ারে বসে ছিল আরমান্ড, ওর চোখের সামনে চিঠিটা খুলে রেখে নির্বাক-নিশ্চল সাদা পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল ডেজিরে।
নিঃশব্দে, নির্লিপ্ত চোখে চিঠিটা পড়ল আরমান্ড, কিছু বলল না।
‘আমি কি চলে যাব আরমান্ড?’ অনিশ্চিত উদ্বেগ আর উত্তেজনায় যন্ত্রণাক্লিষ্ট তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞেস করল ডেজিরে।
‘হ্যাঁ, চলে যাও।’
‘তুমি চাও আমি চলে যাই?’
‘হ্যাঁ, আমি চাই তুমি চলে যাও।’
ওর ধারণা হয়েছিল ঈশ্বর ওর সঙ্গে নিষ্ঠুর ও অন্যায় আচরণ করেছেন আর ও স্ত্রীর বুকে ছুরি বসিয়ে ঈশ্বরকে তার প্রতিদান দিচ্ছে। তাছাড়া তখন ডেজিরের জন্য ওর কোনো ভালোবাসা ছিল না। কারণ অসচেতন হলেও ডেজিরে ওর পিতৃগৃহ ও বংশ মর্যাদায় ক্ষত সৃষ্টি করেছিল।
আঘাতে হতবুদ্ধি ডেজিরে ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীরে দরোজার দিকে হাঁটতে লাগল, তবু আশা করছিল আরমান্ড ফিরে ডাকবে।
‘চলি আরমান্ড’, করুণ স্বরে বলল ডেজিরে।
কোনো উত্তর দিলো না আরমান্ড, এভাবেই ভাগ্যকে শেষ আঘাত হানল সে।
শিশুটিকে খুঁজতে গেল ডেজিরে। জ্যানড্রিন ওকে কোলে নিয়ে প্রায়ান্ধকার বারান্দায় পায়চারি করছিল। কোনো কথা বলল না ডেজিরে – কেবল ওর কোল থেকে শিশুটিকে নিজের কোলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ওক গাছের শাখা-প্রশাখায় 888sport app পথ দিয়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল।
সে অক্টোবরের এক বিকেল। সূর্য মাত্র অস্তে চলেছে। দূরে নিস্তব্ধ মাঠে মাঠে নিগ্রো দাসদাসীরা তখনো তুলো সংগ্রহ করছিল।
ডেজিরে কাপড় বদলে আসেনি, ওর পরনে ছিল সাদা, পাতলা পোশাক আর পায়ে ছিল স্লিপার, চুলও খোলা ছিল, অস্তাগামী সূর্যরশ্মি স্বর্ণাভা দিলো ওর বাদামি চুলের রাশিতে। বহুদূর ভ্যালমন্ড খামারের প্রশস্ত, পেটানো রাস্তায় ও গেল না, হাঁটতে শুরু করল ফসল কেটে নেওয়া এক পরিত্যক্ত মাঠের ভেতর দিয়ে, ফসলের শক্ত ধারাল গোড়ায় ওর হালকা স্লিপার পরা অনভ্যস্ত পা ছিঁড়ে যেতে লাগল, পরনের পাতলা গাউনটা টুকরো টুকরো হয়ে গেল। কাছেই নদীর এক সংকীর্ণ অথচ গভীর ও মন্থরগতি শাখা ছিল, তারই তীরভূমির নলখাগড়া আর উইলোর ঘন বনে ও অদৃশ্য হয়ে গেল, আর কখনো ফিরল না।
কয়েক সপ্তাহ পর লা’আব্রিতে এক অদ্ভুত দৃশ্য সংঘটিত হলো। বাড়ির পেছনের মসৃণ, পরিচ্ছন্ন উঠোনের মাঝখানে প্রজ্বলিত হলো এক বিশাল অগ্নিকুণ্ড। এই চমৎকার নাটকীয় দৃশ্যটি উপভোগ করার জন্য আরমান্ড অবিনি বসেছিল বাড়ির ভেতরের সুপ্রশস্ত করিডরে এবং অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত রাখার জন্য নিজেই ছ-জন দাসদাসীর হাতে বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করছিল। কাঠ সাজিয়ে তৈরি হয়েছিল অগ্নিকুণ্ডের মঞ্চ, তার প্রথম আহার ছিল নবজন্মলব্ধ শিশুর মহামূল্যবান পোশাক ও বিছানার সরঞ্জাম, তার ওপর সেই চিতায় স্থাপন করা হলো নিখুঁত সমস্ত সাজসজ্জাসহ উইলো কাঠের সুন্দর এক দোলনা। তারপর সে-অগ্নিকুণ্ডে সমর্পিত হলো রেশম, ভেলভেট, স্যাটিন আর লেসের পোশাক, কত যে-সূচি888sport live chat, কত রকমের মাথার টুপি, হাতের দস্তানা আর সেই ফুলের সাঁজি, কারণ বিয়ের সে-উপহারসামগ্রী তো সহজে মেলে এমন ছিল না।
চিতায় নিক্ষিপ্ত করার শেষ বস্তু ছিল একগুচ্ছ চিঠি, ওদের বিয়ের আগে ডেজিরের হাতে লেখা ছোট নির্মল কিছু চিঠি। ওই একই ড্রয়ারে ডেজিরের পত্রগুচ্ছের পেছনে আর এক টুকরো চিঠি আরমান্ডের চোখে পড়ল। ডেজিরের নয়, ওর বাবাকে লেখা মায়ের পুরনো চিঠির টুকরো। চিঠিটা আরমান্ড পড়ল। মা ওর বাবার ভালোবাসার আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন তাই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছেন :
‘কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা’, তিনি লিখছেন, ‘আমি দিনরাত ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাই কারণ তিনি আমাদের জীবন এমনভাবে সাজিয়ে দিয়েছেন যে আমাদের প্রিয় আরমান্ড, মায়ের আদরের ধন আরমান্ড কোনোদিন জানবে না, তার মা দাস নামধারী অভিশপ্ত জাতেরই একজন।’
লেখক পরিচিতি
১৮৫১ সালে মিসৌরির সেন্ট লুইসে ফরাসি মাতা ও আইরিশ পিতার সন্তান কেট শোঁপ্যার জন্ম হয়। জন্মগত কারণেই বাড়িতে ফরাসি ও ইংরেজি দুই ভাষারই প্রচলন ছিল। কেটের শৈশব ছিল দুঃখময়, বোনেরা শিশুকালেই মারা যায়। একটি ভাই ছিল কেটের, সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার কিছুকাল পর টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে ভাইটিও মারা যায়। কেটের বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তাঁর বাবা ট্রেন দুর্ঘটনায় মারা যান। স্কুলে কেট সবসময়ই প্রথম হতো; কিন্তু শিক্ষকেরা তাঁকে নিঃসঙ্গ একটি মেয়ে হিসেবেই জানতেন। বিশ বছর বয়সে কেট অস্কার শোঁপ্যা নামে লুইজিয়ানার এক খামার মালিকের ছেলেকে বিয়ে করেন। আটাশ বছর বয়সেই কেট ছয় সন্তানের জননী হন। কেটের বয়স যখন বত্রিশ তখন তাঁর স্বামী ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তারপর কেট সেন্ট লুইসের যে-বাড়িতে বড় হয়েছিলেন সেখানে মায়ের কাছে ফিরে আসেন। সংসার নির্বাহ করার জন্য তখন থেকেই তাঁর লেখালেখির শুরু। লেখার প্রধান বিষয় ছিল বিবাহ, মুক্তি, জাতি, দাসপ্রথা ও মেয়েদের বয়ঃপ্রাপ্তি। 888sport promo code চরিত্রকে কেট স্বাধীন সত্তা দিয়ে নির্মাণ করতেন, কারণ তিনি বড় হয়েছিলেন শক্তিময়ী 888sport promo codeসঙ্গ লাভ করে। তিনি একলা চলায় সমর্থ মা, মাতামহী ও প্রমাতামহী দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিলেন, তাঁরা সকলেই অল্পবয়সে স্বামী হারান। তাঁর প্রমাতামহী (great great grandmother) সেন্ট লুইসের প্রথম 888sport promo code যিনি আইনত অধিকার লাভ করে স্বামীকে ত্যাগ করেছিলেন এবং পাঁচটি সন্তান মানুষ করে তুলেছিলেন, একই সঙ্গে জাহাজের ব্যবসা চালাতেন। মেয়েদের সক্ষমতায় কখনো কেটের সন্দেহ ছিল না আর এজন্যেই তাঁকে ‘888sport promo codeবাদী’ নামে অভিহিত করা হয়েছিল; কিন্তু কেট নিজেকে কখনো 888sport promo codeবাদী হিসেবে স্বীকার করেননি, তিনি নিজেকে আধুনিক লেখক মনে করতেন। 888sport promo code স্বাধীনতা ও ক্ষমতাকে স্বাভাবিক জেনেই বড় হয়েছিলেন কেট, তাই 888sport promo codeবাদী হিসেবে বিশেষায়িত হবার কারণ খুঁজে পাননি তিনি। কিন্তু কেট নিজেকে 888sport promo codeবাদী হিসেবে না দেখলেও তিনি যে পুরুষের সমপর্যায়ের শক্তি ও সক্ষমতা দিয়ে 888sport promo code-চরিত্র নির্মাণ করতেন তা তাঁর সময়ের বিপরীতে ছিল। আমেরিকায় 888sport promo code ভোটাধিকার অর্জিত হয়েছিল আরো অনেক পরে।
সেন্ট লুইসের একটি বিশ্বমেলা থেকে ফিরে কেট তাঁর এক পুত্রকে মাথাব্যথার কথা জানান। ১৯০৪ সালে মাত্র চুয়ান্ন বছর বয়সে মস্তিষ্কে রক্তক্ষণ হয়ে কেট শোঁপ্যার মৃত্যু হয়।
এখানে তাঁর ‘Desiree’s Baby’ গল্পটি ‘ডেজিরের শিশু’ নামে অনূদিত হয়েছে। লুইজিয়ানা আমেরিকার একটি প্রদেশ কিন্তু এটি একসময় ফ্রান্সের অধিকারে ছিল। ফ্রান্সের রাষ্ট্রপ্রধান নেপোলিয়ন বোনাপার্ট আমেরিকার প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের কাছে মাত্র ১৫ মিলিয়ন ডলারে লুইজিয়ানা বিক্রির প্রস্তাব পাঠান। প্রেসিডেন্ট জেফারসন সম্মত হন এবং ১৮০৩ সালে লুইজিয়ানা আমেরিকার অধিকারভুক্ত হয়। এই কাণেই লুইজিয়ানায় ফরাসি ভাষার প্রচলন ছিল, বহু জায়গার নাম ফরাসি ভাষায় ছিল এবং ফ্রান্সের সঙ্গে লুইজিয়ানার অধিবাসীদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.