তিমিরের তীরে

মনি হায়দার

 

আপনারা আসমান আলীকে চিনতে পারবেন না।

না, আসমান আলী কোনো আশ্চর্য প্রদীপ পায়নি। কিংবা হয়নি কোনো মন্ত্রী-টন্ত্রী। মানুষ হিসেবে ঠিকই আছে। রক্ত, মাংস, কাম, ক্রোধ-রিপু মিলিয়ে আগের মতোই আসমান আলী আছে আসমান আলীর মতোই। প্রশ্ন হচ্ছে – কী এমন ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটল যে আমরা, পরিচিতজনেরা আজ আসমান আলীকে চিনতে পারছি না?

হ্যাঁ, পরিবর্তন তো কিছুটা হয়েছেই।

অবশ্য পরিবর্তনটা বাহ্যিক। অর্থাৎ বাইরের পোশাকে-আশাকে এক আকর্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে তার। সাধারণত তাকে, আমাদের আসমান আলীকে আমরা যে পোশাক-আশাকে দেখি, আজকে দেখছি ব্যতিক্রম। মতিঝিলে একটি মাল্টিপারপাস কোম্পানির খ্যাতিমান এমডির নিজস্ব

পিয়ন আসমান আলী। কোম্পানির এমডি মাহমুদ হোসেন বিশেষ স্নেহ করেন আসমান আলীকে। সে-কারণে অফিসের 888sport app বড়কর্তা থেকে আরম্ভ করে আসমান আলীর নিজের শ্রেণির 888sport app পিয়ন, চাপরাশি-ঝাড়ুদার সবাই একটু ঈর্ষাই করে থাকে। বাঁকা চোখে দেখে। মাঝেমধ্যে নানা প্রকার কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যও করে পেছনে। আসমান আলী শোনে এবং বোঝে। কিন্তু প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে না। কারণ উপভোগ করে। আপন মনে বলে  –  শালারা, তোমাগো গা চুলকায় পরের ভালো দেখলে?

বড় অফিসের কাজকর্মই আলাদা। অন্যরকম। যেমন বড় সাহেব, মাঝারি সাহেব, ছোট সাহেব  –  যত রকম সাহেব আছে তারা অফিসে কি পোশাক পরে আসল কি আসল না, তাতে কারো কিছু যায় আসে না। কিন্তু শালার পিয়ন, চাপরাশির গোষ্ঠীর যদি কেউ একদিন অফিস থেকে দেওয়া পোশাক না পরে আসে একশ টাকা ফাইন। এমনকি চাকরিও চলে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। মাস ছয়েক আগে ফারহাত হোসেনের চাকরিটা নট হয়ে গেল। কারণ সে অফিসের পোশাক পরে আসেনি। ওকে একটা কৈফিয়তেরও সুযোগ দেওয়া হয়নি। বেচারা ফারহাত কাঁদতে-কাঁদতে চলে গেল। ফারহাত হোসেনের পরিণতি দেখে অফিসের চাপরাশি, পিয়ন, আরদালি প্রত্যেকে অফিসের দেওয়া জামা-প্যান্ট পরেই আসে।

আসমান আলী প্রতিদিন সকাল নটায় অফিসে আসে। এই অফিসে নির্দিষ্ট সময়ে আসা বিষয়ক যদি কোনো প্রতিযোগিতা হয়, আপনাদের অনেক দিনের চেনা আসমান আলী অনিবার্যভাবে প্রথম 888sport app download bdটি পাবে। পাবেই। অফিসে এসে প্রথম কাজ এমডি মাহমুদ হোসেনের বাসায় ফোন করা। মাহমুদ হোসেনের দিনের করণীয় তালিকাটা জেনে নেয়। এমডি কখন অফিসে আসবেন কি আসবেন না, জানান আসমান আলীকে। আসমান আলী  বসের দেওয়া আদেশ-নিষেধ-উপদেশ যথাযথ কর্মকর্তাকে পৌঁছে দিয়ে অফিস কক্ষটি ঝাড়ামোছা করে খুব যত্নের সঙ্গে। ঝাড়ামোছার পর সে এক কাপ চা পান করে, অনেকটা আয়েশি ভাবগম্ভীর পরিবেশে। যখন এমডির রুমের সামনে বসে তারিয়ে-তারিয়ে হাতে কাপ-পিরিচ নিয়ে আলতোভাবে ঠোঁটে চুমুক দিয়ে চা পান করে  –  মনে হয় মৃগয়ায় আসা আধুনিককালের কোনো রাজকুমার হরিণ শিকার শেষে আনমনে চা পানের সঙ্গে বিশ্রাম নিচ্ছে।

আমার আপনার এই আপন, পরিচিত লোকটাকে যদি হঠাৎ অন্য জায়গায় ভিন্ন রকম কেতাদুরস্ত পোশাকে মোড়ানো শরীর দেখে চমকে ওঠেন বা উঠি, সেটাকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় বা যাবে বলে মনে হয় না। আর স্বাভাবিক বুদ্ধিমাত্রার মানুষেরা দোষ দিলে মানবেও না কেউ।

বাহুল্য থাক। বলছিলাম আসমান আলীকে চিনতে না পারার প্রসঙ্গে। কেন আপনারা বা আমি, যে আসমান আলীর গল্পটা বলছি  –  আমরা দুপক্ষই কেন আসমান আলীকে চিনতে পারব না! চিনতে না পারার গল্প যদি আমাকে আনুপাতিক হারে সবটুকু বলতে হয়, তার আগে আসমান আলীর নিজস্ব আরো কিছু ব্যাপার-স্যাপার বা ব্যক্তিগত জীবনযাপন, সংসার, স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, বয়স, শিক্ষাগত যোগ্যতা ইত্যাদি জানা দরকার। আসমান আলীর বয়স কত সেটা দেখে বোঝা বা অনুমান করা কঠিন। তাকে পঁয়ত্রিশ বছর বা আটত্রিশ বছরের একজন মানুষ বলে অনায়াসে চালানো যায়। স্বাস্থ্যটা ভালো। পেটা শরীর, মাথায় হালকা চুল। ডানপাশে দীর্ঘ সিঁথি, নাকটা সুচালো। মুখ  –  মুখম-লের তুলনায় একটু ছোটই। চোখদুটো মানানসই। শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট যদি দেখেন আপনারা, তাহলে বয়স প্রায় সাতচলিস্নশ বছর। পুরো সাতচলিস্নশ হতে মাস তিনেক বাকি। শিক্ষাগত যোগ্যতার সার্টিফিকেট যখন দেখবেনই, তখন কেবল বয়স কেন? শিক্ষাগত যোগ্যতাও দেখে নিন। আসমান আলী ম্যাট্রিক পাশ দ্বিতীয় বিভাগে, যশোর বোর্ড থেকে। ব্যক্তিগত রোজনামচায় জানা যায়, আসমান আলী কেবল ম্যাট্রিক পাশ করেই থামতে চায়নি, সে ডিগ্রি কিংবা মাস্টার ডিগ্রি পাশও করতে চেয়েছিল। কিন্তু ম্যাট্রিকের পর ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা পরপর তিনবার দিয়ে ব্যর্থতার পর পিতা কৃষক মোহাম্মদ সাদেক আলী (প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী থেকে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদপ্রার্থী নয়) প্রাচীন রূপকথার অনুসরণে রেগেমেগে স্ত্রী জয়তুন বেগমকে বলে  –  হারামজাদারে আর ভাত দিও না, ছাই দাও।

কৃষক পিতার মুখে আপত্তিজনক উক্তি শ্রবণ করে পিরোজপুর জেলার কচানদীর পাড়ের গ্রাম – বোথলার অভিমানী পুত্র আসমান আলী 888sport appগামী একটি দোতলা লঞ্চে উঠে বসল সবার অজামেত্ম। শুরু হলো প্রবাসজীবন। 888sport app শহরে তার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাসা ছিল আগে থেকেই। সেই দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয় তাকে এমডি মাহমুদ হোসেনের কাছে অর্পণ করলে সেখানেই খাসকামরার খাস-চাকরিটা পেয়ে যায়। বাড়িতে মা-বাবা অত বড় ধাড়ি পুত্রের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। আসমান আলীর মা জয়তুন বেগম কেঁদেকেটে আকুল। বাবা কৃষক মোহাম্মদ সাদেক আলী কী করবে, পুত্র-সন্ধানে কোথায় যাবে বুঝতে পারে না। গ্রামবাসীর পরামর্শে বাবা সাদেক আলী পাড়েরহাটের ইয়াসিন মাওলানার কাছে আসে পুত্র হারিয়ে যাওয়ার বৃত্তান্ত বিষয় অবগত হওয়ার জন্য। সাত-সাতটা শুক্রবার ঘুরিয়ে অষ্টম শুক্রবারে ইয়াসিন মাওলানা জানায় – কাইল রাতে আমি তোমার পোলার লগে কথা কইছি।

কথা কইছেন? সাদেক আলী নিশ্চিত হতে চায়।

হয়, কইছি – নিশ্চয়তা প্রদান করে ইয়াসিন মাওলানা।

কোথায় আমাগো পোলা আসমান আলী?

কোকাব শহরে।

হেইডা কোথায়?

ইয়াসিন মাওলানা সরাসরি তাকায় সাদেক আলীর দিকে –  কোকাব শহর হইল আসমানে, পরিরাজ্যে। তোমাগো পোলা আসমান আলীরে পরিরা লইয়া গেছে। আমি বিশেষ ব্যবস্থায় গভীর রাইতে কথা কইছি হের লগে। হে তো আইতে চায় না। কোকাব শহরে খুব সুখে আছে।

কন কি হুজুর? প্রায় ডুকরে ওঠে কৃষক মোহাম্মদ সাদেক আলী  – এই কতা পোলার মায় হোনলে মইরা যাইবে –

একটা কাম করতে পারবা?

কী কাম হুজুর?

তিনটা কালা রঙের খাসি ছাগল, বিশ কেজি সাক্করখানা চাল আর পাঁচটা রাওয়া মোরগ আনতে পারবা?

সাদেক আলী অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে ইয়াসিন মাওলানার শ্মশ্রম্নময় উদ্ভাসিত মুখের দিকে। সে বুঝতে পারছে না, পরিরাজ্যে কোকাব শহর থেকে তার ছেলে আসমান আলীকে নিয়ে আসার সঙ্গে তিনটি কালো রঙের খাসি, বিশ কেজি সাক্করখানা চাল আর পাঁচটা মোরগের সঙ্গে কী সম্পর্ক!

ইয়াসিন মাওলানা বড় বিরক্তি প্রকাশ করে – শোনো, তোমার ছেলেকে ফিরিয়ে আনতে হলে পরিরাজ্যের রানি মোহতারেমা দিলরাশ সালসালবিলকে এসব নজরানা দিতে হবে, যদি দিতে পারো ছেলেকে ফিরে পাবে। দিতে না পারলে পাবা না। আর আমারে জ্বালাইও না। এসব কাজ করা কঠিন। দিতে পারলে আগামী শুক্রবার আইসো –

আচ্ছা, একটা দীর্ঘ সালাম প্রদান করে কৃষক মোহাম্মদ সাদেক বাড়িতে ফিরে আসে। জয়তুন বেগমের কাছে সব খুলে বললে জয়তুন বেগম সঙ্গে-সঙ্গে মনস্থির করে ফেলে ইয়াসিন মাওলানা হুজুরে যা-যা চেয়েছে সব দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। নিজের আছে দুটি খাসি এবং অবশ্যই কালো রঙের। মোরগ নাই খোপে একটাও। সব মুরগি।

সুতরাং যা আছে বিক্রি করে পাঁচটি মোরগ কিনবে। আর মাচায় তোলা আমন ধানের বীজ বিক্রি করে বিশ কেজি সাক্করখানা চাল কিনবে।

জয়তুন বেগমের তীব্র তাড়াহুড়োয়, দাপাদাপিতে ত্যক্তবিরক্ত স্বামী কৃষক মোহাম্মদ সাদেক আলী মার্দার্সীর বাজার, ইকড়ি বাজার, তেলিখালী বাজারে ঘুরে সব ঠিকঠাক কিনে আনে। বুধবার সব বাজার শেষ করে এনেছে, বৃহস্পতিবার দিনটা মাঝখানে, শুক্রবার সকালে তিনটা কালো খাসি, পাঁচটা মোরগ আর বিশ কেজি সাক্করখানা চাল নিয়ে যাত্রা করবে কৃষক মোহাম্মদ সাদেক আলী, পাড়েরহাটে ইয়াসিন মাওলানার বাড়ি। সিদ্ধান্ত হয়েছে এবার সঙ্গে স্ত্রী জয়তুন বেগমও যাবে।

বৃহস্পতিবার দুপুর বেলা আচানক গ্রামের ডাক পিয়ন বারেক মিয়া হাজির। হাতে চিঠি এবং সাতশ টাকা। ঘটনা কী? চিঠি খুলে জানা গেল তাদের পুত্র কোকাব শহরে পরিদের রাজ্যে নয়, আছে 888sport app শহরে। সেখানে একটি বিরাট কোম্পানির এমডি মাহমুদ হোসেনের খাস পিয়ন পোস্টে চাকরি করে। বেতন মাসে দশ হাজার টাকা। চিঠিতে পুত্র – পিতা এবং মাতার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে না বলে আসার জন্য। দুমাস পর ছুটি নিয়ে সে বাড়ি আসবে –  তখন কার জন্য কী আনতে হবে তার লিস্ট পাঠাতে বলেছে।    কোথায় পরিরাজ্যে কোকাব আর কোথায় 888sport app শহর? সব মিলেমিশে

একাকার এখন কৃষক মোহাম্মদ সাদেক আলী ও জয়তুন বেগমের সংসারে। সারা গ্রামে একটা সাড়া পড়ে। কৃষক মোহাম্মদ সাদেক আলীকে এখন গ্রামের মাতুববরেরা গ্রাম্য সালিশিতে ডাকে। চেয়ারে বসতে দেয়।

আমি এবং আমার সঙ্গে পাঠকেরা ট্রেন মিস করার কায়দায় গল্পের মূল চরিত্র আসমান আলীকে বাদ দিয়ে আসমান আলীর পিতা এবং মাতাকে নিয়ে অধিক মাতামাতি করেছি। গল্পের স্বার্থেই আমাদের সঠিক জায়গায় অর্থাৎ গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরে আসা দরকার। গল্পের ডালপালা-শাখা বিস্তারের কারণে আমাদের ফিরে যেতেই হচ্ছে গ্রামে, কৃষক মোহাম্মদ সাদেক আলীর দরবারে। পুত্র 888sport appয় বড় অফিসে বড় চাকরি করে, মাস গেলে হাজার টাকা পাঠায়, পুত্রের কাছে কন্যার পিতারা তাদের কন্যাকে অর্পণ করার জন্য স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই আগ্রহের আতিশয্যের লক্ষে বছরখানেকের মধ্যে আবদুল জববারের কন্যা মিস মরিয়মের সঙ্গে আসমান আলীর বিবাহ যথাসময়ে সম্পন্ন হলো।

বিবাহের পর আমাদের গল্পের প্রধান চরিত্র আসমান আলী তার স্ত্রী মরিয়মকে 888sport appয় নিয়ে আসে। বাসা মাদারটেকে। আদরে-ভালোবাসায় আহ্লাদে সময় গড়িয়ে যায়। বছরে-বছরে তাদের সংসারে বাচ্চা আসতে থাকে। বাচ্চা আসার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কিন্তু আসমান আলীর অফিসে বেতন বাড়ে না। এখন তাদের অর্থাৎ আসমান আলী এবং তার স্ত্রী মরিয়ম বিবির খামারে পাঁচ-পাঁচটি সন্তান। চারটি মেয়ে। নাম যথাক্রমে – সোনালি, রুপালি, চৈতালি এবং বৈকালি। সর্বশেষে এসেছে ছেলে। নাম চাঁদ সওদাগর। অভাবে-অভিযোগে হাসি-কান্নায় সংসার মোটামুটি চলে যাচ্ছে আসমান আলীর। কিন্তু –

গল্প তো প্রায় শেষ, সেখানে আবার কিন্তু কেন? প্রশ্ন ওঠা সংগত। উত্তরে লিখতে হচ্ছে, আসলে এতক্ষণ গল্পটির কেবল গৌরচন্দ্রিকা হচ্ছিল। ‘কিন্তু’ থেকেই গল্পের মূল আখ্যান শুরু বলা যায়।

সংসার, প্রজনন, যৌনতৃষ্ণার কাতরতা, স্নেহ-মমতা, নির্দিষ্ট সময়ে অফিসে আসা, বসের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করার বাইরে বা ভেতরেও আলীর নিজস্ব একটা জগৎ আছে। থাকতে পারে। অথবা থাকাটাই স্বাভাবিক। আসমান আলীকে গল্পের শুরুতে চিনতে না পারার কারণ – আসমান আলীর নিজস্ব জগতের দৃশ্যমান দৃশ্যটির জন্য। নিয়মিত যে-পোশাকে অফিসে আসে, বাজার করে, আজকে আমরা দেখছি ভিন্ন পোশাকে। দামি কাপড়ের প্যান্ট এবং সাফারি পরিধান করেছে আসমান আলী। একেবারে ক্লিন শেভ। পায়ের বুট জোড়া চকচক করছে। বোঝা যায় কালি করিয়েছে। নিয়মিত বাসের যাত্রী। হাতে থাকে একটি টিফিন ক্যারিয়ার। কিন্তু এখন দেখছি হাত খালি। সে দুপুরের খাবার খায় অফিসে, বড় সাহেব মাহমুদ হোসেনের খাওয়ার পর প্রায় সময়ে কিছু অবশিষ্ট থাকে – সেই অবশিষ্টের সঙ্গে বাসা থেকে আনা টিফিন ক্যারিয়ারের খাবার মিলিয়ে দিব্যি রাজভোগ খায় আসমান আলী।

বড় সাহেবের খাবারটা আসমান আলীই এনে দেয় তাঁর ইচ্ছে অনুসারে ফাইভ স্টার হোটেল থেকে। কত দিন, কত সময়ে আসমান আলী বড় সাহেবের সঙ্গে এসেছে ফাইভ স্টার হোটেলে। কিন্তু কখনো মাহমুদ হোসেনের মতো হোটেলে ঢুকে খেতে পারেনি। গাড়ির ড্রাইভার সিকান্দার বখতের সঙ্গে গাড়িতে বসে থেকেছে। কখনো-কখনো ফাইভ স্টার হোটেলের বয় এসে আসমান আলীকে খবর দিয়ে ভেতরে নিয়ে গেছে। বয়ের পেছনে যেতে-যেতে আসমান আলী ভেবেছে, আজ নিশ্চয়ই বস তাকে বলবেন – আসমান আলী, সারাটা জীবন তো আমাকে এখান থেকে নিয়ে-নিয়ে খাওয়ালি, আজ বস আমার সঙ্গে – খা একদিন।

বসের সামনে দাঁড়াতেই ডান হাতে রান চিবুতে-চিবুতে বাম হাতে কাগজ আর একটা চাবির রিং ধরিয়ে বলেন – এখনই বাসে করে অফিসে যা, এই কাগজটা ম্যানেজারকে দিবি। আর বলবি –  আমার ফিরতে দেরি হবে।

আচ্ছা!

আসমান আলী তীব্র গতিতে চলে আসে ফাইভ স্টার হোটেলের ভেতরের মৌ-মৌ গন্ধের আকর খেয়ে।

মুখে লালা, লোভের তৃষ্ণায় – সাপের লকলকে জিহবার মতো গাছ বায় সে। বাসে চড়ে ঘামে ভিজে ক্ষুধার্ত শরীরে অফিসে পৌঁছে ম্যানেজারকে চাবি বুঝিয়ে নিজের টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে বসে আসমান আলী। স্ত্রী মরিয়মের রান্না ডানকিনি মাছের চ্চচড়ি, একটা ডিমের অর্ধেক ভাজা – সঙ্গে দুটুকরো গোল আলু, একদমই ভালো লাগে না আসমান আলীর। মুখের মধ্যে আড়াআড়ি বালির বাঁধ। সবকিছু বালু। বালুময়। নাকের ফুটোয় স্বাদের চুলো জ্বলে দাউ-দাউ লোভে। শালা, জীবনটাই কানামাছির আউলাঝাউলা যুদ্ধ! স্যারের টেবিলের পাশে দাঁড়ানোর পর নাকের ফুটো পার হয়ে স্বাদের স্রোত পৌঁছেছিল রসনার পাতিলে। সবকিছু বৃথা।

সারাটা জীবনভর কেবল স্যারের খাওয়া এভাবে দেখে যাব, নাকে স্বাদ নেব কিন্তু স্বাদের পদ্মপুকুরে ডুবসাঁতার কেটে জিহবা এবং মাড়ির সংযোগে রসনার তৃপ্তি আর মিটাতে পারব না!

আসমান আলী টিফিন ক্যারিয়ার বন্ধ করে। খেতে ইচ্ছে করে না। অথচ পেটে ক্ষুধা আছে।

আমি এখানে, আপনাদের একটু খেই ধরিয়ে সাহায্য করতে পারি – ইতোমধ্যে আমরা আসমান আলীর কাজকর্ম সম্পর্কে জেনে এসেছি। সে একজন খাঁটি অকৃত্রিম ক্রীতদাস। জীবন চলে তার সরলরেখায়। তার মধ্যে আবার তথাকথিত বিল্পবের ঝড় বইবে কেন, প্রশ্নটা সংগত কারণেই উঠতে পারে। আসলে বিপস্নব-টিপস্নব ওসব কিছু না। লোভ। নিখাত পাস্ত্তরিত লোভ আর মানুষের ভেতর হায়েনার মতো বসবাস করা প্রতিহিংসার প্রলুব্ধ বাতাস আসমান আলীকে নিয়ে এসেছে এখানে।

কোনখানে?

শেষ পর্যন্ত গল্পটা হবে তো? দেখুন তো কোথাকার পান্তা কোথায় এসে জড়ো হচ্ছে বোঝা মুশকিল। না, আর কাক খোঁজা নয়, আমরা ফিরে যাই আমাদের আসমান আলীর কাছে। আসমান আলীর মানবিক হায়েনাবোধ, যেটা লুকিয়ে ছিল জন্মাবধি লোভ এবং প্রতিহিংসার ডানার নিচে, সম্প্রতি তারা দুজন জেগে উঠছে। থেকে-থেকে আসমান আলীর মগজ চূড়ায় টোকা দিচ্ছে আর আসমান আলীর ভেতর আরেকজন আসমান আলী জন্ম দিচ্ছে। সে নিজেকে প্রস্ত্তত করে দিনে-দিনে, পলে-পলে গোপনে গভীর সাবধানে আর একজন মাহমুদ হোসেনের প্রতিপক্ষ হিসেবে। সারাজীবনে না হোক অন্তত একবার, অন্তত একটিবার প্রতিপক্ষ হবেই বসের, বিশাল কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাহমুদ হোসেনের। প্রায় দীর্ঘ এক বছর, বারো মাস, তিনশো পঁয়ষট্টি দিনে, সে, আসমান আলী নিজেকে প্রস্ত্তত করার পর আজ এখানে পাঁচতারা হোটেলের লনে চাকচিক্য আঁটা পোশাক পরিধান করে গাড়ি থেকে নামল।

গাড়ি থেকে নামার পর আমরা, পাঠক সবাই এবং লেখক আসমান আলীকে অসম্মান করতে পারি না। কথাবার্তায় অবশ্যই তাকে সম্মান জানাব। ব্যাকরণ এখানে প্রয়োজন বা গুরুত্ব হারিয়েছে। কারণ সমাজের, রাষ্ট্রের গাড়িঅলাকে দেখলে সম্মান, আদব-লেহাজের বুকে মাথা নুইয়ে, কখনো-কখনো সাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানায়, এখানেও আমাদের সেসব সম্মানের অনুষঙ্গ পালন করতে হবে।

আসমান আলী গাড়ি থেকে নেমে পাঁচতারা হোটেলের লনে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে দারোয়ান প্রায় সাষ্টাঙ্গ সালাম জানায় আসমান আলীকে। মুখে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বাঁহাত পকেটে রেখে ডান হাত সামান্য উঁচু করে দৃঢ় পদক্ষিপে তিনি কাচের দরজার সামনে দাঁড়ান। দাঁড়াতেই দরজা খুলে অপেক্ষমাণ প্রহরী তাকে আবার সালাম জানায়। তিনি মাথাটা একটু নেড়ে সালাম গ্রহণ করেন এবং কয়েক কদম হেঁটে

টেবিল পর্যবেক্ষণ করে একটি টেবিলে বসে পড়েন। বসার সঙ্গে-সঙ্গে ওয়েটার এগিয়ে এসে মেন্যু বুক খুলে দাঁড়ায়। আসমান আলী মেন্যু বুকে চোখ বুলিয়ে কয়েকটি খাবারের অর্ডার দেন। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যায়।

আমাদের আসমান আলী চেয়ারে শরীর এলিয়ে দিয়ে গলার কাছে হাঁসফাঁস করা টাইয়ের বাঁধন একটু ঢিলা করেন। চারদিকে তাকান তিনি সহনশীল চোখে, গভীর আয়তদৃষ্টিতে। সামনের টেবিলে একজোড়া কপোত-কপোতী খাবার চাখতে-চাখতে নিজেরা দৃষ্টির সেলুলয়েডে নিজেদের চাটছে লজেন্সের রসে। আসমান আলী ব্যাপারটা দেখেন আর আপন মনে হাসেন। মনে-মনে বলেন  –  বাছাধনেরা, এই রকম চাখার জীবন আমাদেরও এক সময়ে ছিল। আমরা সেসব পেছনে ফেলে এসেছি। ভাবতে-ভাবতে আসমান আলী দেয়াল-ঘেঁষে আর একটি টেবিলের দিকে তাকান। তিনি দেখতে পান – টেবিলে তার বস এমডি মাহমুদ হোসেনের বন্ধু কায়দুজ্জামান বসে আছেন। সঙ্গে সিনেমার ফ্লপ মারা এক নায়িকা। নামটা মনে করতে পারছেন না আসমান আলী। অনেকক্ষণ চেষ্টার পরে মনে পড়ে – নায়িকার নাম – মূর্ছনা। মূর্ছনা দেখতে-শুনতে খারাপ না। অন্তত আসমান আলীর চোখে। মাস চারেক আগে এমডি মাহমুদ হোসেন যখন বিদেশে ছিলেন, তখন আমাদের আসমান আলী মতিঝিলের একটি সিনেমা হলে নায়িকা মূর্ছনার একটি ছবি দেখেছিলেন। মূর্ছনা পাছা এবং বুক দুটো দুলিয়ে যখন তা থইথই নাচ আরম্ভ করল পর্দায়, সারা সিনেমা হলটা নড়েচড়ে বসেছিল। তৃতীয় শ্রেণির দর্শকেরা তেজি ঘোড়ার উচ্ছ্বাসে, ফুটবল রেফারির মতো মুখে বাঁশির পরিবর্তে দুআঙুল পুরে অদ্ভুত কৌশলে বাঁশি বাজিয়েছিল। বলা বাহুল্য, আসমান আলীর কানে সে-বাঁশির কর্কশ সুর খারাপ লাগেনি। সেই নায়িকা মূর্ছনা এখন তার সামনে বসা। রুপালি পর্দার আলো-ছায়ার বাইরে একেবারে জীবন্ত রক্তমাংসের 888sport promo code, কায়দুজ্জানের অতিথি? যাবে নাকি একবার কায়দুজ্জামান এবং নায়িকা মূর্ছনার টেবিলে? না, নিজেই পরিকল্পনা বাতিল করে দেয়  – স্বগত কণ্ঠে নিজেকে শুনিয়ে আসমান আলী বলে – না, যাওয়া ঠিক হবে না।

হঠাৎ কায়দুজ্জামান তাকান আমাদের আজকের অসামান্য অনন্য আসমান আলীর দিকে। আসমান আলী তাকান সাহসের ভেলায় চড়ে, ডাটের সঙ্গে। ডান পায়ের ওপর বাম পা তুলে তুমুল নাচাতে থাকেন। কায়দুজ্জামান কি চিনতে পেরেছেন আসমান আলীকে? পা নাচাতে-নাচাতে ভাবনার দোলনায় দোল খায় আসমান আলী। তার দোলার মধ্য ওয়েটার খাবার এনে টেবিলে সাজিয়ে রাখে। সাজানো শেষ হলে আসমান আলী পরম আয়েশে খাওয়া আরম্ভ করেন গভীর তপস্যার ঢঙে, আসেত্ম এবং ধীরে। সামনে দাঁড়ানো নতজানু ওয়েটার। মুরগির মাংসে কামড় বসিয়ে ইশারায় কাছে ডাকেন ওয়েটারকে।

পানি কোথাকার?

স্যার – বিদেশ থেকে আমদানি করা। বোতলজাত পানি।

ও কে।

আসমান আলী আশ্বস্তবোধ করেন। বিশেষভাবে সেদ্ধ ফিল্টার করা বোতলজাত পানি সরবরাহ করা হয়েছে তার জন্য। জীবাণুযুক্ত বাইরের ময়লা পানি অন্তত আজকে, আমাদের আসমান আলী পান করতে পারেন না। সামাজিক পারদরেখায়, তার জীবনের মূল্য অনেক। সেই মূল্যবান জীবন জীবাণুযুক্ত সামান্য পানি পান করে একটি ঝুঁকির বধ্যভূমিতে তিনি দাঁড়াতে পারেন না।

আসমান আলী ধীরেসুস্থে, যথেষ্ট সময় নিয়ে তারিয়ে-তারিয়ে খাওয়া শেষ করেন। নিজের ওপর এক অবিশ্বাস্য আস্থা হিমালয়ের মতো অনুভব করেন তিনি, আসমান আলী।

খেতে-খেতে আপন মনে বলেন – দেখে যাও মাহমুদ হোসেন, তোমরা প্রতিদিন খেতে পারো, খাও। কিন্তু আসমান আলী একদিন হলেও খেতে পারে। ভেতরে, শরীরের অবকাঠামোর মধ্যে দীর্ঘদিনের বুনো জান্তব প্রতিশোধের বাজপাখি, কথার নিঃশব্দ উচ্চারণের ফাঁকে ঠোঁট নড়ে ওঠে। দাঁত এবং ঠোঁটের ফাঁকে দু-একটি শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে।

কিছু বললেন, স্যার? ওয়েটার জিজ্ঞেস করে ঠোঁট নড়তে এবং অস্ফুট কথা বলতে দেখে।

নাহ।

খাওয়া শেষে আসমান আলী আয়েশ করে এক কাপ চা পান করেন। চা পান শেষে ওয়েটার বিল নিয়ে আসে। বিলের ওপর আলতো চোখ বুলিয়ে খুব তাচ্ছিল্যের সঙ্গে পকেট থেকে টাকা বের করে বিলের পেস্নটে রাখেন। ওয়েটার পেস্নটটি নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ দেখেন – পেস্নটে একটি একশ টাকার নোট, সঙ্গে কয়েকটি খুচরো টাকা।

হাত ইশারায় টাকাটা ওয়েটারকে নিয়ে যেতে বললে ওয়েটার দীর্ঘ, বিগলিত ক্রীতদাসসুলভ হাসি বমি করতে-করতে, হাত কপালে ঠেকাতে-ঠেকাতে আড়ালে চলে যায়। আসমান আলী গাম্ভীর্যের সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান এবং চারদিকে একবার চোখ বুলান। তিনি দেখতে পান যে, কায়দুজ্জামান এবং নায়িকা মূর্ছনা টেবিলে নেই। গেল কোথায়?

যাক যেখানে খুশি সেখানে, তাতে আমার কী! এই জাতীয় অভিব্যক্তি প্রকাশ করে আসমান আলী সিংহ পৌরুষে গেটের দিকে হাঁটতে থাকেন।

আসমান আলী গেটের দিকে হাঁটতে থাকুক, এই ফাঁকে গেট পার হওয়ার আগে আমরা, পাঠক এবং লেখক মিলে আসমান আলীর হিসাবটা কষে ফেলি। আশা করি পাঠকেরা আমার সঙ্গে একমত হবেন এবং হিসাব মিলাতে যোগ-গুণ-ভাগ করতে বসবেন। আসমান আলীর বেতন মাসে দশ হাজার টাকা ছিল। চাকরির বয়স তিন বছরে আরো দুহাজার টাকা বেড়েছে। আর ফাও বা টিপস ইত্যাদি ধরে আরো পাঁচশো টাকা। মাসে সর্বমোট বারো-তেরো হাজার টাকার মালিক সে। এর মধ্যেই টেনেহিঁচড়ে বাসা ভাড়া, থাকা-খাওয়া, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ, হাটবাজার ইত্যাদি চলে। সেই আসমান আলী আজকে একবেলা খেয়ে বিল দিয়েছে সাড়ে নয় হাজার টাকা। বকশিশও দিয়েছে তিনশো টাকা। এখন হিসাব করে দেখুন, এখন তার কাছে থাকে আড়াই থেকে তিন হাজার ও সামান্য কিছু খুচরা টাকা। আমাদের হিসাব শেষ। চলুন, ফাইভস্টার হোটেলের গেট পার হয়ে আসা আমাদের চিরচেনা সনাতন আসমান আলীর কাছে।

পাঁচতারা হোটেলের গেট পার হওয়ার পর তাকে আর সম্মান জানানোর প্রয়োজন নেই। গেট পার হয়ে আসমান আলী লনে সামান্য সময় দাঁড়ায়। চোখের তারা এবং সেই সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে হোটেলটা দেখে নেয় এক পলক। দেখা শেষে প্রধান সড়কের দিকে হাঁটতে-হাঁটতে পকেটে হাত ঢোকায়। হাতে একটুকরো কাগজ আবিষ্কার করে। কাগজটা হাতের ওপর চোখের সামনে তোলে। স্ত্রীর দেওয়া বাজারের ফর্দ। স্ত্রীর অসুস্থতার ওষুধ, মেয়ের জামা, কাপড়, ওড়না, নিজের পায়ের স্যান্ডেল, মরিচ, আদা, ডাল, তরকারি, চাল মিলিয়ে প্রায় চার হাজার টাকার হিসাব। বাড়ি ভাড়া আট হাজার টাকা। সাড়ে নয় হাজার টাকা দিয়েছে হোটেলের বিল। এখন পকেটে আছে মাত্র আড়াই থেকে তিন হাজার এবং সামান্য কিছু খুচরা টাকা।

আসমান আলী ফর্দটা দেখে পঁয়তালিস্নশ ডিগ্রি উষ্ণ আবহাওয়ায় শূন্য তাপমাত্রার ঠান্ডার মধ্যে জমে যায়। কোথায় ছিল সে এতক্ষণ? কী করেছে সে? ইচ্ছে হয় – পেটের মধ্যে চালান করা খাবারদাবার টেনে বের করে পেস্নটে সাজিয়ে ফাইভস্টার হোটেলে ফিরিয়ে দিয়ে নগদ টাকাটা নিয়ে আসে।

কিন্তু ততক্ষণে পেটের ভাত, মাছ, মাংস বোতলজাত পানি গলে-গলে বিষ্ঠায় রূপান্তর হতে আরম্ভ করেছে। আসমান আলী বিস্ফারিত চোখে প্রতিপক্ষ আপন পেটটার দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকে এবং আমরাও আগের মতো আসমান আলীকে চিনতে পেরেছি। r