‘অ’পুত, অ’পুত এই ঠাডারের মইধ্যে ঘরত্তুন বাইর ন হইছ অ’পুত। আঁরত বাইশ ধরা লাইগদুনু। টেঁয়া-পইশে লাইগদুনু অ’পুত।’
মায়ের এই আকুতি শোনার সময় নেই আব্বাসের। সে পলিথিনের ব্যাগে সিগারেটের প্যাকেট, লাইটার আর টাকা ভরে কোমরে গুঁজতে ব্যস্ত। বাইরে মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। সঙ্গে বিজলি আর থেকে থেকে বজ্রপাতের বুক কাঁপানো আওয়াজ।
বৈশাখের দুই সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। বৃষ্টি-বাদলের দেখা পাওয়া যায়নি। এরপর শুরু হয়েছে দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি। এই বৃষ্টি যখন মুষলধারায় রূপ নেবে আর সঙ্গে বজ্রপাত ঘটবে সে-সময়ে হালদায় ডিম ছাড়বে মা মাছ।
প্রকৃতির এক অন্যরূপ ও অপার খেলা হালদায় মাছের ডিম ছাড়ার ঘটনাটি। 888sport apps আর কোনো নদীতে এভাবে ডিম ছাড়ে না মাছ। হালদা বলতে আবার পুরো হালদা নদীতে নয়। উজানে সত্তারঘাট সেতু থেকে নিচে মদুনাঘাট পর্যন্ত এলাকাতেই কার্প জাতীয় মাছ অর্থাৎ রুই, কাতলা, মৃগেল, কালাবাউশ ডিম ছাড়ে। সারাবছর নদীর যেখানেই থাকুক বৈশাখের এই সময়ে সব মা মাছ জড়ো হয় এই এলাকায়। বৃষ্টির সঙ্গে প্রচণ্ড বাজ পড়ার শব্দে মাছ ডিম ছাড়ে। আর শত শত নৌকায় করে নদীতে জাল পেতে মানুষ সে-ডিম সংগ্রহ করে নদীর কূলে আগে থেকে তৈরি করে রাখা কুয়ায় এনে রাখে। সেখানেই একসময় ডিম ফেটে রেণু হয়। তারপরে হয় পোনা।
হালদা পার্বত্য চট্টগ্রামের বাটনাতলী পাহাড়ি এলাকা থেকে সৃষ্টি হয়ে ফটিকছড়ি উপজেলার উত্তর-পূর্ব কোণ দিয়ে চট্টগ্রাম জেলায় ঢুকেছে। এরপর হাটহাজারী উপজেলা এবং শেষে রাউজান উপজেলা হয়ে কালুরঘাটের কাছে কর্ণফুলী নদীতে এসে পড়েছে। বাটনাতলীর একটি গ্রাম সালদা। সেখান থেকে নদীর নাম হয় সালদা। চট্টগ্রামের মানুষ ‘স’-কে ‘হ’ বলে বলেই সালদা নদী হালদা নদী হয়ে গেছে বলে মনে করে অনেকে।
হাটহাজারী ও রাউজানকে বিভক্ত করেছে এই নদী। রাউজান উপজেলার একসময়ের গহিরা ইউনিয়নের একটি গ্রাম দক্ষিণ গহিরা। গহিরা এখন রাউজান পৌরসভার অংশ হয়ে গেছে। সত্তারঘাটের পর একদিকে পশ্চিম গহিরা, দক্ষিণ গহিরা ও মোবারক খানখিল আর অন্যপাশে হাটহাজারী থানার গড়দুয়ারা ইউনিয়ন।
কাগজে-কলমে হালদাকে নদী বলা হলেও বয়স্ক লোকেরা এটাকে এখনো হালদা খাল বলে। অনেকে বড় খালও বলে। এই নদীর কারণে এর দুই তীরবর্তী জমিগুলি অতি উর্বর। বছরে তিনবার ফসল দেয় এই জমি। ধান ছাড়াও নদীর কূলে বেগুন, টমেটো, মরিচ, খিরা, বাঙ্গি, তরমুজের প্রচুর ফলন হয়। আর সারাবছরই তো এই নদীর মাছ অনেকের জীবন-জীবিকার উৎস হয়ে আছে।
বছরের এই সময়টাতে নদীর দুই কূলের মানুষ অনেক উৎসাহ নিয়ে ডিম ধরার প্রস্তুতি নেয়। এর জন্য নৌকা তৈরি করা, জাল কেনা, নদীর পাড়ে কুয়া খনন করে রাখার কাজ শুরু হয় দু-তিন মাস আগে থেকে। সত্তারঘাট থেকে ভাটিতে মদুনাঘাট পর্যন্ত নদীর দু’কূলে তখন একটা উৎসব উৎসব ভাবও আসে। এই ডিম ধরা অনেকটা লটারি পাওয়ার মতো। সবাই যে ডিম ধরতে পারে তা নয়। দেখা যায়, নৌকা নেমেছে শত শত। জালও ফেলা হয়েছে শত শত। কিন্তু ডিম পেল মাত্র ২০-৩০ জন। এদের মধ্যে আবার দু-চারজন এক দানেই কয়েক লাখ টাকার ডিম পেয়ে যায়। যে-কারণে ডিম পাওয়ার আশায় অনেকে নানারকম মানত করে।
কবে কখন কারা প্রথমে এভাবে ডিম সংগ্রহ করে পোনা ফোটানো শুরু করেছিল তা এখন আর কারো জানা নেই। এখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিয়মিত ডিম সংগ্রহের কাজটি করে যাচ্ছে।
হালদার পোনার প্রচুর চাহিদা আছে দেশে। এই পোনা বেশ বড় হয় এবং সবচেয়ে বড় কথা হলো, হালদার মাছ অত্যন্ত সুস্বাদু।
আব্বাস এবার আগে থেকেই নৌকার জাল এবং কামলা ঠিক করে রেখেছে। হালদার পাড়ে সে নিজেই তিনটি কুয়া ভাড়া নিয়েছে। তিন-চারদিন ধরে একটু একটু বৃষ্টি হচ্ছে। বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। এখন ভরা কটাল মানে জো। এ-সময় মুষলধারে বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাত হলে সে-শব্দে মা মাছ ডিম ছেড়ে দেবে। ডিম ছাড়ার সময় মা মাছ এক প্রকার অচৈতন্য অবস্থায় থাকে। চিৎ অবস্থায় মা মাছ ডিম ছাড়ে। নাভি ভেদ করে এই ডিম তীব্র বেগে বেরিয়ে আসে। মাঝেমধ্যে সে-দৃশ্য দেখা যায়। একসময় হালদায় প্রচুর ডলফিন ছিল, স্থানীয়রা তাকে ‘হুচ্ছুম’ বলে। ডিম ছাড়ার আগে ক্লান্ত অর্ধচেতন মা মাছকে শিকার করে হুচ্ছুম। অনেকে এ-সময় খুব সহজে মা মাছও শিকার করে। তবে বর্তমানে সরকারি নিষেধাজ্ঞা ও জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কেউ আর মা মাছ ধরে না।
আব্বাস মায়ের কথায় মাথা নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেয়। সঙ্গে আছে তার এক কামলা। কিশোর বয়েসি ছেলেটির নাম রহমত। একই পাড়ার রহমত তাড়া দেয় আব্বাসকে।
‘চলো না কাক্কু। দেরি হই যার তো। আজিয়ার ভুতুর ডিম ছাড়িবু বুলি ক’র বেগ্গুনে।’
আব্বাসের মাকে লক্ষ করে বলে, ‘তুঁই চিন্তা ন গইজ্জু দাদি। আঁই ন আছি না! এইবার দেইবা আব্বাস কাক্কু লাখপতি হই যাইবু।’
আব্বাস বলে, ‘বেশি কথা ন কইস বেডা, বেয়াক কিছু লইয়ুছনি চা-আ।’
এ-সময় আব্বাসের বউ এসে দাঁড়ায় শাশুড়ির পাশে। আব্বাসের পোয়াতি বউ। সময় একেবারে ঘনিয়ে এসেছে। চোখে-মুখে ভেসে উঠেছে কষ্ট ও ক্লান্তির ছাপ। বউকে দেখে আব্বাস বলে, ‘তুঁই কিল্লাই উডি আইস্যুদে। বিছানত শুই থাকোগুই যাই। চিন্তা ন গইজ্যু। বাইল্যের মা চাচি তো ঘরত আছে। বেশাবেশি খারাপ লাগিলে আঁরে খবর দিও, আঁই আই যাইউম। মনসুইজ্যেরে কই রাইখ্যি, হসপিটাল য’ন পড়লি ইতে গাড়ি লই আই যাইবু। য শুই থাকোগুই।’
প্রথম সন্তান হতে যাচ্ছে আব্বাসের। সময় একেবারে ঘনিয়ে এসেছে। গ্রামের অভিজ্ঞ দাই বাইল্যার মাকে তাই ঘরে এনে রাখা হয়েছে। বাইল্যার মায়ের বড় সুনাম আছে গ্রামে। আব্বাসেরও জন্ম হয়েছে বাইল্যার মায়ের হাতে।
‘অ’মা আঁই যাইর। দোয়া গইজ্যু, তোঁয়ারার বউ উজু খেয়াল রাইখ্যু।’
তুমুল বৃষ্টি আর বিজলির মধ্যে বেরিয়ে পড়ে আব্বাস।
কয়েক বছর ধরে এ-সময়টাতে আব্বাস ডিম সংগ্রহে যায়। আর এ-ধরনের ঝড়-তুফান না হলে মাছ ডিম ছাড়ে না। কিন্তু আজ আব্বাসের মায়ের মনটা কেন যেন বারবার কোনো এক অজানা আশঙ্কায় কেঁপে কেঁপে উঠছে।
নৌকা নেমেছে এবার ঝাঁকে ঝাঁকে। রিচার্জেবল লাইট, টর্চলাইট নিয়ে হাজারো মানুষ নৌকা ও নদীর দু’কূলে প্রস্তুত হয়ে আছে। আব্বাস তার নৌকায় গিয়ে ওঠে। অনেকেই বিকেল থেকে জাল ফেলে রেখেছে। আব্বাস এখন ফেলবে জাল। বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। সঙ্গে বিজলি ও বজ্রপাত। বাজ পড়ার প্রচণ্ড শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠছে চারিধার। জাল ফেলা হয়ে গেছে। উজানের পানি আর ভরা কটালের জোয়ারে নদী ক্রমাগত ফুলে উঠছে। এ-সময় বজ্রপাতের তীব্র শব্দকে ছাপিয়ে ভেসে এলো অনেক কণ্ঠস্বর, ‘বাইশ ছাইজ্যি, বাইশ ছাইজ্যি।’ সঙ্গে সঙ্গে এই খবর সত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত পৌঁছে গেল। কয়েক হাজার জাল নেমে গেল হালদা নদী জুড়ে।
পশ্চিম দিক থেকে এসে হালদা ছোট করে দক্ষিণে বাঁক নিয়েছে যেখানে সেই বাঁকের পাশেই মনু মেম্বারের বাড়ি। এদিকটা দক্ষিণ গহিরা। অপর পাশে গড়দুয়ারা। মনু মেম্বারের বাড়ির দুই বাড়ি উত্তরে আব্বাসদের বাড়ি। সে-কারণে এই জায়গাটি বেছে নিয়েছে সে। 888sport app বছর আরো উজানে অঙ্কুরীঘোনায় নৌকা গাড়ত সে। এবার বাড়ির কাছেই নৌকা গেড়েছে।
যে-কোনো সময় বাচ্চা প্রসব করতে পারে বউ – এই সম্ভাবনা মাথায় রেখে।
আব্বাস বাপ-মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা নাই। সে যেদিন জন্ম নেবে সেদিনই তিনি মারা গিয়েছিলেন এমন ডিম ধরার মৌসুমে। একদম জোয়ানকালে স্বামীহারা হয়েও কুলসুম একমাত্র সন্তান আব্বাসকে নিয়ে থেকে যায় স্বামীর ভিটায়। যেটুকু জায়গা-জমি আছে তাতে ক্ষেত-ফসল করার পাশাপাশি মানুষের ঘরে কাজকর্ম করে ছেলেকে বড় করে তুলেছে। গ্রামে একটি মাত্র স্কুল আছে নিম্ন মাধ্যমিক। বাড়ির কাছে বলে সেখান থেকে কোনোভাবে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ে আব্বাস কালাচাঁদ হাটে একটি মুদির দোকানে চাকরি নেয়। ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছে, হালদা খাল তার বাপকে খেয়েছে, তাই এই নদীর ওপর ভীষণ রাগ ছিল তার। ভয়ও পেত নদীকে ছোটবেলা থেকে। কিন্তু বড় হতে হতে একসময় ভয় কেটে যায়। ডিম ধরার মৌসুম এলেই কোনো না কোনোভাবে সে জড়িয়ে যায় এ-কাজে। কয়েক বছর ধরে বাইশ ধরার সময়ে সে নৌকা-জাল নিয়ে নেমে পড়ে। এভাবে প্রতিবছর কিছু না কিছু বাড়তি আয় করে সে।
বছর দেড়েক হলো কুলসুম বউ এনেছে ছেলের জন্য। বিয়েতে শ্বশুরপক্ষ থেকে যৌতুক হিসেবে দু-লাখ টাকা পেয়েছিল আব্বাস। সেইসঙ্গে নিজের কিছু জমানো টাকায় পাড়ায় মুদির দোকান খুলেছে একটা। বেচাবিক্রি ভালোই আছে। এতে বাড়িতে থাকার সুযোগও হয়েছে তার।
আসলে মাছে ডিম ছেড়েছিল ভাটার সময়ে। কেউ বুঝতে পারেনি। এখন জোয়ার হতে হতেই ডিম সংগ্রহ করা যাচ্ছে বেশ। দু-তিন ঘণ্টায় প্রায় দশ-বারো বালতি ডিম সংগ্রহ করে ফেলেছে আব্বাস। আনন্দে ভেসে যাচ্ছে সে। বালতি বালতি ডিম তুলছে আর ভাবছে তার অনাগত সন্তান খুব ভাগ্যবান হবে। সবকিছু ঠিক থাকলে এক রাতেই সে কয়েক লাখ টাকার ডিম সংগ্রহ করবে।
একদিকে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাত, অন্যদিকে ডিম ছাড়া আর ডিম ধরার প্রতিযোগিতা চলছে। মুহুর্মুহু বাজ পড়ার শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠছে হালদার পাড়। বেশ কয়েক বছর পর এক রাতে এত ডিম ছেড়েছে মাছ। আব্বাসসহ কয়েকজনের নৌকা ভারী হয়ে উঠেছে সংগৃহীত ডিমে। এই ডিম তোলা হবে নদীর পাড়ে তৈরি করে রাখা কুয়ায়। সেখানে ডিমগুলো রেণু হয়ে ফুটবে। তারপর পোনা হিসেবে বিক্রি হবে। কয়েক বছর হলো সরকারি হ্যাচারিতে এ-ধরনের কুয়া করা হয়েছে। অনেকে সেখানেও নিয়ে যায় ডিম।
ফজরের সময় হয়েছে। মসজিদে আজান দেওয়া হলেও তার শব্দ নৌকা পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। ঝড়, বাজকে উপেক্ষা করে মানুষের মধ্যে উৎসব ভাব এসেছে। কমবেশি সবাই ডিম সংগ্রহ করতে পারছে, তবে আব্বাসের মতো কেউ এখনো সংগ্রহ করতে পারেনি। আজ ঘন ঘন বাজ পড়ছে, বিকট একটা শব্দ হলো। মনে হলো কাছেই কোথাও পড়েছে। অনেকে দেখলো আগুনের একটা হলকা, কোথা থেকে ছিটকে এসে একটা নৌকায় পড়ল। প্রচণ্ড শব্দে আশেপাশের লোকজনের কানে যেন তালা লেগে গেল। কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই শোনা গেল কারো একজনের আর্তচিৎকার, ‘ঠাডার পইজ্যি, ঠাডার পইজ্যি।’ তারপর সে-চিৎকার এক নৌকা থেকে হাজারো নৌকায় ছড়িয়ে পড়ে – ‘ঠাডার পইজ্যি, ঠাডার পইজ্যি।’
সারারাত ঘুমাতে পারে নাই আব্বাসের মা কুলসুম খাতুন। এত ঠাডারের মধ্যে ছেলেটা বেরিয়ে যাওয়ার পর এক অজানা উৎকণ্ঠায় বারবার কেঁপে কেঁপে উঠেছে সে। ঘরে পোয়াতি বউ। বাইল্যার মাকে এনে রাখা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে আজকালের মধ্যে ব্যথা উঠতে পারে। শুয়ে আছে কিন্তু
দু’চোখের পাতা এক হচ্ছে না। প্রতিটা ঠাডারের আওয়াজে মনে হচ্ছে সেটা যেন কাছাকাছি কোথাও পড়ল। ভোর হওয়ার আগে আগে প্রচণ্ড শব্দে চারপাশ কাঁপিয়ে একটা ঠাডার পড়ল। মনে হলো যেন ঘরের কাছেই পড়েছে কোথাও। ভয়ে-আতঙ্কে ছুটে গেল কুলসুম ছেলের বউয়ের ঘরের দিকে। সারারাত বিদ্যুৎ নেই। হারিকেনের আলোয় দেখা গেল – বউ জেগে আছে। খাটে বালিশ দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় শুয়ে ছিল। শাশুড়িকে দেখে উঠতে চাইল। কুলসুম বলল, ‘শুই থাকো অ বউ। ঠাডার উগ্গো পড়িল দি চিন্তা লা’র। আঁর আব্বাস কী গরের ক’নে জানে। এককানা খবর লইত পাইত্তেম।’
পাশে ঘুমাচ্ছে বাইল্যার মা। কুলসুম আবার নিজের বিছানায় ফিরে আসে। তার খুব অস্থির লাগছে। ছেলেটার যদি একবার খবর নেওয়া যেত। মনটা ভারি হয়ে আছে। কেন যেন বারবার আব্বাসের বাবার কথা মনে পড়ছে। কত বছর হবে? ২৩-২৪ বছর হয়তো। এরকম ঝড়-বাদলের রাতে বেরিয়ে গিয়েছিল। নিজের নৌকা ছিল না। অন্যের নৌকায় কাজ নিয়েছিল। যা লাভ হবে তা থেকে চার ভাগের এক ভাগ পাবে। সে-বছরও প্রচুর ডিম ছেড়েছিল মাছ। দুইদিন নৌকায় কাটিয়ে এক সন্ধ্যায় ঘরে এলো। ছুরি শুঁটকির তরকারি দিয়ে পেট ভরে ভাত খেল। খাওয়ার সময় বারবার বলছিল, কতদিন পর এমন সুস্বাদু রান্না খাচ্ছে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলছিল, ‘ক’নে রাইনধিদে ‘অ’মা! বড়ো ফোয়াদ হইয়্যি।’
মা পাশে বসে থাকা বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুই আইবি বুলি ফুনি তোর বউয়ে রাইনদিদে অ’পুত। এই শরীল লই চুলার দুয়ারত যাইতেম মানা গইজ্যিলেম। ন ফুনিল। খা অ’পুত। পেট পুরাই খা। আবার ক’দিন পরে ঘরত আ’বি ক’নে জানে।’
সে-সময় কুলসুমও গর্ভবতী। আব্বাস তখন পেটে। এই হবে-সেই হবে অবস্থা। মাকে কিছু বলল না। কুলসুমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই শরীল লই কিল্লেই রাঁধন পড়েদ্দে, বাইশ ধরা শেষ হইলি আঁই ঘরত ন আইস্যুম না।’
ভাত খেয়ে মায়ের হাত থেকে পান নিয়ে তা মুখে পুরে বের হয়ে গেল ঘর থেকে। সেই রাতও ছিল এমন। প্রচুর
ঝড়-তুফান। সারারাত ঘুমালো না কুলসুম। ভোরের দিকে চোখ দুটোর পাতা একটু লেগে এসেছিল। হঠাৎ
চিৎকার-চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙে গেল। ছুটে গিয়ে দেখল মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে যেখানে বসে ভাত খেয়েছিল মানুষটি, এখন সেখানে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার পরের অনেককিছু মনে নেই কুলসুমের। প্রচণ্ড ব্যথা উঠল পেটে। সকালের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নিল আব্বাস। পরে শুনেছিল, নৌকা থেকে পড়ে জালে জড়িয়ে গিয়েছিল লোকটা। উপরে উঠতে পারেনি আর।
আজ বারবার সে-কথা মনে পড়ছে কেন? ঠাডারের পর মনটা আরো ব্যাকুল হয়ে পড়ল। বাড়ির পাশ দিয়ে যে-রাস্তাটা নদীর দিকে গেছে সে-রাস্তা ধরে কিছু লোক ছুটে যেতে যেতে বলাবলি করছে, ‘ঠাডার পইজ্যি বলে নৌকত।’ ঘরে থেকেও কুলসুমের উৎকর্ণ হয়ে থাকা কানে বাজে কথাটি – ‘ঠাডার পইজ্যি বলে নৌকাত’। ঘরে কোনো পুরুষ নেই। খবর নেবে সে-উপায়ও নেই। রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো। যত দোয়া-দরুদ মনে আছে তা পড়তে লাগল কুলসুম। একবার বউয়ের কামরায় আবার নিজের কামরায় ছোটাছুটি করতে থাকে সে।
একসময় বৃষ্টি কমে আসে। বজ্রপাতও থেমে যায়। অন্ধকার ভেদ করে কোথা থেকে একটি আলোর রেখা স্পষ্ট হতে থাকে। হঠাৎ কানে আসে অনেকগুলি কণ্ঠস্বর। তা স্পষ্ট ও নিকট হতে থাকে। একসময় সব কণ্ঠস্বর কুলসুমের উঠানে এসে থামে। তারা কাঁধে করে কিছু একটা বয়ে নিয়ে আসে। আলো-আঁধারের মধ্যে জানালা দিয়ে কুলসুম দেখে – লোকগুলি তার দরজার দিকেই আসছে। দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয় কুলসুম। ওরা কাঁধে করে নিয়ে এসেছে কারো লাশ। কুলসুমের সামনের ঘরে লাশটি নামিয়ে রাখতে রাখতে তাদের মধ্যে দু-তিনজন একই সঙ্গে বলে, ‘আহা রে! পোয়াও শেষ পইয্যন্ত ঠাডারে মরি গেইল। বহুত ডিম ধইজ্যিল। বেয়াগ্গুনুত্তুন বেশি পাইয়িলদে আব্বাস। কোয়াল খারাপ। ঠাডারখান পইল্লুদে হিতের গ’ত। চারিকিনেরে এত মানুষ, কেউর কিছু ন হইল। বাপোরে খাইলদি হলদা। পোয়ারে খাইলদি ঠাডারে।’
কুলসুমের কানে শেষের কোনো কথাই যায় না। জ্ঞান হারায় সে।
এর মধ্যে সকাল হয়। গ্রামের বহু লোক এসে ঘর ভরে যায়। উঠানেও প্রচুর মানুষ। গ্রামের মেয়ে-বউরাও এসেছে দলে দলে। ধীরে ধীরে জ্ঞান ফিরে আসে কুলসুমের। ‘আঁর পুত কডে’ বলে আশেপাশে তাকায়। দেখতে পায়, অনেকগুলি মুখ ঝুঁকে আছে তার দিকে। সে-সময় পাশের ঘর থেকে নবজাতকের কান্না ভেসে আসে। কুলসুম শুনতে পায় কেউ বলছে, ‘আব্বাসর বউত্তে উগ্গো পোয়া হইয়্যি।’


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.