হুমায়ুন মঞ্জু সরকার
বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়ির রাস্তা বত্রিশ নম্বরে ঢোকার মুখে ফুটপাতে নতুন এক বিলবোর্ড দেখে ভোরবেলা একটি কাক তার উপরে উঠে বসে। রাস্তার ধারে বড় বড় বিলবোর্ড ও আলো-ঝলকানো হরেকরকম বিজ্ঞাপন দেখে কাকটি অভ্যস্ত। কিন্তু এ-জিনিসটার ওপরে বসেও বুঝতে পারে না, কোত্থেকে এবং কেনই-বা এটা এখানে উঠেছে। মাথা নিচু করে বিলবোর্ডের বুক দেখে সে। পড়তে না পারলেও দুটো ছবি তার চেনার কথা। জনতার উদ্দেশে আঙুল তুলে বঙ্গবন্ধু ও পাশেই তার কন্যা প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা। জোড়া ছবির নিচে আরো একটি বড় ছবি, যা কাকের কাছেও প্রশ্নচিহ্ন মাত্র। একটু পরে নগরীর ব্যস্ততম সড়কে ও ফুটপাতে মানুষের ঢল নামতে শুরু করবে। জনস্রোতের মাঝে হঠাৎ বিলবোর্ডের বড় ছবির মুখটি কোন মানুষের, বোঝা সহজ নয়।
কাকের মতো প্রতিক্রিয়া হয় পথচারী মানুষজনের। তবে তারা পড়ে এবং কেউবা না পড়েও, এ-স্থানে বিলবোর্ড গজানোর কারণটি মুহূর্তেই বুঝতে পারে। বারো মাসে তেরো পার্বণের মতো বত্রিশ নম্বরে নানারকম উৎসব-অনুষ্ঠান লেগেই আছে। জাতীয় ও বিশেষ দিবসে জাতির পিতার প্রতিকৃতিতে ফুল দিতে আসেন সপারিষদ প্রধানমন্ত্রী ও দলের নেতাকর্মীরা। এসব বিশেষ দিবসকে কেন্দ্র করে বত্রিশ নম্বরে সাজসাজ আয়োজন চোখে পড়ে। তখন রাস্তায় নানারকম ব্যানার ও পোস্টারও শোভা পায়। পুলিশ এবং দলের স্বেচ্ছাসেবকদের তৎপরতাও বাড়ে। নতুন বিলবোর্ডটিও যে বিশেষ দিবসকে সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর প্রতি সর্বোচ্চ 888sport apk download apk latest version জানাতেই করা হয়েছে, তা না পড়েও বুঝতে পারে অভিজ্ঞ লোকজন। কিন্তু বিলবোর্ডে প্রচারক হিসেবে যার ছবি ছাপা হয়েছে, তাকে চেনামাত্র চমকে ওঠে তার পরিচিত লোকজন। ছবির নিচে অবশ্য ডাকনামের সঙ্গে আসল নাম হুমায়ুন কবির টিটু এবং স্থানীয় যুবলীগকর্মী হিসেবে তার পরিচয়ও লেখা হয়েছে। পরিচয়টা মিথ্যে নয়, কিন্তু সামান্য এক কর্মী বত্রিশ নম্বরে ঢোকার মুখেই এভাবে শোভা পাবে, এটা সহজভাবে নিতে পারে না দলেরই এক কর্মী রাজু।
সকালবেলা হুমায়ুনের বিলবোর্ডে হোঁচট খেয়েই যেনবা, মোটরসাইকেল দাঁড় করায় রাজু। টিটুর ছবিটার দিকে তাকিয়ে মোবাইলে ঘনিষ্ঠ দলীয় নেতাকে ধরে উত্তেজিত কণ্ঠে জানায়, জাফর ভাই, টিটু হালায় নিজের একখান বড় ছবি দিয়া বত্রিশ নম্বরের মুখে বিরাট সাইনবোর্ড ফিট করছে! আপনি কি হুকুম দিছিলেন?
হ্যাঁ, আমাকে কইছিল তো, মন্ত্রী সালামের কাছেও মনে হয় কইছে। তা সমস্যাটা কী?
সমস্যা কিছু না, এত নেতা থাকতে সে নিজের ছবি সাইনবোর্ডে তুইলা কি টাকার গরম দেখায়?
দেখাউক না, টাকা সে বঙ্গবন্ধুর নামে যত খুশি খরচ করুক। বিকেলে অফিসে আসিস তোরা।
বঙ্গবন্ধুর নামে এবং তার 888sport sign up bonusবেদির কাছেই ঘটনাটা ঘটেছে বলে রাজু আর কিছু বলতে পারে না। জাফর ভাই আপত্তি করলেই সে ফোন করে টিটুকে এখনই বত্রিশ নম্বরে তলব করত। তারপর ওই সাইনবোর্ড ছবিওয়ালার মাথায় তুলে দিয়ে এক মণ ওজনের একটা লাথি কষে নেতা হওয়ার শখটা তার পোঁদে ঢুকিয়ে দিত আজ। কিন্তু জাফর ভাইয়ের কথা শুনেই বুঝতে পারে, রাজুকে টেক্কা দিয়ে এবার কমিটিতে একটা ভালো পদ পাওয়ার জন্য টিটু ইতোমধ্যে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। মন্ত্রী সালামভাই ছাড়াও বেশ কয়েকজন বড় নেতার চামচাদের সঙ্গে খাতির হয়েছে টিটুর। সাইনবোর্ড তো আকাশ থেকে নামেনি, নেতাদের সাহসেই সে বত্রিশ নম্বরে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
টিটুকে ফোন করে আজ বিলবোর্ড দেখে তার পুরো নামটাই উচ্চারণ করে রাজু, হু-মা-য়ু-ন ক-বি-র টি-ট্টু আবে হালায় কই তুই! বত্রিশ নম্বরে তোর ছবি দেখতে নেতাকর্মীদের ভিড় লাইগা গেছে। প্রধানমন্ত্রীরও চোখে পড়ব অবশ্যই, জাফর ভাইরে জিগাইব, ছেলেটা কে রে?
রাজু যখন ফোন করে, হুমায়ুন তখন বাথরুমে। বত্রিশ নম্বরে বিলবোর্ডে নিজের প্রতিকৃতি ওঠার পর এর মধ্যে তিনটি ফোন পেয়েছে সে। সবাই দলের পরিচিত কর্মী-সমর্থক। কিন্তু রাজুর উত্তেজিত কণ্ঠে নেতাদের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার খবর শুনে তলপেটে পাঠানো কোতনও মাঝপথে থেমে যায়। সামান্য কর্মী হয়েও এভাবে নেতাদের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর 888sport sign up bonusকে স্যালুট দেওয়া! নিজেরও দ্বিধাভয় ছিল বলে নেতাদের অনুমতি সে আগেই আদায় করে রেখেছে। পকেটের পয়সা খরচা করে দলে নিজ গ্র“পে সমর্থকদের 888sport free betও বাড়িয়েছে। রাজুরা যতই ফাল পাড়–ক, টিটুর কাছে নত হতে হবে সব শালাকেই।
আমি এখন বাথরুমে, তোরে পরে ফোন দিতাছি Ñ বলেই সম্ভাব্য শত্র“কে টিপে ভ্যানিশ করে দেয় টিটু।
মোবাইল ফোন হাতে নিয়েই আজকাল সকালে বাথরুমে ঢোকে টিটু। অনেক রাতে বাড়ি ফেরে বলে বেলা করে শয্যাত্যাগ তার পুরনো অভ্যাস। ততক্ষণে ফোনে দু-একটা মিসড কল জমা হয়। বাথরুমে ঢুকে সাধারণত দিনের কাজকারবার ফাইনাল করার জন্য নানা জনের সঙ্গে ফোনে কথা সেরে নেয় টিটু। কিন্তু ভিআইপি কারো সঙ্গে নিজ বাড়ির পুরনো বাথরুম থেকে কথা বলতেও দ্বিধাসংকোচ জাগে। মনে হয়, বাথরুমের গন্ধ ও গরিবি চেহারা অপর প্রান্তের ভিআইপিগণ কান দিয়েও ঠিক দেখতে পাবেন।
প্রতিদিন সকালে প্রাকৃতিক ক্রিয়ার এই পুরনো জায়গাটায় ঢুকলে হুমায়ুন কবির টিটুর দেহমনের স্বস্তি বাড়ে বটে, পুরনো বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য মনের চাপটাও বাড়ে। 888sport appয় বাপের কিছু জায়গাজমি থাকলে কবেই ডেভেলপারকে দিয়ে বহুতল ফ্ল্যাট, নিজের জন্য আলাদা বিশাল ড্রয়িংরুম এবং সুগন্ধি-ছড়ানো ঝকঝকে বাথরুম বানিয়ে নিত। মাঝেমধ্যে দলের কিছু লিডারের বাসাবাড়ির ড্রয়িংরুমেও বসার সুযোগ হয়। যেমন নেতা, তেমনই তার ঠাটবাট। টিটুও আজ নেতাদের পাশে আর্টিস্টের আঁকা ছবিতে উদ্ভাসিত হুমায়ুন কবির টিটু হয়ে বিলবোর্ডে ধানমণ্ডিতে শোভা পাচ্ছে। এই মামুলি ভাড়াবাসার নোংরা বাথরুমে এখন তাকে মানায়! শিশিবোতলের ব্যবসায়ী বাপও বেকার বখাটে পোলার অবস্থান নিয়ে টিটুর মাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে সবসময়। আমার ব্যবসায় ঢুকল না, দিনে-রাইতে পাট্টি-পলিটিক্স কইরা বেড়ায়! কতো বড় নেতাগো লগে ঘোরে। তোর পলিটিশিয়ান পোলা অহনও বাপের ঘাড়ে পা তুইলা এ-বাসায় আছে ক্যান?
বেশিদিন থাকবে না। লাইনে যখন উঠেছে, পরিবারকে নিয়েই বড় বাসায় উঠবে টিটু। রাজুর মতো হিংসুটে শয়তানও আজ তাকে সমীহ করে কথা বলতে শুরু করেছে, দলের নেতাকর্মীরাও করবে। শুধু দলেবলে নয়, পুরো 888sport app শহরই একদিন নিজের নামচেহারা দিয়ে ভরিয়ে দেবে টিটু।
সকাল ৯টার বাথরুমে চোখ বুজে দেখা দিবাস্বপ্নের ঘোরেও বেশ চাঙ্গা হয়ে ওঠে টিটু। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আজ মায়ের সঙ্গেও কথা বলে অচেনা হুমায়ুন কবিরের ঠাটবাট নিয়ে, আব্বারে কইস মা, আমি মাসে আরো দশ হাজার টাকা দেব, বাসাটা পালটাইতে হইব। ঠিক আছে, আমি এ-মহল্ল¬ায় একটা ভালো বাসাও ঠিক কইরা দিমুনে।
নয়াবাজারে শিশিবোতলের দোকানটাই বাবার সংসারের একমাত্র ভরসা। চাকরি হয় না বলে ছেলেকেও নিজের ব্যবসার লাইনে নামানোর চেষ্টা করেছে বাবা। কিন্তু রাজনীতি করে সমাজ ভাঙাগড়ার খেলার প্রতিভা নিয়ে জন্ম হয়েছে যার, তাকে তুচ্ছ কাচ ভাঙরির দোকানে চৌহদ্দির মধ্যে আটকে রাখা কি সহজ কাজ? স্কুল থেকেই দলবলের সঙ্গে মিশে থাকার অভ্যাসটা গড়ে উঠেছিল টিটুর। কোনোমতে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্ররাজনীতির তেমন সুযোগ না পেয়ে মহল্ল¬ার যুবলীগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এরপর দলের পক্ষে মিছিল-সমাবেশ করার ব্যাপারে টিটুই হয়ে উঠেছে নেতাদের কাছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য কর্মী। মিছিলে উত্তাপ সঞ্চার করতেও তার জুড়ি নেই। একবার পুলিশকে ঢিল দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তার টিকিটি ধরতে পারেনি। ক্ষমতায় আসার আগে দলেবলে মিশে থেকে কয়েক বছর মিটিং-মিছিল করেও যা হয়নি, দল ক্ষমতায় আসার পর বত্রিশ নম্বরে একটি বিলবোর্ডের জাদুতেই টিটুর খ্যাতি-প্রতিষ্ঠা যেন আজ বহুগুণ বেড়ে গেছে।
বাসা থেকে বেরোনোর জন্য মোটরসাইকেলে হাত দিতেই মন্ত্রী সালামভাইয়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার আনন্দ পায় হুমায়ুন। এমনিতেই মোটরসাইকেলে উঠলেই মন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উত্তাপ পাছার নিচে সবসময়ই অনুভব করে। কারণ ভোটের সময় দলের ফুলটাইম কর্মী-ক্যাডারদের জন্য দশটি মোটরসাইকেলের ব্যবস্থা করেছিল সালামভাই। টিটু দিনরাত মোটরসাইকেল দাবড়ে সালামভাইকে জেতানোর জন্য কম করেনি। ভোটে জিতে এমপি সালামভাই প্রতিমন্ত্রী হয়েছে। আর তার দেওয়া মোটরসাইকেলখানা নিজের হওয়ায় টিটুরও দায়দায়িত্ব বেড়েছে অনেক। মন্ত্রী হওয়ার পর টিটুর মতো কর্মী-ক্যাডারদের সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে সালামভাইয়ের। এখন সরকারি পুলিশ, অফিসার-স্টাফরাই সারাক্ষণ তাকে বেষ্টন করে থাকে। টিটুর মোবাইলে মন্ত্রীর জ্বলজ্বলে নম্বরটা টিপলেও সবসময় সংযোগ হয় না। তাই বলে দলের কাজে টিটুর মোটরসাইকেলের গতি ও গন্তব্য সংকুচিত হয়নি, বেড়েছেই বরং।
বাড়ির কাছে মহল্ল¬ার রনি রেস্টুরেন্ট নামক চায়ের দোকানটাকেই ড্রয়িংরুম বানিয়েছে টিটু। মহল্লা ও দলের সমর্থক বন্ধুরা টিটুর সঙ্গে বাড়িতে দেখা করতে এলে এখানেই অপেক্ষা করে। নানা কাজের তদবির নিয়েও আসে লোকজন। টিটু তাই রেস্তোরাঁর সামনে মোটরসাইকেল থামিয়ে অন্তত রাস্তা থেকেও ড্রয়িংরুমে দর্শনার্থীর উপস্থিতি পরখ করে। আজ রাস্তায় মোটরসাইকেল দাঁড় করিয়ে ভেতরে ঢোকে। ক্যাশে বসা ম্যানেজার, মেসিয়ার ছেলে দুটি এবং টেবিলের খদ্দেরদের উদ্দেশে একই সঙ্গে অভিন্ন প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ওই, তোরা কেউ এর মধ্যে বত্রিশ নম্বরের দিকে গেছিলি নাকি?
যায়নি কেউ। ম্যানেজার জানতে চায়, টিটুভাই বত্রিশ নম্বরে কী হইছে?
নিজের উত্থানের খবর দিয়ে গৌরব করতে চায় না টিটু। বিনীত জবাব দেয়, সামনে জাতীয় শোক দিবস, বত্রিশ নম্বরে অহন কত কী! আমাদের প্রধানমন্ত্রী নেতারা সবাই আইব তো।
খদ্দেরদের আসন থেকে টিটুর কাছে এগিয়ে আসে অচেনা একজন। টিটুর সঙ্গে কথা বলার জন্যই অপেক্ষা করছিল লোকটা। বিলবোর্ডের ছবি দেখেই হোক, অথবা অন্য যে-কোনো চ্যানেলে, ড্রয়িংরুমে দর্শনার্থীর 888sport free bet বাড়লে খুশি হয় টিটু। কোণের টেবিলে বসে চা খেতে খেতে লোকটার পরিচয় ও মতলব জানতে চায় সে। মহল্ল¬ারই বাসিন্দা লোকটা। তিন নম্বর গলিতে ভাড়া থাকে। গতকাল পুলিশ নিউমার্কেটের তিনজন ছিনতাইকারীর সঙ্গে তার নির্দোষ ভাগ্নেকেও ধরে নিয়ে গেছে। কোর্টে চালান করে দেবে। ভাগ্নেকে ছাড়ানোর জন্য টিটুর সাহায্য চায় লোকটা।
নিজে দলে আছে বলে অচেনাদের দলীয় পরিচয়টা আগে জানার চেষ্টা করে টিটু। লোকটা এবং তার ভাগ্নে অন্তত বিরোধীদলীয় কর্মী-সমর্থক নয় শুনে কেসটা হাতে নেয় সে।
থানা-পুলিশ মন্ত্রীর কথাও হুনতে চায় না। ঘুষ না পাইলেই শালারা খালি আইনের প্যাঁচ দেখায়। তাছাড়া আমি একা গেলে তো কাম হবে না, দলের আরো দু-একজনকেও সঙ্গে নিতে হবে।
আমি ক্যাশ দশ হাজার টাকা সঙ্গে আনছি টিটু ভাই। দরকার হয় আরো দেব। কোর্টে চালান করলে জামিন-উকিলের হাঙ্গামা করতে পারব না।
অতিথিকে চা দিতে বলে টিটু। আজকের কর্মব্যস্ত দিনের সূচনা থানা থেকেই হবে বলে ফোনে দুই সহকর্মী Ñ সাগরদের থানায় যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তারপর লোকটাকে মোটরসাইকেলের পেছনে বসিয়ে থানার দিকে ছুটে চলে টিটুর মোটরসাইকেল।
থানার ওসি টিটুর শুধু মুখচেনা নয়, তার নামধামও জানা। বিরোধী দল পাওয়ারে থাকার সময় একবার সাসপেন্ড হয়েছিল এ-দারোগা, সে-খবরও জানে টিটু। মন্ত্রী সালামভাইয়ের নির্দেশে মাস দুয়েক আগেও দলের গ্রেফতারকৃত এক কর্মীকে ছাড়ানোর জন্য দলবল নিয়ে এসেছিল। দলের কর্মী শুনে সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দিয়েছিল ওসি। কিন্তু আজ দলের পরিচয় দেওয়ার পরও ওসি ব্যাটা টিটুকে চিনতে পারার বদলে সন্দেহের চোখে তাকায় কেন? দলের কমিটিতে এখনো তেমন পজিশন হয়নি বলে হুমায়ুন কবির নামে কার্ড বানায়নি সে। একা দেখলে পরিবারে যেমন, তেমনি বাইরেও টিটুকে লোকজন বখাটে যুবক কি ফিচকে মাস্তান ভাবে হয়তো। এজন্য একা সাধারণত থাকেও না টিটু। আজো সঙ্গের দুই কর্মী-সমর্থকই দারোগার কাছে টিটুকে তাদের নেতা হিসেবে চেনানোর চেষ্টা করে।
বত্রিশ নম্বরে গেলে টিটু ভাইয়ের বিরাট ছবি দেখতে পাবেন স্যার, মিনিস্টারের অর্ডারেই উঠছে। এর আগেও তো সেদিন মিনিস্টার সালামভাই আপনার কাছে পাঠিয়েছিল টিটুভাইকে।
ওসি কেসটা শোনার পর দ্বিধা নিয়ে বলে, স্পট থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে তিনজনকে, কেউ তো আপনাদের দল করার কথা বলেনি।
টিটু সিদ্ধান্ত দেয়, ওদের একজন ইয়াসিন আসলে আমাদেরই দলের। ওকে ছাড়তে হবে স্যার।
বিরক্ত ওসি বলে, প্রাইম মিনিস্টার বলেন, অপরাধী দলের লোক আর যে-ই হোক, অপরাধ করলে তাকে ছেড়ে না দিতে। আর আপনারা এসেছেন দলবলের প্রেশার নিয়ে। আমরা কীভাবে কাজ করব বলেন তো?
সরকারি চাকরি করে সরকারপ্রধান ও তার দলবলকে অগ্রাহ্য করার সাহস দেখালে সহ্য করা কঠিন। এসব লোকের জন্য আইন বা নিয়মনীতির শাসন নয়, বন্দুকের নলের মুখে বান্দরবানে বদলি কিংবা এক্ষুনি সাসপেন্ড করার ক্ষমতা দেখাতে পারলে উচিত শিক্ষা হয়। টিটু হাতের মোবাইলটাই অস্ত্রের মতো উঁচিয়ে বলে, আমার কথা বিশ্বাস না হলে মিনিস্টার সালামভাইকে ধইরা দিই, কথা বলেন। নাকি আপনি থাকতেও এই সামান্য ব্যাপারে আমাদেরকে আইজি-ডিআইজিদের সঙ্গে কথা বলতে হবে স্যার!
নরম হয়ে ওসি হাসে। টিটুকে বসতেও বলে। এসআইকে ডেকে হাজতিদের মধ্য থেকে ইয়াসিনকে ছেড়ে দেওয়ার গোপন নির্দেশ দেয়। খাতির জমানো কণ্ঠে বলে, এসআই-কনস্টেবলরা কষ্ট করে আসামিদের ধরেছে, ওদেরকে তো খুশি রাখার কথা ভাবতে হয় আমাকে।
টিটু প্রয়োজনে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করবে বলে পাঁচ হাজার টাকা একটি খামে আলাদা করে রেখেছিল। খামটা এগিয়ে দিয়ে বলে, এটা রাখেন স্যার, আপনি আমাদের জন্য করলে আপনাদের দিকটাও দেখা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের থানায় আপনার কোনো সমস্যা হলে বলবেন. সালামভাইকে বলব।
ভাগ্নেকে হাজত থেকে মুক্ত করে দেওয়ায় টিটুর প্রতি খুব কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে মহল্ল¬াবাসী লোকটা। ইচ্ছে করলে তার কাছ থেকে নিজের জন্য আরো কিছু নগদে আদায় করতে পারে টিটু। কিন্তু টাকাটাই তার কাছে সব নয়। জনসেবা করার আনন্দ ও পাবলিকের দোয়া-ভালোবাসা জিনিসটাকেও বড় গুরুত্ব দেয় হুমায়ুন কবির টিটু। লোকটাকে বিদায় দিয়ে, পরবর্তী গন্তব্য হিসেবে দলেরই সাংগঠনিক নেতার ব্যবসায়-অফিসে যাওয়ার কথা বলে টিটুর সঙ্গীরা। কিন্তু তার আগে বত্রিশ নম্বরে বিলবোর্ডের অবস্থান ও নিজের প্রতিকৃতিটা সচক্ষে দেখতে চায় বলে টিটু সঙ্গীদের জানায়, তোরা তো হালা আমার আসল নামটাও অহনো জানস না। চল দেখায়া আনি।
পেছনে বডিগার্ডের মতো দুই কর্মীবন্ধুকে নিয়ে টিটুর মোটরসাইকেল বত্রিশ নম্বরের দিকে ছুটে চলে।
বত্রিশ নম্বরে টিটুর বিলবোর্ড থানা-পুলিশকে খানিকটা প্রভাবিত করেছে কি? কে জানে, তবে এটা ঠিক, মন্ত্রীর মতো পাওয়ারফুল দু-চারজন নেতার কাছে মোবাইলের বোতাম টিপে সহজে পৌঁছতে পারার সুযোগ ও ক্ষমতাটিকে সবাই বড় দাম দেয়। মৃত্যুর কয়েক যুগ পরেও যে মহান নেতার 888sport sign up bonus-প্রতিকৃতি পুরো দলবলসহ জাতিকে প্রভাবিত করাতে পারে, সেই 888sport sign up bonusকেন্দ্রে নিজেকে তুলে ধরার পর হুমায়ুনের ক্ষমতার বলয় বাড়ানোর তৃষ্ণা ও চেষ্টাটাও তাই আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
প্রচুর টাকা ও বাড়িগাড়ির মালিক না হলে যে ক্ষমতাবান নেতা হওয়া যায় না, সেটা দলের বহু নেতাকে কাছে থেকে দেখেশুনে বুঝতে পেরেছে টিটু। ভাঙরি ব্যবসায়ীর পোলা হয়ে নেতাদের সারিতে ওঠার কথা ভাবতে পারে না সে। কিন্তু দলে লেগে থাকলে কি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ওয়ার্ড কমিশনারের পদে দাঁড়াতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। নগর কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা তাকে সমর্থন করবে। বর্তমান ওয়ার্ড কমিশনারের চেয়ে এখনই দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে টিটুর দহরম-মহরম। পার্থক্য শুধু, আগের কমিশনারের মহল্ল¬ায় নিজের বাড়ি আছে, ব্যবসা আছে, অন্যদিকে টিটু বেকার, থাকে এখনো বাপের ভাড়া বাসায়।
অল্প সময়ে মেলা টাকা ধরার ব্যবসায়ের ফাঁদফিকির খুঁজতেও টিটুর মোটরসাইকেল তাই নগরীর রাস্তায় জ্যাম কেটে সাঁ-সাঁ ছুটে চলে।
থানা-পুলিশের তদবিরে আজ পাঁচ হাজার টাকা আয় হয়েছে মাত্র। সঙ্গী দুজনের জন্য কিছু ব্যয় করে নিজের জন্য থাকবে সামান্য। আসলে বড় ব্যবসায়ীদের কাছে বড় দাঁও মারতে না পারলে চটজলদি অবস্থার বদল হবে না। টিটু মওকায় আছে। মহল্ল-ারই চেনা এক রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ী তার প্ল¬্যান পাশের জন্য মন্ত্রীর কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। প্ল্যানটা পাশ করিয়ে দিতে পারলে লাখ পাঁচেক দেবে। কাজটার বুকিং হিসেবে টিটুকে আগাম হাজার দশেক দিয়েছে। বত্রিশ নম্বরে নিজের অতবড় প্রতিকৃতি ওঠার পর দলের প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতারা তাকে চিনে মনে রাখবে কি? বিশেষ দিবস কেটে যাওয়ার পর দলেরই কেউ বিলবোর্ড নামিয়ে ফেলবে, স্থানীয় সংগঠন ও নেতাদের নামে করা তোরণগুলিও উধাও হবে। বিলবোর্ডের বাইরেও অন্য কিছু করা দরকার।
ক্ষমতার বলয়ে নিজের অবস্থান স্থায়ী করার লেলিহান তৃষ্ণা নিয়ে দলেবলে একাত্ম থাকতে হুমায়ুন কবির টিটুর মোটরসাইকেল জ্যাম কেটে রাজধানীর রাস্তায় সাঁ-সাঁ ছুটে চলে।
বিলবোর্ডে যা খরচ হয়েছে, সেই খরচে কয়েক হাজার পোস্টার ছেপেও দেয়ালে লাগাতে পারত সে। কিন্তু পোস্টার পথচারীদের নজরে এলেও নেতামন্ত্রীদের চোখে পড়ে কম। ওয়ার্ড কমিশনার পদে ইলেকশন করলে অবশ্যই পোস্টার-ব্যানারে মহল্ল¬ার সব দেয়াল ভরিয়ে ফেলবে টিটু। কিন্তু তার আগে ক্ষমতবান নেতাদের কাছে নিজেকে তুলে ধরাটা জরুরি। এ কাজে পোস্টার-ব্যানারের তুলনায় টিভিতে বা পেপারে নিজের নাম-ছবি প্রচার পেলেই সবচেয়ে বেশি সুবিধা। কারণ ঘরে বসে সব নেতাই কমবেশি এ দুটি জিনিসে চোখ বোলান। হুমায়ুন কবিরের নাম-ছবি দেখলে দলের চেনা-অচেনা নেতা, এমনকি হয়তো প্রধানমন্ত্রীরও চোখ আটকে যেতে পারে। পারে না?
টিটুর দুর্ভাগ্য, এতদিন রাজনীতি করার পর একবারই মাত্র তার ছবি পেপারে উঠেছিল। তাও দলের মিছিলের সঙ্গে। মিছিলে পুলিশের পিটুনি শুরু হলে টিটুর হাতে ইট ছিল বলেই তার ছবিটা অনেকেই চিনেছে। ওই সময় বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকায় টিটু ওই ইটওয়ালা ছবির কারণেই পুলিশের ভয়ে কয়দিন গা-888sport app দিয়ে বেড়িয়েছে। কিন্তু এখন তো টিটুদের দল ক্ষমতায়, ইচ্ছে করলে কি টিটু কোনো পেপারে নিজের একটা ছবি ও খবর ছাপাতে পারে না? প্রশ্নটা মনের মধ্যে জাগতেই মহল্লার এক সাংবাদিকের কথা মনে পড়ে। রনি রেস্টুরেন্ট তথা নিজ ড্রয়িংরুমে বসেই একদিন লোকটাকে দেখেছিল টিটু, কুদ্দুসের কাছে শুনেছে, বড় সাংবাদিক। কিন্তু আলাপ হয়নি। মহল্লায় থাকে যখন, তার ঠিকানা খুঁজে বের করা টিটুর জন্য কঠিন কাজ হবে না।
সারাদিন দল ও জনসেবার কাজে নানা গন্তব্যে ছোটাছুটির পরও, রাতে সাংবাদিককে ধরার জন্য টিটুর মোটরসাইকেল এবার নিজের মহল্ল¬ায় ছুটে চলে।
রনি রেস্টুরেন্টে বসেই মিনিট কয়েকের তত্ত্বতালাশে উদ্দিষ্ট সাংবাদিকের বাসার হদিস মেলে। মোটরসাইকেল রেস্টুরেন্টের সামনে রেখেই, একা মোড়ের নতুন ফ্ল্যাটবিল্ডিংয়ের তিনতলার ফ্ল্যাটে উঠে কলিংবেল বাজায় সে।
মুখচেনা সাংবাদিকের সঙ্গে হাত মেলানোর পরই টিটু জানতে চায়, ফ্ল্যাট কি কিনছেন, না ভাড়া?
ভাড়া শুনে ভরসা দেয়, ভাড়া থাকবেন কেন, মহল্ল¬ায় ডেভেলপাররা কত ফ্ল্যাট করতেছে। আপনারে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে দেব, আপনার মতো লোকের পার্মানেন্ট দরকার আছে আমাদের মহল্ল¬ায়।
দারোয়ানের মাধ্যমে ফোনে নিজের দলীয় পরিচয় দেওয়ার পরও সাংবাদিক শালা মনে হয় বিশ্বাস করেনি। জানতে চায়, আপনি ডেভেলপার কোম্পানিতে চাকরি করেন নাকি?
হুমায়ুন গর্বের সঙ্গে আবার দলের পরিচয় দিয়ে বলে, বত্রিশ নম্বরে গেলেও আমারেও চিনতে পারতেন।
বোকা সাংবাদিক মনে হয় তাও চিনতে পারেন না। জানতে চান, দল ছাড়া আর কী করেন আপনি?
দলবল আর জনসেবা কইরাই রাত বারটার আগে কখনো বাসায় ফিরতে পারি না। আপনি নতুন আইছেন তাই জানেন না। এই মহল্ল¬ায় বিরোধী পার্টির মাস্তান কাওছার গ্র“প চাঁদাবাজি কইরা বহুত অশান্তি সৃষ্টি করছিল। ইলেকশনের পর হারামজাদা কাওছারকে পিটাইয়া মহল্ল¬াছাড়া করছি। অহন জেলের ভাত খাইতেছে। এই মহল্ল¬ায় আর চাঁদাবাজি-অশান্তি পাইবেন না।
তা আমার কাছে কেন ভাই! আপনার জন্য কী করতে পারি বলেন?
টিটুও সরাসরি জবাব দেয়, আপনার পেপারে আমার একটা খবর ও ছবি ছাপায় দিতে হবে।
কিসের খবর?
এই যে কইলাম। তাছাড়া সামনে তো জাতীয় শোকদিবস। বত্রিশ নম্বরে গেলে দেখবেন, ওইখানে আমারও একটা বড় ছবি, মাত্র দুই হাজার টাকা নিয়া মহল্ল¬ারই সাইনবোর্ড আর্টিস্ট কইরা দিছে। সাইনবোর্ড আর কয়জন দেখব, আপনাদের পেপারে ছবি-খবর বের হইলে সবাই দেখত।
সাংবাদিক মুচকি হাসেন। জ্ঞান দেন, দেখেন ভাই, আমরা তো পেপারে দেশের ভালো বা খারাপ ঘটনার খবর ছাপি। খারাপ খবরই বেশি ছাপি, পেপারে খবর ছবি ছাপাইতে হইলে আপনাকেও ভালো-মন্দ একটা ঘটনার নায়ক, মানে অন্তত ঘটনার শিকার তো হবে। বললেই তো আর পেপারে ছবি ছাপা যায় না।
মুচকি হাসি দেখে মেজাজ খিচড়ে উঠেছিল টিটুর। কড়া জবাব দেয় সে, জাতীয় শোকদিবসে জাতির পিতার জন্য আমার ভালোবাসা, এত টাকা খরচ কইরা বিলবোর্ড টাঙানো, দিনরাইত দলের সেবা করা Ñ এসব আপনার কাছে কোনো ঘটনা না?
জাতীয় দিবস পালনের খবর ছবি তো পেপারে আসবেই। দেশের জন্য ভালো কিছু করেন, আপনার খবর ও ছবিও নিশ্চয় একদিন পেপারে বেরোবে।
সাংবাদিকের ওছিয়ত শুনে দেশপ্রেমের আবেগ টিটুর বুকে ছোবল দেয় যেন। দেশের জন্য ভালো কাজের আইডিয়াও মাথায় বিদ্যুতের মতো চলকে ওঠে। শোক দিবস উপলক্ষে মহল্ল¬াতেও স্কুল বা কলোনির মাঠে যদি জাতির পিতাকে ঘিরে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারে, আর সেখান মন্ত্রীসহ দুই-এক নেতা আসে, কাগজের সাংবাদিক ছাড়াও টিভির ক্যামেরা অবশ্যই আসবে। আর হুমায়ুন কবির টিটুও যদি মঞ্চে আয়োজক হিসেবে মন্ত্রী-নেতাদের পাশে থাকে, তবে সাংবাদিকদের ক্যামেরা তাকেও মিস করতে পারবে না। মন্ত্রীর সঙ্গে যাতে টিটুর ছবিও বেরোয়, এই সাংবাদিককে সে আগাম বলে রাখবে। টিটুর এতবড় ভালো কাজের খবর না ছেপে মহল্ল¬ায় কেমনে থাকে সে, দেখবে।
ঠিক আছে ভাই, এই মহল্ল¬ায় তোলপাড় করা দেশের জন্য একটা ভালো কাজ কইরাই আপনার কাছে আসব।
সাংবাদিকের বাসা থেকে মোটরসাইকেল পর্যন্ত দ্রুতপায়ে আসে টিটু। ভেতরে জাগ্রত দেশপ্রেমের প্রকাশ দেখাতে নেতাদের কথাই আগে মনে পড়ে। শোক দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠান করতে চাইলে চিফ গেস্ট হওয়ার জন্য অনুমতি ও সময় দিতে মন্ত্রীকেই আগে ধরা দরকার। মোটরসাইকেলে উঠে অভ্যস্ত পায়ের কিকটি আজ বেশ জোরের সঙ্গেই ছুড়ে দেয় সে। গর্জে উঠেই টিটুর মোটরসাইকেল এবার দ্রুত ছুটতে থাকে মন্ত্রীর বাড়ির দিকে।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.