দুই ‘বহিরাগত’ সমামত্মরাল জীবন

হাসান ফেরদৌস

 

‘রিয়েল’ এবং ‘রিয়েলিটি’ এক জিনিস নয়। গল্প, তা  যে-বিষয় বা ব্যক্তি নিয়েই হোক, পাঠকের কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। তা ‘রিয়েল’ কি না, অর্থাৎ সত্যি-সত্যি এমন ঘটেছিল কি না, সফল 888sport alternative linkের জন্য তা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। সম্ভবত এ-কথাটা বোঝাতেই রবীন্দ্রনাথ ‘888sport live footballের সত্য’ নামে একটি ধারণার কথা বলেছিলেন।

নীল মুখার্জির 888sport alternative link অ্যা লাইফ অ্যাপার্ট (নর্টন, নিউইয়র্ক, ২০১৬) পড়তে গিয়ে আমার এ-প–তি কথাগুলো মনে পড়ল। দুটি সমামত্মরাল জীবনের গল্প নিয়ে এই বই, তার একটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক, অন্যটির উৎস কঠোর যাপিত বাসত্মবতায়। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ভারতে ২০০৮ সালে, পাস্টকন্টিনিউয়াস, এই নামে। সেই বই নতুন নাম নিয়ে পেপারব্যাক হিসেবে নিউইয়র্ক থেকে বেরিয়েছে ২০১৬ সালে। অপরিচিত হলেও লেখকের বাঙালি নাম, সেই আগ্রহে বইটি সংগ্রহ করেছিলাম। প্রায় ৪০০ পাতার ঢাউস বই, বলতে পারেন প্রায় গোগ্রাসে তা পড়েছি। শুধু বেঁচে থাকার জন্য মানুষের যে কঠিন-কঠোর দিনাতিক্রম, তাকে এমন নিরাবেগ ও নিরাসক্ত অভিনিবেশে প্রকাশ গ্রন্থটিকে দুর্লভ্য সাফল্যে ভূষিত করেছে।

নীল কলকাতার বাঙালি ছেলে, বিলেতে থাকেন, এই দুই জীবনকেই তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এ-গ্রন্থে তাঁর নিরীক্ষণের বিষয় একজন বহিরাগতের জীবন, একজন নয় দুজন, সময়ের হিসাবে তাদের মধ্যে ফারাক একশ বছরেরও বেশি। বহিরাগত, আক্ষরিক অর্থেই তারা ‘দ্য আদার’। এদের একজন 888sport appsের বগুড়ায়, অন্যজন লন্ডনে। একজন ঔপনিবেশিক ভারতে শ্বেতপ্রভুর প্রতিনিধি, যদিও সেই শ্বেতপ্রভুর চেয়ে বাংলার সঙ্গেই তার অধিক নৈকট্যের বাঁধন। অন্যজন স্বাধীন ভারত থেকে আসা নতুন প্রজন্মের একজন প্রতিনিধি, ভাগ্য বদলাবে এই বিশ্বাসে প্রাক্তন প্রভুর দ্বারে এসে সে কড়া নাড়ছে কৃপাভিক্ষার আশায়। সময়, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক পরিপ্রেক্ষেত, এমনকি লিঙ্গভেদ সত্ত্বেও অমত্মর্গতভাবে তারা অভিন্ন। গ্রন্থের নাম আলাদা জীবন হলেও বস্ত্তত তাদের জীবন অভিন্ন, নীল মুখার্জি কল্পনার জাদু মিশিয়ে এই দুই জীবনকে এক সুতোয় বেঁধেছেন। সে-গ্রন্থের আদি নাম পাস্টকন্টিনিউয়াস আমার বিবেচনায় অধিক তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ সময় ও স্থানের ভিন্নতা সত্ত্বেও এই জীবন দুটি অমত্মর্গতভাবে একই সুতোয় বাঁধা।  তারা ‘রিয়েল’ হোক বা না হোক, এই নির্মাণ যে বিশ্বাসযোগ্য – ‘রিয়েলিস্টিক’ – তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

কলকাতায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত একান্ন পরিবারের সন্তান ঋত্বিক, অসহ্য-ভাবনীয় দারিদ্রে্য তার শৈশব কেটেছে। কঠোর নিয়মানুবর্তী মায়ের শাসন-িআঁচলে তার শৈশব-আশু যৌবন ছিল নিরানন্দ, সে-সময়ের প্রিয় ও আনন্দময় কোনো 888sport sign up bonus কার্যত তার নেই। ভালো ছাত্র ছিল, সেই সুবাদে বিদেশি বৃত্তি নিয়ে বিলাতে আসা, দুবছরের জন্য। বিদেশ মানেই সোনার হরিণের স্বপ্ন, তাকে ঘুমে দেখা যায়, জাগরণে নয়। এই বাসত্মবের সঙ্গে পরিচিত ঋত্বিক, কিন্তু দেশে ফেরার কোনো তাড়া নেই তার, যেভাবে – যে-মূল্যে হোক তাকে এখানেই থাকতে হবে। ফলে, আরো হাজার-হাজার অবৈধ অভিবাসীর মতো ঋত্বিকও বৈধ কাগজপত্র ছাড়া একজন বেআইনি বহিরাগত হয়ে পড়ে। এভাবে মাটি কামড়ে থাকা যায়, কিন্তু বাঁচা যায় না। সমকামী ঋত্বিক শুধু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে একজন যৌনকর্মী হয়ে পড়ে। মাথা গোঁজার ঠাঁই মেলে বৃদ্ধা অ্যানক্যামেরনের বাসায়। এখানে, নিজের একাকিত্ব কাটাতে ঋত্বিক লেখা শুরু করে মিস গিলবির গল্প। রবিঠাকুরের ‘নষ্ট নীড়’ গল্পে এই গিলবি একজন নেহায়েত গৌণ চরিত্র, জমিদার নিখিলেশের স্ত্রী বিমলার ইংরেজির শিক্ষক মাত্র। রবীন্দ্রনাথ তার জন্য বড়জোর পাতাদুয়েক ব্যয় করেছেন। নীল গিলবিকে তাঁর গল্পের দ্বিতীয় মূল চরিত্র করে তোলেন, তাঁর চোখ দিয়ে দেখার চেষ্টা করেন বঙ্গভঙ্গের সময় নিখিলেশ ও বিমলার জীবনের ঝড়। সে-ঝড় যেমন বাইরে, তেমনি ভেতরেও।

এ-গল্পের মোড়কে নীল মুখার্জি ক্রমশ যে-কাহিনি গড়ে তোলেন, তার কেন্দ্রে রয়েছে ‘বহিরাগতের’ – ‘দি আদার’-এর
– নিকট অবলোকন। মিস গিলবি ও ঋত্বিক, উভয়েই বহিরাগত, কিন্তু যে ‘আদারনেস’ তাদের আক্রামত্ম করে, তাদের স্বরূপ ভিন্ন। ঔপনিবেশিক ভারতে মিস গিলবি ক্ষমতাধরের প্রতিনিধি, তিনি শ্বেতপ্রভুর একজন। ভাবনায়, সহানুভূতিতে, বুদ্ধিগত বিবেচনায় তিনি নিজে কখনো রাজপ্রতিনিধি হয়ে ওঠেননি, বরং তিনি অনেক বেশি নৈকট্যবোধ করেন শাসিতের সঙ্গে। কিন্তু ‘অপর’ ধারণাটি নির্মিত হয় সমষ্টিগত দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে, ব্যক্তির পরিচয় প্রকাশিত হওয়ার অনেক আগেই সমষ্টির ভিত্তিতে তার আত্মপরিচয় নির্ধারিত হয়ে যায়। আমাদের মাথার ভেতর যে-ছবি থাকে, সেটাই মুখ্য হয়ে পড়ে, ব্যক্তিকে সমষ্টি থেকে আলাদা করার প্রয়োজন আমরা দেখি না। ফলে, তাঁর সকল আমত্মরিক চেষ্টা সত্ত্বেও ঔপনিবেশিক ভারতে মিস গিলবির একটাই পরিচয় – তিনি শ্বেতপ্রভুর প্রতিনিধি, অতএব শাসিতের চোখে তিনি শত্রম্ন।

‘আদার’ হিসেবে ঋত্বিকের অবস্থানটিও খুব ভিন্ন নয়, যদিও তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা পুরোপুরি ভিন্ন। সে শিক্ষেত, আধুনিক ও বিশ্বাসবোধে কসমোপলিটান হওয়া সত্ত্বেও বিলাতে তাঁর একটাই পরিচয় – সে অবৈধ অভিবাসী। প্রামত্মবর্তী এসব মানুষ, তাঁরা যেখান থেকে আসুন না কেন, চরিত্রগতভাবে তাঁরা একে অপরের চেয়ে যত ভিন্নই হোন না কেন, 888sport free betগুরু তাদের জন্য যে আত্মপরিচয় বেঁধে দিয়েছে, তার থেকে বেরোনোর কোনো উপায় নেই। সমাজের প্রামত্মসীমায় তার বাস, ‘অবৈধ’ হলেও 888sport free betগুরুর কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন সে মেটায়। নোংরা ও শ্রমনির্ভর কাজ, যা করতে 888sport free betগুরু নিজে আগ্রহী নয়, এই বহিরাগতেরা তা করবে, বিনিময়ে দেহ ধারণে তার ন্যূনতম প্রয়োজন মেটানো হবে, এই অলিখিত – অথচ সুপরিচিত – সামাজিক চুক্তির ভিত্তিতে তাদের অস্তিত্ব মেনে নেয় 888sport free betগুরু।

আগেই বলেছি, নীল মুখার্জির 888sport alternative linkে মিস গিলবির কাহিনিটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।  রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘নষ্ট নীড়’ গল্পে – অথবা সত্যজিৎ তাঁর ঘরে বাইরে live chat 888sportে – গিলবির মনের জগৎটি আমাদের কাছে উন্মোচিত করেননি, সেখানে গিলবি একজন আকস্মিক অতিথি, অতিথি কক্ষের বাইরে তার স্থান হয় না। নীল তাকে একজন পূর্ণ মানবীর অবয়ব দিয়েছেন – তার বোধ, বিশ্বাস, আক্ষেপ ও অপেক্ষার অমত্মরঙ্গ ছবিটি এঁকেছেন। কল্পনা বলছি বটে, রবিঠাকুর সে-গল্প বলেননি, তাতে কি, প্রথম রচনার এক শতাব্দী পরে তাকে পূর্ণতা দেন নীল।  কাহিনিকার হিসেবে তাঁর মুন্শিয়ানায় আমাদের মুগ্ধ হতে হয়।

অন্যদিকে ঋত্বিকের যে গল্প, তার ভিত্তিটি সম্পূর্ণ বাসত্মব, কোনো না কোনো ঋত্বিকের অভিজ্ঞতায় এই ঘটনা দৈনিক ঘটে চলেছে। পরিপ্রেক্ষেত ভিন্ন হতে পারে, ঘটনার পারম্পর্যে ফারাক থাকতে পারে, কিন্তু মোদ্দা অভিজ্ঞতাটি খাঁটি। অভিবাসী হিসেবে এই অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমি নিজে পরিচিত, এর বৈধতা নিয়ে আমার মনে কখনোই কোনো প্রশ্ন জাগেনি।

অভিবাসন সুখকর নয়, একথা জানার পরেও সম্পূর্ণ বিজাতীয় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাসত্মবতাকে অভিবাসী কেন স্বেচ্ছায় বেছে নেয়? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এর উত্তর অর্থনৈতিক। যে কঠিন-কঠোর জীবন ত্যাগ করে উন্নততর আর্থিক সম্ভাবনার সে দ্বারপ্রামেত্ম, একজন অভিবাসী তাতে সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। নিদেনপক্ষে তাকে সে বিশ্বাস করতে চায়। ঋত্বিকের জন্য বাড়তি তাগিদ, সমকামী হিসেবে নিজ দেশেই যে ‘অপর’, সেখানে সামাজিকভাবে স্বীকৃত হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই তার নেই। বিদেশে, নাম-পরিচয়হীন আত্মপরিচয়ের মুখোশে সে নিজেকে ‘মুক্ত’ ভাবার সুযোগ পাবে, এই বিবেচনাও তাকে প্ররোচিত করে।

‘আমি আর সেই দুঃসহ দারিদ্রে্য ফিরে যেতে চাই না। আমার পিতা যেভাবে ক্রমশ অতলে তলিয়ে গেছেন, আমি তা চাই না। ফিরে গেলে আমার জন্য সেই পুরানো জীবন, অনমত্মকাল অপরিবর্তিত যে জীবন, তাই অপেক্ষা করবে।’

কিঞ্চিত ইতসত্মত করে গেভিন বলে, ‘সমকামী, সে কারণে তুমি দেশে ফিরতে চাও না, সেটাও কি ঠিক না?’

ঊর্ধ্বমুখী তাকিয়ে জবাব দেয় ঋত্বিক, ‘সেটাও অংশত ঠিক, এখানে আমি মুক্ত হয়ে থাকতে পারব। নিজের যৌন পরিচয় গোপন না করে থাকার যে সম্ভাবনা, তার মূল্য খুব কম নয়।’ দীর্ঘ বিরতি নিয়ে সত্যি কথাটা ভেবে দেখার সুযোগ পায় ঋত্বিক।

‘দেখ গেভিন, মানুষ নিজে দেশ থেকে পালায় যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, রাজনৈতিক অত্যাচার, এইসব নানা কারণে। এসব হালকা জিনিস নয়। কিন্তু, তুমি বল, নিজের অসুখ ও দুর্ভাগ্য থেকে যদি কেউ পালাতে চায়, রাস্তার শেষ সীমায় পৌঁছানোর আগে বাঁক নিতে চায়, সেটা কি খুব দোষের? নতুন জায়গায়, নতুন মানুষের সঙ্গে আমি নতুন করে শুরু করতে চাই, সেটা কি খুব অভাবিত?’

ঋত্বিকের এই অবরোহী যৌক্তিকতা বস্ত্তত নিজেকে আশ্বসত্ম করার একটি গোপন হাতিয়ার। সকল অভিবাসী অনবরত একটি অপরাধবোধে ভোগে : সে নিজে রাস্তার শেষ সীমায় পৌঁছানোর আগেই বাঁক নিয়েছে, কিন্তু যারা রয়ে গেল – নিকটাত্মীয়, শৈশবের বন্ধু – তাদের কী হবে? ঋত্বিকের বেলায় তার এক সহোদর, আশৈশব সকল সুখ-দুঃখ যার সঙ্গে সে ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে। তার মুখটি ঋত্বিকের মনে পড়ে। ‘ভাইয়ের প্রতি নিজের বিশ্বাসঘাতকতা তার মুখে বিস্বাদ লাগে, ভাইয়ের নিষ্পাপ ছবিটি – পালানোর জন্য তারও ছিল দুর্মর আকাঙক্ষা – তাকে ছুরির মতো আঘাত করে। কিন্তু তাকে মিথ্যা বলতে হয়, বেঁচে থাকার জন্য।’

সমাজের প্রামত্মবর্তী সীমায় নতুন যে-জীবন ঋত্বিক নিজের জন্য নির্বাচন করে, তার ভয়াবহ চরিত্রের সঙ্গে তার কোনো পরিচয় ছিল না, তার ভাবনাতেও সে বাসত্মবতাকে সে প্রশ্রয় দেয়নি। যে কোনো মূল্যে বাঁচতে হবে, বেঁচে থাকতে হবে। লন্ডনে তাঁর মতো নাম-পরিচয়হীন অবৈধ অভিবাসীর অভাব নেই – মেসিডোনিয়া, আলবেনিয়া, লিবিয়া, 888sport apps, পাকিস্তান, রাশিয়া, ইউক্রেন নানা দেশ, নানা জনপদ থেকে তাদের আগমন। মুক্তির আশায় নিজ দেশ ছেড়ে পালানো, কিন্তু অধিকাংশের নিয়তি নতুন ধনী জনারণ্যে দিনমজুরের কাজ – শস্যক্ষেত অথবা ফলের বাগানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, প্রায় বিরতিহীন পরিশ্রম। নির্দিষ্ট কোটা পূরণ করতে হবে, অপচয় করা যাবে না, কাজের ফল দেখে দিন শেষে মজুরি। মাথার ওপর খড়্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দালাল, সেও ভিনদেশি, সম্ভবত সেও অবৈধ, কিন্তু সহমর্মিতার কোনো স্পর্শ তার মধ্যে নেই। নীল এই অভিজ্ঞতার বিবরণটি দিয়েছেন প্রবল সহমর্মিতায় ও অভিনিবেশে, তিনি যেন একটি বিপুল বেদনার ছবি িআঁকছেন, সেখানে কান্নার প্রতিটি অশ্রম্নকণা – বেদনার প্রতিটি দমক – গুরুত্বপূর্ণ, এভাবে এক অপরিসীম দুর্ভাগ্যের মানচিত্র গড়ে ওঠে। এই মানচিত্রে কারো কোনো ভিন্ন

পরিচয় নেই, তারা নামহীন-গোত্রহীন, শুধু দুর্ভাগ্যের এক গহন অরণ্য তাদের যূথবদ্ধ করেছে।

ভারতে মিসেস গিলবির অভিজ্ঞতাটি ভিন্ন, শ্বেতপ্রভুর একজন হওয়ায় বেঁচে থাকার যুদ্ধ তাঁকে চালিয়ে যেতে হয় না। মিস গিলবির সমস্যা, যত চেষ্টাই তিনি করুন, তিনি কখনোই একজন ভারতীয় হবেন না। অথবা, যত চেষ্টাই তিনি করুন, একজন ভারতীয়ের মন তিনি কখনোই পুরোপুরি বুঝবেন না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, বিসত্মর দেন-দরবারের পর মহীশূরের মহারাজার অন্দরমহলের বাসিন্দাদের সঙ্গে দেখা করার একটি সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন। বহু অলংকারে সজ্জিত সেইসব মহিলারা মিস গিলবি ও তার ইংরেজ বান্ধবীদের মাথায় হ্যাট দেখে, অনাবৃত হাত দেখে হেসে কুটি-কুটি। ‘তাদের পোশাক-আশাক এত ভিন্ন যে, তারা যেন ভিন্ন-ভিন্ন প্রজাতির।’

বগুড়ায় নিখিলেশের জমিদার বাড়িতে এসে প্রাথমিক জড়তা কাটিয়ে ওঠার পর বিমলার সঙ্গে অমত্মরঙ্গ সম্পর্ক নির্মাণ গিলবির জন্য কঠিন ছিল না, কিন্তু যে-সামাজিক আচার-আচরণে ভারতীয় জীবন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা, তা সামলানো মিস গিলবির জন্য দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। একবার আকস্মিকভাবে তিনি বিনা আমন্ত্রণে ভেজানো দ্বার ঠেলে ভেতর-মহলে ঢুকে পড়েছিলেন।  সে-মহলের বিস্ময়াহত বাসিন্দারা যত দ্রম্নত সম্ভব আড়ালে আশ্রয় নিলেন। তিনি ত্রসত্ম বিদায় নেওয়ার পর জল ঢেলে তা শুচিশুদ্ধ করা হয়, দরোজার অপর পার থেকে গিলবি তা ঠিকই ধরতে পারেন।

‘নষ্ট নীড়ে’র গল্পটি – নিখিলেশ, বিমলা ও সন্দ্বীপের ত্রিভুজ সম্পর্ক – নীল এ-888sport alternative linkে মোটামুটি বিশ্বসত্মতার সঙ্গেই সেটি অনুসরণ করেন, কিন্তু তা প্রকাশিত হয় মিস গিলবির চোখে। ফলে বাইরে থেকে ভেতরে তাকানোর একটি ভিন্ন অভিজ্ঞতা এতে আমাদের অর্জিত হয়। মার্জিত রুচি ও শিক্ষেত ভাবনার মানুষ নিখিলেশের প্রতি গিলবির একটি স্বাভাবিক পক্ষপাতিত্ব আছে, তাঁর কাছে নিখিলেশ কার্যত একজন ‘ভারতীয় ইংরেজ’। অন্দরবাসিনী হলেও বিমলা যে মুক্তমনা, এ-পরিচয় পেতেও তাঁর বিলম্ব হয় না। তাঁর মনে এই রুচিশীল ও আধুনিক ভারতীয় দম্পতির প্রতি গভীর আনুগত্য জন্ম নেয়, তাদের প্রতি যে
মঙ্গল-আকাঙক্ষা, সেটিও আমত্মরিক। ‘স্বদেশি বাবু’ সন্দ্বীপের অনাহূত আগমনের ফলে এই সাজানো বাগানে যে-ঝড় ওঠে, সেটি গিলবির অগোচরে থাকে না, সন্দ্বীপ ও বিমলার মধ্যে একটি অবৈধ সম্পর্ক দানা বাঁধছে, সেটিও ক্রমশ অনাবৃত হয়। রবিঠাকুর নিজে যা করেননি, এমন অমত্মরঙ্গতার বিবরণও মিস গিলবির বয়ানে আমাদের শুনিয়ে দেন নীল।

‘মিস গিলবি তাঁর স্বাভাবিক কৌতূহল নিয়ে ত্রসত্ম পায়ে এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষ পেরিয়ে যান। সামান্য শব্দ, অথবা মানুষের পদশব্দ শুনে চকিতে তিনি ফিরে তাকান। হঠাৎ তাঁর চোখে যে দৃশ্য নজরে আসে, তাতে মিস গিলবির চুল খাড়া হয়ে যায়। কেরোসিন লণ্ঠনের মৃদু আলো-িআঁধারে, বাইরের বৃক্ষরাজির দীর্ঘ ছায়া ভেদ করে তাঁর চোখে পরে বিমলা ও মি. ব্যানার্জি, সেই বিপস্নবী স্বদেশি। ঘনিষ্ঠ আলিঙ্গনে তারা একে অপরকে জড়িয়ে আছে, উভয়ের ঠোঁট এক বাকহীন কামেচ্ছায় আটকা পড়েছে।’

নীলের বাহাদুরি যে, এই সমামত্মরাল দুই কাহিনির পরিসমাপ্তি তিনি টেনেছেন এক অদৃশ্য নিকট-বন্ধনে। রবিঠাকুরের গল্পে আমরা জানি বঙ্গভঙ্গের সেই উত্তেজনায় নিখিলেশের গ্রাম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ঝলসে উঠেছিল, তাতে মিস গিলবির কোনো ভূমিকার কথা আমরা পড়িনি। নীল সেটি কল্পনায় এনেছেন অতি বিশ্বাসযোগ্যভাবে। একদিন ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন মিস গিলবি, লোকালয় পেরিয়ে নির্জন প্রামত্মরে আসামাত্র তাঁকে মুখোমুখি হতে হয় ক্রুদ্ধ গ্রামবাসীর। তাদের মধ্যে জনাদুয়েককে তিনি চেনেন, নিখিলেশের প্রজা হিসেবে এতদিন মিস গিলবিকে তারা সালাম জানিয়ে এসেছে। প্রথমে গিলবির পিঠে এসে লাগে একটি ঢিল, ভীত গিলবির হাত থেকে ঘোড়ার লাগাম খসে পড়ে। মিস গিলবি ভাবেন নিশ্চয় ভুলে কেউ ঢিল ছুড়েছে, তাকে কেউ আঘাত করতে পারে না। কিন্তু সে-ভুল ভাঙতে সময় লাগে না, তাদের সেই চেনা দুজনের ছোড়া ঢিল এবার এসে পড়ে তাঁর মাথায়। জ্ঞান হারানোর আগে তিনি শুনতে পান সেই যুবকেরা ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি তুলছে।

লন্ডনে এক সন্ধ্যায় একাকী হেঁটে যাওয়ার সময় বর্ণবাদীদের হামলায় আক্রামত্ম হয় ঋত্বিক। ‘পাকিখানকি, তুই নিজের দেশে ফিরে যা’, তারা ঋত্বিককে বিদ্রূপ করে। ভীতি গ্রাস করে ঋত্বিককে, ত্রসত্ম সে পালাতে চায় বৈরী পরিবেশ থেকে। যে-রাস্তাটা স্বল্প আলোয় 888sport app, দ্রম্নত সেদিকে পা বাড়ায়, ভাবে, সেটাই পালানোর নিকট পথ। ঋত্বিক ভয় পেয়েছে, লোকগুলো সে-কথা টের পেয়ে তারা দ্রম্নত তার পিছুপিছু এগিয়ে আসে। যেন অভুক্ত শিকারি কুকুর, খাদ্যের গন্ধ পেয়েছে। আনন্দে শিস বাজায় তারা। পাঁচজন লোক এবার তাকে ঘিরে ধরে, একজন লাফিয়ে পড়ে তাকে টেনে নামায়। অন্যজন তার অ-কোষে লাথি মারে, আরেকজন তার বুকের পাঁজর খামচে ধরে। মানুষগুলোর মধ্যে এমন তীব্র ক্রোধ, এই ঘৃণা কোথা থেকে আসে, জ্ঞান হারানোর আগে শেষবারের মতো ভাবে ঋত্বিক।

নীল মুখার্জির এটি প্রথম 888sport alternative link, এতে কল্পনা ও বাসত্মবতার এমন প্রখর সমন্বয় তিনি অর্জন করেছেন, যা পাঠক হিসেবে আমাকে তাক লাগায়। গ্রন্থের প্রথম পর্বে কলকাতায় ঋত্বিক ও তার পরিবারের দারিদ্র্য ও একান্নবর্তী পরিবারের অহর্নিশ দ্বন্দ্ব – তাদের অপমানিত, অপচয়িত দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বিবরণ – যা কখনো ক্রোধে, কখনো বেদনায় প্রকাশিত হয়, কিন্তু কখনোই তাকে কৃত্রিম ও কষ্ট কল্পনা মনে হয় না। যে-কোনো সফল 888sport live footballকর্মের প্রথম শর্ত, সহমর্মিতা, নীল এই 888sport alternative linkে আগাগোড়া তা রক্ষা করে চলেন, অথচ কখনোই লেখকের পরিকল্পিত অভিপ্রায় হিসেবে প্রকাশিত হয় না।

যে-ভাষায় তিনি এই কাহিনি নির্মাণ করেন, তাতে একটি বিস্ময়কর সমভার রয়েছে – কাব্যিক পেলবতা রয়েছে, কিন্তু ভাবালুতা নেই। তাঁর দেখার চোখটিও অসাধারণ, বেদনার ও একাকিত্বের যে নির্জনতা, তাকে প্রকাশের জন্য যে ঋজুতা চাই, নীল তা অর্জন করেন অভাবিত দক্ষতায়। কিছু উদাহরণ দিই।

ঋত্বিকের মনে পড়ে পিতার কথা, ‘একজন ক্লামত্ম মানুষ, রাস্তার পাশ ঘেঁষে মাথা নিচু করে, ঢাকনাবিহীন ড্রেনের পাশে সামান্য যে জায়গা তা ধরে হেঁটে চলেছেন, যেন সকালে সেই একই পথ ধরে যাওয়ার সময় কিছু একটা খুইয়েছিলেন, তা খুঁজছেন। একজন অতিশয় প্রাচীন, অতিশয় বৃদ্ধ, অপরিচিত কানাগলিতে আটকে আছেন, যার অর্ধেক দেহ ইতোমধ্যে মৃত্যুর ছায়ায় 888sport app পড়েছে।’

ফলবাগানে কাজ করার সময় ঋত্বিকের পরিচয় হয় এক আলবেনীয় যুবকের সঙ্গে।                ‘তাদের গ্রাম ছাড়া করার জন্য বন্দুক নিয়ে পুলিশ দরজায়-দরজায় আঘাত দিয়ে বলে গেছে এখনই পালাও, আর কখনো ফিরবে না। থেকেই বা কী করবে, আলবেনিয়ায় আয়ের কোনো পথ নেই, কোনো চাকরি নেই। ক্ষুধায় ও পিপাসায় তুমি মরে গেলেও কেউ ফিরে তাকাবে না, এমনকি কোনো কুকুর এসেও তোমার মুখ ভেজানোর জন্য প্রস্রাব করবে না।’

বৃদ্ধা অ্যানের সঙ্গে কথা বলার সময় ঋত্বিককে চুপ করে থাকতে হয়। একদম চুপ, নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে হয় কখন ফের সে কথা বলবে, যেন এক বিরল প্রজাতির প্রাণী জল খেতে এসেছে, সামান্য শব্দ করলে – এমনকি নিশ্বাস ছাড়লেও – সে চলে যাবে, আর কখনো ফিরে আসবে না।

অভিনন্দন, নীল। আপনার পরবর্তী গ্রন্থের জন্য গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করব।