দুটি রাতের ভোরের দিকে যাত্রা

হাসনাত আবদুল হাই

এক

ঘটনাটি যদি হয় ছেচলিস্নশ কি সাতচলিস্নশ বছর আগের এবং ঘটে থাকে এ-দেশেই, যদিও তখন নাম ভিন্ন ছিল, আর যে বা যিনি প্রত্যক্ষদর্শী না হলেও সঙ্গে সঙ্গেই জেনেছেন বা শুনেছেন, তিনি যদি এমনভাবে বর্ণনা করেন যে, তার 888sport sign up bonusতে সেই অভিজ্ঞতা, জানার এবং শোনার, শুধু রক্তাক্ত ক্ষতের মতো জ্বলজ্বল করছে না, মাঝে মাঝেই এমনভাবে যন্ত্রণাকাতর করে তুলছে যে মনে হয় ছেচলিস্নশ কি সাতচলিস্ন­শ বছর নয়, এই সেদিন শুনতে পেয়েছেন, আরো অনেকের সঙ্গে যারা তার মতোই ভয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়েছিল তাদের মফস্বল শহরের উত্তর-পূর্বে এক প্রান্তের দিকে যেখানে বকুল গাছঅলা একতলা সাদা দালানটা প্রায় সবার কাছেই ছিল পরিচিত, সেখানে যাতায়াত ছিল এমন লোকেরাও হয়ে পড়েছিল ভীতসন্ত্রস্ত, তাহলেও এই দীর্ঘকাল আগে ঘটে যাওয়া মর্মন্তুদ ঘটনাটি যুবক বয়সের একজন, তাকে ঝোড়ো হাওয়ার মতো বিপর্যস্ত করতে পারে না, যন্ত্রণাকাতর তো নয়ই। অথচ ভদ্রলোক, যিনি প্রত্যক্ষদর্শী না হলেও ছেচলিস্ন­শ কি সাতচলিস্নশ বছর আগের ঘটনাটি জেনেছেন বা শুনেছেন, তিনি তাকে, তার চেয়ে বয়সে অনেক কম যুবককে করুণ স্বরে অতীতের অভিজ্ঞতা বর্ণনার পর তার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য তাকিয়ে থাকলেন এক দৃষ্টিতে, যেন দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে যুবকের সহানুভূতি-ভেজা স্বরে বলা কিছু কথা শুনতে খুবই উদগ্রীব। কিন্তু তার, যাকে বলা হলো ঘটনাটি সেই যুবকের ভেতর এমন কিছুই ঘটল না, যাকে সত্যিকার অর্থে প্রতিক্রিয়া বলা যায়, বিশেষ করে দীর্ঘকাল আগের ঘটনাটির প্রসঙ্গে। সে, যুবকটি, তার অফিসের টেবিলে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে শুধু বলতে পারল, ভেরি স্যাড। ট্র্যাজিক। তারপর প্রায় স্বগতোক্তির মতো বলল, তখন এমন কত ঘটনা ঘটেছে, সব কি মনে রেখেছে সবাই, কাছের কিংবা দূরের? আর মনে রেখেই বা কী লাভ? যারা দায়ী তারা তো কেউ নেই, কোথায় আছে, বেঁচে আছে কি না, থাকলেও তাদেরকে সামনে নিয়ে আসা সম্ভব কি না, এ-সবই তো অনিশ্চয়তায় ডুবে আছে। সাক্ষী-সাবুদও তো তেমন আছে বলে মনে হয় না। সমস্ত ইতিহাসটিরই, মানে যখন ঘটনাটি ঘটে বলছেন, তার ডকুমেন্টেশন ইজ সো পুওর, সো স্কেচি যে সেই কারণে এই এতদিন পর কী করা যেতে পারে বলুন? তারপর মাথায় কাশফুলের মতো শ্বেতশুভ্র কেশ-শোভিত মাথার মানুষটির দিকে তাকিয়ে সে, যুবকটি, বলে এতদিন কোথায় ছিলেন এবং বলার পরই তার কেন জানি জীবনানন্দ দাশের কথা মনে পড়ে যায়। প্রৌঢ় ভদ্রলোক কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে প্রায় অভিযুক্তের মতো শুকনো গলায় বলেন, পঁয়তালিস্নশ বছর আগে বিদেশে চলে যাই। এর আগে আর আসিনি। শুনে সে, যুবকটি, অবাক হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে থাকে।

অফিসে তার সিনিয়র সব শুনে বললেন, একটা স্টোরি হতে পারে, হোক না পুরনো ঘটনা। সময়ের জন্য নাটকীয়তা হারিয়েছে, ইমিডিয়েট শকিং ইফেক্টটাও নেই। কিন্তু ঘটনাটি মর্মে আঘাত করে, ভেতরে অস্থিরতা জাগায় একটু হলেও, এই এতদিন পরও। সবই তো 888sport sign up bonus থেকে মুছে যেতে পারে না, যেমন ওই ভদ্রলোক, যার কথা তুমি বললে, যিনি অফিসে এসে তোমাকে ছেচলিস্নশ বছর আগের ঘটনাটির কথা বলে গেলেন, তাকে ভয়াবহ 888sport sign up bonus এখনো তাড়া করে বেড়াচ্ছে। শুনে সে, যুবকটি, তার সিনিয়রের দিকে তাকিয়ে বলে, এতদিন পর? কী করছিলেন তিনি এই ছেচলিস্নশ, সাতচলিস্নশ বছর? হঠাৎ খেয়াল হলো কেন তার? তিনি যা বললেন তার ভিত্তিতে একটা স্টোরি লেখা আমার কাছে বেশ কঠিন মনে হচ্ছে। লেখা যাবে, কিন্তু তার মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা যাবে কি না, সেটাই চিমত্মার বিষয়। কথ্য ভাষায় যদি বলি, মানে আমাদের পেশার লিঙ্গোতে, পাঠকরা কি স্টোরিটা খাবে? তার সিনিয়র সহকর্মী কাঁধের ওপর হাত রেখে স্নেহের ভঙ্গিতে বললেন, ঠিক স্পিরিটটা নিয়ে লেখা হলে নিশ্চয়ই খাবে। মানে শুধু লেটার নয়, স্পিরিটও থাকতে হবে যেন অক্ষরগুলো জীবন্ত হয়ে পাঠকের সামনে জোনাকির মতো জ্বলতে আর নিভতে থাকে। আর ভদ্রলোকের দেরি করার কথা বলছো? শুনলে না, তিনি তো তোমাকেই বলে গেলেন, ছেচলিস্ন­শ বছর বিদেশে ছিলেন। হয়তো ভুলে থাকতে চেয়েছেন ভয়াবহ সেই অভিজ্ঞতার কথা, কিন্তু পারেননি। বলতে পারো ছেচলিস্ন­শ বছরের প্রতিটি দিনই তাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছেন, অনেক কিছু ভেবেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত 888sport sign up bonusই জয়ী হলো, তাকে নিয়ে এলো সেই দেশে যেখান থেকে তিনি ছেচলিস্নশ বছর আগে চলে যান। হয়তো তিনি বিদেশে দেশের অনেককে এ-কথা বলেছেন, কিন্তু তারা কিছু করেনি, বা করতে পারেনি। ঘটনাটি সবার কাছে পৌঁছায়নি, যার জন্য তাঁর বিবেক তাঁকে দংশন করে চলেছে। ভারমুক্ত হওয়ার জন্যই এই বয়সে তাঁর এক সময়ের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। তাঁকে নিরাশ করা ঠিক হবে না। তুমি যাও সেই শহরে, সকালে গিয়ে রাতের মধ্যে ফিরে আসতে পারবে। তারপর একটু থেমে তার সিনিয়র কলিগ বললেন, শোনো ওই মেয়েটিকে ধর্ষণ করার পর তার বাবা নালিশ করতে গেলে ধর্ষকের বাবা এবং অন্য ছেলেরা যেভাবে বাবা এবং মেয়ে, দুজনকেই নির্যাতন করেছে, সেই রিপোর্টিং তুমি খুব সুন্দরভাবে করেছো। অনেকে ফোন করে জানিয়েছে আমাকে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এই স্টোরিটা তুমি লিখলে তেমনই হবে, তুমি পারবে। তোমার সেই ক্ষমতা আছে। তুমি যাও। ইতস্তত করো না। ভারমুক্ত হওয়ার দায় শুধু তাঁর একার নয়, আমাদেরও। বিশেষ করে আমাদের পেশায় যারা আছি। তারপর তার টেবিল থেকে নিজের টেবিলে যেতে যেতে বললেন, ঘটনাটি খুবই পুরনো কিন্তু তুমি তাকে পুনর্জীবিত করতে পারো। যারা পড়বে তাদের কাছে মনে হবে, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দেন ফিকশান।

সে সকালে রওনা হলো গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে, বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পর। বৃষ্টির পানিতে বাসস্ট্যান্ডের অবস্থা করুণ। কাদা থিকথিক করছে, যেন মাটির রাস্তা, ঘোলা পানি ছিটকে পড়ছে বাসের চাকার নিচ থেকে, মেয়ে-পুরুষ, বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ছোটাছুটি করছে যার যার বাসের সন্ধানে। হর্ন বাজাচ্ছে ড্রাইভার ভিড় সরিয়ে মেইন রোডে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ফেরিঅলারা টুকরি মাথায় নিয়ে প্যাসেঞ্জারভর্তি বাসের পাশে দাঁড়িয়ে যার যার বিক্রির জিনিস হাতে তুলে যাত্রীদের দেখিয়ে চিৎকার করছে। দুজন পুলিশ তাদের রাইফেল মাটির দিকে তাক করে রেখে হেঁটে যাচ্ছে ভিড় ঠেলে। কয়েকটা কুকুর জঞ্জালের সত্মূপে খাবার খুঁজছে আর একটু পরপর ঝগড়া করছে নিজেদের মধ্যে। সে বাসে উঠে এক পাশে বসল, কাছেই জানালা। মাথার ওপরে র‌্যাকে রাখল তার হাতের ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর একটা রুটি, ছয়টা কলা, চারটা আপেল আর মাঝারি সাইজের মিনারেল ওয়াটারের একটা বোতল। নাম, জীবন। অনেক ব্র্যান্ডের মিনারেল ওয়াটার বিক্রি হচ্ছে এখন, নাম মনে রাখা মুশকিল। কোনটা আসল কোনটা নকল তা-ও বলার উপায় নেই। সে হাতের কাছে যেটা পায় সেটাই কিনে নেয়, বেশি চিমত্মা-ভাবনা করে না। সে তার সিটে বসে বাসের ভেতরটা দেখে নিল, প্রায় সব সিটেই যাত্রীরা বসে পড়েছে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ওপরের র‌্যাকে মালামাল রাখছে ঠেলে ঠেলে। কন্ডাক্টর ছেলেটা দরোজায় দাঁড়িয়ে গন্তব্যস্থানের নাম বলে ডেকে যাচ্ছে যাত্রীদের। বাস একটু পরই ছাড়বে। ড্রাইভার তার মুখে এক খিলি পান ভরে দিলো। তারপর চিবোতে চিবোতে রক্তের মতোন রস বের করে জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পিক ছুড়ে মারল পিচকিরির মতো। ড্রাইভারের মাথার ওপরে আঠারো ইঞ্চির একটা পুরনো রঙিন টিভি। সেটা চলছে, একটা পুরনো বাংলা সিনেমা দেখাচ্ছে। রাজ্জাক, ববিতাকে দেখা যাচ্ছে। একজন যাত্রী চেঁচিয়ে বলল, এই চ্যানেল বদলাও। সিরিয়াল চালাও। রংধনু।

একটু পর বাস হেলতে-দুলতে বড় রাস্তায় এসে স্পিড দিলো গোঁ গোঁ করে। ভেতরে এসি চলছে খুব দুর্বলভাবে, ভেতরটা গরম হয়ে আছে। একজন যাত্রী কন্ডাক্টরকে বলল, এই এসি বাড়াও। গরম লাগতাসে। এসি বাসের লাগি টিকিট কাটছি ঘাইমা জামা-কাপড় ভিজাইতে নাহি? সে বাসের ভেতর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাস্তার পাশে তাকাল। বর্ষার পানিতে থইথই করছে যতদূর চোখ যায়, যেন নদী। মাঝে মাঝে উঁচু জায়গায় বাড়িঘর অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে। ইটখোলার টাওয়ার আকাশে কালো ধোঁয়া ছুড়ে দিচ্ছে গলগল করে। এই বর্ষাতেও কাজ বন্ধ নেই, 888sport appয় বহুতল বাড়ির কনস্ট্রাকশন চলছে নন-স্টপ। সিমেন্ট-রডের সঙ্গে ইটেরও চাহিদা এখন সারাবছর। পেটফোলা বার্জ দিয়ে বালি আর মাটি এনে রাস্তার পাশে ফেলে জমি উঁচু করার কাজ চলছে। অনেক বছর ধরেই এমন, রাস্তার দুধারের জমি বেড়ে চলেছে। একটু পরপর সাইনবোর্ডে লেখা, এই জমির মালিক… নিচে নাম এবং ঠিকানা। চলতি বাস থেকে সেসব পড়া গেল না। মাটি উঁচু হয়ে বৃষ্টির পানি ঠেলে দিচ্ছে রাস্তায়, লোকালয়ে। বন্যা হচ্ছে। এটা নিয়েও একটা স্টোরি হতে পারে, যদিও বিষয়টা সবারই জানা। কিন্তু এই যে একটু বৃষ্টি হলেই 888sport app শহরের মানুষ জলবন্দি হয়ে পড়ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, এমন তো কয়েক বছর আগেও ছিল না। দিন দিন মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। কেউ কি দেখার নেই? হ্যাঁ, একটা হিউম্যান স্টোরি হতে পারে। সে পাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে ভাবে।

একটু পর হাতের কাগজ খুলে পড়তে থাকল সে। প্রথম পৃষ্ঠাতেই তিন বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করে মেরে ফেলার খবর। ধর্ষকের ছবি ছাপা হয়েছে খবরের পাশেই। বেশ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে তাকে। তার ভেতরে যে একটা দানব বসে আছে, দেখে বোঝাই যায় না। কে বলেছে চেহারাই হলো মানুষের ভেতরের ছবি? সে এ-বয়সে জেনে গিয়েছে চেহারা দেখে কারো সম্বন্ধে কিছু বলা যায় না। প্রথম পৃষ্ঠাতেই নিচে আরো একটা ধর্ষণের খবর। ভিকটিম এক কলেজছাত্রী। পড়তে পড়তে তার গা রিরি করে ওঠে ঘৃণায়। রোজ রোজ এসব খবর থাকে কাগজে। দেশটা কি এসব দানবের খপ্পরে চলে যাবে? এত মানববন্ধন, ব্যানার নিয়ে মিছিল, রাস্তা অবরোধ, টক শোতে নিয়মিত আলোচনা, সিভিল সোসাইটির সভায় বক্তৃতা, কিন্তু কোনো ফল দেখা যাচ্ছে না। অপরাধীরা সব শ্রেণির, বড়লোকের ছেলে থেকে দাগি আসামি। দেশের জিডিপি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেসঙ্গে বাড়ছে জঘন্য অপরাধ। আরো একটা খবর, অপরাধেরই তবে অপরাধীর শাসিত্ম সম্পর্কে। বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের মধ্যে দুজনের মৃত্যুদ- বহাল, চারজনের যাবজ্জীবন, দুজন খালাস। বারোজন আসামি এখনো ফেরারি। খবরের পাশে পুরনো ছবিটা ছাপা, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কয়েকজন যুবক বিশ্বজিৎকে আক্রমণ করছে। সে দুহাত তুলে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। সে খবরটা পড়ে আবার জানালা দিয়ে পাশের দিকে তাকাল। অদূরে গ্রাম দেখা যাচ্ছে, নিচের দিকটা ডুবে আছে বন্যার পানিতে। নৌকায়, ভেলায় করে গ্রাম থেকে আসছে মানুষ। কয়েকটা ইঞ্জিন বোট ঢেউ তুলে যাচ্ছে তরতর করে, ঢেউ উঠছে তাদের দুদিকে। কাছের নৌকাগুলো দুলে উঠছে, ভেলা হেলে যাচ্ছে একদিকে, ওপরের লোকজন সভয়ে ধরে রাখছে নিচের পাটাতন। আকাশে ধূসর মেঘ, মাঝে মাঝে নীল উঁকি দিচ্ছে, যে-কোনো সময় বৃষ্টি পড়তে পারে। এখন শ্রাবণ মাস।

রাতে ভালো ঘুম হয়নি তার। একটু পর দুচোখ বুজে এলো নিজের অজান্তেই। মাথা নিচু হয়ে সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হলো। কতক্ষণ এভাবে ছিল তার মনে নেই, সম্বিত ফিরে এলো জোর ঝাঁকুনি খেয়ে। সে নড়েচড়ে বসে সামলে নিল। কী ব্যাপার? বাস ব্রেক চেপেছে। সামনে তরুণ এবং তরুণীরা দলবেঁধে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে লাঠিসোটা। একটা মাইক্রোবাস ভাঙাচোরা অবস্থায় রাস্তার একপাশে হেলে আছে, ভেতরে কেউ নেই। একটা নীল রঙের গাড়ি ভেঙে চুরমার। পাশে একটা লোক আকাশের দিকে দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে। হয়তো গাড়ির মালিক। সে বুঝল, ঝামেলা হয়েছে, যারা রাস্তা অবরোধ করে লাঠি ওপরে তুলে শাসাচ্ছে তারা সবাই ছাত্রছাত্রী, কেননা তাদের পেছনেই বাঁয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। সে ভাবল, নিশ্চয়ই কোনো ছাত্র বা ছাত্রী বাসে কিংবা মাইক্রোতে চাপা পড়েছে। এরকম দুর্ঘটনা প্রায়ই হয় এখানে।

একটু পর তাদের বাসের পেছনে আরো অনেক বাস এসে থেমে গেল। একটা লম্বা লাইন হয়ে গেল অনেক দূর অবধি। যাত্রীরা বাস থেকে নেমে সামনে গিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। পুরুষদের কেউ কেউ রাস্তার পাশে বসে পেশাব করছে, কেউ সিগারেট বের করে টানছে। সে ব্যাগ থেকে একটা কলা বের করে খেতে খেতে নিচে নামল। ফেরিঅলারা এরই মধ্যে কলা, বিস্কিট, মুড়ি, মিনারেল ওয়াটার বিক্রি শুরু করেছে। কেউ কেউ থালায় সাজিয়ে কাটা আমড়া, জাম্বুরার কোয়া নিয়ে যাত্রীদের পাশে ঘোরাঘুরি করছে। আশপাশের গ্রাম থেকে খাবার নিয়ে আরো লোক আসতে দেখা গেল। সবাই জানে এই অবরোধ সহজে উঠবে না, অনেকক্ষণ চলবে। হয়তো সারাদিন। সে মোবাইলে সময় দেখে হিসাব করল। এখন এগারোটা বাজে, যদি দুঘণ্টা পর বাস ছাড়ে তাহলে সে গন্তব্যে পৌঁছাবে বিকেল চারটায়। দু-ঘণ্টা লেট। যদি চারটায় অবরোধ ওঠে তাহলে সে লেট হবে চার ঘণ্টা, গন্তব্যে পৌঁছবে বিকেল ছয়টায়। বিকেল না বলে সন্ধ্যা বলাই ভালো, কেননা তখন সূর্য অস্তাচলে যাবে। তাহলে তাকে রাতে থাকতে হবে কোনো হোটেলে। আজকাল সব মফস্বল শহরে ছোট আর মাঝারি ধরনের হোটেল হয়েছে, ওভারনাইট থাকতে অসুবিধা নেই। সে অবশ্য রাতে থাকার জন্য কাপড়-চোপড় কিংবা টাকা নিয়ে আসেনি। অবশ্য গন্তব্যে পৌঁছে মফস্বল সংবাদদাতার কাছ থেকে টাকা ধার করা যাবে। সেটা কোনো সমস্যা নয়, কিন্তু সে আজকে বাইরে রাত কাটাতে চায় না। কেন চায় না, তার কোনো কারণ সে সঙ্গে সঙ্গে খুঁজে বের করতে পারে না। ভেতর থেকে মন বলছে, রাতে বাইরে থাকা যাবে না। এমন তার মাঝে মাঝেই হয়, ভেতর থেকে কেউ যেন তাকে চালিয়ে নিয়ে যায়। সে ভাবতে ভাবতে ছাত্রছাত্রীদের কাছে চলে গেল। শোনা যাক তারা কী বলে, কী তাদের দাবি।

তার সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের কেউ কথা বলতে চায় না। তাদের দাবি ভিআইপি কাউকে আসতে হবে, যিনি ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করবেন, অপরাধীদের ধরার আশ্বাস দেবেন। সে শুনতে শুনতে ভাবল এ-রাস্তাটা বেশ বিপজ্জনক, এখানে পুলিশ চেকপোস্ট থাকা দরকার, রাস্তার ওপরে ঘন ঘন স্পিডব্রেকার তৈরি করে দিলে এত দুর্ঘটনা হবে না। এসব সহজ সমাধানগুলো কেন নেওয়া হয় না, সে বুঝতে পারে না। লিখবে না কি একটা স্টোরি এই বিষয় নিয়ে? পুরনো, কিন্তু থেকেই যে যাচ্ছে। পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

অবরোধ উঠল বিকাল তিনটায়। সব যাত্রী যার যার বাসে পড়িমরি করে দৌড়ে গিয়ে উঠল। ঘুমন্ত অজগর জেগে ওঠার মতো বাসের লম্বা লাইন নড়েচড়ে উঠল। একটু পর তাদের বাস চলতে শুরু করল। ইউনিভার্সিটি এলাকা পার হয়ে বাসগুলো স্পিড বাড়িয়ে দিলো, একে অন্যকে ওভারটেক করার জন্য বিপজ্জনকভাবে রাস্তার পাশের সোল্ডারে নেমে গেল। দেখে মনে হলো যেন ডেথ রেস সিনেমায় অ্যাকশন হিরো জ্যাসন স্ট্যাথাম হুইলের পেছনে বসে। ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস সিনেমায় ভ্যান ডিজেলের কথাও মনে পড়ল।

হাইওয়েতে ড্রাইভার মানেই স্পিড ম্যানিয়াক। এদের জন্যই দুর্ঘটনা ঘটে। সে সভয়ে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল। একবার চেঁচিয়ে ড্রাইভারকে স্পিড কমাতে বলল এক যাত্রী। ড্রাইভার তাতে কর্ণপাত করল বলে মনে হলো না। এক ঘণ্টা পর রাস্তার পাশে একটা রেসেত্মারাঁর সামনে বাস এসে থামল। যাত্রীদের টয়লেটে যাওয়া, খাওয়া, হাত-মুখ ধোয়া, এসব কাজের জন্য আধাঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছে। সে বাসে বসেই রুটি আর কলা খেয়ে রেসেত্মারাঁয় গিয়ে এক কাপ চা নিয়ে টেবিলে বসল। আরো কয়েকটা বাসের যাত্রী রেসেত্মারাঁয় খাচ্ছে, প্রায় সব টেবিলই ভর্তি। চা শেষ করে সে বাসের দিকে তাকিয়ে দেখল ড্রাইভার তার সিটে বসে সিগারেট ফুঁকছে। একটু পর অন্য যাত্রীদের সঙ্গে সে-ও বাসে গিয়ে উঠল। আধাঘণ্টা দেখতে না দেখতে শেষ হয়ে গেছে। সে তার সিটে বসে নোট-প্যাড বের করে গন্তব্যে যে কর্মসূচি লেখা ছিল সেখানে কিছু অদল-বদল করল। আজই 888sport appয় ফিরতে চায় সে সন্ধ্যার বাসে। এর জন্য সে যা যা করতে চেয়েছিল তার মধ্যে কিছু কাটছাঁট করল। প্রথমেই প্রেসক্লাবে গিয়ে ছেচলিস্নশ বছরের পুরনো খবরের কাগজের কপি খোঁজার চেষ্টা না করে অথবা ছেচলিস্নশ বছর আগের ঘটনা মনে আছে, এমন বৃদ্ধ বা প্রৌঢ় কাউকে খুঁজে ইন্টারভিউ নেওয়ার আগে সোজা চলে যাবে উত্তর-পূর্বে শহরের শেষ মাথায় বকুল গাছঅলা একতলা বিল্ডিং ছিল বলে ভদ্রলোক জানিয়েছেন। সেখানে এখন যিনি আছেন তাঁর কাছ থেকে কিছু তথ্য নেবে সে, জায়গাটা সম্বন্ধেও একটা ধারণা করা যাবে। ভাবতে ভাবতে তার মনে হলো, বাড়িটি কি এখন থাকার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে? যদি হয় তাহলে যিনি থাকছেন, তিনি কি ভাড়াটিয়া, না মালিক? 888sport sign up bonus-ভারাক্রান্ত বাড়িটিতে লাইব্রেরি কিংবা মিউজিয়াম জাতীয় কোনো প্রতিষ্ঠান করা হলো না কেন? যিনি সেই বাড়িতে থাকেন তাঁকে জিজ্ঞেস করলে এ-সম্বন্ধে কিছু তথ্য পাওয়া গেলেও যেতে পারে। ইন্টারভিউ শেষ করে সে যাবে প্রেসক্লাবে। সেখানে কাজ শেষ হওয়ার পরও সময় থাকলে ইন্টারভিউ নেবে দু-তিনজন বৃদ্ধ বা প্রৌঢ়ের, যাঁরা ছেচলিস্নশ বছর আগের ঘটনাটি সম্বন্ধে জানেন এবং কিছু বলতে পারবেন। বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা নিয়ে শহরের উত্তর-পূর্বে ফরেস্ট রোডের শেষ মাথায় যেতে বলল সে রিকশাঅলাকে। রিকশাঅলা প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে বলল, ফরেস্ট রোডের শেষ মাথা? তারপর সে হেসে বলল, ফরেস্ট রোডের শেষ মাথা তো এখন ধাক্কা খাইতে খাইতে নদীর পারে গিয়া ঠেকছে। সে বুঝতে না পেরে বলল, তার মানে, কী বলতে চাও তুমি? রিকশাঅলা বলল, আমি আর কী কমু, নিজের চোখেই দেখবেন। মনে হয় অনেক বছর পর আইলেন এই শহরে। নামেই এখন ফরেস্ট রোড। রাস্তার শেষে যে-গাছপালা আছিল সব কবে কাইটা শ্যাষ। ফরেস্ট এখন নদীর পার ঘেঁইষা কোনোরকমে টিকা আছে। সে বলল, ফরেস্ট রোডের শেষে একতলা একটা দালান ছিল, সামনে বড় বকুল গাছ। সেখানে যাব আমি। রিকশাঅলা প্যাডেল চালাতে চালাতে বলল, সেই দালান আর বকুল গাছ আমি দেখি নাই। তবে হুনছি। এহন এইখানে লাল রঙের তিনতলা বাড়ি, সামনে কোনো গাছটাছ নাই। চলেন, হেইখানে নিয়া যাই। বোঝা গেল শহরের শেষ প্রান্তের চেহারা বেশ বদলেছে। সে ওয়াকিবহালের মতো বলল, হ্যাঁ। সেখানে।

কিছুক্ষণ পর রিকশা এসে থামল একটা লাল রঙের তিনতলা দালানের সামনে। সামনে বিশাল লোহার গেট। পেছনে লাঠি হাতে স্বাস্থ্যবান গার্ড দাঁড়িয়ে। বাড়ির সামনে খালি জমি নেই, কোনো গাছ দেখা গেল না। ভেতরে ঢুকতে বেশ সময় নিল, গার্ড কিছুতেই তাকে ভেতরে যেতে দেবে না। মালিকের কড়া হুকুম। গার্ডকে সে তার নেমকার্ড দেওয়ার পর সে ভেতরে অনুমতির জন্য চলে গেল। একটু পর সে বের হয়ে এসে বলল, যান হুজুর বাইরের ঘরেই আছেন। তার হাতে আপনার কার্ডটা দিছি। তিনি পইড়্যা খুব খুশি হইলেন বইলা মনে হয় নাই। তাও যাইতে কইছে। তারপর উপদেশ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, বেশি টাইম নিয়েন না। হুজুরের মেজাজ গরম হয়্যা যায় হটাৎ হটাৎ।

বসার ঘরে ঢুকতেই সামনের দেয়ালে শিংঅলা হরিণের মাথা ঝোলানো দেখতে পেল সে। কার্পেটের ওপর একটা বাঘের চামড়া ছড়ানো, মাথাসুদ্ধ। মুখের লাল জিভ দেখা যাচ্ছে, আসলটা না, রং করা। মাড়ির ওপর দাঁতগুলো আসল, খুব ধারালো দেখাচ্ছে। বাঁদিকে দেয়াল ঘেঁষে সিঙ্গেল সোফায় সবুজ পাঞ্জাবি পরে বসে            থাকা ভদ্রলোক তার দিকে তাকালেন। মুখে চাপদাড়ি, চোখের নিচে সুরমার কালো দাগ। বেশ হৃষ্টপুষ্ট দেখতে এবং লম্বা। ভদ্রলোক বিরক্তির সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে আছেন, অপেক্ষা করছেন সে কী বলে। ভারিক্কি মেজাজের লোকেরা এমনই করে থাকেন। প্রথমে মুখ খোলেন না, শুনতে চান আগন্তুক কী জন্য এসেছে। সে নোটবই হাতে নিয়ে তার পাশের সোফায় বসে পড়ল, একটা স্টোরি লেখার জন্য এসেছি। বেশি সময় নেব না। সামান্য কিছু তথ্য চাই।

স্টোরি, মানে গল্প? গল্প লেখার জন্য আমার এখানে কেন? আর জায়গা পেলে না? মশকরা করতে এসেছো মনে হয়।

না, না। মশকরা করতে আসব কেন? আপনি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, দেখেই মনে হচ্ছে। শুধু এই বাড়িটার জন্য আপনার কাছে আসা।

এই বাড়িটার জন্য? কী হয়েছে এই বাড়ির যে 888sport app থেকে দেখতে আসতে হবে?

সে বলল, আপনি নিশ্চয়ই জানেন, এ-বাড়ির একটা ইতিহাস আছে। বেশ ট্র্যাজিক। তারপর একটু থেমে বলল, ছেচলিস্নলশ বছর আগে এখানে কি একটা একতলা দালান ছিল? সাদা রং, সামনে একটা বকুলগাছ?

শুনে তিনি বাজখাই গলায় বললেন, ছেচলিস্নশ বছর আগে এখানে কী ছিল না ছিল, সে-কথা আমাকে জানতে হবে কেন আর জানলেই তোমাকে বলতে যাবো কেন? তুমি কি কোনো সরকারি তদন্তে এসেছো? তোমার কার্ড দেখে তো মনে হয় না কোনো সরকারি দায়িত্বে আছো। তারপর বিরক্তির সঙ্গে বললেন, তোমার পেশার লোকদের কাজই হলো বিরক্ত করা। ঝামেলা সৃষ্টি করা। আমি তোমাদের দুচোক্ষে দেখতে পারি না। কেন যে তোমাকে ঢোকার অনুমতি দিলাম বুঝতে পাচ্ছি না।

সে বলল, আপনি আমাকে ভেতরে আসতে দিয়ে কৃতজ্ঞ করেছেন। এই বাড়িটা দিয়েই তো আমার স্টোরি শুরু। সেজন্য জানতে চাই আপনি কবে থেকে আছেন, বাড়িটার মালিক কি না, বাড়িটার ইতিহাস জানা আছে কি না। এ-শহরের পুরনো লোক হলে নিশ্চয়ই বাড়িটার ইতিহাস জানবেন। ছেচলিস্নশ বছর আগের ঘটনাও আপনার মনে পড়বে। প্রথমেই জানতে চাই, এটাই সেই একতলা সাদা বাড়ি কি না, যার সামনে একটা বকুলগাছ ছিল?

ভদ্রলোক হুংকার দিয়ে বললেন, তুমি আমাকে শুধু বিরক্ত না, রাগিয়ে তুলছো। ছেচলিস্নশ বছর আগের কথা বলার জন্য আমি এখানে বসে নেই। আমার সময়ের দাম আছে।

সে বিনয়ের সঙ্গে হেসে বলল, সে তো অবশ্যই। দেখেই বুঝেছি আপনি গুরুত্বপূর্ণ মানুষ, ব্যস্ত থাকেন। সেজন্য বেশি সময় নেব না। তারপর বলল, এখানে ছেচলিস্ন­শ বছর আগে কে থাকতেন, তার কী হয়েছিল, সে-সম্বন্ধে নিশ্চয়ই কিছু জানেন? আমাকে বললে বাধিত হব।

ভদ্রলোক মুখ ভেংচি দিয়ে প্রায় চিৎকার করে বললেন, আবার ছেচলিস্ন­শ বছর আগের কথা! আমি কি পৌরসভার রেকর্ডকিপার? কী ভেবেছো আমাকে? হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই, বাড়িতে ঢুকে আবোল-তাবোল বলতে শুরু করেছো। তোমার মতলবটা কী? তোমাকে পাঠিয়েছে কে?

সে হাসিমুখে বলল, কেউ পাঠায়নি। নিজেই এসেছি। ওই যে বললাম, একটা স্টোরি লিখতে চাই। এই বাড়িটা দিয়ে শুরু হবে সেই স্টোরি।

তিনি চোখ লাল করে উঠে দাঁড়ালেন। হুংকার দিয়ে বললেন, তোমার মু-ু হবে। বের হও এখুনি এখান থেকে। তারপর চেঁচিয়ে ডাক দিয়ে বললেন, এই কে আছিস কোথায়? এখানে তাড়াতাড়ি আয়। এই বেআদব ছেলেটাকে ঘাড় ধরে বের করে দে। খুব খারাপ মতলব নিয়ে এসেছে মনে হয়। আমার কোনো শত্রম্ন পাঠিয়ে থাকবে। তার কথা শেষ হতে না হতে ঘরের মধ্যে পাঁচজন যুবক প্রায় দৌড়ে ঢুকল। প্রত্যেকের পরনে জিনসের প্যান্ট, ব্র্যান্ড নামের টি-শার্ট আর পায়ে নাইকের স্নিকার, যেন একটা ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানের সদস্য সবাই, একই ইউনিফর্ম পরে আছে। ভদ্রলোক তাদের দেখে রাগে ফেটে পড়লেন। ক্রুদ্ধস্বরে উত্তেজিত হয়ে বললেন, এই তোরা করিস কী? তোদের মাসোহারা দিয়ে পুষছি এসব বিরক্তি সহ্য করার জন্য? কী মতলব নিয়ে একটা ছোকরা 888sport app থেকে বাসে করে শহরে ঢুকেছে, ঢুকেই সোজা আমার বাসায় এসে এই বাড়ি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, এসব কি সন্দেহজনক ব্যাপার নয়? তোরা এই ধরনের লোকদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্যই আছিস। কিন্তু তোদের নজরদারি এড়িয়ে কী করে এই ছোকরা আমার বাড়িতে ঢুকল? কী করিস তোরা সারাদিন? রেসেত্মারাঁয় বসে আড্ডা দিস, গোপন আস্তানায় বসে নেশা করিস? তাহলে তোদের দরকার কি আমার? তারপর একটু থেমে বললেন, এখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস, একে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কিছুই করছিস না, ব্যাপারটা কী? আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সন্দেহজনক চরিত্রদের কীভাবে শায়েস্তা করতে হয়, তা তোদের শেখাতে হবে নাকি?

ওর কাছ থেকে আসল কথা বের কর। কেন এসেছে এখানে, কে পাঠিয়েছে তাকে, এসব তথ্য বের করে আমাকে জানা। যা করার নিচে নিয়ে গিয়ে কর, আমার সামনে কিছু করার দরকার নেই।

তার কথা শেষ হতে না হতে পাঁচজন যুবক কিল-ঘুসি মারতে থাকল তাকে। তাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ দিতে থাকল। একের পর এক ঘুসি আর লাথি খেয়ে তার প্রায় পড়ে যাওয়ার মতো হলো অবস্থা। সে দুহাত দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করল কিল-ঘুসি থেকে। হঠাৎ করেই মুহূর্তের জন্য তার চোখের সামনে ভেসে উঠল বিশ্বজিতের মার খাওয়ার ছবি। পাঁচজন কিল-ঘুসি মারতে মারতে তাকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। তার তখন প্রায় অজ্ঞান হওয়ার মতো অবস্থা। পেছন থেকে বাড়ির মালিক চেঁচিয়ে বললেন, নিচের সব জানালা বন্ধ করে ওর পেট থেকে কথা বের করার জন্য তোদের সিস্টেম কাজে লাগা। দেখবি যেন বাইরে কোনো শব্দ না যায়। আর হ্যাঁ শোন, যদি দফারফা হয়ে যায় তাহলে আমার বাড়ির ধারে-কাছে রাখবি না। একটু পর সন্ধ্যা হবে। অন্ধকারের ভেতর নিয়ে যাবি জঙ্গলে।

সন্ধ্যা হতে দেরি নেই, যা করার সন্ধ্যার পরেই করবি। তোদের তো আবার বুদ্ধি-শুদ্ধি কম।

পাঁচজন তার অজ্ঞান শরীর চ্যাংদোলা করে তিনতলা বাড়ির বেজমেন্ট থেকে অনিষ্প্রাণ শরীর নিয়ে ফরেস্ট রোডের শেষ মাথায় গিয়ে গাছপালার নিচে ছুড়ে ফেলে দিলো। এতক্ষণ মারধর করে এতদূর তার ভারী শরীরটা বয়ে নিয়ে আসার পর তারা হাঁপাতে থাকল। বেশ নির্জন এখন চারিধার। লোকজন নেই, রিকশা দেখা যাচ্ছে না। তারা বেশ নিশ্চিন্ত মনে রাস্তায় কিছুদূর এসে একে একে সিগারেট ধরাল। অন্ধকারে পাঁটা লাল রক্তবিন্দু জ্বলে উঠল একসঙ্গে।  দলের লিডার একমুখ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, শালা! কিছুই বের করা গেল না পেট থেকে। মনে হচ্ছে হুজুর মিথ্যাই সন্দেহ করেছেন। শুধু শুধু আমাদের হাত-পা ব্যথা করিয়ে দিলেন। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। কী আর করা যাবে।

 

দুই

মফস্বল শহরটা কয়েকদিনের মধ্যেই বদলে গেল। এখন দেখে চেনাই যায় না। দিনেদুপুরেও রাস্তায় লোকজনের 888sport free bet কম। দোকান প্রায় সবই আগুনে পুড়ে ছাই। রিকশাঅলাদের মধ্যে যারা রাস্তায় বেরিয়েছে অপেক্ষা করেও যাত্রী পাচ্ছে না। রাস্তায় কয়েকটা কুকুর ঘুরছে, আকাশে শকুন ঘুরে ঘুরে চক্কর দিচ্ছে আর ক্রমেই নিচে নেমে আসছে। এদের আগে কখনো দেখা যায়নি। বাতাসে পচা মাংসের গন্ধ। রাস্তার পাশের গাছগুলোর পাতা জ্বলে গিয়েছে আগুনে। ডালপালাও পুড়ে কাঠ-কয়লা। গুঁড়িগুলো ঝলসানো মাংসের মতো দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে সাঁ সাঁ শব্দে মিলিটারির জিপ, অস্ত্র হাতে সেনাভর্তি ট্রাক, ছুটে যাচ্ছে রাস্তা দিয়ে। পেছনে লাল ধুলোর ঝড় উঠছে। যেসব বাড়ির ছাদে, গাছের মাথায় কদিন আগেও জয় বাংলা পতাকা উড়েছে পতপত করে বাতাসে, সেখানে এখন চাঁন-তারাখচিত পতাকা উড়ছে। খুব উদ্ধত সেই ওড়ার ভঙ্গি, বাতাসে যে-শব্দ হচ্ছে সেখানে বিদ্রূপের তরঙ্গ।

সমস্ত শহরটায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সব বাড়ির দরোজা-জানালা বন্ধ, যেন ভেতরে কেউ নেই। বেশ কয়েকটা বাড়ির দরোজায় তালা ঝুলছে। কেউ কেউ বার্নিশ-ওঠা দরোজায় কালো কালিতে দোয়া-দরুদ লিখে রেখেছে। রাস্তায় যারা হাঁটছে তারা যেন না পেরে বাধ্য হয়েই বের হয়েছে। বেশিরভাগই বৃদ্ধ, না হয় প্রৌঢ়। তাদের প্রায় সবার হাতে বাজারের ঝোলা। কয়েকদিন কারফিউতে ঘরে বন্দি থাকার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য বের হয়েছে মনে হয়। যুবক-তরুণদের দেখা যাচ্ছে না। তারা যেন সব উধাও হয়ে গিয়েছে অথবা তাদের সাবাড় করে দেওয়া হয়েছে। যে-শহরটা পহেলা মার্চ থেকে সেস্নাগানে মুখরিত ছিল, রাস্তা কেঁপে উঠেছিল আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার দর্পিত পদভারে, যার আকাশ-বাতাস গর্জে উঠেছিল মানুষের উত্তেজিত কণ্ঠস্বরে, যে-জনপদ জেগে থাকত সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত, সেখানে এখন গোরস্তানের নীরবতা।

শহরটার মৃত্যু হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখন যা রয়েছে সেটা তার কংকাল। মেদ-মাংস খসে গিয়ে বীভৎস দেখাচ্ছে। এটা শুরু হয়েছে সেদিন ভোরবেলায়, যেদিন আকাশে শ্রাবণের গুরুগুরু মেঘ ডাকার মতো শব্দ শোনা গিয়েছে প্রথমে, এবং সেই শব্দ ক্রমেই জোরালো হয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়ার মতো উঁচু নাদে উঠেছে। তার পরেই আকাশে দেখা গেল মস্ত বড় কালো কালো পাখির মতো বস্তুগুলোকে, যেগুলো শহরটার কাছে এসে একসঙ্গে আগুনের বর্শা ছুড়ে মারতে লাগল। প্রচ- শব্দে সেসব ফেটে পড়ল বাড়ির, দোকানের, রাস্তার আর গাছপালার ওপর। আগুন জ্বলে উঠল লেলিহান জিহবা মেলে। সমস্ত শহরটা পুড়তে থাকল মস্ত বড় চিতার মতো। সে সঙ্গে শোনা গেল কানফাটা কটকট শব্দ, একটানা। বৃষ্টির ধারার মতো গুলি এসে পড়তে থাকল মানুষের শরীরে, বাড়ির দেয়ালে, দোকানপাটের গায়ে নির্বিচারে। সবই যেন টার্গেট। কাউকে রেহাই দেবে না, জীবিত অথবা নির্জীব, যাই হোক না কেন। ভয়ার্ত নর-888sport promo code শিশু কোলে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করল নদীর দিকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে, অথবা নদীতীরে ফরেস্টের গাছপালার ভেতর। তারা গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই একে একে শুয়ে পড়ল রক্তাক্ত দেহে রাস্তার ওপর, পাশের ডোবায় অথবা আবর্জনার সত্মূপে। বেশ কিছুক্ষণ রকেট নিক্ষেপ আর গুলিবর্ষণের পর হেলিকপ্টারগুলো শহরের স্কুল আর কলেজের মাঠের ওপর-নিচে হয়ে নেমে এলো, তারপর ঘুরন্ত পাখা নিয়ে স্থির হয়ে থাকল, যেমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নিচের দিকে খাবার খোঁজে ফড়িং। একটু পর হেলিকপ্টারের ভেতর থেকে নিচের মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে নামল হিংস্র চেহারার খাকি পোশাক পরা মানুষগুলো, তাদের হাতের অস্ত্র থেকে ছুটতে থাকল গুলি চারিদিকে। যারা কাছে কিংবা অদূরে ছিল পলায়নরত তাদের কেউ রক্ষা পেল না রক্তপিপাসু হানাদারদের হাত থেকে। কিছুক্ষণের মধ্যে রক্তে স্নান করার মতো হয়ে গেল শহরটার রাস্তাঘাট আর মাঠ। কিছু পর দেখা গেল হিংস্র চেহারার পশুর মতো খাকি পোশাক পরা মানুষগুলো গুলি ছুড়তে ছুড়তে রাস্তার পাশের বাড়ির দরোজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে কিশোরী, তরুণী এবং যুবতীদের চুল ধরে টেনে বের করে এনে স্কুল আর কলেজের দিকে যেতে থাকল। সেখানে গিয়ে ঘরের মধ্যে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিলো ধরে আনা মেয়েদের, যেন মানুষ নয়, ছাগল অথবা মুরগি। মেয়েদের আর্তচিৎকার ডুবে গেল অনর্গল গুলিবর্ষণে, যদিও তখন দাঁড়িয়ে থাকা কিংবা পলায়নরত মানুষ কি জন্তু, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। একটা সকালের এক ঘণ্টা ঘটনা বদলে দিলো সব বয়সের মানুষের কণ্ঠস্বরে প্রাণবন্ত এবং চঞ্চল হয়ে থাকা ছোট শহরটার চেহারা।

অধ্যাপক অমিয়ভূষণ আর তাঁর স্ত্রী থাকেন শহরের এক প্রান্তে, ফরেস্ট রোডের শেষ মাথায়। তাঁদের বাড়িটার পরই শুরু হয়েছে ফরেস্টের গাছপালার জঙ্গল। বাড়িটা একতলা, সাদা রং, সামনে বড় একটা বকুলগাছ। বকুল ফুল ফোটে নিয়মিত, ঝরে পড়ে নিচে, মিষ্টি গন্ধ ছড়ায় অনেকদূর পর্যন্ত। অনেকে আসে সকালে ঝরেপড়া ফুল কুড়াতে। অধ্যাপক আর তাঁর স্ত্রী কোনো আপত্তি করেন না। মাত্র দুজন মানুষ তাঁরা, এত ফুল দিয়ে কী করবেন? সেই সকালে কেউ ফুল নিতে এলো না। অধ্যাপক এবং তাঁর স্ত্রীও ফুল কুড়িয়ে নিয়ে ঘরে রাখার কথা ভুলে গেলেন। অন্য সবার মতো তাঁদের বাড়ির দরোজা-জানালা বন্ধ থাকল।

সেই সকালের পর প্রতিদিনই কিছুক্ষণ পরপর জিপ আর মিলিটারি ট্রাক দ্রম্নত ছুটে গেল শহরের এক মাথা থেকে অন্য মাথা। ভেতরে বসে হিংস্র এবং মাংসাশী মানুষগুলো ভয়ানক মারণাস্ত্র হাতে বাইরের দিকে জিঘাংসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল। একতলা সাদা দালানটার সামনে দিয়েও কয়েকবার ট্রাক আর জিপ ছুটে গিয়েছে। অমিয়ভূষণ ইংরেজি 888sport live footballের অধ্যাপক। ট্রাক আর জিপ দেখে শহীদ কাদরীর 888sport app download apkর ‘জলপাই রং’ জিপ আর ট্যাংকের কথা মনে পড়ল তাঁর। একদিন একটা জিপ কিছু সময়ের জন্য থেমেছিল তাঁদের বাড়ির সামনে। ভেতরে বসেছিল লাল মুখের সুদর্শন এক যুবক অফিসার। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে নিয়ে হাতের ম্যাপ খুলে কী যেন দেখল সে কিছুক্ষণ। তারপর যেমন হঠাৎ করে এসেছিল সেভাবেই দ্রম্নত চলে গেল। অধ্যাপক অমিয়ভূষণ সাহসী মানুষ, কিন্তু তিনিও প্রথমে একটু ভয় পেলেন। তারপর সামলে নিলেন অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর স্ত্রীকে দেখে। তাঁর স্ত্রী কমলা রানী তাঁর মতো সাহসী নন, বেশ ভীরু। মেয়ে বলে নয়, তাঁর স্বভাবটাই অমন। তিনি সেই ভয়ংকর সকালের পর থেকে মাঝে মাঝেই থরথর করে কাঁপছেন। তাঁর চোখদুটো ঘোরে কিছু দেখতে পেয়ে যেন, ঠোঁট কাঁপে কিছু বলার ইচ্ছায়, কিন্তু গলার স্বর বুজে আসে কথা বলতে গিয়ে।

পাকিস্তানি সেনারা শহর দখল করে নেওয়ার পর যখন চোখ বেঁধে বন্দি লোকদের নিয়ে সন্ধ্যার পর নদীর তীরে গুলি করে মেরে পানিতে ভাসিয়ে দিতে শুরু করল এবং সেই কথা ছড়িয়ে পড়ল সারা শহরে, যারা তখনো ছিল তাদের মধ্যে, কমলা রানী স্বামীকে বললেন, চলো পালাই। ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। অমিয়ভূষণ বললেন, পালাতে যাব কেন? আমাদের পূর্বপুরুষের বাড়ি। এর প্রতিটি ইটের সঙ্গে মিশে আছে বংশের 888sport sign up bonus, ইতিহাস। এখান থেকে যাওয়া হবে একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। কিন্তু ওরা যে আমাদের মেরে ফেলবে, বলে কমলা রানী তাঁর স্বামীর হাত ধরে ঝাঁকাতে থাকেন মরিয়া হয়ে। অমিয়ভূষণ স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেন, যদি মৃত্যু কপালে লেখা থাকে তাহলে তা এড়ানো যায় না। বেশ তো, মেরে ফেললোই না হয়। এত লোককে মেরেছে, আমাদেরকেও না হয় মারল। আমাদের তো একদিন মরতে হবেই। অসুখে পড়ে মরা আর ওই পশুদের হাতে মরার মধ্যে তফাৎ শুধু এই যে, একটা বেশি যন্ত্রণার আর কষ্টের, অন্যটা হয়তো তেমন নয়। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, বেশ তো কয়েকদিন হয়ে গেল হানাদাররা শহর দখল করেছে। এখন আমাদের মারতে আসবে কেন?

আমরা যে… আমরা যে হিন্দু। কাঁপতে কাঁপতে কমলা রানী স্বামীর বুকে সিঁটিয়ে যেতে যেতে বললেন।

ওরা মুসলমানও মারছে। তাদের সঙ্গে আমাদেরও যদি মারতে চায়, মারুক। কুকুরের মতো ভয় পেয়ে লেজ গুটিয়ে পালাব কেন পূর্বপুরুষের বাড়িঘর ছেড়ে। তারপর একটু থেমে বললেন, আমি অমিয়ভূষণ মজুমদার। কলেজে ইংরেজির প্রফেসর। পঁচিশ বছর বয়সে চাকরিতে ঢুকেছি। এখন আমার বয়স ছেচলিস্নশ। কত ছাত্র বের হয়েছে আমার আর আমার সহকর্মীদের হাত ধরে। আমাদের গর্ব করার মতো অনেক কিছু আছে। আমরা মাথা উঁচু করে থেকেছি সমাজে। এখনো থাকব। আমাদের আত্মসম্মানবোধ আছে।

এই বিপদ মাথায় নিয়েও? কমলা রানী স্বামীর দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকান। অমিয়ভূষণ অল্প হেসে বলেন, শুধু আমরা তো নই, আরো অনেকে রয়েছেন শহরে। রাস্তাঘাটে বের হন না বটে, কিন্তু শহর ছেড়ে যাননি। আমার সঙ্গে দেখা হয় আমি যখন বের হই, বাজারে যাই। খুব বেশি কথা হয় না, কিন্তু চোখে চোখে অনেক কিছুই বিনিময় হয়। তার মধ্যে ভয় নামক বস্তুটা নেই। তারা কেউ পালানোর কথা ভাবছে না। আমার মতোই তারা বিশ্বাস করে, পালানোটা কাপুরুষের কাজ। মৃত্যুর ভয়ে পালানোর মতো লজ্জার আর কিছু নেই। হ্যাঁ, পালানো যায় যদি ওপারে গিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কেউ, যেমন নিয়েছে এ-শহরেরই অনেক যুবক এবং তরুণ। গ্রামের অনেক সাধারণ মানুষও তাদের অনুসরণ করেছে। তারা কেউ মৃত্যুভয়ে দেশ ছেড়ে যায়নি।

কিন্তু তোমার বন্ধুরা, সহকর্মীদের কেউ তো আগের মতো সন্ধ্যায় গল্পগুজব করতে আসেন না। গানের আসর বসে না তোমাকে নিয়ে? কমলা রানী স্বামীর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকান।

অমিয়ভূষণ বলেন, না তাঁরা আমাদের এড়িয়ে যাচ্ছেন না। একটু সময় নিচ্ছেন সামলে নিতে। তারপর আগের মতোই আসবেন। আগের মতোই আমাদের আসর বসবে। হয়তো পুরনো ছন্দটা থাকবে না।

কমলা রানী তাঁর কথায় আশ্বস্ত হন না। বলেন, আমার মন বলছে এখানে থাকা নিরাপদ নয়। কেন থাকব এখানে এত ভয় নিয়ে। ভালোমতো খাওয়া হয় না। রাতে ঘুম ভেঙে যায় একটু শব্দ শুনেই। এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। এর চেয়ে ওপারে যাওয়া ভালো। সেখানে আমাদের ছেলেমেয়ে আছে। তাদের সঙ্গে কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন।

অমিয়ভূষণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ওপারে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলে কবেই যেতে পারতাম। ছেলেমেয়ে ওখানে আছে তাদের নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। আমরা যেতে বলিনি। তারপর একটু থেমে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হেসে বলেন, আমরা যদি মরেও যাই, তাহলেও আমাদের বংশের বাতি জ্বলবে। আমরা ছেলেমেয়েদের মধ্যে বেঁচে থাকব। এই দেখছো না কেমন বিষয়টা? স্বার্থপরের মতো বেঁচে থাকার জন্য এত আকুতি কেন? এতে নিজেকে ছোট করে দিচ্ছো। তোমার কাছ থেকে এটা আশা করি না। তুমি আমার জীবনসঙ্গিনী। যদি মৃত্যু আসে তখনো সঙ্গ দেবে।

কমলা রানী স্বামীর বুকে মাথা রেখে বললেন, ঠাকুর, ঠাকুর। তুমি সহায় থেকো বলে তিনি দুই হাত কপালে ছোঁয়ালেন। অমিয়ভূষণ স্ত্রীর মুখ তুলে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, যেন পুরনো দিনের কমলা রানীকে খুঁজছেন। তারপর মুখ নামিয়ে তাঁর ঠোঁটে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করলেন। কতদিন পর তাঁদের শরীরের ভেতর বিদ্যুৎ সঞ্চারিত হলো যেন। মনে হলো তাঁরা মুহূর্তের জন্য হলেও ফিরে গিয়েছেন যৌবনের দিনগুলোতে। সামান্য একটি চুম্বন, এতটা সাহস, আত্মবিশ্বাস আর আনন্দ দিতে পারে, ভাবতে পারেননি দুজনের কেউ।

সত্যি যেমন বলেছিলেন অমিয়ভূষণ, সেভাবেই কয়েকদিন পর বিকেলের দিকে আসতে শুরু করলেন তাঁর বন্ধু এবং সহকর্মীরা। সবাই না, কেননা কেউ কেউ মারা গিয়েছেন, কেউ গ্রামের বাড়িতে গিয়ে থাকছেন আত্মীয়দের সঙ্গে। বন্ধু এবং সহকর্মীরা এলেও আগের মতো জমে না আড্ডা। ভেতরে ভেতরে একটা আশঙ্কা, অস্থিরতা জেগে থাকে। অমিয়ভূষণ একের পর এক গান গেয়ে যান। গানের কথা আর সুরে সাহস দেন অতিথিদের। কমলা রানী লুচি-ভাজি তৈরি করে আনেন আগের মতোই। তবু যেন কোথায় একটা ফাঁক থেকে যায়। সবকিছু আগের মতো হয় না। তা না হয় না-ই হলো, নদী যে একই খাতে বইবে চিরকাল, তার নিশ্চিতি নেই, ভাবেন অমিয়ভূষণ। নদী তার চলা বন্ধ করে না। মানুষের জীবনও তো নদীই, বলতে গেলে একটু ভিন্ন খাতেই না হয় বইল। এই বয়ে যাওয়াতেই তার জয়, তার আনন্দ।

সেদিন গান শেষ করে এক খিলি পান মুখে দিয়েছেন অমিয়ভূষণ তখন তাঁর সহকর্মী সবুর চৌধুরী গলার স্বর নামিয়ে বললেন, ক্যাপ্টেন সাত্তার নামে এক পাঞ্জাবি অফিসার এই শহরের দায়িত্বে। খুব নৃশংস আর নিষ্ঠুর। শুনতে পাই রোজ সন্ধ্যার পর নদীতীরে চোখবাঁধা বন্দিদের দাঁড় করিয়ে নিজেই গুলি করে হত্যা করে সে।

জলিল উকিল বলেন, হ্যাঁ। আমিও তাই শুনেছি। সমস্ত শহরের মানুষ তার নামে থরথর করে কাঁপে, এটাও জেনেছি।

অমিয়ভূষণ হেসে বলেন, আমরা ভয়ে থরথর করে কাঁপব না। আমরা যে বিশ্বাস করি, মরণরে তুহু মম শ্যাম সমান। সুফি জালালউদ্দিন রুমী বলতেন, মৃত্যুই ঈশ্বরের সান্নিধ্য পাওয়ার উপায়। মৃত্যুকে তিনি বলতেন বিবাহের মতো একটা উৎসব। রবীন্দ্রসংগীতের সঙ্গে একটা মিল দেখতে পারছেন না?

জালালউদ্দিন উকিল বললেন, তবু সাবধানে থাকা ভালো। সন্ধ্যার পর কেউ বাইরে বের হবেন না।

সবুর চৌধুরী গম্ভীর হয়ে বললেন, গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি ক্যাপ্টেন সাত্তার একটা নামের তালিকা তৈরি করেছেন।

তালিকা? কিসের তালিকা? অমিয়ভূষণ তাকালেন তাঁর দিকে। সবুর চৌধুরী বললেন, এ-শহরের এলিটদের, প্রফেশনালদের নামের তালিকা।

কেউ সবুজ ক্যাটেগরিতে আছেন, মানে নিরাপদ। কেউ গ্রে মানে ধূসর ক্যাটেগরিভুক্ত। তারা আন্ডার অবজারভেশন। আর বস্ন্যাক ক্যাটেগরিতে যারা আছেন, তারা মৃত্যুদ-প্রাপ্ত। বিচার ছাড়াই।

অমিয়ভূষণ বললেন, আমাদের যখন এতদিনে হত্যা করেনি আমাদের কেউ তাহলে বস্ন্যাক ক্যাটেগরিতে নেই। কী বলেন জলিল ভাই?

জলিল উকিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, আলস্নাহই জানেন।

আসর ভাঙার পর সবুর চৌধুরী উঠতে উঠতে বললেন, মিলিটারিরা সব দোকানপাট খোলা রাখতে বলেছে। ভয়ে ভয়ে খুলছে যাদের দোকান গোলাবর্ষণে ভস্মীভূত হয়নি। কিন্তু তারা স্কুল-কলেজ খোলার কথা বলছে না।

জলিল উকিল বললেন, কী করে বলবে? সেখানে যে মেয়েদের আটকে রাখা হয়েছে, সন্ধ্যার পর জোয়ান-অফিসার সব ফুর্তি করতে যায় সেখানে। মেয়েগুলোর জন্য বড় কষ্ট হয়। পারতপক্ষে স্কুল-কলেজের পাশ দিয়ে যাই না আমি। দূর থেকে দেখি সব দরোজা-জানালা বন্ধ থাকে। ভেতরের কান্না, আর্তচিৎকার শুনতে পায় কেউ কেউ। এরই মধ্যে কয়েকজন মেয়ে গলায় শাড়ি বেঁধে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আত্মহত্যা করেছে, এই খবরও পেয়েছি। যৌন অত্যাচারেও মারা যাচ্ছে বন্দি মেয়েদের কেউ কেউ। সব সন্ধ্যার পর নদীতে ফেলে দিয়ে আসে ওরা। বেশ্যাদের জীবনও এমন করুণ নয়।

সবুর চৌধুরী বলেন, কী করে পারে এরা এমন পৈশাচিক নিষ্ঠুর আচরণ করতে। এরা কি মানুষ নয়? বাড়িতে মা-বোন নেই? আর এ-দেশের লোক, তারা কি পাকিস্তানি নয়? শুধু স্বায়ত্তশাসন চেয়েছে বলে এমন জিঘাংসা, এমন বর্বর হামলা?

অমিয়ভূষণ বললেন, শুনতে পাই আমাদের ছেলেরা ট্রেনিং নিচ্ছে যুদ্ধের জন্য। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য আছে অনেক। তারা ছেড়ে দেবে না।

জলিল উকিল বললেন, সেই অপেক্ষায় আছি।

তাঁরা চলে গেলে কমলা রানী বললেন, ভূতনাথ বলল, রোজই চোখ বেঁধে লোক নিয়ে জেলে রাখে। সন্ধ্যার পর নদীর তীরে নিয়ে মারে। কোথা থেকে ধরে আনে এদের?

অমিয়ভূষণ চিমত্মা করে বলেন, মনে হয় গ্রাম থেকে। শহর থেকে গ্রামে গিয়ে যারা আশ্রয় নিয়েছে আর গ্রামের জওয়ান বয়সের লোকদের। এরা বৃদ্ধ আর প্রৌঢ় ছাড়া কাউকেই জীবিত রাখবে না এ-দেশে মনে হচ্ছে। যারা বেঁচে থাকবে তারা তাদের দাসবৃত্তি করবে। ইংরেজরাও এমন পলিসি নেয়নি।

এক সন্ধ্যায় জিপ গাড়ি এসে থামল অমিয়ভূষণের বাড়ির সামনে। তিনি আর তাঁর স্ত্রী জানালা ফাঁক করে দেখলেন এক যুবক অফিসার ভেতর থেকে নামল লাফ দিয়ে। প্রায় লাফিয়ে এসে বাড়ির বারান্দায় উঠে দরোজায় ধাক্কা দিলো জোরে জোরে। অমিয়ভূষণকে ধরে কমলা রানী তখন থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছেন। কাঁপা গলায় বললেন, চলো, পেছনের দরোজা দিয়ে পালাই। ওরা মারতে এসেছে। অমিয়ভূষণ বললেন, এত ভয় পেয়ো না। একা এসেছে। মারতে এলে সঙ্গে সেপাই থাকত। যুবকটি অফিসার। মনে হয় কিছু বলতে এসেছে। তার ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে না মারার জন্য এসেছে। তেমন শান্ত আর স্বাভাবিক দেখাচ্ছে ওকে। চোখে-মুখে কোনো উত্তেজনা নেই। ক্রুদ্ধ দেখাচ্ছে না। অস্থিরও মনে হচ্ছে না উত্তেজনায়। না, সে আমাদের মারতে আসেনি। তাহলে তাকে অন্যরকম দেখাত। আমি যাই, দরোজা খুলে শুনি কী বলে। তুমি ভেতরে থাকো।

দরোজা খুলতেই ইউনিফর্ম পরা যুবক অফিসারটি করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আই অ্যাম কাপ্টেন সাত্তার। ইনচার্জ অব দিস টাউন। হঠাৎ এসে পড়লাম খবর না দিয়ে। কিছু মনে করলেন না তো? তারপর উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে ভেতরের দিকে তাকিয়ে বলল, আসতে পারি?

অমিয়ভূষণ সরে দাঁড়িয়ে বললেন, নিশ্চয়ই। আসুন ভেতরে।

ক্যাপ্টেন সাত্তার বসার ঘরে ঢুকে চারিদিক তাকিয়ে দেখল। দেয়ালে বইয়ের আলমারি। ঘরের মাঝখানে বেতের পুরনো দুটো সোফাসেট। একটা সোফার সামনে টেবিলের ওপর হারমোনিয়াম রাখা, সামনে লেখা ‘পাকরাশি’। কোণে দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা একটা সেতার। নিচু টেবিলে একদিকে হেলে আছে দুটো তবলা। টুপি খুলে টেবিলে রেখে সোফায় বসতে বসতে ক্যাপ্টেন সাত্তার বললেন, আপনার খুব সুনাম শুনেছি। ভালো শিক্ষক। এ ভেরি কালচার্ড ম্যান। গানের চর্চা করেন। শহরের অনেকে আসত আপনার বাড়ি গান শুনতে, আড্ডা দিতে। এখনো আসে, তবে কম। তারপর সে গলা উঁচিয়ে বলল, কম কেন? আগের মতো সবাইকে আসতে বলবেন। আমরা সিচুয়েশান নরমাল করে তুলতে চাই। মিসক্রিয়েন্ট না হলে ভয়ের কিছু নেই। আপনি, আপনার সহকর্মীরা নিশ্চয়ই মিসক্রিয়েন্ট নন? বলে উত্তরের অপেক্ষা না করে যোগ করল, ইউ আর দি এলিট অব দি টাউন। দি ক্রিম অব সোসাইটি। আপনারা স্বচ্ছন্দে ঘোরাফেরা করবেন। দেয়ার ইজ নাথিং টু ফেয়ার। তারপর সে হারমোনিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার গান শোনার খুব শখ। লাহোরে আমার বাড়িতে অনেক রেকর্ড আছে। সেসব রেখে চলে আসতে হয়েছে হঠাৎ করে। এখন গান শোনা হয় না। খুব লোনলি ফিল করি। তাই ভাবলাম, যাই প্রফেসারের বাড়ি। গান শুনে আসি। হ্যাঁ, আমি গান শুনতে এসেছি। শোনাবেন না?

অমিয়ভূষণ ব্যস্ত হয়ে বললেন, অবশ্যই শোনাব। এ তো আমার সৌভাগ্য। আপনার মতো ব্যস্ত মানুষ আমার বাড়িতে এসেছেন গান শুনতে। একটু থেমে বললেন, আমি কিন্তু খুব ভালো গান গাই না। শখ করে গাই। শুনে হয়তো আপনি হতাশ হবেন।

ক্যাপ্টেন সাত্তার বললেন, আপনি খুব বিনয়ী মনে হচ্ছে। একটা কথা কি জানেন? গান করা আর শোনা দুটোই শখ। পেশাদার আর কজন। তাহলে কুছ গানা হো যায়ে। কিছু গান শোনান আমাকে। আই অ্যাম ডাইং টু হিয়ার সংস।

কী গান শুনতে চান? অমিয়ভূষণ তার সামনে হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে তাকালেন সাত্তারের দিকে। দেয়ালঘড়িতে তখন সাড়ে সাতটা। ভেতরের দরোজার ফাঁক দিয়ে সভয়ে কমলা রানী তাঁকে দেখছেন। মনে হলো কাঁপছেন একটু একটু।

ক্যাপ্টেন সাত্তার বলল, গজল। গজলই আমার প্রিয়। আপনি কী গান?

অমিয়ভূষণ বললেন, আমি টেগোর সং, ভজন, গীত, ক্ল্যাসিকাল এসব গাই। গজলও গাই মাঝে মাঝে। বন্ধুরা যখন যা অনুরোধ করেন।

ক্যাপ্টেন সাত্তার বললেন, হ্যাঁ। আপনারা বাঙালি লোগ টেগোর সং খুব পছন্দ করেন শুনেছি। সেটা দিয়েই শুরু করেন। আমি কখনো টেগোর সং শুনিনি।

অমিয়ভূষণ হারমোনিয়ামে সুর তুলে গলা পরিষ্কার করে গাইলেন, বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়। গান শেষ হলে ক্যাপ্টেন সাত্তার বলল, 888sport app download apk latest version করে শোনান। আমি বাঙাল বুঝি না।  তর্জমা শুনে বলল, হ্যাঁ, অর্থ তো বেশ ভালো। একটা প্রেয়ারের ভাব আছে। কিন্তু গানটা খুব সেস্না। ভেরি ভেরি সেস্না। সব টেগোর সংই কি এমন?

অমিয়ভূষণ হাতের কাছে রাখা খাতার দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ। সাধারণত তাই। রবিঠাকুর নিজে সুর ঠিক করে গিয়েছেন। এই সুরই তাঁর পছন্দের ছিল।

ক্যাপ্টেন সাত্তার বলল, এবার গজল শোনান। কার গজল জানেন আপনি?

অমিয়ভূষণ বললেন, মেহেদী হাসান, তালাত মাহমুদ, বেগম আখতার। আর হেমন্ত কুমারের গীত।

শুনে প্রায় লাফিয়ে ওঠে ক্যাপ্টেন সাত্তার। উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে, আরেববাস। আপনে কামাল কার দিয়া। সব আমার ফেভারিট সিঙ্গার। শোনান গজল। অমিয়ভূষণ ঘড়ির দিকে তাকালেন। আটটা বাজে। সাত্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটু চা-জলখাবার, মানে নাস্তা?

ক্যাপ্টেন সাত্তার বললেন, কুচ পরোয়া নেহি। ওহোভি হতে পারে। চা আর পাকোরা।

পাকোরা? পাকোরা তো তৈরি করতে পারে না আমার স্ত্রী। ভূতনাথও না।

আচ্ছা। আচ্ছা। পাকোরা না হোক একটা কিছু থাকলেই হবে চায়ের সঙ্গে।

অমিয়ভূষণ বললেন, শিঙাড়া চলবে?

আরো হ্যাঁ। ভুলই গিয়া থা। আপকা শিঙাড়া বড়া ওমদা নাস্তা। চলে গা। বিলকুল চলে গা। আপ ফিকির না কিজিয়ে। গজল শুরু হো যায়ে। মেহেদী হাসান।

অমিয়ভূষণ ভূতনাথকে ডেকে চা-শিঙাড়া, রসগোলস্না আনতে বললেন। তারপর হারমোনিয়াম টেনে গাইতে শুরু করলেন। ইয়ে দুনিয়া কিসি কা পেয়ার মে জান্নাত সে কম নেহি। প্রথম লাইন শেষ না করতেই ক্যাপ্টেন সাত্তার প্রায় লাফ দিয়ে উঠল। শিশুর মতো হাততালি দিয়ে বলল, আরে কেয়া বাত, কেয়া বাত। আপ নে কামাল কর দিয়া। কেয়া শোনায়া! সামনে বাড়হিয়ে।

অমিয়ভূষণ একটানা গেয়ে গেলেন। ক্যাপ্টেন সাত্তার চোখ বুজে শুনছে। গান শেষ হলে উঠে এসে অমিয়ভূষণকে বুকে জড়িয়ে ধরল। ভূতনাথ শিঙাড়া, রসগোলস্না, চায়ের ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে প্রথমে ভড়কে গেল। ভাবল, তার বাবুকে বুঝি মিলিটারি লোকটা মেরে ফেলছে। তারপর ক্যাপ্টেন সাত্তারের প্রাণখোলা হাসিতে নিশ্চিত হয়ে সে টেবিলের ওপর চায়ের কাপ, শিঙাড়া আর রসগোলস্নার পেস্নট রাখল। সেদিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন সাত্তার উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, আরে বাপ! রসগোলস্না ভি! আপকা মেহমানদারি কা জবাব নেহি। কেয়া বাত। কেয়া বাত। হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিই। সময় নষ্ট করা যাবে না। আরো অনেক গজল শুনতে হবে। একটার পর একটা। চা খাওয়া শেষ হলে অমিয়ভূষণ গাইলেন, বাত করনে মুঝে মুশকিল। চোখ বুজে শুনল ক্যাপ্টেন সাত্তার। শেষ হলে হাততালি দিলো। অমিয়ভূষণ দেখলেন দেয়ালঘড়িতে রাত সাড়ে নয়টা বাজে। ক্যাপ্টেন সাত্তার বলল, রুখ গিয়া কিউ? থাক গিয়া? টায়ার্ড? নেহি? তব চলিয়ে সামনে। অমিয়ভূষণ খাতা খুলে দেখে নিয়ে এবার গাইলেন, দিলে নাদান তুঝে হুয়া কিয়া? গজলটা শেষ হলে উচ্ছ্বসিত স্বরে ক্যাপ্টেন সাত্তার বলল, দিস ইজ মাই ফেভারিট। জানেন তো কার লেখা? মির্জা গালিব। এ গ্রেট পোয়েট। লাইক ইয়োর টেগোর। গাইয়ে। ডোন্ট স্টপ। অমিয়ভূষণ দেখলেন দেয়ালঘড়িতে দশটা বাজে। তিনি গাইলেন, গুলো মে রাঙ্গে ভরে। এরপর গাইলেন, মুঝে তো নজর সে গিরা রাহে হো, লেকিন তোম মুঝে ভুলা না সেকো গে। প্রথম লাইন শেষ না হতেই ক্যাপ্টেন সাত্তার উঠে এসে অমিয়ভূষণকে বুকে জড়িয়ে ধরল। গদগদ স্বরে বলল, অ্যানাদার অফ মাই ফেভারিট গজল। তারপর সোফায় ফিরে এসে বলল, চালিয়ে। রুখ নেহি যানা।

মেহেদী হাসানের গজল শেষ হলো রাত সাড়ে দশটায়। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাত্তারের ওঠার কোনো লক্ষণ নেই। বলল, তালাত মাহমুদ হো যায়ে। অমিয়ভূষণ বললেন, রাত হয়ে গিয়েছে। কিছু ডালভাতের ব্যবস্থা করি। খালি পেটে এতক্ষণ থাকবেন কী করে?

শুনে ক্যাপ্টেন সাত্তার কিছুক্ষণ চিমত্মা করল। তারপর বলল, ঠিক হ্যায়। লেকিন, ভেরি সিম্পিল। ম্যায় বহুত থোরা খাতা। চিড়িয়া কি তারা।

অমিয়ভূষণ ভেতরে গিয়ে স্ত্রীকে বললেন, রাতের খাবার খাবে। ব্যবস্থা করো। শুনে কমলা রানী যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, এত রাতে কী রাঁধবো? এ কী খায় তাও তো জানি না।

অমিয়ভূষণ বললেন, মুরগি খায় নিশ্চয়ই। আর পোলাও। এ দুটো হলেই চলবে। ব্যবস্থা করা যায় না? তার তো যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া আছে বলে মনে হয় না। গান-পাগল মানুষ। শুধু গান শুনতে চায়। কমলা রানী বললেন, মুরগি কোথায় পাব? আমি কিংবা ভূতনাথ কেউই পোলাও রাঁধতে জানি না।

অমিয়ভূষণ বললেন, সবুর চৌধুরীর বাসায় পাঠাও ভূতনাথকে। সে সব খুলে বলবে। মুরগি নিয়ে আসবে। সঙ্গে সবুর চৌধুরীর বাবুর্চিকেও।

এই এত রাতে? কমলা রানী ইতস্তত করেন।

অমিয়ভূষণ বললেন, সবুর খান বুঝবেন এমারজেন্সি। তিনি যা করার করবেন। এতদিনের বন্ধুত্ব এই বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন না? কথা শেষ করে অমিয়ভূষণ বসার ঘরে আসলেন। ভূতনাথ তখন আর একপ্রস্ত চা দিয়ে গিয়েছে। ক্যাপ্টেন সাত্তার বলল, খানাকে লিয়ে ফিকির মাত কি জিয়ে। আমি গান শুনতে এসেছি। গান শুনিয়ে যান। আহা, কী সুন্দর এই রাত! অনেকদিন পর স্বর্গীয় অনুভূতিতে মন ভরে গেল। বুঝলেন প্রফেসার, গান হলো আলস্নাহর দেওয়া নেয়ামাত। এর তুলনা হয় না। মানুষকে এই পৃথিবীর কোলাহল থেকে বহু দূরে নিয়ে যায়। অ্যাওয়ে ফ্রম অল বস্নাডি ট্রাবলস্। পিস্নজ কন্টিনিউ। এবারে তালাত মাহমুদ হোক। অমিয়ভূষণ দেখলেন রাত সোয়া এগারোটা বাজে দেয়ালঘড়িতে। তিনি গাইলেন, আয়ে দিল মুঝে এ্যয়সি জাগা লে চল। ক্যাপ্টেন সাত্তার চোখ বুজে শুনতে লাগল। গান শেষ হলে হাততালি দিয়ে বলল, কেয়া বাত। কেয়া বাত। আপনে কামাল কার দিয়া। মেহেদী হাসান, তালাত সব সমান আপনার কাছে। ইউ আর ভার্সাটাইল। আপকো ফানকার হোনা চাহিয়ে থা। ইউ শু্যড হ্যাভ বিন অ্যান আর্টিস্ট। অমিয়ভূষণ যখন ‘তসবির তেরা দিল মেরা বাহলানে সেকে গি’ গাইলেন তখন ঘড়িতে রাত বারোটা বাজে। তিনি এরপর গাইলেন, কোই নেহি মেরা ইস দুনিয়া মে। গানটা শেষ হলে ক্যাপ্টেন সাত্তার বলল, এ স্যাড গজল। ব্রিংস টিয়ার্স টু মাই আইজ। বলে সে রুমাল দিয়ে চোখ মুছল। দেখে অমিয়ভূষণ অভিভূত হলেন। তখন তাঁর মনে ভয়, সংকোচ তো নেই-ই, ক্যাপ্টেন সাত্তারের জন্য একটু একটু সহানুভূতিও দেখা দিয়েছে। ছেলেটা মনেপ্রাণে একজন 888sport live chatী। মিলিটারি প্রফেশন তার মোটেও মানায় না। রাত বারোটায় তিনি গাইলেন, জ্বলতে হ্যায় জিসকে লিয়ে। ক্যাপ্টেন সাত্তার আগের মতোই মন্ত্রমুগ্ধের ভঙ্গিতে শুনল, শেষ হলে হাততালি দিলো। তারপর বলল, চালিয়ে। রুখ কিউ গিয়া? অমিয়ভূষণের পরবর্তী গান শেষ হলো রাত একটায়। ভূতনাথ ঘরে ঢুকে বলে, খাবার তৈরি। এখানে খাবেন, না খাওয়ার টেবিলে? অমিয়ভূষণ ক্যাপ্টেন সাত্তারের দিকে তাকালেন। সাত্তার বলল, এখানেই নিয়ে আসতে বলেন। ঘরটায় গানের আমেজ ছড়িয়ে আছে। যেতে ইচ্ছে করছে না।

খাওয়া শেষ হলো রাত দুটোয়। অমিয়ভূষণ ভাবলেন এবার ক্যাপ্টেন সাত্তার ফিরে যাবে। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে অবাক হলেন তিনি। সে নিশ্চিন্তে সোফায় হেলান দিয়ে বসে বলছে, ফির শুরু হো যায়ে। আব বেগাম আখতার হো সাক্তা। সি ইজ অলসো মাই ফেভারিট। অমিয়ভূষণ হারমোনিয়াম টেনে খাতা খুলে দেখে দেখে গাইলেন, আয় মোহাববাত তেরে আনজাম মে। শেষ হলে সাত্তার উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, বহুত খুব, বহুত খুব। মেয়েলি কণ্ঠস্বরও রপ্ত করতে পেরেছেন আপনি। ইউ আর এ জিনিয়াস। আপনাকে টিভি-রেডিও 888sport live chatী হতে হবে। ইউ ডিসার্ভ ইট। গাইয়ে। অমিয়ভূষণ গাইলেন ওয়ো জো হাম সে তুম সে কারার থা। শেষ হলে সাত্তার বলল, এটা কবি মোমিনের 888sport app download apk। আমরা স্কুলে থাকতে পড়েছি। ভেরি ফেমাস। গাইয়ে। অমিয়ভূষণ গাইলেন, মেরি হামনাফাস, মেরি হামনাভা। গান শেষ হলে দেখলেন ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটা। সাত্তারের চোখে ঘুম নেই, দেহে ক্লান্তি আছে বলে মনে হলো না। কিন্তু তিনি ক্লান্তি বোধ করছেন এখন। সেই কখন থেকে গাইছেন। একটানা এভাবে কোনোদিন তিনি গাননি।

রাত চারটায় শুরু হলো কে এল সায়গলের গান। তিনি প্রথমে গাইলেন, দো নায়না মাতওয়ারে। তারপর গাইলেন, যব যব দিলহি টুট গিয়া। সেটা শেষ হলে গাইলেন, গম দিয়ে মুস্তাকিল। দেখলেন সাত্তার চোখ বুজে শুনছে। ঘুমায়নি, কেননা মুখে হাসি। হাততালি দিচ্ছে না আগের মতো, উচ্ছ্বসিতও হচ্ছে না। শুধু মৃদু মৃদু মাথা নাড়ছে সুরের সঙ্গে। অমিয়ভূষণ দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ভোর পাঁচটা বাজে। তিনি একটু বিরতি দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সাত্তার চোখ খুলে বলল, আরো, কেয়া হুয়া? গাইয়ে। সুনাইয়ে। শো জা, রাজকুমারী শো জা। ভেরি স্যাড সং। ব্রিংস্ টিয়ার্স টু মাই আইজ। হোয়াট এ গোল্ডেন ভয়েস। তারপর বলল, আচ্ছা, আব আওর কুচ হো যায়ে। হেমন্ত কুমার কা গীত। অমিয়ভূষণ গাইলেন, গুজার গেয়া উয়ো জামানা ক্যয়সে ক্যয়সে। তারপর গাইলেন জগমোহনের গীত, তুমসে হায় এতনা পেয়ার কিঁউ, ইয়ে না বাতা সেকু গা মেয়। তারপর গাইলেন, মেরে আঁখে হায় দেওয়ানে। শুনে সাত্তার বলল, ইয়ে সাব গীত কা স্টাইল বিলকুল আলাহিদা। টাচেস ইয়োর সোল। অমিয়ভূষণ দেখলেন দেয়ালঘড়িতে ভোর ছয়টা বাজে। ভূতনাথকে ডেকে বললেন সকালের জলখাবার তৈরি করতে। সাত্তার বুঝতে পেরে বলল, আপ খানাপিনা লেকে এতনা শোচতা কিউ? গাইয়ে। আমি গান শুনতে এসেছি, খাবার জন্য না। অমিয়ভূষণ বললেন, সকাল হয়ে গিয়েছে। ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে। ব্রেকফাস্টের সময় এখন। আপনাকে ব্রেকফাস্ট না করিয়ে যেতে দেব কেমন করে? শুনে হো হো করে হেসে উঠল সাত্তার। বলল, বুঝতে পারছি বিদায় দিতে চান এখন। অমিয়ভূষণ ত্রসেত্ম বললেন, না, না। বিদায় দিতে চাব কেন? বলেছি তো আমার সৌভাগ্য যে আপনি বাড়িতে এসে গান শুনতে চেয়েছেন। আমি সামান্য গায়ক। শখ করে গাই। তবু শুনতে এসেছেন। সারারাত শুনলেন। আরো শুনতে চাইলে শোনাতে পারি। আপনার মতো শ্রোতা তো পাইনি আগে। কিন্তু আপনাকে অফিসে যেতে হবে। এখানে আটকে রাখতে পারব না। আবার আসবেন শুনতে। আমি তো সবসময়ই এভেইলএবল। সাত্তার বলল, হ্যাঁ। ঠিক বলেছেন। আজকের মতো এখানেই শেষ করা যাক। অফিসে যেতে হবে। অনেক কাজ আমার। তবে ব্রেকফাস্টের আগে একটা গান হয়ে যাক। কী শোনাবেন? শুরু করেছিলেন টেগোর দিয়ে, তাকে দিয়েই শেষ করেন। অমিয়ভূষণ গাইলেন, ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু। গান শেষে তর্জমা করে শোনালেন। সাত্তার বলল, ভেরি অ্যাপ্রোপ্রিয়েট ফর দি অকেশন। থ্যাংক ইউ সো মাচ।

ব্রেকফাস্ট শেষ করে ক্যাপ্টেন সাত্তার বের হবার জন্য দরজার কাছে যাচ্ছে। দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছেন অমিয়ভূষণ। সাত্তার হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, ও। একটা কাজ বাকি রয়ে গিয়েছে। আপ কা ওয়াইফ কো বুলাইয়ে। অমিয়ভূষণ ভেতরে গেলেন স্ত্রীকে ডেকে আনতে। কমলা রানী শুয়ে ছিলেন, জেগেই। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বললেন, আমাকে কেন? অমিয়ভূষণ বললেন, মনে হচ্ছে ধন্যবাদ দেবে।

ঠিক সকাল আটটায় ক্যাপ্টেন সাত্তার অফিসে এসে পৌঁছাল। চেয়ারে বসে টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করল একটা লম্বা রেজিস্টার। ভেতরে সবুজ, কালো এবং ধূসর কালিতে লেখা অনেক নাম। সে কালো কালিতে লেখা নামের তালিকার পৃষ্ঠা বের করল। বেশ কিছু নাম ক্রস চিহ্ন দিয়ে কেটে দেওয়া। ক্যাপ্টেন সাত্তার দুটো নামের শেষে ক্রস চিহ্ন দিয়ে নামগুলো কেটে দিলো। তারপর অরডার্লিকে ডেকে বললেন, এক কাপ কফি লে আও।

[সম্প্রতি শোনা একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে। কিছু কল্পনা মেশানো – লেখক]

 

তিন

ভোরবেলায় সূর্য ওঠার আগেই তারা চারজন প্রৌঢ় মর্নিংওয়াকে বের হন। আজো বের হয়েছেন। ফরেস্ট রোডের যেখানে শেষ সেখানে একটু নিচু জমিতে ফরেস্টের কিছু গাছ এখনো অক্ষত অবস্থায় আছে। অদূরে প্রায় শুকিয়ে যাওয়া নদী। তারা চারজন ফরেস্ট রোডে যাওয়ার সময় দেখতে পেলেন গাছগুলোর নিচে একটি যুবকের দেহ। গায়ের পোশাক ছিন্নভিন্ন, রক্তে কালো হয়ে গিয়েছে। মুখটা আঘাতে এমন বিকৃত যে, সহজে চেনার উপায় নেই। দেখে একজন বললেন, ডেডবডি। কেউ ফেলে রেখে গিয়েছে। আরেকজন বললেন, বোঝা যাচ্ছে না। অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন বললেন, হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। শুনে অবসরপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বললেন, মাথা খারাপ? সেখানে গেলে আমাদের নাম-ঠিকানা সব নেবে। পরে পুলিশ তদন্তের জন্য ডাকবে। কোর্ট থেকে সমন আসবে সাক্ষী দেওয়ার জন্য। অত ঝামেলা পোষাবে না। অবসরপ্রাপ্ত ফুড ডিরেক্টর বললেন, তাহলে থানায় খবরটা দিয়ে যাই আমরা। তারা যা করার করবে। সিভিক ডিউটি বলে একটা কথা আছে না?

থানায় গিয়ে দেখা গেল গেটে ডিউটিরত কনস্টেবল মাথা নিচু করে ঝিমুচ্ছে। হাতের রাইফেল প্রায় মাটিতে পড়ে যায়, এমন অবস্থা। ভেতরে গিয়ে তারা একটা ঘরে ডিউটি অফিসারকে দেখতে পেলেন। তিনি চোখ বুজে চেয়ারে হেলান দিয়ে আছেন। ঘুমোচ্ছেন, না জেগে আছেন বোঝা গেল না। পাশের একটা সেল থেকে পেশাবের তীব্র গন্ধ আসছে। অবসরপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, এই যে, শুনছেন? ডিউটি অফিসার ধড়মড়িয়ে সোজা হয়ে বসলেন। সিভিল সার্জন বললেন, একটা বডি দেখে এলাম ফরেস্ট রোডের মাথায় গাছের নিচে। মৃত না জীবিত, বোঝা গেল না।

ডিউটি অফিসার শুনে ফোন তুললেন। কারো সঙ্গে তার কথা হলো। কথা শোনা শেষ হলে বললেন, কাল রাতে কোনো ক্রসফায়ার হয়নি? আচ্ছা স্যার। সকালে বিরক্ত করলাম।

টেলিফোন রেখে ডিউটি অফিসার চারজনের উদ্দেশে বললেন, আপনাদের নাম-ঠিকানা রেখে যান।

তারা অবাক হয়ে বললেন, কেন? আমাদের নাম-ঠিকানা রাখতে হবে কেন?

ডিউটি অফিসার বললেন, আপনারাই তো রিপোর্ট করলেন। কে বা কারা ঘটনা সম্বন্ধে জানাল তা রেকর্ড করে রাখতে হবে না? শুনে তারা অসন্তুষ্ট মুখে নাম-ঠিকানা লিখে থানা থেকে বের হলেন। থানার বাইরে এসে অবসরপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বললেন, না এলেই ভালো করতাম। ভুল হয়ে গেল। সবাই তার কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়লেন।

তিনি লাল রঙের তিনতলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে টুথব্রাশ করছিলেন। ভোরের আলো সবে ফুটে উঠেছে। বেশ ফুরফুরে বাতাস বইছে। হঠাৎ দেখলেন দুজন কনস্টেবল একটা ভ্যানগাড়িতে একটি ডেডবডি নিয়ে যাচ্ছে। পেছন থেকে মোটরসাইকেলে একজন পুলিশ অফিসার তাদের অতিক্রম করে শহরের দিকে চলে গেল। তিনি বারান্দা থেকে নেমে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে বললেন, ডেডবডি নাকি? কনস্টেবলদের একজন তার দিকে তাকিয়ে বলল, না মরেনি। তবে গুরুতরভাবে আহত। হাসপাতালে নেওয়া হচ্ছে। শুনে তিনি এগিয়ে গিয়ে গেটের সামনে থেকে ভ্যানে রাখা দেহটার মুখ দেখলেন। দেখেই চিনলেন। মার খেয়ে বিকৃত হয়ে গিয়েছে, রক্ত জমে আছে এখানে-সেখানে, ঠোঁট ঝুলে পড়েছে।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে তিনি খুব খারাপ মেজাজের সঙ্গে মোবাইলে ফোন করলেন। ওপাশে কণ্ঠস্বর শুনে হুংকার দিয়ে বললেন, এই হারামজাদারা, কী করেছিস তোরা? একটা কাজও তোরা ঠিকভাবে করতে পারিস না। শুধু টাকার ধান্ধায় থাকিস। কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা। একটা সিম্পল কেইস, তা-ও ঠিকভাবে হ্যান্ডেল করতে পারলি না? কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শোনার পর আবার হুংকার দিয়ে বললেন, হ্যাঁ। হ্যাঁ। সেই ছোকরা বেঁচে আছে। পুলিশ তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। এরপর তিনি আবার ওপাশের কথা শুনলেন কিছুক্ষণ। শুনে বাজখাঁই গলায় বললেন, হ্যাঁ, হাসপাতালেই তো তোরা যাবি এখন। শ্বশুরবাড়ি যেতে বলছি না কি? বাকি কাজটা শেষ কর। এবার যেন লেজেগোবরে না করিস। যত সব হতচ্ছাড়া, নেশারু। আর শোন, মাল নিয়ে ট্রাকটা কখন এসে পৌঁছবে সেই খবরটা শুনে আমাকে জানা। কথা শেষ করে তিনি মোবাইলটা টেবিলে রেখে পরোটার পেস্নট সামনে টেনে ডাবল অমলেট পরোটার ওপরে রাখলেন। তার চোখে-মুখে তখনো বিরক্তি। r