অরুণাংশু আজ বিকেলে চা খেতে ডেকেছে। আকস্মিক এই আহ্বান এমন-কিছু আপত্তিজনক নয়, তবু আমার ব্রহ্মতালুতে আগুন ধরে গেল। এর কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে বসে, আমার উষ্মার সপক্ষে, একাধিক যুক্তি খুঁজে পেলাম। প্রথমত, কেমব্রিজ থেকে দু-পাতা ইংরেজি পড়ে এসে ঝলমলিয়ে ‘ফাইভ-ও-ক্লক টি’-র জন্য আমাকে ই-মেইলে নেমন্তন্ন করতে গেল কেন? চায়ের সঙ্গে টা থাকবে কিনা সেটাই বা কী করে জানব? কেন, সরাসরি বাড়ি বয়ে এসে রাত্তিরে ডালভাত খেতে ডাকলে এমন কী লোকসান হতো? অবশ্য এটাও হক কথা, আততি (ওর সঙ্গিনী, বিষ্ণু দে-র ভক্ত বলে ‘টেনশনে’র বিকল্পে কবির নির্মিত ওই শব্দকল্প অঙ্গীকার করে নিয়েছিল; তার আগের নাম ছিল মৌঝুরি) অরুণাংশুর দীর্ঘমেয়াদি স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে গিরিডিতে ওর মা-বাবার কাছে কবেই চলে গেছে। হাত পুড়িয়ে রান্না করবে কে? এই বিবেচনায় অরুণাংশুর ওপর একটু মায়াই হলো আমার। তবু, দ্বিতীয়ত, শ্রীমান্ এতদিন কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিল, আর কাল-পরশু ওরিয়েন্টাল সোসাইটিতে সেক্রেটারিপদে নির্বাচিত হওয়ার জন্যেই কি শেষ মুহূর্তে ওর এই উদ্যোগ? ও কি জানে না আমি ওই এলিট সংঘের কেউ নই এখন? যদি আমি সেই সংস্থার সদস্য থাকতাম তাহলেও কি আমার মাধ্যমে লবি-চালাচালি করতে দিতাম?

একরাশ অভিমান এসে চশমার কাচে বাষ্পমেঘ বিছিয়ে দেয়। ঘরের বাইরে এক লহমা চোখ রাখি, দেখি অকূল কুয়াশায় পথঘাট ডুবে গেছে। তাহলে কি বন্ধুতা এমন আর আদৌ কোনো মূল্যবোধ নয়? তাই যদি হয়, তাহলে জগৎসংসারটা কীভাবে চলছে! সেক্ষেত্রে অরুণাংশুকে একতরফা দায়বিদ্ধ করলেই কি আমার দায়িত্বটা চরিতার্থ হয়ে গেল? না, না, সেটা হতেই পারে না। আমারও তো কিছু করার আছে। ভাবতে ভাবতে আত্মসমীক্ষণে মেতে উঠি। পাঞ্জাবিটা গলিয়ে নিতে গিয়ে সংকল্পের তাড়নায় আলনাটাকে ধাক্কা মারি, আর বুকের মধ্যে একসঙ্গে আশা ও আশঙ্কার সংঘর্ষ বাধে। বাঃ, এটা তো ভারি মজার, আমার ইচ্ছাশক্তিরও একটা সক্রিয় ভূমিকা আছে তবে! সেদিক থেকে দেখলে হাত-পা গুটিয়ে বসে-থাকাটা মানুষের ধর্ম নয়। ভিতরে-ভিতরে যা ভাবছি বাইরে তাকে সঙ্গে সঙ্গে 888sport app download apk latest version না করতে পারলে অসাম্প্রদায়িক সেই ধর্ম যে ধুলোয় বিলীন হয়ে যাবে। এই ভাবনায় ভর করে বেরুতে গিয়ে দেখি আহত আক্রোশে আলনাটা আমার জামাটাকে আচমকা ছিঁড়ে দিয়েছে। অপমানিত বোধ করব কিনা এই মর্মে ভাবছি, এমন সময় আশাবরী আলমারি থেকে মেরুনরঙা একটা জামা বের করে নিয়ে আমার কাছে দাঁড়াল। আশাবরীর চোখেমুখে সপ্রতিভ কৌতুকের আভা।

রীতিমতো ভদ্রলোকের মতোই আমায় দেখাচ্ছে। সৈয়দ আমির আলি অ্যাভিনিউ উজিয়ে যেতে গিয়ে এককদম ফিরে এসে ইব্রাহিম দরজির দোকানের শার্সির আরশিতে যাচাই-জরিপ করে নিই আমার ভদ্রতা। না, সবই ঠিক আছে, প্রৌঢ়ান্তিক বয়সের সঙ্গে সমীচীন অঙ্গুলিমেয় চুলগুলো সুপরিকল্পিতভাবেই অবিন্যস্ত। ব্যস্, এবার তাহলে অনায়াসেই বেরিয়ে পড়া সংগত হবে।

যেই-না পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে পা রাখব, দেখি কোথাও কোনো মহানগর নেই। চতুর্দিকে নতুন শস্যের অপেক্ষায় বিতত, লাঙল দিয়ে উপড়ে-ফেলা একটি প্রান্তর, অস্তমান হলুদ সূর্যের আশীর্বাদ নিয়ে নাছোড় একটা মানুষ কোঁচড়ের থলি থেকে সন্তর্পণে আগলে-আবজে তুলে নিয়ে বীজের পর বীজ ছড়িয়ে চলেছে। ডাল বাড়িয়ে দিয়ে একটা আপেল গাছ সূর্যের ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দিল, সূর্যকে অনপনেয় ভরসা যুগিয়ে দেবে বলে। আর অম্নি নভেম্বরের রুগ্ন, মৃত কয়েকটা আপেলের ত্বকে লাগল সবুজের আভা। দেখতে- দেখতে প্রথম ছবির কোরক থেকে জন্ম নিল দ্বিতীয় আলেখ্য : প্রথমটিতে বীজ-বুনে-চলা মানুষটির মুখে লেপটে ছিল অন্ধকার মুখোশ, এক নিমেষে কে যেন এসে হরিৎ প্রলেপ লাগিয়ে দিয়েছে। তবু কোন দুঃসাহসে বলি, এখানে ঋজু, একমাত্রিক আশার কথা বলা হয়েছে? কৃষাণের চোখদুটি কেউ বুঝি উপড়িয়ে তুলে ফেলেছে? নাকি ধরে নিতে হবে অন্ধতা সত্ত্বেও সে প্রতিজ্ঞা করেছে অনতিভবিষ্যতে ধরিত্রী ছেয়ে আলোর ফসল ফলিয়ে দেবেই দেবে। ডান হাতে তার ক্রমশই ব্যক্ত হয়ে চলেছে অদম্য পুরু প্রকার, ডান পা ঈষৎ মুড়িয়ে বাস্তবের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে এগিয়ে চলেছে।

এতক্ষণে ঠাহর করতে পারলাম, আমার চোখের ওপর দিগন্তবিস্তারী এই দুটি ছবি মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে এঁকেছিলেন ভ্যান গঘ।     অন্ত্যভাষ্য সৃষ্টি করার আগে কতবার যে মানবজমিনের এই কৃষিকাজের খসড়া তিনি করেছেন, কিন্তু সেগুলো তেমন উৎরোয়নি। এই যুগ্ম কোলাজে হঠাৎই প্রতিভার স্বর্ণ পরিকীর্ণ হয়ে উঠল। সেটা কি নিতান্তই অকস্মাৎ? না প্যারিসে ভাইয়ের কাছে দু-দুটো বছর কাটিয়ে প্রাণের অভিনব রসদ জড়ো করে নিয়ে আসতে পেরেছেন বলেই। সেখানেই ইমপ্রেশনিজমের আঙ্গিক চর্চা করে সেই আন্দোলনের পুনর্নব পথপ্রদর্শক হয়ে উঠেছিলেন। তারপর দক্ষিণ ফ্রান্সের আর্লে শুরু হয়ে গেল ঈশ্বরের সঙ্গে বাজি ধরে 888sport live chatীর লড়াই। তারই অভিঘাত মরণপণ এসব ছবিতে। যখন আঁকছেন তখনো বোধহয় গগ্যাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ববিচ্ছেদ হয়নি। অথবা দিব্যদর্শী আঁকিয়ে অনুমান করতে পারছেন, বন্ধুর সাহায্য ছাড়াই একলা-একা নিসর্গে-মানুষে ভবিষ্যবীজ বয়ন করে দিতে হবে তাঁকে?

কোত্থেকে উঠে এল বিজন মানুষের দৃপ্ত এই রূপক? এক ঝলকে মনে পড়ে যায়, পুরোহিতের ছেলে তরুণ বয়সেই স্বযাচিতভাবে গাঁয়ের ধর্মপ্রচারক হয়ে উঠেছিলেন। কারুক্কে দীক্ষিত করবার জন্য নয়, নিজেই উত্তরণের দিকে যাবার তাগিদে। গোধূলি গির্জেয় কবে যেন সেন্ট লুকের এই বিবরণ শুনিয়েছিলেন তখন, গ্রামের লোকজন পুরো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেনি :

তবে শোনো সেই মানুষটির গল্প, যে কিনা বীজ বুনতে গিয়েছিল। বুনতে বুনতে কিছু দানা পথের পাশে ছড়িয়ে পড়ল, পায়ে পায়ে দলিত হলে পাখিরা উড়ে এসে জুড়ে বসে তাদের খেয়ে খাক করে দিল। কিছু বীজ পড়ল রুখু পাথরে, আর্দ্রতার অভাবে গেল শুকিয়ে। যেসব দানা কাঁটাঝোপে গিয়ে পড়ল তাদের লুকিয়ে ফেলে গজাতে থাকল শুধুই কাঁটা। কিন্তু ভালোমতো জমিনে যে-বীজগুলি পড়েছিল একসময় শতগুণে তারা ফসলিত হয়ে উঠল। এ-পর্যন্ত বলে তিনি (যীশু) চিৎকার করে বলে উঠলেন, তোমাদের মধ্যে যাদের কান আছে তারা এসব কথা উৎকর্ণ হয়ে শোনো …

যখন এসব ছবি আঁকছেন, বাইবেল ঝরে গেছে হাত থেকে তাঁর। চোখদুটো প্রায় কোটরে ঢুকে যাবার দশা, তাদের মধ্য থেকে নির্গত হচ্ছে অনীশ্বর এক দ্যুতি, প্রতিপন্ন করছে, ঈশ্বরের সহায়তা ছাড়াও কিছু-একটা বিশ্বাস পোষণ করা সম্ভব, আর, বন্ধুরা যখন ছেড়ে গিয়েছে বা যাবে তখনো মানুষ, নিখিল মানুষের সঙ্গে সহমর্মিতার গরজে, প্রত্যয়কে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। এতক্ষণে আমি অরুণাংশুর দিকে এগিয়ে যাবার ইন্ধন পেয়ে যাবার পর, তৎসত্ত্বেও, মুষড়ে পড়ি কেমন, হাঁটতে পারি না, দম আটকে যায়।

নিজেকে কোনোরকমে সংগ্রহ করে উঠে দাঁড়াই। আঁচ করতে পারি, আমায় যে-কেউ দেখলেই অকৃতার্থতার প্রতিমূর্তি হিসেবে সাব্যস্ত করে নেবে। কেন জানি না আমার মনে হতে থাকে, আমার ওপর আলফ্রেড কুবিনের প্রেতচ্ছায়া এসে বর্তেছে। কতো বড়োমাপের আর্টিস্ট, তবু কতো সহজেই বাঁচবার আর বাঁচাবার আস্পৃহা থেকে-থেকে তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে যেত। একবার মায়ের গোরস্তানে গিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। সেই অপবাদে 888sport live chatীমহলে দুয়ো দুয়ো পড়ে যায়। তখন থেকেই তাঁর যাবতীয় সৃষ্টির গায়ে মৃত্যুদাগ লেগে থাকে। তখন থেকেই প্রাণের বন্ধু খুঁজতে খুঁজতে বেপথুমান তাঁর চলন-বলন। তখনো রবীন্দ্রনাথ চতুরঙ্গ লেখেননি, আমরা গল্পে-888sport alternative linkে আধিভৌতিকের অশরীরী উপস্থিতি দেখে শিউরে উঠিনি। কুবিন, এরকমই একটা সন্ধিক্ষণে, তাঁর বাল্যবন্ধুর আমন্ত্রণে এশিয়ার কোনো একটা জায়গায় যাত্রা করেছিলেন। কোথায় সেই দেশ, কেমন তার অবস্থিতির নাম-ঠিকানা, এসব না জেনেই মনে-মনে ছকে নিলেন বন্ধুর সেই শহরের নীল নকশা। সেখানে একসময় পৌঁছলেনও। গিয়ে দ্যাখেন গোটা শহরের সবগুলো ঘড়িই থেমে গেছে, ডুবে যাচ্ছে সকল দেবায়তন, শতসহস্র মৃতদেহ ঝরে পড়ছে, আর জলাভূমি শহরটাকে গিলে নিচ্ছে। আগুন এসে সবকিছু ছারখার করে দেওয়ার মুখেই ভূমিকম্প হলো, কিছুই আর বাকি থাকল না।

মনে পড়ে গেল এই সেই প্রলয়ের বৃত্তান্ত, কুবিনের একমাত্র 888sport alternative link অন্য আরেক দিক (উরব ধহফবৎব ঝবরঃব/ ১৯০৮), যা আমি আততিকে জার্মান থেকে তরজমার জন্য দিয়েছিলাম। সে কি এখনো কাজটা সম্পূর্ণ করেনি, নাকি শুরু না করেই ফেলে রেখেছে! গিরিডির অতো মনোরম্য পরিবেশে কি এরকম ছমছমে কথাকাহিনী 888sport app download apk latest version করা যায়? অদিতির ভ্রাতৃদ্বিতীয়ায় চিরদিন আমিই ছিলাম প্রথম অতিথি। ‘অদিতি, অদিতি, বোন আমার, তুমি বেঁচে আছ তো?’ প্রশ্নটা আমায় জাপটে ধরে। আচম্বিতে ঘাড়ের কাছে একদমকা হালকা হাওয়ার স্পর্শ পেয়ে ঘুরে দাঁড়াই। আততি মৃদূষ্ণ হাসছে।

ব্রেবোর্ন কলেজে ইংরেজির লেকচারশিপের জন্য ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম, অলোকদা। তা আপনি এত ফ্যাকাশে হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?

রুমালে ওডিকোলন ঢেলে আততি প্রকাশ্যেই আমার পরিচর্যা করতে থাকে।

এই, কী করছ, আততি? লোকে কী বলবে!

লোক? আজ ধারেকাছে কোথাও কোনো জনমনিষ্যি নেই। একেবারে কুবিন-কুবিন লাগছে।

কুবিনের লেখাটা কদ্দূর করলে?

শুধু একটা জায়গাই সামলাতে পেরেছি। আমার ব্যাগেই সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। আপনাকে শোনাতে বডডো ভয় করছে।

আমি কি গুরুমশাই নাকি! এখুনি, এক্ষুনি শোনাও।

ঠিক আছে, শোনাচ্ছি। কয়েকটা শব্দের কূলকিনারা কোনো ডিকশনারিতেই পাইনি। আপনি ঠিকঠাক করে দেবেন কিন্তু। ঠিক আছে, শুনুন :

ভয়-পাওয়া চৌদুনে বুড়ো একটা লোক লম্বা গলি ধরে নদীর দিকে চলেছে, পরনে নেই টুপি। নাইটগাউনের মাঝখানটা ডানার মতো উড়ছে, পুলওভারের সবগুলো বোতাম আটকানো নেই। মাথাটা ঘন ঘন নাড়াচ্ছে, আসলে নিজের সঙ্গেই লোকটা কথা বলে চলেছে। জলের কাছে পৌঁছে গিয়ে কয়েক মুহূর্ত অমীমাংসিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। উড়াল-দেওয়া সারসের মাধ্যাকর্ষে বালির শীর্ষে উঠে গিয়ে আবার নেমে যায়, নিজেকে উদ্দেশ্য করেই ভাষণ দিতে শুরু করে… ল্যাম্পোস্টের লণ্ঠনটা যে-পাণ্ডুর আলো দেয় তার চূর্ণ চূর্ণ বিকিরণ জলের আয়নায় নাচছে। আমাদের এই বুড়ো লোকটি বুক বেঁধে জোয়ারজল ভেঙে এগিয়ে যেতে থাকল…

শিক্ষক হয়ে জন্মেছি বলেই ভাষান্তরকরণের দুয়েকটা খাঁজখোঁজ পালটে দেবার কথা ভাবছি, এমন সময় দেখি এই দৃশ্যের সঙ্গে হুবহু সম্পূরক কুবিনেরই ‘সৈকত’ ছবিটা আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। যেখানটাতে ভ্যান গঘের শস্যক্ষেত জেগেছিল, তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে সমুদ্র, রেখে দিয়েছে তবু প্লাবিত একটা বেলাভূমি। আমি এক ঝটকায় আততিকে সরিয়ে নিয়ে অদূরবর্তী একটা বালুর ঢিবির কাছে রেখে আসি, একটু আগেও যেখানে ছিল ট্রাম টার্মিনাস। তারপরেই ফিরে এসে দেখি এক্সপ্রেশনিজম 888sport live chatধারার শাহেনশাহ্ কুবিনের গড়া অকালথুত্থুরে একটা মানুষ তার খিন্ন দুই হাতে অসীম শূন্যতা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সংগৃহীত সেই শূন্য কি ঝিনুকের, নাকি কাদামাটির মতো প্রতীয়মান হচ্ছে? আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে লোকটার পা থেকে মাথা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকি। মুখের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করে নিতে পারি, কোনো রবীন্দ্রসংগীতই তার দাহময়তা এতটুকু জুড়িয়ে দিতে পারবে না। সে যতই জলের দিকে হেঁটে যাচ্ছে জল ততোই তাকে ডুবিয়ে দেবার সংগ্রামে এগিয়ে আসছে। ‘হেঁটে-যাওয়া’র উপমাটা খুব ভুল হলো। প্রাণপণে বাঁ-পাটা সামনে রেখেছে, ডান-পা কিন্তু শেকড়ের মতো মাটি গেড়ে বসে যেতে চায়। দুঃস্বপ্নশরীরী মুমূর্ষু এই মানুষের মাথার ওপর ভ্যান গঘের প্রতিশ্রুতিব্যঞ্জক অস্তসূর্য নেই, তার বদলে আছে সিন্ধুশকুন, তাকে আস্তেসুস্থে খুবলে খেয়ে নেওয়ার মন্ত্রণায়। মানুষটি এখনো মওে যায়নি, হয়তো এক অনুপলের জন্যে হলেও ছেড়ে-যাওয়া বন্ধুর সঙ্গে পুনর্মিলনের প্রত্যাশাই    এই গ্রহে তাকে টিকিয়ে রেখেছে।

ঘড়ির অভ্রে চোখ নামিয়ে দেখি সন্ধে ছটা। অর্থাৎ ঘড়িটা চলছে। চোখ তুলে দেখি অবিশ্বাস্য ব্যাপার, ট্রাম-বাস চলতে শুরু করেছে, আর হাজার হাজার মানুষ প্রত্যেকে তার প্রিয়জনের অভিমুখে বাড়ি ফিরছে। বিকেল পাঁচটা কখন চুকেবুকে গেছে, এত দেরি করে আর অরুণাংশুর কাছে গেলে নিজের হয়ে নিজেই প্রক্সি-হাজিরা দিতে হবে। তাকে বরঞ্চ আজ রাতে একটা চিঠি লিখব, তার ভেতরে থাকবে এই সমাচার যে, তার নেমন্তন্ন বজায় রাখতে  গিয়ে একবার ভ্যান গঘ এবং দ্বিতীয়বার কুবিনের ছন্দে আমি হেঁটে গিয়েছিলাম। আর সেই দুরকম যাওয়াটাও তো এরকম পৌঁছুনো।

Ñচলুন, অলোকদা, অরু-ণাংশুর ওখানে যাবার পথে আপনাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আসি।

 ‘অরুণাংশুর ওখানে’ বলছ কেন, আততি? তুমি তাকে ছেড়ে এলেও সেটা তো তোমারও ফ্ল্যাট।

না, আমি আর সেখানে তো ফিরতে পারি না। কিন্তু আপনার কাছে সে এমন কী অন্যায় করেছে যে, আপনি তার ডাকে সাড়া দেবেন না?

তোমার কাছে সেসব কথার সাতকাহন গাইতে গেলে অনেক রাত্তির হয়ে যাবে। তার চেয়ে বরং এসো, আমরা একটা কাজ করি। ন্যাড়া ওই জারুল গাছটার নিচে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়াই। তুমি দেখো, অরুণাংশু ঠিকই আমাদের দিকে আসছে। তুমি ঠিক দেখবে, ওর হাতে একটা থালি, আর তার মধ্যে রয়েছে ডাল আর আধপোড়া রুটি। মরিচের আচার দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে আমরা দুজন খাব। আর ও-ব্যাটা শুধু দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দেখবে।