দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাসির গান ও প্রেমের গান

শান্তি সিংহ

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৮৬৩-১৯১৩) হাসির গান ও প্রেমের গান আলোচনা করতে হলে, কবি-প্রতিভার মূলসুরটি ধরতে হবে এবং তা হলো : কবির প্রেমচেতনা কবির যৌবনে যা কৌতুকরসদীপ্ত ও রোমান্টিক।

২৪ বছরের দ্বিজেন্দ্রলাল বিলেতফেরত নব্যযুবা। চাকরি-সুবাদে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৮৮৭ সালে পরমাসুন্দরী সুরবালার সঙ্গে বিয়ে। নতুন প্রেমের আবেগে তিনি লেখেন –

প্রথম যখন বিয়ে হল

ভাবলাম বাহা বাহা রে!

কি রকম যে হয়ে গেলাম

বলবো তাহা কাহারে!

 

এমনি হ’ল আমার স্বভাব

যেন বা খাঞ্জাখাঁ নবাব;

নেইক আমার কোনই অভাব –

পোলাও, কোর্মা, কোপ্তা, কাবাব্,

রোচে না ক আহারে

– ভাবলাম বাহা বাহা রে।

[‘প্রণয়ের ইতিহাস’, হাসির গান]

 

কিংবা, তরুণীর চোখ-দিয়ে-দেখা প্রেমিক ও প্রেম –

প্রেমটা ভারী মজার ব্যাপার।

প্রেমিক মজার জিনিস।

ও-সে জানোয়ারটা হাতায় পেলে

আমি ত একটা কিনি

বোধ হয় তুই-ও একটা কিনিস।

(‘নূতন প্রেম’/ তদেব)

 

কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রেমপূর্ণ সুখী দাম্পত্য জীবন মাত্র ১৬ বছরের। ১৯০৩ সালে কবি-প্রেয়সীর লোকান্তর। ইতিমধ্যে বিরহ (১৮৯৭), হাসির গান (১৯০০) লিখে ফেলেছেন। একদা বিলেত-যাওয়ার জন্য তাঁকে হিন্দু সমাজ একঘরে করেন। সমাজপতিদের বিধান মান্য করে তিনি তথাকথিত প্রায়শ্চিত্ত করেননি। কবির স্বাধীনচিত্ত পরিহাসপ্রিয় হয়ে রচনা করেছে একঘরে (১৮৯৭) প্রহসন। যেখানে আছে –

বিলেত থেকে ফিরে এসে হরিদাস রায়

ছেড়ে দিলেন মুরগী, গরু জাতের ঠেলায়

মুড়িয়ে মাথা, ঢেলে ঘোল

ধল্লেন আবার মাছের ঝোল

কুম্ড়াসিদ্ধ, বেগুনপোড়া, আলুভাতে তায়

বিলেত থেকে ফিরে এল হরিদাস রায়।

 

বিলেত থেকে ফিরে এসে হরিদাস রায়

দলে মিশি’ ভন্ড ঋষি হতে যদি চায়

পেটের মধ্যে থেকে থেকে

মুরগীগুলো উঠে ডেকে

গরুগুলো হাম্বা করে – এ কী হল দায়,

বিলেত থেকে ফিরে এসে হরিদাস রায়।

 

আমাদের সংসারজীবনে, স্ত্রীর অনুজার সঙ্গে মধুর রঙ্গরস ভালো জমে। তাই শ্যালিকার আরেকনাম ‘কেলিকুঞ্চিকা’! রঙ্গপ্রিয় কবি দ্বিজেন্দ্রলাল তাই সরসচিত্তে বলেন –

পত্নীর চাইতে শ্যালী বড়

যে-স্ত্রীর নাহিক ভগ্নী –

সে-স্ত্রী পরিত্যাজ্য, ও তার

কপালেতে অগ্নি!

(‘সংসার’, হাসির গান)

কৌতুকচিত্তে হাস্যপ্রিয় কবি লেখেন –

পত্নীর চাইতে কুমীর ভাল

– বলে সর্বশাস্ত্রী।

কুমীর ধর্ল্লে ছাড়ে তবু

ধর্ল্লে ছাড়ে না স্ত্রী। (তদেব)

প্রভাতী কবোষ্ণ চা আমাদের খুবই প্রিয়। তার জন্য আমাদের সাহেবসুবো না  হলেও চলে। হাসির গানে কবি ‘চা’ নিয়ে লিখেছেন –

বিভব, সম্পদ, ধন নাহি চাই

যশ, মান চাহি না;

শুধু বিধি, যেন প্রাতে উঠে

পাই ভাল এক পেয়ালা চা।

তা সঙ্গে যদি ‘টোস্ট’-ডিম্ব থাকে

আপত্তিকর নয় তা

শুধু বিধি যেন নাহি যায় ফাঁকে

ওগো, প্রাতে এক পেয়ালা চা।

 

পিতৃসত্য পালনের জন্য রামের বনবাস নিয়ে আধুনিক মনের কবি কৌতুক করে লিখেছেন –

যদি নিতান্ত যাইবি বনে

সঙ্গে নে সীতা-লক্ষ্মণে

ভালো একজোড়া পাশা

আর ঐ (ওরে) ভালো দুজোড়া তাস।

এ কি হেরি সর্বনাশ!

ওরে আমি যদি তুই হইতাম

পোর্টমান্টর ভিতরে নিতাম

বঙ্কিমের ঐ খানকতক

(ওরে) ভালো 888sport alternative link।

(‘রাম-বনবাস’, তদেব]

কবির কৌতুকরসের সঙ্গে সরস-উৎকৃষ্ট কল্পনার মিশ্রণে আশ্চর্য এক অতিকল্পনা (Fantasy) তৈরি করেছে ‘তান্সান্-বিক্রমাদিত্য-সংবাদ’ গানে। বহুবছর আগে, নীলাদ্রিশেখর বসু তাঁর অসাধারণ আবৃত্তিকৌশলে এই রচনাটি আবৃত্তি করতেন, তা অনেকেরই জানা।

কিঞ্চিৎ উদ্ধৃত করা যেতে পারে –

যা হোক, এলেন তান্সান্ রাজার কাছে

দেখাতে ওস্তাদি;

আর নিয়ে এলেন নানা বাদ্য

‘পিয়ানো’ ইত্যাদি।

 

অ – অর্থাৎ আন্তেন নিশ্চয়

কিন্তু হ’ল হঠাৎ দৃষ্টি

যে, হয়নি ক তান্সানের সময়

‘পিয়ানো’রও সৃষ্টি।

ধিন্তাকি ধিন্তাকি

মেও-এঁও-এঁও।

 

যা হোক, তান্সান্ গাইলেন এমন মল্লার

রাজা গেলেন ভিজে;

আর, গাইলেন এমন দীপক, তান্সান্

জ্বলে উঠলেন নিজে –

অ – অর্থাৎ যেতেন রাজা ভিজে

তান্সান্ উঠতেন জ্বলে

কিন্তু রাজার ছিল ‘ওয়াটারপ্রুফ’;

আর তান্সান্ এলেন চলে।

(কোরাস) তা ধিন্তাকি ধিন্তাকি

ধিন্তাকি ধিন্তাকি –

মেও-এঁও-এঁও।

 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মন্দ্র কাব্য (১৯০২) স্বাতন্ত্র্য কবি-প্রতিভায় উজ্জ্বল। সেখানে রবীন্দ্রনাথের মানসী (১৮৯০), সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬) বা কথা (১৯০০), কাহিনী (১৯০০), ক্ষণিকা (১৯০০), নৈবেদ্য (১৯০১) ইত্যাদি কাব্যের কোনো প্রভাব নেই।

দুই

১৯০৩ সালে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের স্ত্রীবিয়োগ। তারপর তিনি নাটক লেখার জগতে আসেন। তারাবাই (১৯০৩) কাব্যনাট্যটি অবশ্যি স্ত্রীবিয়োগের পূর্বে রচিত। তারপর একাদিক্রমে নাটক-রচনা। প্রতাপসিংহ (১৯০৫), দুর্গাদাস (১৯০৬), নূরজাহান (১৯০৮), সোরাব রুস্তম (১৯০৮), মেবারপতন (১৯০৮), সাজাহান (১৯০৯), চন্দ্রগুপ্ত (১৯১১) ইত্যাদি। তাঁর মৃত্যুর পর প্রকাশিত ভীষ্ম (১৯১৪), সিংহলবিজয় (১৯১৫)।

স্ত্রীবিয়োগের পর কবি দ্বিজেন্দ্রলালের অন্তরে জাগে অপার শূন্যতাবোধ ও বিশেষ এক দার্শনিক চেতনা। জগৎ ও জীবন সম্পর্কে জাগে গভীরতাবোধ। তখন তাঁর কবিদৃষ্টিতে প্রেমের অতলান্ত বিরহ এবং উচ্ছল আবেগের অন্তরে প্রেমের বিচিত্র অন্তর্দীপ্তি জেগে ওঠে। সেই প্রেমানুভূতি মানবজীবনের অন্তর্লোকের বিচিত্র আলো-অাঁধারির বর্ণবিভায় প্রেমের গানের কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে নতুনভাবে জাগিয়ে তোলে।

দ্বিজেন্দ্রলালের কবিজীবনে নেই রবীন্দ্রনাথের ‘নতুন বউঠান্’ কিংবা সুন্দরী-বিদুষী কবি-অনুরাগিণীরা। পরকীয়া প্রেমের               চিন্তাবর্ধক বর্ণালিতে তিনি জীবনকে দেখার আগ্রহ বোধ করেননি। অথচ শেকস্পিয়র-বায়রন-গ্যেটে-শিলার প্রমুখ বিদেশি                 কবি-নাট্যকারদের 888sport live footballরসে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। তার সঙ্গে একদা সুখী দাম্পত্যজীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে 888sport sign up bonusর আলোয় প্রজ্বলিত করেছেন কবিত্বশক্তির দুর্বার প্রেরণায়। উদাহরণ হিসেবে তাঁর লেখা কয়েকটি নাটক থেকে বহুমুখী প্রেমানুভবের প্রকাশ দেখানো যেতে পারে।

সোরাব রুস্তম (১৯০৮) নাটকের তৃতীয় অঙ্ক চতুর্থ দৃশ্য। স্থান-সামিঙ্গনের রাজ-অন্তঃপুরকক্ষ শিখর। কাল সায়াহ্ন। তামিনা একাকিনী গাইছেন –

আমি রব চিরদিন তব পথ চাহি

ফিরে দেখা পাই আর নাই পাই।

দূরে থাক, কাছে থাক, মনে রাখ, নাহি রাখ

আর কিছু চাহি নাকো, আর কোন সাধ নাহি।

অবহেলা, অপমান বুকে পেতে লব, প্রাণ –

ভালোবেসেছিলে জানি, মনে শুধু রবে তাই।

আমি তবু তব লাগি, নিশিদিন রব চাহি

এমনই যুগ-যুগ, জনম-জনম বাহি।

 

লক্ষণীয়, তামিনার একাকিত্বে যে-প্রেমবিধুরতা, সেখানে পত্নীহারা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের একাকিত্বের বেদনা ও অতলান্ত শূন্যতাবোধ মিশে গেছে। তাই নাটকের গানটি মর্মস্পর্শী।

দুর্গাদাস (১৯০৬) নাটকে পঞ্চম অঙ্ক তৃতীয় দৃশ্য। স্থান – কোয়েলার দুর্গশিখর। কাল – জ্যোৎস্না রাত্রি। অজিত ও রাজিয়া একটি বেদির ওপর উপবেশন করে আছেন। অজিত প্রেমাবেগে রাজিয়ার হাত ধরে ‘প্রাণাধিক’ সম্বোধন করলেই, প্রেমবিহবল রাজিয়া ‘প্রিয়তম’ উচ্চারণ করেন। তারপর প্রেমতপ্ত হৃদয়ের আর্তি জানান গানের মাধ্যমে। গানটি নিম্নরূপ :

 

এসো এসো বঁধু বাঁধি বাহুডোরে,

এসো বুকে করে রাখি।

বুকে ধরে মোর আধ ঘুমঘোরে

সুখে ভোর হয়ে থাকি।

মুছে যাক চখে এ নিখিল সব

প্রাণে প্রাণে আজ করি অনুভব

মিলিত হৃদির মৃদু গীতরব –

আধানিমীলিত আঁখি।

বহুক বাহির পবন বেগে

করুক গর্জন অশনি মেঘে

রবি-শশী-তারা হয়ে যাক হারা

আঁধার ফেলুক ঢাকি

আমি তোমার বঁধু, তুমি আমার বঁধু

এই শুধু নিয়ে থাকি –

বিশ্ব হতে সব লুপ্ত হয়ে যাক

আর যা রহিল বাকি।

এই আবেগব্যাকুল প্রেমানুভব বা প্রেমার্তি যেন পত্নীসঙ্গকাতর স্বয়ং নাট্যকারের। যা রাজিয়ার মুখে প্রকাশ করে পতণীহারা প্রেমিকের তীব্র প্রেমাবেগকে রূপায়িত করেছেন কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়।

 

দুর্গাদাস নাটকের তৃতীয় অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য। রাজিয়া এস্রাজ রেখে গান ধরেন –

হৃদয় আমার গোপন করে

আর ত লো সই রৈতে নারি,

ভরা গাঙে ঝড় উঠেছে –

থর থর কাঁপছে বারি।

ঢেউয়ে ঢেউয়ে নৃত্য তুলে

ছাপিয়ে উঠে কূলে কূলে

বাঁধ দিয়ে এ মত্ত তুফান

আর কি ধরে’ রাখতে পারি।

মানের মানা শুনবো না আর

মান-অভিমান আর কি সাজে,

মানের তরী ভাসিয়ে দিয়ে

ঝাঁপ দেবো এই তুফানমাঝে।

এখানেও যেন কবি-নাট্যকার নিজের তপ্ত প্রেমের আবেগকে স্বতঃস্ফূর্ত করে দিয়েছেন রাজিয়ার মুখে!

সাজাহান (১৯০৯) নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক, প্রথম দৃশ্য। স্থান মথুরায় ঔরংজীবের শিবির। কাল – রাত্রি। দিলদার একাকী। তারপর দিলদারের সঙ্গে ঔরংজীবের প্রস্থান। তখন মোরাদ নর্তকীদের উদ্দেশে বলে, ‘নাচো, গাও।’ তখন একটি নৃত্যগীতের দৃশ্যের অবতারণা করেছেন নাট্যকার। গীত নিম্নরূপ :

আজি এসেছি – আজি এসেছি, এসেছি বঁধু হে

নিয়ে এই হাসি, রূপ, গান।

আজি, আমার যা কিছু আছে

এনেছি তোমার কাছে

তোমায় করিতে সব দান।

আজি তোমার চরণতলে রাখি এ কুসুমভার

এ হার তোমার গলে দিই বঁধু উপহার

সুধার আধার ভরি’, তোমার অধরে ধরি –

কর বঁধু কর তায় পান।

আজি হৃদয়ের সব আশা, সব সুখ ভালোবাসা

তোমাতে হউক অবসান।

ঐ ভেসে আসে কুসুমিত উপবন সৌরভ

ভেসে আসে উচ্ছল জলদল-কলরব

ভেসে আসে রাশি রাশি জ্যোৎস্নার মৃদুহাসি

ভেসে আসে পাপিয়ার তান;

আজ এমন চাঁদের আলো,  মরি যদি সেও ভাল

সে মরণ স্বরগ সমান।

আজি তোমার চরণতলে লুটায়ে পড়িতে চাই

তোমার জীবনতলে ডুবিয়া মরিতে চাই,

তোমার নয়নতলে শয়ন লভিব বলে, আসিয়াছি

তোমার নিধান

আজি সব ভাষা সব যাক – নীরব হইয়া থাক

প্রাণে শুধু মিশে  যাক  প্রাণ।

 

কবি-নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর রোমান্টিক আবেগকে সুন্দরভাবে রূপ দিয়েছেন উপরের প্রেমসংগীতটির মাঝে। এই গানটি একদা  একটি জনপ্রিয় বাংলা live chat 888sportে অভিনব পরিবেশে পরিবেশিত। সংগীতটির মাধুর্য-ঝঙ্কার জনচিত্তরঞ্জনী, বলা বাহুল্য।

 

সাজাহান নাটকের তৃতীয় অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য। স্থান খিজুয়ায় সুজার শিবির। কাল – সন্ধ্যা। সুজা মানচিত্র দেখছেন। ফুলমালা হাতে পিয়ারার আগমন। সুজার ইচ্ছায় পিয়ারা প্রেমসংগীত নিবেদন করেন। তা নিম্নরূপ :

তুমি বাঁধিয়া কী দিয়ে রেখেছ হৃদি এ,

(আমি) পারি না যেতে ছাড়ায়ে,

এ যে বিচিত্র নিগূঢ় নিগড় মধুর –

(কী) প্রিয় বাঞ্ছিত কারা-এ!

এ যে যেতে বাজে চরণে এ পয বিরহ কাজে 888sport app download for androidে

কোথায় যায় মিলিয়া যে মিলনের হাসি

চুম্বনের পাশে হারায়ে।

 

এই 888sport sign up bonusমধুর প্রেমসংগীতে বিরহী কবি দ্বিজেন্দ্রলালের হৃদয়ার্তি প্রবল-গভীরভাবে পরিস্ফুট।

নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর নাটকের প্রেমের  গানে কিংবা পরিবেশনায় প্রায়শ গভীর আত্মমগ্ন (subjective) হয়ে যেতেন, যদিও নাট্য888sport live chat বহিরঙ্গভাবনার (objectivity) প্রকাশ। একটি সহজ উদাহরণ প্রসঙ্গত নিবেদন করি। সাজাহান নাটকের তৃতীয় অঙ্ক, ষষ্ঠ দৃশ্য। স্থান – যোধপুরের প্রাসাদকক্ষ। কাল – মধ্যাহ্ন। যশোবন্ত সিংহ ও জয়সিংহ। মহামায়ার প্রবেশ। মহামায়া বলেন – ‘চেয়ে দেখ – ঐ রৌদ্রদীপ্ত গিরিশ্রেণি – দূরে ঐ ধূসর বালুস্তূপ। চেয়ে দেখ – ঐ পর্বত স্রোতস্বতী – যেন সৌন্দর্যে কাঁপছে।’ তখন চারণবালকগণের প্রবেশ। মহামায়া বলেন – ‘গাও  বালকগণ! সেই গান গাও – আমার জন্মভূমি!’

তখন চারণবালকদের মুখে কবিনাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল শ্যামস্রী বঙ্গভূমির বন্দনাগান শোনান! যা তাঁর অন্তরের গভীরে আবেগে স্বতঃস্পন্দিত। [বলা বাহুল্য, গানটি রাজস্থান যোধপুরের প্রাকৃতিক দৃশ্যে একান্তই বেমানান।] গানটি বাংলা ভাষাভাষীদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। তা নিম্নরূপ :

ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা

তাহার মাঝে আছে দেশ এক – সকল দেশের সেরা;

ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ, 888sport sign up bonus দিয়ে ঘেরা

এমন দেশটি্ কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,

সকল দেশের রাণী সে যে-আমার জন্মভূমি।

 

তিন

‘ধনধান্যপুষ্পভরা…’ গানটির সুরারোপ ক’রে স্বকণ্ঠে প্রায়শ গেয়ে শোনাতে ভালোবাসেন  স্বয়ং দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। গানটিতে দেশি সুরে বিদেশি সুরের মিশ্রণ ঘটেছে। একদা বিলেতপ্রবাসী দ্বিজেন্দ্রলাল বিলিতি সুরলহরিতে  মুগ্ধচিত্ত হন। তারই ফলে,  তাঁর লেখা বহু গানে বিলিতি সুরের মনমাতানো ধ্বনি আমাদের মুগ্ধ করে। প্রসঙ্গত, দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর ‘ইংরেজি ও হিন্দু সংগীত’ নামক রচনায়  বলেছেন, ‘আমাদের রাগরাগিণীগুলি একটি আশ্রয় অবলম্বন করিয়া থাকে।… সে আশ্রয়বিচ্যুত হইতে চাহে না। ইংরেজি সংগীতে প্রতি গানের সুর নিরাশ্রয়। তাহারা কোনো নির্দিষ্ট ভিত্তি হইতে ওঠে না, বা কোনো নির্দিষ্ট স্থানে শেষ হয় না। ধূমকেতুর মতো কোথা হইতে আসিয়া কোথায় চলিয়া যায়, তাহার ঠিকানা নাই।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমাদের গানে আগে যেন একটা স্বভাবের সমুদ্র রচনা করিয়া লইতে হয়, রাগরাগিনীগুলি যেন সেই সমুদ্রের বক্ষে ঊর্মিমালার ন্যায় – তাহা হইতেই ওঠে, তাহাতে মিলাইয়া যায়।’ অন্যদিকে বিলিতি গানের সুরগুলি ‘যেন হাউয়ের মতো একেবারে ঊর্ধ্বে উঠিয়া চলিয়া যায় এবং সেখানে অগ্নিস্ফুলিঙ্গরাশি প্রক্ষিপ্ত করিয়া শূন্যমার্গেই নিভিয়া যায়।’

লক্ষণীয়, দ্বিজেন্দ্রলাল বিদেশি সংগীত থেকে আহরণ করেছেন স্বতঃস্পন্দিত দীপ্তিভরা জৌলুস, অর্থাৎ দুরন্ত আবেগদৃপ্ত প্রাণশক্তি। তৎসম শব্দে যাকে বলে – ওজঃ।

দ্বিজেন্দ্রলালের পুত্র দিলীপকুমার রায় সংগীতজ্ঞ ও তাঁর বাবার গান সুন্দরভাবে গাইতে পারতেন। তিনি বলেছেন, ‘দ্বিজেন্দ্রলালই প্রথম আমাদের সংগীতের মধ্যে বৈদেশিক প্রাণশক্তির নিবিড়তার রসদ্যুতি আবাহন করে, ভারতীয় আত্মিক সুরের সঙ্গে বৈদেশিকী ওজঃশক্তির সমন্বয়ে এক অপূর্ব রসের সৃষ্টি করেছিলেন, যার ফলে শুধু যে তাঁর সুরের নানা বৈদেশিকী চলাফেরাকে অচেনা মনে হয় না; তাই নয়, বিদেশিরাও তাঁর সুর শুনে বলতে বাধ্য হয় : এ কী! এ-সব অচিনসুরও যে আমাদের কণ্ঠে সহজেই বসে। এ অত্যুক্তি নয়, আমি এদেশে ও বিদেশে নানা বিদেশিকেই তাঁর গান শিখিয়ে তাদের মনে চমক জাগিয়েছি। একটিমাত্র উদাহরণ দিই : ১৯৫৩ সালে, সানফ্রান্সিস্কোয় এশিয়ান আকাদেমিতে রীতিমতো গান শেখাতাম আমেরিকান ও আরো নানা জাতের জার্মান ছাত্রছাত্রীদের। তাঁরা তাঁর [দ্বিজেন্দ্রলালের] ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ গানটি গাইতে গাইতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। বলত – ‘কী সুন্দর সুর! তাঁর (পিতৃদেবের) ‘যেদিন সুনীল জলধি হইতে’ গানটি বাংলায় গেয়ে  জার্মান ভাষায় গেয়েছি, জার্মানিতেও উচ্ছ্বসিত অভিনন্দন পেয়েছি, গটিংগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে। এ কৃতিত্বের গৌরব আমার প্রাপ্য নয়, প্রাপ্য তাঁর, যিনি এ-সুর রচনা করেছিলেন, ভারতীয় আত্মিক শক্তির সঙ্গে য়ুরোপীয় প্রাণশক্তির সমাহারে।’

রবীন্দ্রনাথের সর্বব্যাপী সংগীতপ্রতিভায় আছে আশ্চর্যমধুর সুর এবং বাণীর  মেলবন্ধন। তিনিও দেশীয় সংগীতের ঐতিহ্যকে 888sport apk download apk latest versionয় মান্য করেও বিদেশি সুরের আশ্চর্য মেলবন্ধন করেছিলেন। অথচ তাঁর সমকালীন সংগীতপ্রতিভা দ্বিজেন্দ্রলাল আপন সুরস্বাতন্ত্র্যে দ্যুতিমান! শুধুমাত্র সুরবৈচিত্র্য সম্বল করেই কবি দ্বিজেন্দ্রলাল খ্যাতিমান নন। তাঁর নাটকের গানের কথায় আছে আশ্চর্য কোমল, সূক্ষ্ম অথচ সুরভিত সুবাসযুক্ত স্বপ্নজগৎ, যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অথচ অধরা। উদাহরণ হিসেবে তাঁর লেখা ভীষ্ম (মৃত্যুর পরে ১৯১৪ সালে প্রকাশিত) নাটকের দ্বিতীয় অঙ্ক ষষ্ঠ দৃশ্যের কথা মনে আসে। স্থান – কাশীরাজের উদ্যানের বহির্ভাগ। কাল – সন্ধ্যা। অম্বিকা ও অম্বালিকার কণ্ঠে শোনা যায় গান –

আমরা – মলয় বাতাসে ভেসে যাবো

শুধু কুসুমের মধু করিব পান;

ঘুমোবো কেতকী সুবাস শয়নে

চাঁদের কিরণে করিব স্নান।

888sport app download apk করিবে আমারে বীজন

প্রেম করিবে স্বপ্নসৃজন,

স্বর্গের পরী হবে সহচরী,

দেবতা করিবে হৃদয়দান।

সন্ধ্যার  মেঘে করিব দুকূল, ইন্দ্রধনুরে চন্দ্রহার

তারায় করিব কর্ণের দুল

জড়াবো গায়েতে অন্ধকার।

বাষ্পের সনে আকাশে উঠিব

বৃষ্টির সনে ধরায় লুটিব

সিন্ধুর সনে সাগরে ছুটিব

ঝঞ্ঝার সনে গাহিব গান।

 

অথবা, নূরজাহান নাটকের চতুর্থ অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্য। স্থান – নূরজাহানের কক্ষ। কাল – রাত্রি। নূরজাহান একাকিনী দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ জাহাঙ্গীরের প্রবেশ। জাহাঙ্গীর বলেন, ‘তোমার সাম্রাজ্য তুমি শাসন কর প্রিয়ে! এখন নিয়ে এসো আমার সাম্রাজ্য – সুরা, সৌন্দর্য, সংগীত।’

শুরু হলো বাদ্যযন্ত্রের মধুর ধ্বনি। নূরজাহান স্বহস্তে সুরা ঢেলে জাহাঙ্গীরকে দিলেন। তারপর সুরাপানরত জাহাঙ্গীর বলেন, ‘সংগীত – যার গান যেন একটা পিপাসা; উল্লাস যেন একটা আক্ষেপ; হাস্য যেন একটা হাহাকার; আলিঙ্গন যেন একখানা ছোরা; অমৃত যেন সে গরল!… গাও আবার গাও।’ নর্তকীরা শুরু করে নৃত্যগীত –

আমরা এমনই এসে ভেসে যাই –

আলোর মতন, হাসির মতন,

কুসুমগন্ধরাশির মতন,

হাওয়ার মতন, নেশার মতন

ঢেউয়ের মতো ভেসে যাই।

আমরা অরুণ-কনক কিরণে চড়িয়া নামি;

আমরা সান্ধ্য রবির কিরণে অস্তগামী;

আমরা শরৎ ইন্দ্রধনুর বরণে

জ্যোৎস্নার মতো চকিত চরণে,

চপলার মতো চকিত চমকে

চাহিয়া, ক্ষণিক হেসে যাই।

আমরা স্নিগ্ধ, কান্ড, শান্তি-সুপ্তিভরা

আমরা আসি বটে, তবু কাহারে দিই না ধরা

আমরা শ্যামলে শিশিরে গগনের নীলে

গানে, সুগন্ধে, কিরণে-নিখিলে

স্বপ্নরাজ্য হতে এসে, ভেসে

স্বপ্নরাজ্য দেশে যাই।

উদ্ধৃত দুটি গানের  বাণীচয়নে আছে পেলব মধুর, সুরেলা ধ্বনিযুক্ত মায়াবী-স্বপ্নিল জগৎ। সেই fantasy রবীন্দ্রনাথের কবিকল্পনা থেকে স্বতন্ত্রতর। এই স্বপ্নমায়ার জগতের সঙ্গে কিট্স, শেলি বা সুইনবার্নের ইন্দ্রিয়মধুর 888sport app download apkর তুলনা করা যেতে পারে। লক্ষণীয়, এধরনের শব্দচয়ন অতুলপ্রসাদ সেন  বা রজনীকান্ত সেনের সংগীতে দুষ্প্রাপ্য।

রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান আলোয়-ভরা ব্যথার শতদল! সেখানে আছে গহিন গোপন মনের বিচিত্র মায়া, রজনীগন্ধা বা চাঁপার সুবাসিত বর্ণালিম্পন, অথচ সেখানে নেই শরীরী কামনার ঘূর্ণিঝড়! তাঁর বিরহের বীণাপাণি অশ্রু-কমলিকার পেলব পাপড়িতে বেদনার অচিন রাগিনী জাগায়! অথচ দ্বিজেন্দ্রলালের প্রেমের গানে মলয় পবনের স্নিগ্ধ আবেশে কুসুমের মধুপানের বাসনা, চাঁদের কিরণে অবগাহন ও কেতকী সুবাসে শয়নস্বপ্নের পাশাপাশি আছে অতুলপ্রসাদ বা নজরুল ইসলামের কিছু গানের শরীরী-সন্তাপযুক্ত বিরহের প্রবল আর্তি!

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সার্ধশতজন্মবর্ষে প্রকাশিত হয়েছে বাংলা 888sport live footballে একটি উল্লেখযোগ্য সংকলন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রেমের গান, প্রকাশক : অভিযান পাবলিশার্স। দ্বিজেন্দ্রগীতির আলোকদিশারি 888sport live chatী নূপুরছন্দা ঘোষ। তাঁর সক্রিয় সহযোগিতায় উক্ত সংকলনে যুক্ত হয়েছে একগুচ্ছ জনপ্রিয় দ্বিজেন্দ্রগীতির প্রামাণ্য স্বরলিপি। দ্বিজেন্দ্রলালের জীবন, 888sport live football ও সংগীতপ্রতিভা সম্পর্কে নানা পর্বে বিভক্ত বিস্তীর্ণ আলোচনা গ্রন্থটিকে উৎসাহী নর888sport promo codeদের মনস্ক করেছে।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সমকালীন নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদের (১৮৬৩-১৯২৭) নাট্যকৃতির কথা এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে। কলকাতা স্কটিশ চার্চ কলেজের (তৎকালীন নাম জেনারেল অ্যাসেম্ব্লিজ ইনস্টিটিউশন) রসায়নের অধ্যাপক (১৮৯২-১৯০৩) থেকে পুরোপুরি পেশাদারি নাট্যকার। তাঁর লেখা ৪৯টি নাটক। অনেকগুলি নাটক কলকাতার স্টার-মিনার্ভা-রয়েলবেঙ্গল-কোহিনুর প্রভৃতি থিয়েটারে একদা অভিনীত হয়েছে। বিখ্যাত অভিনেতা শিশির কুমার ভাদুড়িও অভিনয় করেছেন তাঁর লেখা নাটকে। অথচ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতন পাশ্চাত্যশিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক মন তাঁর ছিল না। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতন শেক্সপিয়র নাটকের চারিত্রিক জটিলতাকৌশল ও জার্মান নাট্যকার শিলারের মতন আবেগদৃপ্ত বাগরীতি তাঁর অনায়ত্ত থাকায় কালজয়ী 888sport live footballখ্যাতির তিনি অধিকারী হতে পারেননি।

সংগীতস্রষ্টা দ্বিজেনদ্রলালের অনন্যসাধারণ কালজয়ী সংগীতঘরানা তাঁর বিশাল নাট্যপ্রতিভার থেকে অধিকতর সমুজ্জ্বল, এরকম ভাবনা প্রায়শই  মনে জাগে। r