নজরুল-সান্নিধ্যে : চুরুলিয়া ও পশ্চিমবঙ্গে

শান্তনু কায়সার

নজরুলকে লেখা চিঠিতে একবার রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘আমরা আছি তোমাদের পাশের জেলাতেই।’ শান্তিনিকেতন থেকে লেখা এ-চিঠিতে তিনি নজরুলের জন্মভূমির প্রতি ইঙ্গিত করেছিলেন। শান্তিনিকেতন বীরভূম জেলায় আর তার পাশের জেলা বর্ধমানে নজরুলের জন্মস্থান চুরুলিয়া। এর আগে শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীতে গেলেও চুরুলিয়া যাইনি। তাই এবার ২৫ জানুয়ারি (২০১৩) থেকে অনুষ্ঠেয় কলকাতা পুস্তকমেলায় যোগদানের জন্য ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় কলকাতায় পৌঁছে ভাবি, পুস্তকমেলা উদ্বোধনের পর ১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় শামসুদ্দীন আবুল কালামের ওপর সেমিনারে অংশ নেওয়ার আগে একবার চুরুলিয়া যেতে হবে। সকলেই জানেন, কলকাতা পুস্তকমেলা, ২০১৩-এর থিম কান্ট্রি ছিল 888sport apps এবং মেলা উদ্বোধন করেন 888sport appsের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী আনিসুজ্জামান।

সেভাবে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহের শেষদিকে চুরুলিয়া পৌঁছাই। আসানসোল রেলস্টেশনে আমাকে নেওয়ার জন্য উপস্থিত ছিলেন একটি কলেজের তরুণ প্রভাষক আবিদ হাসান। তরুণ লেখক হিসেবে 888sport live footballের খোঁজখবর রাখেন। 888sport appsের 888sport live football নিয়েও তিনি যথেষ্ট উৎসাহী ও অনুসন্ধিৎসু। তাঁর সঙ্গে চুরুলিয়া পৌঁছাই। আসানসোল থেকে চুরুলিয়ার যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনো ভালো নয়। বাস ছাড়া সেখানে যাওয়া-আসার সাধারণভাবে তেমন ভালো ব্যবস্থা নেই। ফলে ফেরার সময় চুরুলিয়ার কাছাকাছি বাস স্টপেজে আমাদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। চুরুলিয়া আসার পথে তার আগে রয়েছে নজরুলের নামাঙ্কিত কলেজ। উচ্চমাধ্যমিক ও সাধারণ স্নাতক পাঠের ব্যবস্থা রয়েছে এ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

নজরুলের জন্মস্থানের এলাকায় রয়েছে ‘কবিতীর্থ চুরুলিয়া নজরুল বিদ্যাপীঠ’। নজরুলের জন্মের আগে ১৮৭০ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে ভিন্ন নামে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। নজরুলের নাম এর সঙ্গে যুক্ত হয় ১৯৭৫-এ এবং  সরকারি অনুমোদন লাভ করে ১৯৮৬-তে। নজরুলের নিজেদের বাড়ি এখন ‘কাব্যালয়’। এতে নজরুলের নানা 888sport sign up bonus রয়েছে। এই বাড়ির অনতিদূরে এবং কবিতীর্থ নজরুল বিদ্যালয়ের একেবারে কাছেই অবস্থিত নজরুল 888sport sign up bonusসৌধ। এখানে রয়েছে প্রমীলা নজরুল ইসলামের কবর। তাঁর মৃত্যুর আগে ব্যক্ত কবিপত্নীর ইচ্ছানুসারেই তাঁকে এখানে সমাধিস্থ করা হয়। কবির সমাধি 888sport app বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হওয়ায় তাঁর কবরের মাটি এনে প্রমীলার কবরের পাশেই নজরুলের একটি প্রতীক-সমাধি তৈরি করা হয়। 888sport sign up bonusসৌধের তোরণে উৎকীর্ণ হয়েছে কবির ‘এ মোর অহঙ্কার’ 888sport app download apkর পঙ্ক্তিদ্বয় :

যেদিন আমি থাকব না ক, থাকবে আমার গান

বলবে সবাই, ‘কে সে কবির কাঁদিয়েছিল প্রাণ।’

কবিতীর্থ চুরুলিয়া নজরুল বিদ্যালয়ের দেয়ালে রয়েছে সাম্যবাদীর অন্তর্ভুক্ত ‘মানুষ’ 888sport app download apkর  অমর দুই পঙ্ক্তি, ‘গাহি সাম্যের গান -/ মানুষের  চেয়ে বড়ো কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।’ তার নিচে উদ্ধৃত হয়েছে ‘ছাত্রদলের গানে’র কয়েক পঙ্ক্তি। বিদ্যালয়ের কাছেই রয়েছে ‘প্রমীলা মঞ্চ’। এখানে নজরুলজয়ন্তী তো বটেই, নানা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষগুলোও নানা নামে চিহ্নিত। যেমন রবীন্দ্র কক্ষ, বিবেকানন্দ কক্ষ অথবা প্রমীলা-নজরুল কক্ষ।

চুরুলিয়া থেকে ফেরার আগে ভালো করে দেখে নিই হাজী পালোয়ানের মাজার, তার পাশের পুকুর এবং নজরুল যে-মসজিদে ইমামতি করতেন তার বর্তমান রূপ। রুক্ষ লাল মাটির চুরুলিয়ায় হাজী পালোয়ানের মাজারের পাশের পুকুরটিকে দেখে ভুলে যেতে হয় এ-অঞ্চলের মাটির রুক্ষতার কথা। এর টলটলে জল যেন নজরুল-হৃদয়ের শ্যামলিমার কথাই মনে করিয়ে দেয়।

চুরুলিয়া থেকে কলকাতায় ফিরে ভাবি, পশ্চিমবঙ্গের আর কোথায় নজরুলের 888sport sign up bonus রয়েছে। মনে পড়ে, ২০১১-তে বালিগঞ্জ থেকে ব্যারাকপুর যাওয়ার পথে দেখেছিলাম কাজী নজরুল ইসলাম সড়ক। কিন্তু ২০১৩-তে কলকাতা পুস্তকমেলায় সেমিনারে যোগদান শেষে ৫ ফেব্রুয়ারি 888sport appsে ফিরে আসার  ফলে নজরুল888sport sign up bonusর অনেককিছুই দেখতে পাইনি। কিন্তু আবার ৭ এপ্রিল অনুষ্ঠেয় নদীয়ার করিমপুরে প্রান্তিক আন্তর্জাতিক 888sport app download apk উৎসবে যোগ দিতে তার দুদিন আগে ৫ তারিখ সন্ধ্যায় কলকাতা পৌঁছে মনে হয়, নজরুল 888sport sign up bonusচিহ্নিত জায়গাগুলো আবারো একটু খুঁজে দেখা যেতে পারে। সেভাবে ওই উৎসবে যোগ দেওয়ার পর ৮ তারিখে কলকাতা ফিরে এ-কাজে সামান্য মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করি।

তার আগে নজরুলের 888sport sign up bonusচিহ্নিত কৃষ্ণনগর শহরটা যাওয়া-আসার পথে খানিকটা ঘুরে দেখি। সময়ের স্বল্পতার জন্য নজরুল-চিহ্নিত জায়গাগুলো শনাক্ত করা সম্ভব না হলেও ঐতিহ্যবাহী এ-শহরে নজরুলকে উপলব্ধি করি। এ-জেলার নবদ্বীপে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব এবং সেখানে তাঁর অবস্থান ও কর্ম শুধু বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ের নয়, সাধারণভাবে সাংস্কৃতিক তাৎপর্যেরও বিষয়। বিশেষত নজরুল এই উত্তরাধিকারকে সাংস্কৃতিকভাবে উপলব্ধিই শুরু করেননি, তাঁর 888sport live footballে একে তিনি উপযুক্ত মাত্রায় আত্মস্থ ও ব্যবহারও করেছেন। প্রতিক্রিয়াপন্থী ও রক্ষণশীল সম্প্রদায় একে যত ভ্রান্তভাবেই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে থাকুক, নজরুল কখনো স্বধর্মচ্যুত হননি।

কলকাতা থেকে কৃষ্ণনগরের যতটা দূরত্ব, কৃষ্ণনগর থেকে তার সমান কিংবা তার চেয়ে বেশি দূরত্বের করিমপুরে গিয়ে দেখি, সেখানকার গ্রাম পঞ্চায়েত রাস্তার পাশে নজরুলের একটি আবক্ষমূর্তি স্থাপন করেছে। প্রায় গ্রামবাংলায় নজরুলের চেতনা ও ভাবমূর্তি কতটা উজ্জ্বল এ-ঘটনা তার একটা দৃষ্টান্ত।

কলকাতায় ফিরে মেট্রো রেলে একদিকের প্রান্তিক স্টেশনে যেতে গিয়ে দেখি, তার একটি স্টেশনের নাম ‘কবি নজরুল’। ১৯২১-এ কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেনের দোতলা বাড়ির নিচতলার একটি ঘরে ‘বিদ্রোহী’ 888sport app download apk রচিত হয়। মৌলালি থেকে ধর্মতলার দিকে যেতে পড়ে এই বাড়ি। তখনকার ত্রিপুরা জেলার পশ্চিমগাঁওর নবাব ফয়েজুন্নেসার দৌহিত্ররা পুরো বাড়িটি ভাড়া নিয়েছিলেন। পরে মুজফ্ফর আহমদ এর নিচের একটা অংশ সাবলেট নেন। সেখানে তাঁর সহভাড়াটে হয়ে নজরুল রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত 888sport app download apk। এখন সেখানে এবিষয়ক একটি স্মারকচিহ্ন স্থাপন করা হয়েছে।

মির্জাপুর স্ট্রিটে যেখানে একসময় বঙ্গীয় মুসলমান 888sport live football সমিতির দফতর ছিল সেখানে এখন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘নজরুল পাঠাগার’। কলেজ স্ট্রিটে রয়েছে ‘ফেভারিট কেবিন’। ১৯১৮-তে প্রতিষ্ঠিত এই কেবিনে আড্ডা দিতে আসতেন নজরুল ও তাঁর বন্ধুরা। কেবিনটি এখনো চালু আছে। তবে তা যথেষ্ট জরাজীর্ণ। কেবিনের বর্তমান মালিক জানান, তাঁর বাবা সেসব মানুষের 888sport sign up bonusচারণ করতেন। দেয়ালে টানানো রয়েছে নজরুলের ফটোগ্রাফ।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ সংগৃহীত 888sport free bet login যে-গ্রন্থাগারে দেওয়া হয়েছে সেই রামমোহন লাইব্রেরিতে নজরুলের গ্রন্থাবলি রয়েছে তো বটেই তার প্রতি বিশেষ সম্মান দেখানোর জন্য একটি আলমারির কাচের ভেতরে রক্ষিত হয়েছে কবির প্রতিকৃতি।

কলকাতার নানা জায়গায় বিভিন্ন মনীষী ও বিশিষ্টজনের বাণী উদ্ধৃত হয়েছে। কলকাতা পৌর সংস্থার ব্যবস্থাপনায় এক্ষেত্রে নজরুলের 888sport app download apkংশও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। উদাহরণ হিসেবে চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে মোহাম্মদ আলী পার্কের কাছে কবির ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ 888sport app download apk দুটি পঙ্ক্তির কথা বলা যায়।

 

দুই

কিন্তু এক্ষেত্রে একটি বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করা দরকার। সকলেই জানেন, ১৯২৯-এর ১৫ ডিসেম্বর মাত্র ৩০ বছর বয়সে নজরুলকে বাংলার সারস্বত সমাজ কলকাতার অ্যালবার্ট হলে এক সংবর্ধনা দেয়। এই বিরল সম্মান রবীন্দ্রনাথ ওই বয়সে তো নয়ই, পরেও পাননি। 888sport apkী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সভাপতিত্বে এই সংবর্ধনা সভায় বক্তব্য রাখেন সুভাষচন্দ্র বসু। অভিনন্দনপত্র পাঠ করেন এস ওয়াজেদ আলী। তাতে বলা হয়, ‘তোমার অসাধারণ প্রতিভার অপূর্ব অবদানে বাঙালিকে চিরঋণী করিয়াছ তুমি। আজ তাহাদের কৃতজ্ঞতাসিক্ত সশ্রদ্ধ অভিনন্দন গ্রহণ কর।’ সেখানে আরও বলা হয়, ‘বাঙালির ক্ষীণকণ্ঠে তুমি তেজ দিয়াছ।’

এই সংবর্ধনাসভায় সুভাষচন্দ্র বসু বলেন, ‘আমরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে যাব তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান গাওয়া হবে, আমরা যখন কারাগারে যাব তখনও তার গান গাইব।’ তিনি আরো বলেন, ‘বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় জাতীয়সংগীত শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। কিন্তু নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’র মতো প্রাণ-মাতানো গান কোথাও শুনেছি বলে মনে হয় না।’ সভাপতির ভাষণে প্রফুল্লচন্দ্র রায় ফরাসি বিপ্লবের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, সে-সময়ের প্রত্যেক মানুষ অতিমানুষে পরিণত হয়েছিল। তিনি মনে করেন, ‘আমার বিশ্বাস, নজরুল ইসলামের 888sport app download apkপাঠে আমাদের ভাবী বংশধরেরা এক একটি অতিমানুষে পরিণত হইবে।’

এই সংবর্ধনার উত্তরে নজরুল বলেছিলেন, ‘আমায় অভিনন্দিত আপনারা সেদিনই করেছেন যেদিন আমার লেখা আপনাদের ভালো লেগেছে।’ সেই ভাষণে তিনি আরো বলেছিলেন, নিন্দা ও প্রশংসার পরস্পরবিরোধ ভারসাম্যে তিনি ‘ঠিক’ থেকে গেছেন এবং তাঁকে ‘এতটুকু টলতে হয়নি’। ‘বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনার যুগে জন্মগ্রহণ’ করে তিনি তাকে যে সার্থক করতে চেয়েছেন তা একবিংশ শতাব্দীর উত্তরপ্রজন্মের জন্যও অনুসরণযোগ্য। যে-কুল, যে-সমাজ, যে-ধর্মে তিনি জন্মগ্রহণ করে থাকুন, তাকে ছাড়িয়ে ওঠার মধ্যেই তাঁর কবিসত্তা ও পরিচয়ের সার্থকতা। শুধু সুন্দরকেই যে তিনি দেখেছেন তা নয়, ক্ষুধাদীর্ণ মূর্তিকেও তিনি দেখেছেন। 888sport apps ও এই উপমহাদেশের এত উন্নতি সত্ত্বেও মৌলিকভাবে একে মিথ্যে প্রমাণ করতেও আমরা পারিনি।

নজরুলকে সংবর্ধনা দেওয়ার সেই অ্যালবার্ট হল, কলকাতার কলেজ স্ট্রিট পাড়ার বর্তমান কফি হাউসে বসে গত ১২ এপ্রিল সন্ধ্যায় বুলবুল আহমেদ, জাহাঙ্গীর হোসেন, পুষ্পাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিজিৎ মিত্র, তারিক কাজী প্রমুখের সঙ্গে যখন আড্ডা দিচ্ছি তখন ১৯২৯-এর নজরুলকে স্বীকৃতি দেওয়া সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তগুলির কথা মনে পড়ছিল। যে-কফি হাউসে বসে একসময় নির্মাল্য আচার্য এক্ষণের প্রুফ দেখতেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ আড্ডা দিতেন এবং এখনো যেখানে ১৮-১৯ বছরের তরুণ-তরুণী থেকে ৮০ বছর বয়স্করা পর্যন্ত আড্ডা দেন এবং তুমুল তর্কে মেতে ওঠেন; সেখানে কিন্তু ১৯২৯-এর ১৫ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক ঘটনার কোনো স্মারক নেই। তখনকার অ্যালবার্ট হল, যা এখনকার কফি হাউস তা কিন্তু অসচেতন বা নির্লিপ্ত নয়। গত ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের যে ঢেউ পশ্চিমবঙ্গেও ছড়িয়েছে তার প্রকাশ কিন্তু কলকাতার 888sport app জায়গার মতো কফি হাউসেও দেখেছি। এখানে ঢোকার মুখেই চোখে পড়ে ‘সমুদ্যত শাহবাগে’র পোস্টার, ১২ এপ্রিল সন্ধ্যায় যা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

তাহলে নজরুল-888sport sign up bonus ও তাঁর ঐতিহাসিক ঘটনার বিষয়ে কেন এই বি888sport sign up bonus? কফি হাউসে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের এক বিশাল প্রতিকৃতি। নজরুল যেমন ‘আমার কৈফিয়তে’ বলেছেন, ‘মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি’, তাতে ব্যাপারটা খুবই সংগত হয়েছে। কিন্তু তাই বলে যে-জায়গায় ঐতিহাসিক ওই ঘটনা ঘটেছে সেখানে তার কোনো স্মারক থাকবে না? কলকাতা তথা বাংলা ভাষাভাষী পশ্চিমবঙ্গবাসীর বিষয়টি ভেবে দেখে এ-বিষয়ে অবিলম্বে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলে মনে করি।

 

তিন

এটা একটা ঘটনা যে আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্য দিয়ে গিয়েছি এবং আমাদের পূর্বজরাই ছেচল্লিশের সাধারণ নির্বাচনে তার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই বুঝেছিলাম যে, আমরা প্রতারিত হয়েছি। জিন্নাহর ভাষা-সম্পর্কিত তথাকথিত নীতি যেমন আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল, তেমনি ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্র জাতিগত আমাদের বাস্তব পরিচয়কে শনাক্ত করার ঘটনাও তা বুঝতে সাহায্য করেছে। কিন্তু বিষয়টি বিভাগ-পূর্বকালেই বুঝেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। জীবনের প্রথম পর্বে তিনি যেমন নবযুগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, তেমনি শেষ পর্বেও এ-পত্রিকা বা তখনকার দৈনিকে প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন। পত্রিকা প্রকাশে তাঁর স্বত্বাধিকারী এ. কে. ফজলুল হকের উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম লীগের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব-বিরোধের পত্রিকাটিকে তার বাতিঘর হিসেবে ব্যবহার করা। কিন্তু কবি চেয়েছিলেন তাঁর বিশ্বাসকে প্রকাশ করতে এবং পাকিস্তান যে বাঙালি মুসলমানের কল্যাণ করবে না  সে-কথা বলতে।

১৯৪১-এ প্রকাশিত দৈনিক নবযুগের সূচনা 888sport free betয় ‘নবযুগের সাধনা’ শীর্ষক স্বাক্ষরিত রচনায় পুকুর ও নদীর তুলনামূলক আলোচনা করে তিনি যা বলেন তাতে ভারত ও বঙ্গবিভক্তির বিরুদ্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ক্ষুদ্রত্বের বন্ধনে বাঁধা থাকিলে জীবন, যৌবন ও কর্মের শক্তি ক্ষুদ্র হইয়া যায়। পুকুরের জল গ্রামের কল্যাণ করে; কিন্তু সংক্রামক রোগের একটি বীজাণু পড়িলেই সে জল দূষিত ও অপেয় হইয়া যায়। কেননা, পুকুরের জলের চারিধারে বন্ধন, তার বিস্তৃতি নাই, গতি নাই, প্রবাহ নাই। নদীর জলের চারিধারেও বন্ধন, এক ধারে পাহাড়, একধারে সমুদ্র, দুই পারে কূল। কিন্তু তার বিস্তৃতি আছে, তাই গতি ও প্রবাহ নিত্যসঙ্গী। এই প্রবাহের জন্যই নদীর জলে নিত্য শত রোগের বীজাণু পড়িলেও তাহা অশুদ্ধ হয় না, অব্যবহার্য হয় না।… নদীর তৃষ্ণা সমুদ্রের দিকে…। অসীম সমুদ্রকে পাইয়াও… দেশকে সে স্বীকার করে, তা কক্ষচ্যুত হয় না।’

নবযুগের ১৩৪৯-এর ৩রা বৈশাখ 888sport free betয় ‘বাঙালি বাঙলা’ 888sport liveে নজরুল এর উপসংহারে লিখেছেন, ‘বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক। বাঙালির জয় হোক।’ খ্রিষ্টাব্দ হিসেবে তা হচ্ছে ১৯৪২-এর এপ্রিলের দ্বিতীয় পক্ষের শুরু। ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাব-পরবর্তী এ-সময়ে বাঙালি মুসলমান যখন পাকিস্তানি জ্বরে আক্রান্ত, তখন নজরুলের এই উদাহরণ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতবাহী। এই পর্বের নবযুগ মূলত পাকিস্তানকে অগ্রাহ্য করার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে।

তারও আগে ১৯৪১-এ নবযুগে প্রকাশিত ‘আমার লীগ কংগ্রেস’ 888sport liveে নিজেকে ‘মুসলিম লীগ বিদ্বেষী’ হিসেবে অস্বীকার করেও নজরুল ইসলাম সত্যোচ্চারণে দৃঢ় থেকেছেন। বলেছেন, লীগ কংগ্রেসের চেয়েও তাঁর কাছে বড় সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ব ও সর্বমানুষের মুক্তি। বলেছেন, ‘লীগ’ কেন, ‘কংগ্রেস’কেও আমি কোনোদিন স্বীকার করিনি।’ কারণ, ‘কংগ্রেসও ছিল বুরোক্রেসির অঙ্গ।’ তা এমন দূরত্ব তৈরি করেছে যে, জমিদারের জমি যখন নিলামে, তখনো ‘সে প্রজার হাত ধরিবে না’। অন্যদিকে মুসলিম লীগ ‘নিজেদের যে রাজত্ব’ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল নজরুলের বিবেচনায় তা ছিল ‘শয়তানে’র রাজত্ব। সংগত কারণেই কবির তাতে সায় ছিল না। ১৯৩৮-এ কলকাতার কৃষক পত্রিকার অফিসগৃহে জন 888sport live football সংসদের উদ্বোধন উপলক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি যে বলেছিলেন, কওমের জন্য চিৎকার করতে করতে কওমের নেতারা হয়ে যাচ্ছেন মন্ত্রী আর জনগণের জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে করতে বনে যাচ্ছেন জমিদার এবং কওম যখন হয়ে যাচ্ছে দরিদ্রতর, তখন গড়ে উঠছে নেতাদের দালান-ইমারত, তা নিশ্চিতই ছিল মুসলিম লীগ নেতৃত্বের প্রতি স্পষ্ট ইঙ্গিত।

ফলে কলকাতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে নবযুগ সম্মাদনা করতে গিয়ে কবি পাকিস্তান প্রত্যয়ের যে বিরোধিতা শুরু করেছিলেন, যদিও নিজের অসুস্থতার কারণে সে-পথে তিনি বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি, তাকে বুঝতে ও সে-পথে এগোতে আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

অতএব নজরুলের কলকাতা-জীবন, তার শেষ পর্ব ভবিষ্যৎ দেখতে ও তা নির্ধারণে আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। পরবর্তীকালে ১৯৭১-এ কলকাতায়ই যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তার আনুষ্ঠানিক সম্প্রচারের জন্য আমরা কবির জন্মদিন ১১ জ্যৈষ্ঠকে বেছে নিই।

২০১৩-এর এপ্রিলে কলকাতা গিয়ে তাঁর জন্মদিনের কিছুদিন আগে কবির মর্মের সান্নিধ্য পেতে পেতে মনে হয়, তিনি আমাদের আত্মীয় ও সহযোদ্ধাই বটেন।