নজরুল : সিন্ধুর তিন তরঙ্গ

বেগম আকতার কামাল

888sport app download apkই বৃক্ষলতাফুলফল, নদী-সমুদ্র, আকাশ-বাতাসের সঙ্গে মানবিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। আর সেটা করে উপমা-রূপকের অলংকরণে। বস্ত্তপৃথিবীর সঙ্গে এরকম সম্পর্ক তৈরির মধ্য দিয়েই ধরা দেয় অতীন্দ্রিয় জগৎ, ইন্দ্রিয়বিশ্বের সঙ্গে রচনা করে মানবিক সম্বন্ধ। সৌন্দর্য বস্ত্ততে নেই, তা তৈরি করে আমাদের ইন্দ্রিয়াদি এবং 888sport app download apkর শব্দছন্দ। গোলাপ সুন্দর বলেই তা সুন্দর নয়, এই সৌন্দর্য রচনা করে 888sport app download apk, অন্যথায় বস্ত্তজগৎ নিরপেক্ষ মাত্র, ইন্দ্রিয় দিয়ে এরকম অতীন্দ্রিয় সম্পর্ক গড়া হলেই বস্ত্ত প্রাণ পায়, সৌন্দর্যায়িত হয়। মানুষ অনবরত প্রকৃতিকে humanization করে চলেছে; সৌন্দর্যে বিম–ত করছে শৈল্পিক দৃষ্টি দিয়ে। কাজেই 888sport live chatিত দৃষ্টিনিয়নদীপই কাব্যসৌন্দর্য নির্মাণ করে বাস্তবতা গড়ে দেয়। আমরা জেনে যাই যে, গোলাপ সুন্দর; পাখির ডাক মধুর। নদী-সমুদ্রের ঢেউ হয় আমাদের চিত্তের বিচিত্র তরঙ্গলীলা। রবীন্দ্রনাথ সোনার তরী কাব্যে ‘সমুদ্রের প্রতি’ বা ‘বসুন্ধরা’ 888sport app download apkয় নিজের আত্মিক বন্ধন খুঁজে পান সমুদ্রের সঙ্গে।  পৃথিবী সমুদ্রের আন্তজা আর তিনি বসুন্ধরার সন্তান, আর তাই সমুদ্রজলের সঙ্গে তাঁর রয়েছে নাড়ির অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আমাদের দেহের লবণের ভাগ আর হৃদস্পন্দনের তালে সমুদ্রজলধ্বনির সমতা রয়েছে। অগাধ জলরাশি, দিগন্তছোঁয়া অসীম বিস্তার নিয়ে কবিদের ছন্দগাথার শেষ নেই।

রোমান্টিক কবিরা আবিষ্কার করেছিলেন বিষাদ-বিষণ্ণতা-বিরহের অতলগভীর রহস্যময়তা। বিষাদেই তাঁরা খুঁজেছেন সৌন্দর্যের লাবণ্য। সমুদ্রোত্থিতা উর্বশী মানবিক সম্পর্ক-বিরহিত, অধরা eternal beauty, ‘বত্তিচেলির ভেনাস বিষাদময়ী’ অর্মত্য মুখশ্রীতে লাবণ্যমাখা। এটাই কাব্যসত্য আর বাস্তবতার বিনিময়। এই কাব্যসত্যের সঙ্গেই চিত্তজগতের আলো-বাতাস, শিকড় লতাবৃক্ষের অতীন্দ্রিয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে। নজরুলের ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ 888sport app download apkয় তিনটি তরঙ্গে ঢেউয়ের অবিরাম গর্জন-আলোড়ন-অস্থিরতার সঙ্গে একীভূত হয়ে গেছে কবির বিক্ষোভ-বেদনা-উত্তাল দুঃখ-দ্রোহের ছন্দ। ইউরোপীয় রোমান্টিসিজমের প্রেরণা ও প্রভাব থাকলেও রবীন্দ্রনাথের মনোগঠন, ঐতিহ্যিক সংস্কার, দেশকালপরিপ্রেক্ষেত তাঁর রোমান্টিসিজমে সঞ্চার করেছে অতীন্দ্রিয় স্পর্শ, সর্বপ্রাণবাদ ও সীমা-অসীমের লীলাদৌত্য, যা তাঁর বোধিও বটে। নজরুলের মধ্যে বঙ্গীয় লোকায়ত দেহবাদের প্রাধান্য আর ভারতীয় ঐতিহ্যের শক্তিতত্ত্বের প্রভাব রয়েছে। একইসঙ্গে ইন্দ্রিয়ময় দেহ ও শক্তিসাধনা নজরুলের আধেয়। কারণ তিনি তাঁর রোমান্টিসিজমকে ধারণ ও বহন করেছেন ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে আর নিজে নিয়েছেন বি-উপনিবেশবাদীর ভূমিকা। আমেরিকার তুরীয়বাদী (transcendentalist) গোষ্ঠীর মতো তিনিও ধর্ম ও সমাজকে প্রত্যাঘাত করেন, ঔপনিবেশিক প্রভুত্ববাদকে ধ্বংসকরণে হয়ে ওঠেন বিধ্বংসী শক্তি। আরেক মাত্রায় তাঁর প্রেমসত্তা, যা রোমান্টিসিজমের মৌল, তাতে তীব্র জ্বালাময়ী ক্রন্দন, ব্যথাহত বেদনার ধারক। এই দ্রোহশক্তি ও বিধুর বেদনা – দুইয়ের সম্মিলন ঘটেছে তাঁর 888sport app download apkয়, গল্পে-888sport alternative linkে। প্রভুত্ববাদের বিরুদ্ধে তাঁর দ্রোহশক্তি যেমন কোনো রূপক-প্রতীকের ছদ্মবেশ নেয়নি, তা প্রত্যক্ষ ও সরাসরি, তেমনি তাঁর বিষাদ-বেদনাও দেহকে ছাড়িয়ে অতীন্দ্রিয়লোকে উত্তরণ করেনি। তাই বলা চলে নজরুলের রোমান্টিসজম একান্তই পার্থিব।

নজরুলের ‘সিন্ধু’ 888sport app download apkর তিনটি তরঙ্গ তিন বিচিত্র আঙ্গিকে সমুদ্র ও কবিচিত্তকে রূপান্বিত করেছে। পুরুষরূপে কল্পনা করে সমুদ্র প্রতিমাকে তিনি সমাসোক্তি-অলংকারে বিভূষিত করেছেন। কবির চিত্তগহনের যে-অগাধ বিস্তার, বিরহ-বিচ্ছেদের যে-অতলতা তার যথার্থ প্রতিভূ সমুদ্রের বিক্ষুব্ধ জলরাশি, তাই ‘সিন্ধু’ তাঁর ‘বন্ধু’ – সখা। নজরুল মানসিকতার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁর অতৃপ্তি ও তজ্জনিত ক্ষোভ। তাঁর যা কিছু যন্ত্রণা, রক্তক্ষরণ সবই বিক্ষুব্ধ  আবার অশ্রম্নসজলও। এবং চিরবিরহী – যেমনটি অশান্ত সমুদ্র। বিরামহীন তরঙ্গায়নের উদ্বেলিত রূপ নিয়ে সমুদ্রের যে আলোড়ন-বিলোড়ন তা যেমন সক্রিয়, চলচঞ্চল – সার্বক্ষণিক, তেমনি তার বেদনাও পরিপূর্ণ ও চঞ্চল। অব্যক্ত ভাষায় সে যেন তার ব্যথাসিক্ত হৃদয়ের কথা অনবরত বলে যায়। রবীন্দ্রনাথও ‘সমুদ্রের প্রতি’ 888sport app download apkয় অতলগভীর জলধারার অভ্যন্তরে রয়েছে যে বাসনাউদ্বেলতা তাকে দেখেন যেন চিত্তভূমির সার্বক্ষণিক কল্পনা-চিন্তার ওঠানামা রূপে। ব্যাপ্ত হৃদয়ই সমুদ্রের বিস্তারে নিজ মনোজগৎকে রূপান্বিত করে থাকে, নজরুলের চিত্তভূমি যদিও পার্থিব ও রূপজগৎময়ী তবু তাঁর সেই ভূমিকা ছিল কূলহারা অসংযম চাঞ্চল্যে অধীর।

কাজেই সমুদ্রের তরঙ্গ ছাড়া এই মনের উপমান আর কিসের সঙ্গে ঘটতে পারে!

তাই প্রথম তরঙ্গে সখাসুলভ বন্ধুতা নিয়ে সমুদ্রের অব্যক্ত কথার মর্মার্থ বুঝতে চাইছেন। অনন্য আরেকটি রূপকল্পে সমুদ্রের তরঙ্গধ্বনিকে দেখেন, ‘প্রতীক্ষায় চেয়ে আছে  ঊর্ধ্বে নীলা নিম্নে বেলা-ভূমি!/ কথা কও, হে দুরন্ত, বল/ তব বুকে কেন এত ঢেউ জাগে, এত কলকল!’ আমরা স্তব্ধ বিগত অতীতকে কথা কওয়ার মিনতি দেখতে পাই রবীন্দ্র888sport app download apkয়, কিন্তু নজরুলের ‘সিন্ধু’ স্তব্ধ বিগত নয়, এটি বর্তমান,  মুখর। নজরুলের 888sport app download apkয় বা চেতনায় বর্তমানের সত্যতা বা অসিন্তত্ব প্রখর, তিনি বর্তমানেরই কবি হতে চাইতেন, ভবিষ্যতের নবী নয়। এই বর্তমানতা অথচ নিত্যতা ইঙ্গিত করে তাঁর সময়চেতনার স্বরূপকে। চলমান চঞ্চল বর্তমানই তাঁর আধেয়, বর্তমানেই তাঁর ক্ষুব্ধতা ও প্রেমিকতার বসতি। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ – এই ত্রিকালস্পর্শের আকাঙক্ষা থাকে আধুনিক 888sport app download apkয়, এই কবি ঘটমান বর্তমানেই নিজের অসিন্তত্ব ও নান্দনিকতাকে তরঙ্গায়িত করেছেন, নিত্যতার প্রশ্নে দেখি ‘দিবা নাই রাত্রি নাই, অনন্ত ক্রন্দন। থামিল না, বন্ধু-, তব’ – এই  কাব্যাংশে লক্ষ করি সেই নিত্যতাকে যা দৃশ্যমান বাস্তবতার ছবিই তুলে ধরে। এই দৃশ্যমান বাস্তবতা তাঁর 888sport app download apkর আরেকটি বৈশিষ্ট্য।

সমুদ্র পুরুষরূপে আখ্যায়িত, এখানে নিহিত আছে আমাদের সমাজ ও শাব্দিকতার লৈঙ্গিক চিহ্ন – যা কিছু বিরাট তাই পুরুষ। যদিও নজরুলে 888sport promo codeসত্তায় অংশভাগই বেশি, তবু শব্দকল্পকবলিত হয়ে প্রথাগত রূপকে উপমায় সমুদ্রের তরঙ্গকে প্রেমিক পুরুষের ক্রন্দনের সঙ্গে তুলনা করেন। অবশ্য এই কান্না যতই গর্জনমুখর, চঞ্চল-অশান্ত হোক-না কেন তা কিন্তু 888sport promo codeমনের ক্রন্দনশীল রূপটিরই ইঙ্গিত দেয় – যে-ক্রন্দনশীলতা 888sport promo codeর বিশেষ বৈশিষ্ট্যরূপে ভাবা হয়, ভাবা হয়ে আসছে হাজার হাজার বছরজুড়ে। তবে নজরুলের আর্তি ও প্রশ্ন যা সিন্ধুর প্রতি উচ্চারিত, সবটাই যেন 888sport promo codeকণ্ঠের ব্যাকুলতার প্রকাশক। তাঁর 888sport app download apkর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো হাইফেনযুক্ত সমাসবদ্ধ শব্দ ব্যবহার করে, তাতে রূপক অলংকারের দ্যোতনা সৃষ্টি করা। যেমন অগ্নি-বীণা তেমনি এই 888sport app download apkয় – ‘কোন মায়া-মণিকার হেরিছ স্বপন?/ …কেন হল পর/যারে এত বাসিয়াছ ভালো!/ কেন সে আসিল, এসে কেন লুকালো?/ অভিমান করেছে সে?/ মানিনী ঝেঁপেছ-মুখ নিশীথিনী-কেশে?’ নিতান্তই সরল উচ্চারণ কিন্তু আন্তরিকতায় গভীর। ‘ঝেঁপেছ’ – এই ক্রিয়াপদের প্রয়োগেই নজরুলের শব্দনির্মাণের কুশলতা ধরা পড়ে। তিনি 888sport app download apkয় অসংখ্য কথ্যক্রিয়া, নামধাতুকে ক্রিয়ারূপে ব্যবহার করেছেন। বিশেষণকে রূপকম–ত করা আর ক্রিয়াপদের যে-প্রয়োগ তাঁর আভিজাত্যহীন, তাৎক্ষণিক প্রকাশকলার মধ্যে রয়েছে যে ক্রিয়াচঞ্চলতা তথা সক্রিয়তা তা ধরা পড়ে। নজরুল সর্বদাই ক্রিয়ামুখর, কর্মব্রতে উচ্ছল। এই সক্রিয়তা তাঁকে যুক্ত করেছে বেশিসংখ্যক মানুষজনের কর্মজগতের সঙ্গে। তিনি শ্রমণের চেয়ে শ্রমকে বেশি মান্যতা দিয়েছেন, ফলে তিরিশের পটভূমে আবির্ভূত হয়েও তিনি বিশেষণগম্ভীর আভিজাত্যের তোয়াক্কা করেননি, শব্দের চলচঞ্চলতাকেই নান্দনিকতা দিয়েছেন। এখানেই তিরিশি কবিদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য। তাঁর মাত্রাবৃত্ত ছন্দের সুমাত্রিক ব্যবহারও এক্ষেত্রে বিপুলভাবে ফলদায়ক, একটা তরঙ্গায়িত সুর সর্বত্র ওঠানামা করেছে ঢেউয়ের মত – অন্তত ‘সিন্ধু’ 888sport app download apkয় তো বটেই। যে-বস্ত্তপ্রাণতা, বস্ত্তর রূপবৈচিত্র্যের ধারণ, তাই কবিকে ভাববাদিতার হাত থেকে রক্ষা করেছে, যে-কারণে তাঁর প্রেমও বস্ত্তদেহের পরিসীমা ছাড়ায় না, প্রকৃতিও হয়ে ওঠে মানবায়িত। আর প্রথম তরঙ্গে আছে প্রশ্নবোধক চিহ্নের প্রচুর ব্যবহার, এও ক্ষুব্ধ মনের পরিচায়ক।

চিরাচরিত রূপকের হাত ধরে তিনিও চাঁদকে সমুদ্রের প্রেমিকারূপে কল্পনা  করেন – ‘চাঁদের চাঁদিনী বুঝি তাই এত টানে/ তোমার সাগর-প্রাণ, জাগায় জোয়ার?/ কী রহস্য আছে চাঁদে লুকানো তোমার?/ …ঐ চাঁদ সে কি প্রেয়সী তোমার?/ টানিয়া সে মেঘের আড়াল/ সুদূরিকা সুদূরেই থাকে চিরকাল?’ চাঁদের কলঙ্ককে কবি সমুদ্রের ‘ক্ষুধাতুর চুম্বনের দাগ’ মনে করেন – যা বেশ অভিনব কল্পনা। চাঁদের বিচ্ছেদজনিত কারণে ‘তাই/ তরঙ্গে আছড়ি মরে আক্রোশে বৃথাই?’ ‘সিন্ধুকে অনন্ত পুরুষ’ উৎপ্রেক্ষায় সম্বোধিত করার মধ্যেই শব্দরূপের লৈঙ্গিক চিহ্ন ধরা পড়ে। প্রকৃতিকে 888sport promo code  ভাবার ঐতিহ্যিক সংস্কার ভেঙে তিনি 888sport promo code-পুরুষের সম্পর্কের জালায়ন রচনা করেন, এটা যেমন তাঁর স্বাতন্ত্র্য, তেমনি শব্দার্থের বশ্যতাও বটে। এবং এখানেই নজরুল ইউনিভার্সালকে পার্টিকুলারাইজ করেন – আলাদা-আলাদা রূপে বিভাজন করে বস্ত্তর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন। বস্ত্ত প্রতিমাকে তন্নতন্ন করে আলাদা করার এই পরিকল্পনা অনেকটাই উত্তর-আধুনিকদের শব্দায়নের মত! নজরুলের নান্দনিকতার প্রধান সূত্র চিত্রকল্পনির্মাণে – ‘ছিলে স্থির,/ তব মুখে মুখ রেখে ঘুমাইত তীর/ – তপস্বী। ধেয়ানী!/তারপর চাঁদ এলো, কবে, নাহি জানি/ তুমি যেন উঠিলে শিহরি।’ চাঁদের জ্যোৎস্না দর্শনেই সুন্দরের জন্ম হলো – ‘‘সুন্দর, সুন্দর’ গাহি’ জাগিয়া উঠিল চরাচর!/ সেই যে আদিম শব্দ, সেই আদিকথা, সেই বুঝি নির্জনের সৃজনের ব্যথা।’’ ‘একা সে সুন্দর হয় হইলে দুজন।’  যৌথত্বই সৌন্দর্যের জন্মদাত্রী, দুজন মিলেই প্রেম, কাব্যসত্যের বাস্তবতা, আর তাতেই সৃষ্টির প্রাণ পশরা থাকে অব্যাহত। এই প্রেম মিলনোজ্জ্বল বটে তবে  অতীন্দ্রিয় নয়, তা বিরহব্যথার হলেও একান্তই ইন্দ্রিয়গোচর। দৃষ্টিকল্পের মধ্যেই তার অসিন্তত্ব।

রবীন্দ্রনাথের ছিল ‘হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে,’ – আর নজরুলের হচ্ছে ‘কে যেন চাহিছে মোরে, কে যেন কী নাই,/ যারে পাই তা’রে যেন আরো পেতে চাই।’ এই একান্ত করে সর্বাঙ্গীণ পাওয়াটাই নজরুলের মূল কথা, যেখানে রবীন্দ্রনাথ না-পাওয়ার মধ্যেই, চিরবিরহের মধ্যেই তাঁর দয়িতাকে উপলব্ধি করেন। বিরহের মধ্যে সার্বক্ষণিক নিবিড়মগ্ন হয়ে থাকার অর্থই হলো তাকে পাওয়া। কিন্তু নজরুলে ক্রিয়ামুখরতা, – তাতে স্তব্ধতা নেই – ‘জাগিল আনন্দ-ব্যথা, জাগিল জোয়ার, লাগিল তরঙ্গে দোলা, ভাঙিল দুয়ার,/ মাতিয়া উঠিলে তুমি।’ এই মাতামাতিতে ‘নিদ্রাতুরা ভূমি’ কেঁপে ওঠে, বাতাস হতাশ্বাসে ভরে যায়, আকাশের শূন্যতায় ‘নীলিমা-উচ্ছ্বাস জাগে।’ ‘বিস্ময়ে বাহিরি’ এল নব নব নক্ষত্রের দল,/ রোমাঞ্চিত হল ধারা,/বুক চিরে এল তার তৃণ ফুল-ফল।’ ব্যথার সক্রিয়তা আর পাওয়ার বাসনা থেকে সৃষ্টির ক্রিয়াশীলতা জাগে, ফুল-ফল, লতাপাতা, বাতাসের দোলা – সবকিছুতেই দোলা জাগে – ‘জলে জলে ঢলাঢলি চলমান বেগে,/ ফুলে হুলে চুমোচুমি – চরাচরে বেলা ওঠে জেগে।’ সবকিছুই কামবাসনায় চঞ্চলিত হয় – কামই বিশ্বসৃষ্টির প্রাণ – ‘দেবতা ইহার শিব নয়’ – কামরতিই সৃষ্টির বীজতলা। অনন্ত ক্ষুধায় সমুদ্র ও সমস্ত সৃষ্টিতে কম্পন জাগে। তবে না-পাওয়ার ব্যথাও আছে, আর সে ব্যথা – ‘ক্ষুধার পীড়া গলে যায় সারা হিয়া, ছিঁড়ে যায় যত স্নায়ু শিরা।’

ইন্দ্রিয় দিয়ে এই যে তীব্রব্যথার অনুভব এটাও নজরুলের প্রেমবাসনার ধরন, তবে ‘প্রিয় বিরহের সুগভীর ছায়াই’ যে স্বচ্ছ সমুদ্রধারাকে নীলাভ ব্যথায় জড়িয়ে নেয় তা একান্তই রোমান্টিক সূক্ষ্ম কল্পনা। ‘বাসনা তরঙ্গে তব আছড়িয়া পড়ে ছায়া প্রেয়সীর,/ ছায়া সে তরঙ্গে ভাঙে, হানে মায়া, ঊর্ধ্বে প্রিয়া স্থির।’ এই বাসনা-কাঙক্ষা উত্তরাধুনিক তাত্ত্বিক লাকাঁর মনস্তত্ত্বের মতো নয়, এটি  ফ্রয়েডীয় লিবিডোর মত – যা কেবলই যৌন বেদনা – মিলনের জন্য উন্মুখ, তবে এর নিবৃত্তি ঘটে না, কারণ চাঁদকে সমুদ্র কখনোই পায়নি, তার প্রতিচ্ছায়া মাত্র বুকে ধারণ করে। তাই চাঁদকেন্দ্রিক এই বাসনাটি ডিজায়ার নয়, চাঁদকে পাওয়া হলেই বাসনার তৃপ্তি। লাকাঁর ডিজায়ার হচ্ছে যা কখনোই পরিপূরিত হয় না, একটি থেকে আরেকটিতে ধাবিত হয়, যা অপূর্ণ থেকে যায় চিরকাল। অর্থাৎ সমুদ্রের ক্রন্দন লক্ষ্যমুখী, উদ্দেশ্য স্পষ্ট – যদিও তার পূরণ ঘটে না, কারণ পরের দ্বিতীয় তরঙ্গেই আমরা দেখতে পাব 888sport app download apkর পরবর্তী সখ্যকল্পনার ধরন-ধারণ।

 

দুই

দ্বিতীয় তরঙ্গে স্পষ্টভাবে সিন্ধুর সঙ্গে 888sport app download apkর পার্সোনার সখ্য তৈরি হয় এবং ক্ষুব্ধ সিন্ধুর তরঙ্গের সঙ্গে কবি হৃদয়ের একান্ততা ঘটে। এখানে সিন্ধু ভূমিগ্রাসী! যে-রূপটি ফুটেছে তা-ও ‘নিষ্ফল আক্রোশের আস্ফালন’ – ‘সর্বগ্রাসী! গ্রাসিতেছ মৃত্যু-ক্ষুধা নিয়া/ ধরণীরে তিলে তিলে!/ হে অস্থির! স্থির নাহি হ’তে দিলে/ পৃথিবীরে। ও গো
নৃত্য-ভোলা,/ ধরারে দোলায় শূন্যে তোমার হিন্দোলা।’ দ্বিতীয় তরঙ্গের সম্পূর্ণটাই ক্রিয়া ও নৃত্যছন্দে উচ্ছ্বসিত। প্রাচীন মুনিঋষিরা সমুদ্রের তরঙ্গধ্বনি উপলব্ধি করেই গায়ত্রী ছন্দ আবিষ্কার করেছিলেন, সেটি ছিল গম্ভীর ছন্দধ্বনিত, মন্ত্রবাণী। কিন্তু নজরুলের তরঙ্গধ্বনি শুধুই নৃত্যপর প্রেমিক – ‘ধরণীর সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রেমের।’ ‘বারে বারে টানিতেছ দিগমিন্তকা-বধূর অঞ্চল!/ কৌতুকী গো! তোমার এ কৌতুকের অন্ত  যেন নাই।’ আমরা প্রথম অংশ থেকে বুঝতে পারি না এই বেলাভূমি, কূলের পটকথা যে কবিরই কাম্য প্রিয়ার প্রতিতুলনা। – ‘কে নিশীথে এসেছিল ভুলে/ তব তীরে, গর্বিতা সে 888sport promo code,/ যত বারি আছে চোখে তা/ সব দিলে পদে তার/ সে শুধু হাসিল উপেক্ষায়।’ অর্থাৎ এই তরঙ্গ কবিপার্সোনার হৃদয়। এই দ্বিতীয় তরঙ্গের উচ্চারণ কবির পার্সোনাকে লক্ষ করে। এখানে কবি আর সমুদ্র একীভূত, নিজেকেই সম্বোধন করেন ‘বন্ধু’ বলে – নিজেকে অর্থাৎ নিজের সমুদ্রতরঙ্গাকুল প্রেমসত্তাকে – ‘হে-‘মজনুন’ কোন্ সে ‘লায়লী’র/ প্রলয়ে উন্মাদ তুমি? বিরহ অথির/ করিয়াছ বিদ্রোহ ঘোষণা।’ তরঙ্গের সেনা প্রিয়াকে হরণের জন্যে নানা সাজে সেজেছে। 888sport app download apkটির দ্বিতীয় স্তবকে কবির লেখনীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে দৃশ্যমান বস্ত্তবিভাব দিয়ে প্রিয়ার অপেক্ষায় সমুদ্রের কতনা সাজসজ্জা অভিমান – ‘বধু তব দীপান্বিতা আসিবে কখন/ রচিতেছে নব নবদ্বীপ তারি প্রমোদ-কানন।’ সমাসোক্তি অলংকারের প্রাচুর্যে ঠাসা স্তবকটি বস্ত্তকে শুধু সাজসজ্জার উপকরণেই পরিণত করেনি, তাদের করে তুলেছে ক্রিয়াশীল অপেক্ষাতুরা।
জোয়ার-ভাটাও প্রিয়ার জন্যে লীলাখেলার মত্ততা, কিন্তু এই তরঙ্গের নিরুদ্দেশ চলাটি পুরোপুরি বাহিরে নিরুদ্দেশ হয়ে যায় না, তা ‘চাহে তব প্রাণ।/ বাহিরে না পেয়ে তারে ফের তুমি অন্তরের পানে/ লজ্জায় – ব্যথায় – অপমানে।’ নজরুলে প্রেমবেদনায় অপমানের জ্বালা আছে, ব্যক্তিজীবনের 888sport sign up bonus অনুষঙ্গই এই জ্বালার উৎস। তাঁর মা কিংবা নার্গিসের সঙ্গে যে সম্পর্ক তাতে অপমানের যন্ত্রণা ছিল। ব্যক্তিগত অনুষঙ্গই 888sport app download apkর প্রসঙ্গে রূপান্তরিত হয় – কেননা বস্ত্ত অভিজ্ঞতার বাইরে কোনো জগৎ নেই, আর তিনি তো একান্ত বস্ত্তসীমাতেই পরি888sport slot game করেন।

প্রত্যাখ্যান বা বিচ্ছেদের জ্বালা বি888sport app download for androidের জন্যে উন্মত্ত তরঙ্গ হয়ে ওঠে বীর – ‘আনন্দে নাচিয়া ওঠো দুখের নেশায় বীর! ভোল’সব জ্বালা/ অন্তরের নিষ্পেষিত ব্যথার ক্রন্দন/ দেখা হয়ে ওঠে মুখে বিষের মতন।’ বিষ বা বিষধর নজরুলের একটি প্রিয় টোটেম যাকে ঘিরে তাঁর সৃষ্টিশীলতা সক্রিয় থেকেছে। (দ্রষ্টব্য : সিরাজ সালেকীন, নজরুল-টোটেম, কথাপ্রকাশ, 888sport app ২০১৫) এবং বিষের উৎস শুধু প্রেমের অপমান নয়, ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে নির্যাতিতার স্বভাব-প্রকৃতিও। নিম্নবিত্ত থেকে কবির যে-উত্থান এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়-দুর্দশার মধ্যে অতিবাহিত যে-জীবনাভিজ্ঞতা তার ঐতিহাসিক  দেশকাল তো উপনিবেশে বসবাস, তাই জনমানুষ ও তরুণ যেমন তাঁর সম্বোধিত আন্তজন তেমনি সমুদ্রও তাঁর বন্ধু – ‘এসো বন্ধু, মুখোমুখি বসি।/ অথবা টানিয়া লহ তরঙ্গের আলিঙ্গন দিয়া,  দুহুঁপশি/ ঢেউ  নাই যেথা – শুধু নিতল সুনীল! -’ রবীন্দ্রনাথও তাঁর ‘সমুদ্রের প্রতি’ 888sport app download apkয় অশান্ত পৃথিবী ও ব্যথায় অস্থির মানুষের জন্যে সমুদ্রের কাছে যাচনা করেছেন শামিন্ত – ‘বলো তারে ঘুমা ঘুমা ঘুমা’, আর নজরুলে শুধু আন্তবিরহ সমুদ্র শুধু নিজের অশান্ত হৃদয়ের সাথি।

 

তিন

কিন্তু তৃতীয় তরঙ্গে নজরুল সমুদ্রের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্কের জালটি পেতে দেন। সমুদ্র এখানে বুভুক্ষু – ‘তিন ভাগ গ্রাসিয়াছ – এক ভাগ বাকি!/ সুরা নাই – পাত্র-হাতে কাঁপিতেছে সাকি।’ সমুদ্র আপন তরঙ্গমালা নিয়েই বিভোর, কবির বাসনা ‘শস্য-শ্যামা বসুমতী ফুলে-ফলে ভরিয়া অঞ্জলি/ কবিছে বন্দনা তব, বলী!/ তুমি আছ নিয়া নিজ দুরন্ত কলেস্নাল/ আপনাতে আপনি বিভোল,।’ এখানে কবির সঙ্গে সমুদ্রের আর বন্ধুতা নেই, কারণ সমুদ্র আন্তভোলা, পৃথিবীর প্রতি একান্ত উদাসীন। জনমানুষের সঙ্গে নজরুলের যে সার্বক্ষণিক সম্পর্ক সেখানে আন্ততা সত্ত্বেও তিনি বহু হয়ে ওঠেন, বহুজন সংস্পর্শে যেতে চান। সেখানে সিন্ধুর ‘আপনাতে আপনি’ বদ্ধ শব্দটাকে তিনি তৃতীয় তরঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, উদাসীনবৎ সমুদ্র বর্তমান, অতীত, দূরের ভবিষ্যৎ নির্বিকারভাবে প্রত্যক্ষ করে। কিন্তু সুন্দর ধরার যত পলস্নল-পলস্নব সবই তো সমুদ্রতরঙ্গের দান। এই উদাসীন মনোভাবটি নজরুলের চরিত্রানুগ; কিন্তু এও সত্য যে, সমুদ্রতরঙ্গ শুধু প্রাণবন্তই করে না ধরাকে, পৃথিবীর পাপ-গস্নানিকে মুছেও দেয়। সে যেন পবিত্র ও দরদি। এখানে এসে তিনি পৃথিবীকে সমুদ্রের ‘আদরের মেয়ে’ বলেই সম্বোধন করেন রবীন্দ্রনাথের ‘সমুদ্রের প্রতি’ 888sport app download apkর মত। এখানে পিতাকন্যার সম্পর্ক – ‘তাহারে দেখিতে তুমি আস মেঘ বেয়ে/ …জলধারা হয়ে নামো, দাও কত রঙিন-যৌতুক, ভাঙ গড়, দোলা দাও, – কন্যারে লইয়া তব অনন্ত কৌতুক।’ প্রেম এখানে কন্যার প্রতি স্নেহে রূপান্তরিত। সমুদ্রবন্দনার এই যে বিচিত্র সম্পর্কের রূপায়ন তাতে ‘সিন্ধু’ 888sport app download apkটি হয়ে উঠেছে আন্ততা ও বহুত্বের ‘ওড’ – স্ত্ততিগাথা। সমুদ্র শুধু অনন্ত যৌবনের অধিকারীই নয়, সে দেবতাদের দেয় গজমোতি, ঐরাবত, উর্বশী। কবি যেমন 888sport app download apk রচনার মধ্যে নিজেকে নিষিক্ত করেন অন্তরমথিত করে, তেমনি পৌরাণিক সমুদ্রমন্থনের কাহিনিতেও দেখি সমুদ্রের অজস্র দান – ‘করেছে লুণ্ঠন/ তোমার অমৃত-সুধা – তোমার জীবন।’ কিন্তু ঐশ্বর্য লুণ্ঠিত হলেও ‘আছে জ্বালা, আছে 888sport sign up bonus, ব্যথা-উৎরোল!/ ঊর্ধ্বে শূন্য, – নিম্নে শূন্য – শূন্য চারিধার,/ মধ্যে কাঁদে বারিধারা সীমাহীন রিক্ত হাহাকার।’

তাই তরঙ্গ চিরবিরহী ও বিদ্রোহী। নজরুল দ্রোহকে তথা শক্তিকে সর্বদাই গেঁথে দেন ব্যথাব্যাকুলতার সঙ্গেও, আর তাতেই ঝলকে ওঠে সৌন্দর্য – ‘সুন্দর আমার।/ নমস্কার!/ নমস্কার লহ।/  তুমি কাঁদো, – আমি কাঁদি – কাঁদে মোর প্রিয় অহরহ।’ বিরহই শেষ কথা, যদিও সমুদ্রের পার আছে কূল আছে কিন্তু কবির অনন্ত বিরহের ‘নাহি পার, – নাহি কূল, – শুধু স্বপ্ন, ভুল।’ রবীন্দ্রনাথের সর্বপ্রাণতার মতই সমুদ্র ও মৃত্তিকায় বয়ে যাওয়ার আকুল বাসনায় নজরুলও প্রত্যয়িত হন – ‘মাগিব বিদায় যবে, – নাহি র’ব আর,/ তব কলেস্নালের মাঝে বাজে যেন ক্রন্দন আমার!/ বৃথাই খুঁজিবে যবে প্রিয়া, উত্তরিও বন্ধু ওগো সিন্ধু দোর, তুমি গরজিয়া।/ তুমি শূন্য, আমি শূন্য; শূন্য চারিধার,/ মধ্যে কাঁদে বারিধারা, সীমাহীন রিক্ত হাহাকার।’

তিনটি তরঙ্গেই মূল স্বর বিরহীর ও ক্রন্দনের, শেষে এসে যে-শূন্যতার কথা বলা হল তা কবির চির-একাকিত্বের দিকেই ইঙ্গিত দেয় – যদিও তা রাবীন্দ্রিক বা তিরিশি বচনের সংস্কারবহ নয়। এই শূন্য কাম্যপ্রিয়ার অভাবজনিত, যার ভেতরে আছে উদাসীন প্রত্যাখ্যানের তীব্র দাহ। এত তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণার সুর বাংলা 888sport app download apkয় কমই আছে। তীব্র প্রকাশই নজরুলের স্বকীয়তা, যা তাঁর শক্তিতত্ত্ব থেকে উৎসারিত। তাঁর ‘সুন্দর’ও বিরাট, ব্যাপ্ত ও বলিষ্ঠ; কখনো  রুগ্ণ-দুর্বল নয়। r