নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক

 

\ ৩৮ \

 

হ্যাঁ, গান্ধীকে নিয়ে এতবড় একটা অশ্লীল কথা! লোকটার দিকে খরদৃষ্টিতে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকে মন্মথ দারোগা। আসলে সে সময় নেয়; বুঝে দেখতে চায় পাকিস্তান হবার পরিস্থিতিতে বর্তমানের বাস্তবতা; এতটাই তার খর সতর্কতা যে, সামান্য গাছের পাতা নড়াটাও পাকিস্তানের প্রসূতি-ভোরে বুঝিবা কোন অর্থ বহন করে, সেটাও নির্ণয় করে নেওয়া চাই! লোকটা হিন্দু নয়, সে তার চেহারাতেই স্পষ্ট। তবে মুসলমান! তাহলে একটু ভাবতে হয়! পেটাবার জন্যে উদ্যত হান্টারের মুঠো থেকে হাতের চাপ আলগা হয়ে আসে

তার। এইখানে আমরা ঈষৎ থামি, এ-কাহিনির কিছুই না-সরল না-জটিল, এ-কাহিনির এতদূর এসে মনে হচ্ছে মইনুল হোসেন মোক্তারের মৃত্যু আর সাতচল্লিশের দেশভাগে পতিত জলেশ্বরী ও তার পাশ দিয়ে বহে যাওয়া আধকোশার নদীধারা, এ সবই যেন জিগা বৃক্ষের কান্ডে বৃহৎ এক ক্ষত, আর এ-কাহিনির বয়ান যেন সেই ক্ষতমুখের জমাট কষ ঘিরে বিষাক্ত হলুদ নাছোড় এক বোলতা! – কেবলই বোঁ বোঁ করে চক্রাকার উড়ানে রয়েছে। যা হোক, এখানে এক মুহূর্তের বিরাম নিয়ে একটি কথা ভেবে লই। ওই যে মন্মথ দারোগা লোকটিকে মুসলমান বলেই ঠাহর করে তার চেহারা দেখে, এটা কী রকম? চেহারার কি হিন্দু-মুসলমান হয়? আমরা জানি না। অনেককে জিগ্যেস করে উত্তর এই পাওয়া যায় যে, এর কোনো বিচার-নিরিখ নাই, দেখামাত্রই অনুমানটা হয়, কীসে হয় তারা জানে না! ভারতবর্ষীয় মাটিতে, যে-মাটি সাতচল্লিশে এখন হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানে বিভক্ত, এই বিভক্তির মূলেই আছে অবিরাম হিন্দু-মুসলমান শনাক্ত করা – সবকিছুতে, রান্নায়, চেহারায়, বাড়িঘরের বাইরের ও ভেতরের সাজসজ্জায়, ব্যাপারটা যে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারে তার উদাহরণ ওই চেহারা দেখে মুসলমান কি হিন্দু নির্ণয়  করা।

মন্মথ দারোগা ইংরেজের পা-চাটা হয়েও, হাজার বছর ইংরেজ বহাল থাকবে মনে তার এই দৃঢ়মূল বিশ^াস সত্ত্বেও, ইংরেজের উচ্ছেদকামী গান্ধীকে অ888sport apk download apk latest version করা তার পক্ষে কখনই সম্ভব হয় নাই। মনের কোথাও গান্ধীকে সে বরং সিংহাসনেই রেখেছে, এবং রহস্যের কথা এই যে, তার নিজের কাছেই সিংহাসনের অকুস্থলটি অজ্ঞাত এবং ঘোর অন্ধকারে আবৃত। এ ধরনের রহস্যতা ও অজ্ঞানতা ইংরেজের চাকরি করা ভারতীয় দাসগণের মনে এক সময় খুব দেখা গেছে, বিশেষ করে দাসত্বের শেকল ছিঁড়ে ফেলার আন্দোলন যত জোরালো হয়ে উঠেছে ততই যেন ইংরেজের পা-চাটা এবং বিপরীতে ইংরেজবিরোধী নেতাদের প্রতি গোপন আগাম 888sport apk download apk latest versionটাও একই সঙ্গে বেড়ে গেছে তাদের। এখন সাতচল্লিশের চোদ্দই আগস্ট, ইংরেজের নিশান নামিয়ে জলেশ^রীর কাছারির মাঠে এখন যতই ওঠানো হোক পাকিস্তানের নিশান, যতই হোক পাকিস্তান, আর গান্ধীর নাম যতই ধুলায় পড়ে যাক না কেন পাকিস্তানে, লোকটাকে হান্টার পেটা করবার জন্যে হাত নিশপিশ করলেও, মন্মথ দারোগা শেষ পর্যন্ত সংযম ও সতর্কতা অবলম্বন করে। পাকিস্তান হবার সদ্য ভোরে, ঘণ্টাদুয়েকও হয় নাই, এরই মধ্যে কোনো মুসলমানের গায়ে হাত তোলাটা খুব সুবুদ্ধির হবে না। লোকটাকে জলেশ^রীতে আগে দেখেছে কি দেখে নাই মনে পড়ে না। আমরা তো বুঝতেই পারছি এ ব্যক্তি সেই ওয়াহেদ ডাক্তার, অচিরে যে জলেশ্বরীর এক কিংবদন্তি হয়ে উঠবে, এবং সূর্যাস্তকালের রক্তিম আকাশে যাকে নাকি অতঃপর উড়ে যেতে দেখা যাবে, এবং কোনো কোনো নক্ষত্রমন্ডিত জোছনারাতে তাকে রাজবেশেও আকাশ থেকে নেমে আসতে দেখেছে বলে কেউ কেউ বলবে। আমরা সেই রূপকথায় অচির পরে প্রবেশ করছি। তার আগে আধকোশার পাড়ে তাকে এখন দেখে লই।

মন্মথ দারোগা হাতের হান্টারটি বগলের কাঁচিতে আটকে প্রশ্ন করে, আপনি? – তখন খুব তাচ্ছিল্য করে ওয়াহেদ ডাক্তার বলে, আমার আর পরিচয়! পরিচয় অচিরে পরকাশ পাইবে, তখন না হয় পরিচয় দেমো। – তবু? এর উত্তর না দিয়ে ওয়াহেদ খেয়া নৌকার দিকে ধেয়ে যায়। মাত্রই গতকাল ছিল ইংরেজের রাজত্ব, গতকাল হলেও মন্মথ দারোগা লাফিয়ে উঠে লোকটাকে পাকড়াও করত, আজ সে দুর্বল বোধ করে। মাত্রই কাল আর আজ – কী তফাৎ! হতভম্ব, বিস্মিত, অপ্রতিভ, অপ্রস্ত্তত হয়ে মন্মথ নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সে ভুলেই যায় কী কারণে তাকে ছুটে আসতে হয় এখানে। হইহই করে এসে পড়ে সিপাহিরা। লাল পাগড়ি দেখে নদীর পানিতে গোসলে নামা গ্রাম্য লোকেরা চট করে উঠে পড়ে দৌড় লাগায়। সিপাহীরা বনবন করে পাক দিতে থাকে। ব্যাপারীদের শূন্য চালার ভেতরে গিয়ে হুটপাট করে। একপাল কুকুর মিছিলের মতো করে কোথা থেকে এসে হাজির হয় নদীর পাড়ে, সামনের দুপা নদীর জলে দিয়ে তারা মুখ নামায়, পিপাসার্ত তারা চকচক করে পানি খেতে থাকে। মন্মথ দারোগা অবাক হয়ে যায় কুকুরদের এই শৃঙ্খলা-বোধ দেখে, মানুষেও এমন সচরাচর দেখা যায় না।

সিপাহিরা একজনকে ধরে আনে। লোকটি গোসল করতে নেমেছিলো, সিপাহি দেখে উঠে পড়ে দৌড় লাগাচ্ছিলো, সিপাহি সাক্ষাতে দৌড়ের একটাই অর্থ – নিশ্চয় কোনো অপরাধ আছে, তাকে ঘাড় পাকড়ে দারোগার সামনে পেশ করে। – এ শালা কিছু জানে! ভীত লোকটি অকপটে তৎক্ষণাৎ স্বীকার করে, হ্যাঁ, সে জানে। যতটুকু জানে বা দেখেছে সে তার বয়ান দেয়।

হ্যাঁ, সে ইস্টিশানে মাল গুদামে কুলির কাজ করে। আজ পাকিস্তানের জন্ম হবার কারণে কাজ বন্ধ, আসলে গুদামের কাজ আর মালগাড়িতে চালান তোলার কাজ কয়েকদিন থেকেই বন্ধ হয়ে আছে। গত কয়েকদিন থেকেই মহাজন মাড়োয়ারিরা হাত গুটিয়ে বসে আছে, চাষির উৎপন্ন শস্য কেনা তারা স্থগিত রেখেছে পাকিস্তানের হাওয়া বুঝে দেখতে। তারা যদি বেগতিক দেখে পাকিস্তান থেকে মানে এই জলেশ্বরী থেকে চলে যায়, তাহলে গরিব কুলিরা কী করে সংসার চালাবে, সেই দুশ্চিন্তায় তাদের ঘুম হরে গেছে। মন্মথ দারোগা কষে ধমক লাগায়। গ্রাম্য লোকের এই এক দোষ – বিষয় ছেড়ে অবিষয়ে কথা বলবে, বিষয়ে ঢুকতে ঢুকতে সাতকাহন করে অন্য কথা বলা হয়ে যাবে, তারপর মূল বিষয়ের খেই হারিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে। মন্মথ ধমক দিয়ে জিগ্যেস করে, নদীর পাড়ে কোনো 888sport promo codeকে নিয়ে টানাটানি সে দেখেছে কিনা। হ্যাঁ, সে দেখেছে। বলে কী! দেখেছে! কী দেখেছে! না, টানাটানি সে দেখে নাই। না, 888sport promo codeকে নিয়ে চালঘরের দিকে যুবকদের যেতেও সে দেখে নাই। তবে কী দেখেছে?

লোকটি বলে, মুঁই দেখিলোম, যুবকেরা ওই বেটি ছাওয়ার সাথে আল্লাপ-সাল্লাপ জুড়ি দিছে। মন্মথ দারোগা খর গলায় জানতে চায়, শুধু আলাপ-টালাপ? না, আর কিছু? – না, আর কিছু নয়! তার বাদে দেখিলোম বেটিছাওয়া যুবকদের সাথে মিলিয়া-মিশিয়া চলি গেইলো হুই দিকে হুই পথ ধরি। মন্মথ দারোগা প্রশ্ন করে, তুই অবাক হইস নাই? মনে খটকা বাধে নাই? – ক্যানে? খটকা কিসের? – এই যে এক হিন্দু বেটিছাওয়া মোছলমানের দলের সাথে? লোকটি তখন হাঁ করে দারোগার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর সে মাটির দিকে চোখ নামিয়ে মাথা দোলায় খানিক। তারপর আবার সে চোখ তোলে দারোগার মুখের ওপর স্থাপন করে এবং প্রায় স্বগত উচ্চারণের মতো বলে, হিন্দু বেটিছাওয়ার সাথে মোছলমান, মনেও মোর হয় নাই!

অতঃপর লোকটির বর্ণনা অনুসারে নদীর পাড়ে পূর্বদিকের রাস্তা ধরে মন্মথ দারোগা সিপাহিদের নিয়ে অগ্রসর হয়। দেখা যাক মুসলমান যুবকেরা 888sport promo codeটিকে নিয়ে কোথায় ভোগের আসর বসিয়েছে। ভোগ! ভোগ! 888sport promo code সম্ভোগ! এ ভিন্ন দারোগার মনে আর কোনো শব্দ নাই। হিন্দু 888sport promo codeর সাক্ষাতে মুসলমানের উপস্থিতি মানেই যে কাম চাগানো ও ধর্ষণ সম্ভাবনার শুরু, হিন্দুর মনে মুসলমান সম্পর্কে এ বহুদিনের একটা ধারণা। যেন মুসলমানের হৃদয় নাই, তার বদলে আছে লিঙ্গ!

মন্মথ দারোগারও ছিল এই ধারণা, অতএব সে হিন্দু 888sport promo codeটির খোঁজে পায়ে পায়ে এগোচ্ছিলো, নদীর পাড়ে উঠে পূর্বদিকের ধানগন্ধী পাড়ায় পাড়ায় ঘরে ঘরে উঁকি দিয়ে দেখছিলো, জনে জনে জিগ্যেস করছিলো, এবং প্রতি মুহূর্তেই তার মনে হচ্ছিলো এই বুঝি বিবস্ত্র 888sport promo codeটিকে সে ধর্ষিত মূর্ছিত অবস্থায় আবিষ্কার করে উঠবে কোনো একটি বাড়িতে, বাড়ির কোনো এক অন্ধকার ঘরে, গোয়ালঘরের নিভৃতে কি গোলাঘরের গোপনে। কিন্তু সে আশ্চর্য হয়ে যায়, আশ্চর্য কী স্তম্ভিত বিমূঢ় হয়ে যায় যখন 888sport promo codeটিকে দিব্য স্বাভাবিক অবস্থায় সে দেখতে পায় – কোনো অন্ধকার ঘর বা কোণে নয়, একেবারে প্রকাশ্যে, একটি পরিচ্ছন্ন উঠানের মাঝখানে। 888sport promo codeটি বসে আছে, তাকে ঘিরে তিনটি যুবক, এবং হ্যাঁ, তারা মুসলমান। তাদের চেহারা দেখেই মুসলমান ভিন্ন আর কিছু তাদের মনে হয় না। আসরের ভেতরে মধ্যমণি হয়ে বসা 888sport promo codeটিকে দেখেই মনে হয় যেন খুবই আপন স্বজনদের বাড়িতে সে বেড়াতে এসেছে, এখন তাকে ঘিরে কথার কলরব, আপ্যায়নের ধুম, সৌজন্যের ঢল চলছে বইছে।

পরিবেশটাও যেন একই সঙ্গে আহ্লাদী হয়ে উঠেছে। পরিষ্কার করে নিকানো উঠান, দেয়ালে গোবর ঘুঁটি, কামরাঙা গাছটির নিচে মুরগি মা ও তার ছানারা, চারদিকে ধানের অপরূপ গন্ধ যেন নেশা ধরায়। না, উঠানে কোনো মাদুর পাতা হয় নাই, 888sport promo codeটি – আমরা তো জানিই এ 888sport promo code মুকুলের বিধবা মা, চোখ ফেরানো যায় না এমন রূপবতী, অথচ বিধবা জীবন যাপনের কঠোর রূক্ষতা তার সর্বাঙ্গে, ছোট করে ছাঁটা চুলে, পরিচ্ছন্ন শাদা কিন্তু কর্কশ শাড়িতে – সে নিকানো মাটিতেই পা মুড়ে বসে আছে। আর এক যুবক, হ্যাঁ তাকে নজরুল বলে শনাক্ত করতে পারে মন্মথ দারোগা, মুসলিম লীগের কর্মী নজরুল, সেই নজরুল একটা ডাব 888sport promo codeটির সমুখে হাঁটু ভাঁজ করে ধরে আছে। একটু কাছে যেতেই মন্মথের কানে আসে, যুবকটি বলছে, ভাবিজান, রইদ চ্চচড় করি উঠছে, ডাব খায়া আগে শীতল হন, ভাবিজান! আর যে দুই যুবক 888sport promo codeর দুইদিকে বসে, তারাও সমস্বরে বলে ওঠে, হয়, হয়, ভাবিজান! ডাবখান খান!

ভাবিজান! নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না মন্মথ দারোগা। শব্দটার অর্থ ঠিক ঠাহর হয় না তার কাছে। ভাবিজান মানে কী? ভাবি তো এমন যে আমি ভাবি, সে ভাবে, তুমি ভাবো। সেই ভাবির সঙ্গে জান? জান-এর অর্থইবা কী? ব্যাপারটা কী দাঁড়ালো? আবারো যেন শোনা যায় – ভাবিজান ভাবিজান! মন্মথ দারোগা ভীষণ আতান্তরে পড়ে যায়।

আমরা আরো একবার এখানে একটু থামি এবং শুনে উঠি বাঙালি মুসলিম সমাজে আত্মীয়-স্বজনের সম্পর্কসূচক সম্বোধনের শব্দগুলো – ভাবি, খালা, ফুপু, খালুজান, ফুপাসাহেব; বিপরীতে বৌদি, মাসি, পিসি, মেসোমশাই, পিসেমশাই! মুসলমানেরা যদিও মাসি পিসি বোঝে, বোঝে যে কাকে সম্বোধন করা হচ্ছে, বক্তার সঙ্গে উদ্দিষ্টের সম্পর্কটা কী, কিন্তু আমরা দেখবো হিন্দুজনেরা খালা ফুপু একেবারেই বুঝতে পারছে না। জলেশ্বরীতে ভাইকে দাদা ডাকার চল হিন্দু মুসলমান সবার ভেতরে। এবং এটাও লক্ষণীয় যে, মুসলমান অনেকেই হিন্দুজনের মাতৃসমান 888sport promo codeকে খালার বদলে মাসি বলে ডাক দেয়, ফুপুর বদলে ডাক দেয় পিসি; বিপরীতে এই সৌজন্যটি কিন্তু কোনো হিন্দুর কণ্ঠে শোনা যায় নাই যে খালা বলে মায়ের সমান মুসলমান 888sport promo codeকে ডাকছে। তাই বলে এটাকে অসৌজন্যও বলা যাবে না, বরং এ হচ্ছে বাংলার দুই প্রধান সমাজের ঐতিহাসিক গভীর তলদেশ থেকে উত্থিত দূরত্ব বা অপরিচয়েরই বহু সংকেতের একটি মাত্র। এ-বিষয়ে আমরা কেউ হয়তো মকবুল হোসেনের লেখা 888sport live পড়ে থাকবো, অথবা ওই দূরত্ব ও অপরিচয় নিয়ে তার একাধিক বক্তৃতায় হয়তো আমরা উপস্থিতও ছিলাম।

888sport appsের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেনের কথা আমরা কাহিনির আবর্তে হারিয়ে ফেলি নাই; এই জলেশ্বরীতে তার জন্ম, তার পিতৃনিবাস; পিতা মইনুল হোসেন মোক্তারের মৃত্যুরহস্য ভেদ করতেই জলেশ্বরীতে তার আসা, উঠেছে সে এখানকার ধনী কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানের নদীর পাড়ের বাংলাবাড়িতে, আর সেই কথা দিয়েই আমাদের এই কাহিনি আমরা কবে থেকে বলতে শুরু করেছিলাম। মকবুলের বাবার মৃত্যু হয়েছিলো জলেশ্বরীর পাশ দিয়ে বহে যাওয়া আধকোশা নদীর পানিতে। নদীতে তখন আষাঢ়ের ঢল। উত্তরে হিমালয় থেকে বরফ গলা পানিতে তুমুল উত্তাল নদী। সেই নদীতে কেন তার বাবা নেমেছিলেন, এ-কাহিনির প্রথম আভাস সে পায় সাইদুর রহমান মিয়ার জামাই গফুরের কাছে।

গফুর 888sport app এসেছিলো চাকরির সন্ধানে। তাকেই সে মুরবিব হিসেবে ঠাউরে নিয়েছিলো। আপনি যদি একটু চেষ্টা করেন তাহলে ব্যাংকের চাকরিটা আমার হয়ে যায়। হাজার হোক গফুর তার জন্ম শহরের মানুষ। যদিও সে জলেশ্বরীতে বহুদিন যায় না, তবু দেশের মানুষ বলে কথা। তাছাড়া 888sport appতে তার থাকার জায়গা নেই। চাকরি সন্ধান করছে, অতএব পকেটেও পয়সা নেই। অগত্যা তার বাড়িতেই থাকা-খাওয়া। প্রথম রাতেই খাবার টেবিলে গফুর বলেছিলো, আহ, আপনার বাবার কথা মনে করে এখনো টাউনের বুড়া মানুষেরা কান্দে! – কেন কাঁদে? – তার মৃত্যুর কথা মনে করিয়া কান্দে তারা। আইজকাল তো সকল কথাই সকলের বি888sport app download for android হয়া গেইছে। বুড়া সকল চলিয়া গেলে কারো কিচ্ছু 888sport app download for androidে আর থাকিবার নয়। অতঃপর গফুর মইনুল হোসেন মোক্তারের মৃত্যু কাহিনির অবতারণা করে। গফুরের কথার আভাসে রহস্য ফুটে ওঠে, মকবুলের মনে হয়, বেকার যুবকটি তার বাড়িতে থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে একটি লোমহর্ষক কাহিনি তাকে উপহার দেয়। এমত আমরা সকলেই করি। উপকার যার কাছে পাই তাকে আমরা তার সন্তোষজনক বিষয়-কথাই শোনাই।

সন্তোষজনক? মকবুলের মনে প্রশ্নেরও উদয় হয়। পিতার অপঘাতে মৃত্যুর কথা কি কারো জন্যে সন্তোষজনক হতে পারে? গফুর সবিস্তারে বয়ান করে চলে। – আমরা শুনিছি তখন ভরা বষ্যাকাল। নদী পাগল হয়া গেইছে। ঘোলা পানি চক্কর মারি মারি ছুটিয়া চলিছে। সেই পানিতে, আহ্, ক্যানে যে তিনি ঝাঁপ দিয়া পড়ে তার নির্ণয় না হয়। কাঁইও না কবার পায়। টাউনের বুড়া মানুষেরাও আপসোস করি কয়, মাথাটায় বা তাঁর বিগড়ি গেইছিলো। শুনতে শুনতে মকবুলের 888sport app download for android হয় হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় তার মায়ের সেই শেষ কথা – একবার পাকিস্তানে, একবার ইন্ডিয়ায়! একটি ধাঁধার মতো কতকাল সে করোটিতে বহন করে চলেছিলো মায়ের শেষ ওই কথাটি। কতকাল ধরে থেকে থেকে তাকে আছাড় দিয়েছে হাসপাতালে মায়ের সেই শেষ মুহূর্তটি আর শেষ ওই কথাটি। একবার পাকিস্তানে, একবার ইন্ডিয়ায়। গফুরের কাছে সবিস্তারে সব শুনবার পরেও সে কোনো কূল পায় না। গফুরও তো সেদিনের যুবক। তারও তো সব শোনা কথা। এবং উপকারীর জন্যে ইনিয়ে-বিনিয়ে অতিরঞ্জিত করে সব বলা। সত্যের ভাগ বা আভাষ তাতে কতটুকু!

মকবুলের মনে পড়ে, পাকিস্তান থেকে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে, পূর্ব পাকিস্তানের জলেশ্বরী থেকে ভারতের কুচবিহারে, মাকে নিয়ে সে যাচ্ছে একাত্তরে। একাত্তরের এপ্রিল মাসে। মান্দারবাড়ির আকবর হোসেন জলেশ্বরীর মানুষগুলোকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। সে খুব অবাক হয়েছিলো অজানা-অচেনা ওই যুবকটিকে দেখে। যুবকটিকে দেখে নয়, তার হাতে রাইফেল দেখে। রাইফেলটি যেন তার হাতে থাকবার কথাই নয়। বরং একটা বাঁশি তার হাতে হলেই যেন মানাতো। মাথায় লম্বা চুল। চোখে যেন কাজলটি পরানো। কাজল সে পরেনি, স্বাভাবিক সে কাজল। ছিপছিপে শরীর। ঠোঁটে লালিমা। এমন যুবক আমরা কত দেখি বাংলার গ্রামে-গঞ্জে। এদের চোখে স্বপ্ন। কণ্ঠে গান। এলাকার সাংস্কৃতিক আসরে এদেরই আমরা দেখি। কিংবা আকবর হোসেনকে আমরা কখনো দেখিনি, যদিওবা দেখে থাকি, ভুলে গেছি। কেবল অনুভব এই যে, যুবকটি বাঁশি বাজায় অথবা তবলা পেটায় অথবা গান গায় কিংবা 888sport app download apk আবৃত্তি করে। স্বপ্নদূতের মতো তাকে মান্দারবাড়ি থেকে হরিষালের পথে শরণার্থীর দল আবিষ্কার করে। সে রাতে ভরা পূর্ণিমা ছিলো। আকবর বলে, পূর্ণিমায় কানাহোলা ধরে। চেনা পথও অচেনা হয়ে যায়। আপনারা সেই তখন থেকে এক রাস্তাতেই ঘুরছেন। আমার সঙ্গে আসুন। আমি বর্ডারে নিয়ে যাচ্ছি। এখান থেকে বেশি দূরে নয়। তখনো তার শোনা হয়নি, তখনো তো মায়ের মৃত্যুকাল নয় যে শুনবে – একবার পাকিস্তানে, একবার ইন্ডিয়ায়।

আহ, একটি দেশ দুই ভাগ হয়ে যায়! পাকিস্তান আর হিন্দুস্তান। আমরা এর মধ্যেই দেখতে পেয়েছি, পাকিস্তান হিন্দুস্তান হবার সাতচল্লিশের চোদ্দই আগস্টের সেই দিনটিতে মইনুল হোসেন আধকোশা নদীর পাড়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কাছেই কাছারির মাঠে তখন ব্রিটিশের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের পতাকা তোলার উৎসব। মহকুমা হাকিম নেয়ামতউল্লাহর সেই ভাষণও আমরা শুনেছি – আজ থেকে আজাদ এই মাটি, আজাদ আজ মুসলমান, আজাদির চেয়ে মিঠা লব্জ আর ইনসানের জবানে নাই! ইয়ে আজাদি আজ মুসলমান কো লিয়ে এক নয়া ইশারা লেকে হাজির হুয়া। ইয়ে খোদা কি শান হ্যয় কে মুসলমান আজ ছে আজাদ হ্যয়। আল্লাহ্ জিন্নাহ সাহাব কো হায়াত দরাজ করে! আইয়ে হাম দরুদ পড়হে, দোয়া মাঙ্গে, আল্লাহকে দরবার মে হাত উঠাকে শুকরিয়া আদা করহে! শহরের সমস্ত লোক সেদিন কাছারির মাঠে, কেবল মইনুল হোসেন ছাড়া।

আধকোশা নদী সেদিন স্তব্ধ, বুকে তার স্রোতের টান নাই, ঢেউ নাই। খাপখোলা তলোয়ারের মতো ঝকঝক করছে আধকোশা, দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে – এই বুঝি সটান লাফিয়ে উঠে বিদ্যুতবেগে আঘাত করবে, দ্বিখন্ডিত করে ফেলবে সবকিছু, গলগল করে রক্তধারা ছুটবে চরাচর প্লাবিত করে। মইনুল হোসেন কাছারির ময়দানে পাকিস্তানের উৎসবে যায় নাই। অথচ নিশানের মঞ্চে থাকবার কথা ছিলো তারও, অন্তত মঞ্চের কাছাকাছি তো বটেই, মুসলিম লীগের নেতা নজির হোসেনের পাশেই। নজির হোসেন একবার আশেপাশে দৃষ্টিও করেছিলো – নাই! দু-একজনকে জিগ্যেসও করেছিলো – মোক্তার গেইলো কোনঠে? খোঁজ করি দ্যাখো, ধরি আনো তাকে। শুভ সময়ে তার হাজির না থাকা কেমন কথা! – কিন্তু ততক্ষণে পাকিস্তান জন্মের তোপ পড়ে গেছে, বিউগলে ভোঁ বেজে উঠেছে।

এই দৃশ্য নিজের চোখে দেখে নাই মকবুল হোসেন, কল্পনায় কতবার দেখেছে, কতবার সে চোদ্দই আগস্টের ভোরে আধকোশা নদীর পাড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীর পাড়ে তখন কত খন্ড নাটক, উন্মত্ত নাটক, আপাতদৃষ্টিতে সেইসব খন্ডের কোনো যুক্তগ্রাহ্য গ্রন্থনা নাই – মুকুল নামে বালকটিকে আমরা নদীর ঘাটে দেখছি, তার বিধবা মা তাকে নদীর ওপারে সদ্য হওয়া হিন্দুস্তানে পাঠাচ্ছে, কেননা পাকিস্তান এখন মুসলমানের, হিন্দুর কীবা হয় এখানে, অতএব – ভাগো! দেশ ছেড়ে চলো! আমরা দেখছি ওয়াহেদ ডাক্তারকে, সেও কাছারির মাঠে পাকিস্তানের জন্মোৎসবে নাই, বরং সে হিন্দুস্তান আর পাকিস্তানের দুই জনক গান্ধী আর জিন্নাহর পশ্চাদ্দেশে বাঁশ প্রবিষ্ট করবার সংকল্প থুতু ছিটিয়ে ঘোষণা করছে। আমরা মন্মথ দারোগাকেও দেখছি সে হিন্দু 888sport promo code মুসলমান যুবকদের হাতে নদীর পাড়ে ব্যাপারীদের চালায় ধর্ষিত হচ্ছে খবর পেয়ে ছুটে এসেছে। এরই মধ্যে আমরা দারোগাটির এতদূর বিস্ময়ে পৌঁছে গেছি যে, হিন্দু 888sport promo codeকে ধর্ষণের বদলে মুসলমান যুবকেরা 888sport promo codeটিকে ডাবের পানি পান করাচ্ছে এবং আরো যে বিস্ময় – মুসলমান যুবকেরা হিন্দু 888sport promo codeটিকে বড় ভক্তিভরে ভাবিজান সম্বোধন করছে এবং 888sport promo codeটিও তাদের প্রতি প্রীতিময়!

কিন্তু ওই যে ভাবিজান সম্বোধন, ওই যে মন্মথ দারোগা সম্বোধনের এই শব্দটিই বুঝে উঠতে পারছে না, আমাদের ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেন যদি এখানে উপস্থিত থাকতো, তবে বলতো – সম্বোধনের এইসব শব্দের সঙ্গে অপরিচয় তথা হিন্দুজনের কানে এর দুর্বোধ্যতা, এ হচ্ছে এক ভয়াবহ চিত্র, কিংবা চিত্রের একাংশ মাত্র, পুরো ছবিটি আরো মারাত্মক : সেটি এই যে হিন্দু ও মুসলমানেরা এত শতাব্দী পাশাপাশি বাস করে, আরো অধিক – হাটে বাজারে ক্ষেতে মাঠে মাছ ধরার নদীতে একই জীবন কি যৌথ জীবনই যাপন করেও, পরস্পরের থেকে কতটাই না দূরে। এবং এই দূরত্বটি মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুজনের বোধেই ও তাদের সামাজিক জীবনে উপস্থিত প্রায় সর্বাংশেই। আমাদের ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেন মর্মে মর্মে জানে, শুধু এই দূরত্ব আর অপরিচয়ের কারণেই তার 888sport alternative linkগুলোর ভারতীয় সংস্করণ কলকাতায় মোটে চলে নাই; সে খিন্ন হয়ে লক্ষ করেছে, কলকাতার এত ভালো ভালো কথা ও বড় বড় বুদ্ধিজীবীর এত বিশ্ব-দর্শন সত্ত্বেও ঘরের বাইরে ঘাসের শীষের ওপর শিশিরবিন্দুটি তারা দেখে নাই, ফলত বাঙালি মুসলিম সমাজের কথা জানবার কোনো আগ্রহ এতদিনেও বাঙালি হিন্দুজন কি পাঠকের মধ্যে মোটে গড়ে ওঠে নাই। r (চলবে)