সৈয়দ শামসুল হক
\ ৪৫ \
হরিচরণ নামে যে কেউ একজন জলেশ^রীতে এতকাল ছিল, মানুষেরা যেন ভুলেই ছিল, আজ তার মৃত্যু-সংবাদ পেয়ে সবাই হঠাৎ জেগে ওঠে। হরিচরণের বিষয়ে বাজারে কাছারির মাঠে ইস্টিশানের আড্ডায় কত কথাই না গল্পের ফুলঝুরি হয়ে ওঠে। প্রাচীন কেউ-কেউ বিশেষ একটি কথা 888sport app download for android করে ওঠে হরিচরণের বাবা রাধাচরণের বিষয়ে। সে-কথা শুনে যুবকেরা কুলকুল করে হাসে। রাধাচরণ যে গরিবের গরিব ছিল, ছুকরি সেজেই তার ভাগ্য পালটে যায়। – তোমরা কী জানিবেন ছুকরি নাচ কেমন? এলায় তো তার কদর আর নাই। যুবকেরা উৎকর্ণ হয়ে ওঠে, বিস্তর শোনার জন্যে তারা ঘন হয়ে আবদার করে, কন, চাচা, কন।
সে একটা সময় ছিল। রঙ্গ নাচের ছুকরি সাজত ছোকরারা, আর সে নাচের দলের নাম ছিল ছোকরার দল। ছুকরি সাজলে বোঝাই যেত না নাভির নিচে অন্য বস্ত্ত। এখনো যে জলেশ^রীর আশপাশে নবগ্রাম কি হাগুরার হাট বল্লার চরের দিকে হারাধনের দল টিমটিম করে ছোকরার দল চালায়, যতই সাজুক ছুকরি – মন না সেই আগের দিনের মতো উথালপাথাল হয়। সে-নাচের রস আজ আর নাই। তবে, মান্দারবাড়ি হস্তিবাড়ির দিকে এখনো কিছু খোশাল লোক আছে, তাদের ওখানে আসর হয়। খোশাল তো নয়, আসলে গরিব। সিনেমা দেখার পয়সা নাই, ছোকরা-নাচেই হাউশ পুরায়। লাঠিভর বুড়ারাও আসে। হাউশ এমন, যেন দুধ। জ্বাল দিতে-দিতে ক্ষীর। আমোদেরও সেই ভাব – যত বয়স তত ঘন।
হরিচরণের বাবা রাধাচরণের ভাগ্য খুলে যায় তার ছুকরি-রূপের কারণে। মান্দারবাড়িতে সেই কতকাল আগে রাজা ছিল প্রতাপ রায় নামে, তাঁর বংশধর মহেন্দ্র রায় তখন রাজা, তাঁর নজরে পড়ে যায় রাধাচরণ। রানী ছিল তাঁর তিনজন, যাদের রূপের ছটায় চোখ ধাঁধায়, রাধাচরণের ছুকরি-রূপের কাছে মহেন্দ্র রাজার চোখে তারা কিচ্ছু না হয়ে যায়। যুবতী দাসী ছিল তাঁর কত, 888sport free betয় না বলা যায়, রূপেও তারা কম নয়, যৌবনের দাপ ঠমকে নটিকেও হার মানায়, রাজার কাছে তারাও কুৎসিত হয়ে পড়ে। রাধাচরণের জন্যে পাগল হয়ে যান মহেন্দ্র রাজা। মান্দারবাড়ির উত্তরে শটিবাড়িতে আছে তাঁর এক কাছারি, সেই কাছারিতে ছিল এক বাগানবাড়ি। রাজা কখনো শটিবাড়ি গেলে সেখানে রাত্রিবাস করতেন। টিনের বাহারি নকশাকাটা ঘর, সামনে ফুলের বাগান, বাগানে ঝুলনা, সামনে পুকুর। রাধাচরণকে ছোকরা-নাচের দল থেকে তুলে এনে রাজা তাকে বসত করালেন সেই বাড়িতে। নিজেও এসে থাকতে শুরু করলেন। রাতভর রাধাচরণের সঙ্গে। দিনভর রাধাচরণের সঙ্গে। রাজত্বের দিকে মন নাই, শুধু রাধাচরণ আর রাধাচরণ। শখ করে তাকে রাধা বলে ডাকতে শুরু করেন। স্বয়ং কৃষ্ণ বোধে রাজা জগৎ-বিস্মৃত হন। রানীমহলে সাধু-সন্ন্যাসী, ওঝা-ফকিরের আগমন শুরু হয়ে যায়। তুকতাক রুপার টাকা উজাড় হয়ে যায় রানীদের, রাজার মন ফেরে না রাধাচরণ থেকে। সেই বান টোনা জাদু মাদুলি ফুঁকফাঁক কতই না করা হয়, আসল কাজ হয় সময়ের গতিকে। সময় তো থেমে থাকে না, বয়সও লাগাম দিয়ে রাখা যায় না, দিন যায়, একদিন রাধাচরণের গোঁফদাড়ি ওঠে, ক্রমে ঘন কালো হয়, কিছুদিন খুব ক্ষুর চলে, দিনে-দিনে দাড়ি এত কর্কশ হয়ে পড়ে তার যে শানানো ক্ষুরের ধারেও মুখে তার মসৃণতা আর ফেরে না, রাজার মন বিষণ্ণ হয়ে যায়, রাজার কৃষ্ণভাব ঘোচে। রাধাচরণকে তিনি নির্বাসন দেন জলেশ্বরীতে। লোকে বলে, সেইসঙ্গে বিস্তর জমিজমা তিনি লিখে দেন রাধাচরণের নামে, আর সেই সূত্রেই হরিচরণের এত সম্পত্তি আধকোশার এপারে।
কুসমির কথাও উঠে পড়ে হাটে-বাজারে। একে মেয়েমানুষ, তার ওপর যুবতী এবং বিধবা, এবং সুন্দরী, আর কথা কী! সম্পত্তি রক্ষার জন্যে কুসমি যে কত অফিসারকে সুখ দিয়েছে, সত্য-মিথ্যা সেইসব গল্পকথা লতিয়ে ওঠে মুখে-মুখে। জলেশ^রীর বউ-ঝিরা গা টেপাটেপি করে, ফিসফাস করে, তাদের দেহঅগ্নিতে কুসমির ঘৃত পড়ে, কামরসে তারা সিক্ত হয় এবং আরো সিক্ত হওয়ার আকাঙক্ষায় তারা তিলকে তাল করে তোলে, নিজেদের অতৃপ্ত বাসনার উপকরণে তারা কুসমিকে সাজায়, কুসমির কথা অচিরে এক রগরগে 888sport alternative linkে পরিণত হয়।
কুসমির টানে-টানে বৃদ্ধরা মুকুলের বিধবা মায়ের কথাও 888sport app download for android করে ওঠে। সেও ছিল যুবতী এবং বিধবা, সুন্দরী এবং অরক্ষেতা। যখন সে নদী পেরিয়ে ইন্ডিয়া যাওয়ার জন্যে নদীর পাড়ে আসে তখন নদীর পাড়েই উপস্থিত কিছু মুসলমান যুবকের নজরে পড়ে যায়। এই যুবকেরাই মুকুলের মাকে নাকি খুব সমাদর করে ইন্ডিয়া পৌঁছে দেয়। – আরে, এলাও 888sport app download for android হয়, যুবকেরা তাকে গরুর গাড়ি করি হরিষাল পজ্জন্ত দিয়া আসে, তবে – এইখানে সেই বৃদ্ধ তার বাক্য থামিয়ে খলখল করে হেসে ওঠে। – হাসেন ক্যানে, দাদু, খুলিয়া কন। – খুলিয়া আর কী কমো ভাই, নদীর পাড় হতে তাকে তোলা আর ইন্ডিয়ার দিকে রওনা হয়া ওপারে যাওয়া, ইয়ার ফাঁকে তিনদিন গুজরি যায়। এই তিনদিনের কোনো খবর নাই। বৃদ্ধ আবার খলখল করে হেসে ওঠে। বাক্যের অধিক সেই হাসি। সাতচলিস্নশের সেই মুসলমান যুবকেরা যে মুকুলের মাকে সম্ভোগ করে তিনদিন ধরে, সত্য কি মিথ্যা এই ঘটনা, মুকুলের মাকে এখনকার শ্রোতা যুবকের কেউই চোখে দেখে নাই, তবু তাদের যুবক শরীরে তারা রক্তের মাতাল টান অনুভব করে ওঠে।
এই সূত্রে হিন্দু-মুসলমান যুবক-যুবতীর কত ভালোবাসার গল্পই না উঠে পড়ে জলেশ^রীতে। – বাহে, সেই পরেশ ডাক্তারের বেটির কথা শুনিছিলোম, মোছলমান এক ছোকরার সাথে তার সম্পক্ক হয়। এ সম্পক্ক ডাক্তার মানিবার নয়। বেটিকে তাই ঘরে শিকল দিয়া রাখে। তার বাদে সে-বেটি একদিন পায়খানায় যায়া শরীরে ক্রেচিন ঢালি দিশলাই শলা ধরি অগ্নি জ্বালি দেয়। সোনার শরীর তার পুড়ি ছাই হয়া যায়। একটা যে জীবন শ্যাষ হয়া গেইলো, তবে একখান সওয়াল থাকি গেইলো, সে নিজের জীবন নিজেই নেয়, না তাকে খুন করা হয়! এ কথার নির্ণয় এলাও হয় নাই। বক্তা এই বৃদ্ধটি দীর্ঘশ^াস ফেলে আসর থেকে উঠে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলে, বাপজানের কাছে শুনিছিলোম ডাক্তারই তার বেটির গায়ে আগুন দেয়।
আবার এরই টানে আরেক আসরে আরেক গল্প ওঠে। মুসলমান যুবককে ভালোবাসার কথা টের পেয়ে হিন্দু পিতাটি তার মেয়েকে নিয়ে রাতারাতি ইন্ডিয়া চলে যায় রেলপথে। দর্শনা পার হয়ে ট্রেন ইন্ডিয়ায় ঢোকার পর গু-াদের হাতে মেয়েটি অপহৃত হয়, তাকে আর পাওয়া যায় না। যে-ইন্ডিয়ায় গেলে মুসলমানের হাত থেকে মেয়েটিকে বাঁচানো যাবে ভেবেছিল তার পিতা, সেই ইন্ডিয়াতেই মেয়েটির সর্বনাশ হলো। এর চেয়ে কি ভালো ছিল জলেশ^রীতেই থেকে যাওয়া এবং মুসলমানের সঙ্গে মেয়ের ভালোবাসাটি মেনে নেওয়া? হাহাকার করতে করতে বাবা ফিরে আসে জলেশ^রীতে, ফিরে এসে দেখে তার শূন্য ফেলে রাখা বাড়িটিতে বিহার থেকে আসা উদ্বাস্ত্ত এক পরিবার জাঁকিয়ে বসে আছে। – সেই হতভাগা তার বেটিকেও হারায়, ভিটাও হারায়, আমও যায় তার ছালাও যায়।
হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপারটি নিয়ে নানা গল্পকথা যখন 888sport promo code ও সম্পত্তি বিষয়ে জলেশ^রীতে হতে থাকে, তখন তার টানে-টানে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা আর সাতচলিস্নশের দেশভাগের কথাও দু-এক যুবকের আলোচনায় উঠে আসে। একজন বলে, হিন্দু-মুসলমানের ভিত্তিতে এই দেশভাগ মেনে নিতে পারি না। আরেকজন বলে, তোমার একার মানা না-মানা, আর এতদিন পরে একথা বলা, এর কোনো অর্থ নাই। ইতিহাসের শরীর বেয়াড়া বলদের মতো, একবার শিং তুলে যেদিকে সে ছুটবে, তোমাকেও তার পিছে-পিছেই যেতে হবে, প্রয়োজনে দৌড়ে যেতে হবে। নইলে বলদটাই তোমার হাতছাড়া হয়ে যাবে! তৃতীয় যুবককে তখন বলতে শোনা যায়, হিন্দু-মুসলমানের ভিত্তিতে দেশভাগের ভুলটাকে শুধরে নিয়েই তো 888sport appsের জন্ম হয়। ভাষার ভিত্তিতে জাতি, আর সেই জাতির রাষ্ট্র 888sport apps। – ভাষার ভিত্তিতেই যদি জাতি আর সে-জাতির জন্যে রাষ্ট্র, তবে ওপারের বাঙালিরা সীমামেত্মর ওপারে কেন?
বৃদ্ধদের মনে পড়ে, সাতচলিস্নশের সেই আগস্ট মাসে জলেশ^রীর যতীনবাবু আক্ষেপ করে বলতেন, পাকিসত্মান হিন্দুস্থান হতো না, বাংলাও ভাগ হতো না, যদি নেতাজি আজ থাকতেন। এরপরই তিনি আরো একটি নাম উচ্চারণ করতেন – রবীন্দ্রনাথ! হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথও বাঁচিয়া থাকিলে বাংলা ভাগ হইতো না!
বাংলাভাগ! বাংলার বুক চিরে বিভক্তির লাল রেখা। সাতচলিস্নশের চোদ্দোই আগস্ট আধকোশা নদী গেছে ইন্ডিয়ার ভাগে। নদীর পাড়ে মইনুল হোসেন মোক্তার। নদীর বুক ঝকঝক করছে আয়নার মতো। কিন্তু কোনো ঢেউ নাই। নদী যেন প্রাণহারা। নদীর সেই গতিবেগ নাই। দেখেও কল্পনা করা আর নাই যে এই নদী একদিন বর্ষাকালে কী প্রচ- রূপ নেবে ও অতীতে নিয়েছে – ধড়াসধস পাড় নদীগর্ভে তলিয়েছে, বাড়িঘর গিলেছে, সড়ক খেয়েছে, মানুষও খেয়েছে উন্মাদিনী আধকোশা। মইনুল হোসেন স্থিরদৃষ্টি তাকিয়ে আছে নদীটির দিকে। এই সেই নদী! যতই সে চ- হোক, যতই সে শহর-খাদক হোক, যতই সে আমাদের দুঃখের কারণ হোক, তবু সে আমার নদী! আমার আধকোশা! জননী যতই মারুক-ধরুক তবু সে জননী। তার দুগ্ধ তারপরও পান করিবার মতো হে!
মইনুল হোসেনের মনে হাহাকার – ওই যারা পাকিসত্মানের নিশান নিয়ে নাচানাচি করছে, তাদের কি জানা নাই আধকোশা আর আমার দেশের নদী নয়? র্যাডক্লিফ সাহেবের লাল পেনসিলের দাগে আধকোশা এখন হিন্দুস্থানের! জলেশ্বরীর পাড় বরাবর নদীই এখন হিন্দুস্থান-পাকিসত্মানের সীমান্ত। হাহাকার – আজ থেকে নদী তবে আর আমার নয়! এই আধকোশা এতকাল পরে তবে পর হয়ে গেল। এখন সে সীমামেত্মর ওপারে! আর, সীমান্তই কাকে বলে? কোনো রেখা তো দৃষ্টিপথে নাই। আছে! র্যাডক্লিফ সাহেবের টেবিলে বিছানো বাংলার মানচিত্রের বুকে লাল পেনসিলের দাগ! যেন রক্তধারা! রক্তের রেখার ওপারে এখন আধকোশা। ওপারের ওই বালি বিসত্মীর্ণ পাড় আর আমার নয়। ওপারের ওই ঝাউগাছ আমার নয়। ঝাউগাছের ভেতর দিয়ে বহে যাওয়া বাতাসও আর আমার নয়! বালির বুকে ওই ঘূর্ণিও আমার নয়। খেয়াঘাটের ওই বিরলে যে শনের ছাপরা চোখে পড়ে, ওই যে সেই ছাপরায় চা বানায় হাশমত, তার চুলার আগুনও আর আমার নয়, তার গেলাসের চা-ও আর আমার নয়, তার ছাপরার আড়ে ঝোলানো মালভোগ কলার ছড়ও আমার নয়, ওই পায়ে চলা পথের চিহ্ন আর আমার নয়, ওই সরু পথটির উঠে যাওয়া ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়কে, তাও আর আমার নয়। আর আমার পায়ের তলায় তার ধূলি না লাগিবে হে! অন্য দ্যাশের ধূলি হয়া গেইছে আইজের ফজরে। ওপারের ওই আসমানও বুঝি পর হয়া গেইছে। সব মিছামার হয়া গেইছে গো। বুক ভাঙি নিয়া গেছে ঢলের আগেই এ কোন ঢল কোন পর্বত হতে নামিয়া!
মইনুল হোসেন মোক্তার জীবিতের সকল বিস্ময় ও ধন্দ নিয়ে তাকিয়ে থাকে আধকোশার দিকে। তার বিশ্বাস হয় না নদী সে দেখছে। নদীজল ছলছল করে, রুপার আয়নার মতো ভেঙে-ভেঙে যায় যে জল, সেই জল আজ স্তম্ভিত হয়ে আছে। জ্বলজ্বল করছে ভীষণ খাঁড়ার মতো। জলেশ্বরীর নারায়ণ নামে ভীষণ দর্শন মানুষটির হাতে দুর্গাপূজায় মহিষ বলির জন্যে উদ্যত খাঁড়ার মতো ঝকঝক করছে, যমদেবতার অট্টহাসি যেন ঠিকরে-ঠিকরে পড়ছে। এই নারায়ণের কাছেই তো শহরের কংগ্রেস নেতা রাজেনবাবু এসেছিলেন – হা রে, নারায়ণ, শুনিছিস তো! কইলকাতায় হিন্দু বিনাশ করিতে মোছলমানেরা ছোরা-তাওরাল নিয়া বির হইছে! কচুকাটা করিচ্ছে!
ছেচলিস্নশের কলকাতায় সেই হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। কে প্রথম দাঙ্গা শুরু করেছিল? হিন্দু? না, মুসলমান? একদল বলে মুসলমানেরাই শুরু করে। মীনা পেশোয়ারী নামে এক পাঠান গুন্ডা সর্দারের কথা খুব শোনা যায়। বলা হয়, সোহরাওয়ার্দীর গোপন নির্দেশেই – আর আসল নির্দেশটা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহরই – মীনা পেশোয়ারী হিন্দুদের কতল করতে শুরু করে। কিন্তু এর বিপরীতে বলা হয়, না, হিন্দুরাই শুরু করে হত্যাকা-; কিন্তু মীনা পেশোয়ারীর মতো কোনো মাতবর হিন্দু গু-ার নাম এ পর্যন্ত কেউ উদ্ধার করতে পারে না, পুলিশ রেকর্ডেও পাওয়া যায় না। বরং সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়, ব্রিটিশ বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দাঙ্গার দিনগুলো লালবাজারের থানায় বিনিদ্র দিনরাত বসে থেকেছেন দাঙ্গা থামাবার জন্যে। আমরা আরো জানতে পাব, একদিন যে এই পূর্ববাংলা – র্যাডক্লিফের লাল পেনসিলের দাগে গড়ে ওঠা পূর্ব পাকিসত্মান – যে বাঙালির সার্বভৌম 888sport apps হয়ে ওঠে, তার কারক ও জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই ছেচলিস্নশ সালে ছিলেন কলকাতায়, কলেজপড়ুয়া ছাত্র তিনি তখন, কিন্তু রাজনীতিতেও পাঠ নিচ্ছেন, অংশ নিচ্ছেন; সেই তিনি সেই দূর কালে নিজের জীবন বিপন্ন করে মানুষ সকলকে গু-াদের হাত থেকে রক্ষা করতে নেমে পড়েছিলেন। সম্ভবত সেই প্রথম তিনি প্রত্যক্ষ অনুভবে হিন্দু নয়, মুসলমান নয়, মানুষকে মানুষ হিসেবে ধারণ করে উঠেছিলেন, যার ভিত্তিতেই ছিল তাঁর সমগ্র রাজনৈতিক জীবন ও 888sport appsের কল্পনা।
ছেচলিস্নশের সেই জলেশ্বরীতে রেডিও নাই। আজ এটা ভাবাও যায় না, ঘরে-ঘরে রেডিও তখনো আসে নাই বাংলায়। কলকাতা থেকে দাঙ্গার খবর তাই তৎক্ষণাৎ জলেশ্বরীতে পৌঁছায় নাই। জলেশ্বরীতে খবরের কাগজও আসে কলকাতায় বের হওয়ার একদিন পরে, ভোরের ট্রেনে। আগস্ট মাসের সতেরো তারিখে জলেশ্বরীতে ভোরের ট্রেন আসে, কিন্তু লাগেজ ভ্যান থেকে খবর কাগজের বান্ডিল নামাতে গিয়ে বশির হকার দেখে বান্ডিল আসে নাই। এমন কা- সচরাচর হয় না। প্রতি ভোরেই ট্রেন আসার আগেই হিন্দু-মুসলমান কয়েক যুবক ইস্টিশানে নিয়মিত আসে বশিরের হাত থেকে টাটকা পত্রিকা নেওয়ার জন্যে। বশিরকে ট্রেনের লাগেজ ভ্যান থেকে খালি হাতে নামতে দেখে তারা কলরব করে ওঠে। – তুই ভাল্ করি দেখিছিস তো রে বছির? – হয়, হয়, নাই। – ফির দ্যাখ যায়া। গার্ডকে পুছ কর্। – করিচ্ছো। গার্ডেও কইলে পার্বতীপুর হতে পত্রিকার বান্ডিল ওঠে নাই। – রংপুরে? – অমপুরের খবর পাঁও নাই। অমপুরে হয়তো বা গেইছে। বিরস হয়ে যুবকেরা যে যার বাড়িতে বা কাজে ফিরে যায় পত্রিকা বিনা খালি হাতে।
দুপুরের দিকে পোস্টাফিসের হরেন মাস্টার, যার হাতে টেলিগ্রাফের টরেটক্কা, বার্তা প্রেরণের হ্রস্বদীর্ঘ টকটক মারফত এক সংবাদ পায় – তার মর্ম সে উদ্ধার করতে পারে না। বার্তাটি এসেছে জলেশ্বরীর হাকিমের নামে। ঊর্ধ্বশ্বাসে টেলিগ্রাফ মাস্টার বার্তাটি রওনা করে দেয় হাকিমের দফতরে। সংকেতে, যাকে আমরা সাইফার বার্তা অর্থাৎ সাধারণ মানুষ না বুঝতে পারে কিন্তু সংকেত বুঝে পাঠ উদ্ধার করা যায় এমন বার্তা বলে জানি, এটি আসে কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং থেকে। সাইফার বার্তাটি মহকুমা হাকিম সংকেত ভেঙে পাঠ করে চমকে ওঠেন। কলকাতায় দাঙ্গা শুরু হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান একে অপরকে আক্রমণ করছে। তোমার এলাকায় শামিত্ম যাতে বজায় থাকে তার ব্যবস্থা অবিলম্বে গ্রহণ করো। অবিলম্বে শহরের হিন্দু ও মুসলিম নেতাদের নিয়ে আলোচনায় বসো। এখন মানুষেরা বলাবলি করে, বসিয়া কোন লাভ হইতো? হিন্দু-মুসলমান যে ভাগ-ভাগ হয়া গেইছে, কে তাকে ফির জোড়া দিবে?
পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নই প্রথমত উত্থাপিত হয় সাধারণ মানুষের কণ্ঠে। এবং সে-কণ্ঠের উচ্চারণ উত্তরবিহীন মিলিয়ে যায় বাতাসে। জীবন চলেই চলে। ইতিহাস নয় বরং জীবনটাই হচ্ছে বেয়াড়া বলদ – কখন যে কোনদিকে ধাবমান হবে তার ঠিক নেই, তার নিয়ন্ত্রণটাও সব সময় আমাদের হাতে থাকে না। একই দিনে যে হরিচরণ ও বলরামপুরীর মৃত্যু হবে কে ভেবেছিল? এদের একজন হবে হিন্দু আরেকজন হবে মুসলমান, এটাও কি ভাবা গিয়েছিল? কিন্তু ঘটনা যখন ঘটেই যায় তখন এর পূর্বাপর নিয়েও কথা ওঠে। r (চলবে)

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.