নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক
॥ ২২ ॥
ইতিহাস শুধু মানুষকেই হত্যা করে না, ঘোড়াও ইতিহাসের হাতে নিহত হয়! হ্যাঁ, ঘোড়াও বাদ যায় না ইতিহাসের ধারালো খড়্গ থেকে, কিংবা বন্দুকের গুলি থেকেই। আমরা মানিকগঞ্জের সেই জমিদারবাড়িতে না হয় যাই, সেখানে সেই তিনটি ঘোড়া আমরা একবার এই সুবাদে দেখে লই। বড় শৌখিন নাম ছিল ঘোড়া তিনটির – ঝড়, ঝঞ্ঝা আর বিদ্যুৎ, আর এই নাম রেখেছিল জমিদারের মেজ কুমার সত্যেন্দ্রনারায়ণ। বিহারে হরিহরছত্রের মেলা থেকে একলপ্তে ঘোড়া তিনটি কেনা হয়। তখন কী উদ্দাম বুনো ছিল, সহজে কি বাগ মানতে চায়, পোষ করাতেই মাসাবধি লেগে যায়। জমিদারবাড়ির মাঠে যখন তাদের নিয়ে পোষ মানাবার তদবির চলতো, গাঁয়ের মানুষ দূর থেকে সেই তামাশা দেখতো আর সভয়ে ছোটাছুটি করতো যে, এই বুঝি ঘোড়া এসে তাদের ওপর হামলে পড়ে। কিন্তু সহজে ছাড়বার পাত্র নয় সত্যেন্দ্র। বড় কুমার রণেন্দ্র হাঁক দিয়ে বলতো, ও বনের ঘোড়া, বিদায় করে দে। কিন্তু হাল ছাড়ে নাই সত্যেন্দ্র। – না, দাদা, দাপটে তোমার বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়, তুমি সবুর করো, তোমার পায়ের কাছে এসে নাক ঘষবে। হলোও তাই। মাসাবধি কালের মধ্যে শান্ত-সুবোধ হয়ে গেল প্রাণী তিনটি। রণেন্দ্র প্রথম যেদিন চড়লো ঘোড়ার পিঠে, হ্রেষা তুলে স্বাগত করলো তাকে, তারপর দুলকি চালে গাঁ ঘুরিয়ে আনলো। ঘোড়া তিনটিকে সত্যেন্দ্র েস্নহ করতো সন্তানের মতো, নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের নিত্যভোরের দলাইমলাই তদারক করতো, নিজহাতে দানা খাওয়াতো। সত্যেন্দ্রর নিজ ঘোড়াটি ছিল বিদ্যুৎ, ঝঞ্ঝা ছিল ছোট কুমার রমেন্দ্রর, আর ঝড় ছিল বড় কুমার রণেন্দ্রর। রণেন্দ্র ঘোড়ার পিঠে বড় বিশেষ উঠতেন না, তার ছিল পালকি, কালেভদ্রে মানিকগঞ্জে যাওয়া পড়লে সে পালকিতেই যাতায়াত করতো। ছোট কুমার নামেই ঝঞ্ঝার মালিক, গায়ে-পিঠে হাত বুলাতো, পুণ্যাহর দিনে নিজ হাতে সাজপোশাক পরিয়ে দিত ঘোড়ার, ক্বচিৎ তার পিঠে উঠতো। কিন্তু সত্যেন্দ্র ছিলো ঘোড়ার সওয়ারি, ভোরে একবার, বিকেলে আরেকবার বিদ্যুতের পিঠে তার ওঠা চাই, মানুষ অচিরে তাকে ঘোড়ার পিঠে ভিন্ন 888sport app download for androidে আর গাঁথে নাই। আজও মানিকগঞ্জের তেওতার মানুষেরা সত্যেন্দ্রর ছবি ঘোড়ার পিঠে সওয়ারিরূপেই কল্পনা করে ওঠে।
এই ঘোড়ার গল্প আমরা শুনেছি মকবুল হোসেনের সঙ্গে বসে সাইদুর রহমানের বাংলাবাড়িতে। গল্প করেছিল বাবুর্চি আলাউদ্দিন মিয়া। – তখন হিন্দুস্থান পাকিস্তান হইলো, দ্যাশ ভাগ হইলো, ঘোড়া তিনটারও মউত ঘনাইলো, তবে শোনেন সেই কথা।
জলেশ্বরী এসেছে থেকে আলাউদ্দিনের হাতের রান্নায় মুগ্ধ হয়ে পড়ে মকবুল হোসেন। প্রথম দিনেই মুরগির কোরমা আর শাদা পোলাও আলাউদ্দিন যা করেছিল, মকবুলের মনে পড়ে গিয়েছিল মায়ের কথা। মায়ের হাতেও একই পদ কী আহ্লাদ করেই না খেতো মকবুল। ছোটবেলায় আশা করে থাকতো কবে মা পোলাও কোরমা রাঁধবেন। গরিব ছিল তাদের আশ্রয়দাতা মামারা। ঈদের পরব ছাড়া পোলাও? কালেভদ্রে। সেটাও মামাদের শ্বশুরবাড়ির মুরুব্বি কেউ এলে। সাইদুর রহমানের বাংলাবাড়িতে প্রথম দিনেই রাতের খানায় সেই পোলাও সেই কোরমা। – হাঁ, আলাউদ্দিন, আপনার হাত খুব ভালো। আমার মা এ রকম রান্না করতেন। তা আপনার বাড়ি কোথায়? – মানিকগঞ্জে। আমার দ্যাশে গেছেন কখনো, ছার? – দুই একবার! – কেন, 888sport appর কাছেই তো! – হলেও, যাওয়া হয় নাই, আলাউদ্দিন মিয়া! – আমার বাড়ি মানিকগঞ্জের ভিতরে তেওতায়, ছার। তেওতার রাজবাড়ি কি আপনে দ্যাখছেন? – না, দেখি নাই। – আলাউদ্দিন নীরব হাহাকার করে মাথা দোলায়। – আহ, যদি দ্যাখতেন! জমিদারের বংশ তো সেই পাকিস্তানের সময় পাকিস্তান যখন হয় তারা ইন্ডিয়া চইলা যায়। ঝাড়ে বংশে তারা দ্যাশ ছাড়ে। আমার তখন বাইল্যকাল। সব কথা 888sport app download for android নাই। তবে ছবিটা মনে আছে। তারা গ্যালো যে গ্যালো, জমিদারের ছোট ছেলেটা, ছোট ছেলে মানে যুবক তিনি, নিজের হাতে রাজবাড়ির তিনটা দুধের মতো শাদা ঘোড়ারে মাঠের মইধ্যে খাড়া করায়া বন্দুকের গুল্লি কইরা মারলো। নিজের হাতে। চক্ষে পানি নাই। মুখের চেহারা চেনন যায় না এমন কঠিন। ক্যান ক্যান নিজের হাতে মারেন ক্যান? এই ঘোড়ায় চইড়া না শিকারে যাইতেন। এই ঘোড়ায় না আপনেদের জুড়িগাড়ি টানতো। এই ঘোড়া না ঈদের দিনে পূজার দিনে জরির সাজপোশাকে সাজাইতেন। আর মেলায় আনতেন। আর দৌড়বাজি দেখাইতেন। এখন নিজের হাতে জান কবচ করলেন? মুরুব্বিরা তখন কইতো শুনছি, পাকিস্তান মোসলমানের দ্যাশ, হিন্দুর জাগা নাই পাকিস্তানে, এই রকম একটা রব চাইরদিকে। পঞ্চাশ সালে তো রায়টও লাগলো 888sport appয়। হিন্দুরা এক লহরে তখন ইন্ডিয়া যায়া সারবার পারে না, এই মারে কি এই তাওরাল দিয়া মাথা কাটে। মুরুব্বিদের কাছেই শুনছি, জমিদারবাবুদের ওই ঘোড়া মারা দেইখা তারা যখন তাজ্জব বেকুব হয়া গেছে, তখন তারা কয়, মানুষই পলায়া সারতে পারি না, ঘোড়া! আর এই ঘোড়া পাকিস্তানের জন্যেও থুয়া যামু না। বোঝেন তা হইলে! কী অবস্থা! হিন্দু জমিদার। রাজবংশ। মানুষে ডরে থরথর করতো তাদের দেখলে। সালাম দিয়া মাথা তুলতো না যতক্ষণ না চক্ষের আড়াল! আর সেই জমিদার বংশ, রাজার বংশ, আইজ পাকিস্তানের ডরে মোসলমানের ডরে দ্যাশ পলায়! ছার, তবে একবার রাজবাড়িটা সুযোগ পাইলে দেইখা আইসেন। পাঞ্জর ভাঙলে মানুষ যেমন দ্যাখা যায়, বাড়িটাও পাঞ্জর ভাঙা বিরান এখন। আর মন্দিরটাও দ্যাখবেন, ছার। তারা হিন্দু হইলেও জগতের সৃষ্টিকর্তা যে আছেন একজন, সেইটা তো তারা মানে। নাকি! আইজ মন্দিরের সামনে গিয়া খাড়াইলে আপনের মনে হইবো, সেই তাদের সৃষ্টিকর্তাও বুঝি পাকিস্তানের ডরে ইন্ডিয়া চইলা গ্যাছে, মূর্তিখান পইড়া আছে। মূর্তির হাত-পাও নাই, তাই যাইতে পারে নাই। মকবুল সবেদন বিস্মিত ও সম্মোহিত হয়ে পড়ে। আলাউদ্দিনের 888sport sign up bonus-কথনের ভাঁজে-ভাঁজে সে যেন অস্পষ্ট দুর্বোধ্য দূরাগত একটি কাতরধ্বনির কম্পন টের পায়। অথবা তখন পায় না। বহু পরে এটি সে আরোপ করে, যেমন আবহসঙ্গীতকার যোজনা করে live chat 888sport দৃশ্যে।
আমরা সেই দিনটিকে একবার কল্পনা করি না কেন! তেওতার রাজবাড়ির মাঠে সবুজঘাসের চাদর ঝকমক করছে রোদের তেজে। শীতের রোদ, যেমন মিষ্টি তেমনি মোলায়েম; এমন রোদে পিঠ রেখে মানুষ জীবনপ্রেমী হয়ে ওঠে, ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে পড়ে, সৃষ্টির সমুদয় মানুষের চোখে অপার্থিব বলে বোধ হতে থাকে। সেদিনও মানুষেরা রোদে এসে দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু ঈশ্বরকে আর নিজস্ব বা নিজপ্রভু করুণার প্রভু বলে তাদের মনে হয় নাই, কেননা তারা এমন দৃশ্য দেখে নাই কিংবা এমন হবে স্বপ্নেও ভাবে নাই। দেশভাগ! দেশটা তো দেশই আছে, কিন্তু নাকি ভাগ হয়ে গেছে – হিন্দুস্থান পাকিস্তান তো নয়, হিন্দু আর মুসলমানই ভাগ হয়ে গেছে। মানুষেরা দেখেছে জমিদারবাড়ি থেকে একে একে বাকসোপ্যাঁটরা টমটমে উঠছে আর আরিচার ঘাটে যাচ্ছে। কী, না – আরিচা থেকে ইস্টিমারে গোয়ালন্দ যাচ্ছে। গোয়ালন্দে কেন? কেন আবার, সেখান থেকে রেলগাড়িতে কলিকাতায়। কলিকাতায় কেন? আরে, কলিকাতা যে হিন্দুস্থানে, হিন্দু জমিদার তল্পিতল্পা নিয়ে কলিকাতা যায়, হিন্দু যায় হিন্দুর দেশে! দিনের পর দিন, দিনের পর দিন, বাকসোপ্যাঁটরা, বড় বড় সিন্দুক, কোষা, তারপর একে একে বুড়িরা, মহিলারা, বালিকারা, বালকেরা; বড় কুমার তো আগেই গেছে, ছোট কুমারও পরশুদিন আরিচায় রাজা কোম্পানির জাহাজে গিয়ে উঠলো।
কিন্তু মেজ কুমার সত্যেন্দ্র তখনো যায় নাই। লোকেরা বলাবলি করে – না, মেজ কুমার থাইকা যাবে। মাটির টান তার। মাটি তাকে রাইখবে। বাপদাদার দ্যাশ ছাইড়া যাইতে তার পরান কান্দে। থাইকবে, মেজ কুমার থাইকবে, এই দ্যাশেই থাইকবে গো! কিন্তু তারা জানে না, মেজ কুমারও যাবে, চলে যাবে, পাকিস্তান ছেড়ে হিন্দুস্থানেই সে যাবে। – কিন্তু এখানে তো দাঙ্গা হয় নাই, হিন্দু মোসলমানে কাটাকাটি হয় নাই, বাপের মতো প্রজা পালন কইরাছে গো, বংশের পর বংশ তারা আমাগো দেইখা রাখছে, বিপদে আপদে ঢাল হয়া খাড়াইছে, আমাগো শোকেতাপে পাশে খাড়াইছে, এখন সেই সন্তান থুয়া এতিম কইরা কলিকাতা যাবে তারা কোন পরানে গো! না, আমাগো মেজ কুমার যাইবে না। লোকেরা তবু নিশ্চিন্ত হতে পারে না, মনের মধ্যে ভয় লাফায়, গুরগুর দুমদুম করে ভয়; হবে না কেন? এই যে মেজ কুমার জমিদারির তাবৎ প্রজার সঙ্গে কথা বলতো যেন জমিদার নয়, তাদেরই বাড়ির মানুষ, সেই মেজ কুমার আজকাল কথা তো বলেই না, চোখ তুলেও কারো দিকে তাকায় না।
সেদিন ভোরে মানুষেরা এক আশ্চর্য ঘটনা দেখে; মেজ কুমার আস্তাবলের দরোজা নিজ হাতে খুলে বজ্র, বিদ্যুৎ আর ঝঞ্ঝাকে এনে মাঠে দাঁড় করায়; সহিস মজনু মিয়াকে দেখা যায় মাঠের প্রান্তে বিষণœ মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে। – কী মজনু, তুমি দূরে ক্যান? – আমাক্্ কইছে তফাৎ থাইকতে। – ক্যান, তফাৎ থাইকতে কইছে ক্যান? মজনু এর উত্তর জানে না। ভোরে সে যখন আস্তাবলে যায় মেজ কুমার তাকে বলে, মজনু, তুই কাছারি যা। মজনু অবাক হয়। এত ভোরে কাছারি যাবার হুকুম কেন? মেজ কুমার ধমক দিয়ে বলে, কাছারিতে যতীন বসে আছে তোর মাইনাপত্তরের হিসাব নিয়া। ব্যস এইটুকুই। তবে কি তার আর দরকার নাই? দরকার নাই তো ঘোড়ার খিদমত করবে কে? মজনু আতান্তরে পড়ে মাঠপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে ঢিল খাওয়া মানুষের মতো। মেজ কুমারের থমথমে মুখ দেখে তখনো তার অনুমান হয় নাই কী ঘটতে যাচ্ছে।
আমরা দেখি, লোকেরাও দেখে – মেজ কুমার ঘোড়া তিনটিকে মাঠের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে তাদের ঘাড়ে-পিঠে হাত বুলোয়, কেশর চুলকে দেয়, রানের ওপর আদরের থাপড় মারে, থুঁতনি ধরে নাড়িয়ে দেয়। মানুষের আগে জন্তু-জানোয়ার অনেক কিছু আগাম টের পায়। বজ্র, বিদ্যুৎ আর ঝঞ্ঝার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। মেজ কুমারের গায়ে লাল শাল জড়ানো, শালের প্রান্ত দিয়ে ঘোড়াগুলোর চোখ মুছিয়ে দেয় সে, ঘোড়াদের প্রত্যেকের কানের কাছে মুখ রেখে কী যেন বলে মেজ কুমার, দূর থেকে মানুষের কানে তা পৌঁছায় না। অচিরে তারা দেখতে পায় মেজ কুমারের নিজস্ব চাপরাশি ভজুয়া দালানের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। এটা চোখে পড়তো না বা বিশেষভাবে লক্ষ করবার হতো না, কারণ মনিবের কাছে চাপরাশি তো আসবেই, কিন্তু আজ এখন সে আসে বন্দুক হাতে করে, তাই চোখে পড়ে, আর চোখে পড়ে কার্তুজের মালাটিও তার হাতে। মানুষেরা বিস্ময়ে গুঞ্জন করে ওঠে। ভজুয়া বন্দুকটা কুমারের হাতে তুলে দেয়, তারপর কার্তুজের মালাটি। এর পরপরই বুঝি ভজুয়া একটা ধমক খায়, কেননা তাকে দেখা যায় হঠাৎ সভয়ে পিছিয়ে যেতে। মেজ কুমার কার্তুজের মালাটি বামুন পৈতার মতো গলায় পরে বন্দুক হাতে নিয়ে ঘোড়া তিনটির কাছে যায়। আবার সে খানিক আদর করে বজ্র, বিদ্যুৎ আর ঝঞ্ঝাকে, বড় সংক্ষিপ্ত আদর, যেন কী একটা বিষম তাড়া আছে মেজ কুমারের।
মানুষেরা ঘন হয়ে পড়ে; দূরেই তারা, কিন্তু তাদের চোখ মেজ কুমারের ওপর তীব্র নিবদ্ধ। তারা দেখতে পায় মেজ কুমার বন্দুকের নল ভেঙে টোটা পুরছে। আহ, টোটা! এই টোটায় বরাহ শিকার হয়, শেয়ালের লাশ পড়ে, পালা পরবে আকাশে তুলে ধরা বন্দুকের নল থেকে উল্লাসের বুক কাঁপানো শব্দ ছুড়ে দেয়, সেই টোটা! মেজ কুমার আর সময় নেয় না। কখন যেন দুম করে শব্দ হয় কি মট করে শব্দ, যেন একটা পাকা বাঁশ চড়াৎ করে ফেটে যায় – বজ্র পড়ে যায়, ঘোড়ার নাম বজ্র, ঘোড়ার দেহ মাটিতে পড়ে যায়। তীব্র হ্রেষা? না, নয়, ঘোড়া ডাকে না, না মৃত্যুর আগে ঘোড়াটি বা তখনো পায়ের ওপর দাঁড়ানো অপর দুটি, কেবল তাদের কান নড়ে ওঠে, আর পতিত ঘোড়াটির পায়ে একটা কাঁপনমাত্র, যেন দিঘির জলে ঢিল পড়েছে মাত্র, আর কিছু না, আর কিছু নয়, জলেরই কাঁপন শুধু, জলের বুকে ছোট্ট একটি দোল।
তারপর দ্বিতীয় গুলি, দোনলা বন্দুকে দুটিই তো টোটা, টোটার খোসা ছিটকে পড়ে মাঠে, তৃতীয় গুলিটির জন্যে নতুন টোটা ভরে মেজ কুমার সত্যেন্দ্র এবার তার নিজের ঘোড়া, তার সওয়ারি ঘোড়া, তার দৌড়বাজির ঘোড়া, সেই ঘোড়া, নাম যার বিদ্যুৎ, বিদ্যুতের দিকে তাক করে। সময় নেয় সে। সময় বহে যায়। দেশ ভাগ করা যায়, সময়কে তো দ্বিখণ্ডিত করা যায় না। তবু সময়, তবু কাল, এই কালটিও দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায় একটিমাত্র গুলির শব্দে। গুলি খেয়েও বিদ্যুৎ পড়ে যায় না। তখনো চার পায়ের ওপর বিদ্যুৎ দাঁড়িয়ে থাকে। কিংবা এ আমাদেরই বিভ্রম মাত্র। আমরাই হয়তো চাই নাই যে বিদ্যুৎও পড়ে যাক। আমরা কি তাই তাকে পায়ের ওপরই খাড়া দেখে চলি, যদিও তার দেহ পড়ে গেছে মাটিতে।
মাটিতে তিনটি লাশ, ঘোড়ার লাশ – বজ্রের লাশ, ঝঞ্ঝার লাশ, আর ওই বিদ্যুতের লাশ। মেজ কুমার আর তাদের দিকে দেখে না। মেজ কুমার হেঁটে যায়। মেজ কুমার দালানের ভেতরে চলে যায়। দেউড়ির কাছে ভজুয়া, ভজুয়া মনিবের হাত থেকে বন্দুকটা নেয়, কার্তুজের মালার জন্যে হাত বাড়ায় সে, কিন্তু মেজ কুমার মালাটি খুলে তার হাতে না দিয়ে চত্বরের মর্মর পাষাণের ওপর ছুড়ে মারে। দালানের ভেতরে মেজ কুমার সত্যেন্দ্র অন্তর্হিত হয়ে যায়। পরদিন রাজবাড়ি খাঁ-খাঁ করে। কেউ নাই। পূজাঘরে প্রদীপ নাই। পাকশালে রন্ধন নাই। শয়নমন্দিরে মানুষ নাই। রাতের অন্ধকারে টমটমের শব্দ পেয়েছিল মানুষেরা। টমটম আরিচার দিকে চলে যায়। রাজা কোম্পানির ইস্টিমারে ভোঁ বাজে। ভোরের ইস্টিমার গোয়ালন্দে যায়। গোয়ালন্দে ইলিশের স্তূপ, ইলিশের গন্ধে বাতাস ঘন সেখানে। কিন্তু সেই ঘন ঘ্রাণও আর আমাদের রসনাকে সিক্ত করে তোলে না। আমরা মৃতের ঘ্রাণ পাই। চারদিকে লাশের ঘ্রাণ। নিহতের শরীর পচনের ঘ্রাণ। গন্ধ কি দুর্গন্ধ কে নির্ণয় করে? ইতিহাসে পচন যখন ধরে তখন যদি ঘ্রাণ ওঠে, সে ঘ্রাণ তেওতার রাজবাড়িতে কবেকার পূজা আরতির বাসি ফুলেরই ঘ্রাণ হয়তো বা!
আমরা ভুলি নাই যে মুকুলের বিধবা মা পূজার থালা নিয়ে মন্দিরে গিয়েছিল, কিন্তু পূজা সে দিতে পারে নাই, মন্দিরে তাকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় নাই। অপবাদ! অপবাদ তাকে দেওয়া হয়েছিল যে ফরোয়ার্ড ব্লকের তরুণদের সঙ্গে তার রাতের সম্পর্ক হয়েছিল। আহ, কত সহজেই না 888sport promo codeকে এমত দোষা যায়! আর কত সহজেই না 888sport promo codeর এমত অপবাদ মানুষেরা সত্য বলে ধরে নেয়। ফরোয়ার্ড ব্লক, সুভাষ বসুর দল, কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে  এসে তাঁর এই দল গঠন। আহ, আজ যদি সুভাষ বসু থাকতেন তবে কি দেশভাগ হতে পারতো? যদি থাকতেন চিত্তরঞ্জন দাশ? রবীন্দ্রনাথ? নজরুল? কিংবা তাদের আগের কালে যে সৈয়দ আহমদ ছিলেন তিনিই বা কী বলতেন? সেই তিনিই তো বলেছিলেন, আমি আন্তরিকভাবে আমার দেশ ও জাতির সেবা করতে চাই। জাতি কথাটি দিয়ে আমি হিন্দু এবং মুসলমান উভয়কেই বোঝাতে চাইছি, কেননা জাতি কথাটির এইটিই একমাত্র অর্থ। তিনি কাব্য করে এতটাও তো বলেছিলেন, আমাদের 888sport app download for android হবে যে, হিন্দু এবং মুসলমান এক সুন্দরী 888sport promo codeর দুটি চোখের মতো। কোনো আঘাতে তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেলে অপরটিও নষ্ট হয়ে যাবে!  কী হলো সেই কথাটি শেষ পর্যন্ত? একই মুখাবয়ব থেকে দুটি চোখ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, তবে? তবে সেই মুখাবয়ব আর অটুট থাকলো কীভাবে? আমরা বাংলায় বড় দিশেহারা বোধ করি। বাংলাই আমার দেশ। সেই দেশটি তো সাতচল্লিশে প্রথম নয়, এর চল্লিশ বিয়াল্লিশ বছর আগেও ভাগ করা হয়েছিল একবার। ব্রিটিশ শাসকেরা তখন বলেছিল, ঐক্যবদ্ধ বাংলা একটি শক্তি, বিভক্ত বাংলা যা নয়, আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য একে বিভক্ত করা এবং ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদের দুর্বল করে তোলা। বিরোধী, না স্বাধীনতা সংগ্রামী? আর বাংলাকেই ভাগ করে দুর্বল করা, না সমগ্র ভারতবর্ষকে ভাগ করে এক বিপুল জনগোষ্ঠীর মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া?
কিন্তু এ প্রশ্ন সাতচল্লিশে আর নয়, সাতচল্লিশে এখন দেশবিভাগ সম্পন্ন হয়ে গেছে, ভারতবর্ষ আর নয় – হিন্দুস্থান পাকিস্তান। রবীন্দ্রনাথ চিতাভস্মে পরিণত। নজরুল উন্মাদ। সুভাষ নিখোঁজ। আর চিত্তরঞ্জন বহু আগেই গত। দেশভাগের মাত্রই মাসাবধি আগে অখণ্ড বাংলার স্বাধীন সার্বভৌম এক বাংলার স্বপ্ন যে গুটিকয় মানুষ দেখেছিলেন তাঁদের একজন সোহরাওয়ার্দীও হন তাঁর বীর্যহীন কালে পতিত।
মুকুলের মাকে আমরা ভুলি নাই। জলেশ্বরীর কাছারি মাঠে যখন পাকিস্তানের নিশান সদ্য তোলা হয়েছে আর শহরের হিন্দু নেতারা যখন দূরে দাঁড়িয়ে তা দেখছে, মুকুলের মা তখন আধকোশা নদীর দিকে ছুটে চলেছে। আমরা তাকে অনুসরণ করি। এই 888sport promo code আজ এমত উদ্ভ্রান্ত কেন, এ প্রশ্ন কেবল জলেশ্বরীর হাই ইংলিশ ইশ্কুলের হেডমাস্টার শ্রী যতীন্দ্রমোহন গাঙ্গুলির নয়, আমাদেরও। মুকুলের মা কি আত্মহত্যা করতেই নদীর দিকে যাচ্ছে? ওই তার পরনের শাড়ি স্খলিত, ধুলায় আঁচল লুটাচ্ছে, মাথায় কাপড় নাই, খোলা চুল বাতাসে উড়ছে। উন্মাদ এক 888sport promo codeরই তো রূপ? না, উন্মাদ সে নয়। মিথ্যা অপবাদ তাকে ভাঙে নাই, বরং তাকে আগুনের মতো জ্বলে উঠতে সাহায্য করেছে। আগুন? সে কি দগ্ধ করতে? হ্যাঁ, যদি পারতো, তাহলে দগ্ধই সে করতো এই বাস্তবতাকে, এই দেশবিভাগকে, মুহূর্তেই এই পায়ের নিচের মাটি অপরের হয়ে যাওয়াটিকে। কিন্তু একা এই অবলা 888sport promo code, সুভাষ বসুর দলকে নিজ বাড়ি ভাড়া দেওয়ার কারণে চরিত্রের অপবাদ মাথায় এই 888sport promo code, কিবা সাধ্য তার এ সকল খণ্ডন করে?
খণ্ডন করতে না-ই পারুক, বর্জন তো করতে পারে। মুকুলের মা সেই সিদ্ধান্তই নিয়েছে। সে এ দেশ ত্যাগ করবে। আরো অনেক হিন্দুর মতোই মুকুলের মাও পাকিস্তান থেকে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা বিস্মিত হয়ে দেখবো, শহরের হিন্দুরা যখন দূরে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের নিশান তোলা দেখছে, যখন তাদের মনের মধ্যে এতটুকু উদিত হয় নাই যে এ দেশ থেকে তারা চলে যাবে – যদিও অচিরে তারা যাবে, তখন সবার আগে মুকুলের মায়ের মনেই কথাটা উঠবে – এ দেশ আর তার নয়, হিন্দুও নয় মুসলমানও নয় – কেউ তার পাশে দাঁড়াবে না, কেউ তাকে রক্ষা করবে না, এ দেশ থেকে তাকে চলে যেতে হবে।
বড় কষ্ট করে ছেলেকে সে মানুষ করছিল। মুকুলের বাবা বসন্ত রোগে মারা যাবার পর সম্বল শুধু ছিল সুপারির বাগানঘেরা বাড়িটি। বাগান ইজারা দিয়ে, বাড়ির প্রায় সবটাই ভাড়া দিয়ে, মুকুলকে মানুষ করছিল বিধবা মা। মুসলমানের বিধবা হলে আবার বিয়ে বসতে পারতো। হিন্দু বিধবার সে পথ খোলা নাই। নাই বটে, কিন্তু মুসলমান বিধবার তুলনায় বিপদ তার আরো বেশি। শহরের সিগারেট ব্যবসায়ী, কাঁচি মার্কা সিগারেটের সোল এজেন্ট, কেরাসিন তেলের একমাত্র কারবারি, হরিহর সাহা তাকে তো প্রস্তাবই দিয়েছিল রক্ষিতা হয়ে যেতে। প্রস্তাবটা সরাসরি দেয় নাই; প্রথমে বাড়ির সদর ঘরখানা ভাড়া নিয়েছিল, ভাড়া সে চলতি হারের তুলনায় অনেক বেশি দিয়েই ঘরে উঠেছিল, অফিস বসিয়েছিল, আলাপে আলাপে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল – আরে, হিন্দুর বিধবা হিন্দু না দেখিলে দেখিবে কাঁই! – মুকুলের মায়ের মনে খচখচ ছিল, এত বেশি ভাড়া নিজে সেধে লোকটা কেন দিতে চেয়েছিল? 888sport promo codeর মনে 888sport promo codeর সম্ভ্রম চিন্তা শুকপাখির মতো ঘোর আঁধারে ডানা ঝাপটায়, ঘটনা ঘটার আগেই ঘটনার সংকেত দেয়। অচিরে হরিহর সাহা মুকুলের মায়ের হাত ধরে ফেলে; পূজার প্রসাদ যাচ্ঞা করেছিল হরিহর – হামার ব্যবসা বড় মন্দা যাইচ্ছে যুদ্ধের গতিকে, দেবতার আশিব্বাদ না পাইলে আর বাঁচিবার গতিক নাই! কোন্ যুদ্ধ? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ! সবারই তখন উথাল পাথাল অবস্থা। যুদ্ধের গতিকে তখন কেউ রাতারাতি বড়লোক, কেউবা ফকির; কিন্তু হরিহর সাহার সে সম্ভাবনা নাই, কেননা সিগারেট আর কেরাসিনের চাহিদা কখনো ফুরায় না, বরং যুদ্ধের কালেই তার বেশি রমরমা। কিন্তু এতশত বিধবা ভাবে নাই; তার মন নরোম হয়েছিল হরিহরের দুঃখের কথা শুনে; সেই সূত্রে প্রসাদী ফুল হরিহরকে সে দিতে যায়। আর সেই তখন মুকুলের মায়ের হাত খপ করে ধরে ফেলে হরিহর, বলে, আর কতকাল বা কষ্ট করিবে? ইচ্ছা করিলে রাজরানীর মতো তোমাকে – কথাটা শেষ করতে পারে নাই হরিহর, পূজার থালা তুলে তার কপালে ততক্ষণে আঘাত করে বসেছে বিধবা। দরদর করে রক্ত। – আই বাপ্! আই!
হাঁ, বিধবার রূপ থাকাও অভিশাপ। রূপ না থাকলেই বা কী! কুরূপা বিধবাও কি পুরুষের নজর থেকে রেহাই পায়! মুকুলের মা রূপবতী, মুকুলের মা যুবতী, মুকুলের মা নিঃসঙ্গ বিধবা – কতজনে কত টোকা তাকে দেয় ও দিয়েছে, কিন্তু সে পতিত হয় নাই। তার একমাত্র চিন্তা মৃতস্বামীর চিহ্ন এই সন্তানকে সে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে। দেশভাগের এই মুহূর্তে, পাকিস্তানের নিশান এই প্রথম আজ জলেশ্বরীতে ওড়ার মুহূর্তে, মুকুলের মা পথে নামে। তার বাড়িঘর ফেলে সে পথে নামে, হিন্দুস্থানের উদ্দেশে সে ঘর ছাড়ে। পড়ে থাকুক তার বাড়ি, পড়ে থাকুক তার সুপারি বাগান, খাক! বারোভূতে খাক! শুনেছে সে, ফরোয়ার্ড ব্লকের ছেলেরা তাকে গতরাতেই বলেছে, মাসি, নদীর এপারে পাকিস্তান, ওপার গেইছে হিন্দুস্থানে, এপারে আর আশা নাই, ওপারেই এখন আমাদের সমুদয়!
ভোররাতেই মুকুলকে সে রওনা করিয়ে দিয়েছে। – যা বাপ, নদী পার হয়া ওপারে যা। একখান খেওয়া নাও ধরি ওপারে যায়া বসি থাক। আমি পাছে পাছে আইসোঁ। – একো সাথে যাই না কেনে, মা? – না, বাপ, একোসাথে গেইলে সবার নজরে পড়িবে। তুই আগোতে যা। – তুমি? – মুঁই পাছে পাছে। – জিনিশপত্তর? বালক হলে কী হয়, মুকুলের বিষয়জ্ঞান টনটনে। অবোধ বয়সেই যে ছেলে পিতৃহারা হয়, বিষয়জ্ঞান তার আপনা থেকেই আসে। মা বলে, বিষয়ের কীবা আছে! আইজ হউক কাইল হউক বাড়ি যাইবে মোছলমানের ভোগে! বাড়ি তো আর বগলে করি নিয়া যাবার নয়! – বাসনকোসন! – বাসনকোসন প্রাণে বাঁচিলে আবার হইবে। তবু মাটির ওপর পা আঁকড়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুকুল। তখন গালে একটা চড় বসিয়ে দেয় মা। – অলক্ষ্মীর ঝাড়! মোছলমানের হাতে বিনাশ হবার ঝইন্যে তাল তুলিছিস!
মুকুল এখন নদীর কিনারে। পেছনে জলেশ্বরী শহর। এই নদী আধকোশা! এ নদী এখন হিন্দুস্থানে। জলেশ্বরীর পাকিস্তানের মাটি থেকে পা তুলে নদীর জলে নামে মুকুল। হাঁটু পর্যন্ত নামে। তার হাফপ্যান্ট ভিজে যায়, কিন্তু লক্ষ নাই। তার কাছে মনে হয় নদীর জল কী শীতল! কত শীতল! কত আপন! মায়ের হাতের সেই চড় – চড়ের তোড়ে তার গাল এখনো রাঙা, এখনো জ্বলুনি তার যায় নাই। বাড়ি ছেড়ে আসবার কালে আর কিছু নয়, তার বইখাতা নিয়ে এসেছিলো; বইগুলো পাড়ে নামিয়ে মুকুল দুই হাতে নদীর জল তোলে, আঁজলা ভরে তোলে আর গালের ওপর ঝাপটে ঝাপটে মারে। আহ, শীতল! শীতল হয় চড়ের জ্বলুনি, মুকুল শীতল হতে থাকে। নদীর জলে হাঁটু ডুবিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে, আঁজলায় জল তুলছে আর গাল ভেজাচ্ছে। আহ্, এই না হলে হিন্দুস্থানের নদী, হিন্দুস্থানের জল! শীতল! কী শীতল! (চলবে)