নদী কারো নয়

সৈয়দ শামসুল হক

॥ ২৫ ॥
মানুষের মন এমন, ভেতরের সব শক্তি দিয়ে শূন্যের ভেতরে সত্য ছবি তৈরি করতে চায়, এমন ছবি যা হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যাবে। নদীর বুকে নৌকো। নৌকোয় পা রাখবেন দেবী। মানবীর ছদ্মবেশে দেবী আজ। এভাবেই দেবী দেখা দেন মানুষের কাছে। তার ভেজা পায়ের ছাপ পড়ে নৌকোর পাটাতনে। পাটাতন তো নয়, জীবন! আমাদের জীবন! মানবীর পদচিহ্নে দেবীর সাক্ষাৎ আমরা পাই। আর এই কথাটিই তো অবিরাম আমাদের কলমের মুখে কালির ঝরনে। কিন্তু ঔপন্যাসিক মকবুল হোসেনকে আমরা
যতদূর জানি সে তার কলমের মুখে বিভ্রম  নির্মাণেরই কারিগর আসলে। না, এ বিষয়ে আমাদের কোনো সমালোচনা নাই। কারণ, তার 888sport live footballের বিচার এখানে আমরা করতে বসি নাই। জলেশ্বরীতে সে কন্ট্রাক্টর সাইদুর রহমানের সেই আমন্ত্রণেও আসে নাই যে এখানে চমৎকার সিনারির ভেতরে বই লিখতে পারবে। সে যে-কারণে জলেশ্বরীতে আসে, সে-কারণের তালাশ-কথা কে করে আর এ দেশে? কে মনে রাখে সাতচল্লিশে দেশভাগের কথা। বি888sport app download for androidেই সকল নাশ এখানে। এমনকি মুক্তিযুদ্ধটাও। তবু সকাল হয়। সকালের সূর্যের কোনো দোষ বা গুণ নাই, জ্ঞান বা 888sport apk নাই। সে উদিত হয়, হয়েই চলে। যেদিন না হবার, সে-ইতিহাস লেখার অবকাশ আমাদের নাই।
কেয়ারটেকার এসে গলা খাঁকারি দেয়। তার বাঁ হাতের আড়ে ভাঁজ করা গামছা লুঙি ঝোলানো। ডান হাতে দাঁতন। মকবুল বসে ছিলো নদী বরাবর নেমে যাওয়া টকটকে লাল পাকা সিঁড়ির মাথায়। সেখানে সিমেন্টের তৈরি হেলনা বেঞ্চ। সেও টকটকে লাল। আকাশেও লাল। কেয়ারটেকার লোকটি সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নেমে যেতে যেতে আত্মীয়তার অন্তরঙ্গ কণ্ঠে বলে, ঘুম কি ভাঙিলো, ছার? ঘুম কেমন হইলো? তামাম দিনে যে জার্নি করিয়া আসিছেন, শরীল তো ছাড়ি দিবারে কথা! এর উত্তরে মকবুল ফিনফিনে একটি মৃদু হাসি ছাড়া আর কোনো শব্দ বা ভাববিকাশ করে না। সকালে নাশতা কী দেমো? বাবুর্চি বসিয়া আছে। রুটি চান রুটি। পরোটা চান পরোটা। তবে বাঙালি নাশতায় সমুদয়। বলিলে ফেনাভাতও দিবার পারি। লোকটি বিপজ্জনকভাবে সিঁড়ির প্রান্তে দাঁড়িয়ে মকবুলের উত্তরের প্রতীক্ষা করে। মকবুল তার পছন্দ বলে না। নগদ কোনো উত্তরও সে দেয় না। মকবুলের মনে হয় লোকটি এই যে কুশলাবাদ করছে, এ নেহাতই নিয়মরক্ষা। আসলে সে এসেছে ভোরের নদীতে গোসলটা সেরে নিতে।
আধকোশার সকালরাঙা স্রোতের দিকে, বহমান নয়, শান্ত জলরাশির দিকে তাকিয়ে সহেলিকে মনের মধ্যে রক্তে-মাংসে তৈরি করতে চেয়েছিলো সে। সেই ভাবনাতেই সে ফিরে যায়। কেয়ারটেকার লোকটি – আহ্, তার নাম জানা হয় নাই! – ততক্ষণে ঝপাং করে নদীজলে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যে-শব্দটা হয় তার সঙ্গে পাড় ভেঙে মাটির ধস নামার কোনো তফাৎ নেই। মকবুলের বুকের ভেতরটা ধড়াস করে ওঠে। কেননা, তার ভেতরেই লীন হয়ে আছে এই ইতিহাসটি যে, একদিন আধকোশা ছিলো উন্মত্ত নদী। বর্ষাকালে বিস্তার হতো তার আধক্রোশ। নদীর পাড় গিলে খেতো, পাড়ের বাড়িঘর তার স্রোতোদীর্ঘ জিহ্বার টানে তরল জঠরে টেনে নিতো আধকোশা। মকবুলের আশঙ্কা হয় কেয়ারটেকার লোকটি না নদী জঠরেই চলে যায়। কিন্তু না! ওই সে ভুস করে মাথা তুললো। আবার সে ডুব দিলো। এবার জলের উপরিভাগে আলোড়ন দেখে অনুমান হয় লোকটি ডুবসাঁতারে দূরে চলে যাচ্ছে। দূরে একটি নৌকো বাঁধা। নৌকোটি ভোরের বাতাসে ও স্রোতের মন্দটানে একবার ডানে একবার বাঁয়ে সরে সরে যাচ্ছে। গলুইটি পোঁতা বাঁশের সঙ্গে বাঁধা বলে, নৌকোর পেছনটাই এপাশ-ওপাশ করছে। যেন নদীর বুকে লম্বমান কেউ। হাতজোড় করে শুয়ে পড়েছে। তীরের কাছে মাফ চাইছে, প্রার্থনার ঘোর কাতরতায় অস্থির শরীর নিয়ে।
কিন্তু এ সকল কে দেখে? আমরা যা দেখার দেখি। মকবুল সহেলিকে নির্মাণ করতে থাকে, পটের বুকে তুলির আঁচড় ফেলে যেমত চিত্রকর। সে এতোটাই গভীর করে ভাবতে থাকে, যেন সহেলিকে সে প্রত্যক্ষ পায় নৌকোয় ওই উঠছে। ছবি, ছবি। মন একদিকে জানবে এ মিথ্যে। কিন্তু চোখ দেখবে – সত্য! ম্যাজিকের কালো মঞ্চে, কামনার অন্ধকারে, শূন্যে ভাসতে ভাসতে চলে আসছে সহেলি, যেন শোলার তৈরি, যেন বায়বীয়, যেন সাবান পানির বুদ্বুদ, ভেঙে যাবে, ফেটে যাবে – নাহ্, সে আসেনি, সে শরীর ধরে হয়ে ওঠেনি। ভেঙে ভেসে গেছে। কবেই তো মকবুলের চোখজোড়া পুড়িয়ে দিয়ে চলে গেছে সহেলি পৃথিবীর তলপ্রান্তের কোন দেশে না কোথায় – নিউজিল্যান্ডে! নামটা থেকে থেকেই তার মনে পড়ে। দেশে বোধহয় তার মতো আর কারো নিউজিল্যান্ডকে এতো বেশি মনে পড়ে না। তার মনের পটে সহেলি আর ফোটে না। মুছেই হয়তো গিয়েছে, একদিন সেই যে ছিলো সেই মেয়েটির মুখের মানচিত্র। বি888sport sign up bonusর বন্যা যখন থইথই, গ্রামরেখা বৃক্ষবিতান শস্যক্ষেত তখন সকলই তলায়। তখন শুধু দিগন্তবিস্তৃত ধু-ধু জলরাশি, তার নাকচোখমুখ নাই। কিন্তু এতো দেশ থাকতে নিউজিল্যান্ডে কেন সহেলি? কোথায় যেন কবে সে পড়েছিলো, হয়তো ছেলেবেলাতেই, যে, নিউজিল্যান্ড এমন এক দেশ যেখানে কোনো সাপ নাই। সাপের কথা গতরাতেও হয়েছে। সাইদুর রহমানের কেয়ারটেকার বলেছে সাপেরও মানবতা বোধ আছে। বলে কী লোকটা! 888sport sign up bonusর যে সাপ তার কোনো মানবতা নাই। দংশন করে সে অবিরাম। বিষ আর অমৃত ঢালে। বিষে প্রাণ হরণ করে, অমৃতে সে আবার জাগায়। জাগায়, কেননা সে দংশন করে বিষে আবার মারবে।
ঠিক তখনই ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে স্বর্গীয় একটি সুর, অমৃতের সূচিমুখ একটি রেখা, প্রবাহিত হতে থাকে। যেন উজ্জ্বল সোনালি রঙের চিকন একটি রেখা, জীবন্ত, চঞ্চল, ভোরের ধুসরতার বুক চিরে এগিয়ে চলেছে।… ইউটি টিট্ টিট্… হু হু পিইট্… পিট্ পিট্ সিউটি… তারপর ছোট্ট একটা শিস, আবার প্রথম থেকে… ইউটি টিট্ টিট্। কেয়ারটেকারের মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। নিজের ঊরুতে নিজেই জোর একটা চাপড় দিয়ে চাপাস্বরে বলে ওঠে, আরে! আরে! কতদিন বাদে! হিমালয়ের জঙ্গল থেকি! সেথাকার জঙ্গলে থাকে। দ্যাখেন তার কেমন ধারা! মানুষে না পারে পাসপোট ছাড়া বডার পার হইতে। বডারে গেইলেই চক্ষু রাঙা করি বন্দুক তুলি ধরি কয় বোলে তফাৎ! নিজ নিজ জাগায় থাকেন! আর এই পাখি দ্যাখেন পাখায় উড়িয়া বডার পার হয়া হামার মুলুকে! হঠাৎ ব্যাকুল হয়ে লোকটি চারদিকে তাকায়। আরে গেইলো কোথায়! কই? কই? কোন্ঠে? তখন মকবুল বলে, আমি বোধহয় দেখেছি, একটু আগেই দেখছিলাম, এখন আর দেখছি না, এই তো ঝোপের ওই গাছটাতে বসে ছিলো এতক্ষণ। বলতে বলতে মকবুল চারদিকে চোখ পাঠায়। জাহাজের সন্ধানী আলোর মতো তার চোখ অদেখাকে ছিন্ন করে চলে। তারপর সে দেখতে পায়। তার চোখের আলো ঘনীভূত হয়ে পাখিটির ওপরে পড়ে। আরে! ওই তো! ওই! ওই! ওই যে! পাখিটিকে সে কামরাঙা গাছের ডালে দেখতে পায়। লাল সেই পাখিটি। ভোরের সেই পাখিটি। গান গাইবার জন্যে তখন থেকে যে গলা ফোলাচ্ছিলো সেই পাখিটি। কেয়ারটেকারও তাকে দেখতে পায়। সে আলতো করে হাততালি দেয় খুশিতে। কিন্তু নিঃশব্দ হয় তার হাততালি, পাখিটি যেন উড়ে না যায়। দ্যাখেন, দ্যাখেন, ছার! ইন্ডিয়ার পাখি উড়ি আসি হামার দ্যাশে হামার মুলুকে। মুলুকে তো মুলুকে, হামার নিজবাড়ির কামরাঙা গাছে! জানেন তো, সব পাখি না কামরাঙা গাছে বইসে। সেই পাখি বইসে যে হামাকে সাগাই বলিয়া জানে। সাগাই মানে বোঝেন তো? সাগাই মানে আত্মীয় হয়। – আহ্লাদ করে সে মকবুলকে বলতে থাকে, কতদিন বাদে দেখা গেইলো গো! বড় বিরল পাখি এই মুলুকে। কতদিন বাদে! ছার, ইয়াকে কয় সাতসয়ালি পাখি। – আর ঠিক তখন একটি হলুদ পাখিকে দেখা যায় উড়ে আসতে।
হলুদ পাখিটি উড়ে এসে লাল পাখিটির পাশে বসে। কামরাঙার ডালে ভোরের প্রথম রোদ, রোদের ফালি, যেন সোনার তক্তা সটান বিছিয়ে আছে। পাখিটি যে উড়ে এসে বসে, কয়েকটি মুহূর্ত মাত্র, ওর ভেতরেই তার উড়ন্ত তলভাগের চকচকে হলুদ রংটি চোখে পড়ে। বুকে, পেটে, গলায়, লেজে। এমন সে থুপথুপে রং, স্পর্শ করলেই আঙুলের ডগায় হলুদ লেগে যাবে। কেয়ারটেকার বিস্ময়াপন্ন চোখে তাকিয়ে থাকে। মুখে তার বাক্য নেই। তার ঠোঁট একবার শব্দের ভেতর-চাপে খুলে যায়; কিন্তু কোনো শব্দ ফোটে না, ঠোঁট ফাঁক হয়েই থাকে, মুখের ভেতর থেকে লালা এসে ঠোঁট ভিজিয়ে দেয়। তারপর ধীরে বুঁজে যায়। এরকম কয়েকবার চেষ্টার পরে শব্দ ফোটে, তাজ্জব!  দ্যাখেন, দ্যাখেন, সচরাচর না দেখা যায়, ওই দ্যাখেন তার মাদিও আসি গেইছে। জোড়ার টানে জোড়া গঠন হয়। আর মানুষের বেলায় কী হয়? জোড়া ভাঙিয়া পড়ে। – এই পর্যবেক্ষণটি মকবুলকে ক্ষণকালের জন্যে চিরে যায়। ছুরির ধারে ত্বক চিরে দিলেই চেরা জায়গাটা চোখের পলকে রক্তলাল রেখায় পরিণত হয়। মকবুলের চেতনা-ত্বকে কেয়ারটেকারের পর্যবেক্ষণটি – মানুষের জোড়া ভেঙে যায় – রক্তলাল রেখার জন্ম দিতে না দিতেই মিলিয়ে যায়। কারণ, সে নিজের বিষয়ে এতো অধিক ভাবিত হবার অবকাশ এখন চায় না। সে বলে, তাহলে মাদির রংটা হয় হলুদ। লাল পাখির জোড়া! – হয়, হয়, লালের জোড়া হলুদ, হলুদের জোড়া লাল, দুয়ে মিলি স্বামী ইস্ত্রি। পাশাপাশি বসিলে য্যান তারা লালহলুদ ফুল ঝলমল ঝলমল করে। – হ্যাঁ, কেয়ারটেকার সাহেব, এ পাখি আমি আগে কখনো দেখি নাই। কী যেন নাম বললেন? – সাতসয়ালি! – মানে, এরা সওয়াল করে? সাতটা সওয়াল? তাই সাতওয়ালি? – কেয়ারটেকার থতমত খেয়ে বলে, হাঁ, হবার পারে! এত মুঁই ভাবিয়া দ্যাঁখো নাই। – মকবুল পাখি দুটির দিকে চোখ ফেরায়। এ কি! তার হৃদয় বসে যায়। সেতারের তার ছিঁড়ে যায়। পাখি দুটি নেই। পাখি দুটি ডালে নেই। পাখি দুটি আর কোথাও নেই। পাখি দুটি আকাশেও নেই। পাখি দুটি বুঝি কখনোই এখানে ছিলোই না। সবুজ পাতাগুলো হিলহিল করছে। কামরাঙার ডালে ভোরের আলো তেজি হয়ে সোনার কলমে সবুজ লিখতে শুরু করেছে। পাতায় পাতায় আলোর ছন্দ মেলাতে শুরু করেছে। মকবুল বলে, সাত সওয়ালি! যে-পাখি সাতটা সওয়াল করে! সাতটি প্রশ্ন! কেয়ারটেকার তখন বলে, কী জানি! এ তো হামার জানা নাই। তবে সাতসওয়ালিও ঠিক ইয়ার নাম নয়, সাধারণভাবে মানুষজনে এই পাখিকে সহেলি পাখি কয়।
সহেলি! আকস্মিক এই বিদ্যুৎস্পর্শের জন্যে তৈরি ছিলো না মকবুল। সে একটা প্রবল ধাক্কায় গড়িয়ে পড়ে যায়। বিকট রকমে বিস্মিত হয়। অথবা হয় না। কারণ, সে দেখেছে আকস্মিক যোগাযোগটি তার জীবনে বহুবার ঘটেছে। সহেলির সঙ্গে বিচ্ছেদটাও আকস্মিক যোগাযোগেরই। আজ সকাল থেকে সহেলি তার কাছে বারবার ফিরে আসছে। অথচ নাসরিনকে একবারও তার মনে পড়ছে না। কিংবা একবার মাত্র। একটিবার নাসরিনের নামটা যেন শুকনো পাতার মতো উড়তে উড়তে পায়ের কাছে খসে পড়েছে। নাসরিন, যার সঙ্গে তার বিবাহিত জীবন। যে-নাসরিন তার মেয়ে প্রিয়লি চাঁদকে গর্ভে ধরেছে। সেই নাসরিন! আহ্ নাসরিন! নাসরিনকেও সে কবর দিয়ে এসেছে। সত্যিকার কবর। মাটি খুঁড়ে। মাটি চাপা দিয়ে। কবরের বুকে কাঠগোলাপের চারা লাগিয়ে। এখন সেই কাঠগোলাপ গাছটিতে ফুল ধরেছে। জলেশ্বরীতে আসবার আগে সে দেখে এসেছে। শাদা পুরু পাঁপড়ি, তার গোলাপি পাড়। ভেতরটায় হলুদের ছোপ। আর সুগন্ধ। কী গাঢ় সুগন্ধ। নাসরিন কী গাঢ় সুগন্ধই না বিস্তার করে ছিলো তার জীবনে। সেই সুগন্ধে তার চারপাশে যে থেকে থেকেই গলিত গন্ধ উঠতো, চাপা পড়ে যায়। সে ভুলে যায়। কিন্তু ইতিহাস ভোলে না। আমাদের জীবনকথাও ইতিহাস বটে। ব্যক্তিগত ইতিহাস। আমরা যতই তাকে নতুন করে লিখি, নিজের মতো করে লিখি, নিজের স্বার্থ বুঝে লিখি, সত্যটা মিথ্যা হয়ে যায় না, সত্যই থেকে যায়। সত্যটা অপেক্ষায় থাকে একদিন আত্মবি888sport sign up bonusর জঙ্গলে ঘেরা সুন্দরবনের গহিনে বাঘের মতো পিঠের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্যে। প্রেম যখন মরে যায়, তখন লাশের মতো সে পচে যেতে থাকে। পচে ফেঁপে ফুলে ওঠে। সব প্রেম নয়, কোনো কোনো প্রেম। সেই প্রেম, যে-প্রেম প্রতারণার তীক্ষè দাঁত পায়, সেই দাঁত দলিল কেটে কুটিকুটি করে, হৃদয়ের ভেতরে ঘুণপোকা ধরায়, রক্তপ্রবাহকে নষ্টপাঁকে ঘুরিয়ে দেয়। তখন প্রশ্ন জাগে, ওটা কি আসলেই ছিলো প্রেম? আর যদি প্রেম, তবে অমৃতের সিঞ্চন সে পায় নাই কেন? কেন পচে যেতে আছে, ফুলে উঠতে আছে, মহাসড়কে ট্রাকের ধাক্কায় লাশ হয়ে যাওয়া, দিনের পর দিন পড়ে থাকা, কুকুরের মতো। সহেলির সঙ্গে তার ভালোবাসাটা একদিন লাশ হয়ে যায় এবং জীবন নামক মহাসড়কের ওপর সেই লাশ পড়ে আছে সেই কতকাল থেকে। কিন্তু অন্যদিকে এটাও সত্য, সহেলি তার অস্তিত্বের ভেতরে মাটি ও গোলাপের মতো সম্পর্কযুক্ত – এখনো। একদিকে লাশ, অন্যদিকে গোলাপ। একই মুদ্রার দুই পিঠ। আমাদের জীবন-বাজারে এই মুদ্রাতেই বিকিকিনি।
সাতটি প্রশ্ন। সাত সওয়াল। সাতটি সওয়াল করে বলেই সে সাতসওয়ালি। তার… ইউটি টিট্ টিট্…হু হু পিইট্… পিট্ পিট্ সিউটি… গিইএ… পিট্ কি পাখির ভাষায় করা সাতটি প্রশ্ন আসলে?
কী সেই সাতটি প্রশ্ন? কেয়ারটেকার এসে ডাক দেয়, আসেন, খায়া যান। মকবুল খাবার ঘরে যায়। সে তাকিয়ে দেখে গামলায় গরম ভাত থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে ধোঁয়া উঠছে। পাশেই ঘিয়ের বোয়াম। আর শাদা ধবধবে চিনে মাটির থালা। সে বলে, এমন নাশতা মাটিতে বসে খেতে হয়। টেবিল-চেয়ারে মানায় না। – তবে মাটিতে পাটি পাতিয়া দেই? – তাই দিন। – পাটির ওপরে বাবু হয়ে বসে সে। কেয়ারটেকার উদ্বিগ্ন চোখে তাকিয়ে থাকে। এই রে, এখন না চিনেমাটির বাসনের বদলে মাটির শানকির আবদার হয়। কথাটা যদি ওঠে, উঠবার আগেই কেয়ারটেকার তার পাতে হাতায় হাতায় ফেনাভাত তুলে দিতে থাকে। সে দেখতে পায়, ভাতের ভেতরেই সেদ্ধ হয়ে আছে বেগুনের টুকরো, পটল, লাউ পাতা, লাল একটা কাঁচামরিচ। – ঘি নুন দিয়া ডলি নেন। অম্রিতের সোয়াদ পাইবেন। – তার চোখমুখ আচ্ছন্ন হয়ে যায় গরম ভাতের ধোঁয়ায়। বিশ্ব লোপ পেয়ে যায়। কানের ভেতরে সাতসওয়ালি পাখির ডাক হতে থাকে। ইউটি টিট্ টিট্। এমন মধুর সেই স্বর, সংগীত বলে মনে হয়। কিন্তু পাখি কি সত্যিই সংগীত করছে, না কথা বলছে, কিছু একটা বলতে চাইছে। সাতসওয়ালি। সাত সওয়াল। সাতটি প্রশ্ন। জীবন এত প্রশ্নময় কেন? প্রশ্নের ধার কি সবচেয়ে ধারালো ছুরির ধারের চেয়েও তীক্ষè? জীবন কি দুধারি ছুরি? জীবনটাই বা কি? পাওয়া না-পাওয়ার যোগ-বিয়োগের ওপর জীবন কতটা নির্ভরশীল? অথবা মৃত্যু? আমার বাবার মৃত্যুটা কি ছিলো স্বাভাবিক, নাকি হত্যা বা আত্মহত্যা?
তার আঙুল পুড়ে যায় ভাতের তাপে। একটা চামচ হবে? ছোট্ট একটা চামচ। পেতলের বেঢপ একটা চামচ তার হাতে তুলে দেয়। সে ভাতের থালায় বেগুন-পটোল ডলতে থাকে। ঘি ঢালে বোয়াম থেকে। ঘিয়ের ঘ্রাণে হঠাৎ সে তার শৈশব ফিরে পায়। মনে পড়ে যায় মায়ের হাতে ঘিমাখা ভাত আর একটু আলুভর্তা কি ডিমভাজা। কোলে বসে। বাবা, নদীর কাছে যাস নে। কেন মা? নদীর কাছে কেন যাবো না? মায়ের জন্যে তার চোখে পানি চলে আসে। কিন্তু পড়ে না। বাবার জন্যে তার ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে। চিন্তায়। অথবা, দূরবর্তীকে ভালো করে দেখার একাগ্রতায়। বয়ে চলে নদী। শীতে সাপের মতো মৃত। বর্ষায় ভৈরবীর মতো ঘোর উন্মত্ত। কিন্তু তখন না-শীত না-বর্ষা। শরতের সেই কাল। আকাশ নীল। শাদা মেঘ। নদী শান্ত। শান্ত সেই আধকোশার বুকে ভাসমান। একজন। নিষ্প্রাণ। পূর্ণিমা। দুধেল আলোয় কার যেন লাশ ভেসে চলেছে। মাঝিরা নৌকোয়। মাঝনদীতে। জাল পেতে। বৃত্তাকারে। রুই, মহাশোল, চিতল। জীবন একটি জাল ভিন্ন আর কিছু নয়। কেয়ারটেকার তাড়া দেয়, গরম গরম খায়া নেন, গরম না খাইলে মজা নাই। অভিভূতের মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে মকবুল। সাতটি প্রশ্ন – কী সেই সাতটি প্রশ্ন? আর তাদের উত্তরগুলোই বা কী! সেই সাতটি উত্তরের সমাহারই কি তার জীবন ইতিহাস, তার ও তার বাবার, তার বাবা ও আধকোশার। অথবা এ সকল কিছুই নয়, সাতটিরই উত্তর আসলে এক উন্মাদের দিগন্তধ্বনিত অট্টহাসি।
সেই সন্ধ্যা অথবা কোনো এক সন্ধ্যা, কোন সন্ধ্যা? এখন আর তার 888sport app download for android হয় না। কেবল ছবিটিই ভাসমান হয়ে আছে, যেনবা আধকোশারই শান্ত নীল পানিতে, সেই সন্ধ্যার পর থেকে। আমাদের এরকমই হয়। দিন-তারিখ মুছে যায়, কেবল ছবিটি। আর সেই ছবি! সাইদুর রহমান কন্ট্রাক্টরের এই বাংলাবাড়ির সিঁড়ি নেমে গেছে নদীতে। লাল সিঁড়ি। শেষ ধাপে পা রেখে দাঁড়ালে, নদী বুঝি মানুষের আগমন টের পায়। নদীর কি প্রাণ আছে? চেতনা আছে? আমাদের এখনো জানা নাই। মানুষ এসে দাঁড়ালে নদী তখন মানুষের মতো আচরণ করে। যেন এক আত্মীয় 888sport promo code সে হয়ে ওঠে। দীর্ঘ পথযাত্রার ধুলো লাগা পায়ে বাড়িতে এলে প্রথমেই যে পা ধোবার পানি এনে দিতে হয়, নদীর তা জানা আছে। নদীটি তখন 888sport promo code। মমতার সেই 888sport promo code – মা, কিংবা মায়ের গরিব বোন যে গ্রামে থাকে, সম্পর্কের কোনো বোন – হয়তো ছোট, কিন্তু কৃষিনির্ভর মাঠনির্ভর ফসল ঝাড়াই-বাছাই নির্ভর গ্রামীণ সংসারে বয়সের অধিক বুড়িয়ে গেছে সে – কতকাল দেখা নাই। মানুষটিকে – আসে না কি নাড়ির টানে? – যদি আসে, দেখার জন্যে কতদিন থেকে তারা আশা করে ছিলো। কিন্তু আসে নাই। আমাদের সকল আশাই কি পূরণ হয়? তাই বুঝি আশা ছেড়ে দিয়েছিলো তারা। কিন্তু একদিন সে আসে। শহর থেকে আসে। ট্রেনপথে আসে। তারপর সাইকেলভ্যানে করে গ্রাম্যপথ পাড়ি দিয়ে আসে। তারপর বাদাবনের ভেতর দিয়ে কিছুটা পথ পায়ে হেঁটে।
তখন আঙিনায় এসে দাঁড়ানো অবাক তার ছবিটি দেখে ওঠে 888sport promo code। আঙিনায় পাখিরা যেন কলরব করে ওঠে। সন্ধ্যার অন্ধকারে সব পাখি নীড়ে। কিন্তু তারা উচ্চকিত হয়ে ওঠে 888sport promo codeর রূপ ধরে। ওরে পানি দে। ওরে আসন দে। ওরে পাখা আন। প্রথমেই পেতলের ঝকঝকে বদনিতে পানি। দীর্ঘদিন শহরে থাকা, আজ আগন্তুক সে, অতিথির পদার্পণে প্রথম যে আচার, সে তো কবেই ভুলে গেছে। কিংবা জানাই নাই। কিন্তু সে বোঝে। বুঝে ওঠে। এ সকলে আমরা জাতিস্মর। অথচ সে নিষ্ক্রিয় নিশ্চল থাকে। তারপর চমকিত হয়ে হয়তো সে বদনিটা নিজেই ঢেলে নিতো পায়ে, হয়তো ঝুঁকেও ছিলো এই ক্রিয়াটির জন্যে, কিন্তু তার আগেই তার পায়ে অনুপম øিগ্ধতার শীতলতা সে টের পেয়ে যায়। 888sport promo codeটি নিজেই তার পায়ে পানি ঢেলে দিচ্ছে।
সেই সন্ধ্যায় আধকোশা নদী যেন 888sport promo code হয়ে উঠেছিলো। সেদিন সন্ধ্যাকালে সে এক পা এক পা করে সিঁড়ি দিয়ে নদীর কাছে গিয়েছিলো। দাঁড়িয়েছিলো সিঁড়ির শেষ ধাপে। ডাঙার বুকে শেষ ধাপ। আরো দুটি ধাপ জলের স্বচ্ছতার ভেতরে ডুবে আছে, দেখা যাচ্ছে। লক্ষ না করলে পানিডোবা ধাপেই পা পড়ে যেত তার। তখন নদীটি যে শান্ত ছিলো, ঢেউ ছিলো না, স্রোত ছিলো না, কোথা থেকে কী একটা শিহরণ তার লাগে, নদীটি হঠাৎ একবার ছলকে উঠে ভিজিয়ে দেয় তার পা। পা নয়, স্যান্ডেল। ফিতে-বাঁধা স্যান্ডেল। চট করে খোলার জো নাই। খুলবার দরকারও সে দেখে না। তার পায়ের পাতায় – নদী আর নয় – সেই আশা ছেড়ে দেওয়া 888sport promo codeটি, তার মা অথবা মায়ের বোন কী সম্পর্কের সেই বোনটি যে অকালে বুড়িয়ে গেছে, তার পা প্রক্ষালন করে দেয়।
কিন্তু এতো কথা তার তখন মনে হয় নাই। এসব সে অনেক পরে ভেবে উঠেছে। লেখক সে। লেখকের এই এক দোষ কিংবা গুণ কিংবা দক্ষতা আমরা দেখি – ঘটনাকালে যা সামান্য বলে মনে হয়েছিলো, অনেক পরে তার ভেতরেই অসামান্য কোনো বার্তা পড়ে ওঠা। আমাদের মকবুল হোসেনের 888sport alternative linkগুলো অগভীর হলেও তার মননের ভেতরে এমন অধিক গভীরতা ছিলো যেখানে সে কলম ধরে কখনোই পৌঁছায় নাই। সে খবরও কেউ রাখে নাই। সে নিজেও জানে কিনা আমরা সন্দেহ করতে পারি। জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক অনেকের ভেতরেই আমরা এই গভীর-অগভীরের দ্বন্দ্বটি আবিষ্কার করতে পারবো। দ্বন্দ্বটি তখনই জন্ম নেয় যখন তাঁরা নিজের জন্যে নয়, পাঠকের জন্যে লেখেন। দ্বন্দ্বটি আরো বিকট হয়, মনের ভেতরে পাথরচাপা হয়ে থাকে সেইসব ঔপন্যাসিক কি গল্পকারের, যারা বালক-যুবক বালিকা-যুবতীদের মনোহরণের জন্যে হাতের কলমটিকে পাঠিয়ে থাকেন।
না, আধকোশা নামে নদীটির 888sport promo code হয়ে ওঠার কল্পটি তখন সে ভাবে নাই। এমনকি যখন জলতল ভেদ করে এক যুবতী উঠে এসেছিলো অদূর-সুদূর নদীর কিনারে, তখনও নয়। হ্যাঁ, একই সঙ্গে অদূর ও সুদূর। যুবতীটি তাকে দেখে নাই। কেন যে দেখে নাই, কোনো গাছ কি ঝোপের তো আড়াল ছিলো না। নদীর একেবারে কিনারে আড়াল দেবার জন্যে উদ্ভিদের কোনো প্রতিভা নাই। তবে নদীও কিছু কম যায় না যদি সে হয় পাহাড়ি নদী। স্রোতের প্রবল আঘাতে পাড় ভাঙতে ভাঙতে সে গাছের কাছে এসে যায়। খলখল করে হাসতে থাকে। দানবের বাহুর মতো বিপুল শেকড়গুলো জলের অট্টহাসিতে নগ্ন করে সে ধোয়াতে থাকে। না, কোনো আড়াল ছিলো না উদ্ভিদের তার ও যুবতীটির ভেতরে। মকবুল গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ চোখে স্থির তাকিয়ে ছিলো নদীজলে। সে অনেকক্ষণ। তারপর অকস্মাৎ যুবতী যখন নদী থেকে ওঠে, মকবুল তাকে দেখে ওঠে। বুঝি জলের তরল একটা শব্দই হয়েছিলো। সেই সন্ধ্যায় তো মকবুল তার নিজেরই নিঃশ্বাস পতনের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলো, এতোটাই গভীর ছিলো সে নিস্তব্ধতা। সামান্য জলশব্দ তো সেখানে সহস্র সোৎসাহ করতালি তুল্য। সে প্রথমে দেখতে পায় নদীর বুক ছিন্ন হচ্ছে। মুহূর্তেরই তা। তারপর জেগে ওঠে মুখ। মুখই কি? মানুষের? 888sport promo code বা পুরুষ বলে নির্ণয় নাই তখনো। মাছও হতে পারে।
মকবুল তার মায়ের কাছে শুনেছে বাবার কথা। ভোররাতে বেড়িজাল টেনে জেলেরা যখন নদীর বিপুল শস্য রুই কাতল চিতল মৃগেল আড় রিঠাদের তুলে আনতো, বাবা যেতেন মাঝে মাঝে, আধকোশার পাড়ে, সেই ভোরবেলায়, জেলেদের কাছ থেকে সবচেয়ে বড় মাছটা পছন্দ করে নিতেন।
সারারাতের শীতল নদীতে মাছের গা øিগ্ধ হিম হয়ে আছে। মকবুল কল্পনা করতে পারে। ডাঙায় শরীর মেলে দেওয়া মাছের গায়ে হাত বোলাচ্ছেন বাবা। বাড়িতে এনেও নাকি মাছটির গায়ে অনেকক্ষণ ধরে আঙুল বোলাতেন তিনি, করতল দিয়ে চাপড় কাটতেন। যেন ঘুমন্ত শিশুকে। মা বিরক্ত হতেন। – আহ্্, সরেন, সরেন তো! বাবা কি আর শোনেন! কে বলছে, কী বলছে, তাঁর লক্ষই নাই। হাত বুলিয়ে আদর করে চলেছেন তো চলেইছেন। – আহ, হাত না গন্ধান! ঠেলা দিয়ে বাবাকে সরিয়ে দিতেন মা। – যান, কলের পাড়ে যায়া সাবান দিয়া হাত ধোন। মকবুল তার মায়ের মুখে জলেশ্বরীর ভাষা শুনে অবাক হতো না। যদিও তা হবারই কথা, কেননা মকবুল তার মায়ের মুখে শহুরে মানুষের ভাষা শুনেই বড় হয়েছে। জলেশ্বরীর গল্প যখন, তখনই কেবল জলেশ্বরীর ভাষা মায়ের মুখে ফুটতো। মকবুল যদি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখতো, তাহলে দেখতে পেতো গল্পের স্থানকাল বিবেচনা করে ভাষা প্রয়োগ করবার ব্যাপারটা আসলে গল্পলেখকদের। আর সেটাই ছিলো তার মায়ের। আরো একটু এগিয়ে সে চিন্তা করলে, তার নিজের গল্প রচনার প্রতিভাটি যে মায়ের কাছ থেকেই পাওয়া, এটাও সে শনাক্ত করতে পারতো। জীবনের অগ্রসরণ এরকমই হয় বা হওয়া উচিত। এ শুধু এগিয়ে যাওয়া নয়, পেছনের সঙ্গে মেলাতে মেলাতে যাওয়া। চলবে