নবান্ন : দেশকালের পরিপ্রেক্ষিত

সাগরিকা জামানী
নবান্ন নাটক নিয়ে আলোচনার শুরুতেই ফিরে তাকাতে হয় ইতিহাসের দিকে, যে-ইতিহাসের আয়নায় ধরা পড়ে দেশকাল পরিপ্রেক্ষিতের চিত্র। ইতিহাস জন্ম দেয় নতুন কাল নতুন সময় ও নতুন ঘটনার। একেকটা যুগ পার হয় আর মানুষের চিন্তায় ও মননে সময়ের প্রতিচ্ছবির ছাপ সুস্পষ্ট হয় এবং তা থেকেই জন্ম নেয় নব-নব দৃষ্টিভঙ্গির। সেই দৃষ্টিভঙ্গির ক্রোড় থেকে বেরিয়ে আসে যুগান্তকারী কোনো বিশেষ সৃষ্টি যা কিনা আবহমান নদীর মতো ধাবিত হয় সময়ের হাত ধরে, অবশ্য সেটা দেশকাল ও রাজনীতির আঙিনায়। যা কিনা মানুষের চেতনার দরজায় আঘাত করে। নবান্ন এমনই এক সৃষ্টি। নবান্ন সম্পর্কে নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য নিজেই বলেছেন – ‘আবেগ না হলে বোধহয় 888sport app download apkর জন্ম হয় না – অনুভূতি না থাকলে জীবনযন্ত্রণা না থাকলে কোনো সৃষ্টিই বোধহয় সম্ভব নয়।’ নবান্ন নাটক নিয়ে আলোচনার শুরুতেই আমরা ফিরে তাকাব নবান্ন রচনার ঠিক আগে বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার রাজনৈতিক জীবনে শুরু হয়েছিল ঘন ঘন পরিবর্তন। আর তারই ফলে জাতির জীবনে নিদারুণ দুর্যোগ নেমে এসেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বিপর্যস্ত করে তুলেছিল মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডকে এবং স্বাভাবিক বেঁচে থাকা ব্যাহত হতে শুরু করেছিল সমগ্র বিশ্বে। নাৎসিবাদের অভ্যুত্থানের পর থেকেই চলছিল গণতন্ত্রের নিধন, প্রগতিমান সংস্কৃতির নিষ্ঠুরতম অবদমন। আর তখনই ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধের প্রতিরোধে সংগঠিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক বুদ্ধিজীবীদের আন্দোলন। বিশ্ববন্দিত বুদ্ধিজীবীদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছিলেন ভারতীয় লেখক-888sport live chatীবৃন্দ। আর তার পৌরোহিত্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্পেনের গণতন্ত্র রক্ষার সপক্ষে, আবিসিনিয়ার স্বাধীনতা হরণের প্রতিবাদে, মিউনিখে মুক্তিফৌজের মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রামের সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয়দের উদ্দীপ্ত করেছিলেন। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলো। ১৯৪১-এ হিটলার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হলো সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন।
ভারতীয় প্রগতিবাদীরা বিশ্বাস করলেন, বিশ্বমানবতা বিপন্ন কেননা সোভিয়েত দেশ বিশ্বমানবতার দুর্গ। এ যুদ্ধ জনযুদ্ধ। গঠিত হলো সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি। ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও 888sport live chatী সংঘ, ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের সপক্ষে সংগ্রামের এক দৃপ্ত সৈনিক বিজন ভট্টাচার্যের লেখনী ক্ষুরধার হয়ে উঠল। ১৯৪৩ সালে অবিভক্ত বাংলায় দেখা দিলো এক ভয়ঙ্কর মন্বন্তর। লাখ-লাখ লোকের মৃত্যু হলো। মুখিয়ে উঠল চারিদিকে সামাজিক অবক্ষয়। অবিভক্ত বাংলার যন্ত্রণা নিঙড়ে জন্ম নিল বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। আর এই সংগ্রামের গভীর থেকে বিজন ভট্টাচার্য আত্মপ্রকাশ করলেন নাট্যকার রূপে।
অস্থির রাজনীতির ভেতর নবান্ন নাটকের জন্ম। তখনো বাঙালির রঙ্গশালা উজ্জ্বলিত ছিল না তা নয়। সেই সময়টাতে অধিকাংশ নাটকের কাহিনি ছিল প্রধানত রাজা-রাজরানিদের কাহিনি, পুরাণ ও ইতিহাসের চর্বিতচর্বণ। সামাজিক নাটক একেবারেই যে ছিল না তাও নয়, কিন্তু সেখানে মধ্যবিত্ত জীবনের গুটিকয়েক কল্পিত সমস্যা ছাড়া ব্যাপকভাবে জনজীবনের চিত্র অঙ্কিত হয়নি। অর্থাৎ দেব-দেবীনির্ভর কাহিনি থেকে বেরিয়ে এলেও একেবারে মাটির কাছাকাছি থাকা জনজীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেনি কোনো নাট্যকারের হাতে নবান্ন নাটকের মতো। এমনকি নাট্যাচার্য শিশির কুমারভাদুড়ীর মতো যুগন্ধর প্রতিভাবান মানুষও তখন আলমগীর-সীতার রূপকল্প সাধনায় মগ্ন ছিলেন।৩
যেহেতু এক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে নবান্ন নাটকের জন্ম সেহেতু তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা কীভাবে বুনিয়াদ হয়ে উঠল একটি বাস্তবধর্মী নাটকের, সেটাকে পর্যালোচনা করতে হলে রাজনীতির চিত্রটি তুলে ধরা জরুরি এখানে।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে হরিজন নামক সাপ্তাহিকীতে লিখিত একটি 888sport liveে গান্ধি প্রথম ‘ভারত ছাড়ো’ স্লোগানটি ব্যবহার করেন এবং এটা ছিল ভারতকে আশু স্বাধীনতাদানেরই আহ্বান। ৬ জুলাই ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী কর্তৃক ভারতরক্ষা সমর্থনের সঙ্গে সঙ্গে ‘ভারত ছাড়ো’ দাবিটিও অনুমোদিত হয়। এই প্রস্তাব মোতাবেক কংগ্রেসের দাবি বাস্তবায়নের জন্য গান্ধি ব্যাপক আইন অমান্য আন্দোলনের কথা ঘোষণা করেন, যাতে অহিংসার সীমানা অতিক্রমও বৈধ হবে। ঘোষণাটি ছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ হুমকিস্বরূপ। আর শুরু হলো আগস্ট-আন্দোলন। আর সে-আন্দোলনের প্রভাব পড়ল সাধারণ মানুষের জীবনে। চলমান জীবন ব্যাহত হলো আর তাই দেখা দিলো গণবিক্ষোভ। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের প্রতিহিংসায় দুই হাজারের বেশি আন্দোলনকারী নিহত হলো এবং ৬০ হাজারের বেশি গ্রেপ্তার হলো। ক্ষতিগ্রস্ত হলো শহর থেকে শহর, গ্রাম থেকে গ্রাম। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ‘আগস্ট বিপ্লব’ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হলো। অহিংসা মন্ত্রে দীক্ষিত হলেও জনগণ স্বাধীনতার জন্যে সশস্ত্র সংগ্রাম চালানোর অপরিহার্যতা উপলব্ধি করেছিল।
১৯৪৩ ও ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের অনেকগুলো অঞ্চলে অজন্মার কারণে খাদ্যাভাব এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার কোনো কোনো অঞ্চলে এই অবস্থা মারাত্মক হয়ে ওঠে। ১৯৪৩-৪৪ খ্রিষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষের জন্যে স্থানীয় উৎপাদন-ঘাটতি অপেক্ষা ব্রিটিশ প্রশাসনের দুর্বল বণ্টন-ব্যবস্থা এবং অজন্মা সত্ত্বেও অব্যাহত শস্য-রপ্তানিই অধিকতর দায়ী। এই সময়ে ভারতের ৪০ লাখ টন শস্য ঘাটতি সত্ত্বেও ১০ লাখ টন শস্য রপ্তানি করা হয়।
শস্যের দর দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি যুদ্ধপূর্ব স্তরের দশগুণের ওপরে পৌঁছায়। এই দরবৃদ্ধির প্রথম বলি ছিল গ্রামের গরিবসহ ভারতীয় সমাজের দরিদ্র মানুষেরা। গ্রামাঞ্চলে কৃষকের ব্যাপক দারিদ্র ছিল মহাজনদের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণগ্রহণ এবং প্রচুর জমিজমা মহাজন ও জমিদারদের কুক্ষিগত হওয়ারই নামান্তর। সুবিধাবাদীরা ও চোরাকারবারিরা ইচ্ছেমতো নিজেদের সাম্রাজ্য তৈরি করে নেয়। প্রাকৃতিক বিপর্যয় আর মানুষের সৃষ্টি করা সংকটের জাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে মানবতা। এই মন্বন্তরে প্রাণ হারায় ৫০ লক্ষাধিক মানুষ। দুর্ভিক্ষের কবলগ্রস্ত হওয়ায় কৃষক-আন্দোলনে মন্দাভাব দেখা দেয়। দেশের দক্ষিণাঞ্চল, তামিলনাড়– ও কেরালা এই সময়ে কৃষক-আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। সেকালে এবং পরবর্তীকালে বাংলায় কৃষক-আন্দোলন নতুন পথে অগ্রসর হতে থাকে। কৃষকরা জমিদারদের পতিত জমি চাষ করতে থাকে এবং তাদের শস্যগোলা দখল করে নেয়। একথা 888sport app download for androidীয় যে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে আইনসম্মত করার আনুষঙ্গিক ঘটনাবলির দ্বারা গণআন্দোলনের বিকাশ বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
বিজন ভট্টাচার্য ছাত্রাবস্থাতেই যুক্ত হন স্বদেশি আন্দোলনে। দ্বিতীয় সূচিত বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার পর তাঁর মাতুল প্রখ্যাত সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার কর্তৃক অরণি পত্রিকা প্রকাশিত হলে শুরু হয় সেখানে তাঁর গল্প লেখা। সমকালেই খ্যাতিমান মার্কসবাদী রেবতী বর্মণের লেখা পড়ে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তিনি আকৃষ্ট হন। আনন্দবাজার পত্রিকায় রেবতী বর্মণের লেখার সমালোচনা লেখেন এবং সংস্পর্শে আসেন কমিউনিস্ট নেতা মুজফ্ফর আহমদের। ১৯৪২-৪৩ সালে সদস্যপদ লাভ করেন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির। ১৯৪৪ সালে আনন্দবাজারের চাকরি ছেড়ে পার্টির হোলটাইমার হন।
তাঁর ব্যক্তিজীবনের কর্মধারার খানিকটা তুলে ধরতেই হলো, কারণ ব্যক্তিচরিত্রের অনেক কিছুর বহিঃপ্রকাশ ঘটে সৃষ্টির মধ্যে। আর বিজন ভট্টাচার্যও তাঁর চরিত্রের বাইরে যাননি। সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেতনা ছিল তাঁর প্রখর। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন সংবেদনশীল মানুষ আর এই সংবেদনশীল মানসিকতার ফসল হলো তাঁর নবান্ন নাটক।
নবান্নের প্লট সম্পর্কে নাট্যকার নিজেই বলেছেন – ‘একদিন ফেরার পথে কানে এলো, পার্কের রেলিঙের ধারে বসে এক পুরুষ আর এক 888sport promo code তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে, নবান্নের গল্প, পুজো-পার্বণের গল্প। ভাববার চেষ্টা করছে তাদের অবর্তমানে গ্রামে তখন কি হচ্ছে?’ তাঁর অভিজ্ঞতার ভেতর থেকেই এই নাট্যরূপ উঠে এসেছিল। ‘যে মানুষেরা রাস্তায় দুর্ভিক্ষের মড়া দেখে মুখ ফিরিয়ে গেছে ‘নবান্ন’ নাটক দেখিয়ে সেই মানুষদের চোখে আমরা জল ঝরাতে পেরেছি – এটা ছিল আমাদের কৃতিত্ব।
তখন নবান্ন নাটক সৃষ্টি হয়েছিল একটি বিশেষ সময়কে নিয়ে একথা অনস্বীকার্য। নাট্যকার যদিও বলেছেন – ‘নবান্ন যখন প্রযোজিত হয় তখন সে নাটক আমি দেশের কথা ভেবেই লিখেছিলাম, কোনো দলীয় রাজনীতি বা বিশেষ মতবাদে প্রভাবিত হয়ে নয়।’ তা-ই ধরে নিলাম। কিন্তু মানুষের আদর্শের শেকড় বহুদূর বিস্তৃত। সে যে যেভাবেই দেখুক না কেন। মানুষকে নিয়ে গড়ে ওঠে সমাজ, তাই পরোক্ষভাবে হলেও সে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মানবতার অবমাননা যেখানে সেখানেই মানুষের কণ্ঠ সোচ্চার হওয়া উচিত আর সত্যিকারের যারা মানুষ তারা মানবতার অবমাননা কোনোমতেই সহ্য করতে পারে না। কখনো কণ্ঠ, কখনো কলম হয়ে ওঠে প্রতিবাদের হাতিয়ার। মানবিক অবক্ষয় মানুষের মনে করে বেদনার সঞ্চার আর সেই বেদনা থেকে বেরিয়ে আসে প্রতিবাদী সৃষ্টি। আর সেটা তখন কোনো অরাজনৈতিক বিষয় থাকে না। অর্থাৎ মানুষের কল্যাণচিন্তাও বেরিয়ে আসে রাজনৈতিক চেতনা থেকে। সে-রাজনীতিতে আছে বেঁচে থাকার লড়াই, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার কথা। সুখী সমাজ গড়ার স্বপ্ন থাকলেই শ্রেণিসংগ্রামের কথা আসে আর সেখানে ব্যক্তির ভাবনা ব্যক্তিগত থাকে না, সেটা হয়ে ওঠে সামগ্রিক, যেটা রাজনীতির মধ্যেই পড়ে। বিজন ভট্টাচার্যের নাটকের ভেতর সাম্যবাদী যে-চেতনা পরিলক্ষিত হয় তা থেকেই বোঝা যায়, তাঁর চিন্তা ও মননে রাজনীতি কেমনভাবে জড়িয়ে ছিল। সংগ্রামের কথা বলতে গেলে চাই একটি নির্দিষ্ট প্লাটফর্ম আর সেই প্লাটফর্ম করতে গেলে প্রশ্ন আসে দলীয় রাজনীতির। দলীয় রাজনীতি ছাড়া সংগ্রাম সম্ভব নয়। আর নাট্যকারের জীবন থেকে যতটুকু ছবি পাওয়া যায় তাতে তিনি অবশ্যই জড়িয়ে ছিলেন দলীয় রাজনীতির সঙ্গে। আর তিলতিল করে দেখা তাঁকে নবান্ন নাটকের ছবি আঁকতে সাহায্য করেছে। তৎকালীন সমাজের প্রেক্ষাপট যখন তাঁকে নবান্ন নাটক লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছিল তখনো তিনি দলীয় রাজনীতির বাইরে অবস্থান করছিলেন না।
১৯৪৩ সালের ২৩ এপ্রিল অরণি পত্রিকায় আগুন প্রকাশিত হয়েছিল। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৪৩-এর মে মাসে নাট্য ভারতী হলে (অধুনা প্রেস সিনেমা)। এই নাটক লেখার পেছনে তৎপরতা ছিল তখনকার ফ্যাসিস্টবিরোধী লেখক সংঘের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের।
কিন্তু নবান্ন নাটকের পরিপ্রেক্ষিতটাই তাঁর সবচেয়ে ভিন্ন ধরনের। আগস্ট আন্দোলনে নাট্যকারের অংশগ্রহণ, প্রতি পদক্ষেপেই মৃত্যুর ইশারা, দেশজুড়ে কান্নার রোল – কারো স্বজন নেই, কারো অন্ন নেই, ভুখা মিছিলের আর্তনাদ নাট্যকারের জীবনকে করেছিল বিস্বাদ। বাড়িতে দরজা বন্ধ করে তিনি খেতে বসতেন, অন্ন উঠত না মুখে, একটু ফেনের জন্য রান্নাঘরের ড্রেনে ভিক্ষাপাত্র ধরত বুভুক্ষ মানুষের দল। ওই নব অসহায় মানুষের বোবাদৃষ্টি আর ক্ষুধার চিৎকার নাট্যকারকে করে তুলেছিল অস্থির ও মর্মাহত। নবান্নের আগে আরো দুটি নাটক তিনি রচনা করেছিলেন; কিন্তু নবান্ন নাটকই দিকচিহ্নের সাক্ষ্য বহন করছে বলা যায়।
তাঁর এই সৃষ্টিকে 888sport app download for androidীয় করে রাখতে এগিয়ে এসেছিলেন নবান্ন নাটকের চরিত্রগুলোতে যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁরা এবং কলাকুশলীরা, অনেক কর্মী, অনেক উদ্যোগ, প্রগতি 888sport live chatী সংঘের উৎসাহ।
দুর্ভিক্ষের আর্তচিৎকার মনের মধ্যে আলোড়ন তুলেছিল বিবেকমান মানুষের, কিন্তু প্রকাশ করার ভাষা তো সবার জানা থাকে না। নাট্যকার লেখনীর ফ্রেমে ধরে সচেতন মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করলেন। ভেতরের তাগিদ থেকে ঘর ছেড়ে অনেকে বাইরে দাঁড়ালেন তাঁর নবান্ন নাটক সফল করার জন্যে। ব্রিটিশ সরকারের অগণতান্ত্রিক জাঁতাকলের চাপে অনেক খোলাখুলি কথা হয়তো বলা হয়নি, যে কারণে কোথাও কোথাও নাটকের স্বাভাবিক রস ক্ষুণœ হয়েছে; কিন্তু অনিচ্ছাকৃত অসংগতি বাদ দিলে দেশকালের সাক্ষ্য বহন করতে সমর্থ হয়েছে নবান্ন নাটক। আর এ-নাটক সার্থক করে তোলার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন সেদিন বিখ্যাত অভিনেতা শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি ভাদুড়ী  (মিত্র), চারুপ্রকাশ ঘোষ, সজল রায় চৌধুরী, সুধা প্রধান, গঙ্গাপদ বসু, শোভা সেন, মণিকুন্তলা সেন প্রমুখ। যাঁরা অভিনয় করেছিলেন তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন সমাজ-সচেতন মানুষ। কারণ গভীর অন্তর্দৃষ্টি না থাকলে অভিনয়কে বাস্তবমুখী করে তোলা সম্ভব নয়। আরো বিশেষ করে দেখতে হবে, কোন সময়ে নাটকটি মঞ্চস্থ হচ্ছে। যেখানে নাট্যকার সরকার-নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীকে বুঝতে দিতে চাননি পোড়া বাঁশের শব্দকে গুলির আওয়াজ বলে চালানো হচ্ছে। পুলিশ ভাবছে, পোড়া বাঁশের কট্কট্ শব্দ। নাটকের একটি দৃশ্যে মিছিলে গুলিবর্ষণের ঘটনা আছে আর সেই গুলির আওয়াজ সৃষ্টি করা হয়েছে পোড়া বাঁশের শব্দের মাধ্যমে। বোকা পুলিশ বুঝতে পারেনি। সেদিন ঘোলাটে সময়ে প্রতিটি চরিত্রই একাত্মতা ঘোষণা করেছিল অভিনয়888sport live chatের মধ্যে দিয়ে এই নবান্নের কাহিনির মধ্যে। সেই চরিত্রগুলো আজ ভূখণ্ডের বুকে দাঁড়িয়ে, তারা সকলে একই ভাবধারা পোষণ করেছে অর্থাৎ সকলের চোখেই স্বাধীন ভারতের স্বপ্নের আলো ছিল আর সে-কারণেই একেকজন হয়ে উঠেছিল নাটকের চরিত্রে কালের সাক্ষী। রোগা শরীর নিয়ে 888sport live footballিক স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য ভিখারির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বাস্তবসম্মত। সে-প্রসঙ্গে নাট্যকার নিজেই বলেছেন – ‘তা ভোলবার নয়।’ মহর্ষি মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য চট দিয়ে মঞ্চ পরিকল্পনার বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে এক অসাধারণ অভিনবত্ব এনে দিয়েছিলেন মঞ্চে। কারণ অল্প ব্যয়ে এর চেয়ে ভালো পরিকল্পনা আর কী হতে পারে! সকলেই সাড়া দিয়েছিলেন সেদিন কাজ করার মানসিকতা নিয়ে। এটা অবশ্যই লক্ষণীয় বিষয় যে, সেই অস্থির সময়টাতে সকলেই কিছু করার জন্যে প্লাটফর্ম খুঁজে নিয়েছিলেন।
অরুণ মিত্রের নবান্ন-888sport sign up bonusর কিছুটা এখানে উল্লেখ না করে পারছি না। কারণ সামগ্রিক চিত্রটা আরো পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। ‘এইভাবে চলতে চলতে হঠাৎ দেখি আমরা সবাই মিলে উপস্থিত হয়েছি ধর্মতলা স্ট্রিটের ওপরতলার একটা ঘরে। সেটা ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও 888sport live chatী সংঘের কেন্দ্র। তখন যুদ্ধ চলছিল, তার মধ্যেই দেখা দিলো মন্বন্তর। এই অবস্থার নাড়া আমাদের আড্ডাখানাতেও লেগেছিল। দেশ, পৃথিবী, জনসাধারণ সম্বন্ধে আমাদের প্রত্যেকের ভাবনা যেন এক বৃহৎ অঙ্গ পেল। লেখা, গান, ছবি, অভিনয় – এ সবই নিজের নিজের আলাদা কাজ, কিন্তু তা চারপাশের মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন নয় এবং মানুষের প্রতি তার দায়িত্ব অন্তর্নিহিত।’
আরো বললেন – ‘আমি থিয়েটারের লোক কখনো ছিলাম না। তার কলাকৌশল নিয়ে মাথা ঘামানোর তাগিদ আমি অনুভব করি না। আমার স্বভাবের বহু ঘাটতির মধ্যে এটা একটা। কারো কারো কথা বলা শুনেই আমি মুগ্ধ হয়ে যাই, নাটক দেখবার মত তারিফ করতে ইচ্ছে করে। Berliner Ensemble-এর কীর্তি কলাপ আমি দেখিনি, কিন্তু তাতে আমার কিছু আসে-যায় না, কারণ ইৎবপযঃ-এর নাটক পড়েই আমি অভিভূত হই। তবু আমি কিশোর বয়স থেকে অভিনয় দেখে আসছি এবং অসাধারণ অভিনয় কতবার যে আমাকে তছনছ করেছে তার ঠিক নেই। কিন্তু একথাটা বাইরে থেকে, থিয়েটারের ভিতরের ব্যাপার আমার কাছে বরাবরই সুদূর। সুতরাং শম্ভু মিত্র বা বিজন ভট্টাচার্য থিয়েটারের পদ্ধতিকরণে কি যুগান্তর আনলেন তা আলোচনা করার সাধ্য আমার নেই, সাধও নেই। তাঁদের বিশেষ বিশেষ ক্ষমতা নিয়ে তাঁরা যে আমার সঙ্গে এক প্রবাহে রয়েছেন, এটাই ছিল আমার কাছে প্রধান।’ অরুণ মিত্রের এই মন্তব্য থেকে সহজেই বোঝা যায়, যুগ উদ্দীপ্ত করেছিল নাট্যকারকে আর নাট্যকার উদ্দীপ্ত করেছিলেন মঞ্চের ভেতর ও বাইরের এবং জাতীয়তাবোধসম্পন্ন জনসাধারণকে।
নবান্নের সংলাপের মধ্যে সরল ও স্বাভাবিকতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আমিনপুর ছিল মোদিনীপুরের ছদ্মনাম – তা হলেও মেদিনীপুরের উপভাষা ব্যবহার করেননি নাট্যকার। কারণ স্বভাববাদী প্রকরণে চরিত্রগুলোর সঙ্গে দর্শকদের একাত্মতা ব্যাহত হতো। তাই সহজবোধ্যতার জন্যে তিনি একটি মিশ্র-গ্রামীণ ভাষার ব্যবহার করেছেন, যা যশোর ও খুলনার ভাষার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। অর্থাৎ একটি মিশ্র-গ্রামীণ ভাষা যা কিনা চলতি ভাষার রূপ বহন করে এবং তা দর্শকদের কাছে সহজেই গ্রহণযোগ্যতা লাভ করেছিল। তিনি চাষিদের মুখে এই ভাষা লাগিয়েছিলেন আর তাই সেখানে কোনো কৃত্রিম ভাষার অবতারণা ঘটেনি।
নবান্ন নাটকের সংলাপের স্বাভাবিকতার আশ্রয় তার আঞ্চলিকতা নয়, সে-আশ্রয় তার বাক্যের গঠন, শব্দের চরিত্র ও বিন্যাসে, তার বাগ্-ব্যবহারের প্রক্রিয়ায়। বিশেষ করে চাষিদের সংলাপের কথাই ধরা যাক। লক্ষ করি, তারা মূলত ছোট্ট ছোট্ট বাক্যে নিজেদের মনের কথা ব্যক্ত বা প্রকাশ করে, সেই বাক্যগুলোর মধ্যেই মনোলগধর্মী সংগতি ও নাটকীয়তা তৈরি হয়, আর কথাগুলোকে দুবার-দুবার করে বলে তারা নিজেদের আবেগাপ্লুত মনোভাবকে প্রবলভাবে প্রকাশ করতে চায় অন্যদের কাছে, যেন নিজেদের প্রকাশক্ষমতায় তাদের যথেষ্ট বিশ্বাস নেই, যেন অন্যেরা তাদের কথায় যথেষ্ট মনোযোগী নয়, অভিব্যক্তির জন্যে একটি তীব্র ব্যাকুলতাই যেন তাদের পুনরুক্তি করতে বাধ্য করে।
কথার পুনরুক্তির কারণ অবশ্য আমদের কাছে অস্পষ্ট নয়। গ্রামীণ মানুষের মুখের ভাষা অত্যন্ত সহজ এবং সরল। তারা এক কথা বারবার বলতে পারে। কারণ ভাষা প্রকাশের যথেষ্ট শব্দভাণ্ডার তাদের মধ্যে নেই। তবু নাট্যকার ভাষার যেমন প্রয়োগ দেখিয়েছেন গ্রামবাংলার কৃষকদের মুখে, সেটি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গ্রামের সাধারণ কৃষকের মধ্যেও অনেক প্রতিভাবান থাকেন, যাদের মধ্যে রয়েছে স্বভাবকবির বসবাস। তাঁরা জীবনকে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতন করে দেখেন না। মাঝে মধ্যেই এইসব ভাবব্যাকুলতায় পূর্ণ কবিস্বভাব সাধারণ মানুষের মধ্যে জেগে ওঠে। অদ্ভুত এক ভাবের বৈচিত্র্য। আর তখনই সে এমন কিছু কথা বলে যার মধ্যে নিহিত থাকে ভবিষ্যৎকালের ইঙ্গিতবহ অর্থপূর্ণ ভাষা অথবা জীবন-মরণ বিষয়ক তার নিজস্ব ভাবনা, যাকে আমরা ব্যক্তিদর্শন বলতে পারি। হয়তো সে যা বলতে চায় তা হয়তো পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করতে পারে না; কিন্তু নানান প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব থাকে, যাকে বলা হয় তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তুত কথা, তা আপনা থেকেই তার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। এ-প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে-সময়ে জমিদারি তদারকির কাজে কুষ্টিয়ার শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে থাকতেন এবং বিভিন্ন স্থান 888sport slot gameকালে হঠাৎ হঠাৎ করে এক পাগল (কথিত) চাষি প্রায় দিন তাঁর পথ আগলে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বরচিত ছড়া শোনাতেন। সকলে তাঁকে দূরে ঠেলে দিলেও কবিগুরু তা কখনোই করতেন না। তিনি পাগলকে দূরে ঠেলে তো দিতেনই না, বরং মনোযোগ দিয়ে সহাস্য বদনে তাঁর ছড়া শুনতেন। এখন প্রশ্ন হলো, সেই পাগলটি কি লেখাপড়া জানতেন? না, তিনি ছিলেন নিরক্ষর। কিন্তু তিনি ছিলেন এক স্বভাবকবি। অনেক ছড়াই হয়তো ছিল বাতুলতা মাত্র; কিন্তু তাঁরও ছড়ার মধ্যে ছিল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনবোধের পরিচয়। রবীন্দ্রনাথের মনে সেই পাগল স্বভাবকবি দাগ কেটেছিলেন বলেই পরবর্তীকালে তিনি তাঁর লেখায় সেই পাগলের ছড়ার কথা 888sport app download for android করেছেন।
স্বভাবকবির মুখ থেকে সংলাপ শোনা যায় নবান্নের প্রধান সমাদ্দারের মুখে, যা কিনা একটি দিকনির্দেশ করে। প্রধান সমাদ্দার যেন এক কালের সাক্ষী! তার মুখে নাট্যকার এমনকিছু সংলাপ স্থাপন করেছেন যা কিনা ভবিষ্যৎ সমাজের কিছুটা ইঙ্গিত বহন করে এবং বর্তমানকে করে পরিহাস। যেমন – প্রথম ফটোগ্রাফারের কথার উত্তরে প্রধান বলেছেন – ‘সুবিধে! আমাদের বাবু সুবিধে আর অসুবিধে!’ অর্থাৎ মানুষ হিসেবে তাদের কতটুকু মূল্য আছে তারই এক ক্ষোভ প্রকাশ করা। আবার আরেকটি জায়গাতে প্রধানকে বলতে শোনা যায় – ‘যাও বেচোগে, কঙ্কালের ছবি বেচোগে! যাও যাও।’ এখানে প্রধানের সংলাপে ব্যঙ্গাত্মক সুরেরই প্রাবল্য লক্ষ করা যায় এবং তার সঙ্গে মিশে থাকে প্রবল ঘৃণা যা কিনা তিক্ত করেছে তার বেঁচে থাকাকে।
আবার ডাক্তার যখন প্রধানকে পরীক্ষা করে দেখেছে তখন প্রধানকে বলতে শোনা যায়, ‘হ্যাঁ, আবার ব্যথা করছে। এ ভয়ানক ব্যথা, দারুণ যন্ত্রণা। এ ব্যথা এই আছে, এই নেই। কালবৈশাখীর মেঘের মতো আছে। এ ব্যথা একেবারে হু-হু করে আসে আমার সর্বাঙ্গে ছেয়ে – তারপর এই মাতন লাগে, আরে ব্বাসরে বাপ্, সে একেবারে ঘরবাড়ি ভেঙ্গেচুরে।’ প্রধানের এই সংলাপ থেকে বোঝা যায় – যুদ্ধে তার দুই ছেলের মৃত্যু, বউ পঞ্চাননীর মিছিলে আত্মবলিদান ও অভাবে তার হৃদয় জর্জরিত। আর তার জীবনের এই মর্মান্তিক বেদনাবোধ তাকে করে তুলেছে এক দার্শনিক। যার কোনো অক্ষরজ্ঞান নেই, তার মুখে এই সংলাপ নাট্যকার বসিয়ে সর্বহারানোর বেদনাকাতর মানুষ কীভাবে বেঁচে আছে এবং জীবনধারণের জন্যে যেভাবে লড়াই করছে সেটাই বোঝাতে চাইছেন।
নবান্ন নাটকের চরিত্রগুলো এমনভাবে সাজানো, যা কিনা কালের সাক্ষ্য বহন করছে। এক্ষেত্রে নাট্যকারের নিপুণ হাতের সেবাই পরিলক্ষিত হয়। অনেক সৃষ্টির মধ্যে সব সৃষ্টিই কালজয়ী হওয়ার দাবি রাখে না আর কালজয়ী হলেও তা সবসময় কালের সাক্ষ্য বহন করে না। কিন্তু বিজন ভট্টাচার্য নবান্নের ভেতর তৎকালীন প্রেক্ষাপটকে এমনভাবে তুলে ধরলেন যা কিনা সর্বকালের সংগ্রামী চেতনার মূলে মানুষের হৃদয়ের সুকোমল পর্দায় নাড়া দিয়ে যায়। আর সেই নাড়া শেকলের মতো দোলা দিতেই থাকে সচেতন মানুষের মনে। এই নাটকের বৈশিষ্ট্য হলো – এর চরিত্রগুলো বাংলার শোষণ, অত্যাচারের ও প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে। আর তা আরো গভীর হয়ে ওঠে মঞ্চের আলো-আঁধারির খেলায়। চরিত্রগুলোর দৃঢ়তা মানুষকে আশাবাদী করে তোলে। ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে (খুব প্রত্যক্ষ না হলেও) এ-যেন উলটো চোখ রাঙানির প্রাথমিক পদক্ষেপ, যা কিনা পরবর্তী সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করেছে, সাহস জুগিয়েছে।
এই নাটকে পৃথক পৃথক চরিত্রের মধ্যে নাট্যকার তুলে ধরেছেন পৃথক পৃথক ব্যক্তিত্ব। আমরা যখন দেখি মোরগের লড়াই – এ লড়াকু মোরগদের নিয়ে তাদের মালিকদের কথা বলার নিজস্ব ঢং – তা থেকে বোঝা যায় প্রত্যেক চরিত্রের মধ্যে রয়েছে এক আলাদা ধরনের ব্যক্তিত্ব। অর্থাৎ চরিত্রগুলো যে যেখানে আছে সেখানে কেউ তার নিজ নিজ ব্যক্তিত্ব থেকে সরে যায়নি। কখনো দেখি আবার প্রধান সমাদ্দারের কথাবার্তায় – এমনিভাবে একে একে ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটেছে কুঞ্জ সমাদ্দার, নিরঞ্জন সমাদ্দার, পঞ্চাননী, রাধিকা প্রভৃতি জনের মধ্যে। ‘বিজন ভট্টাচার্যের জনতা কখনোই কোরাস হয়ে ওঠেনি।’ তাঁর নাটকে তিনি ব্যক্তিত্বের বিচিত্র রূপ দিয়েছেন। তিনি ব্যক্তিকে স্পষ্ট এবং সজীব করেছেন। নবান্নতে চরিত্রের বহুলতা সত্ত্বেও নাট্যকার তা করতে সমর্থ হয়েছেন। দুর্ভিক্ষের শিকার-পরবর্তীকালে ভিক্ষুক বলে যাদেরকে দেখি সেই চাষিরা প্রায় একই ভাষায় কথা বলে। কিন্তু তারই মধ্যে তুলির সূক্ষ্ম টানে চরিত্রগুলোর ব্যক্তিগত মূর্তি দাঁড় করিয়েছেন নাট্যকার – কুঞ্জ যেভাবে প্রধানকে অনুযোগ, অভিযোগ, গঞ্জনা করে, কখনো কখনো প্রতিবাদই করে; নিরঞ্জন আস্তে আস্তে গ্রামের নেতৃত্বের দায়িত্ব নেয় বয়সভিত্তিক গ্রামীণ অধিকারভেদকে ভেঙে দিয়ে, সে তার যৌবন, সাহস ও বিবেচক দায়িত্বশীলতার সমর্থে সকলের সমীহ অর্জন করে।
অপরদিকে বৃদ্ধা পঞ্চননী (প্রধান সমাদ্দারের স্ত্রী) মিছিলে এগিয়ে গিয়ে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে বিপ্লবের সূচনা করে দিয়ে যায়। মৃত্যুর অন্ধকার গ্রাস করে তাকে কিন্তু তার ভেতরেও ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে হাত ইশারা করে সকলকে এগিয়ে যেতে বলে। অর্থাৎ তার দৃঢ়তার মধ্যে বিপ্লবের যে-আগুন নিহিত ছিল তা নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্নকে সফল করে তুলেছে, যার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় বর্তমানের 888sport promo code-আন্দোলনের ভেতর। বটবৃক্ষের ছায়ায় ছোট গাছ বাড়ে না আর তাই সমস্ত ঝড় সামলে বটবৃক্ষ ভূপতিত হয়ে জায়গা করে দেয় নতুন গাছকে – পঞ্চাননী সেই বটবৃক্ষ।
অভাব-অনটন মানুষকে করে তোলে বিক্ষিপ্ত। রাধিকা চরিত্রটিও  তেমনি বিক্ষিপ্ত একটি চরিত্র। তার মধ্যে আছে প্রেম, আছে øেহ, আছে শাসন অথচ দারিদ্রের কারণে সে তা ব্যক্ত করতে পারে না। তার পরিবর্তে কিছু বিষোদ্গার করে তিক্ততার সৃষ্টি করে। দেখা যায়, এক চোখে অভাবের খরা আরেকদিকে ভালোবাসার বন্যা – দুই-ই আছে তার দুচোখে। কিন্তু বাস্তবের কঠোরতায় তার চোখের খরার দিকটিই বেরিয়ে এসে পোড়ায় তার আপনজনদের। তার ভালোবাসার জন্য বন্যা আর প্লাবন ঘটায় না। কষ্ট-অভাবে 888sport app পড়ে যায় তার øেহময় চরিত্রটি।
কিন্তু কেন? সেও তো সেই অভাব। অভাবের করাল গ্রাস তার চরিত্রের কোমলতাকে গ্রাস করেছে। কিন্তু এই রাধিকা চরিত্রটির মৌলিক রূপের বহিঃপ্রকাশ ঘটে নাটকের শেষ দৃশ্যে। অর্থাৎ সকলেই যখন গ্রামে ফিরে আরে, নতুন ধান তোলে গোলায়। গ্রামবাংলার মাতৃরূপ তার মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। খোকনকে হারানোর বেদনা ভুলে সে সন্তানøেহে আঁকড়ে তুলে নেয় নিরঞ্জন আর বিনোদিনীকে। চিরন্তন বাঙালির রূপ এখানে বিদ্যমান।
চরিত্রের ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলোচনার আরেকটি দিক হলো অন্যরকম, বিষয়টি নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। যেটা হলো ব্যক্তিত্ববোধ, মানুষের মৌলিক চরিত্র, যা ধার করা যায় না। যেমন নাটকের একটি দৃশ্যে দেখা যায় – ‘হারু দত্তের একটা চেহারা চাষীদের ঘরে ঘরে। যেখানে সে ছলে বলে কৌশলে প্রধানের জমি গ্রাস করতে চায়। ‘ছোটলোক’ বলাতে কুঞ্জ প্রতিবাদ করায় সে ক্রুদ্ধবিস্ময়ে বলে – ‘বেটা হারামজাদার কথা শোন, ‘ছোটলোক’ গালাগালি হলো!’ তারপর লাঠিয়াল ডেকে কুঞ্জ আর প্রধানকে পেটায়। অন্যদিকে কালীধন ধারার আড়তে তার অন্য এক ইয়ার মুরুব্বি গোছের চেহারা তৈরি হয়। আর এদিকে দ্বিতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্যে মেয়ে কেনাবেচার সময় খুকির মার সঙ্গে ফষ্টিনষ্টিতে তার আর একটি মুখ বেরিয়ে পড়ে। সবগুলিই সুসংহত, আলাদা আলাদা দৃশ্য জুড়ে নাট্যকার হারু দত্তের আস্ত মূর্তি তৈরি করেন। তবে কালীধন, রাজীব, ফটোগ্রাফার ইত্যাদি চরিত্র কিছুটা এক সেটে রঙে মাখানো, তাদের ব্যাপ্তি কম। যে নাটকে চরিত্র 888sport free betটি এত বেশি, সেখানে সমস্ত চরিত্র পূর্ণাঙ্গ চেহারা পেয়ে দর্শকদের দৃষ্টির কেন্দ্রে এসে দাঁড়াবে না, তা বলাই বাহুল্য।’ সাম্প্রতিককালের নাটকগুলোতে এই ধারার প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়।
প্রধান-চরিত্রে আলাদা ব্যক্তিত্ব আছে, যা অনুপ্রাণিত করে নিরঞ্জনদের মতো তাজা জোয়ান প্রাণদের, যারা কিনা স্বপ্নের বীজ বপন করবে পৃথিবীতে। তাই তো কুঞ্জ আর নিরঞ্জন যখন পালিয়ে যাওয়ার কথা বলে, তখন দ্বিধাগ্রস্ত প্রধান প্রতিরোধের কথাই বলে। ‘কুঞ্জ ও কুঞ্জ আমি প্রাণ দেব রে কুঞ্জু। শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে আমি প্রাণ দেব রে কুঞ্জ। আমি প্রাণ দেব’ – অবশ্য তার এই প্রতিরোধ সংকল্পের কারণ তীব্র পুত্রশোক। দুই সমর্থ ছেলে শ্রীপতি-ভুপতিকে হারিয়েছে পুলিশ-মিলিটারির আক্রমণে। মিছিলে প্রাণ হারাল তার স্ত্রী পঞ্চাননী। প্রধানের আর তো কিছু হারানোর ছিল না, তাই পালিয়ে যাওয়াকে ঘৃণার চোখে দেখছে প্রধান। সে মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায়, নয়তো প্রাণ দিতে চায়। শহরে একমুঠো অন্নের জন্যে হন্যে হয়ে ঘোরাঘুরি, ফটোগ্রাফারদের ছবি তোলা, ডাক্তারদের পরীক্ষা করা সবকিছুর মধ্যেই তার প্রতিবাদী চেহারা পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ দেখা যায় নবান্ন নাটকের প্রতিটি চরিত্রেই নিজ নিজ ব্যক্তিত্বে মহিমান্বিত।
যে-কোনো সৃষ্টির মূলে রয়েছে গভীর জীবনবোধ। আরো সহজ করে বলা যায়, দেখা এবং উপলব্ধি। যা কিনা একটি মানুষ ভাবছে উপলব্ধি করছে আবার সেটিকে মর্মমূলে ঠাঁই দিয়ে জীবনকে একটি জায়গায় দাঁড় করিয়ে তার ভেতরকার সত্যকে মনেপ্রাণে ধারণ করছে সেটা তার নিজস্ব দর্শন। কিন্তু ব্যক্তিজীবনের এই দর্শন ধরা পড়ছে তার সৃষ্টির মধ্যে। কারণ সেই ব্যক্তি তার ভাবনার গণ্ডিকে কখনো অতিক্রম করে না। অর্জন, প্রাপ্তি এবং ত্যাগ সবকিছু মিলিয়ে জীবনকে তাঁর নিজস্ব আঁকা ছবি একটি ফ্রেমে বাঁধিয়ে নেন। আর সে ফ্রেমের ভেতর তার চিন্তাশক্তি ঘুরপাক খেতে থাকে এবং সেই চিন্তাশক্তি একটি ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। আর সেই প্রবাহিত ধারা তাঁর সৃষ্টিকে বহন করে নিয়ে যায় কালের দরজায়।
নবান্ন নাটকেও তেমনি নাট্যকারের নিজস্ব দর্শন লক্ষ করা যায়। আর সেই দর্শন বিশ্বদর্শনের ছোঁয়ায় আরো সমৃদ্ধ হয়ে যায়। নবান্নের পরও তাঁর অনেক সৃষ্টিতে আছে জীবনের ছবি, তাঁর ভাবনা-চিন্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে যাতে – যেমন : জবানবন্দী (১৯৪৩), অবরোধ (১৯৪৬), মরাচাঁদ (১৯৪৬), অপেরাধর্মী রূপক নাট্য জীয়নকন্যা (১৯৪৭), কলঙ্ক (১৯৫১), জতুগৃহ (১৯৫২), গোত্রান্তর (১৯৫৭), ছায়াপথ (১৯৬১), দেবীগর্জন (১৯৬৯), ধর্মগোলা (১৯৬৭), কৃষ্ণপক্ষ (১৯৬৬), গর্ভবতী জননী (১৯৬৯-৭১), মুক্ত অঙ্গন (১৯৬৯), স্বর্ণকুম্ভ (১৯৭০), রূপক নাট্য আজ বসন্ত (১৯৭০), একাঙ্ক লাশ ঘুইরা যাউক (১৯৭০), সোনার বাংলা (১৯৭১), চলো সাগরে (১৯৭০-৭২), চুল্লী (১৯৭২-৭৪), হাঁসখালির হাঁস (১৯৭৪-৭৭)।
কিন্তু এই সকল নাটক রচনা করা সত্ত্বেও তাঁর গোড়ার নাটক নবান্নের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় এক ভিন্নধর্মী রূপ, চেতনা ও জীবনদর্শন। এ যেন এক আলাদা স্বাদের। পরবর্তীকালের সৃষ্টিগুলো যেন মনে হয় নবান্নের ধারা থেকেই এসেছে। অর্থাৎ মৌলিক সৃষ্টি বলতে যা বোঝায় তাই নবান্ন। ভিন্ন তার স্বাদ, ভিন্ন তার রূপ এবং ভিন্ন তার দর্শন। আর সেই মৌলিক সৃষ্টিকে কালের চাকা হিসেবে গড়িয়ে দিলেন বিজন ভট্টাচার্য আগামী দেশকাল ও সময়ের দিকে।
বিজন ভট্টাচার্যের অবদান তাঁর এই মৌলিক রচনার মধ্যে। আগেই বলেছি নবান্ন নাটকের যখন মহড়া চলছিল, তখনো অন্য থিয়েটারগুলোর মধ্যে আমরা পৌরাণিক কাহিনি ও রাজ-রাজড়াদের কাহিনিভিত্তিক অভিনয় দেখতে পাই। নবান্ন-পরবর্তীকালে দেখি বিদেশি নাটকের 888sport app download apk latest version, ভাবানুবাদ, ছায়ানুসরণ বঙ্গীয় নাট্য-আন্দোলনের বড়মাপের একটি জায়গা দখল করে রেখেছে। কিন্তু নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য মৌলিক নাটকই রচনা করেছেন এবং সেইসব নাটকের কথাবস্তু, চরিত্র, দ্বন্দ্ব, সংলাপ, সবই এই বাংলার মাটি থেকে উঠে এসেছে। নাট্যকারের পা দুটি দেশের মাটিতে থাকলেও দৃষ্টি ছিল আন্তর্জাতিক। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘কমিউনিস্ট আন্দোলনে না এলে নাট্যকার হতাম না। আমার পক্ষে নাটক লেখা সম্ভব হতো না।’ আরো লিখেছেন, ‘…888sport live chatী দেখবেন তাঁর খোলা দু’চোখে। সাধারণ মানুষের জানের লড়াই-এর সঙ্গে প্রাণের লড়াইও তাকে চালিয়ে যেতে হবে। 888sport live chatী হিসেবে এই দায় আমি আজ সমধিক বলেই বিশ্বাস করি।’
গণনাট্য আন্দোলনে ‘সেকাল ও একাল’ নিবন্ধেও তার দায়বদ্ধতা অত্যন্ত সুস্পষ্ট – ‘মানুষের কল্যাণে রুটির লড়াইয়ের সঙ্গে প্রাণের লড়াইকে একসূত্রে বেঁধে নাট্য-আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই গণনাট্যের মর্মকথা। মানুষের প্রতি বিশ্বাস ও 888sport live chatকর্মের প্রতি একনিষ্ঠ 888sport apk download apk latest versionই গণনাট্য 888sport live chatীকে স্ব-মহিমায় প্রতিষ্ঠা দিতে পারে। এই প্রত্যয়-ই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বিজনবাবুকে নাট্যকর্মে প্রাণিত রেখেছিল। শ্রমজীবী মানুষের প্রতি সুগভীর নিষ্ঠায় শুরু করেছিলেন যে-নাটক (আগুন) তাতেই প্রতিভাত হয়েছিল সমকালীন শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্তের জীবনসংগ্রাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কলকাতায়-চাটগাঁয়ে জাপানি বোমা পড়েছিল। চালের চোরাবাজারির দৌরাত্ম্যে ঘনিয়ে এসেছিল অনাহারের অন্ধকার। পরাধীন দেশে শাসনযন্ত্রের নৃশংসতা প্রকট হয়েছিল। বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম নাটকেই ভাস্বর হয়েছিল সারিবদ্ধ মানুষের মনে পারস্পরিক সমবেদনা ও ঐক্যবদ্ধতার সংকেত।
আসলে একা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। হাতে হাত না রেখে, কাঁধে কাঁধ না মিলিয়ে সমাজবিপ্লবের স্বপ্ন দেখা সম্ভব নয়। হয়তো সমবেত পথচলায় আছে কখনো হিংসা, দ্বেষ, মতপার্থক্য ইত্যাদি। তবু এগুলোকে তুচ্ছ করে এগিয়ে যাওয়ার নামই হলো বিপ্লব, যে-বিপ্লব বাঁচতে শেখায়, পথ দেখায় নতুন আলোকিত দিনের। সমবেত প্রচেষ্টায় ফসল ফলিয়ে সে-ফসল ঘরে তোলার আনন্দই আলাদা। বিজন ভট্টাচার্য তাই নবান্নতে বহুল চরিত্রের আবির্ভাব ঘটিয়ে তাদের মুখ দিয়ে কথা বলিয়ে স্বপ্ন তৈরি করেছিলেন। সাধারণ মানুষের মনে জাগিয়েছিলেন যে, সমবেত প্রচেষ্টায় স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ সম্ভব। চিহ্নিত করেছিলেন সমাজের ঘৃণ্য অপরাধীদের, যাদের করাল গ্রাসে নিপীড়িত সাধারণ মানুষের অপমৃত্যু ঘটেছিল তিলে তিলে।
সময় একটা বিরাট ব্যাপার, যা কিনা গোলে পাঠানোর জন্য বল তৈরি করে। আর এই ‘বল’ হলো দেশের 888sport live football, যা মানুষের চোখের সামনে উন্মোচন করে অজানা দিক। এই অজানা হয়তো লুকিয়ে থাকে। মানুষের মনের গভীরে। সামনে এলেই আপন প্রজ্ঞায় সে তাকে জানতে পারে। আর 888sport live football এই কর্মটি করে নিপুণ হস্তে। সাধারণ মানুষ কোনো আন্দোলনে অংশ নিলে নেতৃত্বদানকারী থাকেন সকলের সামনে। আর সেই নেতৃত্ব সশরীরে না দিয়ে কলমকে হাতিয়ার করে দেওয়াও সম্ভব। আসল কথা হলো মানুষের মনের চেতনার দুয়ারে আঘাত করা। আর তেমনি এক অস্থির সময়ে এই নাট্যকার লেখনী ধারণ করে আন্দোলনের গতিকে করলেন ত্বরান্বিত। মানুষের মনে বিপ্লবের আগুন জ্বালাতে সমর্থ হয়েছিলেন তিনি। কারণ – কুৎসিত শাসন আর নিরঙ্কুশ শোষণের অনিবার্য ফলে 888sport appsের গ্রামীণ জীবন চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। নেমে এসেছিল সমস্ত দেশব্যাপী মন্বন্তরের করাল ছায়া। নিরন্ন মানুষের বিরামহীন ভুখা মিছিল হাহাকার করে ফিরছিল শহরের অলিতে-গলিতে রাজপথে। প্রাণের অপচয়ের সেই নিষ্করুণ ইতি বৃত্তান্ত সমগ্র জাতির জীবনে লেপন করেছিল কালিমা। সেই সময়ের বীভৎতা নাট্যকারকে ব্যথিত করে তুলেছিল, কাতর করে তুলেছিল – আর সেই কারণে নবান্ন রচিত হয়। এ যেন সমাজের কাছে দায়বদ্ধতার ফসলস্বরূপ এক নাটক। সাধারণ মানুষ তখন রঙমহলের দরজা ছেড়ে ভুখা নাঙা মানুষের জীবন নিয়ে রচিত নবান্ন নাটকের মঞ্চে অভিনয় দেখে সম্বিৎ ফিরে পায় – এ যে তাদেরই কথা, অর্থাৎ তারা যা বলতে চেয়েছিল অথচ বলতে পারেনি, সেই কথাই বিজন ভট্টাচার্য বলাচ্ছেন ছেঁড়া নোংরা কাপড় পরা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মুখ দিয়ে। এই তো বাংলার মানুষের আসল ছবি। প্রমোদে বিভোর মানুষের মুখ ঘুরিয়ে জয়ের মুকুট পরে নবান্ন নাটক তখন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায়। আর তারই পথ ধরে আসে নাটকে নতুন চিন্তা নতুন ভাবনা। আর সেই ভাবনাচিন্তার ফসলই হলো আজকের দিনের নাটক, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এসেছে আরো নতুন ভাবনায়, নতুন চিন্তায় অনেক ধাপ উপরে। বুনিয়াদ শক্ত হলে ইমারত হয় ততটাই মজবুত।
নবান্ন নাটকে যে সকল সাধারণ মানুষের জীবনপ্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে তা হলো ’৪৩-এর মন্বন্তরের প্রেরণায়। এরপর ভারতের রাজনীতিতে আসে একের পর এক পরিবর্তন। আর এই পরিবর্তনের কারণে নাট্যকারেরা পেয়ে যান নতুন নতুন বিষয়। 888sport live chatীদের কণ্ঠে শোনা যায় প্রতিবাদী গানের ঝংকার। নাটকে নানান সময়ে সংগীতের ব্যবহার দেখা যায়। পৌরাণিক কাহিনি, রাজা-মহারাজার কাহিনিতেও এর ব্যবহার দেখা গেছে। কিন্তু মানুষের নিজের মুক্তির কথা, সংগ্রামের কথা, বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে দেখা গেছে এবং বর্তমানের নাটকও সে-ধারাকে সমুন্নত রেখেছে। দেশের রাজনীতির পটভূমির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সর্বভারত এবং সমগ্র বাংলার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়, সংস্কৃতিতে আসে বিরাট পরিবর্তন। আর সংযোজন হয় মানবধর্মী নানান গানের সুরধ্বনি। রাজনৈতিক পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা লক্ষ করলে পরবর্তী নাটকগুলোর মধ্যে সমগ্র চিত্রটি দেখতে পাওয়া যায়। লেখকের লেখনী যেহেতু কালের সাক্ষী, তাই সে-সাক্ষী থেকে জানা যায়, কীভাবে তাদের চিন্তায় অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সামাজিক পরিস্থিতি ও সর্বোপরি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছায়া ফেলেছিল।
নবান্ন থেকে শুরু হয়েছে সরাসরি মানুষ, মনুষ্যত্ব মানবিকতার কথা বলা নাটকে যা আজো অব্যাহত রয়েছে। কখনো রয়েছে ইতিহাসকে ধরে আবার কখনো বা রয়েছে চলমান সময়কে ঘিরে – এভাবেই চলছে নাটকের ঘূর্নীমাতন। নানান ধরনের অসঙ্গতি ও ত্র“টি থাকা সত্ত্বেও এ-ধরনের নাটকগুলো সমাজের দলিল হিসেবেই পরিচিত লাভ করেছে সেকালেও এবং বর্তমানকালেও।
তবে নবান্নের সমাজ-পরিপ্রেক্ষিতটা সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা আমরা লক্ষ্য করেছি। এটি একটি দিক-নির্দেশনা নিঃসন্দেহে। ‘পুরান ইতিহাসের রোমান্টিক পরিবেশের ক্লান্তিকর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে এসেছে এই নাটক। যার চরিত্রগুলো কিনা একেবারেই আলাদা ধরনের অর্থাৎ একেবারে মাটির গন্ধভরা শরীর কৃষক শ্রেণি। যারা জীবনের দুঃখদেন্যকে প্রকাশ করেছে, তারা সেইসব অবহেলিত উপেক্ষিত মানুষ। আর এইসব চিরপরিচিতি চরিত্র নূতনত্বের দীপ্ত নিয়ে সেই সময়টাও জনসমুদ্রে কোলাহলের ঢেউ তুলেছিল। আর সেই ঢেউ দুর্বিনীত হয়ে আজ ছুটে চলেছে নানা সময়ে নানা ঘটনার মধ্যে। আর এই ধারাকে খর্ব করার মতো সাহস শক্তি কারো নেই। নবান্নের নবচেতনার আন্দোলন থেকেই বাঙালি নব নাট্যধারার সূত্রপাত।
বিজন ভট্টাচার্যের নবান্ন গণজীবনের প্রতিচ্ছবি। এই নাটকগুলি শুধু আর্ট হিসেবেই প্রশংসনীয় নয়, দুঃখ-নিপীড়িত মনুষ্যত্বের প্রতি এই নাটক যে বেদনা জাগ্রত করে, তার মূল্য অনেক (যুগান্তর পত্রিকা)
নবান্ন-নিরন্ন মানুষের মুখ চেয়ে নাট্যকার লিখেছিলেন আর ১৯৪২ সালের জাতীয় অভ্যুত্থান আগস্ট আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়েই তিনি এটি লিখেছিলেন।, যা তাৎপর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে এবং নবান্নর কাহিনীর ভিতরের সারবস্তু নাটকটির গুরুত্ব বহন করে।
যেমন – একটি øিগ্ধ গ্রাম, গ্রামের মানুষ – যারা ছিল মোটামুটি স্বচ্ছল। হঠাৎ আগস্ট বিপ্লব এলো, চাষিরা আন্দোলনে অংশ নিল এবং বেশি কিছু চাষি প্রাণ হারালো। খাদ্যাভাবে পড়লো চাষিরা, দুর্ভিক্ষের করাল থাবা নেমে এলো এইসব গরিব মানুষদের জীবনে। স্বল্পমূল্যে সুবিধাবাদীরা চাষিদের জমি হাতিয়ে নিল, জীবন সমস্যার সমাধান হলো না বরং আরো ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ চাষিদের বেষ্টন করল ও মড়ক এলো সঙ্গে। দুমুঠো অন্নের জন্যে মানুষের হাহাকারে ভারি হয়ে উঠল আকাশ-বাতাস। চাষিরা শহরে গেল বাঁচার আশায়। কিন্তু সেখানেও মুক্তি মেলেনি। আড়তদার করল চাল মজুত, মোটা মুনাফা লুটল আর সেই মুনাফার যাতাকলে পিষ্ট হতে থাকলো সাধারণ মানুষ। শহরে ফটোগ্রাফার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের কঙ্কালসার পল্লীবধূর ছবি তুলে বাংলার ম্যাডোনা আখ্যা দিয়ে চড়া দামে বিক্রি করল। ভিক্ষার পয়সাটুকু হাতে গুঁজে দিয়ে মহানুভব উপাধি কেনে। সাধারণ মানুষ শান্তি পেল না কোথাও, পেল না খানিকটা সহানুভূতি। এক লঙ্গরখানা থেকে আর এক লঙ্গরখানায় সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতো টোক্কর খেয়ে বেড়ালো। এই সকল দুঃখ ও অবিচারের শেষ হলো। অন্নহীন জনতার ভিড় থেকেই প্রতিরোধের ইঙ্গিত এলো। আর তাই আড়তদারের জেল হবার পর নিরঞ্জন শহরে আড়তদারের চাকরি চেড়ে পরিত্যক্ত ভিটা আমিনপুরে ফিরে এলো এবং আবার বাসোপযোগী করে তার স্ত্রী বিনোদিনীকে নিয়ে বসবাস করতে শুরু করল। শুধু বসবাস নয়, নেতৃত্ব দিয়ে নিরঞ্জন গাঁয়ের মাতবক্ষর চাষি দয়াল মণ্ডলকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দু-মুসলমান চাষিকে সংঘবদ্ধ করল। এবং প্রতিজ্ঞা করে স্বল্পাশিষ্ট জমিতে পৃথকভাবে চাষ না করে সমবেতভাবে গতর খাটিয়ে জমিতে ফসল ফলাবার সিদ্ধান্ত নিল। দৃপ্ত শপথের পতাকাতলে সংঘবদ্ধ হয়ে বলল ‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা, মারী নিয়ে ঘর করি’- নিপীড়িত চাষিরা উঠে দাঁড়াল সবশেষে শুরু হলো তাদের নবান্ন উৎসব। কুঞ্জ ফিরে এলো – এলা তার স্ত্রী রাধা, শহরের ফুটপাতে হারিয়ে যওয়া অর্ধোন্মাদ প্রধান সমাদ্দার ও এলা। উৎসব প্রাঙ্গনে মুখরিত হলো চাষি বউয়ের নবান্ন পালনের গানে। আর সেই উৎসব প্রাঙ্গণে চাষি প্রতিনিধি হিসেবে দয়াল মণ্ডল ঘোষণা করলো আগামী দিনের শপথ। আর তার শপথের মধ্যে দিয়েই শেষ হয়ে গেল নাটকের কাহিনী।
নবান্ন নাটকের আর একটি বৈশিষ্ট্যও ধরা পড়ে, সেটা হলো এক নায়ক তত্ত্বের উচ্ছেদ। এই নাটকে সমস্ত জনতাই যেন নায়ক। প্রধান সমাদ্দারের ব্যক্তি দুঃখের প্রকাশ আসলে সমগ্র চাষি জীবনেরই প্রকাশ। আর এখানেই নাটকটি তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে অনেক অসঙ্গতিকে ছাড়িয়ে।

তথ্যনির্দেশনা
১।     ভারতবর্ষের ইতিহাস – কোকা আন্তোনভা, গ্রিগোরি বোনগার্দ – লেভিন কতোভস্মি। (সংক্ষিপ্ত রূপরেখা)।
২।     নট নাট্যকার নির্দেশক বিজন ভট্টাচার্য – একটি আলেখ্য
৩।     নবান্ন নাটক – বিজন ভট্টাচার্য।
৪।     সমকালীন দৃষ্টিতে : সমালোচনার সমালোচনা (নবান্ন প্রসঙ্গে), ‘নবান্নে’র নাট্যধর্ম, নবান্নের ঐতিহাসিকতা।
৫।     নবান্নের নাট্যকারের 888sport world cup rate – বিজন ভট্টাচার্য (পুনর্মুদ্রন  – অভিনয় দর্পণ, জানু-ফেব্র“ ১৯৬৯ খ্রিঃ)।
৬।     ‘নবান্ন’ ও ভারতে সাম্যবাদী আন্দোলন – সুধী প্রধান (পুনর্মুদ্রণ – অভিনয় দর্পণ, মার্চ-এপ্রিল ১৯৬৯ খ্রিঃ)।
৭।     ‘নবান্ন’ 888sport sign up bonus – অরুণ মিত্র।
৮।     ‘নবান্ন’ ও আজ – দিলীপ রায়।
৯।     ‘নবান্ন’ চিন্তা – নীহার দাশগুপ্ত।
১০।     ‘নবান্ন’-র পঁচিশ বছর ও নাট্য আন্দোলন – বিষ্ণু দে (পরপর চারটি রচনাই বহুরূপী ‘নবান্ন’ – স্মারক 888sport free bet, ২য় সংকলন, জুন ১৯৭০ থেকে পুনমুদ্রিত)।
১১।     নাটক ‘নববান্ন’ – চিত্তরঞ্জন ঘোষ।
১২।     বাংলা নাটকের রাজনীতি ও ‘নবান্ন’ – অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় (পরপর দুটি রচনাই গন্ধর্ব, বিজন ভট্টাচার্য, বাংলা থিয়েটার আন্দোলন, আশ্বিন ১৩৮৪ থেকে পুনঃমুদ্রিত)।
১৩।     ‘নবান্ন’ নাটকের চরিত্র পরিকল্পনা – পবিত্র সরকার।
১৪।     ‘নবান্ন’র সংলাপ। ‘প্রমা’ প্রকাশিত ৭ম সংস্করণ (২০০ খ্রিঃ) থেকে পুনর্মূুদ্রিত।
১৫।     থিয়েটারওয়ালা – সপ্তম বর্ষ – প্রথম 888sport free bet, জানুয়ারি-মার্চ ০৫।
১৬।     নবনাট্য আন্দোলন : নাটক ও নাট্যকার (বাংলা 888sport live footballের ইতিহাস, বাংলা নাট্য 888sport live footballের ইতিহাস)।
১৭।     আধুনিক বাংলা 888sport live footballের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস – ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।