সেলিনা হোসেন
কুলসুম মনে করে বাড়িঘর নাটাইয়ের সুতো ছাড়ার গল্প। এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি একটি নাটাই। দিনযাপন নাটাইয়ের সুতো। অনবরত সেই সুতো ছড়াতে থাকে। ওর শৈশবে শুরু হয়েছিল নাটাইয়ের সুতো ছড়ানো। এখন সাতান্ন বছরের জীবনের দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে ও। ফিরে দেখছে ছেড়ে আসা বাড়িঘর। ভাবতে গেলে বুকে চেপে আসে। কত ঘটনা, কত 888sport sign up bonus। কত সময়ের রঙিন ক্যানভাস। সেই ক্যানভাসে ও এক বিন্দুসম মানুষ।
পঞ্চাশের দশকে কুলসুমের শৈশব বগুড়া শহরের গন্ডগ্রাম নামের এলাকায় কেটেছে। এখন সেই এলাকার নাম বনানী – পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে এখানে। সেই সময়ে সে-এলাকার যে-বাড়িতে ও থাকত, সেটি ছিল বাবার চাকরিসূত্রে পাওয়া সরকারি বাসভবন।
বাড়িটি তৈরি হয়েছিল মাটি দিয়ে, ওপরে ছিল খড়ের চাল। বড় আকারের এই বাড়িতে ছিল ষোলোটি ঘর। এই বাড়িকে নিয়ে ওর অনেক 888sport sign up bonus আছে। আনন্দের 888sport sign up bonusর পাশাপাশি কষ্টের 888sport sign up bonusও আছে। দুটি 888sport sign up bonusর কথা ও বলতে চায়। একটি 888sport promo code-নির্যাতন, অন্যটি মৃত্যু।
কুলসুমের দাদার বাড়ি নোয়াখালী। ওর মা তরিকুন্নেসা সেখান থেকে একটি কিশোরী মেয়েকে এনেছিল। ও মাকে গৃহকাজে সাহায্য করত। ছোটখাটো মেয়েটি কুলসুমের চেয়ে তিন-চার বছরের বড় ছিল। বছরখানেকের মাথায় ওর বাবা হামিদ সাহেব বললেন, আমার অফিসের পিয়ন ওসমানের সঙ্গে তারার বিয়ে দিয়ে দিই।
তরিকুন্নেসা খানিকটুকু দ্বিধা নিয়ে বলেছিলেন, ওসমানের চেয়ে তারা তো অনেক ছোট। দেখে মনে হয় প্রায় পঁচিশ বছরের ছোট হবে। এত ছোট মেয়ের বিয়ে –
হামিদ সাহেব স্ত্রী তরিকুন্নেসার কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, মেয়েদের আবার বয়স! দেখতে দেখতে বড় হয়ে যাবে।
তরিকুন্নেসারও ইচ্ছে ছিল তারার বিয়ে দেওয়া, নইলে হয়তো জোর প্রতিবাদ করতো। কিন্তু তেমন জোরালো প্রতিবাদ করেননি। যাই হোক, তারার বিয়ে হয়। ওর বিয়েতে কুলসুমসহ ছোটরা ওকে বউ সাজায়। গান গায়। খাওয়া-দাওয়া ফুর্তি করে। ছয় মাসের মাথায় পরিস্থিতি পালটে যায়। ওসমান ওকে মারধর করে। মাঝে মাঝে দরজার আড়ালে তুতগাছের সরু ডাল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘরের কাজে এদিক-ওদিক হাঁটলে সরু ডাল দিয়ে মারে। ওর কী অপরাধ তা কুলসুমের বোঝার বয়স ছিল না। দুজনের কাছাকাছি বয়স হওয়ার কারণে ওকে কাঁদতে দেখলে কুলসুমও কাঁদত। এখন ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট ওম্যান কুলসুমকে কাঁদায় না, প্রতিবাদী করে। মাঝখানে কত কত বছর গড়িয়ে গেছে। এখনো কোনো ঘরে নির্যাতনে কোনো মেয়ে বা 888sport promo codeকে কাঁদতে দেখলে কুলসুম তারার কান্নাই শুনতে পায়। এই বাড়িতে কুলসুমের সবচেয়ে ছোট বোন লাকীর মৃত্যু হয়। আট ভাইবোনের মধ্যে লাকী ছিল সবার ছোট। মৃত্যুর সময় ওর বয়স ছিল চার বছর। সন্ধ্যার সময় কুলসুম অন্য ভাইবোনসহ বিছানার চারপাশে বসে ছিল। লাকী অনবরত আববা-আববা করে ডাকছিল। চারদিকে তাকাচ্ছিল। সেদিন হামিদ সাহেব গিয়েছিলেন শিকার করতে। অনেক পাখি মেরে সন্ধ্যা নাগাদ বাড়ি ফিরেছিলেন। মেয়ের খবর শুনে ছুটে এসে ওকে কোলে তুলে নিয়েছিলেন। ও দুইবার আববা, আববা ডেকে মাথা কাত করেছিল। কুলসুমের বদরাগী বাবা এই মৃত্যুতে একদম শান্ত হয়ে গিয়েছিলেন। আর কোনোদিন রান্না খারাপ হলে ভাতের থালা ছুড়ে ফেলেননি। কোনো সন্তানের গায়ে হাত তোলেননি। কোনোদিন রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাননি। কুলসুমের মনে হয়েছিল, মাটির দেয়াল আর খড়ের চালের সেই বড়সড় বাড়িটি একটি মৃত্যুতে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বাড়িটির পেছনদিকের কামিনী ফুলের গাছটি থেকে ভেসে আসত সুগন্ধ। সেই গন্ধ বুকে নিয়ে ও ভাবত, লাকী বোধহয় ফুল হয়ে ওদের জন্য গন্ধ ছড়াচ্ছে। এই গন্ধ যে কুলসুম আগেও পেয়েছে, সেই 888sport sign up bonus লাকীর মৃত্যু ওকে ভুলিয়ে দিলো। কুলসুম মৃত্যু আর ফুলের সৌরভ এক করে দেখতে শিখল।
কুলসুমের কিশোরবেলার দিন কাটে রাজশাহীতে। বগুড়া থেকে বদলি হয়ে গেলেন হামিদ সাহেব। রাজশাহীর প্রথম বাড়িটি ছিল ভাড়া করা। এলাকার নাম গোরহাঙ্গা। এই বাড়িতে চারটি ঘর ছিল। একটি বড় উঠোন ছিল। কুয়ো ছিল। আর রান্নাঘরটি ছিল উঠোনের এক কোণে। শুকনো কাঠ দিয়ে রান্না করত তরিকুন্নেসা। বাড়িটি ছিল একতলা দালান।
বাড়ির পেছনে একটি পুকুর ছিল। শোবার ঘরের জানালার কাছে ছিল একটি লেবুগাছ। গেটের সামনে দুশো গজের সমান একটি সরু গলি ছিল। গলির দুপাশে ছিল কাঠের আড়ত। গলির পরেই প্রধান সড়ক। বের হতেই একটি ঢপকল ছিল। এখান থেকে সবাই খাবার পানি সংগ্রহ করত। এখনো সেই বিশালাকায় ঢপকল কুলসুমের 888sport sign up bonusতে আটকে আছে। অমন অদ্ভুতকিমাকার একটি বস্ত্ত ও দ্বিতীয়টি দেখেনি।
এই বাড়িতে থাকার সময় কুলসুম ছিল অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। ভর্তি হয় রাজশাহী পিএন গার্লস হাইস্কুলে। হেঁটে স্কুলে যেত। বাড়ি ফিরে মাঝে মাঝে পেছনের পুকুরের পাড়ে বসে থাকত। জলকাদা-কচুরিপানায় মাখামাখি পুকুরপাড়ের 888sport sign up bonus এখনো খুব মনে পড়ে। একটি সাদামাটা বাড়ির পেছনের 888sport sign up bonus সেই বাড়ির কথা 888sport app download for androidে রাখে – বাড়ির নিজস্ব কোনো বৈশিষ্ট্যের কারণে নয়।
শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত নাটাইয়ের সুতো গড়াতে থাকে। কুলসুম ভাবে, বাড়িঘরের গল্প একটা নাটাই। 888sport sign up bonus সেই নাটাইয়ের সুতো। ওটা গড়াতেই থাকে।
রাজশাহীতে আর একটি বাড়িতে ভাড়া থাকে হামিদ সাহেবের পরিবার। এলাকার নাম শিরোইল। লাল ইটের তৈরি এই বাড়িটির বৈশিষ্ট্য ছিল অন্যরকম। বাড়ির চারদিকে ঘর। মাঝখানে একটা শান-বাঁধানো উঠোন। আটটি ঘর ছিল বাড়িতে। এই বাড়ির পাশেও একটি পুকুর ছিল। বাঁধানো ঘাট ও সিঁড়ি ছিল। গোসলের উপযোগী পুকুর। মাঝেমধ্যে সেই পুকুরে সাঁতার কেটে এপার-ওপার করত কুলসুমরা দুই বোন। ভালোই সাঁতার কাটতে পারত, কুলসুম এখন সাঁতার কাটতে পারে না। বয়স তাকে জড়িয়ে ধরেছে। হাড্ডি ক্ষয় হওয়ার পালা শুরু হয়েছে। এখন পানি দেখলে ভয় পায়। একদিন কুলসুম আর শাহজাদী সাঁতার কেটে মাঝপুকুর পর্যন্ত যাওয়ার পর হঠাৎ খেয়াল করে যে, ছোট বোনটি আর সাঁতরাতে পারছে না। মাঝে মাঝেই ডুবে যাচ্ছে। চোখ গোল হয়ে যাচ্ছে। কী করবে, সেটা ও মুহূর্তে চিন্তা করে। তারপর এক ঝটকায় ওর চুলের গোছা ধরে টানতে টানতে ঘাটে নিয়ে আসে। এরপরে দুই বোন আর পুকুরে নামেনি। পুকুরপাড়ে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরত। সেই বড় লাল দালানটিকে কুলসুমের কুঠিবাড়ির মতো মনে হতো। এখন এই সাতান্ন বছর বয়সে কল্পনা করে আনন্দ পায় যে, ওই কুঠিবাড়িতে হয়তো কোনোদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাস করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তার এমনই প্রিয়।
বছরের মাথায় রাজশাহী সেরিকালচার কম্পাউন্ডে কুলসুমের পরিবার একটি সরকারি বাড়িতে যায়। হামিদ সাহেব ততদিনে সেরিকালচারের পরিচালক হয়েছেন। সরকারি বাসা হিসেবে বেশ বড়সড়। বাড়িটি দুভাগে বিভক্ত ছিল। একভাগ মূল অংশ। ড্রইংরুম, দুটো বেডরুম আর রান্নাঘর। আর একটি অংশে ছিল দুটি বেডরুম এবং স্টোররুম। এই বাড়ির নানা 888sport sign up bonus আছে কুলসুমের। ততদিনে স্কুলের পড়া শেষ করে কলেজে পড়ছে কুলসুম। বাড়িটির দক্ষিণদিকে ছিল রাস্তা। রাত দশটা পর্যন্ত রিকশা চলত। গাড়ির 888sport free bet ছিল কম। পায়ে হাঁটার মানুষ ছিল অনেক। রাস্তাটি কুলসুমের খুবই পছন্দের। অনেক রাতে ঘুম না এলে রাস্তার মানুষের কণ্ঠস্বর শুনতে ওর ভালো লাগত। সেজন্য কান পেতে থাকত। মাঝে মাঝে শূন্য রাস্তা ওকে কষ্ট দেয়। চৌষট্টির দাঙ্গার সময় হামিদ সাহেব তার সহকর্মী ভুবনেশ্বর গুপ্ত ও তার স্ত্রীকে এই বাড়িতে লুকিয়ে রেখেছিলেন। বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে বিহারিরা যখন আল্লাহু আকবর-নারায়ে তাকবির বলে বড় বড় ভোঁজালি নিয়ে মিছিল করে যেত, কুলসুম ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে থাকত।
এই বাড়ির 888sport sign up bonusতে কুলসুমের কৈশোরকাল থেকে তরুণ বয়সের সময় আছে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় ওর পুরো শরীর প্যারালাইসিসে অচল হয়ে গিয়েছিল। এই বাড়িতেই ও নতুন করে হাঁটতে শিখেছিল। এক পা বাড়ালে ধুপ করে পড়ে যেত। একদম নতুন করে হাঁটতে শেখা। এক অবি888sport app download for androidীয় সময় ছিল কুলসুমের জীবনে। এখন ও ভীষণ তরতাজা। ভোলা যায় না।
হামিদ সাহেব সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ার করেন এই বাড়ি থেকেই। কুলসুমও লেখাপড়া শেষ করে এই বাড়িতেই। সকালবেলা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস ধরতে ছুটত। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উজ্জ্বল সময়। লেখালেখির সূচনা এবং বিয়ে এই বাড়িতেই। অনেক 888sport sign up bonusর বাড়ি এটি। সামনের বাগানে দুটো নারকেল গাছ ছিল, একটি কাঠগোলাপ গাছে সাদা-গোলাপি মেশানো রঙের ফুল ফুটত। ড্রইংরুমের পাশের দেয়াল ঘেঁষে বেড়ে ওঠা স্বর্ণচাঁপার ফুল ছিঁড়ত কুলসুম ছাদে দাঁড়িয়ে। স্বর্ণচাঁপার অপূর্ব গন্ধ এখনো নাকে লেগে আছে। দৃষ্টিজুড়ে আছে সোনালি রঙের ফুলের ছোট আকার। কুলসুমের পঞ্চাশোর্ধ্ব জীবনের নাটাইয়ের সুতো ক্রমাগত ছুটছে। অনবরত বন্ধন তৈরি করেছে। বাড়ি তো শুধু দালানকোঠা নয়, সেখানে বন্ধনের সূত্র আছে। সেই সূত্রই তৈরি করে নাটাইয়ের সুতো। এখন এই বয়সে এসে মনে হয় বড় আনন্দ, বড় দুঃখ! ঘরের বন্ধনই তো মানুষকে আকাশ দেখায় কিংবা পাতাল!
চাকরিসূত্রে হামিদ সাহেব দীর্ঘদিন রাজশাহী থাকার কারণে বাড়ি বানিয়েছিলেন শিরোইলে। সুন্দর একটি দোতলা বাড়ি। চমৎকার বারান্দা ছিল। এ-বাড়িতে স্থায়ীভাবে থাকা হয়নি কুলসুমের। বেড়াতে গিয়ে থেকেছে। নিজের সংসার থেকে বাবার বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া। বিয়ের সূত্রে ততদিনে চলে এসেছে 888sport appয়। আবার নাটাই হয়েছে অন্য কোনো বাড়ি। বন্ধনের সুতো ছড়িয়েছে জীবনের পরিসরে।
888sport appয় প্রথম যে-বাড়িতে কুলসুম ছিল, সেটি ছিল সরকারি ফ্ল্যাট। একটি কলোনির দোতলায়। এ-বাড়িতে বাস করার সময় ও কলেজের চাকরি পায়। চাকরিতে শুরু হয় নতুন জীবন। এ-বাড়িতে ঘরে আসে দুই মেয়ে। এক বছরের ব্যবধানে জন্ম নেয় ওরা। কুলসুম ভাবে, ভালোই হয়েছে। পাশাপাশি ওরা বড় হয়ে উঠলে কাজ করার পরিসর বাড়বে। বছর দুয়েক এই বাড়িতে থাকার পরে একই কলোনিতে আর একটি বড় বাড়িতে যাওয়া হয়। বাড়িটির নাম ছিল ‘মনীষা’। নামটি ওকে বেশ ভাবিয়েছিল। এমন সুন্দর একটি নামের বাড়িতে বসবাস ওকে নিজের আত্মপরিচয় পৌঁছে দিয়েছিল। ভেবেছিল নাটাইয়ের সুতো বুঝি ওকে আকাশে পৌঁছে দিয়েছে। বেশ বড় ফ্ল্যাটটি ছিল একতলায়। বিশাল ড্রইংরুমসহ আরো ছয়টি রুম। সামনে-পেছনে ছিল লম্বা বারান্দা। ফুলের বাগান ছিল সামনে। পরে বাউন্ডারি ওয়াল। তারপর রাস্তা। রাস্তার পাশে ছিল অর্জুন গাছের সারি। অর্জুনের পাকা বিচি পড়ে থাকত গাছের তলায়।
মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় কুলসুম এই বাড়িতে কাটিয়েছে। ভেবেছে, একটি শ্রেষ্ঠ সময় এখানে ছায়া দিয়ে রেখেছে। বাবা-মা-ভাইবোন রাজশাহী থেকে সেই সময়ে এই বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। বিহারিদের উৎপাতে তারা রাজশাহীতে থাকতে পারেনি। যুদ্ধের শেষের দিকে হার্ট অ্যাটাকে স্বামী মারা যায়। একটি ধাক্কা। সেই শৈশবে মৃত্যু দেখার পরে এটি ছিল দ্বিতীয় মৃত্যু। তরিকুন্নেসা থেকে গেল কুলসুমের সঙ্গে। কেটে যাচ্ছিল দিন এই বাড়িতে। দুবছর পরে মারা গেল তরিকুন্নেসা। হার্ট অ্যাটাক। শবেবরাতের রাত ছিল সেটি। গভীর রাত। ডাক্তার ডাকার সুযোগ ছিল না। মায়ের মাথা নিজের কোলের ওপর রেখে কুলসুম অন্ধকারে তাকিয়েছিল। তার পাশে ছিল অন্য দুই ভাইবোন। রাতদুপুরে অর্জুনগাছের ওপরে কাকের ডাক শুনেছিল কুলসুম।
কুলসুম নাটাইয়ের সুতো আবার ছড়ায়। এবার একটি ভিন্ন ভাড়া বাড়ি। কুলসুমের কলেজ কাছে হওয়ায় হামিদ সাহেব বাড়িটি পছন্দ করেন। হাতিরপুল এলাকায়। তার এক অফিস কলিগ হাতিরপুলে থাকতেন। তিনি ঠিক করে দিয়েছিলেন। এত ছোট বাড়িতে এর আগে কুলসুম থাকেনি। বেশ কষ্ট হতো। এর মধ্যে ওর বড় ভাই এলেন ভাবি বাচ্চাদেরসহ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। তিনি পাকিস্তান এয়ারফোর্সে চাকরিতে ঢুকেছিলেন। যুদ্ধের সময় পেশোয়ারে ওয়ারশ ক্যাম্পে বনিদ ছিলেন। তিনি ফিরে এসে হাতিরপুলের বাড়িতে উঠলেন। তরিকুন্নেসা মারা যাওয়ার পরে হামিদ সাহেব ছেলেমেয়েদের সঙ্গে থাকতেন। তাই আর একটি বড় বাড়ির দরকার হলো।
এরপর যে-বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হলো, সেটি ছিল কলেজ স্ট্রিটে। ধানমন্ডির এক নম্বরের পরের একটি গলি। এই বাড়ির যোগাযোগও করে দিলেন হামিদ সাহেবের সহকর্মী। আগের বাড়ির চেয়ে এই বাড়ির ভাড়া ছিল বেশি। কত তা আজ আর মনে নেই কুলসুমের। এই বয়সে এসে মনে রাখার প্রয়োজনও নেই। তারপরও মনে হয়, নাটাইয়ের সুতোও ছাড়ার বিষয়টি থাকা দরকার। নইলে সুতোর খবরে গিঁট্টু পড়বে। এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে কুলসুম বাড়ির কথা ভাবে।
বাড়িতে তিনটি ঘর ছিল। বেশ বড় বড় ঘর। বারান্দার মতো বেশ বড় একটি গোলাকার জায়গা ছিল, সেটি ঘেরাও করে ড্রইংরুম বানানো হলো। সামনে ছোট্ট সবুজ মাঠ ছিল। গলিটি ব্লাইন্ড লেন হওয়ায় রিকশা-গাড়ির চলাচল তেমন ছিল না। এই বাড়িতে কুলসুমের বিয়ে হয়। ছোট বোনেরও বিয়ে হয়। বড় ভাই এয়ারফোর্সে যোগদান করলে এয়ারফোর্স কলোনিতে সরকারি ফ্ল্যাট পায়। হামিদ সাহেব রাজশাহীর বাড়িতে ফিরে যান। বাড়ি ছেড়ে সবাই চলে যাওয়ার আগে এখানে বসেই কুলসুম নিজে রেডিওতে শুনেছিল বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যাকান্ডের খবর। ওর মনে হয়েছিল চারদিক তোলপাড় করছে। ও চিৎকার করে সবাইকে রেডিওর সামনে জড়ো করেছিল। সেদিন কুলসুমের জীবনে এটি ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিন হয়েছিল। পরের বছরেই ওরা এ-বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কুলসুমের মুক্তিযোদ্ধা স্বামী মণিপুরিপাড়ায় একটি পরিত্যক্ত বাড়ি বরাদ্দ পায়। ওরা সে-বাড়িতে চলে যায়। দশ কাঠার বাড়িতে ঘর ছিল বেশ বড় বড় তিনটা। ঘরের সামনে ছিল বড় একটা উঠোন। তিনটা বড় আমগাছ ছিল। জাম ও পেয়ারাগাছ ছিল। ফাঁকা জায়গায় একটি গোলাপ বাগান করেছিল কুলসুম। বিভিন্ন ধরনের গোলাপ চারা সংগ্রহ করে লাগিয়েছিল। ফুল ফোটার সময়টি ছিল খুবই অপরূপ। একটি বড় আকারের কুকুর পালত ওরা। খরগোশ, রাজহাঁসও ছিল। এই বাড়িতে বাস করার আনন্দ ছিল অন্যরকম। এই বাড়িতে কুলসুমের ছেলের জন্ম হয়। আর একদিন কুকুরটিকে হঠাৎ অসুস্থতায় সামনে দাঁড়িয়ে মরে যেতে দেখে ও। কুকুরটির মরে যাওয়ার কষ্ট সামলাতে সময় লেগেছিল ওর। মনে হয়েছিল নাটাইয়ের সুতোতে নতুন একটি গিঁট্টু পড়ল।
বাড়িটির সমস্যা ছিল একটি। প্রবল বৃষ্টিতে ঘর পর্যন্ত পানি উঠে যেত। পুরনো কালের বানানো বাড়ি। রাস্তার লেভেলের চেয়ে নিচু ছিল বাড়ির এলাকা। সেজন্য যে-দ্রুততায় পানি জমত, সে-দ্রুততায় পানি নামত না। বারো বছর থাকার পরে সেই বাড়িটি ছেড়ে কুলসুম পরিবার নিয়ে চলে যায়। বাড়িটা দুজনে মিলে কিনেছিল শ্যামলীতে। দোতলা বাড়ি। কুলসুমের বড়ভাই এয়ারফোর্স থেকে রিটায়ার করলে দোতলার ফ্ল্যাটটি কেনেন। অনেক পরে ওরা তিন ও চারতলা বানায়। বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলে পমি। বিডিআর মিউটিনির সময় পিলখানায় ছিল। বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হয়। এক বছর পরে বড় ভাই মারা যায়। ভাবি ও তার দুই মেয়ে ফ্ল্যাটটি আর একজনের কাছে বিক্রি করে দিয়ে অন্যত্র চলে যায়। শূন্য ফ্ল্যাটের খাঁ-খাঁ অংশ একটি পরিবারের অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার গল্প। কুলসুম ভেবে দেখেছে, এমন একটি গল্পই মানুষের নিয়তি।
কুলসুমের জীবনের নাটাইয়ের সুতো এই বাড়িতে এসে রাশ টানে। কুলসুমের সুখ-দুঃখ আনন্দ-বেদনার 888sport sign up bonus এই বাড়ি। এই বাড়িতে এসে কঠিনভাবে বুঝেছে, বাড়ি শুধু বসবাসের জায়গা মাত্র নয়, কখনো এই বাড়ি মহাকালের বিশাল প্রলয় হয়ে দিগ্বিদিক অন্ধকার করে দেয়। তার মধ্যে ঢুকে যায় একজন মানুষের পুরো জীবন। এই বাড়ি তেমন অভিজ্ঞতায় ভরিয়ে দিয়েছে কুলসুমকে। গত পনেরো বছর ধরে প্রবল শূন্যতা দৃষ্টিহীনের মতো রেখেছে কুলসুমকে। এই বাড়িকে আর তেমন আপন মনে হয় না, কাছেরও না। কখনো কোনো খুশির খবরে আনন্দিত হয়েছে, কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। এই বিষণ্ণতায় ডুবে গিয়ে এই বাড়ি এখন ওর স্থায়ী ঠিকানা। এই বাড়ি থেকে ওর ছাবিবশ বছর বয়সের ছোট মেয়ে চলে গেছে না-ফেরার দেশে। শিখছিল বিমান চালনা। দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয় বিমান। অন্য দুই ছেলেমেয়ে বিদেশে থাকে। একজন ভ্যাঙ্কুভারে চাকরি করছে। অন্যজন থাইল্যান্ডে আছে। মরে যাওয়া মেয়ের নানা কিছু এখন ওর ঘরে আছে। দুই ভাইবোন এই বাড়িতে আর কোনোদিন ফিরে আসবে কি না কুলসুম জানে না। কুলসুম জানে, ওরা ফিরবে না। ওরা ঘরমুখী ছেলেমেয়ে নয়। ওদের সামনে বাইরের পৃথিবী অনেক বেশি আকর্ষণীয়। কুলসুম চলে-যাওয়া মেয়েটির ছবির সামনে দাঁড়ায়।
ওরা দুজন এখন এই বাড়িতে থাকছে। নাটাইয়ের সুতো নিজের হাতে গুটিয়ে নিয়েছে কুলসুম। ভাবে, আকাশ দেখার স্বপ্ন শেষ। এ-বাড়িতে এখন শুধুই থাকা। আনন্দ-বেদনার ঊর্ধ্বে উঠে বসবাস। কুলসুম জানে, এই বাড়ি থেকে আর কোথাও যাবে না। যাযাবর জীবনের ঠাঁই এখানে – যেভাবে একসময়কার যাযাবর মানুষেরা পথ হেঁটে তাঁবু টানিয়ে জীবন কাটানোর পরে স্থায়ী বসবাসের জায়গা খুঁজে নিয়েছিল – সেভাবে কুলসুম নিজের জীবনকেও দেখতে চায়। যাযাবর জীবনের ধর্মের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া স্থায়ী বসবাসের পথও একদিন ফুরোবে। সেদিন দেহ থাকবে, প্রাণ থাকবে না। তখন বসবাসের বাড়ি খোঁজার দরকার থাকবে না। তার পরও বাড়ি ঘিরে মানুষের স্বপ্ন, বেঁচে থাকার সবটুকু। বাড়ি থেকে বাড়িতে নাটাইয়ের সুতো রেখে যায় একটি নতুন গিঁট্টু।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.