নায়িকার অটোগ্রাফ

বিশ্বজিৎ চৌধুরী

সকাল ঠিক নয়টায় ডাইনিং হলে প্রবেশ করলেন তিনি। বিশাল দরজা ঠেলে ঢুকেই দু-পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। সুপরিসর কক্ষটির ভেতর চোখ বুলিয়ে নিলেন একবার। প্রাতরাশ সাজানো গরম পাত্রগুলো কোন দিকে রাখা আছে এবং নিজের জন্য প্লেটে খাবার নিয়ে কোথায় গিয়ে বসবেন তা ঠিক করে নিলেন বোধহয় ওখানে দাঁড়িয়েই। তারপর ধীর অথচ দৃপ্ত পায়ে এগোলেন। সারি সারি ওয়ার্মার থেকে অল্প কিছু খাবার তুলে প্লেটে নিলেন, গিয়ে বসলেন কাচের দেয়ালের পাশে একটি টেবিলে।

মেঝে থেকে ছাদ অবধি এই কাচের জানালার পাশে বসে এখন তিনি বাঁ দিকে তাকালেই দেখতে পাচ্ছেন পরিকল্পনামাফিক বিন্যস্ত বিরাট সবুজ একটি মাঠ, যেটি একসময় গলফ খেলার জন্য তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত সে-কাজে আর ব্যবহৃত হয়নি। মাঠটি যেখানে শেষ, সেখান থেকেই সমুদ্রসৈকতের শুরু আর তারপরই তো সেই বিশাল জলরাশি ও ঢেউ। অতদূর অবশ্য চোখ যায় না। 

আমি যখন তাঁর টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, তখন তিনি শল্যচিকিৎসকের মতো গভীর মনোযোগ দিয়ে এক টুকরো মুরগির মাংসের ওপর ছুরি চালাচ্ছিলেন। বাঁ-হাতের কাঁটাচামচে গেঁথে তুলে মাংসটা মুখে পুরে তিনি তাকালেন আমার দিকে। তাঁর চেহারায় একটা জিজ্ঞাসা ছিল।

‘আমি এই হোটেলের ম্যানেজার।’ তাঁর সেই জিজ্ঞাসার উত্তর দিলাম আমি। 

তাতে তাঁর কিছু যায়-আসে না, মাথা নামিয়ে আবার খাবারের দিকে মনোযোগ দিলেন তিনি।

‘আপনার মতো একজন অতিথি পেয়ে … সত্যি বলতে কী … আমরা ধন্য।’

তিনি হাসলেন। সৌজন্য রক্ষার জন্য

কৃত্রিম হাসি। কিন্তু অভিনয় তো তাঁর সহজাত দক্ষতা, ওই বানানো হাসিটার মধ্যেও প্রায় আসল হাসির মতো একটা মন ভালো করা ব্যাপার আছে।

সদ্য স্নান সেরে এসেছেন। চুলগুলো এখনো ভেজা বলেই হয়তো খোলা রেখেছেন। ছোট একটা কালো টিপ কপালে। মুখে পাউডারের পাফ বুলিয়ে এসেছেন, কাজলও টানা হয়েছে চোখে। লিপস্টিক দেননি, তবে ভেজা ও উজ্জ্বলতার কারণে অনুমান করা যায় ঠোঁটে রংহীন অথচ চকচকে কিছু একটা লাগিয়েছেন আলতো করে। ঘিয়ে রঙের জামদানি শাড়ি আর কালোর ওপর সাদা প্রিন্টের ব্লাউজ পরা সাদামাটা সাজে পঞ্চাশ পেরোনো এই প্রাক্তন নায়িকাকে কী সুন্দরই না লাগছে! অথচ এই স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে কিছুতেই মনে হচ্ছে না live chat 888sportের এই নায়িকা ছিলেন আমাদের কৈশোর-যৌবনের অনিদ্র রাতগুলোর দুর্বাসনা!

খাওয়ার সময় একজন মানুষের সামনে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা নিশ্চয় অশোভন। তিনি ভ্রু কোঁচকাবার আগেই বললাম, ‘কফি খাবেন তো? আমি নিয়ে আসছি …।’

তিনি মাথা না তুলেই বললেন, ‘চিনি ছাড়া।’

হোটেলের ম্যানেজার নিজেই এক কাপ কফি নিয়ে এসে দাঁড়াল তাঁর সামনে, কিন্তু তাতে কৃতার্থ হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, বরং সামান্য হেসে যেন করুণা করলেন আমাকে। অতঃপর আমি তাঁকে আমার প্রথম যৌবনের একটা 888sport sign up bonus বলতে শুরু করলাম। তখন আমার বয়স বড়জোর

বিশ-888sport cricket BPL rate। আমাদের এক বড়লোক সহপাঠীর ফোর হুইলার গাড়িতে চেপে আমরা চার বন্ধু এই কক্সবাজারে বেড়াতে এসেছিলাম। তখন মেরিন ড্রাইভের সড়কটি ছিল না। আমরা ঢেউয়ের সঙ্গে দূরত্ব রেখে শুকনো বালুর সৈকতের ওপর দিয়ে হিমছড়ি যাওয়ার পথে পাহাড়ি ঝরনার ধারে একটি live chat 888sportের শুটিংদলকে দেখে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েছিলাম। তখন সম্ভবত শীতকাল, কারণ ঝরনাজলের ধারাটি খুব সরু হয়ে পড়েছিল মনে আছে। বাংলা ছবির বহুল ব্যবহৃত সখী সহযোগে আনন্দিত নায়িকার নৃত্যদৃশ্য চিত্রায়িত হচ্ছিল সেদিন। 

‘আমীর হোসেন নামের একজন নৃত্য পরিচালক আপনাকে নাচের মুদ্রা বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। একটা ক্যাসেট রেকর্ডারে গান বাজছিল, আপনি সেই গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাচতে নাচতে পাহাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসছিলেন। আপনার চারপাশে সখীরা, মানে আপনারা যাদের এক্সট্রা বলেন তারা কোমর দোলাচ্ছিলেন। সেই কবেকার কথা এখনো মনে আছে।’

এতক্ষণে সহর্ষে তাকালেন আমার দিকে, একটু উচ্ছ্বসিতও হলেন বোধকরি, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমার মনে আছে, হিমছড়িতে শুটিং হয়েছিল, বাবুভাই ছিলেন ড্যান্স ডিরেক্টর, ছবিটার কী যেন নাম …।’

‘রূপনগরের রাজকন্যা। পরে সিনেমা হলে গিয়ে দেখেছিলাম ছবিটা।’ 

‘তোমার তো দেখি অনেক কথা মনে আছে। সেই কবেকার কথা। … তুমি করে বললাম, কিছু মনে করো না। তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন, বসো না।’ 

অবশেষে বসার অনুমতি মিলল আমার। নায়িকার নামটা কিন্তু এখনো বলিনি। বলছি না, কারণ এই নামটা উচ্চারণমাত্র আপনারা তাঁকে চিনে ফেলবেন। এখন অভিনয় করেন না বটে, কদাচিৎ টিভি টকশোতে দেশের live chat 888sportের বর্তমান দুর্দশা নিয়ে কথা বলেন। তাছাড়া মাঝে মাঝে টেলিভিশনে পুরনো দিনের live chat 888sportগুলোও তো দেখানো হয়, যেগুলো আমরা হলে বসে দেখতাম। এখন অবশ্য এসবের অধিকাংশই হাস্যকর মনে হয়, তবে আমার এই প্রিয় নায়িকাকে দেখলে আমি নিজের 888sport sign up bonus খোঁজার জন্য টিভি সেটের সামনে থেকে নড়ি না।

আমি মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলাম।  আমার চশমাটা সাধারণত গলার সঙ্গে সরু ফিতেয় ঝুলিয়ে রাখি, প্রয়োজনমতো চোখে দিই। এখন চশমা চোখে দিয়ে নায়িকার দিকে তাকাতেই তাঁর অবয়ব জুড়ে বেশ কিছু বলিরেখা দেখতে পেলাম। এসব রেখা আমার সুদূর কৈশোর ও যৌবন থেকে আসা সরু পথের মতো। এই রেখাগুলোই হয়তো মনে করিয়ে দিলো আমার বয়সও চল্লিশ ছাড়িয়ে গেছে।

পর্যটন করপোরেশনের একজন মাঝারি মানের কর্মকর্তা হিসেবে আমি এখন কক্সবাজারের এই হোটেলটির মহাব্যবস্থাপক। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই করপোরেশনের হোটেল-মোটেল পরিচালনার অভিজ্ঞতা আমার আছে। কক্সবাজারের এই হোটেলটি ছিল একসময় এখানকার সবচেয়ে নামি ও অভিজাত। এখন সেই অবস্থা আর নেই, এই শহরটাতে চারদিকে এতসব ঝাঁ-চকচকে হোটেল- মোটেল-রিসোর্ট দাঁড়িয়ে গেছে, আমাদের হোটেলটি আর তার অবস্থান ধরে রাখতে পারেনি। হৃতগৌরব ফিরে পাওয়ার বিশেষ আগ্রহ করপোরেশনের আছে বলেও মনে হয় না। তবে এখনো কিচেন থেকে রুম সার্ভিস, ইলেকট্রিসিটি মেইনটেইন্যান্স থেকে বাগান পরিচর্যা ইত্যাদি নানা কাজে আমার অধীনে আছে পূর্ণকালীন বা খণ্ডকালীন অন্তত শ-দেড়েক কর্মী। সুখের কথা, বিরাট এলাকাজুড়ে অবস্থিত এই হোটেলটি তুলনামূলক কোলাহলমুক্ত বলেই হয়তো এর নিয়মিত অতিথি তালিকায় কিছু অভিজাত বিত্তবান লোকজন এখনো আছেন।

‘যতদূর মনে পড়ে আপনার মধুযামিনী ছবিটাই আমার দেখা শেষ ছবি।’

‘ওটাই আমার শেষ ছবি। আসলে কী জানো …’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নায়িকা বললেন, ‘জীবনে ভালো ছবি তো করেছি হাতেগোনা অল্প কয়েকটি। বেশিরভাগ ছবি তো ওই নাচগান আর শরীর দেখানো, এই আফসোসটা রয়ে গেল।’ ম্লান হাসলেন তিনি। 

যথার্থ অভিনয়-দক্ষতা প্রকাশের পরিবর্তে পর্দায় শরীর দেখানো নিয়ে তাঁর অনুতপ্ত ও অতৃপ্ত কণ্ঠস্বর শুনে আমার আবার সেই হিমছড়ির ঝরনার ধারে শুটিংয়ের কথা মনে পড়ল। সেদিনের ঘটনাটি তাঁকে বলেছি, কিন্তু যে-দৃশ্যটি কম বয়সে আমার অনেক অনিদ্র রাতকে আনন্দ ও অপরাধের দোলাচলে ফেলে দিয়েছিল সেই কথাটি বলা হয়নি। সেদিন সাদা সংক্ষিপ্ত কাঁচুলি, কুঁচি দেওয়া সাদা ঘাগড়া, সাদা মুক্তার মালা ইত্যাদি পরেছিলেন নায়িকা। সখীরাও কাঁচুলি আর ঘাগড়া – তবে নানা রঙের। 

শুটিং ইউনিটের লোকজনের মধ্যে নায়িকার কদর ও সমীহ কী রকম, সেদিন নিজের চোখে দেখেছিলাম। কেউ মাথার ওপর ছাতা ধরে ছিল তাঁর, কেউ বিরাট ঘেরের ঘাগড়াটি তুলে ধরে তাঁর পাশে পাশে হাঁটছিল, যাতে ধুলোকাদা বা পানি না লাগে মূল্যবান পোশাকটিতে। একজন মেকাপম্যান কিছুক্ষণ পরপরই তাঁর সামনে তুলে ধরছিল আয়না, তাঁর নির্দেশে পাউডারের পাফ বুলিয়ে দিচ্ছিল মুখে বা গলায়।

কক্সবাজারের মূল সৈকত থেকে একটু দূরে লোকেশন নির্ধারণ করা হয়েছিল সম্ভবত অত্যুৎসাহী লোকজনের ভিড় এড়াতে। ভিড় তেমন ছিল না, আমরা চার বন্ধু ছাড়া বড়জোর আর জনাদশেক। কিন্তু নায়িকা কৌতূহলী জোড়া জোড়া চোখকে আমলেই নেননি। তিনি জটলার দিকে তাকিয়েছিলেন দু-একবার, কিন্তু এমন উদ্দেশ্যহীন সেই দৃষ্টি, আমাদের আকুল চোখে চোখ পড়ার কোনো সুযোগই ছিল না। 

নৃত্য-পরিচালক ইশারা করলেই নায়িকা নাচের ভঙ্গিতে ছুটে এসে একটি পাথরখণ্ডে বসে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝরনার জল ছিটাবেন হাত দিয়ে। দৃশ্যটা এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল নায়িকা পাথরখণ্ডে বসে উবু হয়ে জলধারার দিকে হাত বাড়ালেই তাঁর স্তনসন্ধির অনেকটাই দেখা যাবে। ছবির পর্দায় এসব দৃশ্য অনেক দেখেছি। কিন্তু বাস্তবে এরকম দৃশ্য চাক্ষুষ করার সুযোগ পেয়ে আমরা শিহরিত হয়েছিলাম। নৃত্যছন্দে উচ্ছলিত স্তনদ্বয়ের দৃশ্যমান অংশটুকুর দিকে বুভুক্ষুর মতো তাকিয়েছিলাম, মনে আছে। দৃশ্যটি কিছুতেই নৃত্য-পরিচালকের মনোপুত হচ্ছিল না, তিনি একই নৃত্যভঙ্গিটির বেশ কবার পুনরাবৃত্তি করিয়েছিলেন। তাতে আমাদের আনন্দের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। পরে এ-ব্যাপারে আমার বন্ধুদের সঙ্গে আমার আর আলাপ হয়নি। কিন্তু দীর্ঘকাল এই দৃশ্য আমার দুর্বহ সুখকল্পনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। আমি বহুবার ওই দৃশ্যটি কল্পনা করে স্বমেহনে লিপ্ত হয়েছি। 

‘তুমি কি এই হোটেলেই থাক? তোমার ফ্যামিলি?’ 

‘জি এখানেই থাকি … ফ্যামিলি, মানে বিয়ে করা হয়নি।’

‘ফিল্মের হিরোইন নিয়ে এত অবসেসড থাকলে বিয়ে আর করবে কখন …।’ ব্যঙ্গ মেশানো স্বরে বিড়বিড় করে বলছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন হয়তো আমি শুনতে পাবো না, কিংবা শুনলেও কীইবা আসে-যায়।

আমি চমকে উঠে বললাম, ‘জি?’ 

আগের কথাটি বেমালুম এড়িয়ে গিয়ে অনাবিল হাসিতে মুখ ভরালেন তিনি, ‘বিয়েটা না করে ভালোই করেছো। আমি তো দুবার করে দেখলাম, এমন কিছু ইন্টারেস্টিং ব্যাপার না।’ 

আমি হাসিতে যোগ দিলাম। আসলে তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে বেশ লাগছিল আমার।

‘আপনি এখানে সারাদিন রুমে বসেই তো কাটিয়ে দেন। এই দুদিনে একবারও বিচে গেলেন না। কক্সবাজার এসে সমুদ্রের সামনে বসে কিছুক্ষণ সময় কাটাবেন না এটা কেমন হলো!’

‘ভালো লাগে না। বারান্দায় বসেই দূরের দিকে তাকিয়ে থাকি। বেশ লাগে।’

‘আপনি বোধহয় লোকজন পিছু নেবে বলে বের হন না। একটু ভোরের দিকে বেরোলে কিন্তু তেমন ভিড় থাকে না …।’

‘না না, লোকজনের ভয়ে বের হই না এটা মোটেও ঠিক না। বরং উলটো। আজকাল লোকজন আমাকে যে চিনতেই পারে না এটা দেখে খুব কষ্ট পাই। কম বয়েসিদের কথা না হয় বাদ দিলাম, তোমাদের বয়েসি বা আরো বেশি বয়সের লোকজনের তো না চেনার কথা নয়। কিন্তু তারা কেমন দেখেও না দেখার ভান করে। যেন চেনেই না, কোনোদিন দেখেইনি। এই দেশের মানুষজন আমাকে এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল! তাহলে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর ধরে কী করলাম বলো?’ গভীর অভিমানে যেন গলা বুজে আসে তাঁর।

‘এভাবে নেবেন না আপনি। এটা আসলে এক ধরনের নার্ভাসনেস। ভয়ে আপনার কাছে ঘেঁষে না। ভাবে, এত বড় সেলিব্রেটি, যদি পাত্তা না দেন।’ কিছুতেই যেন তিনি করুণা না ভাবেন সতর্কতার সঙ্গে প্রবোধ দিলাম আমি।

‘হুম।’ হাসলেন নায়িকা, ‘আমি পাত্তা দেব না ভেবে আগেভাগেই পাত্তা দিচ্ছে না আমাকে! দেখলেই নাকটা তুলে রাখছে আকাশের দিকে …।’

‘এসব চিন্তা মাথা থেকে ফেলে দেন। কাল ভোরের দিকে বেরিয়ে পড়বেন।’ একটু জোর বা আবদার খাটানোর অধিকার নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমার হয়েছে, ‘মাত্র পঞ্চাশ গজ হাঁটলে সমুদ্রসৈকত, সেখানে ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসলেন, ডাবের পানিতে চুমুক দিতে দিতে সমুদ্রের ঢেউ দেখলেন। সৈকত থেকে ফিরে পুকুরঘাটটাতে বসতে পারেন, এই পুকুরটাকে পদ্মপুকুরও বলা যায়, শত শত পদ্মফুল ফুটে আছে, আর পুকুর ঘিরে সব নারকেল গাছ। ভালো আপনার লাগবেই …।’

‘বেশ। দেখি তাহলে কাল ভোরে …। আর একটা কথা, কাল দুপুরেই তো ফ্লাইট, এয়ারপোর্ট ড্রপের জন্য একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।’

‘ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কাল ব্রেকফাস্টের সময় দেখা হচ্ছে তো?’

‘হ্যাঁ।’

নায়িকা উঠে দাঁড়ালেন। ধীরে, অথচ দৃপ্ত পদক্ষেপে হেঁটে গেলেন দরজার দিকে। 

তাঁর গমনপথে তাকিয়ে নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার। কেন জানি না কিছুটা বিষণ্নবোধ করলাম। নায়িকার সোনালি দিনগুলোর কথা ভেবে, নাকি নিজেরই কৈশোর-যৌবনের অনেকটা সময় জুড়ে থাকা স্বপ্নরঙিন দিনগুলোর কথা ভেবে!

পরদিন সকালে ডাইনিং রুমে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো তাঁর জন্য। তিনি এলেন, আগের দিনের চেয়ে অনেক অনানুষ্ঠানিক আর উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছিল তাঁকে। 

গতকাল রাতে তাঁকে আমি স্বপ্নে দেখেছি, এ-কথাটা তাঁকে বলব কি না ভেবে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। শেষে এটা আমার বয়সের তুলনায় যথেষ্ট চটুলতা মনে হতে পারে ভেবে নিজেকে সংযত করলাম। কিন্তু তাঁর কণ্ঠস্বরেই বরং চাপল্য, ‘তোমার কথাই তো ঠিক দেখছি, লোকজন এখনো বেশ মনে রেখেছে আমাকে। ভালোই কাটল আজ ভোরবেলাটা।’ 

‘কী রকম?’ জানতে চাইলাম আমি।

‘এই ধরো সৈকতের দিকে যাওয়ার পথে এক বয়স্ক ভদ্রলোক বললেন, ‘আরে এখানে হঠাৎ আপনার দেখা পাবো ভাবিনি, আপনার ছন্দপতন ছবিটা আমি জীবনে ভুলতে পারব না।’ কমবয়েসি কয়েকজন ছেলেমেয়ে এসে ছবি তোলার বায়না ধরল। ডাব বিক্রি করে যে-লোকটা সে পর্যন্ত টাকা নিল না, আমাকে একবার দেখতে পেয়েছে তাতেই নাকি তার পয়সা উশুল, হা হা হা।’

‘বলেছিলাম না, সাধারণ মানুষ সহজে ভোলে না।’

‘সবচেয়ে মজার কাণ্ড ঘটল তোমার ওই পদ্মপুকুরের ঘাটে এসে। তরুণ দম্পতি, কত হবে বয়স, এই ধরো ছেলেটার ত্রিশ হলে মেয়েটা পঁচিশ-সাতাশ। তারা নাকি বিয়ের আগে পাকা কথা হওয়ার পর শুভ মিলন ছবিটা দেখেছিল, তাদের বড় মেয়েটার নাম রেখেছে আমার নামে … ভাবতে পারো?’

‘পারি ম্যাডাম, খুব পারি, এখনো আপনার জনপ্রিয়তা কেমন সেটা আমি জানি, আপনি জানেন না …।’ আমিও তাঁর উচ্ছ্বাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বললাম।

‘থ্যাংক ইউ।’

আজ তাঁর মেজাজ ফুরফুরে, প্রচুর কথাবার্তার ফাঁকে খাওয়া-দাওয়া করলেন খুবই সামান্য। প্লেটটা ঠেলে দিয়ে বললেন, ‘এক কাপ কফি …।’

‘আমি নিয়ে আসছি। চিনি ছাড়া তো?’

তিনি হাসলেন।

দু-কাপ কফি নিয়ে ফিরে এলাম। পর্যটন হোটেলের ম্যানেজার আজ অতিথির সঙ্গে একই টেবিলে বসে কফি পান করার সানন্দ অনুমোদন যে পেয়েছে সেটা অতিথির প্রসন্ন চেহারা দেখে দিব্যি বোঝা যায়।

নানা বিষয়ে আলোচনা হলো। হালে দেশের সিনেমা হলগুলোর দুর্দশা থেকে এখনকার তথাকথিত তারকাদের কাণ্ডকীর্তি পর্যন্ত। তিনি বারবার এই জেনারেশনের নায়ক-নায়িকাদের কাজের প্রতি নিষ্ঠা, মনোযোগ এসবের অভাব আর নানান অশোভন কাণ্ডকীর্তির কারণে খবরের শিরোনাম হয়ে-ওঠার কথা বলছিলেন। আমি কিছুতেই তাঁকে 888sport app download for android করিয়ে দিতে সাহস পাচ্ছিলাম না যে, কাণ্ডকীর্তি তাঁর আমলেও কম কিছু হয়নি। এমনকি তিনি নিজেও নানা কারণে বিনোদন পত্রিকার খবরের শিরোনাম হয়েছেন একাধিকবার।

ডাইনিং রুম ছেড়ে যাওয়ার সময় আমি প্রায় কিশোরসুলভ আগ্রহ নিয়ে একটি অটোগ্রাফ চাইলাম প্রিয় নায়িকার কাছে। জানালেন, ঠিক একটায় হোটেল কক্ষ ত্যাগ করবেন তিনি। তখন যেন সেখানে উপস্থিত থাকি, অটোগ্রাফ তখন পাওয়া যাবে।

ঘড়ি একটার কাঁটা ছোঁয়ার কয়েক মিনিট আগেই আমি উপস্থিত হয়েছি তাঁর কক্ষে। তখন তিনি মধ্যাহ্নের আহার হিসেবেই হয়তো একটি স্যান্ডউইচ খাচ্ছিলেন। টি-পটে চা-ও রাখা ছিল। স্যান্ডউইচের টুকরো চিবুতে চিবুতে তিনি ইশারায় টি-পটটি দেখালেন আমাকে। আমি তাঁর নির্দেশ বুঝে নিয়ে দু-কাপ চা ঢাললাম কাপে। একটি তাঁর সামনে এগিয়ে দিয়ে অন্যটিতে চুমুক দিতে শুরু করলাম। ইতোমধ্যেই তাঁর হোটেলের যাবতীয় পাওনা পরিশোধ করা হয়ে গেছে, টেবিলের ওপর রাখা বিল দেখে বোঝা গেল। হাতব্যাগটি ছাড়া একটি মাত্র লাগেজ, তাতে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখা ছিল আগেই। আমি ইন্টারকমে একজন কর্মচারীকে ডেকে এনে লাগেজটা বিমানবন্দরগামী গাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। 

‘এবারের ট্রিপটা বেশ ভালোই হলো …।’ তিনি বললেন। তারপর একটু এগিয়ে এলেন আমার দিকে, ‘তবে আজ ভোরবেলা যা যা ঘটল, সেই ডাবঅলা থেকে তরুণ দম্পতি … চারপাশে আমার এত ফ্যান … এসবই যে তোমার তৈরি করা নাটক এটা কিন্তু বুঝতে বেশ সময় লেগেছে আমার। আমাকে খুশি করার জন্য বেশ খাটাখাটি করতে হলো তোমাকে।’

তাঁর মুখে হাসি। আমি চোরের মতো মাথা নিচু করলাম। 

‘অ্যানিওয়ে তোমার কথা অনেকদিন মনে থাকবে আমার।’ – বলে কাছে টেনে নিয়ে গালে আলতো করে একটা চুমু খেলেন তিনি। বিশ-পঁচিশ বছর আগে একটা আগুন জ্বলেছিল মনে, দীর্ঘকাল তার কিছুটা আঁচ অবশিষ্ট ছিল, কিন্তু আজ এই অযৌন স্পর্শ আমার এতকালের যাবতীয় উত্তেজনা যেন নির্বাপিত করল মুহূর্তে।

বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললেন, ‘হোটেলের স্লিপ প্যাডে তোমার জন্য অটোগ্রাফ রেখে গেলাম। এখনই না, আমি চলে যাওয়ার পর দেখো।’ 

আমি তাঁর পিছু পিছু করিডর পর্যন্ত এগিয়ে গেলাম। তিনি লিফটে উঠে পড়লে দ্রুত ফিরে এলাম তাঁর কক্ষে। টেবিলের ড্রয়ার থেকে বের করলাম স্লিপ প্যাডটি। তিনি লিখেছেন : ‘কাল রাতে তোমাকে স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নে দেখলাম, তুমি আমাকে স্বপ্ন দেখছো।’  আমি আবার ছুটে করিডরে এলাম। তিনতলার এই করিডর থেকে দেখা যাচ্ছে গাড়িতে উঠছেন তিনি। ফিরে তাকালেন, হাসিমুখে হাত নাড়লেন। মুখে হাসি, দুই চোখ রোদচশমায় 888sport app।