আমি থাকি কোলকাতার শ্যামবাজার অঞ্চলে। শহরের এই উত্তরদিকটাকে বেশ রক্ষণশীল এলাকা বলা হয়। এখানকার বেশ কিছু বাড়ি আড়াই-তিনশ বছরের পুরনো। ঘটি-কালচার বলতে যা বোঝায় তা একদা এই অঞ্চলে জাঁকিয়ে ছিল। জলপাইগুড়ি থেকে পড়তে এসে যে-কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম সেটা ছিল এখানেই। তাই বাইরের লোক হলেও এঁদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলাম। একই কোলকাতার অন্যপ্রান্তের মানুষের জীবনযাপন এবং শব্দপ্রয়োগের সঙ্গে এখানকার মানুষের বিস্তর পার্থক্য ছিল।
রকে বসে আড্ডা মারা এখানকার একটা স্বাভাবিক রেওয়াজ। বাংলা 888sport live football-সংস্কৃতির বিখ্যাত মানুষেরা নাকি ওইসব রকে বসে ধন্য করে গেছেন। বাড়ির লাগোয়া রাস্তার ধারের ছোট বারান্দাগোছের জায়গাকে রক বলা হয়। সকালে বৃদ্ধরা, বিকেলে তরুণরা আর সন্ধ্যের পর প্রৌঢ়রা সেখানে বাসে রাজা-উজির মারেন।
বছর-তিরিশ আগে রাত সাড়ে নটার পর উত্তর কোলকাতার এইসব বনেদি রাস্তায় একটি দৃশ্য প্রায়ই দেখা যেত। হাতে-টানা রিকশা টুনটুন করে আসছে। রিকশায় সওয়ারি বসে আছে কাত হয়ে। মাথা ঝুঁকে পড়েছে। বোঝাই যায় নেশায় ডুবে গেছেন। ওইসব সওয়ারির রিকশা দেখে রকের আড্ডাধারীরা সময় বলতে পারত। কে যায়? ও, রমানাথ বাবু! তাহলে এখন রাত সাড়ে নটা। নরনারায়ণ কাকা না? তাহলে দশটা। এই যে বাইরে মদ্যপান করে বাড়ি ফেরা, পায়ে হেঁটে বা ট্যাক্সিতে নয়, রিকশায় চেপে হাওয়া খেতে খেতে ফেরা – এটা একটা প্রচারে সাহায্য করত। সবাই জেনে যেত এই পাড়ায় কজন মাতাল আছেন। তখন মদ খাচ্ছে অথচ মাতাল হচ্ছে না, এটা ভাবাই যেত না। বাড়িতে বসে মদ খেতেন জমিদার বা রাজাবাবুরা। তাঁরা শেষ হয়ে যাওয়ার পর অর্থবান মানুষ বাড়িতে বসে মদ্যপান করার অধিকার এই অঞ্চলে পাননি। প্রথমত, বাপ-ঠাকুরদা-মায়েরা আছেন, তাঁরা মেনে নেবেন না, দ্বিতীয়ত, ঘরের কোণে চোরের মতো একা বসে মদ্যপানে কোনো সুখ নেই। তাঁরা যেতেন পার্কস্ট্রিটের বারে, যেখানে বেয়ারা সব সুবিধে দিচ্ছে। একটু দুঃসাহসীরা একত্রিত হয়ে সোনাগাছিতে একটি ঘর ভাড়া করে মদ খেয়েছেন। বারবনিতার একটু হাসি, একটু রসিকতার বেশি এগোতে তাঁরা পছন্দ করেননি। পানের আনন্দে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলতে দেরি হতো না। তাই তাঁদের বাড়ি ফিরিয়ে আনতো চেনা রিকশাওয়ালা। নরনারায়ণকাকার শবযাত্রায় সেই রিকশাওয়ালা এসেছিল। লোকটা বলেছিল, ‘এই বাবু গত তিরিশ বছরে প্রতিটি রাত্রে আমার রিকশায় উঠেছেন। শেষের দিকে আমিই ওঁকে জোর করে রিকশায় তুলে নিতাম। আজ থেকে বেকার হয়ে গেলাম।’
যে-সময়ের কথা বলছি সে-সময়ে দক্ষিণ কোলকাতার ছবিটা একটু উদার ছিল। সেখানে তখন নব্য যুবক-যুবতীরা সংসার পেতেছে। বাড়িতে অনেকেরই মা-বাবা-ঠাকুরমা নেই। অতএব বন্ধুরা বাড়িতে এলে স্বচ্ছন্দে প্রশ্ন করা যেত, কি খাবেন বলুন, চা, কফি, বিয়ার? এই বিয়ার দুপাত্র খেলে নেশা হয় না অথচ গুলতানি মারা যায় যখন, তখন চলুক না। উত্তরের মানুষ দক্ষিণের বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে দু গ্লাস বিয়ার খেয়ে মশলা-দেওয়া পান চিবিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরে সোজা বেডরুমে ঢুকে বউকে ফিসফিস করে বলত, ‘বিয়ার খেয়ে এসেছি!’
বউ চোখ কপালে তুলত, ‘অ্যাঁ? এখন কী হবে?’
‘কেউ বুঝতে পারেনি। তুমি মা-বাবাকে বলে দাও আমার খুব মাথা ধরেছে। আমি শুয়ে পড়ছি, আলোটা নিভিয়ে দাও।’
অবস্থাটা বদলে গেল বছর পাঁচেক আগে। এতদিনে উত্তর তার সব কৌলিন্য হারিয়েছে। গুরুজনরা গত হয়েছেন। একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙে গিয়ে স্বামী-স্ত্রী আর বাচ্চার সংসার হয়েছে। যদিও রকে আড্ডা বসে, তবে আগের মতো নয়। কিন্তু এখন রাত বাড়লে রিকশায় মাতাল দেখা যায় না। রাস্তায় মাতলামি করে কখনো সখনো সর্বহারা মানুষের কেউ চোলাই খেয়ে। এমন কি বাংলা ছবিতেও আজকাল একটাও মাতাল দেখা যায় না। তাহলে মাতালরা গেল কোথায়?
সমাজ নিয়ে যাঁরা সমীক্ষা করেন এই প্রশ্নের উত্তর তাঁরা দিতে পারবেন। লক্ষ করেছি, মদ্যপানের আসরে আজকাল শিক্ষিত সমাজ কোনো পাপবোধে আক্রান্ত হন না। বেশির ভাগই বুঝতে পারেন তাঁর কতটা পান করা উচিত। যিনি একটু বেশির দিকে তাঁকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। অর্থাৎ অ্যালকোহলের ওপর কর্তৃত্ব করতে বাঙালি শিখে গেছে। তার ওপর ডাক্তাররা যখন বলেন হার্টের জন্যে একটু পান করা ভালো তখন তো লাইসেন্স পাওয়াই গেল। এই পানের আসরে বাড়ির মেয়েরা হয়তো কফির কাপ হাতে নিয়ে আড্ডা মারে, কেউ একটা ছোট ভদকা হাতে নিয়ে গল্প শোনে। আচমকা দেখলে মদ্যপানের আসর বলে মনেই হবে না। অর্থাৎ মদের শক্তি এখন অস্তমিত। বাড়িতে এসে পান করে যদি কেউ বেচাল হয় তাহলে তাকে আর কখনো আমন্ত্রণ জানানো হয় না।
আমার এক ভ্রাতৃস্থানীয় বললেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। তাঁর কন্যা জ্ঞানচক্ষু ফোটার পর থেকেই বাড়িতে বাবা আর তার বন্ধুদের মাঝে মাঝে পান করতে দেখেছে। কোনোদিন তার মনে কোনো খারাপ প্রতিক্রিয়া হয়নি। চার বছর বয়সে সে একটু স্বাদ পরখ করতে চেয়েছিল। জিভে বিস্বাদ লাগায় আর দ্বিতীয়বার চায়নি। কিন্তু প্লেটে সাজানো খাদ্যদ্রব্যের লোভে সে মাঝে মাঝেই হানা দেয়। তার যখন সাত বছর বয়স তখন বাড়ির সামনে একটি মানুষকে পড়ে থাকতে দেখে উদ্বিগ্ন হয়েছিল। বাড়ির কাজের লোককে সে জিজ্ঞাসা করেছিল লোকটির কি হয়েছে?
জবাব পেয়েছিল, ‘আর বলো না খুকি, সস্তার চোলাই মদ গিলে নেশায় মাটিতে পড়ে আছে।’
মেয়েটি গম্ভীর গলায় আদেশ দিয়েছিল, ‘বাবার বন্ধুরা যেদিন আসবে সেদিন তুমি ওকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলো। বাবাদের সঙ্গে ভালো মদ খেলে ওর নেশা হবে না, ফুটপাতেও পড়ে থাকতে হবে না!’


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.