সেবার বইমেলার সময়েই রমজানের মাস শুরু হয়ে গেল। আমি থাকতাম 888sport appর মগবাজার আড়ংয়ের দোকানের যে-বাড়িটা তার চারতলায়। অক্ষর প্রকাশনীর ফয়েজ ভাই ওই বাড়ির মালিক, তাঁরই ব্যবস্থাপনায় আমার থাকা। একটু অস্বস্তি ছিল। বন্ধু-বান্ধবরা সারাদিন রোজা রাখবেন আর আমি পেট ভরাবো! স্থির করলাম দিনের বেলায় আমিও খাবো না। এমনকি চা পর্যন্ত নয়।
ঘুমিয়ে থাকলে খিদে পায় না আমার। ভোরবেলায় না উঠে বেলা বারোটা পর্যন্ত যদি বিছানায় কাটিয়ে দিতে পারি তাহলে অর্ধেক দিনের সমস্যা মিটে যাবে, বাকিটা কোনোমতে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তেমন হলে চলে যাবো ফয়েজের মায়ের কাছে, অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ। ওঁর সঙ্গে গল্প করলে খিদেটা মাথা নিচু করে থাকবে।
কিন্তু ভোর হতেই রাস্তার উলটোদিকের কলেজের মেয়েগুলো চড়ুই পাখির মতো এমন কথা বলতে শুরু করে যে চারতলায় শুয়েও ঘুম ভেঙে যায়। তবু ঘাপটি মেরে পড়ে থাকি। ঠিক পৌনে আটটায় দরজায় শব্দ। প্রথম দু-বার উপেক্ষা করি। শেষ পর্যন্ত খুলতেই হয়। মতিন ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। হাতে খবরের কাগজ, চায়ের ফ্লাস্ক এবং এক প্যাকেট ফাইভ ফাইভ ফাইভ, ‘গুড মর্নিং। ঘুম ভাঙ্গালাম?’
উত্তরের জন্যে অপেক্ষা না করে তিনি চেয়ারে বসে পড়লেন। হাতের জিনিসগুলো সযত্নে রাখলেন টেবিলে। টয়লেট থেকে ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি তৈরি?’
‘হ্যাঁ। চা খেয়ে নিন, ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
‘কিন্তু মতিন ভাই, আমি দিনের বেলায় কিছু খাবো না।’
‘কেন?’ মতিন ভাই অবাক।
‘আপনারা সবাই উপোস করবেন আর আমি খাবো, এটা হতে পারে না।’
মতিন ভাই হাসলেন, ‘পরের বার যখন আপনি এই সময়ে কলকাতায় থাকবেন তখন তো জানবেন আমরা উপোস আছি, তখনো কি খাবেন না?’
‘তখন তো সামনাসামনি দেখছি না!’
মতিন বললেন, ‘আপনি এখানে মুসাফির। মুসাফিরদের রোজা রাখার ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা নেই। শুধু মুসাফিরই নয় অসুস্থ মানুষ, গর্ভবতী মহিলারাও প্রয়োজনে ছাড় পেতে পারেন। অতএব চা পান করুন।’
দোনোমনা করছি এই সময়ে ফয়েজ এলো টিফিন ক্যারিয়ার হাতে। মতিন ভাইকে দেখে খুশি হয়ে বলল, ‘দাদাকে ঘুম থেকে ওঠালেন। চা আনছেন, গুড!’ সে দ্রুত টিফিন ক্যারিয়ার খুলে মাংস-পরোটা বের করল।
‘মতিন ভাই, রোজা আছেন?’ ফয়েজ জিজ্ঞাসা করল।
‘হ্যাঁ।’ মাথা নাড়লেন মতিন ভাই।
অতএব সে দুটো বাটিতে খাবার ভাগ করল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি খাবে?’
‘হ্যাঁ, আমি আজ রোজা নেই।’
‘কেন?’
‘আমার হেমোগ্লোবিন কমে গিয়েছে। তাই ডাক্তারের অ্যাডভাইস, উপোস করা চলবে না।’
‘তাহলে তুমি খাও। আমি না। তাছাড়া এই সকালে মাংস-পরোটা খাওয়ার অভ্যেস আমার নেই। দেশে এই সময়ে আমরা চা-টোস্ট খাই।’
অনেক অনুরোধেও যখন আমাকে রাজি করানো গেল না তখন ফয়েজের মনে পড়ে গেল, ‘ওহ-হো, রাজু ভাই ফোন করছিলো। আপনাকে সাড়ে নটায় নিতে আসবে। রেডি থাকতে বলেছে।’
শেষ পর্যন্ত আমি খাচ্ছিনা দেখে খাবারগুলোকে আবার টিফিন ক্যারিয়ারে তোলা হলো। চা ইতিমধ্যে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। ওরা যখন চলে গেল তখন টেবিলের ওপর খবরের কাগজ আর সিগারেটের
প্যাকেট পড়ে আছে। ধূমপান বলা হয়, কিন্তু ওটাকে কি খাওয়া বলে? তরল বা শক্ত খাবার নয়, নির্ভেজাল ধোঁয়া। তাও না গিললে পেটে যাচ্ছে না। অতএব সিগারেট ধরিয়ে টয়লেটে যাওয়া যেতেই পারে।
ঠিক সাড়ে নটায় সেজেগুজে নিচের রাস্তায় দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালাম রাজু ভাইয়ের অপেক্ষায়। এক ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আমাকে দেখে কাছে এসে বিনীত গলায় বললেন, ‘আপনি আমার মনে লোভ ঢোকাচ্ছেন।’
‘সেকি! কী করে?’ আমি হতভম্ব।
‘আপনাকে সিগারেট খেতে দেখে আমারও খেতে ইচ্ছে করছে।’
‘সরি-!’
‘ঠিক আছে। দ্যান একটা সিগারেট।’
সিগারেট ধরিয়ে টানতে টানতে ভদ্রলোক চলে যাওয়ামাত্র গাড়ি নিয়ে রাজু ভাই এসে হাজির। ব্যাপারটা বলতেই হো হো করে হাসল সে, ‘যাক, একটাই সিগারেট নিয়েছে, পুরো প্যাকেট তো নেয় নাই। চলেন।’
‘কোথায়?’
‘নরসিংদী।’
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জায়গাটার নাম শুনেছিলাম। রাজু যে নির্বাচিত প্রতিনিধি জানতাম, এখন জানলাম তার নির্বাচনী এলাকা ওটাই। জিজ্ঞাসা করলাম ‘ওখানে কেন নিয়ে যাচ্ছ?’
‘আপনাকে একটা দারুণ অভিজ্ঞতা দেবো। নরসিংদী থেকে ভৈরব পর্যন্ত নদীতে 888sport slot game।’ একটু একটু খিদে পাচ্ছিল, শোনামাত্র সেটাও ভুলতে পারলাম।
নরসিংদীর মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যানকে রাজু জানিয়ে রেখেছিল। গিয়ে দেখলাম বেশ ভিড় বাড়িটায়। মানুষজন নিজেদের প্রয়োজনে ওখানে এসেছেন। ভিড় ঠেলে রাস্তা করে আমাদের চেয়ারম্যানের ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। উনি উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে অভ্যর্থনা জানালেন। বেশ ভদ্র মানুষ। জানালেন, ওঁর স্ত্রী আমার সব বই পড়েছেন, উনি মাত্র দুটি। স্ত্রীর ইচ্ছে ছিল আমায় রান্না করে খাওয়াবেন, কিন্তু রোজার সময় বলে অসুবিধে হলো।
তারপরেই সব দরজা-জানালা বন্ধ করে দেওয়া হলো। চেয়ারম্যানের হুকুমে ভেতরের ঘর থেকে প্লেটগুলো আসতে লাগল। চিকেন বিরিয়ানি, কষা মাংস, ইলিশ মাছ, বোয়াল মাছ, পাবদা, দই, তিন রকমের মিষ্টি। চেয়ারম্যান বললেন, ‘রোজার সময় বলে বেশি কিছু করতে পারলাম না। এটুকুনি আপনাকে খেতেই হবে।’
আমি রাজু ভাইয়ের দিকে তাকালাম। সে বলল, ‘দাদা, আমি রোজা আছি।’
বললাম, ‘আমি নেই কী করে জানলেন? সকাল থেকে আমি জলও খাইনি?’
‘আপনি? রোজা?’ চেয়ারম্যান হতভম্ব।
‘আপনারা খাবেন না, আমিও তাই খেতে পারি না।’
পীড়াপীড়ি চলল। আমি অতিথি। আমাকে না খাওয়ালে ওঁদের মন খারাপ হয়ে যাবে। আমি সিগারেট ধরালাম, ‘এই তো খাচ্ছি। তাছাড়া কথায় আছে, ঘ্রাণেও অর্ধেক খাওয়া হয়ে যায়। ব্যাস, এ নিয়ে আর কথা তুলবেন না।’
চেয়ারম্যান নিজে নৌকোয় তুলে দিলেন আমাদের। নৌকো ভটভট্টিতে চলে, মাঝখানে ঘর। একজন রাইফেলধারীও সঙ্গে উঠল। ভরদুপুরে নৌকো ছাড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের দুপাশে বালির চর, কাশবন। বিশাল নদীর মাঝখান দিয়ে নৌকো ছুটছে। অফুরন্ত হাওয়ায় ভাসছি। হঠাৎ নাকে মশলার গন্ধ এলো। রাজুকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, মাঝিরা রান্নাবান্না করছে। মনে পড়ল, 888sport appsের মাঝিদের রান্নার গল্প কত বইতে পড়েছি। রাজু হেঁড়ে গলায় গান ধরল, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি-; দাদা, কেমন লাগছে।’
‘স্বপ্নের মতো।’ জবাব দিলাম।
ইতিমধ্যে মাঝিদের প্রধান রাজুকে নিচুগলায় প্রস্তাব দিল। রাজু জিজ্ঞাসা করল, ‘দাদা, বিয়ার খাবেন নাকি?’
বললাম, ‘না।’
‘আরে, পানিতে নিয়ম নেই।’
‘ঠিক আছে।’
আমরা যাব ভৈরব। সেখানে আমাদের জন্যে গাড়ি থাকবে। 888sport appsের বুকের মধ্যে দিয়ে এই যে যাওয়া, এর জন্যে রাজুর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। বিকেল তিনটার সময় প্রধান মাঝি হাতজোড় করে বলল, ‘আসেন, খাবার রেডি!’
তাকিয়ে দেখলাম, ভাত, ইলিশ মাছের তেল, ভাজা আর ইলিশের ঝাল। তাদের আকৃতিও খুব লোভনীয়। বললাম, ‘ভাইসাব, আজ আমি দিনের বেলায় কিছু খাবো না।’
‘আপনি তো মুসলমান নন-!’
‘তাতে কি! আজ আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।’
ওঁরা গম্ভীর হলেন। আমি কি বাড়াবাড়ি করছি? জানি না।
শেষ বিকেল। ভৈরব এখনো অনেক দূর। প্রচুর পাখি উড়ছে। আমরা যেদিকটা ধরে যাচ্ছি সেদিকে অদ্ভুত দৃশ্য। দুধের সরের মতো বালির চর। তাতে একটুও দাগ নেই। খুব ইচ্ছে হলো ওই চরে নামতে। নৌকো থামল। প্রধান মাঝি বলল, ‘বেশি দূরে যাবেন না, বেদে-বেদেনিরা মাঝেমাঝে ওদিকে থাকে।’
পা ডুবে যাচ্ছে বালিতে। আদিম পৃথিবীতে বালি কি এরকম ছিল? অনেকটা চলে এসেছি নৌকো থেকে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে ওদিকে। তার করুণ আলোয় পৃথিবী কী মায়াময়! হঠাৎ চিৎকার কানে এলো। মুখ ঘুরিয়ে দেখলাম কতগুলো শিশু ছুটে আসছে। তাদের পোশাকই বলে দিচ্ছে তাদের অবস্থার কথা। ছয়-সাতটি শিশুর পেছনে দুজন মহিলা যারা কোনোক্রমে আব্রু রক্ষা করেছেন। এরাই কি বেদেনি, আর ওরা তাদের সন্তান? রাজুর চিৎকার শুনলাম, ‘দাদা, কুইক!’
কিন্তু আমি নড়তে পারলাম না। বাচ্চাগুলো একটু দূরে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখল। কৌতূহল ছিল সেই দৃষ্টিতে, তার সঙ্গে অনেক কিছু। একজন হাত বাড়াল, ‘ভুখ লাগছে।’ সঙ্গে সঙ্গে মহিলাদের একজন বললেন, ‘পাঁচটা টাকা দেন বাবু, ওরা আজ সারাদিন খায় নাই।’
সূর্য ডুবছে। একটু পরেই পৃথিবীতে অন্ধকার নামবে। নৌকোর কাছে ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘দুপুরের খাবারগুলো কি আছে?’
প্রধান মাঝি জানাল, ‘আছে।’
রাজুকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোমরা কখন ইফতার করো?’
‘টাইম হয়ে গেছে দাদা। ওরা মুড়ি-ছোলা বের করছে।’
বললাম, ‘রাজু এসো না, এই খোলা আকাশের নিচে আজ আমরা ইফতার করি।’ রাজু আমার কথা বুঝতে পারল।
সরের মতো নরম বালির চরে এখন অনেক পায়ের দাগ। বাচ্চারা আর তাদের মায়েরা গোল হয়ে বসে গেছে। তাদের সামনে শালপাতায় সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছ। ওরা দেখছে কিন্তু হাত বাড়াচ্ছে না।
রাজুকে নিয়ে আমিও বসলাম। কিন্তু রাজু এখনই ওই মশলা দেওয়া খাবার খাবে না। তাই আমাদের জন্যে এলো মুড়ি, বাদাম, ছোলা এবং বড় বড় বাতাসা আর জল। রাজু প্রার্থনা করল। তারপর আমরা মুঠোয় মুড়ি তুলতেই ওরা ঝাঁপিয়ে পড়ল খাবারের ওপর।
তখন অন্ধকার নেমেছে পৃথিবীতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এক অদ্ভুত আলো আকাশ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছিল ওই বালির চরে। হাওয়ারা যেন আনন্দিত।
তৃপ্ত মুখগুলোর দিকে তাকালাম। ওরা দৌড়ে গেল নদীর ধারে। জল খেল, মাখল।
শুধু বয়স্কা মহিলা বিড়বিড় করে বললেন, ‘আল্লা আপনার ভালো করবেন।’ আমি আকাশের দিকে তাকালাম। পৃথিবীর সব আকাশ কি একই চেহারার? জানি না। কিন্তু শোক বা আনন্দে আমরা আকাশের দিকে তাকাই। তাকাতে ভালো লাগে।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.