প্রায় চার মাস হলো কার্যকরী একটি শব্দও লিখতে পারিনি আমি। অন্তত আটাশ বছরের লেখক-জীবনে এমন নিষ্ফলা বিষণ্ন দিন আগে কখনো দেখতে হয়নি। ১২-১৪ বছর ধরে ল্যাপটপেই হয় সব লেখাজোখা। গত জুলাই থেকে এই বন্ধ্যত্ব রোগ – ল্যাপটপ নিয়ে বসলে একই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় প্রতিবার। লেখার জন্য পরিচিতজনদের তাগিদ আসে, তাদের জিজ্ঞাসার কোনো সদুত্তর দিতে পারি না বলে ফোন রিসিভ করা একপ্রকার বন্ধই রাখতে হচ্ছে। অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে হয়তো দুটো-তিনটে লাইন লেখা হলো তারপর কি-বোর্ডের ওপর লেখার আঙুলগুলি থমকে যায়, মস্তিষ্কের নির্দেশ না পেয়ে যেন সাময়িক অথর্ব হয়ে যায় দশটি আঙুল। মনে হয়, এরপর কী হবে আমি তার কিছুই জানি না। খানিক চুপচাপ বসে দাঁতে নখ কাটতে কাটতে এলোমেলো কী-সব ভাবি, হয়তো কোনো দুঃখের 888sport sign up bonus, হয়তো বাল্যপ্রেমিকার মুখ; আবার সেখান থেকে বিদ্যুতের মতো মুহূর্তে আমার চিন্তাকুণ্ডলী একটি মরাবাড়ির উঠোনে গিয়ে চক্কর খায়, সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে কালোমাছি ভনভন করছে। আমার দু-কান জুড়ে কেবল সুরেলা কান্নার আওয়াজ ভাসে। এরপর সব মিলেমিশে একটি অদৃশ্য মাকড়সা মাথার ভেতর কী-এক দুরভিসন্ধি নিয়ে জাল বুনে চলে। জালটা ভেঙে দিতে আমি বেসিনে গিয়ে চোখেমুখে শীতল জলের ঝাপটা দিই। তারপর কুণ্ঠিত পায়ে আবার এগিয়ে যাই কালো কি-বোর্ডের কাছে। নিজের লেখা লাইনগুলি পুনর্বার পড়ি শুরু থেকে, হয়তো নতুন ভাবনা আসবে, গল্পটা এগিয়ে যাবে পাল তোলা নৌকার মতো তরতর করে। কিন্তু সূচনা থেকে পড়ে মনে হয় – নাহ্, কিচ্ছু হচ্ছে না – ম্যাড়মেড়ে; যাচ্ছেতাই – আগের কোনো লেখার দুর্বল পুনরাবৃত্তি যেন। অগত্যা পুরো পৃষ্ঠা লেখা ডিলিট করে মাথার চুল ছিঁড়ি, ঘরে পায়চারি করতে করতে মন চায় ল্যাপটপটা আছড়ে ভাঙি, কিন্তু অতটা বিলাসী-রাগ করার মতো অর্থও তো আমার নেই। যে-আমি ২৪ ঘণ্টায় এমনকি ২৫-৩০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখেছি, এখন ২৫-৩০টি শব্দও জুটছে না। অথচ আচমকা এই নিষ্ফলতার কোনো কারণ আমি খুঁজে পাই না, শরীর বেশ ঠিক আছে কোনোরকম ডিপ্রেশনেও ভুগছি না, হয়তো সমস্যা মনের আরো গভীর কোথাও লুকিয়ে আছে; গোপনে ক্রমাগত নিম্নবিস্তার করে চলেছে তার সুড়ঙ্গ, সেই সুড়ঙ্গ ব্ল্যাকহোলের মতো টেনে নিচ্ছে আমার সকল কল্পনা, ভাষা আর সৃজনকথা। তবে কী লাভ আর এই বেঁচে থেকে? লেখার হাত স্তব্ধ হয়ে যাওয়া তো মৃত্যুই। কিন্তু আপাতত স্বেচ্ছামৃত্যুর পথে আমি হাঁটছি না। পুরো একটা সপ্তাহ লেখার জন্য অহেতুক কসরত করা সম্পূর্ণ বন্ধ রাখি। ইন্টারনেটে গান-সিনেমায়, পছন্দের খাবারে এবং আড্ডায় সময় পার করব বলে মনস্থ করি। অষ্টম দিনে কেন যেন মনে হয় – আচ্ছা, নেট ঘেঁটে দেখি – কোনো অ্যাবসট্রাক্ট মুভি, পেইন্টিং, কিংবা পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তের কোনো ব্যতিক্রমী গল্প-888sport alternative link বা মনস্তত্ত্বের বই পড়েও হয়তো আসতে পারে গল্প লেখার একেবারে আনকোরা কোনো আইডিয়া। হাতে মোবাইলটা নিয়ে গুগলে ঢুকে সার্চে টিপ দেওয়ার আগেই প্রবল এক সংকোচবোধ আমার পথ রোধ করে দাঁড়ায়। না, এই পথে নয়! তুমি না একজন জাত 888sport live chatী! সেকেন্ডারি, কৃত্রিম কোনো লেখা তোমার হাত দিয়ে বের হতে পারে না। তার চেয়ে আঙুলগুলি পকেটে পুরে রাখো, হাত দিয়ে ভাত-রুটি খাও, যৌবনের প্রান্তভাগে দাঁড়ানো বউয়ের গলা জড়িয়ে রাখো – ওসব ছাইভস্ম লেখার কোনো প্রয়োজন নেই। অজ্ঞাত-অদৃশ্য পরামর্শকের এই বিষয়টার সঙ্গে একমত হয়ে মোবাইলটা দ্রুত ছুড়ে ফেলি।
আমি বরাবরই লেট-রাইজার, কিন্তু মঙ্গলবার সূর্যোদয়ের আগে ঘুম ভেঙে যায়। মাথাটা ফ্রেশ। এক কাপ আদা-চা, কিছু মচমচে মুড়ি পাশে রেখে সাত-সকালে ল্যাপটপ নিয়ে বসে যাই। এই ভিন্ন রুটিনে যদি লেখার নিষ্ফলতা খানিকটা কাটে! কয়েকটি শব্দ টাইপ করতে করতে দিনের আলো স্পষ্টতর হতে থাকে। পাখির কিচির-মিচির আওয়াজ লঘু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে মানুষের কোলাহল বেড়ে যায়। এদিকে আমার চেতনা জুড়ে আবারো সেই শূন্যতার গ্রাস, মগজের ভেতর মাকড়সার জাল বিস্তার স্পষ্ট হতে থাকে। এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও সেই একই ফল। যথারীতি তিনটে বাক্যের পর আর এগোয় না। কী হলো – এভাবে অবেলায় কি একজন স্বীকৃত লেখকের মৃত্যু ঘটবে? আমি বেঁচে আছি অথচ লিখতে পারছি না, এ চরম এক দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কী! দু-চোখে ক্লান্তি আসে – চিরকাল দেরি করে জাগা মানুষের এমন সকাল কি সহ্য হয়! ল্যাপটপ ভাঁজ করে, জানালার পর্দা টেনে বিছানায় গা এলিয়ে দিই। খানিক বাদে চোখ মেলে টের পাই খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। বাথরুম থেকে ব্রাশ করে এসে দেখি বিছানার পাশে ল্যাপটপ-টেবিলে টোস্ট, জেলি আর ডিমপোচ রাখা। তহমিনা এরই মধ্যে উঠে নাস্তা রেডি করে ফেলেছে! মনে মনে স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে টোস্টে কামড় দিয়ে ভাবি, আচ্ছা আমি খানিক আগে কী-যেন একটা দৃশ্য দেখলাম! দেয়ালঘড়িতে সকাল আটটা দশ – তার মানে এই ফাঁকে প্রায় একটা ঘণ্টা দিব্যি ঘুমিয়েছি আমি, আর ঘুমের ভেতরেই চোখের সামনে খেলে গিয়েছে ওইসব দৃশ্য। হ্যাঁ, মনে পড়ছে – একটা সুদৃশ্য পুরনো কাঠের ঘর! নদীর পাশে কাশবনের ভেতর নির্জনতায় ছবির মতো শালকাঠের ঘরখানা। ঘরের ভেতরটা ছোট্ট লাইব্রেরির মতো, সবগুলি দেয়ালের সঙ্গে আটকানো বইভর্তি কালচে কাঠের শতবর্ষী প্রাচীন র্যাক। দক্ষিণের জানালার পাশে লেখার চেয়ার-টেবিল পাতা। ঘরটা ছোট্ট এবং পুরনো, তবে সবকিছুতেই একটা আভিজাত্যের ছাপ। দখিনের জানালার ওপারেই বয়ে চলেছে টলটলে জলের একটা ছোট্ট স্নিগ্ধ নদী। চারপাশে ফুটে আছে অজস্র বুনো ফুল – সাদা, হলুদ, নীল, গোলাপি। তাদের ঘিরে হাজারো বর্ণিল প্রজাপতি। ওদের সদাচঞ্চল ওড়াউড়ি দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়।
গরম চায়ে চুমুক দিয়ে উপলব্ধি করি – স্বপ্নের দৃশ্যগুলি তো স্পষ্ট মনে করতে পারছি, তার মানে মাথা ঠিক আছে। যে-মানুষ এমন 888sport live chatময় স্বপ্ন দেখতে পারে তার লেখার কলম স্তব্ধ হবে না। আমি পারব, আমার আঙুলের স্পর্শে আবারো উন্মোচিত হবে গল্পের নতুন নতুন দিগন্ত।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রাস্তার পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। আনমনে লোকের চলাচল দেখতে দেখতে প্রত্যয় আসে – আমি বোধহয় ওইরকম একটা পরিবেশ পেলে লেখার শূন্যতা ঘুচিয়ে আবার রাশি রাশি গল্প সাজাতে পারব। নদীর অদূরে স্বপ্নের ওই পরিত্যক্ত কাঠের ঘরটি খুঁজে বের করতে হবে আমাকে। এই শহর থেকে দু-তিন কিলোমিটার উত্তরে গেলেই এমন একটা নদীর সাক্ষাৎ মেলে, সে-নদীর জল অবশ্য স্বপ্নে দেখা নদীর মতো অতটা স্ফটিক-স্বচ্ছ নয়। হয়তো আমাদের শঙ্খিনী নামক এই নদীরই কোনো এক কূলে মিলে যাবে সেই কাঠের ঘর; কিন্তু কোন দিক দিয়ে কীভাবে গেলে খুঁজে পাওয়া যাবে কাশবন আর বিচিত্র লতাগুল্মে ঘেরা সেই কুটিরখানা?
২.
একটা দিন মনে মনে ভাবনা ও পরিকল্পনার জন্য সময় নিই। পরদিন শনিবার সকাল সাড়ে ৮টায় বেরিয়ে পড়ি শঙ্খিনীর তীরে সেই কাষ্ঠগৃহের সন্ধানে। কিন্তু সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নদীর কূলঘেঁষা চারটে গ্রাম ঘুরে প্রথম দিনের 888sport slot game নিষ্ফলই হয়। অভিযানের দ্বিতীয় দিন মনোহরদি গ্রামে যাব বলে ঠিক করি, ওই দিকটা অপেক্ষাকৃত নির্জন আর গাঢ় সবুজ। আমার সাদা রঙের স্কুটি চেপে শহর ছেড়ে পূর্বদিকে এগিয়ে চলি পাকা রাস্তা ধরে। মিনিট দশেক পর দেখা যায়, একটা মাটির রাস্তা খালপাড় দিয়ে চলে গিয়েছে ডানদিকে। মনে হলো এই রাস্তা দিয়ে দিব্যি যাওয়া যেতে পারে। পরিত্যক্ত বিস্তৃত একটা ইটের ভাটার ভুতুড়ে পরিবেশ পেরোনোর পর রাস্তা শেষ। স্কুটি নিয়ে এগোনোর মতো কোনো পথ নেই। প্রথমে স্কুটিটা ঘুরিয়ে নেব বলে ঠিক করি, পরক্ষণেই মনে হয়, এটা রেখে হেঁটে তো এগিয়ে যাওয়া যায়। আমি যে-ঘরটা খুঁজছি সেটা তো একেবারে নির্জনতায় – জনপদের অনেকটা বাইরে। কাজেই প্রয়োজনে হেঁটেও পথ চলতে হবে। সতেরো কোটি মানুষের দেশে এতটা নির্জন কোনো জায়গা থাকতে পারে, এখানে না এলে বোঝা যেত না। একপেয়ে সরু পথটাও দীর্ঘ ঘাস আর লজ্জাবতী লতায় প্রায় ঢেকে গিয়েছে, সে-পথ ধরে হেঁটে একটা প্রাচীন আমবাগানে এসে উপনীত হই। গাছগুলি আকাশ ছুঁয়েছে, এগুলির কোনোটার বয়স একশ-সোয়াশো বছরের কম নয়। আমবাগান পেরিয়ে কাশবনের ভেতর দিয়ে সরু পথ। পথের শেষ মাথায় গিয়ে আমার দু-চোখ চকচক করে ওঠে। আরে এই তো সেই ঘর! একেবারে স্বপ্নের ঘরটার মতো। তালাবদ্ধ কাঠের দরজাটার সামনে গিয়ে খানিক দাঁড়িয়ে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করি। ‘কেউ আছেন – আছেন কেউ আশপাশে?’ পাখির ডাক ছাড়া আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। জংধরা তালাটা মোচড় দিতেই খুলে যায়। পাল্লা ঠেলে সাবধানে ভেতরে ঢুকি। ঘরের ভেতরটা যতখানি ধূলিধূসরিত হবে বলে ভেবেছিলাম আদৌ তা নয়। মেঝে, দেয়াল বেশ পরিচ্ছন্ন। একটা জানালা খোলা বলে ঘরটা আলোকিত। অর্থাৎ এখানে মানুষের আসা-যাওয়া রয়েছে। তাহলে তালাটা এমন মরচেপড়া কেন? যা-ই হোক সেসব পরে ভাবা যাবে। আমি অবাক হয়ে দেখি, দেয়াল জুড়ে নানান ভাষার বিচিত্র বই। জানালার পাশে লেখার চেয়ার-টেবিল পাতা। টেবিলের ওপর একখানা ডায়েরি। আমি ডায়েরিটা উল্টে-পাল্টে দেখি, ইংরেজিতে লেখা নাইনটিন সেভেনটি এইট, মানে প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগের। পুরু ও দামি কাগজের পাতাগুলি খানিকটা পাণ্ডুর। তবে পুরো ডায়েরির কোথাও কোনো আঁচড় নেই। পাশে রুপালি রঙের কলমটাও খুব পছন্দ হয়। এতকিছু কি আমার জন্যই প্রস্তুত করে রেখেছে কেউ? কেন – কীভাবে – এসব অনুসন্ধানের চেয়ে বরং আমার নিষ্ফলতার কাল পেরিয়ে লেখাটা আবার চালু করা বেশি জরুরি। এটা ঝর্ণা কলম অথচ কালি তাজা, একটুও শুকোয়নি। এসব কে তাহলে দেখভাল করে? তবে আপাতত অন্য সব কৌতূহল অবদমন করে ডায়েরিটার প্রথম পাতায় তারিখ দিয়ে লিখতে শুরু করি। খাতা-কলমে লেখার অভ্যেস যে আমার নেই, মসৃণ কলমে লিখতে লিখতে তা আমি ভুলেই যাই। ‘এই জীবনের মানে আমি খুঁজে চলেছি বহুদিন। জানি, বৃথা অন্বেষণ তবু আমার কৌতূহল থামে না। আমি আর সকলের মতো হলে নিছক অজ্ঞেয়বাদী, সংশয়বাদী কিংবা প্রার্থনাকারী হিসেবে জীবন কাটিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু এই মধ্যবয়সে এসেও কোনোকিছুতে আমি স্থির হতে পারি না। জীবনের ওপার থেকে কেউ যদি এসে বলে দিত – এই তো আমি পরলোক থেকে বেড়াতে এসেছি, বিশ^াস করো সত্যিই আছে ওপারে এক অনন্য জীবন, অথবা নিজেই যদি একদিন এমনকি স্বপ্নেও মরে যেতে পারতাম, তাহলে বোঝা যেত ওপার শূন্য, আলো নাকি অন্ধকার। কিন্তু তা তো ঘটবার নয় আমি জানি …।’
এভাবে শব্দের মালা গেঁথে এগিয়ে চলে আমার রুপোর কলম, যাক সত্যিই কাটছে লেখার শূন্যতা। লিখতে লিখতে মনটা বেশ নির্ভার হয়ে ওঠে। কতক্ষণ বাদে ঠিক বলতে পারব না, পাখির কিচির-মিচিরে হঠাৎ ধ্যানভঙ্গ হয়। পাখিগুলি কোথায় এমন ডাকাডাকি করছে? মনে হলো ডানার ঝটফটানিও যেন শুনতে পাচ্ছি। আরে এ কী! আমার ঘরভর্তি নানান জাতের পাখি। ওরা যার যার স্বরে বিচিত্র কণ্ঠে কিচির-মিচির করে যাচ্ছে। লিখতে লিখতে বাইরে তাকিয়ে দেখি ঘোর অন্ধকারে ঢেকে গেছে চারপাশ। মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক ঠিকমতো কাজ করছে না। আচ্ছা আমি তো সকালে বেরিয়েছিলাম। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়ে গেল কীভাবে? আমার মনে হচ্ছে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি দুই-আড়াই ঘণ্টার বেশি নয়। অথচ ঘড়ি বলছে সাড়ে দশ ঘণ্টা। আমি তো দুপুরের খাবার খাইনি, এক গ্লাস জলও নয় – কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো – সন্ধে? সময় হিসাবের আরেক গোলকধাঁধায় পড়ে যাই আমি। কিন্তু ওসব কিচ্ছু নিয়ে ভাবা যাবে না, কোনো বিস্ময় নয়, নয় কোনো সংশয় – আপাতত বাড়ি যেতে হবে, তহমিনা ফোনে না পেয়ে নিশ্চয়ই উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। কাল এসে আবার লেখা শুরু করা দরকার।
ঘরে যখন ফিরি ড্রইংরুমের দেয়ালঘড়িতে রাত প্রায় আটটা। দরজা খুলেই তহমিনা কৈফিয়ত চায় – ‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ? তোমার ফোন কী হয়েছে, মুখ শুকিয়ে আছে – খাওনি কোথাও? আর একটু দেরি হলেই তো আমি তোমাকে খুঁজতে বেরুতাম।’ ইত্যাদি।
আগেই ঠিক করা ছিল আমার আবিষ্কৃত ঘরটার কথা কাউকে বলব না, এমনকি তহমিনাকেও নয়।
‘আর বলো না, বেড়াতে গিয়েছিলাম গ্রামের দিকে। সেখানে এক পুরনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা।’
‘আচ্ছা, সেসব পরে শুনব। চেহারা দেখে বুঝতে পারছি কিছু খাওয়ায়নি সে-বন্ধু, তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো – আমি টেবিলে খাবার দিই।’
আমার স্বপ্ন, স্বপ্নকে ধাওয়া করে কুটিরের সন্ধান লাভ, সেখানে রুপোলি কলমে লেখা – এই সব বিষয় কেবল নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখা সহজ নয়, বিশেষত তহমিনার কাছে আমি চিরকালই অকপট। অথচ বিশেষ কঠোরতার সঙ্গে আমি সবকিছু গোপন রাখি।
পরদিন নাস্তা সেরে নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত ও স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে তহমিনাকে নির্দিষ্ট কিছু না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ি। স্কুটি ছুটিয়ে দ্রুত পৌঁছে যাই সেই নির্জন কুটিরে। কাঠের দরজা খুলে চেয়ারটায় গিয়ে বসি। ডায়েরি নিয়ে লিখতে গিয়ে অবাক হই। আমার লেখার পরে আরো খানিকটা লেখা। এই হাতের লেখা তো আমার নয়। দেখি তো কী লেখা –
‘আমিও এক সময় তোমার মতোই আকাশ-পাতাল তন্নতন্ন করেছি, বুকের ভেতর বহু রক্তক্ষরণের যন্ত্রণা সহ্য করেছি একটি নিশ্চিত ভূমিতে পা রাখার জন্য। আমিও বিশুদ্ধ সংশয়বাদী বা বিশ্বাসী হতে পারিনি কোনোদিন। অবশ্য এখন আমার সামনে সবকিছু পরিষ্কার, কিন্তু পেছনে ফিরে গিয়ে ভুল শুধরানোর কোনো সুযোগ তো আর নেই। এই লেখার ঘরটি আমার, এক সময় প্রবল আকাক্সক্ষা ছিল কবি হবো – দেশ-বিদেশের রাজ্যের 888sport app download apkর বই জোগাড় করেছিলাম, জীবনের সবকিছু তুচ্ছ করে আমি কেবল কবিই হতে চেয়েছিলাম, আমার স্ত্রী নেই – নেই সন্তান। অথচ সে-বাসনা পূরণ হলো না। তাই আমার লেখার ঘরটি এখন তেমন আর ব্যবহার হয় না।’
আমি লেখাটা পড়ে খানিক ঘরের ভেতর পায়চারি করতে করতে ভাবি এখন আমার করণীয় বিভিন্ন বিকল্প : ১. এখানে থেকে এই মুহূর্তেই চলে যাওয়া। ২. অযাচিত লাইনগুলি কেটে দিয়ে আমার লেখার ধারাবাহিকতা বজায় রেখে লেখা চালিয়ে যাওয়া। ৩. এই লেখার পেছনের রহস্য উন্মোচনে সচেষ্ট হওয়া। ৪. এই লেখার জবাব দিয়ে আমার লেখাটা এগিয়ে নেওয়া।
ভেবেচিন্তে শেষ পর্যন্ত চতুর্থ অপশনটিই পছন্দ হয় – অন্য কাজে সময় নষ্ট করে লাভ কী! আমি তো লিখতেই এসেছি, এই উপলক্ষে যদি লেখাটা ভিন্নভাবে নতুন কিছু অবলম্বন করে এগিয়ে যায় তো মন্দ কী! দুজন পরস্পর অচেনা মানুষের লেখার মধ্য দিয়ে অবশ্যই নতুন একটা কিছু সৃষ্টি হবে! অজ্ঞাতজনের লেখার পর আমি লিখতে শুরু করি – ‘আমি জানি না, কীভাবে এই জালে জড়িয়ে পড়লাম। কিন্তু আপনার পরিণতি আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আপনি হারিয়ে গেলেন কেন? 888sport live football হলো না তাই বলে কি জীবন অর্থহীন – 888sport live chatের চেয়ে জীবনের মূল্য কোনোভাবেই কম হতে পারে না। আমার মনে হয় এই বুঝতে না পারাটা কেবল আপনার অন্তর্ধানের কারণ নয়, 888sport live chatী হতে না-পারাও প্রধান অন্তরায় ছিল। আপনার মতো 888sport live chatপথের অনেক অভিযাত্রীই অন্ধকারে পথ হারিয়েছে। আসলে জীবনের জন্যই কি সবকিছু নয়? তাই যদি হয়ে থাকে তো 888sport live chatী হতে না পারার কারণ আত্মবিনাশ হওয়া উচিত নয় কোনোভাবেই। আপনি যদি মানুষ আর প্রকৃতির মাঝে নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করার চেষ্টা করতেন, তো আপনার এই পরিণতি হতো না বলে আমার বিশ্বাস।’ – এটুকু লিখে কলম আর এগোয় না। ঘর থেকে বেরিয়ে নদীর ধারটার দিকে এগিয়ে যাই। মিনিট বিশেক প্রাণ ভরে প্রকৃতির দৃশ্য দেখি, শব্দ শুনি, ঘ্রাণ নিই।
কাঠের ঘরটায় ফিরে এসে দেখতে পাই অজ্ঞাতজনের টাটকা কিছু বাক্য : ‘আলাপ যেহেতু হচ্ছেই, সত্য লুকানোর কোনো ইচ্ছে নেই। আমাকে আরো একটা বিষয় ভীষণ হতাশ করে তুলেছিল। আমি শুনলাম 888sport apkীরা বলছেন অদূর ভবিষ্যতে কম্পিউটারভিত্তিক এমন প্রযুক্তি আসবে যার সাহায্যে গানবাজনা, পেইন্টিং, গল্প-888sport app download apk সবকিছুর কাজ করা যাবে, কাজটা করবে মানুষের বিকল্প কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এর কাজ শুরু হয়ে যাবে তিন-চার দশকের ভেতরেই। তাই আমার মনে হলো, তবে আর বৃথা 888sport app download apkর পেছনে সময় দিয়ে কী লাভ? তুমি যে ওখানে বসে আজো গল্প লিখছ, এর কোনো মানে হয়? এসব কিছুই টিকবে না, কদিন পর আরো বেশি অর্থহীন হাস্যকর হয়ে উঠবে সবকিছু।’
আমি পড়ি কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না যে, মানবীয় কোনো 888sport live chatসৃষ্টি অন্য কোনো যান্ত্রিক উপায়ে হতে পারে। তার প্রশ্ন আমার ভেতরে খানিকটা দ্বিধা তৈরি করে বটে কিন্তু আমি যুক্তি দিয়ে তাকে পরাস্ত করতে দৃঢ় হাতে কলমটা ধরি।
৩.
চোখ মেলার পর উপলব্ধি করা গেল কেউ আমার চোখেমুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। চোখ মেলে প্রথমে ঠিকরে পড়া আলো দেখে বোঝা যায় এখন ভরদুপুর। ঘরের কাঠের ছাদটা দেখে স্পষ্ট হয়, আমি সেই ঘরটার মেঝেতে পড়ে আছি। তখনই চোখের সামনে একজন 888sport promo codeর মুখ – তহমিনা! সে মৃদুকণ্ঠে বলে, ‘এখন কেমন বোধ করছ?’
আমি শুষ্ক ঠোঁট-জিভ নেড়ে বলি, ‘এই তো – মাথাটা ভীষণ ভারী হয়ে আছে; তুমি আছো, আমি ঠিক হয়ে যাব।’
ওর অশ্রুসিক্ত চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকি, বলি, ‘কাঁদছ কেন?’
এই কথায় তহমিনার কান্না আরো বেড়ে যায়। আমি তার চেহারা দেখে এতক্ষণে উপলব্ধি করি – আমার কোনো কথাই সে শুনতে পাচ্ছে না, অথবা আমি আদৌ কোনো আওয়াজ করতে পারছি না, আমার এই বাকরুদ্ধ অবস্থা তাকে শঙ্কিত করছে। আমি আরো দুজন পুরুষ ও একজন 888sport promo codeর কণ্ঠ শুনতে পাই, ওদের কণ্ঠস্বর-বেশভুষা পুলিশের মতো, ওরা হয়তো পুলিশই।
৪.
হাসাপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার দুদিন পর আমার মাথার কাছে বসে তহমিনা চুলে বিলি কাটছিল। এখনো তার অশ্রুসজল চোখ। ওর হাতখানা ধরে বলি, ‘আমার কী হয়েছিল বলো তো, আর তুমি কাঁদছই বা কেন? আমি তো ভালো হয়ে উঠেছি।’
সত্যি কথা বলতে সেদিন ওই পরিত্যক্ত কাঠের ঘরে তহমিনাকে এক পলক দেখার পর আমি আবার জ্ঞান হারিয়েছিলাম। তারপর থেকে এই মুহূর্ত পর্যন্ত কত দিন কত ঘণ্টা কেটেছে তার কিছুই আমি বলতে পারব না। তহমিনার সঙ্গে আলাপ করে যা বোঝা গেল তার সারমর্ম হলো : ওইদিন রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত ও আমাকে ফোন করেনি, জানে রাত করে বাড়ি ফিরি। তবে সাড়ে দশটার পর ফোন দিলে রিং হয় কিন্তু আমি রিসিভ করিনি। আত্মীয়-পরিজন, বন্ধুবান্ধব কেউ কিছু বলতে পারে না। তহমিনা ভোরবেলা পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সাহায্য চাইলে ওরা ফোন ট্র্যাক করে মোটামুটি একটা অবস্থান বলে দেয়, তাকে সন্ধানের জন্য ওসি সাহেব একজন এএসআই আর দুজন কনস্টেবলকে তহমিনার সঙ্গে দেয়। সেই আখড়ায় পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা সাড়ে বারোটা। সেখানেই মেঝেতে অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে পেয়েছিল তারা।
‘তুমি যে অতটা দূরে নির্জন জায়গায় কাটাও আমাকে একবার বললে কী হতো? আমার সারাটা রাত কীভাবে কেটেছে জানো তুমি?’
‘সরি, আমি তো জানতাম না, আমি ওভাবে সেন্সলেস হয়ে যাব, আমি তো রাত দশটার আগেই ঘরে ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলাম, কিন্তু ওখানে কী হয়েছিল আমার ঠিক মনে নেই। আমি আসলে একটা বিশেষ কাজে ওখানে যেতাম, ইচ্ছে করেই তোমাকে লুকিয়েছিলাম, ভেবেছিলাম কাজটা খানিকটা এগোলে তোমার সঙ্গে শেয়ার করব। ও, ভালো কথা ওখানে টেবিলের ওপর একটা ডায়েরি ফেলে এসেছি, খুব মূল্যবান।’
‘কী আছে তাতে?’
‘আছে, অনেক দরকারি কথা, তোমাকে সব বলব, আমাকে একটু সময় দাও। এখন কটা বাজে – এক্ষুনি যেতে হবে ডায়েরিটা আনতে।’ বলতে বলতে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসি।
‘তুমি শান্ত হও।’
‘শান্ত হবো মানে – তুমি তো জানো না, ওটার মূল্য এখন আমার কাছে কোটি টাকার বেশি।’
‘কিন্তু ঘরটা তো পুলিশ সিলগালা করে দিয়েছে।’
‘তা হোক, এক্ষুনি আমি যাব, ওসি সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।’
তহমিনা ঘর থেকে বেরিয়ে মিনিটখানেকের মধ্যে ফিরে আসে।
হাত বাড়িয়ে চকোলেট রঙের ডায়েরিটা আমার সামনে ধরে বলে, ‘এটাই তো সেই মহামূল্য সম্পদ?’
আমি হাতে নিয়ে ঠিক আছে দেখে বলি, ‘কিন্তু তুমি কীভাবে বুঝলে?’
অজ্ঞান অবস্থায় তোমার মাথার কাছেই ডায়েরিটা পড়ে ছিল। তোমার 888sport alternative link লেখার ডায়েরি বলে আমি ওটা পুলিশের কাছ থেকে রেখে দিয়েছিলাম।
‘সত্যি তহমিনা আমি যে তোমাকে কী বলব!’
‘আমাকে কিছু বলতে হবে না, তুমি আগে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠো। আর একটা শর্তে তোমার হাতে এটা দিচ্ছি – আমি যতদিন না বলব, অর্থাৎ যতদিন না মনে করব, তুমি আবার লেখার মতো সুস্থ হয়েছ, ততদিন এটা স্পর্র্শ করা যাবে না, ডায়েরিটা রইল এই ওয়্যারড্রোবের ভেতর। আমার কথার অন্যথা যেন না হয়!’
‘পাগল – একবার তোমাকে গোপন করে মরতে বসেছিলাম।’
সম্ভবত ২১ দিন পর আবার আমি ঘরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি পাই। সন্ধের খানিক আগে তহমিনাকে বলি, ‘কতদিন ঘরের ভেতর বন্দি, একটু বাইরে হেঁটে আসি।’
‘যাবে, তবে সঙ্গে আমিও থাকব।’
প্রায় এক কিলোমিটার পথ হেঁটে দুজন ঘরে ফিরি রাত প্রায় পৌনে আটটায়। আমি এই কদিনে বোধহয় ডায়েরিটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। তহমিনা আমাকে এক কাপ চা করে দিয়ে রান্নাঘরে ঢোকে। আমি ওয়্যারড্রোব খুলে ডায়েরিটা হাতে নিই। আমার লেখাটা প্রথম দিক থেকে পড়ি, না ঠিকই আছে। আমার ধারণা সেদিনের সেই ঘটনার আগ পর্যন্ত বোধহয় পঁচিশ পৃষ্ঠার মতো লেখা হয়েছিল। পৃষ্ঠা উল্টে শেষে ২৫-৩০ পাতার দিকে গিয়ে দেখি এর পরে আরো লেখা রয়েছে। ডায়েরিতে ৩৬৫ পৃষ্ঠার পর আরো বাড়তি ৩৬টি পৃষ্ঠা যোগ করা আছে, অর্থাৎ মোট পৃষ্ঠা888sport free bet ৪০১টি। বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম ডায়েরিটির কেবল শেষের ২০-২৫ পৃষ্ঠা খালি আছে, তার আগ পর্যন্ত কালো কালির অক্ষরে ঠাসা। আমার নিজের লেখা ২৮ পৃষ্ঠায় শেষ হয়েছে। এরপর থেকে বাকি অংশ মানে প্রায় ৩৫০ পৃষ্ঠা সেই অজ্ঞাত লেখকের রচনা। অর্থাৎ সেদিন কিংবা সেই রাতের পর থেকে ডায়েরিটা আমাদের বাড়িতে চলে এলেও লেখা থেমে থাকেনি। ওই কাঠের ঘরের কথা বাদ দিলাম, এখানে কীভাবে উপস্থিত হতে পারে সেই রহস্যময় লেখক? আমি গোগ্রাসে পড়তে শুরু করি ২৯ পৃষ্ঠা থেকে, আবার কিছু পৃষ্ঠা বাদ দিয়ে অন্য পাতাগুলি পরখ করি, না – ঠিকই তো আছে, কোনো অর্থহীন এলোমেলো কথা লিখে পৃষ্ঠা ভরা হয়নি, সম্পূর্ণ পরিকল্পনামাফিক সুচিন্তিত পথে এগিয়েছে এই গদ্য রচনা। পড়তে পড়তে মনে হয় আমি এই লেখাটি কী প্রকাশ করব? কোন আঙ্গিকের লেখা হবে এটি? পাঠক তো সত্যিই অভিনব এক ফর্মের স্বাদ পাবে এতে। কিন্তু লেখাটার পেছনের যে-বৃত্তান্ত তা কি ফাঁস করা ঠিক হবে? আচ্ছা, সেসব পরে ভাববো। আপাতত দেখি এটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে গড়ায়।
‘এই চা তো জুড়িয়ে জল। একটা চুমুকও দাওনি দেখছি।’
হঠাৎ তহমিনার কণ্ঠ শুনে আমি চমকে উঠি। ‘এইজন্য বলি বহুত হয়েছে। এবার লেখালেখির ভূতটা ঘাড় থেকে নামাও।’
বিব্রত আমি ডায়েরি থেকে মুখ তুলে বলি, ‘ওহ-হো সরি।’
‘থাক, আর বিনয় দেখাতে হবে না, আমি আবার এক কাপ তৈরি করে দিচ্ছি।’
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, তহমিনা আমাকে আগেরবার চা দিয়ে গিয়েছিল অন্তত ৫০ মিনিট আগে।
কৌতূহলবশত লেখাটা কোথায় গিয়ে শেষ হলো তা দেখতে ডায়েরির শেষ পাতার শেষ লাইনে দৃষ্টি রাখি।
একেবারে শেষে স্বাভাবিকের চেয়ে ছোট অক্ষরে লেখা – ‘বি. দ্র. : আপাতত আমি শেষ করছি। এবার তোমার পালা।’
অর্থাৎ অজ্ঞাতপরিচয় লেখক আমার জন্য এই অংশটুকু বাকি রেখেছে। আমি পেনস্ট্যান্ড থেকে একটা কলম নিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। কিন্তু চারটে-পাঁচটা শব্দের পর আর এগোয় না লেখা। আবারো সেই অস্থিরতা আর বিরক্তি নিয়ে সময় পার করা। তবে কি আমার বন্ধ্যত্ব-দিন আর ঘুচবে না। তহমিনার খবরদারিতে রাত বারোটার আগেই বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়তে হয়। বিছানায় এপাশ-ওপাশ করতে করতে লেখার স্থবিরতা বিষয়ে শঙ্কাটা মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়। তখন মনে পড়ে আমি তো সেই কুটিরে একটা রুপোর কলম দিয়ে লিখতাম। সেটা পেলে নিশ্চয়ই লেখাটা গতি পেত। তহমিনার অনুমতি নিয়ে কালই যেতে হবে ওই কাঠের ঘরে, কিংবা পুলিশের কাছে থেকে থাকলে অনুরোধ করে চেয়ে নিতে হবে।
সকালবেলা ফ্রেশ হয়ে ডায়েরিটা হাতে নেব বলে লেখার টেবিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে দেখি সেই রুপার কলমটা ডায়েরির ওপর রাখা। নিশ্চয়ই তহমিনা ডায়েরির সঙ্গে কলমটাও এনেছিল। এই না হলে লেখকের স্ত্রী! আমি আনন্দচিত্তে লিখতে বসে যাই। এবার দিব্যি তরতর করে এগিয়ে যায় আমার কলম। তহমিনা প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট পর আমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসে। ততক্ষণে ডায়েরির পাঁচটি পৃষ্ঠা লিখে ফেলেছি।
ওকে দেখে আমি বলে উঠি, ‘তুমি আসলে অনন্যা!’
‘সাত সকালে এই স্তুতি কোন উদ্দেশ্যে?’
‘তুমি যে কলমটাও সঙ্গে করে এনেছ তাই তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’
‘কোন কলম!’
আমি হাতের রুপালি কলমটা দেখালে তহমিনা বলে, সে আনেনি। আর কলমটা এখনই সে প্রথম দেখল। ও অনেকটা নির্বিকার চিত্তে আবার কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়।
মুখে রুটি-ভাজি পুরে আমি ভাবি, তাহলে কীভাবে এখানে এলো এই কলম! তখন আমার আরো একটি কথা মনে পড়ে – আচ্ছা এতোদিন হলো এটা তো ঝর্ণা কলম, আমি তো একবারও কালি ভরিনি, আমার কাছে কোনো কালি বা রিফিলও নেই, অথচ দিব্যি লেখা চলছে। তা কীভাবে সম্ভব হতে পারে? আমি ঠিক করি, এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন বা অনুসন্ধান করব না। আমার কাজ লেখা, সেটিই আমি করে যাব। এই জগতে অগণিত রহস্যের অধিকাংশই তো আমাদের কাছে অনুদ্ঘাটিত থাকে। থাক। আমি কেবল আমার কাজটি করে যাব – আমি জানি শেষ পর্যন্ত দারুণ কিছু হবে!


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.