মাহবুব আজীজ
শচীনবাবু স্যার তিন-চারদিন আগে আমাদের একজনের কাছে টেলিফোন করেন; আমরা, বছর দশেক আগে কতিপয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র অস্থায়ী ভিত্তিতে এক বেসরকারি সংস্থার হয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের কাজে দেশের নানান অঞ্চলে যাই – প্রকৃতপক্ষে যা ছিল আমাদের পার্টটাইম চাকরি; আর ওই কাজে আমরা তিন বন্ধু যাই বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে, সেখানেই তখন কালীবাড়ি স্কুলের অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজির শিক্ষক শচীন্দ্র চন্দ্র আইচ বাবুর সাক্ষাৎ পাই; সংগ্রহ করি মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর ও তাঁর পরিবার-প্রতিবেশীদের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা; শচীনবাবু স্যার অনুভূতিপ্রবণ মানুষ, তাঁর বয়ান আমাদের ছুঁয়ে যায়; ধর্মকে ঘিরে গড়ে ওঠা পাকিস্তানে ধর্মের অপব্যবহার আর পাকিস্তানিদের নির্মম আচরণের শিকার এদেশি সাধারণ মানুষ – শচীনবাবুর বর্ণনায় আমরা নিখুঁত হয়ে উঠতে দেখি; শচীনবাবুর সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতা গড়ে ওঠে, পরবর্তীকালেও কয়েকবছর তাঁর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত থাকে; তবে সর্বশেষ চার কি
পাঁচ বছর হয় যোগাযোগ অনিয়মিত হয়ে যায়; আচমকা তিন-চারদিন আগে এক সকালে শচীনবাবু আমাদের ফোন করেন ও তাঁর গুরুতর বিপদের কথা জানিয়ে ব্যাকুল স্বরে বলতে থাকেন, ‘বাবারা, একটু সময় নিয়া আসো তোমরা; আমি ভয় পাইতেছি!’ – আমরা বুঝতে পারি, শচীন স্যার গুছিয়ে কথা বলতে পারছেন না; তবে বুঝতে পারি, তিনি সত্যিই বিপদগ্রস্ত, সিদ্ধান্ত নিই, কয়েকদিন সময় হাতে নিয়ে শচীন স্যারের পাশে দাঁড়াবো; আমরা, একদার পার্টটাইম চাকুরে তিন বন্ধু – কয়েক বছরের ব্যবধানে তিনটি আলাদা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তা; এর মধ্যে একজন আরিফ তার স্ত্রীর অসুস্থতায় ময়মনসিংহ যেতে অপারগতা প্রকাশ করে; আমি আর কাইয়ুম – দুজনের আপিসেরই শাখা কার্যালয় আছে ময়মনসিংহে; আপিস থেকে সেখানকার কিছু কাজ বরাদ্দ নিয়ে মহাখালী বাসস্ট্যান্ড থেকে রওনা দিই ভোর-ভোর।
ময়মনসিংহ শহরে প্রেসক্লাব পেরিয়ে ছায়াবাণী সিনেমা হল ছাড়িয়ে বাঁদিকে যে রাস্তাটি মেডিক্যাল কলেজের দিকে যায়, সে-পথে কিছুদূর এগোলে হাতের বাঁয়ের গলিতে আটতলা বাড়ির চারতলায় শচীন্দ্র চন্দ্র আইচের ফ্ল্যাট; বুঝতে পারি, আজকাল ময়মনসিংহ শহরেও 888sport appর মতো উঁচু-উঁচু ভবন তৈরি হয় ও তা খ–খ- করে নানা মাপের ফ্ল্যাট আকারে কেনাবেচা চলে; যখন শচীনবাবুর সঙ্গে আমাদের সর্বশেষ দেখা, তখন তিনি কালীবাড়ি স্কুলের পাশে ভাড়াবাসায় সপরিবারে থাকেন; আমাদের ভালো লাগে যে, শচীন স্যার নিজের একখানা ফ্ল্যাটে অতঃপর বসবাস
করেন; আমরা ভোরে রওনা দিয়ে সকাল দুপুর হওয়ার আগেই তাঁর ফ্ল্যাটে পৌঁছে যাই।
এক হাজার স্কয়ার ফিটের ছিমছাম দুই বেড, ড্রইং-ডাইনিং; স্ত্রী শামিত্মবালাসহ শচীনবাবু থাকেন এ-ফ্ল্যাটে, পুত্র যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী, কন্যা বিয়ে হওয়ার পর থেকে আছে খুলনায় ফরেস্ট অফিসার স্বামীর সঙ্গে; শচীন স্যার আমাদের দেখে জড়িয়ে ধরে রীতিমতো কাঁদতে শুরু করেন; বুঝতে পারি, আশি উত্তীর্ণ শচীনবাবুর শরীর ভেঙে গেছে, হাড্ডিসার দেহে কোনোরকমে ধুতি-গেঞ্জি জড়ানো – সহজেই আবেগি হয়ে পড়েন; তাঁর পাশে বসে কাঁদেন তাঁর রুগ্ণ স্ত্রী – আমাদের শামিত্ম মাসি – আমরা তাঁদের নিজেদের সামলে নেওয়ার মতো অবসর দিই ও একসময়ে শচীনবাবুর পাশের চেয়ারে বসে বলতে থাকি –
‘শান্ত হোন স্যার। টেলিফোনে যতদূর বুঝলাম, আপনার বিধবা বোনের মেয়েকে নিয়ে সমস্যায় আছেন।’ – কথা বলতে শুরু করি শচীনবাবুর সঙ্গে।
শচীনবাবু ততক্ষণে দম নিয়ে নিয়েছেন, বোঝা যায়, অনেকের কাছে তাঁকে প্রসঙ্গগুলো বলতে হয়েছে; তিনি তাড়াহুড়ো করে একের পর এক প্রসঙ্গ তুলতে থাকেন; তবে সারমর্ম এই, ভাটিকেশরে বিধবা বোনের কলেজপড়ুয়া কন্যা নিশিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে কিছু মাস্তান; থানা-পুলিশ, স্থানীয় রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, সাংবাদিক ইত্যাদির সঙ্গে প্রচুর কথা বলেও শচীনবাবু কোনো সুরাহা করতে পারেননি। দিন-দিন পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপ হতে থাকে; কয়েকমাস পর নিশির উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, সে বাসা থেকেই একপর্যায়ে বেরোতে পারে না; ভাটিকেশরে মায়ের বাসা বা মেডিক্যাল গেটে মামার বাসা – সব জায়গায় একই পরিস্থিতি!
কথা বলতে-বলতে আবারো কাঁদতে শুরু করেন শচীনবাবু; আমরা আচমকা দেখি, ভেতরের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে হলুদ-নীল কম্বিনেশনের জামা-পাজামা-ওড়না পরা এক তরুণী; ছিপছিপে লম্বা শ্যামবর্ণ মেয়েটির বড়-বড় চোখ – এ-ধরনের চোখকেই সম্ভবত ডাগর আঁখি বলা হয়, একমাথা চুল কোমর ছাপিয়ে যেন পায়ে ঠেকেছে; মেয়েটির মধ্যে বাড়তি কোনো সংকোচ দেখি না আমরা, বরং তার হাঁটাচলায় একধরনের মুগ্ধকর স্বাচ্ছন্দ্য চোখে পড়ে; বুঝতে পারি, এই তরুণীর নামই নিশি; শচীনবাবুর সামনে দাঁড়িয়ে বলে – ‘মামা, এভাবে কান্নাকাটি করবেন না, পিস্নজ। কাঁদার মতো কিছুই হয়নি এখনো। আঙ্কেলদের বলুন আমাকে 888sport appর একটি কলেজে ভর্তি করার ব্যাপারে হেল্প করতে। আমি 888sport appয় মেয়েদের একটা হোস্টেলে থাকতে চাই। আর মাকে আপনি এই বাসায় এনে রেখে দেবেন।’
‘মা রে, আইএ পাশ করিস নাই। পরীক্ষার আগে তোকে কোন কলেজ নেবে?’
‘সেজন্যেই তো উনাদের সাহায্য লাগবে। বোর্ড অফিসে আঙ্কেলরা যোগাযোগ করে দেবেন।’
বলতে-বলতে এবার নিশি আমাদের দিকে তাকায়, ‘আঙ্কেল, আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে আমিই মামাকে বলেছি। আপনাদের কথা অনেক শুনি মামার কাছে। এখানে আমি আর থাকতে পারবো না। 888sport appয় আমার আইএ পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিন আপনারা, পিস্নজ।’
শচীনবাবুর বাসা হয়ে আমরা – আমি আর কাইয়ুম – যার-যার আপিস যাই ও কাজ সেরে চলে আসি ব্রহ্মপুত্রের পাশে নিরিবিলি হোটেলের ৪০৪ নম্বর কক্ষে; ময়মনসিংহে এলে এই হোটেল আমাদের পছন্দ; নদীর দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকা হোটেলটির রুমগুলো প্রশস্ত ও পরিচ্ছন্ন; একটি বড় ঘরে দুটি বিছানা, আমরা দুই বন্ধু পাশাপাশি বিছানায় শুয়ে শচীন স্যারের ভাগ্নি নিশির বিপদমুক্তির ব্যাপারে পরামর্শ করতে থাকি, যার-যার আপিসসূত্র ব্যবহার করে আমরা ইতিমধ্যে কয়েকজনের কথা জানতে পারি, যাদের মাধ্যমে ভাটিকেশরের গভীরে যেতে পারবো; আমরা দুজনই প্রতাপশালী এক লোক ভুট্টোর কথা জানতে পারি, ভাটিকেশরে জুলফিকার আলী ভুট্টোর ওষুধের একটি বড় দোকান আছে, সে স্থানীয় প্রভাবশালী মানুষ, জানতে পারি, তার কথায় প্রচুর মানুষ উঠে আর বসে।
‘দূর! শচীন স্যার খামোখাই বেশি কান্দে! ইভটিজিং আজকাল কোনো ব্যাপার নাকি! মেয়ে দেইখা রাস্তায় আওয়াজ দিছে, এই নিয়া তিনি কানতাছেন; আর আমরা সেটা নিয়া লাফাচ্ছি’ – কাইয়ুম বিরক্তির সঙ্গে আমার দিকে তাকিয়ে বলে।
‘এসব কী কথা রে কাইয়ুম? তুই এটা কী বললি! একটা মেয়ের এরকম বিপদ? আমরা কিছুই করবো না! ইভটিজিং থেকে আত্মহত্যার কতগুলো ঘটনা এ পর্যন্ত ঘটেছে? শচীন স্যারের ভাগ্নি না হলেও তো যে কারো নিশির পাশে দাঁড়ানো উচিত’ – আমি বলতে থাকি।
‘তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু নিশি আমাদের আঙ্কেল বললো কেন? সে তো শচীন স্যারের ভাগ্নি। আমাদের ভাগ্নি তো না। আমার আর তোর বয়স কি ৮০? আমাদের আঙ্কেল বললো কেন?’ – কাইয়ুমের কণ্ঠ রীতিমতো অভিমানী।
‘ আহা-হা! তোর বয়স যে ১৮; সেটা নিশি বোঝে নাই। কি দুঃখ!’
‘১৮ না হলেও এখনো ঠিকমতো ৪০ পার হয় নাই। আঙ্কেল বলবে কেন?’
‘নিশি কাজটা মোটেই ঠিক করে নাই। হুম।’ আমি গম্ভীর স্বরে বলি।
‘যেভাবে নিশি বলে ডাকছিস মনে হয়, যুগ-যুগ ধরে চিনিস! দেখলি তো মাত্র কয়েক মিনিট। তাতেই এই অবস্থা -’
আমরা বিষয়টি নিয়ে আরেকটু ঠাট্টা, মজা করি; এমনকি একে অপরের বউয়ের কাছে নালিশ জানানোর হুমকি পর্যন্ত দিতে থাকি যে, পরমাসুন্দরী তরুণী দেখে আপনার স্বামীর মাথা ঘুরেছে; এবং সন্ধ্যার পর রিকশা নিয়ে ভাটিকেশরে ভুট্টোর ওষুধের দোকানে আসি।
সৌজন্যমূলক কথাবার্তা ও নাম-পরিচয় বিনিময়ের পর ভুট্টোকে জানাই, তার কথা আমরা দুজনেই আপিস কলিগদের কাছে জেনেছি, তার সঙ্গে আমরা ভালো একটি রেস্টুরেন্টে চা খেতে চাই; পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে বয়স, মাথার সামনে মস্ত টাক, পানখাওয়া হলুদ দাঁত, মোটাসোটা শরীর, দশাসই ভুঁড়ির জুলফিকার আলী ভুট্টো খানিকটা অবাক হলেও সহজে রাজি হয়ে যায়, সম্ভবত প্রায়শ তাকে নানাধরনের পরামর্শ দিতে হয়, বোঝা যায়, এ-নিয়ে ভুট্টো যথেষ্ট পরিমাণে গর্বিত; তার চোখ দেখে বুঝি, আমাদের ঝকঝকে চেহারা-পোশাক ও কথার ধরন দেখে একটু চমকে ওঠেন শুরুতে; অবশ্য দ্রুত পরিস্থিতি নিজের অনুকূলে নিয়ে সহাস্য আপ্যায়ন করতে শুরু করেন; আমরা একটি রেস্টুরেন্টে তিনজনে বসি ও ভুট্টোর কাছে আমাদের সঙ্গে শচীন স্যারের দীর্ঘ সম্পর্কের বর্ণনা দিয়ে নিশি প্রসঙ্গ তুলে এ-ব্যাপারে কী বিহিত হতে পারে, জানতে চাই এবং মেয়েটির ভালোর জন্যে আমরা সবাই মিলে কী করতে পারি – তার পরামর্শও চাই। ভুট্টো কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঠোঁট উলটে হতাশ স্বরে বলেন, ‘আফনেরা এই বিষয়ে কথা কইবেন, ভাববার পারি নাই। নষ্টা মেয়েছেলে!’
হতবাক হয়ে ভুট্টোর দিকে তাকিয়ে থাকি; একটি ১৮ বছরের কলেজপড়ুয়া মেয়ে, আমাদের শচীন স্যারের ভাগ্নি; তাকে এভাবে –
‘হাক কইরা তাকানোর কিচ্ছু নাই। শচীন স্যারের ভাগ্নি বইলা এহনো মাইয়াটা বাড়িত আছে! নইলে ওরে কবে আমি নিজেই তুইলা নিয়া আসতাম…’
‘তার অপরাধটা কী?’ আমি বলি।
‘অপরাধের শেষ আছেনি? পুলাপানের মাথা ঘুরাইয়া দেওয়া হইলো ওর একমাত্র কাম। এতো হাইসা কথা কওয়ার কী আছে!… না হয় বুঝলাম হিন্দু পরিবারের মেয়ে; তাই বইলা পর্দা-টর্দা থাকবো না, নাকি!’
আমরা নিশ্চুপ, রেগে ওঠা-কথার তুফানতোলা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সামনে বসে থাকি; সে একনাগাড়ে কথা বলে চলে, ‘ভাটিকেশরে রাস্তায় খাড়াইয়া মাইয়ালোক মাথাত উড়না না দিয়া কথা কইবো; হাইসা গড়ায় পড়বো… এইতা হইতো না! আজ এই অনুষ্ঠান, কাইল হেই অনুষ্ঠান – পুলাপান লয়া নাচন-কোদন! গান গাইয়া, নাইচা সবার মাথা নষ্ট করছে নিশি!’
কাইয়ুম কি আমি; কেউই কথা বলি না; নিশ্চুপ শুনে চলি। ভুট্টো
একমনে বলে চলে, ‘জানুইননা তো কিচ্ছু, মাসকান্দার শামসু উকিলের পোলা মকসুদ সঙ্গী-সাথি লয়া তুইলা লয়া গেছিল নিশিরে; তিনদিন কুনো খবর ছিল না। দিন পনেরো আগের কথা। তিনদিন পর ফিরাই দিয়া গেছে! হের পরেই তো কান্দাকাটি শুরু হইছে শচীন প–ত আর হের বইনের! নিশির ফটর-ফটর তো এহনো কমে নাই হুনছি।’
আমরা ভুট্টোর বিবরণ ও বর্ণনার সময় তার কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি ও অশালীনতার ধরনে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকি।
‘তার মানে নিশি এখানে থাকতে পারবে না? পরীক্ষা দিতে পারবে না?’ – কাইয়ুম প্রশ্ন করে।
‘হেইডা আমি কী জানি!’ শুষ্ক হাসে ভুট্টো – ‘আপনেরা অপিসের কামে আইছেন। হেইডা নিয়া থাকুইন। নিশির ব্যাপারে কথা কইলে বিপদ হইতে পারে!’
আমি বিষণ্ণ থেকে বিষণ্ণতর হতে থাকি, এইটুকু একটা মেয়ে; নাচ-গানের জন্যেই তবে সমস্যায় পড়লো? মকসুদ নামের ছেলেটি দলবলসহ নিশিকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল; মানে কি; কাইয়ুমকে বলি – ‘চল, থানায় যাই।’
‘কী শুরু করলি! শার্লক হোমস হওয়ার দরকার নাই। দেখি, কথা বলে 888sport appয় কোথাও নিশিরে ভর্তি করা যায় কিনা!’ – কাইয়ুম বলে চলে; আসলে ভুট্টোর কথা শুনে আমি এতোটাই মুষড়ে পড়ি যে, কাইয়ুম কী বলে, বুঝি না; আমি একাই থানায় যাই, ওসি ইয়াহিয়া মীর্জার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি। ওসি সাহেব মধ্যবয়স্ক, ভারী শরীর, চুল উলটিয়ে আঁচড়ানো, পানখাওয়া হাসিমুখ; তার বাজে অভ্যাস হলো কথা বলার ফাঁকে নাকের লোম ছিঁড়তে শুরু করেন নিজের হাতে –
‘একটি তরুণীকে তুলে নিয়ে গেল মকসুদ নামের মাস্তান, সদলবলে। আপনারা কী করলেন?’
‘ ছিঃছিঃ। ভাইজান। এইসব কী বলেন? এটা বাংলা সিনেমা নাকি! কে বলছে আপনেকে এইসব কথা?’
‘নিশি মেয়েটাকে শামসু উকিলের ছেলে সদলবলে কয়েকটি মোটরসাইকেল নিয়ে এসে তুলে নিয়ে যায়নি? তিনদিন পর আবার ফেরত দিয়ে গেছে। দিন পনেরো আগের ঘটনা?’
‘এইগুলা গুজব। আমাদের কাছে কোনো অভিযোগ দায়ের হয় নাই। শচীন স্যার এলাকার মান্যগণ্য মানুষ। এই ঘটনা ঘটলে তিনি ছাড়তেন নাকি কাউরে?’ বলেন আর মধুর হাসি হাসেন ওসি ইয়াহিয়া।
বিভ্রান্ত হতে থাকি; ঘটনাটি কোন পর্যায়ে আছে প্রকৃতপক্ষে, শচীনবাবু গুরুতররূপে ভয়ার্ত-বিচলিত, নিশিকে দেখে অতোটা বোঝার উপায় নেই, আবার ভুট্টো কি থানার ওসি, এদের সঙ্গে কথা বলে ভিন্ন ভিন্ন উপলব্ধি হয় – না, নিশির সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে; আমি শচীনবাবুর বাসার উদ্দেশে রিকশা নিই ও ১৫-২০ মিনিটের মধ্যে শচীনবাবুর বাসার গেটে পৌঁছে দেখি, কাইয়ুম সেই বাসার গেট থেকে মাথা নিচু করে বের হয়ে আসছে।
আমরা দুজন দুজনের দিকে বিস্মিত হয়ে তাকাই; কাইয়ুম একটু হাসে, আমিও হাসি ও কাইয়ুমকে পাশ কাটিয়ে শচীনবাবুর ফ্ল্যাটে চলে আসি।
শচীনবাবু ততক্ষণে খেয়ে শুয়ে পড়েছেন, শামিত্ম মাসিও বসবার ঘরে নেই; নিশি আমাকে দেখে মোটেও অবাক হয় না, চোখ দেখে মনে হতে থাকে; ও জানতোই আমি আসবো; নিশির শান্ত চোখ দুটো দিঘির অতল জলের মতো টলমল করে – তাকিয়ে থাকতে পারি না, মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে; আমি সোফায় বসে মাথা নিচু করে রাখি; নিশি জলের গস্নাস এনে আমার হাতে দিয়ে বলে – ‘মকসুদ আমাকে তুলে নিয়ে গেছিল কিনা, জানতে এসেছেন? মকসুদ আর তার দলবল? তাই না?’
আমি কথা বলি না। অন্যদিকে তাকানোর চেষ্টা করি; পারি না, আমার মাথা নিচু হয়ে আসে।
‘তিনদিন পর আমাকে বাড়িতে ফেলে গেছে কিনা… জানতে চাইছেন, তাই তো!’
এবার আমি নিজেকে বলতে শুনি, ‘না, তুমি যেভাবে ভাবছো; সেভাবে জানতে চাইছি না। জানতে চাইছি যে, আসলে কী ঘটেছিল? মকসুদ নামের মাস্তান সত্যি তোমাকে নিয়ে গেছিল?’
অপ্রকৃতিস্থ মানুষের মতো হাসে নিশি; স্নিগ্ধ মুখে বিদ্ঘুটে ও আচমকা হাসি থামিয়ে বলতে থাকে নিশি – ‘কেন? একজন আমাকে তুলে নিয়ে তিনদিন পর আবার বাড়িতে রেখে গেলে আমি আর আপনাদের সহযোগিতা পাবো না? আমাকে এখানকার কলেজ বা 888sport appর একটা কলেজে যাওয়ার জন্যে আর সাহায্য করবেন না? আমি পড়াশোনা করতে পারবো না? আমার জীবন এখানেই শেষ!’
‘না, তা হবে কেন? সহযোগিতার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক?’ আমি বলি।
‘তাহলে পড়িমরি করে আপনার বন্ধু, আপনি সব ছুটে-ছুটে এসে কেন জিজ্ঞেস করছেন, গুজবটা সত্যি কিনা! আমার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য এই গুজব সত্য বা মিথ্যা কিনা; সেটা কেন আপনাদের জানা দরকার, সেইটা আমারও জানা জরুরি।’
মনে হতে থাকে, ভুট্টোর কাছে শুনেই কাইয়ুম এখানে দৌড়ে এসে নিশিকে উলটাপালটা প্রশ্ন করে রাগিয়ে তুলেছে; আমি দুঃখ প্রকাশ করি নিশির কাছে, বোঝাতে চেষ্টা করি – বিষয়টা আসলে যেভাবে দেখছে নিশি, তা নয়; পরিস্থিতির ভয়াবহতা বোঝার জন্যেই জিজ্ঞেস করা যে, সত্যিই তোমাকে ওরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল কিনা!
আমার দীর্ঘ বয়ান শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে আসেত্ম-আসেত্ম বলতে থাকে নিশি, ‘একটা মেয়ে। সে ঘর থেকে একমুহূর্তের জন্যে বের হতে পারে না। পড়াশোনা বন্ধ। নিজের বাড়িতে পর্যন্ত থাকতে পারে না। রাস্তায় বেরোলে অকথ্য গালাগাল, বাজে কথা। পুলিশ-থানাওয়ালারা এগুলোকে তাদের দেখার বিষয় বলেই মনে করে না। মেয়েটি নিজের এলাকা ছাড়ার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে।… এইটুকুই কি যথেষ্ট নয়, পরিস্থিতি কতটা গুরুতর বোঝার জন্য! নাকি মেয়েটিকে তুলে না নেওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি গুরুতর মনে হয় না’ – বলে আর কাঁদতে থাকে নিশি; ‘নিজেকে আমার আর মানুষ মনে হয় না ভাই। একটা পশু মনে হয়। বুঝলেন ভাই, একটা পশু। যাকে তুলে নেওয়া যায়, আবার ফেলে রেখেও আসা যায়।’
‘আঙ্কেল থেকে ভাই বলছো নিশি!’ – আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে একটু হাসি।
স্বাভাবিকতার পথেই যায় না নিশি; তীক্ষনস্বরে বলে – ‘আপনার বন্ধু কাইয়ুমই তো রীতিমতো গায়ে-মাথায় হাত দিয়ে আমাকে সান্তবনা দিতে-দিতে বললো, তার বয়স খুবই কম, আমি তাকে যেন আঙ্কেল না বলি। ভাইয়া বলতে বললো। আপনারও তো বয়স কম; তাই না!’
স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে থাকি; নিশি বলতে থাকে – ‘একবার যাকে তুলে নিয়ে তিনদিন পর ফেলে রেখে যায় কেউ; তাকে তো সবাই সান্তবনার নামে তার মুখ ধরবে, ঠোঁট চেপে ধরবে… তাই না! চোখের পানি মুছে দেবে! আপনি আর বসে আছেন কেন? আমাকে সান্তবনা দেবেন না?’ – বলে আর ঝরঝর করে কাঁদে নিশি।
আমি কথা না বলে বাইরে বেরিয়ে আসি; হাঁটতে থাকি সুনসান রাস্তায়, ব্রহ্মপুত্রের পাশ বরাবর রাস্তা ধরে, চৈত্ররাতের স্নিগ্ধ বাতাস; এমনই এক হাওয়ার রাতে নিশির মামা শচীন্দ্র চন্দ্র আইচ বাবুর কাছে আমরা কয়েকজন প্রথমবারের মতো আসি; শচীন বাবু শুনিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার তাঁর অভিজ্ঞতা – একাত্তরে প–তপাড়ায় যে-বাড়িতে ভাড়া থাকতেন শচীনবাবু; তার বাড়িওয়ালার ১৮ বছরের তরুণী মেয়েটিকে পাকিস্তানি আর্মি মেজরের পছন্দ হয় ও মেজর একরাতে মেয়েটিকে তুলে নিতে সাঙ্গপাঙ্গসহ জিপ পাঠায় সে-বাড়িতে! মেয়েটির বাবা – বাড়িওয়ালা ভদ্রলোক আর উপায় খুঁজে না পেয়ে নিজের মেয়েকে মেজরের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাব দেয় আর্মিদের কাছে; অসহায় সেই বাবা নিজের মেয়েকে আর্মি জিপে তুলে দেয়…
শচীনবাবু একাত্তরের যে-মেয়েটির কাহিনি আমাদের বলেছেন; তার নাম যেন কী ছিল! তাকে কদিন পর যেন পাকিস্তানি আর্মিরা ফেরত দিয়ে যায়? তিনদিন; তিনদিন পর ফেলে রেখে যায়। কী নাম যেন ছিল মেয়েটির? নিশি। একাত্তরের ওই মেয়েটির নাম ছিল নিশি। r

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.