তিন প্রজন্মের পরম্পরা যে-কালপটে বিস্তৃত, তার ধারাবাহিক আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। উনিশ শতক-বিশ শতক জোড়া বাংলার সামাজিক-সাংস্কৃতিক আলোড়ন কোন কোন খাতে ঘূর্ণিত হয়েছিল, তার একটা ধারণা তৈরি হয় অনায়াসেই। 888sport live football-সংস্কৃতির ইতিহাসের আড়ালে থেকে যায় জাতির পরিণতির রূপরেখা। তিন প্রজন্মের একমুখী তথা ভিন্নমুখী চর্চা জাতির ব্যাপ্তিকেই প্রকাশ করে। পারিবারিক ঐতিহ্য সামাজিক ঐতিহ্যে মিশে গিয়ে বৃহত্তর তাৎপর্য তৈরি করে। রায় পরিবার অর্থাৎ কার্তিকেয়চন্দ্র-দ্বিজেন্দ্রলাল-দিলীপকুমারের গুরুত্ব বড় পরিপ্রেক্ষিতে নতুন মাত্রা পায়।
দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায়ের সময় ১৮২০-৮৫, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ১৮৬৩-১৯১৩ এবং দিলীপ রায়ের ১৮৯৭-১৯৮০। এই তিন প্রজন্মের মধ্যে দ্বিতীয় প্রজন্ম যতটা বিস্তৃতখ্যাতি, তৃতীয়জন তার আংশিক হলেও প্রথমজন প্রায় বিস্মৃত। বিস্তৃতি-বি888sport sign up bonusর নিরিখে সীমাবদ্ধ না হয়ে বরং ইতিহাসের নিরিখে আলোচনা মুক্তমনা হওয়াই বাঞ্ছনীয়। সময়ের প্রেক্ষাপটে তাঁদের ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হলে যথাযথ বিচার সম্ভব।
রায় পরিবারের ঐতিহ্যের বিস্তার গানে। কার্তিকেয়চন্দ্র বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন গানে। দশ-বারো বছর বয়সেই তিনি ঢোল এবং তবলা বাজাতে পারতেন। গীতচর্চায় মনোযোগী কার্তিকেয় খুব অল্পসময়ে গান বিষয়টিকে আয়ত্ত করতে পেরেছিলেন। গানে নিয়মিত তালিম নিতেন তিনি। আর গীতমঞ্জরী নামে তাঁর স্বরচিত গানের সংকলনে রচনা এবং সুরকৃতির সুন্দর দৃষ্টান্ত রয়েছে। দক্ষ সংগীতজ্ঞ তো বটেই, বাংলার প্রথম যুগের খেয়াল গায়কদের অন্যতম এই দেওয়ান আত্মজীবনচরিতে তিনি জানিয়েছেন, প্রথমে ভালোবাসার গান লিখলেও পরে মাতৃস্নেহ, অপত্যস্নেহ, বাৎসল্য, ভ্রাতৃস্নেহ ইত্যাদি বিষয়েও গান লিখেছিলেন, ঋতুবর্ণনা, বিয়ে, সন্তানলাভ, জন্মতিথি বিষয়েও কিছু গান হিন্দি গানের আদর্শে তৈরি করেন তিনি। বহুমুখী প্রতিভাধর এই মানুষটি শিক্ষানবিশ হিসেবে কৃষ্ণনগর জজকোর্টে যোগ দেন। কিছুদিন মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারিও শেখেন। পরে কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে শ্রীশচন্দ্রের প্রাইভেট সেক্রেটারি ও শ্রীশপুত্র সতীশচন্দ্রের গৃহশিক্ষক হন। অবশেষে রাজা শ্রীশচন্দ্র ‘মহারাজা’ উপাধি পেলে তিনি সেখানে দেওয়ান হন। তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ বই কৃষ্ণনগর রাজবংশের প্রামাণ্য ইতিহাস – ক্ষিতিশবংশাবলিচরিত এবং আত্মজীবনচরিত।
তাঁর এই বইদুটি নিছক পারিবারিক বা ব্যক্তিগত নয়, সামাজিকও। আত্মজীবনচরিতের তাৎপর্যই এই কালচিত্রায়ণে। তাঁরই সার্থক অভিব্যক্তি এই বইটি। ১৩০২ সালের 888sport live football পত্রিকায় প্রকাশিত এই আত্মজীবনী সম্পর্কে ওহফরধহ গরৎৎড়ৎ পত্রিকায় মন্তব্য করা হয় – ‘ঞযব নঁষশ ড়ভ ঃযব ঋধষমড়ড়হ ঘঁসনবৎ ড়ভ ঃযব লড়ঁৎহধষ (ংধযরঃুধ) রং ঃধশবহ ঁঢ় নু ঃযব ধঁঃড়নরড়মৎধঢ়যু ড়ভ ঃযব ষধঃব ইধনঁ কধৎঃরপধুধ পযধহফবৎ, জড়ু উবধিহ ড়ভ ঃযব ঘঁফফবধ জধল. ঞযরং রং ধ াবৎু রহঃবৎবংঃরহম পড়হঃৎরনঁঃরড়হ রহ ধং সঁপয ধং রঃ ঢ়ৎবংবহঃং ধ মৎধঢ়যরপ ধপপড়ঁহঃ ড়ভ ঃযব সবহ ধহফ সধহহবৎং ড়ভ ধ হবধৎষু নুমড়হব ধমব.’ (১৮৯৭ সালের ২৬ মে 888sport free betয় প্রকাশিত)। 888sport live football পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘ইহাতে গত পঁচাত্তর বৎসরের বঙ্গের সামাজিক অবস্থার একটি সুন্দর চিত্র দেখিতে পাওয়া যায়। … আত্মজীবনচরিত এদেশে সম্পূর্ণ অপ্রতুল। স্বর্গীয় বিদ্যাসাগরের অসম্পূর্ণ আত্মজীবনচরিত ভিন্ন এ-বিষয়ে এখনো আর কিছু প্রকাশিত হয় নাই। যে দেশে জীবনচরিত লিখিবার প্রথাই নূতন তথায় পঁচাত্তর বৎসর পূর্বে আবির্ভূত একজন বিষয়ী ব্রাহ্মণ আপনার জীবনকাহিনী আপনি লিখিয়া গিয়াছেন, ইহাও অল্প বিচিত্র নহে। রায় মহাশয় এই আত্মজীবনচরিতে প্রসঙ্গক্রমে যে সকল মত ও মন্তব্য প্রকাশ করিয়াছেন তাহাতে উদারতা ও সূক্ষ্মদর্শনের প্রভূত পরিচয় পাওয়া যায়।’ বইটি লেখকের জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়নি। লেখকের অভিপ্রায় অনুসারে বিদ্যাসাগর এটি ছাপাবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু বিদ্যাসাগরের অসুস্থতা ও মৃত্যুর ফলে তা আর সম্ভব হয়নি। পরে তাঁর ভাই হরেন্দ্রলাল রায়ের ভূমিকাসহ বইটি প্রকাশিত হয়।
বইটিতে ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার ফাঁকে ফাঁকে গেঁথে দেওয়া হয়েছে তৎকালীন সমাজ। লেখকের বিদ্যারম্ভ থেকে বিদ্যা গ্রহণের পরিণতিসূত্রে বিদ্যার্জনের ধরনটি স্পষ্ট হয়। শিক্ষকের সঙ্গে ছাত্রের ব্যক্তিসম্পর্ক গড়ে ওঠার রূপরেখাটিও আঁকা হয়ে যায়। পারস্য বিদ্যারম্ভ পড়লে বিস্মিত হতে হয় এটা জেনে যে, সে-সময় ইংরেজি শিক্ষার ‘প্রথা’ ছিল না। ‘সেই সময় স্কুলের শিক্ষকের ও কেরাণীর পদ ব্যতীত ইংরেজিতে আর কোন কর্ম্ম মফঃস্বলে দৃষ্ট হইত না, এবং এই সকল পদের বেতন বা মান অধিক ছিল না। দেশের সমস্ত জেলার রাজকার্য্য পারস্য ভাষায় নির্বাহ হইত।’ সকৌতুকে লেখক জানিয়েছেন, ‘সে সকল পদে অধিক না হউক, উৎকোচ যথেষ্ট লাভ হইত এবং পদেরও গৌরব বিলক্ষণ ছিল।’
ধর্ম, কবিরাজি চিকিৎসা, হিন্দু পরিবারগুলোর বিচ্ছেদের কারণ, কৌলীন্য প্রথা, বিয়ে ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর আলোচনা অনেক সময় যথেষ্ট ব্যঙ্গাত্মক। প্রসঙ্গত, তাঁর গণিকালয়ের ইতিহাস পড়লে স্তম্ভিত হতে হয়। ‘এ প্রদেশে বেশ্যাগমন অতীব অধর্ম্ম বলিয়া বিশ্বাস ছিল। এমনকি গণিকালয়ে প্রবেশকালে প্রবেশকের সঞ্চিত পুণ্যসমূহ বহির্দ্বারে রাখিয়া যাইতে হয় এবং তজ্জন্য সেই বহির্দ্বারের ভূমি পুণ্যস্থান বলিয়া তাহার মৃত্তিকা দুর্গাপূজার মহাস্নানে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। বোধহয় এই কারণেই প্রাচীনদিগের প্রায় কোন ব্যক্তিকে বারাঙ্গনার গৃহে প্রবেশ করিতে দৃষ্ট হইত না। … এই সময়ে … কৃষ্ণনগরে পরস্ত্রী-গমন নিন্দিত বা বিশেষ পাপজনক না থাকাতে, প্রায় সকল আমলা, উকিল বা মোক্তারের এক একটি করিয়া উপপতœী আবশ্যক হইত। সুতরাং তাঁহাদের বাসস্থানের সন্নিহিত স্থানে গণিকালয় সংস্থাপিত হইতে লাগিল। … লোকে পূজার রাত্রিতে যেমন প্রতিমা দর্শন করিয়া বেড়াইতেন, বিজয়ার রাত্রিতে তেমনি বেশ্যা দেখিয়া বেড়াইতেন।’ …
উনিশ শতকের সমাজ-সংস্কৃতির বিস্তারিত বিবরণে অস্ফুটেই ধরা পড়ে লেখকের মানসপ্রবণতা। পরিশীলিত মানসিকতায় যে প্রগতিশীলতা, আধুনিকতা এবং ব্যাপ্তি কাম্য, দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র তারই আধার। নিস্পৃহ বিবরণেও সেই মুক্তমন অনাবিল আবিষ্কৃত হয়। আত্মচরিত যে ইতিহাসের আকর হয়ে ওঠে কেমন করে, তা অনুভব করা যায়। ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা এবং অনুভব বর্ণনাও আছে, আবার সমাজ-অভিজ্ঞতা এবং সে-বিষয়ে স্পষ্ট মতামতও আছে ফলত। এই আত্মজীবনচরিত সময়ালেখ্য হয়ে উঠতে পেরেছে।
‘এমন জনক-জননীর পুত্র দ্বিজেন্দ্রলাল যেমন হওয়া উচিত তাহাই হইয়াছিলেন। পারিপার্শ্বিক ঘটনা বা অবস্থার প্রভাব অপেক্ষা, একই কারণে, দ্বিজেন্দ্রলালের জীবনে স্বাভাবিক প্রকৃতির প্রভাবই অধিকতর পরিলক্ষিত হইত। … স্বয়ং কার্তিকেয়চন্দ্রও শৈশবেই দ্বিজেন্দ্রলালের এই অসামান্য শক্তি ও অলৌকিক প্রতিভা লক্ষ্য করিতে পারিয়া, একদিন তাঁহার স্বজনগণের সমক্ষে স্পষ্টই বলিয়াছিলেন – ‘দ্বিজু, এবহরঁং (প্রতিভা) – আমি তাহা নহি।’ দেবকুমার রায়চৌধুরী দ্বিজেন্দ্রলাল (জীবন)-এর এমন উক্তিতেই দ্বিজেন্দ্রলালের অবদান সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। মা প্রসন্নময়ীর স্নেহ-আশ্রয়ের কথা দ্বিজেন্দ্রলালও 888sport app download for android করেছেন। কার্তিকেয়চন্দ্র সম্পর্কে দীনবন্ধু মিত্র তাঁর সুরধুনী কাব্যে জলাঙ্গীর মুখে লিখেছেন, ‘কার্তিকেয়চন্দ্র রায় অমাত্য-প্রধান/ সুন্দর, সুশীল, শান্ত, বদান্য, বিদ্বান্,/ সুললিত স্বরে গান কিবা গান তিনি,/ – ইচ্ছা হয় শুনি হয়ে হয়ে উজানবাহিনী।’ এমন বাবার ছেলে দ্বিজেন্দ্রলাল ছোটবেলা থেকে গান গাইলেও গান অনুশীলন শুরু করলেন মুঙ্গের বাসকালে। দ্বিজেন্দ্রলাল নিজেই নাট্যমন্দিরের ১৩১৭-র শ্রাবণ 888sport free betয় লিখেছেন, ‘বাল্যকাল হইতেই সংগীতে আমার বিশেষ আসক্তি ছিল। আমার পিতা একজন সুবিখ্যাত গায়ক ছিলেন। প্রত্যুষে উঠিয়া তিনি যখন ভৈরোঁ, আশোয়ারি ইত্যাদির সুর ভাজিতেন, আমি অন্তরালে থাকিয়া শুনিতাম। শৈশব হইতেই আমি গান ও 888sport app download apk রচনা করিতাম।’ আর্যগাথার প্রথম ভাগে কবির আত্মমূল্যায়ন, এই 888sport app download apkগুলোতে কথা ও সুরের সমন্বয় লক্ষণীয় এবং এটিও বিষয়বৈচিত্র্যও গুরুত্বপূর্ণ। সুরের চেয়ে কথার ওপর নির্ভরতা বেশি হলেও সুরে গেয়। এই 888sport app download apkগুলো আসলে স্রষ্টার অনুভবমালা। আর্যগাথার দ্বিতীয় ভাগ আরো পরিণত – স্কচ, আইরিশ ও ইংরেজি গানের 888sport app download apk latest version করেন। দশ বছরের ব্যবধানে এটাই পাঠকের প্রাপ্তি, রবীন্দ্রনাথও এই বইয়ের বিশিষ্টতা ও অসম্পূর্ণতার আলোচনা করেছেন। আর্যগাথা ‘সংগীতপুস্তক’ বলে সম্পূর্ণ আলোচনা সম্ভব নয়। কারণ গানে কথার চেয়ে সুরেরই প্রাধান্য।
১৯০০ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর হাসির গান। আর্যগাথা দ্বিতীয় ভাগ ছাপানোর আগেই বেশকিছু হাসির গান রচনা করেন দ্বিজেন্দ্রলাল। এই হাসির গান এতই জনপ্রিয় ছিল যে, তাঁকে নানা জায়গায় গেয়ে শোনাতে হতো। বস্তুত হাসির গান তাঁর বিভিন্ন বয়সে লেখা গান সংকলন। রঙ্গ, ব্যঙ্গ এবং কৌতুকাবৃত এই হাসির গান সম্পর্কে ১৩২০ সালে 888sport live football পত্রিকার আষাঢ় 888sport free betয় পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় লেখেন, ‘যখন দ্বিজেন্দ্রলাল বিলাত হইতে এদেশে ফিরিয়া আসেন, তখন বাঙ্গালায় ভাবস্থবিরতা ঘটিয়াছিল। … ন্যাকামির প্রভাব চারিদিকে বেশ ফুটিয়া উঠিয়াছিল। সেই সময়ে দ্বিজেন্দ্রলাল বিলাতের যঁসড়ঁৎ বা ব্যঙ্গের এদেশে আমদানি করিয়া, দেশীয় শ্লেষের মাদকতা উহাতে মিশাইয়া বিলাতী ঢঙের সুরে হাসির গানের প্রচার করিলেন। দ্বিজেন্দ্রলালের হাসির গান বাঙ্গালী সমাজে একটা ভাববিপ্লব ঘটাইয়াছিল।’ সমাজের নানাবিধ অসংগতি এই হাসির গানের আশ্রয়।
প্যারোডি লেখাতেও দক্ষতা ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের। হাসির গানে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সুরের সমন্বয় করেছিলেন তিনি। ‘বিলাত-প্রবাসে’ তাঁর বিলিতি সংগীতচর্চা এই সমন্বয়কে পরিণত করতে পেরেছিল।
দ্বিজেন্দ্রলালের দেশপ্রীতির গানগুলোতে সুরসৃষ্টির বৈচিত্র্য ও বিস্তার আলোড়ন তুলেছিল গভীর। নাটকের বেশকিছু গানও একইরকমভাবে উন্মাদনা জাগায়। কথার চেয়ে জমজমাট সুরই এই আবেগ তৈরি করেছে। গয়াবাস (১৯০৬-এ গয়ায় আসা) তাঁর গানচর্চার খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্ব। তাঁর সঙ্গে জগদীশচন্দ্র বসুর সম্পর্ক গয়ায় ঘনিষ্ঠতর হয়। জগদীশচন্দ্রের অনুরোধে লেখেন, ‘বঙ্গ আমার, জননী আমার, ধাত্রী আমার, আমার দেশ’ গানটি। দ্বিজেন্দ্রলালের গান সম্পর্কে 888sport sign up bonusচারণ করেছেন মোহিতলাল মজুমদার, ‘সেদিন সার্কুলার রোডের সেই ভাবী মিলনমন্দিরের শূন্য প্রাঙ্গণে, বিপুল জনসভায়, বাগ্মীপ্রবর সুরেন্দ্রনাথ বক্তৃতা করিতেছিলেন; সেই বক্তৃতার পূর্বাহ্ণে মুদ্রিত গানটি বিতাড়িত হইল এবং সঙ্গে সঙ্গে – ‘বঙ্গ আমার, জননী আমার, ধাত্রী আমার, আমার দেশ’ – যে অপূর্ব সুরে, উদাত্ত মধুর দৃপ্ত সুর সংযোগে গীত হইতে লাগিল … আজও যেন তাহা শুনিতেছি ও অনুভব করিতেছি।’ মুঙ্গেরবাসও দ্বিজেন্দ্রলালের গানচর্চার একটি আলোচনাযোগ্য পর্ব। গায়ক এবং ‘টপ-খেয়ালের স্রষ্টা’ সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের সান্নিধ্য এই পর্বে তাঁর চর্চাকে সম্পন্ন করেছিল। যেমন গয়াবাসকালে গানচর্চায় প্রভাব পড়েছিল লোকেন্দ্রনাথ পালিত, প্রিয়নাথ সেন, জগদীশচন্দ্র বসুর।
উনিশ শতকের শেষ এবং বিশ শতকের শুরুতে প্রহসন, পৌরাণিক নাটক এবং ঐতিহাসিক নাটক রচনায় মনোযোগী হয়েছিলেন বাংলার নাট্যকারেরা, দ্বিজেন্দ্রলালও তার ব্যতিক্রম নন। ইতিহাস-আশ্রয়ে জাতীয়তাবাদ, যুক্তির আলোয় পুরাণের ব্যাখ্যা এবং সমকালীন সামাজিক বিষয়গুলোতে প্রতিক্রিয়া – এগুলো যে-কোনো সংবেদনশীল 888sport live footballিকের হওয়াটাই স্বাভাবিক; দ্বিজেন্দ্র 888sport live footballেও সে-বিষয়টি লক্ষ করা যায়। সব লেখায় পাঠকমন হয়তো তৃপ্ত হয় না, কিন্তু লেখকের বিশিষ্টতা এবং প্রবণতা বুঝে নেওয়া যায়। বস্তুত নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলালের চেয়ে কবি-সুরকার দ্বিজেন্দ্রলাল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পুত্র দিলীপ রায়ের সঙ্গে তাঁর এরকম কথোপকথন হয়েছিল, ‘না রে না, আমাকে কি রবিবাবুকে (কেউ) ভুলে যাবে না। আর কেন যাবে না জানিস? – এই জন্যে যে, আমরা রেখে যাচ্ছি যা বাঙালির প্রাণের জিনিস – সুরে বাঁধা গান। আমি যে কী সব গান বেঁধে গেলাম তুইও সেদিন বুঝবিই বুঝবি।’ (দ্বিজেন্দ্রলাল, দেবকুমার রায় চৌধুরীর বইয়ে দিলীপকুমার রায়ের ‘গীতিসুরকার দ্বিজেন্দ্রলাল’ 888sport live থেকে উদ্ধৃত)।
দ্বিজেন্দ্রলালের গানে-নাটকে যেমন জাতীয়তার উন্মাদনা আছে, তেমনি আবার তিনি এ-কথাও মনে করতেন, লিখেছিলেন দেবকুমার রায়চৌধুরীকে, ‘আজ যদি ধর, – ইংরাজ-রাজ এ দেশ ছাড়িয়া চলিয়াই যায় তা’ হইলে আমাদের যে কি ভয়াবহ ও শোচনীয় অবস্থা দাঁড়ায়, আমি তা কল্পনা কর্ত্তেও শিউরে উঠি। শ্যাল-কুকুরের অবস্থাও সেদিন আমাদের দুর্দশার কাছে বোধহয় হার মানে।’ এহেন স্ববিরোধিতা নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল। তবু সুধীর চক্রবর্তীর বক্তব্য এখানে মনে করা যেতে পারে, ‘তবু দ্বিজেন্দ্রলাল হয়ে থাকেন আমাদের কাছে 888sport app download for androidীয়। আমাদের জাতীয় জীবনের জাগরণীতে, আমাদের স্বদেশী গানের পরম্পরায়, আমাদের জনপ্রিয়-নাটক-অভিনয়ের সফল দৃষ্টান্তে এবং এক অতুলনীয় পৌরুষসম্পন্ন সাহসিক ও স্বয়ংবশ 888sport live footballসৃষ্টির জন্য। রবীন্দ্রসমকালীন হয়েও তিনি কোনোভাবে রবীন্দ্রনাথের দ্বারা প্রভাবিত হননি।’
ঠিক এমনই বিশিষ্ট ‘দৈলীপি ঢং’; এটির অনন্যতা অনুকরণীয়তায়। বাংলা গানে দিলীপকুমারের এই গায়নরীতি সম্পূর্ণ অভিনব। এমন একজন মানুষের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের গানবিষয়ক মতান্তরেও বারবার প্রকাশ পায় তাঁর স্বাধীনচিত্ততা। দিলীপকুমারের ধারণায় রবীন্দ্রগান টিকবে না স্বাধীনতার অভাবে। তুলনায় অনেক বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন দ্বিজেন্দ্রলাল। সেই ধারণার পরে বহু বছর অতিক্রান্ত; রবীন্দ্রগান আজো আছে সাড়ম্বরে। আসলে এই স্বাধীনতার প্রশ্নেই তাঁরা সহমত ছিলেন না। সুরকারকে লঙ্ঘন করে গান গাওয়ার স্বাধীনতা অর্থাৎ ‘সুরবিহার’ – এই গানের ঐশ্বর্য; রবীন্দ্রনাথ মানতে পারেন না এ-মত – সুরবিহার কতটা, কীভাবে বা কাকে দেওয়া যেতে পারে – এ-বিষয়ে নিঃসন্দিগ্ধ নন তিনি। ‘আমি যা ভেবে অমুক সুর দিয়েছি তোমাকে গাইবার সময়ে সেই ভাবেই ভাবিত হতে হবে’ এটা যে তিনি চাননি তা বলেই দেন রবীন্দ্রনাথ। ইন্টারপ্রিটেশনের স্বাধীনতা বলতে তিনি বুঝেছিলেন স্বরোচ্চারণে গায়নভঙ্গিমা, বুঝেছিলেন গায়কের নিজস্ব উপলব্ধির মধ্য দিয়ে বাণীর অন্তর্গত বোধের উন্মোচন। আর দিলীপকুমার চেয়েছিলেন সুর সঞ্চারণের বিস্তার ভঙ্গিমা, বুঝেছিলেন গায়কের নিজস্ব আনন্দের মধ্য দিয়ে সুরের অন্তর্গত ঐশ্বর্যের উন্মোচন।’ (শঙ্খ ঘোষ, ‘সুর বনাম সুরবিহার’ : ধ্রুবপদ, বার্ষিক সংকলন ১৯৯৬) কথা ও সুরের সামঞ্জস্যেই ছিল রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস, দিলীপকুমার অধিকতর প্রাধান্য দিয়েছিলেন সুরকে, কথা অপেক্ষাকৃত গৌণ ছিল তাঁর কাছে। তাঁর গানভাবনার সংকলন সাঙ্গীতিকী।
দিলীপ রায় বড় হয়ে উঠেছিলেন এক খোলামেলা পরিবেশে। মাতৃহারা এই মানুষটির বাবার সান্নিধ্যে বাৎসল্যে এবং উদারতায় মনের বিকাশ হয়েছিল স্বাধীনভাবে। মেধাবী এই ছাত্রটি নানারকম গান শুনতে শুনতে বড় হয়েছিলেন। উচ্চাঙ্গ ধ্রুপদের অনুরাগী 888sport live chatী কার্তিকেয়চন্দ্রের প্রভাবে তাঁর মনে সঞ্চারিত হয়েছিল হিন্দুস্থানি গানের দিকে ঝোঁক। বাবার বাংলা গানে তাঁর আকর্ষণ তেমন ছিল না বলে ক্ষুব্ধ দ্বিজেন্দ্রলাল মন্তব্য করেছিলেন, ‘বয়স হলে একদিন বুঝবি কী জিনিস আমি রেখে গেলাম।’ (‘দিলীপকুমার গানে, প্রাণে ও প্রেমে’, গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়, ধ্রুবপদ, বার্ষিক সংকলন, ১৯৯৬) একটু পরিণত হওয়ার পর অবশ্য তিনি বাবার কথার তাৎপর্য বুঝেছিলেন, কিন্তু হিন্দুস্থানি গানের ওপরে তাঁর ঝোঁক এতটাই যে, বাংলা গানকে সেই ধাঁচে সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। গোবিন্দগোপালের বয়ানে, ‘সারা ভারতে ভ্রাম্যমাণ এই গান-পাগল তরুণটি তখনকার সব শ্রেষ্ঠ ওস্তাদ, এমনকি বাঈজিদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন তাদের প্রত্যেকের গানের বৈশিষ্ট্য শুনে শুনে আয়ত্ত করার জন্যে। … সুরের পাখায় ভর ক’রে কথা হবে সুদূর নীল নভে উধাও, এই ছিল তাঁর স্বপ্ন।’ কীর্তনের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল গভীর। ধ্রুবপদের ওই সংকলনে সুধীর চক্রবর্তী লিখেছেন, ‘ভজন কীর্তনের পাশাপাশি মৌলিক বাংলা গানের বিচিত্রচারী এরকম সুরকার আমাদের অভিভূত করে। … এককালে নজরুল ও হিমাংশু দত্তের গান তিনি নিজে গেয়ে প্রচার করেছেন। কলকাতায় অতুলপ্রসাদের গান তাঁর ও সাহানা দেবীর গায়নে প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতি পেয়েছে। অতুলপ্রসাদ ও দ্বিজেন্দ্রলালের গানের স্বরলিপিও তাঁর কৃতি। … গান গাওয়া তাঁর বিনোদন ছিল না, ছিল চৈতন্যের অংশ। … দিলীপকুমার সম্পর্কে আমাদের বি888sport app download for androidের একটা বড় কারণ হলো তাঁর দীর্ঘ পণ্ডিচেরি প্রবাস। ১৯২২ সালে বিলাত থেকে ফিরে তিনি সারাভারত পরিক্রমা করেন সুরের সন্ধানে। … ১৯৩৭ থেকে ১৯৪২ পাঁচ বছর তাঁর গানের স্বর্ণযুগ।’
১৯১৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে গণিতে প্রথম শ্রেণির স্নাতক হয়ে ১৯১৯ সালে অংক নিয়ে পড়াশোনা করতে গেলেন ক্যামব্রিজে। সেখানে গান বিষয়েও পড়াশোনা শুরু হলো। মিউজিক পার্ট ওয়ানেও উত্তীর্ণ হলেন দিলীপ রায়। ১৯২১-২২ সালে বার্লিনে সাংগীতিক 888sport slot game, জার্মান ও ইতালীয় সংগীতশিক্ষা ও পাশ্চাত্যরীতিতে কণ্ঠচর্চা, পিয়ানো শেখা এবং জার্মান ও ইতালীয় ভাষাচর্চা, রমা রলাঁ, বার্ট্রান্ড রাসেল, হেরমান হেসের সান্নিধ্য লাভ, রলাঁর চেষ্টায় ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যান্ড ফ্রিডম সোসাইটির আমন্ত্রণে সুইজারল্যান্ডের লুগানোয় ভারতীয় সংগীত বিষয়ে ভাষণ, ১৯২২ সালে দেশে ফিরে ভারতীয় সংগীতে গভীর অভিনিবেশ এবং পরের বছর আবার বিদেশ888sport slot game। তাঁর ভাবনাচিন্তায় এই জীবনযাপনের ছাপও পড়েছে। ১৯২৮ সালে পণ্ডিচেরির শ্রী অরবিন্দ আশ্রমবাসের শুরু এবং যোগজীবনে ব্রতী হন দিলীপকুমার। তবে এ-পর্যায়েও তিনি গান থেকে নির্বাসন নেননি। গোবিন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়ের লেখায় আছে, ‘গানই ছিল তাঁর প্রাণ। পণ্ডিচেরি গিয়ে সে-গানই হয়ে উঠল বন্দন আরাধন, যোগ সাধনারই অপরিহার্য অঙ্গ, অন্তর্বিকাশের অভ্রান্ত রাজপথ। … অরবিন্দ তাঁর দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন তাঁর এই শিষ্যটির সাধনপথের বিকাশ ঘটবে গানের মাধ্যমে, কাব্যের অনুশীলনেই। তাই নিজে হাতে করে শেখালেন ইংরেজি নানা ছন্দ, নিরন্তর পরিবর্তন, পরিবর্জন, পরিমার্জন করে দিতে লাগলেন তাঁর নানাবিধ 888sport app download apk রচনার প্রয়াসকে।’ (ধ্রুবপদ, বার্ষিক সংকলন ১৯৯৬) ১৯৩৭ সালে কলকাতায় ফিরে গান রচনা, গান প্রচার, রেকর্ড সংগীত প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৫৩ সালে প্রধানমন্ত্রী নেহরুর আগ্রহে ও শিক্ষামন্ত্রী আজাদের আনুকূল্যে ভারতের সাংস্কৃতিক দূত হিসেবে ইউরোপ-আমেরিকা 888sport slot game এবং দেশে দেশে সংগীত-পরিবেশন – এই হলেন গানব্রতী দিলীপকুমার। তিনি লিখেছিলেন, ছান্দসিকী : নীলরতন সেনের কথায়, ‘বাংলা ছন্দচর্চার ক্ষেত্রে সুপরিকল্পিত পূর্ণাঙ্গ ছন্দ-ব্যাকরণ রচনার এটিই প্রথম সার্থক প্রয়াস।’ তা ছাড়া ভ্রাম্যমাণের জল্পনা, তীর্থঙ্কর বা 888sport sign up bonusচারণে তাঁর গদ্য স্বচ্ছন্দ। তিন প্রজন্মের চর্চার মধ্যেই নিহিত থাকে বাংলা গানের বৈচিত্র্য ও ক্রমবিকাশের রূপরেখা।
তবে তিন প্রজন্মের এই বিচিত্র ও বিশিষ্ট ধারাবাহিকতার অবশেষ যেন তেমন করে রইল না। গানের নানাবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিশেষত ‘দৈলীপি ঢং’য়ের অনুসরণ খুবই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল। স্বাধীন এই গায়নরীতি মগ্ন করল না পরবর্তী প্রজন্মকে। কার্তিকেয়চন্দ্র কার্যত বিস্মৃত হয়ে গেলেন। দ্বিজেন্দ্রলালের গান নিয়ে চর্চা অবশ্য আজো হয়, তবে সেই চর্চার ব্যাপ্তিও যতটা হওয়া কাম্য ছিল, ততটা হয়নি। রবীন্দ্র-আবহে দ্বিজেন্দ্রগীতির যে স্বাতন্ত্র্য তা নিয়ে মননচর্চা হয়তো কিছুটা হয়েছে, কিন্তু এই গানে বাঙালি মন যতটা তৃপ্ত হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। দ্বিজেন্দ্রগীতির সুরলহরি যেভাবে মনকে নাচায়, মজায়, হাসায়, তাতে তার প্রভাব আরো সুদূরবিস্তৃত হওয়া উচিত ছিল। ইতিহাসের খাতিরে এঁরা যতটা আলোচিত হন, রসের খাতিরে ততটা নন। কেন? যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার অভাব? অথচ বাংলা গানে এঁরা যে আঁচড় কেটেছেন, তা বলাই বাহুল্য।


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.