পারভেজ হোসেন
মরক্কোর ট্যানজিয়র নগরের লোক আবু আবদুল্লাহ মুহাম্মদ – যিনি সারাবিশ্বে পর্যটক ইবনে বতুতা বলে খ্যাত, ইবনে আল আসাদ তার শুধু উত্তরসূরিই নন, দুশো বছর আগের মহান পূর্বপূরুষটির বিরাট ভক্তও। হিন্দুস্থানের নানা তীর্থ ঘুরে চীন যাওয়ার পথে বাঙ্গালার সুবর্ণভূমি 888sport slot gameের যেটুকু অভিজ্ঞতার কথা বতুতা লিখেছেন, ছেলেবেলায় পিতৃপুরুষদের কাছে শোনা দূর অতীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সে-গল্পের অনেকটাই আবু আল আসাদের হূদয়ে খোদিত হয়ে আছে।
শুধু তা-ই নয়, আরব, পারস্য, রোমান, পর্তুগিজ নাবিক – যাদের জাহাজে চড়ে দিনের পর দিন সমুদ্রে কাটানোর কালে এর সৌন্দর্য আর সম্পদের কথা তাদের কাছেও কিছু কম শোনেননি।
বোর্নিও থেকে ছেড়ে আসা এক জাহাজে চেপে সিংহল হয়ে নাগাপট্টিনাম বন্দরে কয়েকদিন অপেক্ষা করলেন ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী মরক্কোর মুসলমান ওই যুবক আবু ইবনে আল আসাদ। ভারতবর্ষের এদিকটায় আগেও তিনি এসেছেন; কিন্তু জাহাজ ছেড়ে বন্দর-নগরে থাকা হয়নি। সমুদ্রতীরবর্তী হলে কী হবে, বাণিজ্যের জন্যে তো গড়ে উঠেইনি এমনকি দু-চারদিন কাটাবার জন্যেও যথেষ্ট নয় এ-নগর। তবু পরের জাহাজ ধরার জন্যে থাকলেন কদিন।
ওলন্দাজ সওদাগরি জাহাজ সেন্ট অগাস্টিন। গোলমরিচ, কর্পূর আর ঝিনুকভর্তি প্রায় পাঁচ হাজারমণি জাহাজখানায় উঠলেন তিনি। এটি যাবে বিশাখাপত্তনম হয়ে সাতগাঁও বন্দরে। তারপর নদীপথে মেঘনা দিয়ে ব্রহ্মপুত্র হয়ে তবে সোনারগাঁয়।
জাহাজের লশকরি অর্থাৎ মুসলমান নাবিক আর বণিকদের সঙ্গে যাত্রী যে-কজন আছেন, পথের পরিচয়ে হলেও মাত্র দুদিনেই খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠলেন তারা। এদের কেউ কেউ বর্মী (মিয়ানমার), গোয়া বা হুগলির, কেউবা মালদ্বীপ অথবা সিংহলের, বাকিরা সব বাঙ্গালার।
একটু আলাদা হয়ে অন্যদের জন্য দুর্বোধ্য এমনি নানা আলোচনায় মেতে পরস্পরের মধ্যে বেশ নিবিড় হলেন দুজন। মালাক্কাবাসী সাদা চামড়ার ছিপছিপে তরুণ পর্তুগিজ খ্রিষ্টান ফ্রান্সিস নাহিয়ান আর চোখে সুরমামাখা পাগড়িধারী মরক্কোর মুসলমান এ-পর্যটক দীর্ঘদেহী আবু ইবনে আল আসাদ। তাদের দুজনেরই বেশভূষণ যেমন অদ্ভুত, আদব-কায়দা আলাপচারিতাও তেমনই।
মাত্র বারো-চৌদ্দো লাখ মানুষের দেশ পর্তুগাল সারা পৃথিবীর সমুদ্রপথ শাসন করার মতো স্পর্ধায় মেতে উঠেছে তখন। ভাস্কো-ডা-গামার চেনানো পথ ধরে হিন্দুস্থানের দিকে পাল উড়িয়ে মসলার খোঁজে নেমে পড়েছে দুঃসাহসী সব অভিযাত্রীর দল। কিন্তু তাদের বণিকবৃত্তির আড়ালে আসল চেহারা বেড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। সমুদ্রের দস্যু বনে যাচ্ছে তারা। তাদের দুর্দম সাহস, বীরত্ব আর নৃশংসতার খবর বাতাসে উড়ছে। ছড়িয়ে পড়ছে হিন্দুস্থানের সমুদ্রতীরবর্তী এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত।
দ্বিতীয়বারের মতো গোয়া অধিকার করলেন পর্তুগিজ নৌসেনাপতি আলফোনসো দে আলবুকের্কে। অস্ত্রের শক্তি প্রদর্শনের নারকীয় বিজয়োল্লাস চলছে। কিন্তু জয়ী হয়েও প্রতিহিংসার আগুন দমাতে পারলেন না সেনাপতি। অধিবাসীদের মধ্যে সব মুরদের অর্থাৎ মুসলিমদের হত্যার হুকুম দিলেন। আর জাহাজের পাটাতনে দাঁড়িয়ে নারকীয় সেই হত্যাযজ্ঞ দেখতে চোখে দুরবিন লাগালেন তিনি। রক্তের নেশায় উন্মাদ অস্ত্রধারী বর্বররা মুরদের একজন 888sport promo codeকেও ছাড়ছে না। রেহাই দিচ্ছে না কোনো শিশুকেও। দুরবিনের ফুটো দিয়ে দেখা সেই নৃশংস দৃশ্যের মধ্যে জেগে উঠল পাশবিক আনন্দ। তার অস্থিমজ্জায় ছড়িয়ে পড়ল শিহরণ, আনন্দে কেঁপে উঠলেন তিনি।
বিজয়ের অমন আনন্দ নিয়ে এরপর তারা এলেন মালাক্কা প্রণালীর কোলঘেঁষা একটি উপদ্বীপে। অধিকার করলেন নগর মালাক্কা।
এই আলফোনসো দে আলবুকের্কে, পর্তুগিজরা যাকে সম্মানের সঙ্গে মার্স বলে ডাকে। এক সময় তারই জাহাজে চড়ে ধর্মপ্রচারের উদ্দেশে হিন্দুস্তানে যাবেন বলে পর্তুগাল থেকে মালাক্কায় এসেছিলেন নাহিয়ানের দাদা ধর্মজাজক ক্যাথলিক খ্রিষ্টান ফ্রান্সিস জেভিয়ার। কিন্তু ধর্মান্ধ আর বিবেকহীন ওই সেনাপতির নির্বিচারে মানুষ হত্যা আর অখ্রিষ্টানদের জোর করে খ্রিষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করায় কোনো সায় ছিল না জেভিয়ারের। নিষ্ঠুর আলবুকের্কের সঙ্গে থাকত ক্রুশ আর অবিশ্বাসীদের পুড়িয়ে মারার জন্য খুঁটি – পরাজিতের এ দুয়ের একটিকে বেছে নিতে হতো।
এখানে এসে সব দেখেশুনে জ্ঞাতিভাইদের এ-অবিচার আর কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না ফ্রান্সিস জেভিয়ার। প্রচন্ড ঘৃণায় আলবুকের্কের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেন তিনি। ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন, আলবুকের্কে যে কী, আমি তা খুব ভালো করে জানি। ও হলো পৃথিবীকে ছারখার করা সবচেয়ে কুখ্যাত দস্যুদের একজন। জনসাধারণের বিশ্বাসকে পদদলিত করে ও গোয়া দখল করেছে। ন্যায়নিষ্ঠ আর শান্তিপ্রিয় মানুষকে তাদের রক্তে ডুবিয়ে হত্যা করেছে ও। আর উৎসাহ জুগিয়েছে সমগোত্রীয়দের যারা সমুদ্রোপকূলের নিরীহ গ্রামবাসীকে ধরে ধরে নিয়ে দাস বানাচ্ছে। অবাধে বিক্রি করছে তাদের। অথচ পর্তুগিজরা কি-না এই আলবুকের্কেই মার্স অর্থাৎ পর্তুগিজ যুদ্ধদেবতা উপাধি দিলো! হায়! আর আমিও যে কী বোকা, ভালোভাবে না জেনে, না বুঝে পুরো পরিবার নিয়ে ওর সঙ্গে বেড়িয়ে পড়লাম ঈশ্বরপুত্রের কল্যাণ বুকে নিয়ে!
মর্মাহত, ব্যথিত ফ্রান্সিস জেভিয়ার হিন্দুস্তানের দিকে আর গেলেন না। সপরিবারে আলবুকের্কের দখল করা মালাক্কাতেই বসত গাড়লেন। এই জেভিয়ারের ধর্মপ্রচারক হওয়ার উৎস্য অবশ্য আরো পুরনো।
পর্তুগালের রাজা প্রথম ম্যানুয়েলের সৈন্যাধ্যক্ষ কাব্রালের খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন নাহিয়ানের দাদা ফ্রান্সিস জেভিয়ারের বাবা অর্থাৎ নাহিয়ানের পরদাদা সেন্ট ফ্রান্সিস মেনদিস। আর পূর্ব-ভারতীয় অঞ্চলে তখন তাদের দাস ব্যবসা ছিল জমজমাট। শুধু তা-ই নয়, মেনদিস ছিলেন তার সময়ে 888sport slot game888sport live footballের একজন নামকরা লেখকও। দাস ব্যবসা যদিও বেআইনি নয়, তবু মানুষ কেনাবেচার ব্যাপারটা কোনো অজ্ঞাত সংস্কারবোধের তাড়নায় পুত্র ফ্রান্সিস জেভিয়ার মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। প্রবলভাবে ঘৃণাও করতেন। ফলে তিনি বাবার পথে আর না হেঁটে ধর্মকর্মে নিবিষ্ট হলেন।
এসব মিলিয়ে দেশ আর পিতার পরিবার ছেড়ে আসা লোকটি শেষমেষ স্থায়ী হলেন মালাক্কাতেই। ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে মাতৃভূমি পর্তুগালে আর কখনো যাওয়া হয়নি জেভিয়ারের।
সেই দাদা, পরদাদার সূত্রে ফ্রান্সিস নাহিয়ান একজন পর্তুগিজ হলেও শিষ্টাচারে মানসিকতায় এখন মালয়েরই লোক।
888sport slot gameে বেরিয়ে ইবনে আল আসাদ আরব সাগর থেকে শুরু করে সিংহল সমুদ্র হয়ে মালয় সাগরে কম ঘোরেননি। বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে এসে হিন্দুস্থানের অনেক শহর, নগর, গ্রামগঞ্জ ঘুরেছেন, থেকেছেনও বহুদিন। দেশি-বিদেশি বহু মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। তাদের কারো কারো সঙ্গে সুবর্ণগ্রাম নিয়ে কথাও হয়েছে অনেক। বিহার হয়ে হুগলি পর্যন্ত এসেছেন তিনি। কিন্তু যতবার ভেবেছেন বাঙ্গালার ভাটির দিকে আসবেন, সে-সুযোগ আর কিছুতেই হয়ে ওঠেনি তার। কিন্তু এবার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেতে চলেছে। আর কী ভাগ্য, ফ্রান্সিস নাহিয়ানের মতো একজন সমমনা তরুণ সাথিও পেয়ে গেলেন তিনি।
গভীর সমুদ্রের নোনা হাওয়ায় দুদিন কেটে গেল। তৃতীয় দিন রাতে দেখা গেল চাঁদ যেন হাতের নাগালে নেমে এসেছে। ভরা পূর্ণিমায় গোটা সমুদ্র আচ্ছন্ন। কাপ্তান দে রইটারের কম্পাসের কাঁটাটি যে-দিক নির্দেশ করছে, সে-দিক ছাড়া এই দিকচিহ্নহীন অথই জল আর জ্যোৎস্নালোয় সবই একাকার।
রাতে অন্ন গ্রহণের পর দ্বিতলে অন্যদের সঙ্গে শুয়ে না পড়ে জাহাজের পেছনদিকে মালখানার সিঁড়ি বেয়ে পাটাতনে ঘুরতে এলেন ওরা দুজন। ছোট-বড় ছখানা পালে বাতাস আটকে কম্পাসের কাঁটা বরাবর তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে জাহাজ।
পালের দড়ি ধরে মাস্ত্তলে হেলান দিয়ে অকূলের দিকে এক ঠায় তাকিয়ে আছেন ইবনে আল আসাদ। মনটা ভারি বিষণ্ণ আজ। এ এক আজব দোষ! গাঢ় চন্দ্রালোয় তার মনের অবস্থা এমনই হয়। ফিরিঙ্গি সঙ্গীটিও একেবারে চুপ মেরে আছেন।
হঠাৎ নীরবতা ভাঙলেন ইবনে আল আসাদ। আচমকাই সামনে দাঁড়ানো নাহিয়ানকে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, একজন মুসলমান সে যে-জাতেরই হোক, একজন পর্তুগিজের কাছে তার পরিচয় কেন ‘মুর’ বলতে পারেন?
বয়সে কিছুটা বড় আর দুদিনের মাত্র পরিচয়। এরই মধ্যে ওর সম্পর্কে যেটুকু ধারণা হয়েছে, তাতে এগারোটি বছর ধরে পৃথিবীর পথে পথে ঘোরা অগাধ জ্ঞানের এ-মানুষটির কোনো প্রশ্নই যে তত সরল নয়, তা বুঝে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন নাহিয়ান। তার পরও বুকে বল রেখে বললেন, ওই শব্দের মধ্যে ঈর্ষা আর বিদ্বেষ ছাড়া আর কী আছে বলুন? মুরদের সঙ্গে আজন্ম বিরোধ, পর্তুগিজদের মরক্কো অধিকার, পরবর্তীকালে মহম্মদিদের সঙ্গে তাদের পরাজয় এসব থেকেই বোধকরি জন্মেছে ওটা। আপনি বোধকরি ভুল করছেন মহাশয়। আমার তো নয়ই, আমার বাপ-দাদা জাতে পর্তুগিজ হলেও তাদের অন্তরে কোনো জাত-পাতের বিদ্বেষ ছিল বলে মনে হয় না।
না, না, আমি ওরকম কিছু ভেবে আপনাকে জিজ্ঞেস করিনি। স্পষ্ট করে বুঝতে চাইছিলাম, নিজ জাতভাইদের অধিকার করা মালাক্কার একজন পর্তুগিজ হয়েও এ-বিষয়ে আপনার ধারণাটা কী। দুদিন ধরে তো দেখছি আপনাকে, আপনি অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ। না হলে রাজকীয় নৌবহরের অমন চাকরি ছেড়ে দিয়ে কিসের প্রলোভনে পথে বেরোলেন?
একটু হকচকিয়ে গেলেন নাহিয়ান। বললেন, মহাশয়, বোধকরি আমাকে ভুল ঠাহর করেছেন। কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আমি বাড়ি ছাড়িনি। নৌবহরের বাঁধাধরা জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। তা ছাড়া আমার ধমনিতে তো পরিব্রাজকের রক্ত বইছে, না-কি?
তা বইতে পারে বইকি। সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো, পথে বেড়িয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত। ওই সিদ্ধান্তের মধ্যেই রয়েছে সেই নির্ণয় যা আপনার পরিচয় বহন করছে।
অন্তরের শক্তিকে যেন একবার পরখ করে নিলেন – এমন ভঙ্গিতে শ্বাস টানলেন ইবনে আসাদ। থিতু হয়ে বলতে লাগলেন, জানেন, ফ্রান্সিস নাহিয়ান, এই পথ আর পথের দিশা খুঁজতেই একদিন কী মনে হলো, বেরিয়ে পড়লাম। সওদাগরিতে দাদু যে-সম্পদ গড়েছিলেন, পর্তুগিজদের লুটপাটের পরও অবশিষ্ট কিছু ছিল। বাবা তা ভোগ করতে পারেননি। তিনিও চলে গেলেন। সবকিছু ভাইদের বুঝিয়ে দিয়ে একদিন এমনি এক জ্যোৎস্নাভরা রাতে নেমে পড়েছিলাম আমি।
এরপর শুধু চলছি আর চলছি। চলতে চলতে দেখলাম দুনিয়া জুড়ে প্রকৃতি তো দীর্ঘ পথ রচনা করে রেখেছে। ওই নদী, এই সাগর, এক জনপদ থেকে আরেক জনপদ, পথের পরে ছড়ানো পথ!
বলতে বলতে নীরব হয়ে গেলেন আবু আল আসাদ। কাঠের প্রকান্ড একটা সিন্দুকের ওপর গিয়ে বসলেন তিনি। বুকের ওপর হাত রেখে বললেন, আমি সন্ত নই মহাশয়, তবু বলব, এ-পথেরও হয়তো শেষ আছে। কিন্তু আরো একটা পথ আছে – লোভ, হিংসা, কাম, ক্রোধ দিয়ে গড়া মনের এ-জন্তুটার মৃত্যু ঘটাতে না পারলে গভীর নির্জন সে-পথের সন্ধান মেলে না। সে-পথের শেষ যে কোথায় কে জানে! তাইতো শুধু চলা আর চলা। এই চলাতেই যতো আনন্দ।
মোহাম্মদি এ-মানুষটির বলা আর ফুরোয় না। এভাবে অনেক রাত পর্যন্ত কথা চলল। নাহিয়ানের মনে হলো পুরো পরিবেশটা যেন গাঢ় হয়ে উঠেছে আর তার চেতনা থেকে অনেক অস্পষ্টতা কেটে গিয়ে উদ্যত সত্যের মতো জেগে আছে অসীম এই সমুদ্রের ওপরে মধ্যরাতের ওই উজ্জ্বল চাঁদ।
কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি, গায়ের জোববার ওপর চাপানো ভারী কাপড় সরিয়ে দীর্ঘ দুহাত মেলে নাহিয়ানকে বুকের দিকে আহবান করলেন, আপনার দিক থেকে যদি কোনো আপত্তি না থাকে তবে আসুন না, আমরা বন্ধুত্ব বরণ করি।
একজন পর্তুগিজ খ্রিষ্টান হয়ে কোনো মরক্কানের কাছে এতটা আশা করেননি নাহিয়ান – কী যে বলেন, আপত্তি থাকবে কেন, এ আমার পরম ভাগ্য। বলে, উনিও দুহাত তুলে এগিয়ে গেলেন।
একনাগাড়ে প্রায় আটদিন চালিয়ে নিরাপদেই সেন্ট অগাস্টিনকে উপকূলের কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারলেন ওলন্দাজ কাপ্তান দে রইটার।
এখান থেকে হুগলি নদীর মোহনা এখনো প্রায় আট-দশ নট দূর। কাপ্তানের দুরবিনটি চোখে লাগিয়ে নাহিয়ানকে বোঝাচ্ছিলেন আবু আল আসাদ – কেবল আরব সাগরেই পর্তুগিজ জাহাজগুলো পাল তুলে বুক উঁচিয়ে যাতায়াত করছে তা নয়। এই বঙ্গোপসাগরের যে-পারের মৌসুমি উপকূল ধরে এখন আমরা চলছি তার ঠিক উল্টোদিকে অর্থাৎ বর্মার উপকূল আর মালয় উপসাগরের যে-পথে কাপ্তান রইটার জাহাজ চালিয়ে এসেছেন এর সমগ্রটা জুড়েই ধীরে ধীরে গজিয়ে উঠছে পর্তুগিজ বণিকদের আধিপত্য। আকাশছোঁয়া স্বপ্ন ওদের আর বুকে অদম্য বল। খুব বেশিদিন বাকি নেই বন্ধু, এই গোটা সমুদ্র-এলাকার অধিপতি হবে তারা। শুধু ওরাই নয়, শুনছি ফরাসি আর ইংরেজদের জাহাজও দেখা যাচ্ছে ইদানীং।
দুরবিন চোখে রেখেই বাঁ থেকে ডানে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘুরলেন আবু আসাদ, এই পর্তুগিজ বণিকরা বর্মার মগদের মদদ দিচ্ছে। তাদের সব অপকর্মের দালাল তো বানাচ্ছেই, দস্যুতায়ও পারদর্শী করে তুলছে মগদের। এদের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে থেকে মগরা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে ঢুকে পড়ছে উপকূলের ভেতরে। হঠাৎ আক্রমণ চালিয়ে নিরীহ গৃহস্থালির 888sport promo code-পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ যাদের পাচ্ছে ধরে নিচ্ছে আর নির্মমভাবে খাঁচায় পোড়া হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগলের মতো বেঁধে-ছেঁদে নিয়ে তুলে দিচ্ছে পর্তুগিজদের হাতে। দাস ব্যবসা তো এখন ধীরে ধীরে জমে উঠছে এই মৌসুমি উপকূলে। আর যত দোষ সব গিয়ে পড়ছে ওই মগদের ঘাড়ে।
এটা ঘোর অন্যায় আর চরম উন্মাদের কাজ হবে বন্ধু, যদি সাদারা এখন যেমন করে ওই উপকূলীয়দের কিছু লোককে ধরে নিয়ে দাস বানাচ্ছে তেমনি করে কখনো যদি মাটিলগ্ন ওই অঞ্চলের তাবৎ অধিবাসীর ওপর প্রভুত্ব ফলায়। আর তাদের নিজস্বতা ধ্বংস করে দিতে চায়। যেমনটি ইতোমধ্যে তারা কোথাও কোথাও করে ফেলেছে।
তেমন স্বপ্নই তো এতদিনে দেখতে শুরু করেছে ওরা। গম্ভীর গলায় বললেন নাহিয়ান। বললেন, ঠিকই বলেছেন আপনি, খুবই ভুল হবে বন্ধু যদি উপকূলীয় কিছু মানুষের মতো ওই জনপদের তাবৎ মানুষের ওপর অমন বর্বরত তারা চালিয়ে যায়। নিজেদের পরিচয় বহনকারী হাজার বছরের বৈশিষ্ট্য মুছে ফেলতে চায়। মুছে ফেলতে চায় সেসব পরিচয়, যা ওদের বিশ্বাসে সত্যের শিকড়ের মতো প্রতিষ্ঠিত। এটাও ভেবে পাই না, খুবই আশ্চর্যের বিষয়, কোনো প্রতিরোধের মানসিকতাও কি জন্মেনি ওই ভূমিলগ্নদের?
আপনি জানেন না বন্ধু, ওরা যেমন সরল, তেমনি প্রকৃতিপরায়ণ। হাজার বছর ধরে তো ওরা ওদেরই জীবন-যাপন করছে। তাই বলে তাদের নিজস্ব সম্পর্কের সুতো ছিন্নভিন্ন করে ধরে ধরে নিয়ে পশুর কাজে লাগাতে হবে? যিশুর ছায়ায় যেতে বাধ্য করতে হবে? কী দোষ ওদের বলুন?
কিন্তু জগৎ যে অতটা সোজা নয়, ন্যায়ের কথা আওড়ালেই যে অন্যায় থেমে থাকে না, সে-কথা মোটেও অজানা নয় নাহিয়ানের। এটি স্বীকার করতেও আজ দ্বিধা নেই তার, অভিযাত্রী আর জলদস্যুরা, ব্যবসায়ী আর জাহাজমালিকরা, মসলা অনুসন্ধানকারীরা, বণিকরাই সভ্যতার ছদ্মবেশে লোভ ও শক্তির প্রদর্শন তো করছেই! হত্যা, লুণ্ঠন, নিপীড়ন, নির্যাতনের মতো নির্মম কর্মের মূল হোতাও তারাই। তথাকথিত সভ্যতার মুখোশ পরে নিজস্ব অভ্যন্তরীণ কারণে বিশ্বব্যাপী এক অশুভ অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার বিস্তার ঘটাতে যাচ্ছে এরা।
দুরবিনে চোখ চেপে খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা দেখছিলেন আবু আসাদ। চোখ থেকে যন্ত্রটা নামিয়ে নিয়ে ঘুরে নাহিয়ানের মুখোমুখি দাঁড়ালেন তিনি। বললেন, প্রতিরোধের কথা কী যেন বলছিলেন? ভাটি-বঙ্গালের ভুঁইয়াদের কীর্তির কথা কিছু শোনেননি? তাদের নেতা ঈশা খাঁর কথা? সম্রাট আকবরের বাহিনীও কিছু করতে পারেনি ওদের। শুধু গল্প রচনা হয়েছে। ঈশার অবর্তমানে তার পুত্র মুসাই তো এখন ভুঁইয়াদের নেতা। বাবার মতো তিনিও অবাধ বাণিজ্যের পথ মুক্ত করে দিয়েছেন। তাই বলে ব্যবসা করতে এসে সাদারা যা খুশি করবে তা কী করে হয় বলুন?
বন্ধুর কাছ থেকে নিয়ে নাহিয়ানও চোখ লাগালেন দুরবিনে। তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগলেন গভীর অরণ্যপূর্ণ পলিমাটির ওইসব উপকূলের নিরীহ ক্ষেত্রকর, মৎস্যজীবী মানুষের বসত। তার জ্ঞাতিভাইয়েরা যাদের পারিবারিক বন্ধন ছিঁড়ে ছারখার করে দিচ্ছে।
কিন্তু দূরে, বহু দূরে অস্পষ্ট কালো রেখার মতো খন্ড খন্ড মেঘের ছায়া ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না তার।
ইতোমধ্যে ওলন্দাজ কাপ্তান দে রইটারের কিছুটা উদ্বেগ লক্ষ করলেন তারা। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একজন নাবিক হলেও এদিককার জল-হাওয়ার মতিগতির কোনো ধারণা তো নেই নাহিয়ানের। কিন্তু কাপ্তানের হাবভাবে একটা বিপদের গন্ধ পেলেন তিনি। আর সাগরের হাওয়াও একেবারে থম ধরে গেছে মুহূর্তে। মাল্লারা সব পাল গুটিয়ে মাস্ত্তলের সঙ্গে কষে বেঁধে নিয়েছে।
মেঘের আবরণ ভারি হয়ে এলে মুহূর্তের মধ্যে পড়ন্ত সূর্যের শেষ আলোটুকুও হারিয়ে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারদিক। ওই অন্ধকার ভেদ করে দমকে দমকে অস্বাভাবিক হাওয়া বইতে লাগল। সে-হাওয়ায় ঢেউগুলোও কেমন ফুলে ফুলে উঠছে। হন্তদন্ত হয়ে দে রইটার বারকয়েক জাহাজের ওপরে-নিচে ওঠানামা করলেন। চিৎকার করে নানারকম হুকুম দিলেন খালাসিদের।
দুদন্ডও গেল না। জল আর বায়ুমন্ডলের মধ্যে রক্তারক্তিটা বোধ-বুদ্ধির সীমা ছাড়িয়ে যেতে থাকল।
দুহাতে নয়, যেন সারা শরীর দিয়ে জাহাজের হুইল শক্ত করে চেপে ধরে উথলে ওঠা ওইসব উন্মত্ত তরঙ্গমালার অবয়ব কিছুক্ষণ অনুমান করার চেষ্টা করছিলেন কাপ্তান। কিন্তু একটু আগে অন্ধকার ঘনিয়ে এলে বাঁদিকের একটা আংটার সঙ্গে টানিয়ে দেওয়া কাচের বাতিটার আলোয় সাগরের জল ছেঁচে বড় হওয়া কাপ্তানের শক্ত গম্ভীর মুখখানা যেরকম পাংশু দেখাচ্ছে তাতে ওর দিকে তাকিয়ে আর কোনো ভরসা পেলেন না কেউ। তারা কী এক ভয়ংকর বিপদের মধ্যে পড়েছেন সেটা বুঝতেও আর বাকি নেই।
গজরে-গজরে মুখে ফেনা তুলে ভেঙেচুড়ে চুরমার করে দেবে এমনি ভঙ্গি নিয়ে তেড়ে ফুঁড়ে আসা বদ্ধউন্মাদ ঝড় প্রতি মুহূর্তে একবার জাহাজটার সামনের দিক তো পরেরবার পেছনদিকে জলের ওপর অনবরত আছড়াচ্ছে।
ঠকঠক করে কাঁপছিলেন আবু আসাদ। তাকে কোনোমতে নিচে পাঠিয়ে জনাতিনেক মাল্লাসহ কাপ্তানের কাছে রইলেন নাহিয়ান। বললেন, ঈশ্বরের নামে প্রাণে বল রাখেন রইটার, যে করেই হোক জাহাজটাকে ঢেউয়ের দিকে রাখতে হবে।
চড়াৎ চড়াৎ বাজ পড়ছে কানে তালা লাগিয়ে। বাতাসের সঙ্গে প্রবল বৃষ্টির ঝাপটা। শরীরটাকে সোজা রাখা ক্রমান্বয়ে অসাধ্য হয়ে উঠল ওদের। এর চেয়েও যেটি মস্ত দুশ্চিন্তার কারণ, তা হলো জাহাজের খোলে যে-পরিমাণ জল ঢুকছে ঝিনুকগুলো ভরে গিয়ে এমন ওজন হবে ডুবিয়ে মারতে সময় নেবে না। এক হতে পারে বস্তা ধরে ধরে ওগুলোকে সাগরে ফেলে দেওয়া; কিন্তু এ-অবস্থায় জাহাজের তলা থেকে তুলে এনে তা করা অসম্ভব।
দে রইটার হুকুম করলেন ওই বিকট আছড়ানি-দুলুনির মধ্যেও যেমন করেই হোক খোল থেকে জল সেচার কাজ যেন বন্ধ না হয়। হুকুম তামিল করতে ডেকের ওপর হামাগুড়ি দিয়ে ছুটলেন একজন। ও যেতে পারল কি পারেনি, নাকি উড়ে গিয়ে ঝুপ করে বিক্ষুব্ধ সাগরের জলে মিলিয়ে গেল ঘোর অন্ধকারে তার হদিস মিলল না।
এখন আর দিকচিহ্নের হিসাব নেই। কোথায় কম্পাস আর কোথায় তার কাঁটা! কোনোমতে জাহাজটাকে পাহাড়সমান একেকটা ঢেউয়ের মত্ততার মধ্যে ভাসিয়ে রাখতে পারলেই যেন হয়। কিন্তু এ-অবস্থায় উথাল-পাতাল জলধির ওপর কচুরিপানার মতো দুল্যমান ভারী কাঠের অর্ণবপোতটিকে ভাসিয়ে রাখা যে, মানুষের সাধ্যে অকল্পনীয়, সেটুকু চিন্তা করারও অবসর থাকল না।
গাঢ় অন্ধকারে প্রলয়-নাচন দেওয়া গভীর জলরাশি থেকে জাহাজসুদ্ধ সবাইকে এক নিমেশে উড়িয়ে নিয়ে দুমরে-মুচড়ে দলা পাকিয়ে ডাঙায় পুঁতে ফেলবে ঘূর্ণিমাড়া ঝড়ের এমনই প্রবল প্রতাপ। তার সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি, সোঁ-সোঁ আওয়াজ আর তান্ডবতোলা বিক্ষুব্ধ প্রকান্ড একেকটা ঢেউয়ের মুহুর্মুহু আঘাত। ওরই মধ্যে জাহাজের নিচ থেকে আর সবার বুকফাটা আর্তনাদের একটু-আধটু কানে এলো। এরপর প্রহর ধরে কোথা থেকে কেমন করে কী হলো সে-কথা 888sport sign up bonusতে আটকে থাকার মতো জ্ঞান কারো ছিল বলে মনে হয় না।
দৈববলে প্রলয়ঙ্করী নাচন নেচে প্রকৃতি যখন স্থির হলো কাপ্তান দে রইটারসহ সকলেই আবিষ্কার করল যে, তারা বেঁচে আছে। কিন্তু একজনও নেই যিনি অক্ষত। আর ভাটায় জল নেমে গেছে বলে তাদের ঠুঁটো সেন্ট অগাস্টিনের পেট দিকচিহ্নহীন ডুবোচরে আটকা। তার একটা মাস্ত্তল ভেঙে দড়ির সঙ্গে লটকানো। পতাকাটা ছিঁড়ে-ছুড়ে ন্যাতা হয়ে ঝুলছে। ডেকের ওপরটায় রেলিংগুলো টুকরো টুকরো আর যে ভারী সিন্দুকগুলো ছিল তার একটাও নেই।
বিধ্বস্ত সেন্ট অগাস্টিন হুগলির বন্দরে ভিড়লে ডাঙায় আটকেপড়া মাছেদের জলের স্বাদ পেয়ে যা হয়, ঘাটে পা রেখে তাদেরও তাই। বন্দর জুড়ে তান্ডবের চিহ্ন ফেলে গেছে ঝড়। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বড় বড় গাছ। যারা দাঁড়িয়ে আছে কারো ডানা ভাঙা, কারো ডালে পাতা নেই। কত ঘরের খুঁটি ভেঙে হেলে আছে চাল। কতটায় আবার চালহারা খুঁটিগুলোর আকাশের দিকে মুখ। তবু প্রাণে শান্তি এলো। বেঁচে যে আছে তা প্রমাণ হলো।
দুদিন পরের ভোরে চবিবশ দিনের বন্ধন ছিন্ন করে আবু আল আসাদ সুমানতোলাগামী এক জাহাজের পাটাতনে দাঁড়িয়ে পাগড়ির খুঁটে চোখ চাপলেন। নাহিয়ানের ফোলা ফোলা বিনিদ্র চোখেও নোনা জল।
হুড়মুড়িয়ে সিঁড়ি তুলে, দড়া খুলে, পালের বাঁধন আলগা করে দিয়েছে মাল্লারা। জাহাজের দুই পাঁজরে ভারী কাঠের তৈরি দাঁড়গুলো কাতকুত শব্দে পাখনা মেলার মতো সোজা করেছে দাঁড়ির দল।
মরক্কোয় আপনি আমার মেহমান হবেন, চিৎকার করে হাত নাড়তে নাড়তে বলেন আবু আসাদ।
নাহিয়ানও হাত নাড়েন আর বলেন, শুধু আপনার জন্যে মরক্কোয় আমি যাবই।
জাহাজের পাঁজরে দাঁড়ের ঝুপঝুপ শব্দে আবু আসাদ তা শুনতে পেলেন কিনা কে জানে! এই অচিন নগরের নৌঘাটে ভোরের নরম বাতাসে আদিগন্তবিস্তৃত জলরাশির দিকে তাকিয়ে বড় একলা লাগে আজ নাহিয়ানের।
শোনা গেছে, মোগল সম্রাটের সৈন্যরা রাজমহল থেকে ধেয়ে যাচ্ছে ভাটি-বাঙ্গালার দিকে। ঘোর যুদ্ধ আসন্ন। কোনো যুদ্ধের মুখে পড়তে চাননি আবু আল আসাদ, তাই তিনি চলে গেলেন।
কিন্তু মনস্থির করেছেন নাহিয়ান, যুদ্ধ বাঁধে যদি বাঁধুক, সুবর্ণগ্রামে গিয়ে কটা দিন না কাটিয়ে ফিরবেন না।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.