ভূমিকা ও 888sport app download apk latest version : আন্দালিব রাশদী
একটি ভূমিকা
বিশ শতকের সর্বাধিক পঠিত কবি চিলির পাবলো নেরুদা (জন্ম ১২ জুলাই ১৯০৪-মৃত্যু ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩)। 888sport appsের স্বাধীনতার বছর ১৯৭১ সালে তিনি 888sport live footballে নোবেল 888sport app download bd পান।
মাতিলদে উরুটিয়া (জন্ম ৩০ এপ্রিল ১৯১২-মৃত্যু ৫ জানুয়ারি ১৯৮৫) পাবলো নেরুদার তৃতীয় স্ত্রী। দাপ্তরিকভাবে তাঁদের দাম্পত্যকাল ১৯৬৬ থেকে নেরুদার মৃত্যু পর্যন্ত। কিন্তু তাঁদের প্রথম দেখা এবং প্রণয়ের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ।
১৯৪৬-এর এক আলসে অপরাহেণ পাবলো নেরুদা ও মাতিলদে উরুটিয়ার সাক্ষাৎ হয় চিলির রাজধানী সান্টিয়াগোর একটি পার্কে, তখন একটি কনসার্ট চলছিল। ক-বছর পর ১৯৪৯-এ আবার দেখা মেক্সিকো সিটিতে। চিত্র888sport live chatী হোসে ক্লেমেমেত্ম ওরোজকোর শেষকৃত্যে যোগ দেওয়ার পর কবি যখন ফ্লেবাইটিসে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন, তাঁর সেবাশুশ্রূষা করতে এগিয়ে এলেন মাতিলদে। বিকশিত হলো একটি 888sport app download for androidীয় প্রেম।
চিলির ডানপন্থি সরকারের হাতে নিগৃহীত ও লাঞ্ছিত পাবলো নেরুদা তখন দেশান্তরে। সেবিকা-গায়িকা মাতিলদের সঙ্গে নেরুদার প্রেম হয়ে ওঠে সেকালের অন্যতম গোপন কাহিনি। নেরুদার মিউজ মাতিলদে।
ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে এবং মেক্সিকোয় চলতে থাকে তাঁদের গোপন অভিসার। ১৯৫১-তে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট পার্টির বার্লিন উৎসবে নেরুদা গান গাওয়ার জন্য মাতিলদেকে আমন্ত্রণ জানান।
চিলিতে তখন নেরুদার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা। নেরুদা মাতিলদেকে নিয়ে চলে এলেন ইতালির ক্যাপ্রিতে। চন্দ্রালোকে আমৃত্যু একসঙ্গে থাকার শপথ নিয়ে দুজন বিয়ে করেন। ওই বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন মাত্র দুজন – বর ও কনে। এটি কোনো আইনসিদ্ধ বিয়ে ছিল না। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী দেল ক্যারিল তখনো বেশ বহাল রয়েছেন। নেরুদার অগ্নিগর্ভ রাজনীতির তখনকার পার্টনার ও স্ত্রী দেলের বয়স যখন সত্তরের কোটায়, নেরুদা তখন পঞ্চাশের ঘরে। দুজনের ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটেছিল আগেই, কিন্তু দাপ্তরিকভাবে বিয়ে তো ছিল অটুট।
নেরুদার শ্রেষ্ঠ প্রেমের 888sport app download apkগুলো যে মাতিলদেকে নিয়েই, ধীরে ধীরে তা প্রকাশিত হতে শুরু করল। মাতিলদে বিয়ের জন্য নেরুদাকে চাপ দেননি কিংবা দেলকে তালাক দেওয়ার জন্যও নয়। তিনি বললেন, দেল থাকুক নেরুদার দাপ্তরিক জীবনে পাটরানি হয়ে, আমার সমস্যা নেই। তিনি জানেন, নেরুদার হূদয়ের সিংহাসনটি তাঁরই অধিকারে।
দেল ক্যারিল ১৯৫৭-তেই নেরুদার এই গোপন সম্পর্কটি আবিষ্কার করেন। কমিউনিস্ট পার্টি এ-সম্পর্কটি সুনজরে দেখেনি, এমনকি দেল ও নেরুদার পুরনো বন্ধুরাও এর বিরোধিতা করেছেন।
নেরুদার 888sport app download apkয় উঠে এলো 888sport app download for androidীয় পঙ্ক্তি :
সারারাত আমি তোমার সঙ্গে ঘুমাব এই দ্বীপে সমুদ্রের কাছে
আনন্দ ও ঘুমের মাঝখানে তুমি বুনো ও মিষ্টি
আগুন ও পানির মাঝখানে।
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ সালে জেনারেল অগাসেন্তা পিনোশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দের সরকারকে উৎখাত করলেন। প্রেসিডেন্টের প্রাসাদে আগুন জ্বলল, চলল অবিরাম গুলিবর্ষণ। নেরুদার প্রিয় বন্ধু প্রিয় প্রেসিডেন্ট আয়েন্দে নিহত হলেন। শুরু হলো নির্বিচারে গণহত্যা। আয়েন্দের মৃত্যুসংবাদ নির্বাক করে দিলো নেরুদাকে। তিনিও দ্রম্নত মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকলেন।
সেই জীবন্ত কাহিনি রচনা করেছেন মাতিলদে উরুটিয়া। তিনি নিজ হাতে নেরুদাকে সমাহিত করেছেন, তাঁর কবরে ইট বিছিয়েছেন, সয়েছেন 888sport app download for androidকালের ভয়াবহতম একটি যন্ত্রণা।
মৃত্যুর আগে তিনি রচনা করেছেন মাই লাইফ উইথ পাবলো নেরুদা। দুর্ভাগ্য, বইটি প্রকাশের আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। স্প্যানিশ ভাষায় লিখিত বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯৮৬ সালে। আলেকজান্দ্রিয়া জিয়ারদিনোর হাতে ইংরেজি 888sport app download apk latest version প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালে। তিন পর্বে বিভক্ত বইটির গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পর্ব (সেপ্টেম্বর ১১-২৫, ১৯৭৩ : অভ্যুত্থান) অনূদিত হলো।
এক
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩। শান্তিপূর্ণভাবেই দিনের শুরু। জানালা খুলতেই উজ্জ্বল আলোর স্রোতধারা আমার মুখম-ল উদ্ভাসিত করল। আমাদের বাড়ির সামনে পাথুরে তীরে সমুদ্র সাধারণত অতিকায় এক একটা ঢেউ ছুড়ে দেয়। কিন্তু এই সকালবেলায় বিশেষ এক ধরনের অপাপবিদ্ধতা নিয়ে সমুদ্র শান্তভাবে দোল খেয়েছে। আকাশও শান্ত ছিল। কেবল আমাদের বাগানের ফুলের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে হালকা বাতাস। আমি আনন্দিত বোধ করছিলাম। সূর্যালোকের কারণে আমি নিশ্চয়ই তখন হাসছিলাম।
সকালের কোনো কিছুই আগামীর ধ্বংসযজ্ঞের কোনো আগাম বার্তা দেয়নি। অলক্ষুনে এমন কিছু আমাদের সতর্ক করেনি যে, আমাদের গোটা জীবনব্যবস্থাই শেষ হয়ে আসছে – বলেনি যে আমরা তখন সেই মুহূর্তে গভীর অন্ধকার সাগরের প্রান্তদেশে ঝুলে আছি।
আমরা বেশ উত্তেজনা নিয়ে ১১ সেপ্টেম্বরের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমরা অনেক দিন ধরে যেসব প্রকল্প নিয়ে কাজ করছি, এসবের সমাপনী উদযাপন করব এই দিন। আমরা আমাদের আইনজীবী ও বন্ধু সার্জিও ইনসুনজার আসার অপেক্ষায় আছি; সার্জিও তখন প্রেসিডেন্ট সালভাদর আয়েন্দের বিচার বিভাগের মন্ত্রী। তিনি সঙ্গে নিয়ে আসবেন পাবলো নেরুদা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র, সঙ্গে পাবলোর দলিল আর পুমন্তা দেত্রালকাতে ফাউন্ডেশনের সদর দপ্তরের ভিত্তি স্থাপনের নীলনকশা। সবকিছুই স্বাক্ষরের জন্য প্রস্ত্তত। আরো একজন বন্ধু ফার্নান্দো আলেগরিয়াও আসবে আমাদের ইসস্না নেগ্রার বাড়িতে। ফার্নান্দো একজন খাদ্যরসিক আর তিনি আমাকে মনে করেন চমৎকার একজন পাচক। দারুণ একটা লাঞ্চ উপহার দেওয়ার জন্য আমিও যথেষ্ট পরিশ্রম করেছি। আমরা হোসে মিগুয়েল বারাসকেও আশা করছি, পাবলো যা পেতে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তিনি তাই নিয়ে আসবেন : সদ্য প্রকাশিত একটি বই। প্রকাশক কুইমান্তত্ম সেদিনই পাবলোর বই Chanson de gaste-এর নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হবে। খুবই ব্যস্ত দিন। আমরা আমাদের বহু ঘণ্টার শ্রমের ফল উদযাপন করব। আমরা সবসময় যেমন করে থাকি, আনন্দে অন্য কোনো-না-কোনো দিনের মজার বিষয় নিয়ে গল্প জুড়ে দিই।
এখনো বেশ সকাল। খবর শোনার জন্য রেডিও চালু করি। সবকিছু বদলে গেছে।
ভয়ংকর এক আতঙ্কের সংবাদ, এর সবই ভীষণ অগোছালোভাবে পরিবেশন করা হচ্ছে। রাজধানীতে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে। হঠাৎ আয়েন্দের কণ্ঠস্বর!
বিস্মিত হয়ে পাবলো আমার দিকে তাকায় : আমরা একটি বিদায়ী ভাষণ শুনছি। এটাই আমাদের শেষবারের মতো আয়েন্দের কণ্ঠস্বর শোনা।
গভীর হতাশা নিয়ে পাবলো আমাকে বলে, ‘সব শেষ হয়ে গেছে।’
আমি দ্বিমত পোষণ করি, ‘এটা সত্য নয়।’
আমি বলি, ‘এটা সামরিক বাহিনীর আর একটা হুমকি মাত্র। জনগণ এসব মেনে নেবে না।’
আজ যখন আমি এ-888sport sign up bonusকথা লিখছি, সেই মুহূর্তগুলোর ছবি পুরোপুরি সঠিকভাবে আবার কল্পনায় নিয়ে আসা আমার জন্য একটা কঠিন কাজ হয়ে উঠবে। সে-সময় যা ঘটেছে, প্রায় সবকিছুরই আমি মোকাবেলা করতে পারিনি। আমার মতো একজন আশাবাদী মানুষ এতকিছু মেনে নেবে কেমন করে?
আমি যা কিছু দেখছি ও শুনছি, সবই আমার গভীর ভরসা ও আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। একটার পর একটা ঘটনা যেভাবে ঘটে যাচ্ছে, আর আমি তার সঙ্গে পেরে ওঠার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আর পাবলোকে আশাবাদী করে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি।
হঠাৎ আমি পাবলোর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিই। তার আচরণের কিছু একটা আমাকে আঘাত করেছে। আমি পাবলোকে যেরকম লড়াকু দেখতে অভ্যস্ত এখন সে অন্যরকম আচরণ করছে। আমি তার মধ্যে অবচেতন হতাশা দেখতে পাই, তার চোখ জ্বলজ্বল করছে।
নাশতা খাবে কিনা জিজ্ঞেস করি। কিন্তু তার মনোযোগ সরিয়ে আনা কঠিন কাজ। ঘোরের মধ্যে সে রেডিওর এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে যাচ্ছে, একবার শুনছে সান্টিয়াগো রেডিওর সংবাদ, তারপরই চলে যাচ্ছে বিদেশি কোনো স্টেশনে। রাজধানীর বাইরে মেন্দোজা রেডিও থেকে আমরা পরে শুনলাম আয়েন্দে নিহত। বিদেশি সংবাদমাধ্যমে থেকে জানতে পারি আয়েন্দে লা মনেদা প্রাসাদে নিহত হয়েছেন। প্রাসাদে এখন আগুন জ্বলছে। জনগণের প্রেসিডেন্ট যে মৃত, তা জনগণকে জানাতে সান্টিয়াগোতে তারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করবে।
আমরা নিঃসঙ্গ গভীর যন্ত্রণায় ডুবে আছি। আমরা সংবাদ শুনতে থাকি। বলা হয়েছে, কেউ রাস্তায় নামতে পারবে না। কেউ তা অমান্য করলে তাকে হত্যা করা হবে। এটাই প্রথম মিলিটারি ডিক্রি।
আসলে চিলি নামের গোটা দেশটাই এখন গৃহবন্দি। আমার কী যে এক পাগলাটে প্রত্যাশা, যেন আমি এখনই শুনব সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বরাবরের মতো ভুল আমারই, এবারো ভুল করেছি। আর বরাবরের মতো পাবলোর যে সজ্ঞাত ভবিষ্যদ্বাণী, তা আমি সবসময়ই সত্যি হতে দেখেছি।
পাবলো বলেছে, সব শেষ হয়ে গেছে।
সব মানুষের আনন্দ, সাম্য ও সুবিচারের যে জীবনের প্রত্যাশা সবার তা বাষ্পীভূত হয়ে গেছে।
পাবলোর জীবনের শ্রেষ্ঠতম প্রত্যাশাগুলো – যার জন্য নিরন্তর কাজ করে গেছে, সব হঠাৎ ধূলিসাৎ হয়ে যাচ্ছে – যেন এই প্রত্যাশাগুলো কিছুই ছিল না, পোড়া দেশলাইয়ের কাঠিতে অবসর সময়ে জোড়া দিয়ে তৈরি করা ছোট্ট একটি দুর্গের চেয়ে বেশি কিছু নয়।
সারাদিন আমরা জার্মানি, স্পেন আর ফ্রান্স থেকে ফোন পেয়েছি। যারা ফোন করেছেন, সবাই জানতে চান পাবলো কেমন আছে?
বিদেশি একটি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, পাবলো অভ্যুত্থানে নিহত। আমি বন্ধুদের আশ্বস্ত করি, খবরটা সঠিক নয়; পাবলো বেঁচে আছে। কিন্তু কি ভুল কথা আমি বলেছি! পাবলো তো আসলেই মৃত। সে তো ভেতরে ভেঙে পড়েছে। সংগ্রামের যে অদম্য সাহস এতদিন তাকে টিকিয়ে রেখেছে, এখন তা আর নেই। সে সারাজীবন স্বপ্ন দেখেছে, আর লড়াই করেছে দারিদ্র্য নির্মূল করবে। সে প্রত্যাশা করেছে তার লোকজন সাম্যের কিছু স্বাদ পাবে। এই মহান কাজের জন্য পাবলো তার কলম ও নিজের জীবনকে নিয়োগ করেছে। বহুবার সে জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে। প্রেসিডেন্ট গঞ্জালেস ডিভেলা, যাকে আমরা স্বৈরাচারী শাসক মনে করি, পাবলো তার হাতে বহুবার নির্যাতিত হয়েছে। স্বৈরাচারী শাসন কেমন – আমার ধারণাই ছিল না।
সাম্প্রতিক যে-নির্বাচন আয়েন্দেকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়েছে এবং নির্বাচনের সময় আমরা সব দেশ ঘুরেছি, কখনো অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমাদের সফর করতে হয়েছে। চিলিতে এমন কোনো শহর নেই, তা যত দূরেই হোক, যা পাবলোর কণ্ঠস্বর শোনেনি। আমি সবসময়ই তাঁকে দেখেছি প্রাণবন্ত ও উদ্যোগী; দুঃখী মানুষের সঙ্গে কথোপকথনরত, ঘুমন্ত ও অদৃষ্টবাদী দরিদ্রদের জাগাচ্ছে; নিঃস্ব অদৃষ্টবাদীরা যে-অবস্থায় আছে, তাতেই যে তাদের সন্তুষ্টি – পাবলো তাদের জাগিয়ে চলেছে। চিলির দক্ষিণে আমরা ছোট ছোট হতাশ শহরে গিয়েছি। পাতাগনিয়া দ্বীপপুঞ্জে আমরা ভিজে শীতার্ত অবস্থায় হাজির হই। শীতে বৃষ্টিভেজা দক্ষিণে দারিদ্রে্যর অনেক যন্ত্রণা। তাদের না আছে কোট, না আছে পর্যাপ্ত খাবার। শুধু কিছুসংখ্যক মানুষ টিকে থাকতে পারে। প্রত্যেকেই নিজের জন্য বেঁচে আছে। এটা অন্যদের মানসও এভাবে গড়ে দিয়েছে। সম্ভবত শীতল আবহাওয়া তাদের শীতল-হূদয় মানুষে পরিণত করেছে। পাবলো তাদের ওভাবে দেখতে চায় না। তারা যেন নিজেদের জীবন থেকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে – নির্মম নিয়তির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়ার তাড়না জাগাতে পাবলো সেখানে হাজির।
আমরা উত্তরে যাই, সেখানকার দারিদ্রে্যর ধরন ভিন্ন। উত্তর চিলির মানুষের মুখাবয়ব বাদামি। কঠোর কষ্টের জীবনে তারা অভ্যস্ত। তাদের অভিব্যক্তি স্পষ্ট। তারা বহির্মুখী, দারিদ্রে্যর বিরুদ্ধে লড়তে তারা প্রস্ত্তত। দক্ষিণের চেয়ে বেশি প্রতিবাদী। এজন্য উত্তরের ধর্মঘট করা শ্রমিকের ওপর বারবার হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। উত্তরের মানুষের সঙ্গে পাবলোর যোগাযোগ অনেক বেশি।
‘যেদিন তাদের যথেষ্ট পড়াশোনা শেখা হবে, ১২ বছরের শিশু শ্রমিকের কাজে যোগ দেবে না। দেশ অনেক এগিয়ে যাবে। আমাদের বহুমূল্য অন্তর্নিহিত শক্তি রয়েছে। এসব কথা বলার সময় তার চোখে আলো ঠিকরে উঠত। তুমি দেখবে মানুষ যখন তার অধিকারের কথা জানবে, আমরা কত এগিয়ে যাব।’
‘এখন তাদের শতাব্দী-দীর্ঘ ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলতে হবে।’
এসব 888sport sign up bonus আমার এখনকার মনোযাতনাকে আরো ক্ষুরধার করে তোলে। আমি বুঝতে পারি, অত্যন্ত শক্তিশালী এক অসহায়ত্ব পাবলোকে অধিকার করে বসেছে। যেন হঠাৎ সে বুঝতে পেরেছে এ-পর্যন্ত যা কিছু সে করছে, সবই অর্থহীন। আরো বড় কোনো ক্ষমতা নিজেকে প্রতিরক্ষা করে চলেছে। এর বিপরীতে আমরা তুচ্ছ, প্রতিরোধহীন। আমরা নিঃসঙ্গ পৃথিবীর তাবৎ তিক্ততা অনুভব করছি। আয়েন্দেকে ঘাতকরা হত্যা করেছে। সংসদ ভবনে আগুন জ্বলছে। খুব শিগগিরই আমরা টেলিভিশনে এই অগ্নিশিখার ধোঁয়া এবং রাজধানীজুড়ে যে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে, তা দেখতে পাই। আমরা নিজেদের জিজ্ঞেস করি, এসব করার ক্ষমতা যাদের, সেই চিলিয়ানরা এতদিন কোথায় ছিল? তারা যে অস্তিত্ববান ছিল, আমরা তা জানতামই না। এটা কেমন কথা?
টেলিভিশনে আমরা দেখতে পাই টমাস মোরো প্রেসিডেনসিয়াল প্রাসাদে আক্রমণ চলছে। মানুষ সব তছনছ করে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের বাস্কেটের কাপড় উপচে পড়ছে, দু-একটা মাটিতে পড়ে রয়ে যাচ্ছে।
আমরা অবাক হয়ে ভাবি, এসব কেমন করে সম্ভব? টেলিভিশনে আমরা যা দেখিনি আর আমরা যা কল্পনাও করতে পারিনি, ঠিক সেই মুহূর্তে সান্টিয়াগোতে আমাদের বাড়িটাতেও লুটপাট আর ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হচ্ছে, আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিকেলের দিকে পাবলোর জ্বর আসে। টেলিফোনে কাউকে পেতে সমস্যা হচ্ছিল। অনেক চেষ্টার পর সান্টিয়াগোর একজন ডাক্তারকে ধরতে পারলাম। তিনি ইনজেকশন দেওয়ার কথা বললেন আর সহজ-সরলভাবেই আমাকে বললেন, সারাদিন চিলিতে যা ঘটেছে পাবলোকে তা না জানানোই ভালো। জানালে অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
আমি কেমন করে এসব জানা থেকে পাবলোকে প্রতিহত করব? আমাদের ঠিক সামনেই একটা টেলিভিশন। সংসদ ভবনে আগুনের ছবি আমাদের চোখের সামনে ভাসছে। আমরা ট্যাঙ্ক দেখেছি। আমরা দেখেছি পুলিশ শত শত মানুষকে গ্রেফতার করেছে, তারা নিচের দিকে মুখ করে রাস্তায় পড়ে আছে; সম্ভবত তারা ছিল পথিক।
আমরা দেখেছি জখম হওয়া মানুষে ভর্তি অ্যাম্বুলেন্স। কোনো সন্দেহ নেই, অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে আমাদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করা হচ্ছে। সামরিক নির্দেশ বলবৎ রয়েছে। কেউই রাস্তায় বেরোতে পারছে না। সমস্ত চিলি গৃহবন্দি হয়ে আছে।
সাহস করে কেউ বাইরে এলে গুলি করে শুইয়ে দেওয়া হচ্ছে।
আমি মরিয়া হয়ে উঠেছি। পাবলোর উত্তেজনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। সে খেতে চাচ্ছে না। তাকে সেই ইনজেকশনগুলো নিতে হবে।
পাশের শহর থেকে আমাকে একজন নার্স নিয়ে আসতে হবে। পুলিশ আমাকে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে – এ-ভরসা নিয়ে আমার বাড়ির সবচেয়ে কাছের থানায় যাই। থানাটি নিকটবর্তী কুইস্কোতে। যখন আমার কথা শুনছে, পুলিশ অফিসারদের মনে হলো শীর্ণ এবং বহুদূরবর্তী মানুষ। ঠিক সে সময় একটা জীবনের এমন কোনো মূল্য নেই। কারণ মিনিটে এমন শত শত লাশ পড়ছে।
আমাকে অবাক করে দিয়ে পুলিশ অফিসার বললেন, তাকে সঙ্গ দিয়ে নিয়ে যাওয়া পুলিশের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে নার্সের খোঁজে আমার যেতে কোনো বাধা নেই। তার মানে আমার জীবনটা নিজের হাতে নিয়ে আমাকে বেরোতে হবে।
সুতরাং জীবন হাতে নিয়েই আমি রাস্তায় নামি। এল তাবোতে নার্স রোসিতাকে পাই। আমাদের জন্য সে যেন একটি এঞ্জেল, পাবলোর সেবা করার জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোসিতা আমার সঙ্গে ইসস্না নেগ্রাতে চলে আসে।
১৪ সেপ্টেম্বর পাবলো ভালো বোধ করছে। আমাকে বলল কিছুক্ষণ সে বলবে, আমাকে লিখতে হবে। কলম আর কাগজ আনার জন্য ছুটি এবং তখনই ডিকটেশন নেওয়ার জন্য তাঁর পাশে বসে পড়ি। তাঁর 888sport sign up bonusকথার শেষ অধ্যায় সে বলতে শুরু করে। তার পাশে বসে কাজ করতে পারায় ১১ সেপ্টেম্বর থেকে যে ভয়ঙ্কর যাতনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম, তা থেকে কিছুটা পরিত্রাণ পাই।
চিৎকার শুনে আমাদের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। এরকম বিচ্ছিন্ন নির্জন জায়গায় এমন করে কে চিৎকার করবে?
আমার গাড়ির ড্রাইভার ছুটে আসে। সে সন্ত্রস্ত। বলছে, ‘ঘেরাও করেছে। তিনটি মিলিটারি গাড়ি আসছে।’
আমি খুব বিচলিত হয়ে পড়ি। ঘেরাও নিয়ে নয়, আমার হাতে যা আছে তা নিয়ে। আমি পাবলোর ডিকটেশন হাতে নিয়েছি। আমাদের বেডরুমে একটি বিশাল কাঠের বোল আছে। আমি এখানেই ম্যাগাজিনগুলো ছুড়ে ফেলি। আমি উন্মত্তের মতো গনগনে এই পাণ্ডুলিপি ম্যাগাজিনের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে অপ্রত্যাশিত দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে নিচে নেমে যাই। কুইস্কো থেকে আসা সেখানকার পুলিশপ্রধানকে আমি চিনতে পারি। তাকে বিচলিত ও লজ্জিত মনে হয়। আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, তারা কোন জায়গা থেকে তলস্নাশি শুরু করতে চাইছে।
‘আপনি যেখান থেকে বলেন।’
আমি তাদের সরাসরি বেডরুমে নিয়ে আসি।
পাবলো তখনো বিছানা থেকে ওঠেনি। রুমে ঢুকেই আমি প্রথম কাঠের বোলের দিকে তাকাই। এখানে যে পাণ্ডুলিপি আছে, তা তাদের পক্ষে সহজে বের করা সম্ভব হবে না। কিন্তু তারা যদি পুঙ্খানুপুঙ্খ তলস্নাশি শুরু করে! সৌভাগ্যবশত তারা তা করেনি। পাবলো বলল, ‘আপনাদের যা যা তলস্নাশি করা দরকার, অবশ্যই ভালো করে করবেন। আমার স্ত্রী আপনাদের সহযোগিতা করবে।’
আমরা বেডরুম ছেড়ে লাইব্রেরিতে আসি। সেখানে হাজারো বই, সংগ্রহে রাখার মতো হাজারো জিনিস আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অফিসাররা অনেক কৌতূহল নিয়ে তাকায়; কিন্তু কোনো কিছু স্পর্শ করার সাহস দেখায়নি। একজন অফিসার জুতোর গোড়ালি দিয়ে মেঝেতে আঘাত করে জানতে চায়, ‘এ বাড়িতে কোনো ভূ-গর্ভস্থ প্যাসেজ আছে কি?’
আমি তার প্রশ্নের জবাব দেওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই তরুণী হাউসকিপার ছুটে ভেতরে চলে আসে। তার চোখ-মুখে আতঙ্ক।
‘ম্যাডাম তাড়াতাড়ি আসুন, ড্রাইভারকে হাতকড়া পরিয়ে ফেলবে আর আমি যা জানি না এমন সব কথা আমাকে জিজ্ঞেস করছে।’
আমি আমার সঙ্গীদের অনুমতি চাই। কী ঘটেছে দেখার জন্য যাব। আমরা যখন উঠানের দিকে যাই, আমি বুঝতে পারি তাদের এই ঘেরাওটা কোনো হাস্যকর ব্যাপার নয়। সৈন্যরা আমাদের ঘিরে রেখেছে। তাদের না জানিয়ে এমনকি একটি মাছিও এই ঘেরের বাইরে যেতে পারবে না।
888sport app download apk ছাড়া তারা এ-বাড়িতে আর কি পাবে বলে তারা মনে করে? অবশ্য 888sport app download apkও একটি শক্তিশালী অস্ত্র। যদিও তারা এটা জানে বলে মনে হয় না। অসম্ভব যেসব ব্যাপার ঘটছে এর মধ্যে আমরা তেমন রহস্যের মোকাবেলা করছি।
ড্রাইভারের রুমে গিয়ে যে হাস্যকর পরিস্থিতি দেখলাম, অন্য কোনো সময় হলে আমাকে এ নিয়ে দীর্ঘক্ষণ হাসাহাসি করতে হতো। যখন অবরোধ শুরু হয়, পুলিশ আদেশ দেয় – যে যেখানে যে অবস্থায় আছে, সেখানেই থাকবে। কয়েক মিনিট পর ড্রাইভার যখন ভাবল কেউ তাকে দেখবে না, সে ছুটে তার রুমে চলে গেল।
অবিশ্বাস্য মনে হওয়ায় তাকেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাকে এখানে আসতে হলো কেন?’
খুব বিব্রত হয়ে সে জবাব দেয়, ‘সকালে আমি আমার আন্ডারওয়্যার আর মোজা ধুয়ে বাথরুমে শুকানোর জন্য টানিয়ে রেখেছিলাম। তারা যখন আমার রুম তলস্নাশি করতে ঢোকে, এগুলো আপনার চোখে পড়ুক – এটা আমি চাইনি।’
এরকম একটা হাস্যকর কারণে ড্রাইভার তার জীবনটা হারাতে পারে।
এ-ঘটনাটি ছাড়া তলস্নাশি তারা বেশ সম্মানের সঙ্গেই শেষ করল; সৈন্যরা 888sport app জায়গায় যা করে থাকে, লুট করে অকারণে নির্মমতা দেখায় অন্তত সে-তুলনায় তাদের আচরণ ভালো।
পাঞ্চো ভিলার দিনগুলোতে শোনা একটি মেক্সিকান আর্মি কমান্ড জোক আমার মনে পড়ে আর এ নিয়ে আমি বহুবার হেসেছি : ‘প্রস্ত্তত হও, গুলি চালাও, তাক করো।’
দুই
১৮ সেপ্টেম্বর চিলির স্বাধীনতা দিবস। দেশপ্রেমের আবেগে বন্ধুদের নিয়ে আমরা উদ্যাপন করি। দিনটি এগিয়ে আসছে। এ-বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর দিনটা হবে দুঃখের। আমাদের কিছুসংখ্যক বন্ধু তবু নেগ্রাতে এসে হাজির হয়। তারা সান্টিয়াগো থেকে আতঙ্কের সংবাদ নিয়ে এসেছে : আমাদের বন্ধুদের কেউ কেউ পালিয়ে আছে, অন্যরা জেলে, তারপরও যারা থাকত, তারা নিহত। যেন তার শরীরের মাংসে ডেগার ঢুকছে – এভাবে পাবলো খবরটা গ্রহণ করে।
১৮ তারিখের বিকেল বেলাটাতে তার জ্বরজ্বর ভাব – এ-অবস্থায় আমি কী করব জানার জন্য সারাদিনই ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। বেশ কয়েকটি ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর শেষ পর্যন্ত ডাক্তারকে ধরতে সমর্থ হই। তিনি তখন ছিলেন তার বাড়ি সান্টিয়াগোতে। তিনি আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করলেন পরদিনই তিনি নেগ্রাতে অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দেবেন, যাতে দু-ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পাবলোকে সান্টিয়াগো সামন্তা মারিয়া ক্লিনিকে পৌঁছানো যায়।
পরদিন আমি সবকিছু নিয়ে প্রস্ত্তত, অ্যাম্বুলেন্স আসার অপেক্ষায় আছি। পাবলো বিষণ্ণ, তার অবয়বে সুদূরের এক অভিব্যক্তি, যা আজো আমি ব্যাখ্যা করতে অক্ষম। আমাদের আদরের মেয়ে কুকুরটি – গাভর্তি লোম, ছোট বাঁকা লেজ, নাম পান্ডা – পাবলোর পাশ থেকে সরে যেতে অস্বীকার করে। আগের রাতে আমাদের বেডরুম থেকেও বেরোতে চায়নি। আমার মনে হয় গতকালই প্রথম গোঁয়ার্তুমি করে একটি আদেশ অমান্য করেছে। লেজ নেড়ে পাবলোর পাশে বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ে মাথাটা সামনের দুই থাবার মাঝখানে রেখে যেন অনুনয় করছে – তোমাদের সঙ্গে আমাকে ঘুমোতে দাও। এই অঙ্গভঙ্গিতে ধন্যবাদ জানানো ও প্রার্থনা করার মাঝামাঝি কোনো এক অবস্থান পান্ডা দখল করে আছে।
অ্যাম্বুলেন্স যে আসছে সে-শব্দ সবার আগে শুনেছে পান্ডা, তারপর নিজেই ঘ্যানঘ্যান করতে শুরু করে। কী হয়েছে দেখার জন্য আমি দরজার বাইরে মাথা বের করি এবং এত সকালে সত্যিই অ্যাম্বুলেন্স এসেছে দেখে অবাক হই। যেহেতু আমাদের সবই আগে থেকে প্রস্ত্তত, আমরা দ্রম্নত তাকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে নিলাম।
আমরা যখন বাড়ি থেকে বেরোচ্ছি, আমি বুঝতে পারি অ্যাম্বুলেন্সের কোনো এক কোণে পান্ডা গুটিসুটি মেরে লুকিয়ে আছে। পাবলোকে তার খুব পছন্দ, পাবলোকে ছেড়ে যেতে চায় না। পাবলো ও আমি প্রায়ই বেড়াতে বেরোই; না ডাকলে সে কখনো লাফিয়ে গাড়িতে উঠে পড়েছে, এমনটা হয় না। বাড়ি থেকে কেউ বকে তাকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে বের করার চেষ্টা করছে। তার কান্নাটা অদ্ভুত, যন্ত্রণাদায়ক। এতক্ষণে সে জেনে গেছে …।
আমরা সেই চেনা রুট ধরেই উপকূল থেকে রাজধানীর দিকে রওনা হলাম – হাসি ও আনন্দে এ পথে আমরা বহুবার আসা-যাওয়া করেছি। আমরা যখন এই হাইওয়ে ধরে যাই, শহরে পৌঁছে কী করব তার কিছু সিরিয়াস কিছু লঘু পরিকল্পনা করে সময় কাটাই। কিন্তু এবার আমাদের ওপর চেপে আছে দুর্ভার একটা কিছু; পাবলোর চেহারায় একটা ভয়ংকর বিষণ্ণণ অভিব্যক্তি। তাকে এই বিষণ্ণতা থেকে টেনে বের করতে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইসস্নানেগ্রায় আমাদের বাড়িতে একটা নতুন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করার কথা বলছি। এতে থাকবে পাবলোর বইয়ের সংগ্রহ। এ-মুহূর্তে বইগুলো ফ্রান্স থেকে জাহাজে আমাদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। আমরা লাইব্রেরিতে বড় বড় জানালা রাখার কথা বললাম। বড় জানালা এবং প্রচুর আলো – এমন রুমই পাবলোর পছন্দ। আমি অবশ্য তাকে সতর্ক করি। বলি, ‘আমাদের বাড়ির ওইদিকটাতে প্রচুর আলো আসে। কিন্তু সাবধান বেশি আলো বইয়ের জন্য খারাপ।’
ধীরে ধীরে আমি তাকে তার নিমগ্নতা থেকে বের করে নিয়ে আসি, কিন্তু আমরা মেলিপিলস্না এক্সিটের দিকে আসতেই আমরা রাষ্ট্রীয় পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যকে দেখতে পাই। তারা আমাদের থামিয়ে দেয় এবং পরিচিতিপত্র দেখানোর হুকুম দেয়। জিজ্ঞেস করে, ‘আপনারা কোত্থেকে এসেছেন? কোথায় যাচ্ছেন?’
একজন আমাকে বলে, ‘ম্যাডাম অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে আসুন? আমাদের তলস্নাশি করতে হবে।’
আতঙ্কিত বিস্ময় নিয়ে আমি তার দিকে তাকাই। নেমে যেতে হবে? আমাকে?
আমি স্বগতোক্তি করতে থাকি – ‘তোমরা কি দেখছ না, পাবলোর শরীরটা কত খারাপ? দেখছো না আমি তার হাত ধরে আছি? আমার শক্তিটা তার দরকার। আমি কেমন করে তাকে একা ছেড়ে যাব?’
তোমরা কি তার মুখের করুণ অভিব্যক্তি দেখতে পাচ্ছ না? চারপাশে যেসব অপরাধ ঘটছে, তার ভারে দেখছো না পাবলো কেমন হয়ে গেছে? যে দেশের প্রতিরক্ষার জন্য পাবলো বারবার উঠে দাঁড়িয়েছে, দেখছ না এখানে কেমন রক্তপাত ঘটছে? তোমরা কি বুঝতে পারো না, পাবলো নেরুদা জনগণের ভোগান্তি এমনভাবে নিজের করে নিয়েছে? এমনকি হে সৈনিক তোমার ভোগান্তিও, কারণ তুমিও তো জনগণের অংশ, ঠিক পাবলোর মতো, ঠিক আমার মতো।
আমি অফিসারের দিকে তাকাই। এতক্ষণ যা বললাম তার একটি কথাও তাকে বলিনি। পাবলোর দিকে তাকিয়ে যে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তুলব, আমার সে শক্তিও নেই। আমি নীরবে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নেমে আসি। তাদের তলস্নাশি কেমন হলো? আমি পাবলোর চোখে কখনো অশ্রম্ন দেখিনি। কিন্তু যখন তার কাছে ফিরে আসি, তার দুচোখে অশ্রম্ন ভারাক্রান্ত। পাবলো নিজের জন্য কিংবা আমার জন্য কাঁদছে না; কাঁদছে চিলির জন্য।
আমরা চিলিকে সবসময়ই সভ্য দেশ বিবেচনা করে এসেছি। আমরা ধরে নিয়েছি, চিলি হচ্ছে সহিংসতার শত্রম্ন, চিলি আইনকে সম্মান করে, রক্তপাতকে ঘৃণা করে, যখন কোথাও এ-রকম কিছু ঘটে সাহস নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ জানায় চিলি। আমি শুনেছি নিজের দেশের কথা বলার সময় এভাবেই পাবলো বলত।
কিন্তু আমরা এখন বিস্মিত ও নির্বাক। কিন্তু এ তো কেবল শুরু। আমি ভাবি, কোনো দুঃস্বপ্ন নয় তো।
আমরা যখন সান্টিয়াগোর সামন্তা মারিয়া ক্লিনিকে পৌঁছি, নার্সরা – যাদের পাবলো বলত ‘নৈঃশব্দ্যের অভিভাবক’ – আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছিল। একজন ডাক্তার এসে হাজির হলেন। তার মুখম-লে, দৃষ্টিতে উত্তেজনার চিহ্ন, এটা তো স্পষ্ট – তাকেও অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এই নয় যে, পরিস্থিতি আমাদের চিমন্তাকে জাগিয়ে তুলেছে, তখন কে ভোগান্তির মধ্যে নেই?
কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের বন্ধুদের কেউ কেউ এসে হাজির হলেন। আমি তাদের স্বাগত জানিয়ে হাতজোড় করে বললাম, অনুগ্রহ করে পাবলোকে কোনো দুঃসংবাদ, কোনো আতঙ্কের সংবাদ দেবেন না। যেমন তারা জানেন সান্টিয়াগোতে আমাদের বাড়িটাতে লুট হয়েছে। তারপর আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। সৌভাগ্যবশত ধোঁয়ার পুচ্ছ বাগানের সবচেয়ে বড় গাছটার ওপর দিয়ে দেখা যাওয়ায় প্রতিবেশীরা সতর্ক হয়েছেন এবং দমকল বাহিনীকে খবর দিয়েছেন। দমকলকর্মীরা তাড়াতাড়ি এসে হাজির হন। আগুনে তেমন বড় ক্ষতি হয়নি। দুটি ছোট বেডরুম, একটি স্টোররুম আর কিছু গাছ পুড়েছে।
বন্ধুদের মধ্যে যারা প্রথম এসে পৌঁছেছেন, তাদের একজন চিলিতে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত। পাবলোকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি জোর দিলেন। মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট এশভারিয়া আমাদের পরিবহনের জন্য উড়োজাহাজ পাঠিয়ে দিতে চেয়েছেন। সেই সঙ্গে নির্বাসিত জীবনে আমাদের যা লাগবে, সবই দেবেন।
আমি প্রেসিডেন্টের এই হূদ্যতার কথা এবং আমাদের নির্বাসনে যাওয়ার সম্ভাবনার কথা তাকে বলি। কিন্তু পাবলো আমার কথা শুনতে রাজি নয়।
‘আমি চিলি ছেড়ে কোথাও যাব না। আমার নিয়তি এখানেই। এটা আমার দেশ, এটা আমার জায়গা’ – এই হচ্ছে পাবলোর বিবৃতি।
সান্টিয়াগোতে আমাদের বাড়ির যে-ক্ষয়ক্ষতি হলো, এ নিয়ে তাকে কিছুই বলিনি। আমার বন্ধুরা চাপ দিচ্ছে, পাবলোকে বলো, তাকে সতর্ক করো, সামনে তার জন্য অনেক ভোগান্তি। চিলিতে এখন বামপন্থিদের কোনোরকম আমলে আনা হচ্ছে না, তাদের সম্মানও করা হচ্ছে না।
২০ সেপ্টেম্বর আমাদের কজন বন্ধুকে নিয়ে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত পাবলোকে দেখতে এলেন। উদ্দেশ্য পাবলোকে দেশ ছাড়তে রাজি করানো। তারা আবার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আমি শেষ পর্যন্ত আমাদের বাড়ি লুট ও ধ্বংসের কথা বললাম। আমাদের দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক আলোচনা চলল।
আমরা চিলিতে থেকে যাওয়ার বিপদের মাত্রা অনুমান করতে চেষ্টা করি। আমি তার চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া যে অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে, সে-কথা বলি (১৯৭১-এ তার প্রোস্টেট ক্যান্সার শনাক্ত হয়, চিকিৎসায় ভালোই সাড়া মিলছিল)।
শেষ পর্যন্ত যখন পাবলো সম্মত হয় আমরা অল্প সময়ের জন্য মেক্সিকো ঘুরে আসব, একবারে অনিবার্য প্রয়োজনীয় যা কিছু কেবল তাই নেব, কারণ আমরা তো আবার ফিরে আসছি। পাবলোর এই সম্মাতিতে আমি খুব খুশিই হলাম।
পাবলো যেসব বই সঙ্গে নিতে চায়, তার তালিকা নিয়ে আমি ইসস্নানেগ্রায় ফিরে আসি।
সঙ্গে কী কী নেব আমি যখন জড়ো করছি, টেলিফোন বেজে উঠল।
এটা তো পাবলো।
আমাকে বলল, তাড়াতাড়ি ক্লিনিকে ফিরে এসো।
তারপর রহস্যজনক স্বরে উচ্চারণ করল, ‘আমি এর বেশি কিছু বলতে পারছি না।’
আমি সবচেয়ে খারাপটাই কল্পনা করলাম। স্যুটকেস বন্ধ করে উন্মত্তের মতো দরজার বাইরে ছুটে এলাম। দুশ্চিমন্তা আমাকে মানসিক রোগগ্রস্ত করে তুলেছে। আমার কেবল মনে হচ্ছে, সান্টিয়াগো যাওয়ার পথে আমাকে আটকে দেবে।
আমি ড্রাইভারকে বললাম, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের সান্টিয়াগো যেতে হবে। নিজেরা কোনো দুর্ঘটনা না ঘটিয়ে কেমন করে পৌঁছলাম জানি না। এক মিনিট পরপরই ড্রাইভারকে বলেছি, ‘আরো জোরে যাও। তোমার গাড়ি তো চলছে না। প্রতিটি মিনিট মনে হয়েছে অনন্তকাল। ভেবেছি আর কখনো সেখানে পৌঁছতে পারব না। আমি পাবলোর রুমে ছুটে যাই। তার পাশে বসি। নার্ভাস টেনশনে আমি ক্লান্ত। পাবলো উত্তেজিত। আমাকে বলল, অনেক বন্ধুর সঙ্গে সে কথা বলেছে, তাদের কাছ থেকে যা শুনেছে, আমাদের দেশে যা ঘটেছে তা অবিশ্বাস্য, আর এ-সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই নেই।
পাবলো বলছে, ওরা তো মানুষ খুন করছে। তারা ক্ষতবিক্ষত শরীর নিয়ে আসছে। মর্গ মরদেহে ভরে আছে। মরদেহ নেওয়ার জন্য শত শত মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিক্টর জারার কী হয়েছে, তা তুমি জানো না কেন? (ভিক্টর জারা বামপন্থি; চিলির বিখ্যাত লোকসংগীত888sport live chatী)। তার হাত ভেঙে শরীর ছিন্নভিন্ন করে ফেলা হয়েছে।
গত কদিনের এসব ভয়ঙ্কর খবর তার কাছ থেকে আড়াল করে রাখতে আমি কত চেষ্টা করেছি, তাকে বাধা দিয়েছি, যাতে এসব খবর শোনার সুযোগ না পায় আর পাবলো মনে করছে আমি সবকিছু উপেক্ষা করছি।
আমার মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেছে। মুখ থেকে আমার কথা সরছে না। আমার যে বিবর্ণ পোর্ট্রেট পাবলো এঁকেছে তা ঠিক, তাকে রক্ষা করার জন্যই তো আমি তাঁর কাছে দর্শনার্থী বন্ধুদের আসা ঠেকিয়ে রেখেছি। এখন পাবলো সব জানে। তাঁর যন্ত্রণা, তার আতঙ্ক, তাঁর ক্রোধ। তার নিবীর্যতা সবই তার মুখম-লে ফুটে উঠেছে।
‘এটা কেমন কথা, তুমি ভিক্টর জারার ছিন্নভিন্ন লাশের কথা জানো না? ওহ্ গড। একটা গানের পাখিকে এভাবে হত্যা করে … তারা বলল জারা শুধু গান গেয়েছে আর গেয়েছে, এতে সৈন্যরা ক্ষিপ্ত হয়েছে।’
(ভিক্টর জারা চিলির কবি, গীতিকার, সংগীত888sport live chatী, নাট্য পরিচালক এবং সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী। ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৭৩-এ সামরিক অভ্যুত্থানের পর তাকে সেনাবাহিনী উঠিয়ে নেয় এবং অবর্ণনীয় শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করে। তার শরীরে চল্লিশটি গুলি বিদ্ধ হয়।)
পাবলো বারবার এসব কথারই পুনরাবৃত্তি করছে। সে যাই বলে ছুরির মতো আমার হূৎপি– বিদ্ধ হচ্ছে। আমার গলা ধরে আসে। কিন্তু আমি জানি, আমাকে কাঁদলে চলবে না।
আমাকে শান্ত থাকতে হবে। শেষ পর্যন্ত যখন আমার মুখ খোলে আমি তাকে এই বলে আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করি যে, ওরা যা বলছে তাতে অতিরঞ্জন আছে। এর সব আমি বিশ্বাস করি না। পাবলো প্রশ্ন করে, ‘তা কেমন করে হয়? মেক্সিকো ও সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত এখানে এসেছিলেন। তোমার কি ধারণা, তারা জানেন না?’
আমি নিস্পৃহতার ভান করি। ‘যা বলে বলুক। আমি এর সবটাই বিশ্বাস করি না।’
এবার আমি ভিন্ন বিষয়ে কথা বলতে শুরু করি। ইসস্না নেগ্রাতে পান্ডা আমাকে লেজ নাড়িয়ে কীভাবে স্বাগত জানায়, এমনভাবে আমায় দুপায়ের মধ্যে নিজেকে ঢুকিয়ে দেয়, যাতে আমি হাঁটতে না পারি। আমি তাকে সমুদ্রের কথা বলি; আমি যখন গেলাম – কী চমৎকার যে লাগছিল, বিশাল সবুজ ঢেউ তীরের ওপর সশব্দে ভেঙে পড়ছিল (আসল সত্য হচ্ছে, আমি যখন বাড়ি ফিরি সমুদ্রের দিকে ফিরেও তাকাইনি।) আমি বাড়ি নিয়ে বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলি এবং আমরা যে-দুঃস্বপ্ন অতিক্রম করছি, পাবলোকে সেখান থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চেষ্টা করি।
ধীরে ধীরে তার স্বর স্বাভাবিক হয়ে আসে। মিষ্টি করে কথা বলতে শুরু করে, আমাকে নিয়ে এমন সব কথা, যা এখানে বলা যাবে না। খুব তোষামুদে মনে হবে।
আমাদের দাম্পত্য জীবনের হিসাব আবার করতে শুরু করল। এত বছর আমি জেনে এসেছি, আমরা দুজন দুজনের জন্য জন্মেছি। কিন্তু আমাদের এই আলাপ থেকে মনে হচ্ছে অমর এক ভালোবাসার এ এক স্বীকারোক্তি। কিন্তু আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি – এই ভাষায় তো পাবলো আমার সঙ্গে আগে কখনো কথা বলেনি। আমরা ১৯৫২-র ৩ মের কথা মনে করি, চন্দ্রালোকিত সে-রাতে আমরা বিয়ে করি, তারপর ক্যাপ্রিতে আমাদের হানিমুন। তারিখ খোদাই করা একটি আংটি পাবলো আমাকে পরিয়ে দেয়। এটাই আমাদের প্রথম ও প্রকৃত বিয়ে। সেখানে আমরা প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ হই, আমাদের জীবনে যাই ঘটুক, আমরা কখনো বিচ্ছিন্ন হব না।
আর তখন শান্ত কিন্তু দৃঢ়স্বরে পাবলো আমাকে জানাল, সে কখনো চিলি ছেড়ে যাবে না এবং সে চাইল, আমিও যেন একই সিদ্ধান্ত নিই।
আমি বুঝতে পারি সে যা কিছু ভালোবাসে, সবই তো এখানে। যখন এখানে তার প্রিয়জনেরা এমন নির্মমভাবে নির্যাতিত হচ্ছে, তার পক্ষে এখান থেকে দূরে থাকা সম্ভব নয়।
আমি বললাম, ‘আমরা থেকে যাব।’
‘আমি তোমার সিদ্ধামেত্ম খুশি। কাল আমি রাষ্ট্রদূতকে বলব, প্রেসিডেন্ট এশভেরিয়াকে এই আমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানাতে।’
তারপর পাবলো শান্ত।
আমরা তখন সেই সময়ের কথা বলতে থাকি, যখন আমরা সঙ্গোপনে বিয়ে করে একসঙ্গে ইউরোপ বসবাস করছি। শেষ পর্যন্ত আমাদের আলোচনা দুর্ভাগ্যবশত ১৯৫২ সালে আমাদের দক্ষিণ আমেরিকায় ফিরে আসার কাহিনিতে এসে ঠেকে। আমরা যখন উরুগুয়ের মন্টেভিডিওর পোর্ট অব এন্ট্রিতে; সেখানে চিলির কর্মকর্তারা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
পাবলো ছিল নির্বাসনে। চিলিতে ফেরার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তার হাতে ছিল না।
পাবলো আমার দিকে তাকিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলল, ‘কী ভয়ংকর একনায়কত্ব! কী ভয়াবহ! এ কী নির্যাতন!’
আবার তার গায়ে জ্বর এসে যায়। ভয়ংকর এক হতাশা তাকে আবার গ্রাস করে। তার চোখ আতঙ্কে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ব্যাপারটা এমন যেন সে স্পষ্ট দেখছে, মানুষ মেরে রাস্তায় ছুড়ে ফেলা হচ্ছে।
অন্য দেহগুলো ভাসছে মাপোকো নদীতে – একটা নয়, অনেকগুলো। আর আমি তো সত্যিই তা দেখে এসেছি।
অধৈর্য হয়ে পাবলো জ্বরগ্রস্তের মতো বকবক করতে থাকে। আবারো আমাকে বলে, সে চিলি ছেড়ে যাবে না। যারা এখানে ভুগছে, তাদের সঙ্গেই তাকে থাকতে হবে। সে পালিয়ে যেতে পারে না। তার দেশে কী ঘটেছে, তাকেই তার সাক্ষী হতে হবে।
আমিই কেবল তার সঙ্গে। ডাকার মতো কেউ নেই। সন্ধ্যা ছ-টায় কারফিউর কারণে আমাদের বন্ধুরা সবাই চলে গেছে। তাকে শান্ত করতে আমার প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে আমি অসহায় বোধ করি। তার মরিয়া হয়ে ওঠা আমাকেও গ্রাস করে; একই যন্ত্রণা আমাদের দুজনের মধ্যেই প্রবাহিত হচ্ছে। তাকে প্রবোধ দেওয়ার শক্তি তা হলে আমি কোথায় পাব?
সে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে পাজামা টেনে ধরে, ছিঁড়ে ফেলে এবং চিৎকার করে ওঠে, ‘ওরা ওদের গুলি করছে, ওরা ওদের গুলি করছে।’ আমি খ্যাপার মতো কল বাটনে চাপ দিই। নার্স ছুটে আসে এবং পাবলোকে এমন উত্তেজিত দেখে।
নিস্পৃহকণ্ঠে নার্স বলে, ‘আমরা ঘুমের ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি।’ তাকে একটি ট্র্যাঙ্কুইলাইজার ইনজেকশন দিয়ে চলে যায়। আবার আমরা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি।
সে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে। আমি তার পাশে বসি, আমার মাথাটা তার বালিশের পাশে। তার জ্বরের উত্তাপ আমি অনুভব করি। আমরা দুজন একসঙ্গে সুরক্ষিত। আমরা এক দেহ, কোনো কিছুই আমাদের বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। এই নিরাপত্তাবোধের মায়াজালে, তাকে খুব কাছে পেয়ে, আসলে একেবারে নিজের ভেতরে, আমি বুঝতে পারি পাবলো ঘুমিয়ে পড়েছে – সারা রাতভরে ঘুম। আমিও চার ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিই। পরদিনও সে ঘুমোচ্ছে। আমি তাকে এভাবেই রেখে যেতে চাই, যাতে সে না ভোগে, যাতে সে আমার কাছে সর্বশেষ খবর জানতে না চায়। ঘুম ভুলিয়ে দেয়। আর এখন যেসব বীভৎস ঘটনা ঘটছে, আমি চাই সেসব ভুলে যাক। বিকেল ঘনিয়ে আসে, আমি বুঝতে পারি ড্রাইভার ক্লিনিকে ফিরে আসেনি।
আগের দিন আমরা যখন ইসস্নানেগ্রা থেকে ফিরে আসি, ড্রাইভার আমাকে ক্লিনিকে নামিয়ে গাড়ি পার্ক করতে চলে যায়। তার তো এখন ফিরে আসা উচিত।
আমি তার কথা জিজ্ঞেস করি, জানতে পারি সে গাড়ি আদৌ পার্ক করেনি। সে গায়েব হয়ে গেছে। যেন পৃথিবী তাকে গিলে ফেলেছে।
পরে জানতে পারি আমাকে নামিয়ে দেওয়ার পরপরই পুলিশ তাকে থামায়। সে কোথায় আমি যখন হন্যে হয়ে খুঁজছি, তখন সে ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে ভয়ংকরভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। কর্মকর্তারা জানায়, ব্যাটা বড্ড ত্যাড়া, কোনো কথা তার মুখ থেকে বের হবে না। বেচারা পাবলোকে নিয়ে সস্তা দ্রব্যসামগ্রীর বাজার থেকে শুরু করে এন্টিক দ্রব্যের দোকান পর্যন্ত কত জায়গায় ঘুরেছে। তার কাছ থেকে পুলিশের কী জানার আছে? ভাগ্য ভালো, আমি সেই পরিস্থিতিতে তার গ্রেফতার হওয়া ও নির্যাতিত হওয়ার খবর পাইনি। আমি কেবল জেনেছি সে গাড়িসহ নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে, আর দিনের এ-সময়টিতে যে আমাকে সঙ্গ দিতে পারত, আমি সেরকম একজন মানুষ হারিয়েছি।
২৩ সেপ্টেম্বর বিকেল পর্যন্ত পাবলো ঘুম থেকে জেগে উঠল না। আমি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। আমি এক মুহূর্তের জন্যও ভাবিনি পাবলো মারা যাচ্ছে। কিন্তু আমি অবাক হয়ে ভেবেছি এমন ভয়ংকর, এমন ক্রোধান্ধ সময় আমি একা কেমন করে থাকব – এমন এক সময় যখন তারা আমাদের বসবাস করার বাড়িটা পুড়িয়ে দিয়েছে, অনবদ্য 888sport live chatকর্ম ধ্বংস করে ফেলেছে। আমি ভাবি, এরপর আমার কী হবে?
খুব বেশিদিন হয়নি, পাবলোর ডাক্তার আমাকে সুস্থ করেছেন, পাবলো খুব সাফল্যের সঙ্গে ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। আর আমি তো সম্প্রতি তাকে দেখেছি পুরোপুরি প্রাণবন্ত ও উদ্দীপনাপূর্ণ। তাহলে আমি কেন হঠাৎ মৃত্যুর মতো এমন ভয়াবহ একটা বিষয় নিয়ে ভাবতে যাব?
তারিখটা ২৩ সেপ্টেম্বর। এখানে এই হাসপাতালে আমরা তিনজন ব্যথিত, বিষণ্ণণ ও নীরব 888sport promo code বসে – আমি, লরা ও টেরেসা। আমার চোখ পাবলোর ওপর থেকে সরছে না।
হঠাৎ আমি দেখলাম, পাবলো একটু উত্তেজিত হয়ে উঠছে। আমি ভাবলাম, ‘ওহ্ গড, সে কি জেগে উঠছে নাকি?’ আমি উঠে দাঁড়াই। একটি কম্পন তার শরীরে প্রবাহিত হয়, মুখটাকে যেন দুমড়ে-মুচড়ে দেয়। আমি তার কাছে আসি।
পাবলো মরে গেছে।
তার জ্ঞান আর ফিরে আসেনি। মৃত্যুর আগে পুরো দিনটা সে ঘুমিয়েছে।
মানুষ আসে। নিশ্চয়ই এখানে ডাক্তার ও নার্সও আছেন। আমি কাউকে কারো কাছ থেকে আলাদা করতে পারছি না। আমার ভেতর কিছু একটা ভেঙে গেছে। প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা খুব কঠিন ব্যাপার। লরা কাঁদতে থাকে। আমি পুরোপুরি হিম-জমাট হয়ে গেছি, আমার কাঁদার ক্ষমতা নেই। আমি টেরেসার স্বর শুনতে পাচ্ছি। কী মধুর তার ব্যবহার, দারুণ। সব খুঁটিনাটি সে দেখছে। আমাকে বলল, ‘তাকে তো পোশাক পরাতে হবে, কাপড় কোথায়?’
‘আমি তাকে বললাম আজ নয়, কাল পোশাক পরাব?’
আমি তো কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি।
আমি আবার তার কণ্ঠস্বর শুনি। ‘তার কাপড় কোথায়? তাকে তো পোশাক পরাতে হবে।’
আমি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াই। পোশাক খুঁজি। চেক প্যাটার্নের একটা শার্ট পাই। এটা বেশ চমৎকার। পাবলো এটা খুব পছন্দ করত। তার জ্যাকেটে বাদামি রোদপোড়া রঙ আর লালের বড় চেক।
এত সবকিছু খুব দ্রম্নত ঘটে যাচ্ছে।
আমাদের জীবনীশক্তি ফুরিয়ে গেছে।
তারা একটি চাকাওয়ালা খাটিয়া স্থাপন করে এবং পীড়াপীড়ি করে, এখন পোশাক পরানোর কোনো দরকার নেই। পাবলোকে এখান থেকে সরাতে হবে।
কিন্তু কোথায়?
আমি জিজ্ঞেস করারও সুযোগ পাইনি।
পাবলোর সঙ্গে তারাও চলে গেছে, বাস্তবে হলওয়ের দিকে দৌড়ে এগিয়েছে।
আমি টেরেসাকে বলি, ‘বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের বলো যেন হালকা রঙের একটি কফিন নিয়ে আসে। পাবলো কালো কফিন ঘৃণা করত।’
সামান্য যে-কবার আমরা মৃত্যু নিয়ে কথা বলেছি, হালকা মেজাজে বলেছি।
পাবলো আমাকে বলেছে, ‘কালো কফিন ভয়ানক দেখায়, তাই না? উজ্জ্বল রং, ওপরে ফুলের ছবি আঁকা – এতে তারা সন্তুষ্ট নয় কেন?’
আমিও সাদাসিধেভাবে ভাবি, কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙের কফিন আমরা নিশ্চয়ই খুঁজে পাব।
পাবলোকে যে এখান থেকে নিয়ে গেছে, আমি তার খোঁজে বের হই এবং তারপর আমি হারিয়ে যাই। আমি সন্ত্রস্ত, একটি উদ্ভট চিমন্তা আমার মাথায় আসে : কী হবে যদি তারা লাশটা চুরি করে নিয়ে একটা লোক-দেখানো শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করে?
সৌভাগ্যবশত নতুন সরকারের মাথায় এই ভাবনাটি আসেনি।
পাবলোর মৃত্যু পৃথিবীজুড়ে কীভাবে প্রতিধ্বনিত হবে,এ-সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই নেই। আধো অন্ধকার হলরুমের পথ ধরে আমি পায়চারি করতে
থাকি। আমার সামনে দেখি একটি অতিকায় লিফট। আমি ভাবি, ওরা নিশ্চয় এই লিফট দিয়ে বেজমেন্টে নেমে গেছে। আমি বাটন চেপে ধরি, লিফট আসে, আমি ভূতলপথে নেমে আসি। হলওয়ের শেষ প্রামেত্ম আলো দেখতে পাই। আমি ভেতরে যাই। দেখি এটা একটা চ্যাপেল। যুক্তি তো তাই বলে, পাবলোকে এখানে আনার কথা। কিন্তু এখানে নেই।
আমি বাইরে আসি। উলটোদিকে আরো একটি অন্ধকার শীতল হলওয়ে। এখানে এলে কারো মাথা আউলিয়ে যাওয়ার কথা। এখানে কী এক অশুভ বাতাস বইছে! শেষ পর্যন্ত এই আধো আঁধারে আমি কিছু ছায়ামূর্তি দেখতে পাই। তারা আমার দিকে এগিয়ে আসে, ঔদাস্যভরা কণ্ঠে আমাকে বলে, ‘এখানে থাকতে পারবে না, রুমে ফিরে যাও।’
আমার মনে হয় আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। এমন একটি সময়ে যখন আমাকেই তার এত বেশি দরকার, আমি কি পাবলোর পাশে না থেকে পারি? তার হাত তো এখনো উষ্ণ চাদরের নিচে শরীরটা কাঁপছে। তারপরও তারা বলছে, আমি পাবলোর পাশে থাকতে পারব না। আমি কেন তার প্রিয় মাথায় আমার হাত রাখতে পারব না? কে আমাকে বাধা দেবে? আমি জানি না, এসব নিস্পৃহ মানুষগুলোকে কী বলব? মৃত্যুর সঙ্গে তাদের নিত্যকার পরিচয়। আমি সুড়ঙ্গপথ ধরে পাবলোকে খুঁজতে থাকি।
শেষ পর্যন্ত তাকে পাই বিষণ্ণণ এক ভূতলপথের শেষ প্রামেত্ম, জায়গাটা প্রায় আলোকবর্জিত। বরফ-শীতল হাওয়া জায়গাটিকে একটি রেফ্রিজারেটরে পরিণত করেছে।
আমার হাত ও পা ঝিম মেরে আছে। তারপর যন্ত্রণা দিতে শুরু করেছে। হাত ও পা যে আছে, এক সময় সেই অনুভূতিও লোপ পেয়েছে। ক্লান্তি আমার শক্তি শুষে নিয়েছে। আমি খাটিয়ায় ঠেস দিয়ে পাবলোর দিকে তাকিয়ে থাকি। আমি তার সঙ্গে চোখাচোখি হতে চেষ্টা করি। আমার মনে হয় না পাবলো আমার সঙ্গে শীতল আচরণ করছে, কিন্তু বাস্তবে আমিই যে তার মতো শীতল হয়ে গেছি। কিছু নেই এমন একটা ভয়ংকর অনুভূতি আমাকে পেয়ে বসেছে। মনে হচ্ছে আমার পায়ের তলার মাটি সরে যাচ্ছে।
এ- অসহায়ত্ব কি আমার ভবিষ্যতের পূর্বাভাস?
কখন আমাকে একটি চেয়ার এনে দিলো বুঝতে পারিনি।
পাবলোর বোন লরা এসে আমার পাশে বসল। তার চোখ লাল হয়ে আছে। নিঃশব্দে লরা কেঁদেছে। তারপর টেরেসা আসে। আমরা কোনো কথা বলি না। গভীর নীরবতার মতো দুঃখ আমাদের গেঁথে আছে। অশ্রম্ন ঝরাতেও দিচ্ছে না। সবকিছু হারানোর এই বেদনা নিয়ে আমি কি টিকে থাকতে পারব?
একটি হাত আমার কাঁধ স্পর্শ করে যেন আমাকে আতঙ্কজনক দুঃস্বপ্ন থেকে জাগিয়ে দিতে চাইছে। একটি নির্মম মানসিক স্থিতাবস্থা আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে।
রাত ফুরিয়ে একটি নতুন দিন এসেছে।
আমি পাবলোর দিকে তাকাই। তার সুন্দর মুখম-লের দিকে – সে মুখে এখনো ঈষৎ পরিহাসের হাসি। আমি হলের সুড়ঙ্গপথের দিকে তাকাই, বড্ড কুৎসিত এবং ফাঁকা দেখাচ্ছে।
সবার আগে যারা এসে হাজির হন তারা হলেন চিলি ও 888sport app দেশের সাংবাদিক। মুহূর্তের মধ্যে অনেক মানুষ আমাকে ঘিরে ফেলে। বন্ধুদেরও অনেকে আসে। তখনই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারে – কী বিরাট ভুল তারা করে ফেলেছে! এমন একজন প্রিয় সুপরিচিত কবিকে তিনজন 888sport promo codeর সঙ্গে অন্ধকার হাড়-শীতল করা সুড়ঙ্গপথে ফেলে রাখা ঠিক হয়নি, ঠান্ডায় সেই তিনজনের অবস্থাই তো মরো মরো। মুহূর্তের মধ্যে তারা পাবলোকে একটি যথোপযুক্ত কক্ষে নিয়ে গেল।
কিন্তু গতকাল তারা এ-কাজটি করেনি কেন?
এমন প্রশ্নের জবাব না চাওয়াই ভালো।
গত রাতে টেরেসা শেষকৃত্যের আয়োজনকারীদের আসতে বলেছিল। তারা এসে হাজির হয়েছে।
তারা এনেছে একটি ধূসর কফিন। দেখতে ভয়ঙ্কর কুৎসিত, তবু ভালো এটা কালো রঙের নয়।
আমি নিজের হাতে তাকে কফিনের শুইয়ে দিই। আমি তার প্রিয় মাথাটি এমনভাবে রাখি, যাতে সে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুমোতে পারে।
এখন পর্যন্ত আমার মনে হয়নি মৃত্যু আমাদের চিরদিনের জন্য বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
আমার যত্ন তার এখনো চাই।
কেউ একজন কাছে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমরা তাকে কোথায় নিয়ে যাব?’
‘আমি বললাম, তার বাড়িতে।’
আতঙ্কের অভিব্যক্তি ফুটে উঠল। বাড়ির অবস্থা কী সবাই জানে। কিন্তু কেউ আমার কথা খ-ন করল না।
শেষকৃত্যের পরিচালকরা যে-গাড়িতে পাবলোকে পরিবহন করবে, আমরা সে-গাড়ির দিকে এগোই। আমি কাস্কেটের পাশ ছাড়ব না। আমি লাশবাহক গাড়িতে ড্রাইভারের পাশে বসি।
ড্রাইভার অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকায়। মনে হয় লাশবহনের গাড়িতে বিধবার চড়ে বসাটা প্রথাসিদ্ধ ব্যাপার নয়। কিন্তু কেউ আমাকে কিছু বলেনি। আমি শুষ্ক চোখের একজন 888sport promo code। একজন ঘুমহাঁটা মানুষ তার নিয়তি-নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদন করছি।
আমরা আমাদের বাড়ি পৌঁছি। আমি যদি শত বছরও বেঁচে থাকি, এ-মুহূর্তটি কখনো ভুলব না। সারা পৃথিবী যদি উলটেও যায়, এর চেয়ে বেশি আঘাত আমাকে দিতে পারবে না। চারদিকে ভাঙা কাচ, সামনের দরজা খোলা, ঢোকার পথে প্রবল জলধারা। ভেতরে ঢোকা অসম্ভব ব্যাপার। আমি শবযানেই বসে থাকি, আমি আর নড়তেও সমর্থ নই। একজন বন্ধু এগিয়ে এসে বলল, তাহলে আমরা কফিনটা অন্য জায়গায় নিয়ে যাই।
বন্ধুরা পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করে। কেউ বলে চার্চে যাই, কেউ বলে লেখক সমিতির অফিসে। আমি তীব্রভাবে এসব প্রস্তাবের বিরোধিতা করি। না, পাবলো তার বাড়িতেই যাবে। সৈন্যরা খালের গতিপথ ঘুরিয়ে দিয়েছে, যাতে নিচতলাটা পানিতে ডুবে যায়। কিন্তু লিভিংরুমটা তো ওপরে, ওটা ডোবানো সম্ভব নয়। এ-বাড়ির আর একটা প্রবেশপথ আছে। পেছন দিকের রাস্তা বরাবর একটা সার্ভিস ডোর। আমি ড্রাইভারকে সেই প্রবেশপথের কথা বলি। ড্রাইভার এতসব দুর্যোগ ও আঘাত পর্যবেক্ষণ করতে থাকে, তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, ‘আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে, একটা চাকা ফেঁসে গেছে।’ যখন শবযানের চাকা বদলানো হয়, আমরা অপেক্ষা করতে থাকি। আর পাবলোর লাশটা কোথায় নেওয়া হবে – এ নিয়ে সবাই আলোচনা করতে থাকে।
আমরা বাড়ির পেছন দিকটাতে যাই, মনে হয় সেদিক দিয়েও একটা নদী বইছে, তবে প্রবেশপথটা চওড়া হওয়ায় ভেতরে ঢোকা সম্ভব হয়। পাবলো এসেছে, এটা আমার সব প্রতিবেশীর জানা হয়ে গেছে। তারা এটাও জানে, ক-দিন ধরে এ-বাড়ির ওপর যে-বর্বরতা চালানো হয়েছে, তা পাবলোর বাড়িতে ঢোকার সামর্থ্যকে বাধাগ্রস্ত করবে।
আমি শবযান থেকে নেমে আসি। আমার সঙ্গে আমার প্রতিবেশীদের একাত্মতা নিশ্চয়ই আমাকে এখন পরাস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করবে।
আমি ভেতরে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছি, তবু তাদের বলি, ‘আমাদের অবশ্যই ভেতরে যেতে হবে। কিন্তু কফিনটাকে কেমন করে ওপরতলায় তুলব?’
একজন প্রতিবেশী বলল, ‘আমার বাড়িতে কিছু বোর্ড আছে।’
অন্যজন বলল, ‘আমিও যাই দেখি কী নিয়ে আসতে পারি।’
যা আমাদের অসম্ভব মনে হয়েছিল, প্রতিবেশী ও বন্ধুদের বাড়িয়ে দেওয়া হাত তা সম্ভব করে তুলল।
এভাবেই পাবলো মৃত্যুর পর তার বাড়িতে প্রবেশ করল। আমি কফিন অনুসরণ করি। সাহস ফিরে পেতে একটি হাতল চেপে ধরে রাখি।
যখন আমরা ভেতরে গেলাম তখন আমার যে শোকস্তব্ধতা, তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। যে-বাড়িটা ছিল আনন্দ ও জীবনে পরিপূর্ণ, তার এ কী দশা? এই ধ্বংসযজ্ঞ কেন? একটি ভয়ংকর সাইক্লোন এখানে চাবকে গেছে, বাগান জ্বালিয়ে দিয়েছে, সবকিছু পুড়িয়ে ফেলেছে। কেন?
আমরা লিভিংরুমে ঢুকলাম, আমাদের সঙ্গে অদ্ভুত শব্দ, পায়ে চাপা পড়ে কাচ ভাঙছে, মেঝে থেকে আতঙ্ক উঠে আসছে। এ কাচঘেরা বাড়িতে একটি জানালাও নেই, যা অখ- রয়ে গেছে বরং চারদিকে জমে আছে ভাঙা কাচের সত্মূপ। ঘৃণার ঢেউ বাড়িটাকে যেভাবে ধ্বংস করেছে, তা দেখে আমি কেঁপে উঠি। এর বেশি যন্ত্রণা ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি একটি দূরত্ব থেকে সবকিছুর দিকে তাকাই – এসব যেন আমার নয়, অন্য কারো ক্ষেত্রে ঘটেছে। আমি নিস্পৃহ।
তারা আমাকে লিভিংরুমে ঢুকতে বাধা দেয়।
কেউ একজন বলে, আগে রুমটা ঝাড়ু দিতে হবে, ভাঙা আসবাবের টুকরো আর ভাঙা কাচ-বোঝাই হয়ে আছে।
কাচের ওপর পা ফেলে আমি হাঁটতে থাকি। বলি, ‘না, এদিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো। আমরা এখন আর কিছু পরিষ্কার করতে যাচ্ছি না।’
এখানে চিমনির সামনে পাবলোকে রাখা হয়। প্রচ- ঠান্ডা, জানালা নেই। কেবল শূন্য দেয়াল রুমটাকে এতটা ঠান্ডা করে রেখেছে। এত উষ্ণ এই লিভিংরুমটার এ কী অবস্থা করেছে? সারাক্ষণই ফায়ারপেস্নসে আগুন জ্বলত।
এই সুখের ঘরে সবসময় তাজা ফুল থাকত। যে-কেউ এখানে এলে অট্টহাসির শব্দ শুনতে পেত। আমি পাবলোর দিকে ঘুরে তাকাই। আধো-পরিহাসের হাসি দিয়ে আমার কথার জবাব দেয়।
আমি তার মাথার কাছে কফিনে মাথা ঠেকাই আর পায়ের নিচে ভাঙা কাচের শীতলতা অনুভব করি। আমি কেন এই কফিনে নই, তার পাশে, মৃত? কে জানে আমি আসলেই মৃত কিনা?
আমি শীতে জমে যাচ্ছি। কেউ একজন আমার সামনে আসে। আমি চেয়ার দিতে বলি। কিন্তু খুঁজে আনতে একটু সময় লেগে যায়। আমার মনে হয় আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাব। আমি কফিন আঁকড়ে ধরি।
একটি স্বর আমাকে শোনায়, ‘চেয়ার আসছে। প্রতিবেশী কোনো বাড়ি থেকে একটি চেয়ার চেয়ে আনতে গেছে।’
সবকিছুই দুর্বোধ্য ঠেকছে। এটা কেমন কথা – এত বড় পরিপূর্ণ বাড়িতে তারা একটি চেয়ারও রেখে যাবে না?
কিন্তু তাই তো হলো। সবকিছু নিয়ে গেছে। ভয় কাটিয়ে বন্ধুদের অনেকে এসে হাজির হলো। ন্যাশনাল পুলিশ আমার বাড়ি ঘিরে রেখেছে। যারা সাহস করে পুলিশের ঘের অতিক্রম করেছে, তারা আমাকে বলেছে আরো অনেকে আশপাশে রাস্তায় অপেক্ষায় করছে। পুলিশের ঘের অতিক্রম করতে গিয়ে তারা বিপদে পড়তে চাচ্ছে না। আমার মনে হয়, পুলিশকে গিয়ে আমার বলা উচিত আপনারা চলে যান।
সামনের দরজায় জমায়েত পুলিশের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমার সঙ্গে একজন সঙ্গী নিলাম। সামনে এসে বললাম আপনাদের যিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার কিংবা যিনি বস, আমি তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
ইউনিফর্মের তারকা দেখে কোন পুলিশের কী র্যাঙ্ক, আমি কখনো বুঝিনি। তারা আমাকে বলল, পুলিশ ইন্সপেক্টরের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তিনিই তাদের এখানে পাঠিয়েছেন এবং বাড়ি ঘিরে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ তো দেখছি সবচেয়ে বড় পরিহাস।
এখন তারা এ-বাড়িতে আর কী রক্ষা করবে। তারা তো সবই তছনছ করেছে, ধ্বংস করে ফেলেছে।
ইন্সপেক্টরের সঙ্গে কথা বলার জন্য আমি টেলিফোন খুঁজি। আমাকে এক প্রতিবেশীর বাড়িতে যেতে হয়। কারণ এটা তো নিশ্চিত, আমার বাড়ির টেলিফোনের তার ছিঁড়ে ফেলেছে। টেলিফোনটা কোথাও কাদায় পড়ে আছে। সৌভাগ্য আমার, আমি সরাসরি ইন্সপেক্টরকে পেয়ে যাই।
আমি তাকে বলি, পুলিশ বাড়িটা ঘিরে রেখেছে, তাদের যেন উঠিয়ে নিয়ে যান। এখানে তাদের কোনো কাজ নেই। মেশিনগান হাতে ঘিরে রাখা বাড়িতে তাদের ভয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমাদের বন্ধুরা আসতে পারছে না।
ইন্সপেক্টর বললেন, আমার কথা রাখতে পারলে তিনি খুশি হতেন, কিন্তু সবটা রাখা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কেবল অর্ধেকটা তিনি রাখবেন। বাড়িটা ঘেরাও অবস্থাতেই থাকবে, তবে এত কাছ থেকে নয়, দূর দিয়ে। কাজেই বন্ধুদের আসাটা আর একটু সহজ হবে; কিন্তু অবশ্যই ভীতিহীনভাবে নয়।
প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে ধার নেওয়া ছোট্ট চেয়ারে আমি পাবলোর পাশে বসে আছি। আমি হঠাৎ ওপরের দিকে তাকাই, সহজ প্রবৃত্তিতে লিভিংরুমের দরজায় চোখ যায়। বেশকজন সৈন্য প্রবেশ করে। তাদের ইউনিফর্ম বহু তারকা ও মেডেলে সজ্জিত। তাদের লম্বা দেখাচ্ছে, খুব লম্বা। আমি পাবলোর দিকে তাকাই। আমাকে যেতে হবে।
সৈন্যরা সিঁড়ি বেয়ে উঠছে, এটা বেডরুমে নিয়ে যাবে, তারা ধীরে ধীরে আমাকে পর্যবেক্ষণ করছে। আমার 888sport promo codeবন্ধুরা আমাকে অনুসরণ করছে। তারা বলছে, ‘ভয় পেয়ো না মাতিলদে। সৈন্যরা সামরিক জামন্তার পক্ষে শোক জানাতে এসেছে।’
কিন্তু আমার বন্ধু বুঝতে পারছে না আমি তাদের দাপ্তরিক আলিঙ্গন নিয়ে সন্ত্রস্ত। বরং সৈনিকদের ক্রোধ আমি গ্রহণ করতে রাজি। একই উন্মত্ততায় তারা এই বাড়ি ধ্বংস করেছে। আর এখন তারা সবার সামনে শোক জানানোর নাটক করে ওটা মুছে দেবে! না, না, প্রশ্নই আসে না, আমি কোনো সরকারি শোক-সহানুভূতি গ্রহণ করব না।
নিচতলায় তারা নিশ্চয়ই চেক শার্ট পরা হ্যান্ডসাম পাবলোর ছবি দেখেছে, এটা ছিল তার খুব পছন্দের ছবি।
না জেনারেলগণ, আমি তোমাদের কোনো সহানুভূতি গ্রহণ করব না। পাবলো কখনো তোমাদের বন্ধু হতো না।
আপনারা ভাগ্যবান যে পাবলো মরে গেছে। সে তার 888sport sign up bonusকথায় শেষ অধ্যায়টি লিখে যেতে পেরেছে। আমি এটা নিশ্চিত করব যেন গোটা পৃথিবী এটা পড়ার সুযোগ পায়।
পাবলো তার কলম দিয়ে তোমাদের চাবকাত। তার হুল ফোটানো সত্য তোমাদের কুঁচকে দিত।
কী লজ্জা, কী লজ্জা, ছিঃ!
এই ক্রুশবিদ্ধ দেশে রক্তপাতের জন্য তারাই দায়ী।
না জেনারেলগণ, আমি তোমাদের সহানুভূতি গ্রহণ করতে পারব না।
আমি লেখক বন্ধুদের কাউকে বলি, ‘এ বাড়িতে সৈন্যরা যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, তা জেনারেলদের দেখিয়ে দাও।’
আমি লিভিংরুমে পাবলোর পাশে ফিরে আসি।
বাড়িটা বিদেশি সাংবাদিক আর তাদের ক্যামেরায় ভরে গেছে। তারা আমার সঙ্গে অনেক কথা বলছে। কিন্তু আমি তার সামান্যই শুনছি।
দিনে ও রাতে যা ঘটছে তার হিসাব রাখা কঠিন। তার চেয়েও কঠিন এর মধ্য দিয়ে অতিক্রম করা। সারাদিন মানুষ লাইন ধরে বাড়িতে আসছে, সারাদিনই।
আর আমি ভয়ংকর সব গল্প শুনেছি।
আমার অচেনা একজন দরিদ্র ও ক্ষুব্ধ 888sport promo code বলেছে, ‘ম্যাডাম ওরা তো আমার ছেলেকে খুন করেছে।’
সেই 888sport promo code বলল, ‘আমার ছেলের লাশটা দাফনের জন্য সাহায্য দরকার। আমি তো একা দাফন করতে পারব না।’
আবেদনের দৃষ্টি নিয়ে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে ভাবছে, আমি তাকে সাহায্য করতে পারব।
আমি তাকে বলি, ‘তোমার সঙ্গে যন্ত্রণা ভোগ করা ছাড়া যে আমার কিছুই করার ক্ষমতা নেই।’
আমি 888sport live chatী ভিক্টর জারার কথা ভাবি, কেমন করে তারা ভিক্টরের শরীরটাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলল। আমি ভাবি, এই 888sport promo codeর ছেলেটির শরীর না জানি কোন অবস্থায় পড়ে আছে।
এখন আমি পাবলোর পেছন পেছন নুড়ি-পাথরের পথ ধরে হাঁটতে থাকি। সে কথা বলতে পারছে না। দেখছেও না। আর আমি যেন বিষণ্ণ না হয়ে পড়ি, সেজন্য আমার দিকে তাকিয়ে যে দুষ্টুমিভরা চোখ টিপ দেবে, তাও করছে না। আমি জানি কোনোভাবে সে আমাকে দেখছে। তাই আমি আমার নীল কোটের নিচে লাল সোয়েটার পরে আছি। শোক করাটাকে সে খুব ঘৃণা করত। এভাবে আমাকে দেখলে সে ধরে নেবে – আমি শোক করতে আসিনি। খালের ওপর একটি সেতু আমাদের পেরোতে হবে। যারা কফিন বয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাদের একজনের পা পিছলে পানিতে পড়ে গেল। তার পায়ের অর্ধেক এখন ভিজে চুবচুবে। এ কেমন কাজ। শুরু থেকে সবটাই কঠিন।
এই প্রথম আমার বন্ধুদের মুখ দেখে চিনতেধ পারছি। তাদের খুব কমসংখ্যকই আসতে পেরেছে। মেক্সিকোর দূতাবাস আমার জন্য একটি গাড়ি পাঠিয়েছে। আমি সেই গাড়িতে উঠি। আমার গাড়ির বেচারা ড্রাইভারটার কথা মনে হয়। সে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। সে কোথায় থাকতে পারে? তার কী ঘটতে পারে?
আমরা সমাধিক্ষেত্রে এসে উপস্থিত হই। আমাদের 888sport free bet অনেক, সৈন্যদেরও তা-ই। সৈন্যরা আমাদের কাছাকাছি চলে আসে। রাইফেল ও মেশিনগান আমাদের ঘিরে রেখেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে শান্তিবাদী মানুষ ও কবির শেষকৃত্যে এ কী ভয়াবহ সামরিক মহড়া! গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাওয়া অমেত্ম্যষ্টিক্রিয়া!
এ মহড়ার মানে যে কী, তা জনগণ জানে। এর মধ্যেই তারা তাদের অনেক প্রিয়জনকে হারিয়েছে। চিলির রাস্তায় এত রক্ত ঝরেছে যে, এই সামরিক মহড়া তাদের আবেগকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা সমস্বরে উচ্চারণ করছে – ‘পাবলো নেরুদা হাজির, এখন এবং চিরদিনের জন্য।’
এ-মুহূর্তটির কথা আমি কখনো ভুলব না। তাদের মুখম-লে যন্ত্রণা ও বিদ্রোহের আভাস। এত বন্ধু ও পরিবারের এত সদস্যের ওপর সামরিক জামন্তার যে নির্যাতন চলেছে, তা তো এখানে আসা প্রত্যেকেরই অভিজ্ঞতা : গ্রেফতার, নিরুদ্দেশ, অত্যাচার। এ-মুহূর্তের শ্বাসরুদ্ধকর অন্ধকারে স্বাধীনতার জন্য চিৎকারের মতোই শোনায় এ-সেস্নাগান : ‘পাবলো নেরুদা হাজির, এখন এবং চিরদিনের জন্য।’
এ-চিৎকার আমাকে আলোর রশ্মি দেখায়। আশার আলো দেখায়। এ-মানুষগুলো পূর্ণ জীবনীশক্তির অধিকারী আর যারা বুটের পেষণে তাদের দমাতে চাইছে, সামনে তাদের কঠিন সময়।
সৈন্যরা জনগণের কণ্ঠস্বর শুনেছো তো?
আমি জানি, তারা সবাই আশঙ্কিত কিন্তু এভাবেই তারা তাদের নিয়তির মোকাবেলা করবে।
আমি একটি ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনি : ‘জাগো, পৃথিবীর যত নির্যাতিত।’ আরো অনেক কণ্ঠ এসে এখানে মিলিত হয় : ‘জাগো ক্ষুধাবন্দি মানুষেরা জাগো।’
আমি যে দুর্ভাগ্যজনক মুহূর্তের আশঙ্কা করছিলাম, তা তাহলে এসে গেছে। শীতল কবর-পাথরের নিচে তার শরীর নামিয়ে দেওয়া হবে।
এবার সত্যিই আমাদের নিশ্চিত বিচ্ছেদ।
কফিন এগোচ্ছে, সবাই সামনের দিকে যাচ্ছে, আর এ-মুহূর্তে আমি ঠিক সচেতন আছি বলে মনে হচ্ছে না। আমি তার পেছন পেছন সমাধিতে প্রবেশ করি।
সেখানে দুজন মানুষ আমার দিকে তাকায়, আমি তাদের দিকে।
আমার চোখে একটি ক্রিপ্টও খোলা দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে তারা মাটির কোন গর্তে পাবলোকে ঢুকাবে?
অবাক হয়ে আমি তাদের দিকে তাকাই।
তারা বলল, ‘ম্যাডাম, ওরা দেয়ালে গর্ত খুঁড়তে ভুলে গেছে। এরকম প্রায়ই হয়।’
তারা আরো বলল, ‘কাল করে দেবে।’
তারা কী বলছে বুঝতে আমাকে প্রচ- শক্তি সঞ্চয় করতে হয়।
এরকম প্রায়ই হয়। আমি বললাম, পাবলোকে আজই দাফন করব।
যাও ইট, সিমেন্ট, বালু – সব নিয়ে এসো। যা যা লাগবে সবই আনো। আমি তোমাদের জন্য অপেক্ষা করব। আমি বাইরে বেরিয়ে আসি। অনেকেই তাড়াহুড়া করে চলে গেছে। আমি সমাধির সামনে রয়ে যাই। সেখানে আমি বুঝতে পারি, এ ধরনের ভোগান্তি শারীরিক। এটা আমার ভেতরে ভয়ংকর হিম এনে দেয়; আমি এত শীতার্ত!
নিয়তি আমাকে একটুও ছাড় দেয়নি। আমার পাবলোকে কবর দিতে আমি এখানে ইট-সিমেন্টের জন্য অপেক্ষা করছি। যন্ত্রণার চাদরে 888sport app অবস্থায় আমি কতক্ষণ অপেক্ষা করেছি জানি না।
যখন শেষ পর্যন্ত ইট, সিমেন্ট, বালু এলো – আমি একটুখানি স্বস্তি পেলাম।
গোরখোদকরা সবল ও শক্তিমন্ত। ইট বিছাতে আমি তাদের সাহায্য করি। পুরুষরা আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার মনে হয়, তারা আমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দিহান। তারা বারবার বলতে থাকে, ‘ম্যাডাম, আমরা এটা করতে পারব।’
তারা আসলে বুঝতে পারছে না, তাদের সাহায্য করতে পারাটা আমার নিজের জন্য কত বড় সাহায্য।
পাবলো সমাহিত হলো, তার কবর ঢেকে দেওয়া হলো ফুলে ফুলে। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ফুল সাজাই, সবচেয়ে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত রঙের ফুল আমি বাছাই করি। যেগুলো শিগগিরই নুয়ে পড়বে না, আমার পছন্দ সেগুলো। আমি ওখানে থেকে যাই, ধীরে ধীরে সবই একটু একটু করতে থাকি। যেন আমি কখনো এই স্থানটি ছেড়ে যাব না। এটাই হবে আমার সবচেয়ে বড় বিচ্ছেদ। আমি ভেতরে ভেতরে তীব্র মনোকষ্ট পেতে থাকি। আমি তাকে এই
অতিথিপরায়ণ নয়, এমন একটি কবরে রেখে যাব।
আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করতে থাকি, পাবলোকে কেন এখানে এনেছি। এই লোহার গেটটা আমার পছন্দ নয়। এটাকে মনে হয় একটা সময়ের প্রতীক। আমরা সবাই এ-গেটটার পেছনে দাঁড়িয়ে।
অন্যদিকে তারা আমাদের পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। তারা গোয়েন্দা তৎপরতা চালায়। আমরা ভয় পাই।
আমি যখন এই গেট দিয়ে বেরিয়ে যাই, গেটের তালাটা চাবি দিয়ে আমাকেই লাগাতে হয়, এটাই ছিল আমার জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর কাজ। আমি গেটের ভেতর দিয়ে পাবলোর কবরের দিকে তাকাই। তার পরও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকি। এমনকি পরবর্তী বছরগুলোতেও আমি 888sport app download for android করতে পারিনি শেষ পর্যন্ত কেমন করে এ-সিমেট্রি থেকে বেরিয়ে এলাম।
নেরুদা এখানেই সমাহিত।
নেরুদারই কথা : ‘শেষে হয়ে আসে মানবতার বসন্তকাল।’ এত মৃত্যু, এত অন্ধকার, এত ভয়ংকর নির্জনতা, এত জিঘাংসা – বসন্ত আসবে কেমন করে!


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.