রাত আড়াইটা। প্রধান সড়ক দিয়ে একটা মালবাহী ট্রাক আসে আর চলে যায়। এরপর দীর্ঘ নীরবতা। বসন্তের ফুরফুরে জ্যোৎস্নায় ফিনফিনে বাতাস বয়ে যায়। দুটো বিড়াল ঝগড়ায় মেতে ওঠে। ফের সব আগের মতো, নীরব।
এমন নীরব ঘুমহীন রাত ইস্পাতের ফলার মতো বুকে বিঁধে অস্বস্তি দিতে থাকে। বালিশ উলটাসিধা করে, এপাশ-ওপাশ করেও আরামপদ একটা অবস্থান পাই না। ঘুম আসে না।
অন্ধকার ঘরে রেলিং গলে আলোর কতগুলো স্তম্ভ মেঝেতে পড়ে আছে। তাতে কতগুলো পাতা কাঁপছে। এই দূরপাহাড়ের পাদদেশে অপরিচিত হোটেলে শুয়ে ভাবতে চেষ্টা করি, আসলে আমি এখানে কেন?
কিন্তু কেন যেন ভাবনাটা কিছুতেই শরীর পায় না। শুধু ফসকে যায়। ঠিক যেন পাহাড়ের মেঘের মতো। নাকে-মুখে এসে ঠেলা মারছে; কিন্তু ধরতে গেলেই কিছু নেই। বরং পা-টাও যেন ফসকে যাচ্ছে। চেতনার পাহাড় থেকে কখন যেন হঠাৎ পা হড়কে যায়; পড়ে যাই ঘুমের নিঃসীম আঁধারে।
২
খুব সকালে ঝটপট গোসল সেরে ঠান্ডা আলু ভর্তা, ডাল-ভাত খেয়ে কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে পড়ি। সাঙ্গু নদী থেকে একটা ট্রলারে করে যাত্রা। রিঝুক ঝরনায় গিয়ে শেষ।
পাহাড়িকন্যা সাঙ্গু। মারমা সম্প্রদায়ের ভাষায় ‘শঙ্খকে রিগ্রাই থিয়াং’ অর্থাৎ স্বচ্ছ পানির নদী। 888sport appsের অভ্যন্তরে যে কয়টি নদীর উৎপত্তি, তার মধ্যে সাঙ্গু অন্যতম। নদীটা পাহাড় শ্রেণিকে চিরে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে। একমাত্র ট্রলারের যান্ত্রিক শব্দের বাইরে কোনো শব্দ নেই। সকাল হলে পাহাড় ডাকে; থমথমে কেমন একটা ডাক সেটা। সেই ডাককে ট্রলারের মেশিনের খিট-খিটি-খিট আওয়াজের ভেতর আরো জীবন্ত মনে হয়।
পাহাড়ের পিঠে কোথাও কোথাও আদিবাসী 888sport promo codeদের দেখা যাচ্ছে উবু হয়ে জুমের পরিচর্যা করতে। পরনে তাদের নিজস্ব ধরনের স্কার্ট আর লেহেঙ্গা। ঠিক পাহাড়ের মতো নির্লিপ্ত তাদের অভিব্যক্তি। এত শব্দ করে নদীতে আলোড়ন তুলে আমরা যাচ্ছি, তাতে তাদের কিচ্ছুটি আসে-যায় না। যেন পাহাড়ের কানে কানে তারা কী গোপন কথা বলছে।
৩
আমাদের ট্রলারটা এসে ভিড়ল ঘাটে। ঘাট বলতে কয়েকটা পাথরের চাঁই। সামনেই প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে রিঝুক মহাকল্লোলে আছড়ে পড়ছে বড় বড় পাথরের বুকে। ঝরনার স্রোত পাথরে আছড়ে পড়ে ছিন্নভিন্ন হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে পাথরের চাঁইয়ের নিচে। সেই পানি পাথরের তল দিয়ে ঝিকঝিক শব্দ করে গিয়ে পড়ছে সাঙ্গুর বুকে। এসব অসংখ্য ঝরনার ফলেই আদিবাসী ললনার মতো সাঙ্গু এমন যৌবনবতী। স্বয়ংবরা রাজকন্যার মতো এগিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ের পর পাহাড় পাশ কাটিয়ে কোনো এক অজানার উদ্দেশে। বাঁ-দিকে রিঝুক আর ডান দিকের পাহাড়ের খাঁজে ওই বাড়িটা। দুটো টিনের ঘরের নতুন চাল সকালের রোদে হিরের টুকরোর মতো ঝলমল করছে। কাছাকাছি আসতে মেশিনটা বন্ধ করে দিলো মাঝি। দূর থেকে কুকুরটার অস্থির ঘেউ ঘেউ পাহাড়-পাথরের গায়ে ধাক্কা খেয়ে একটা বিচিত্র কোলাহলের সৃষ্টি করেছে। অতঃপর উঁকি দিলো সেই মুখটি।
৪
প্রথম যেদিন এখানে আসি, সেদিনের কথা স্পষ্ট আমার মনে আছে। পাহাড়ের ওপর থেকে সেই মুখটি যখন দেখা দিলো, বাস্তবিকই আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম – সকালের আলোটা আসলে কোথা থেকে আসছে? আমার পেছনের আকাশ থেকে, না ওই উঁকি-দেওয়া মুখটি থেকে। মুখটিতে পাহাড়ি এক দুর্বোধ্যতা। পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা লাবণ্যময় পাথরের মতো। প্রথম পরিচয়টা অতিক্রম হয়ে গেলে তার মতো সুন্দর, তার মতো আপন এই ধরাধামে কিছু নেই।
মুখটি চেয়ে আছে আর অদৃশ্য কারো সঙ্গে কী নিয়ে যেন কথা বলছে। পেছনের লোকটার মুখও এবার দেখা দিলো। পরাগদা। ঠিক ছোটখাটো একটা পাহাড়। মাথার ওপর চুলের বন দীর্ঘ কপাল ঢেকে রেখেছে। হালকা ভ্রুর নিচে মাংসের তলে চোখের তারা হারিয়ে গেছে।
হনু-উঁচু আর মাংসল চোখের শক্ত বাঁধুনির ভেতর চকচকে দুধসাদা দাঁতে হেসে সে আমাদের স্বাগত জানাল। পাশের তরুণীকে কী যেন বলতে সে একগাল হেসে উধাও হলো।
পায়ের পিস্টনের পরীক্ষা শেষ করে যখন ভিটায় পৌঁছলাম, ততক্ষণে আমার অবস্থা তথৈবচ। একে তো ট্র্যাকিংয়ের অভ্যাস নেই, তার ওপর ঘুমটা পুরো করতে পারিনি। ভিটার সমতল জায়গাটার পর পাহাড় নিজের গতিতে খাঁজকাটা দেহে সজারুর মতো ওপরের দিকে উঠে গেছে। মেঘ তার শুভ্রহাতে পাহাড়শ্রেণির মাথা ছুঁয়ে রেখেছে। সাঙ্গু ডান দিক থেকে এসে বাঁ দিকে কিছুদূরে গিয়ে বাঁক নিয়ে হারিয়ে গেছে পাহাড়ের পেছনে। কী যেন, হয়তো সেখানে সে তার মনের মানুষটি খুঁজে পেয়েছে।
পরাগদার আতিথেয়তার নমুনা বলে শেষ করা যাবে না। পাহাড়ঘেঁষা ঘরটা একপাশ থেকে ইংরেজি অক্ষর এলের সমান্তরালে তৈরি। মাঝেমধ্যে কাঠের বেড়া দিয়ে রুম করা। নদী থেকে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে পথের মুখে বাড়ির সামনের দিকেই চা-বিস্কুটের দোকান, সঙ্গে হাতে তৈরি চাদরসহ স্থানীয় সব ধরনের কাপড়-চোপড় রাখা।
কাছাকাছি হতে পরাগদা পাহাড়ি সৌজন্যের হাসি দিলেন। অনেকটা পাহাড়ের গা-বেয়ে লাফিয়ে নামা পাথরের টুকরোর মতো। আমার মনে হলো, এতে সৌন্দর্য আছে, সৌহার্দ্য নেই।
পরে জেনেছি, আসলে আমার এ-ধারণা একদম ভুল ছিল না। কারণ তাদের সৌহার্দ্য থাকে আরো ভেতরে, গভীরতর জায়গায়। ঝরনার উৎসের মতো তার অনুসন্ধান করতে হয়, তবেই মেলে।
ভিটায় উঠে আসতেই দোকানে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দিলেন পরাগদা। ওষ্ঠাগত প্রাণ যেন পানি পেল, তারপর এক কাপ চা। কড়া লিকারের। অতঃপর বাঁশের খোলে ভাত, মুরগি, সবজি – কত কিই-না খাওয়া হলো।
সঙ্গে সকালের রোদের মতো মেয়েটি। বারবার এটা-ওটা এগিয়ে দিলো। কখনো পানি, কখনো সিগারেট, কখনো কেবল হাসি।
হাসি তো না যেন পাহাড়ের চূড়া থেকে ঝরে পড়া শিউলিবৃষ্টি। এই হাসির জন্য, কেবল এই হাসির জন্যই আমি এই সকল সৌন্দর্য, পাহাড়শ্রেণি ধসিয়ে দিতে পারি।
সেই থেকে পাহাড়ে নিয়মিত হয়ে গেলাম।
৪
সেই যে আসা-যাওয়া শুরু হলো। সেই থেকে রাজধানীতে এখন আমার তৈজসপত্র, পোশাক-আশাক থেকে আদিবাসী যাবতীয় জিনিসের বিরাট শোরুম। শহরের এক বিখ্যাত আদিবাসী পণ্য ব্যবসায়ী আমি।
এর সবকিছু পরাগদার কল্যাণে। তার হাত ধরেই আমার এই ক্ষুদ্র ব্যবসা ধীরে ধীরে বিরাট আকার ধারণ করেছে। এখন কেবল ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। পাহাড়ে আসা-যাওয়ার মধ্যেই আমাকে থাকতে হয়। এইসব ব্যস্ততার মধ্যেও রুবীর সকালের রোদের মতো মিষ্টি হাসিটি কমপক্ষে একশবার না শুনলে আমার দিন অপূর্ণই থেকে যায়।
একদিন রুবী বলেছিল, ‘তুই আমায় এতো ভালোবাসো কেন? দাদা জানলে তো মাইরা ফেলব?’
আমি বলেছিলাম, ‘মারুক। এখনই মারুক।’ বলে ষাঁড়ের মতো তেড়েফুঁড়ে আমি রুবীর দাদা পরাগদার মুখোমুখি যেতে শুরু করলাম। সেদিন রুবী আমাকে চেপে ধরে ফিরিয়েছিল। না হলে হয়তো সেদিনই হতে পারতো এই পৃথিবীতে আমার শেষ দিন।
‘বোকা নাকি থুমি। তরে মাইরা ফালাইলে আমি কি বাঁচব, ক! অমন করিস না। আমাদের কুশলী হতে হব। বুঝছো ঘোড়ার ডিম। পাগলামি করলে হবো না।’
সেদিন রুবীর কথা শুনে মনে হয়েছিল, আসলে 888sport promo codeরাই শ্রেষ্ঠ। তারা বাস্তববাদী, পরিস্থিতি বুঝে কাজ করতে জানে; আর পুরুষরা আবেগসর্বস্ব, তাদের দিয়ে কিচ্ছু হবে না। 888sport promo codeরা যদি পুরুষদের প্রত্যাখ্যান করে চলত, আমার মনে হয় বেশিরভাগ পুরুষকে পাতকুয়োর ভাঙা হাঁড়িকুড়ি হয়ে পড়ে থাকতে হতো।
সাঙ্গুতে ট্রলারের খিটখিট আওয়াজের ভেতর রিঝুক ঝরনার দিকে যাচ্ছি আর এসব ভাবছি। কারণ আজকের যাওয়া আমার 888sport app দিনের যাওয়ার মতো নয়। আজকে যাওয়া আমার বিশেষ, বিশেষতর।
আজকের আসা আমার কোনো পণ্যের জন্য নয়। মনের আয়নায় ভাসছে কেবল সেই মুখটি, ভাবছি, সেই শিউলিবৃষ্টির হাসির কথা; আর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে যে-হাসির উৎস চিরদিনের জন্য আমার হতে যাচ্ছে।
৫
সাঙ্গুকন্যা রুবী গতকাল সকালে ফোন দিয়ে বলল, কবে আসছস?
আমি বললাম, আগামী পরশু।
‘আজকেই আসেন …’ বলে রুবী ফোন কেটে দিলো। তার এই আধো বোলে বাংলা বলার ঢংটা আমাকে আরো পাগল করে দেয়। এভাবে যখন সে কথা বলে, তাকে শিশুর মতো মনে হয়। তুই-তুমি-আপনি মিশিয়ে সে এক মমতা তৈরি করে; যার জন্য আমি কি না করতে পারি!
আমি রুবীর কেটে দেওয়া ফোনে ঠোঁট লাগিয়ে বললাম, ঠিক আছে। আমি আসছি। তুমি রেডি থেকো।
পাহাড় ডেকেছে আমায়। পাহাড়ের ডাক কি আমি উপেক্ষা করতে পারি?


Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.