পিঞ্জর

শেষ পর্যন্ত বাঁকড়ো সদর থেকেই রুপোর খাঁচাটা করিয়ে নিয়ে যাই। কাছে-পিঠে করালেও হতো। শালতোড়া কি আর তেমন অজ গাঁ? কিন্তু ওই যে বলে মনের খুঁতখুঁতুনি। সবচেয়ে ভালোটা না হলে মন উঠতে চায় না। বাঁকড়োর ছিনাথ স্বর্ণকারের এই নাম তো সেই নাম। রুপোও গড়েন। দুটি ছেলেই তাঁর মুম্বাইয়ের জাভেরি বাজারে কারিগরের কাজে পুঁটলি-ভর্তি টাকা কামাচ্ছে। তাই, অনেকেই, শলা দিলে, ছিনাথকেই দাও, তোমার এত শখের জিনিস! সুন্দর নিটোল করে গড়ে দেবে এখন।

আমার নিজের অন্নপ্রাশনের রুপোর থালা-গেলাস-বাটি সব দিয়ে করাতে দিই খাঁচাটা। জোতদার দাদুর দেওয়া সেকেলে ভারি জিনিস, আজকালের ফঙ্গবেনে নয়। মায়ের প্রথমটা আপত্তি ছিল। বলে—তোর ভাতের জিনিস, দিতুম তোর ছেলেকে। আমি বলি—কপালে থাকলে তোমার নাতির রুপোর বাসন হবেই, আপাতত এই কালো মানিকই তোমার নাতি-নাতকুড়।

মা আর আপত্তি করে না। কালো মানিক মানে আমার পোষা বুলবুলিটা। ফিড়িং ফিড়িং করে নেচে বেড়াবে, রুপোর জলুস এদিকে, আর ওদিকে তার ছেয়ে কালো গলায় লাল টুকটুক লকেট। গলায় টুকটুক, ন্যাজ তুললেও টুকটুক। রূপ খুলে যাবে একেবারে।

বুলবুলিটা আমার প্রাণ। প্রথমে একটা বাঁশের খাঁচা নিজেই বানাই। তারপর কিনি একটা লোহার তারের খাঁচা। তারপর পেতলের খাঁচা। যেমন আপন হয়েছে পাখিটা তেমন-তেমন

আদর বেড়েছে তার। আদর বলতে অবশ্য গয়নাগাটির, পেতল-রুপোর আদর। অন্য আদর তার চিরকালই একরকম।

মাঠে বেরোবার সময়ে ঘেরাটোপ খুলে দিই। তখন চরাচর দুধ- ফিকে হতে শুরু করেছে। বুলবুলিটা তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে ওঠে। আমি ওকে ছেড়ে দিই। উঠোনের ওপরটা পুরো জাল দিয়ে ঘিরে নিয়েছি। ভেতরে পড়েছে একটা কলমের আমগাছ, বেশ গোলমতো বকুল, তেঁতুল, একখানা নিম। খুব ওড়ে আর খুব গায় বেটি। মাঝেমাঝে তারটা ঠোঁট দিয়ে আঁকড়ে ঝোলে, দোল খায়। আমি ইতিমধ্যে খাঁচাটা মাজি। পুরনো জলের জায়গায় নতুন জল রাখি, টেপারি, আঁশফল, বৈঁচি, কালো জাম, যে সময়ের যা ফল যথাসাধ্য রাখি বাটিতে, তারপরে খাঁচার দরজা খুলে ডাকি—মানিক, মানিক। কোনো একটা গাছের পাতার গোছার মধ্য দিয়ে মুখ বাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দেখে পাখি। তারপর হঠাৎ ফররর করে উড়ে এসে আমার হাতে বসে। খানিকক্ষণ আধার খায়, আরামে চোখ বুজে আসতে চাইছে যেন। তারপর খাঁচায় পুরে দিই। খা, সারাদিন ধরে যত খুশি খা।

বুলবুলি নাকি পোষা ঠিক না। পোষার পাখি আলাদা। মুনিয়া পোষো, বদরি পোষো, ময়না, চন্দনা, বড় পাখির মধ্যে কাকাতুয়া। কিন্তু গান-পাখি না। পুষলে গান-পাখির গান থেমে যায়। কথাটা হয়তো ঠিকও। কিন্তু কালো মানিকের বৃত্তান্ত একটু আলাদা। বেচারি ওই নিমগাছের বাসা থেকে পড়ে গিয়েছিল। তখন ওর সবে রোঁয়া বেরোচ্ছে। বেড়ালের পেটেই যেত, যদি না ওর মা আর আমার মা মিলে অষ্টপ্রহর পাহারা দিত। মা বাটি করে জল এনে রেখেছিল। বুলবুলি মা ঠোঁটে করে করে সেই জল খাওয়াচ্ছিল বাচ্চাটাকে। আমি বাড়ি এসে কাণ্ড দেখে তড়িঘড়ি হোমিওপ্যাথি বকসো বার করি, মা দুদিক থেকে দুটো শক্ত পিচবোর্ডের ব্যালা দিয়ে তাকে তুলে আনে, তারপর চলে তার চিকিৎসা। বুলবুলির চিকিচ্ছে না কোনো শাহেন শা’র চিকিচ্ছে বোঝা দায়। তুলোর পাঁজের মধ্যে রাখি, ক্যালেন্ডুলার মলম লাগাই। হালকা গরম জলের কমপ্রেস দিই, আঙুরের রস ছেঁচে, ভাতের মাড় ছেঁকে তুলোর পলতে টিপে খাওয়াই, আর ক্যাম্ফর সিক্স এক্স। ভাগ্য ভালো হুট করে একদিন ও সেরে গেল। আর তারপর থেকে ও বোধহয় ভুলেই গেছে কিংবা জানেই না যে ও একটা পাখি। আমার নাকে ঠোঁট ঘষে আরামসে আমার মায়ের হাতে খায়, মায়ের ওপর রাগ হলে আবার দেখ না দেখ আমার কাঁধে এসে বসবে। আর হোমিওপ্যাথির গুলি পেলে তো আর কিছু চাই না। কী চোখে আমাদের ও দ্যাখে, কী ভাবে মনে মনে তা তো বলতে পারবো না। কিন্তু হাবে ভাবে মনে হয়, আমার মা-ই ওর মা। আমিই ওর বাবা। সময়ে সময়ে মনে হয় আমাকেই ও মা ভাবে। ধুতি-ফতুয়া পরি? তো কী হয়েছে? পাখিতে কি আর মানুষের মেয়ে-পুরুষ ভেদ বোঝে?

যাই হোক, রুপোর খাঁচাখান তৈরি করিয়ে ফুর্তিতে ফিরছিলুম। দূরপাল্লার বাস, যেমন চাপাচাপি ভিড়, তেমন শুমসোনি। তবে আমি উঠেছি টার্মিনাল থেকে, জানলার ধারে বেশ জমিয়েই বসেছি। খাঁচাটার ওপর থেকে ব্রাউন কাগজের মোড়কটা থেকে থেকেই জায়গায় জায়গায় খুলে যাচ্ছে। ঝকঝকে রুপো বেরিয়ে পড়ছে। পড়লো তো পড়লো আমি তো তাই-ই চাই। পাঁচজনে না দেখলে, তারিফ না করলে আর জিনিসের খাতির কী?

অনেকটা পথ এসেছি। দু’তিনখানা গাঁ-ই বোধহয় পার হয়ে গেল। ভিড় কখন পাতলা হয়ে গেছে, খেয়াল করিনি। খাঁচা নিয়ে আমি তখন বুঁদ। মনে বাতাস খেলছে। সেই বাতাসেই বাইরের গাছগাছালি দোল খাচ্ছে। খুশি ওরাও টের পায়। বাগানটার কথা ভাবি। সেখানেও এমনি শ্যামলা গাছপালা আমার খুশির বাতাসে দোল খাচ্ছে নির্ঘাৎ। পাশে কখন থেকে একটা সবুজ চাদর মুড়ি দেওয়া লোক ঠায় বসে বসে ঢুলছে। আমার কাঁধে মাথা ঠুকে যাচ্ছে আর আমি ঠ্যালা দিচ্ছি। বাগানে আমার দুটো কুয়ো, একটা পুকুর। জল দেওয়া, আগাছা নিড়ানো, পাহারা দেওয়া- এ সব আমার জনার্দনের কাজ। বাকি সব আমি নিজের হাতে করি। সিজনের টাইমে সনাকে ডেকে নিই। জনার্দনের ভাই সনাতন, হায়ার সেকেন্ডারি পড়ছে।

আম গাছগুলোয় আর কদিন পরেই বউল আসবে। এখন থেকেই যেন আমার নাকে তার অবশ করা সুবাস এসে লাগছে।

হঠাৎ, কিছুর মধ্যে কিছু না, পাশের লোকটা এক ছোঁ’ খাঁচাখানা আমার কোল থেকে ছিনিয়ে নিয়ে খোনা মতো গলায় চেঁচিয়ে উঠলো, আচ্ছা লোক তো মশাই আপনি, একটুখানি চুল এসেছে কি না এসেছে অমনি আমার খাঁচাখানা তুলে নিয়েছেন? এ স্টপ এলেই নেমে যেতেন, টেরও পেতুম না।

আরে! আমি খাঁচার মুড়ো ধরে হ্যাঁচকা টান মারি, নিজের অন্নপ্রাশনের থালাবাটি দিয়ে করানো, বলে সেই কোন সদর থেকে বয়ে বয়ে আনছি এখন এ সুমুন্দির সবুজ চাদর এলেন খোদকারি করতে।

-দেখুন তো মশাই—বাসের লোকগুলোকে সাক্ষী মানি। ও মা! এ তো সব আগের লোকগুলো নয়! প্যাসেঞ্জার সব বদলে

গেছে। আমি রাখিনি, কিন্তু এ মক্কেল সেটি দিব্যি খেয়াল রেখেছে।

– আচ্ছা চোর তো! লোকগুলো তো আমাকে এই মারে তো সেই মারে। কনডাক্টরকে ডাকি, খালাসিকে ডাকি, বলে, এই গাদাগাদি মেছো হাটার ভিড়ে কার খোলে খাঁচা, কার খোলে মাচা, ওই দেখতে হলেই তো আমাদের হয়েছে। বলি এস্টপ হাঁকবো, না রাজ্যির জোচ্চোরের কাছ থেকে পয়সা আদায় করবো, না প্যাসেঞ্জারের জিনিস পাহারা দেব।

-আবার হবি তো হ’ পেছনের সিট থেকে আরেক মক্কেল খুব মিহি গলায় বলে উঠলো—আহা রাগ তো হতিই পারে। ভদ্দরলোক খাঁচাটি গড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, ওঁর খাঁচা যদি অন্যে টুক করে সরিয়ে নেয়।

কার সম্পর্কে বলছেরে! দেখি ও মা ব্যাটা সবুজ-চাদরকেই সাপোর্ট দিচ্ছে।

বলি বটে! ওহে সবুজ-চাদরের খাঁচা-অলা, বলো দেখি তোমার কী পাখি ?

– কী আবার? ময়না! অম্লানবদনে বললো- রাধাকেষ্ট, কেষ্টরাই। অষ্টপ্রহর গাইছে, বড্ড ভক্ত পাখি। এসব পক্ষীর চৈতন্যের অংশে জন্ম, তা জানেন?

-ভক্ত পাখি? চৈতন্যের অংশ? তবে রে! কোত্থেকে করিয়েছিস খাঁচা।

– বসন্ত স্যাকরা। কে না জানে এ চত্বরে বসন্তর মতো রুপোর কারিগর আর নেই! – গড়গড় করে বলে গেল মাইরি, একটু আটকালো না।

– বটে! পাখির নাম কী?

-তোমার অত কথায় কাজ কী বাপু! আমার খাঁচা দিয়ে দাও, দিয়ে সুড়সুড় করে নেমে যাও।

– বল, নামটা বল আমি হাঁকড়াই! – মুনিয়া!

-দেখুন দিকি মশাইরা, খাঁচার তলায় আমার পাখির নাম খোদাই আছে—আমি ডানদিকের সিট থেকে একটা লোককে ডাকি। লোকটি খাঁচা উল্টে বলে—হ্যাঁ তা রয়েছে। তবে কেস যখন এত ঘোরালো তখন নামটা আপনিও বলুন।

মশাই গড়েছেন। তেনার নামও লেখা আছে। – কৃষ্ণকাল! আমার পাখিটা বুলবুলি। শ্রীনাথ স্বর্ণকার

দেখে-শুনে এবার বাসের লোকগুলো সবুজ-চাদরকে প্রায় মারে আর কী! ছি ছি ছি! কেমন মাখন-মুখো চোর দেখো! আমিই আমার কালো মানিকের খাতিরে লোকটাকে ছাড়াই। “যাঃ বেটা দিলুম এবার ছেড়ে। আর কোনোদিন যদি এ লাইনে দেখি তো!’

লোকটা চাদরের মধ্যে হাতড়াতে হাতড়াতে চলে গেল, যেন তার খাঁচা ওই চাদরের খোলেই কোথাও লুকিয়ে আছে। নাম কেষ্টকালি! বাপের জন্মেও শুনিনি বাপু। শ্ শালা! নামার সময়ে আবার ব্যাজার মুখে বলে গেল—পাখির

সার্থক রে গদা। তোর অন্নপ্রাশনও সার্থক। কেমন পরপর সব খাঁচা দেখে তো মা আহ্লাদে আটখানা। বা বা বা! খরচ গাঁট বানিয়েছে দাঁড়ে! যেখানে খুশি বসবে বেটি। কত বড় বাটি। তলায় ঝাঁঝরি, ছোটখাট খোসা ছিবড়ে দিব্যি পড়ে যাবে। জলের বাটিটিরই বা কেমন গড়ন, চট করে চলকাবে না।

—চাদের গামলাখানা দেখেছ মা? -আমি বলি।

মা তো চমৎকৃত-গামলা কেনরে? চানতো আমাদের বালতিতেই করে!

আমি হেসে বলি-বেশ তো চান করবে প্লাস্টিকে আর হাত মুখ ধোবে রুপোয়। দেখো এবার কেমন লাল টুকটুক কম্বল দিয়ে বিছানা করে দিই এদিকে।

মহা ধুমধাম করে শাঁখ বাজিয়ে, সিঁদুর পান দুব্বো চন্দন দিয়ে খাঁচা বরণ হলো, কালো মানিককে থিতু করানো হলো। সে এদিক যায় ঠোঁট ঘষে, ওদিক যায় পাখা ঝটপট করে, ইতিউতি চায়, ঝুঁটিটি সঙ্গে সঙ্গে দোলে।

মা বলে—খুব মনে ধরেছে। দ্যাখ গদা !

ভোরবেলা জাগি। কালো কাপড়ের 888sport appটি খুলে দিই। ছিটকিনি খুলতে ওর তর সয় না। ফররর করে উড়ে যায় মানিক। দু’তিন শিস দেয়। তারপর আমগাছের নিচড়ালে গিয়ে বসে। তো সেদিন থেকেই আমি মানিককে বাগানে নিয়ে যেতে শুরু করি। খাঁচাতে ফলফুলুরি, জল সব ব্যবস্থা করে, চল রে আমার নন্দনকানন। কোনো একটা গাছের তলায় খাঁচা বসিয়ে কাজ করি। আহা দেখুক চারদিকের আকাশ-বাতাস কেমনটা! টাটকা গাছগাছালির বাস পাক। দেখি আকাশে মেঘ ভাসে, টিট্টি পাখিরা সার বেঁধে উড়ে চলে যায়। একটা মাছরাঙা সাঁৎ করে নেমে একটা পুঁটি মুখে করে উড়ে চলে যায়। গাছে গাছে বউল ঝমঝম করে। কী সুবাস! কী সুবাস! আর বছরের মতো ধুন্ধুমার কালবোশেখি না হলে এবার আমের বান ডেকে যাবে। ছোট ছোট করে কেটে দেব, আম খুব ভালোবাসে মানিক।

চারদিক দেখতে দেখতে মানিক ঊর্ধ্বমুখে কেমন কুক-কুক করে ডাকতে থাকে। অচেনা স্বর একটা। বোধহয় টিট্টি পাখিগুলোকে ভাব করতে ডাকছে। নয় তো আকাশকে, মেঘকে। বন্ধু-বান্ধবের আবার অভাব!

জনা বলে দাদাভাই, খাঁচাখানা বানিয়েছ জব্বর। মানিককে যা মানিয়েছে না! যেন মানিকজোড়!

মনে মনে খুশি হই। যত তারিফ, ফুর্তি তত বেড়ে যায়! সত্যি কথা, এ চত্বরে তো এমন পাখি আর এমন খাঁচা নেই কি না! এ বলে আমায় দ্যাখ। ও বলে আমায় দ্যাখ। তবে জানতে দিই না খুশির খবর। মুখে খুব তাড়া লাগাইযা না। ওদিকে তোর পাইপ থেকে যে না-হক জল বেরিয়ে যাচ্ছে রে!

কাজের শেষে বাড়ি ফিরি। কাঁধে গামছা। তার ওপর খাঁচা, ভেতরে পাখি, মনে ফুর্তি, মুখে গান—মন আমার কেমন কেমন করে। ও বঁধু হে মন আমার কেমন কেমন করে। গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরি। তবে সত্যি কথা বলতে কী, মন কেমন করে না। বেশ লাগে। জীবনে আর যেন কিছুই চাই না। এই খাঁচা, আর খাঁচার মধ্যে গানপাখি। কদিনেই মানিকের বেশ ভালোমতো পালক গজিয়েছে। চিকন ছেয়ে কালো দিয়ে যেন তেল গড়িয়ে পড়ছে। ঝুঁটিটি ঠিক যেন ছোট বাচ্চার মাথার চুলগুলো এঁটে-সেঁটে ঝুঁটি বেঁধে দিয়েছে তার মা।

‘নাচো তো জাদু আমার, নাচো তো সোনা।’ মানিক ঘুরে ফিরে ফিড়িং ফিড়িং করতে থাকে। তার পায়ের সোনার আংটাটা ঝিকমিক করে।

আমের গুটিতে গাছের পাতা দেখা যাচ্ছে না। শীত শেষ করে বসন্ত এসেছে। শিসে শিসে জানান দিচ্ছে আমার কৃষ্ণকলি, কালো মানিক। বেড়ার ধারে কৃষ্ণচূড়ায় লালচে রং ধরছে, রাং চিতের চ্যাটালো পাতায় আয়না-ঝলক, অমলতাস ঝুলছে ঝুমরু ঝুমরু পাতার ভেতর থেকে।

এখন বাগানে গিয়ে শুধু বসে থাকো, ফুলের বাহার দেখো, আর মিষ্টি রসের গন্ধে বুঁদ হয়ে থাকো। ফড়িং উড়ে বেড়াচ্ছে, প্রজাপতির গাঁদি লেগেছে। জনা ডাকলো- দাদাভাই, একবার এদিকে এসো। কত্ত বড় মউচাক!

তা যদি বলেন আমার বাগানে ডজনে ডজনে মৌচাক।

বিশেষ এ সিজনটাতে যা মধু পাই তাতে আমাদের বারো মাসের ঘর-খরচা হয়েও ভালো বিক্রি হয়। রোগভোগ, এসোজন বসোজন সবেতেই আমরা মধু দিই। তো এ মধুচাকটি দেখি সত্যিই একটি বোম্বাই হাঁড়ি বিশেষ। বিজবিজ করছে মক্ষী তাতে। তলায় একটা বড় ভাঁড় রেখেছে জনা, টুপটুপ করে মৌ পড়ছে। বললো-মুখে দিয়ে একটু দেখো!

দু-আঙুলে সামান্য একটু তুলে জিভে ঠেকাই, বাপ এ যে অমৃত রে! সময়মতো ঝাড়াই করিস। এখন ভাঁড়ে একটু দে দিকিনি, বেটির জন্যে নিয়ে যাই।

মানিকের আমতলার কাছটাতে আসতে আসতে একটা তীব্র শিস শুনলুম। জানি বলে তাই, নয়তো শিসটাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে আলো, হাওয়া, তাই যেন একটু চাপা, কেমন দূর- দূর। দেখি খাঁচার পাল্লাটা শেষ চৈতের হাওয়ায় খুলছে, বন্ধ হচ্ছে। মানিক নেই। ‘মানিক, মানিক’- আমি চিৎকার করে ডাকি, ‘-মা-নিক!’ গলায় প্রচণ্ড ভয়, উৎকণ্ঠা, যেন প্রাণটাই চলে এসেছে গলায়। প্রত্যেকবার ডাকে আর কোন আড়াল থেকে শিস এসে ঠিক পৌঁছোয়। যেন মানিক বলছে হারিয়ে গেছি, আমি হারিয়ে গেছি, তুমি কোথায়, কো … থা… য়।

সারাটা দিন আমি আর জনা মিলে বাগানখানা চষে ফেলি। গাছের ওপরে উঠি মালকোঁচা মেরে, ডাল ধরে নাড়া দিই। আরো কত পাখি উড়ে যায়—দোয়েল, টিয়ে, বউ কথা কও, কোকিল, এমন কি একজোড়া নীলকণ্ঠও মেঘের গায়ে ঝিলিক তুলে উড়ে যায়। কিন্তু আমার কৃষ্ণকলি -মানিক? – নাঃ।

আকাশে সুর্যি ক্রমে সুরকি ঢালতে থাকে। আমি জনাকে বলি—তুই যা, মাকে বলে আয়, আজ আমি বাগানে রাতে পাহারা দেবো। চোর-বাটপাড় আছে। খবরদার মানিকের কথা বলবি না।

সারারাত লাঠি নিয়ে ঝোপ-জঙ্গল ঠেঙিয়ে ফিরি আমি আর জনা-সনা দুই ভাই। আরো কিছু অনুগত লোক জুটে যায়। লাঠির ঘায়ে শ’-এ শ’-এ কচি আম ঝরে পড়ে যায়। ভ্রুক্ষেপ করি না। কিন্তু নাঃ, দিন যায় রাত যায়, পাই না। তাকে আর পাই না।

বাগানে যাই, বসে থাকি। জনারা দুই ভাই কাজ-কর্ম করে, আমার হাত-পা আসে না। মা বলেন, দুটো খা! শরীরটা যে শুকিয়ে যাচ্ছে! কোনোক্রমে ভাত নাড়াচাড়া করে উঠে পড়ি। কোথায় গেল আমার খাটা শরীরের উপর্জ্জলন্ত খিদে, কোথায় গেল নিশ্চিন্দির ঘুম! ক্রমশ, অস্থিচর্মসার হয় দেহ। চক্ষু কোটরাগত। যেন কত না অসুখ। বাগানে যাওয়ার কামাই নেই। হঠাৎ হঠাৎ শূন্য থেকে ভেসে আসে সেই চেনা শিস। আবার খোঁজ শুরু করি। নিশ্চিত জানি, বাড়ির জালের ছাউনিতে উড়ে উড়ে বেচারির ধারণা ছিল না, জালের বাইরে এত বড় সবুজ। এত বড় আকাশ। এমন উথাল-পাথাল হাওয়া আছে, যা তোমাকে হারিয়ে দেয়। বেশি দূর যাবার সাধ্যই বা তার কই! এসব তো উঁচুতে ওড়ার পাখি নয়। ‘যাসনে পাখি ও পাখি যাসনে। ও পারেতে কালো রং, বিষ্টি পড়ে ঝমঝম, হারিয়ে যাবি পাখি, একেবারে হারিয়ে যাবি।’ জনা বলে— “দাদাভাই, তুমি যে পাগল হলে! কী বিড়বিড় করতেছ?’ বলি, ‘দূর হয়ে যা। আমার পাখি নেই তো আমিও নেই রে শালা, সুমুন্দির পো!”

জানি, নিশ্চিত জানি, আমার মায়া সে কাটাতে পারবে না। আছে, কাছেই আছে, খালি আসবার পথটুকু সে খুঁজে পাচ্ছে না। কে জানে, হয়তো শেষের দিনে, একেবারে সব শেষের দিনে, আমি আর আমার পরান পাখি দুজনে দুজনকে পাবো!