অমিতাভ ঘোষ
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় বহু বিশিষ্ট মানুষের পুত্র-কন্যা তাঁর শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী হয়ে এসেছিলেন। বিগত শতকের তিনের দশকে শিক্ষার্থী হয়েছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহেরলাল নেহরুর কন্যা ইন্দিরা নেহরু (গান্ধী)। পরবর্তীকালে তিনিও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদ অলঙ্কৃত করেন। ছাত্রী থাকাকালে তিনি অন্যসব ছাত্রীর সঙ্গে ছাত্রীনিবাস শ্রীসদনে অবস্থান করেন। শান্তিদেব ঘোষের কাছে নৃত্যশিক্ষা গ্রহণ করে শান্তিনিকেতনে বসন্ত-উৎসবে নৃত্যরতা হয়েছিলেন। আরো পরে তিনি ছাত্রী হিসেবে যোগ দেন মুম্বাইয়ের ভিলে পার্লেতে ড. জাহাঙ্গীর ভকিল-প্রতিষ্ঠিত ‘পিউপিল্স ওন স্কুলে’। সেখানকার শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রনাথের ফাল্গুনীতে অভিনয় করেন। গানগুলি শেখাতে গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতন থেকে সাগরময় ঘোষ। সাগরময় ঘোষের কণ্ঠে ‘আজি দখিন দুয়ার খোলা’ গানটির সঙ্গে মণিপুরি নৃত্যশৈলীতে নেচেছিলেন ইন্দিরা নেহরু (গান্ধী)।
একসময় ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের (বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত) ভারত-পূজ্য দেশনেতা খান আবদুল গফ্ফার খানের পুত্র আবদুল গনি খান শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। তাঁর সম্পর্কে রানী চন্দের লেখনীতে পাওয়া যায় – ‘আবদুল গফ্ফার খান এলেন। সুউচ্চ সুগঠিত দেহ। সুদর্শন পুরুষ। টকটক করছে অঙ্গের বর্ণ। পরনে সাদা সালোয়ার-পাঞ্জাবি। এলেন, যেন মনে হলো দেবদূত এলেন। খুব ভালো লেগেছিল তাঁকে। সবার সঙ্গে মিশলেন, হৃদ্যতায় জয় করলেন সবাইকে।…
… তাঁর বড়ো পুত্র গনিকে এখানে পাঠিয়েছিলেন কলাভবনে। গনিও পিতার মতোই দীর্ঘ সুপুরুষ যুবক। আমরা গনি বলেই ডাকতাম। পেশোয়ারি ছেলে, গায়ে প্রচন্ড শক্তি। সে বসে বসে ‘ওয়াশ’ ‘টেম্পেরা’র ছবি করবে কী? দুদিনে অধৈর্য হয়ে উঠল। গনি তুলি-কাগজ ছেড়ে মোটা দেখে বড়ো বড়ো কাষ্ঠখন্ড নিয়ে বসে গেল দুহাতে দুই হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে। দমাদ্দম সে বাটালির মাথায় হাতুড়ি পিটত, বড়ো বড়ো কাঠের চিলতে কেটে ফেলত, আর হাসত। হাসিমুখ ছিল গনির। নন্দদা (আচার্য নন্দলাল বসু) বললেন, গনি এটাই করুক, কাঠ কাটুক, পাথর ভাঙুক। আমাদের ছেলেরা এ-কাজে এগোতে চায় না। এভাবে কাঠ কেটে গনি অনেক কিছু করেছিল। ‘ফিনিশিং’য়ের দিকে ততো মন ছিল না, গড়নটি ভাবটি এসে গেলেই সে খুশি হয়ে সেটা ছেড়ে আরেকটা কাঠ ধরত। নন্দদা খুব সন্তুষ্ট ছিলেন তার কাজে।
… গনির একটা পার্সোনালিটি ছিল কাজে ব্যবহারে হাসিতে কথায়, সবেতেই। কিছুকালের মধ্যে সে ছাত্রদের নেতৃত্বের ভূমিকা আপনা হতে পেয়ে গেল।’
(রানী চন্দ/ ‘সব হতে আপন’)
১৯২২ সালে শান্তিনিকেতনে ছাত্ররূপে যোগ দেন মৌলানা জিয়াউদ্দিন। পরে তিনি নিজ কৃতিত্বে সেখানে অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। ১৯৩৮ সালে লাহোর পরি888sport slot gameকালে তাঁর মৃত্যু হয়। এই দুঃসংবাদে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত ব্যথিত হন। শান্তিনিকেতনে শোকসভায় কবি তাঁর প্রতি 888sport apk download apk latest version অর্পণ করেন। ৮ জুলাই ১৯৩৮ একটি 888sport app download apkয় কবির মর্মবেদনা প্রকাশ পায় –
‘…তুমি আপনার বন্ধুজনেরে
মাধুর্যে দিতে সাড়া,
ফুরাতে ফুরাতে রবে তবু তাহা
সকল খ্যাতির বাড়া।…’ (‘মৌলানা জিয়াউদ্দিন’)
মৌলানা জিয়াউদ্দিন সম্পর্কে হীরেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর 888sport sign up bonusচারণে লিখেছেন – ‘জিয়াউদ্দিন খুব দীর্ঘদিন এখানে ছিলেন না।… কিন্তু অতি অল্পদিনেই শান্তিনিকেতনের হৃদয়টিকে তিনি অধিকার করে নিয়েছিলেন।… পাঞ্জাবের অধিবাসী, এসেছেন অমৃতসর থেকে।… কিন্তু ধীরে ধীরে সকল বাধা অতিক্রম করে জিয়াউদ্দিন এখানকার ঘরের মানুষটি হয়ে গেলেন।…
… শিক্ষাবিষয়ক কোনো নতুন উদ্যোগের পক্ষে সময়টা খুব অনুকূল ছিল না। অসহযোগ আন্দোলন চলছে, সারা দেশ তোলপাড়। স্কুল-কলেজ ছেড়ে ছাত্ররা সব বেরিয়ে এসেছে। জিয়াউদ্দিনও তাঁর কলেজ ত্যাগ করে চলে এসেছিলেন। ধুঁয়া উঠেছে – পাশ্চাত্য বিদ্যা তথা বিজাতীয় শিক্ষা বর্জন করতে হবে। ঠিক সেই সময়টিতে বিশ্বভারতীর জন্ম একটা চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। বিশ্বভারতী বললে – বিদ্যার কোনো জাত নেই। দেশের হোক, বিদেশের হোক, যা শিক্ষণীয় তা সকলের কাছ থেকেই গ্রহণ করব।… প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি চর্চার তেমন কোনো উদ্যোগ আয়োজন কি দেশের কোথাও তখন ছিল? আমাদের হিন্দু বৌদ্ধ ঐতিহ্য সম্পর্কে কতটুকু আমাদের অনুসন্ধিৎসা? অবিভক্ত ভারত তখন পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম সমাজের বাসভূমি। সেই ইসলামিক সংস্কৃতির চর্চাই বা দেশে কোথায়? রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নানা বিদ্যার একটি সমবায় ভান্ডার গড়ে তুললেন।… ফারসি ভাষায় জিয়াউদ্দিন এতটা ব্যুৎপত্তি অর্জন করেছিলেন যে, তিনি পরে রবীন্দ্রনাথের বহু 888sport app download apk ফারসি ভাষায় 888sport app download apk latest version করেছিলেন।… উর্দুতেও কিছু 888sport app download apk latest version করেছিলেন। যথার্থ 888sport live footballপ্রেমিক মানুষ ছিলেন। কাব্যপাঠে প্রচুর আনন্দ পেতেন। নিজেও কাব্য রচনা করতেন। উর্দু এবং ফারসি ভাষায় বেশ কিছু 888sport app download apk এবং গান রচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষাটিও দিব্যি শিখে নিয়েছিলেন। গানের গলা ছিল। রবীন্দ্রসংগীতে খুব রস পেয়েছিলেন এবং অনেক গান শিখেও নিয়েছিলেন।…
… বিশ্বভারতীর শিক্ষা সমাপ্ত করে জিয়াউদ্দিন কিছুদিনের জন্য আফগান সরকারের চাকরি নিয়ে কাবুলে গিয়েছিলেন।… কাবুলে গিয়ে হাজির হলেন… প্রথমে সৈয়দ মুজতবা আলি, পরে মৌলানা জিয়াউদ্দিন। তাঁর (জিয়াউদ্দিনের) গানের গলাটিকেও তিনি ওখানে কাজে লাগিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো গান তিনি পাঞ্জাবি ভাষায় 888sport app download apk latest version করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের 888sport live football সভায় সেসব গান মূল রবীন্দ্রসংগীতের সুরে গেয়ে শোনাতেন, সভা জমে উঠত। কাবুলের পাঞ্জাবিদের সেসব গান শুনিয়ে তিনি দুদিনেই সেখানেও খুব জমিয়ে নিলেন। মানুষটি ছিলেন বড় ফুর্তিবাজ। কাবুলের শীতে যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত, শীতে হিহি করে কাঁপছেন, তখন গলা ছেড়ে গান ধরতেন – ‘দারুণ অগ্নিবাণে রে হৃদয় তৃষায় হানে রে’।…
… জিয়াউদ্দিন ঘুরেফিরে আবার শান্তিনিকেতনে চলে এলেন। বিশ্বভারতীতে ইসলামিক সংস্কৃতিবিষয়ক একটি বিভাগ স্থাপনের কথা রবীন্দ্রনাথ প্রথমাবধিই ভেবে আসছিলেন, কিন্তু অর্থাভাবে তা হয়ে উঠছিল না। ১৯২৭ সালে নিজাম বাহাদুর বিশ্বভারতীকে এক লাখ টাকা দান করেন। ওই অর্থে ইসলামিক বিভাগটি স্থাপিত হলো। মৌলানা জিয়াউদ্দিন ওই বিভাগের অন্যতম অধ্যাপক নিযুক্ত হলেন।… অধ্যাপনা কার্যের সঙ্গে সঙ্গে জিয়াউদ্দিন ওই সময়ে বেশ কিছু গবেষণামূলক 888sport live রচনা করেছিলেন, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সেসব প্রকাশিত হয়। মোসলেম ক্যালিগ্রাফি নামক একটি গবেষণামূলক আলোচনা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। নানা বিষয়েই আগ্রহ ছিল। ব্রজভাষায় একখানি প্রাচীন ব্যাকরণ সম্পাদনা করে ফারসি ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন।…
… উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মৌলানা জিয়াউদ্দিন সম্বন্ধে বলতে গিয়েই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – যাঁরা পরিণতির বীজ নিয়ে আসেন তাঁরাই আলো থেকে, হাওয়া থেকে পরিপক্বতা আহরণ করতে পারেন। এ আশ্রমের যা সত্য, যা শ্রেষ্ঠ, সেটুকু জিয়াউদ্দিন এমনি করেই পেয়েছিলেন। এই শ্রেষ্ঠতা হলো মানবিকতার, আর এই সত্য হলো আপনাকে সকলের মধ্যে প্রসারিত করে দেওয়ার শক্তি।…
… জিয়াউদ্দিনের অকালমৃত্যুর পরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন – তিনি যে অকৃত্রিম মানবিকতার আদর্শ অনুসরণ করে গিয়েছেন, সেটা বিশ্বভারতীতে তাঁর শাশ্বত দান হয়ে রইল। – আমার নিজের দিক থেকে কেবল এইটুকু বলতে পারি যে এমন বন্ধু দুর্লভ, এই বন্ধুত্বের অঙ্কুর একদিন বিরাট মহীরুহ হয়ে তার সুশীতল ছায়ায় আমার শান্তি দিয়েছে – এ আমার জীবনের একটা 888sport app download for androidীয় ঘটনা হয়ে থাকল।’
[হীরেন্দ্রনাথ দত্ত/ ‘শান্তিনিকেতনের একযুগ’]
দৌলতপুর কলেজে কাজী নজরুল ইসলাম
আমার ছেলেবেলা কেটেছে বর্তমান 888sport appsের খুলনা জেলার দৌলতপুরে। ১৯৩৫ পর্যন্ত সেখানে ছিলাম। দৌলতপুরের ব্রজলাল শাস্ত্রী হিন্দু অ্যাকাডেমিতে আমার বাবা পূজনীয় ধীরেন্দ্রনাথ ঘোষ ইংরেজি 888sport live footballের অধ্যাপক এবং সেইসঙ্গে সহ-অধ্যক্ষ ছিলেন ১০ বছর। সে-সময়ে ওখানে অধ্যক্ষ ছিলেন বঙ্কুবিহারী ভট্টাচার্য। অন্য অধ্যাপকরা হলেন স্বনামখ্যাত প্রবোধচন্দ্র সেন, হরেন্দ্রকৃষ্ণ সরকার, সুকুমার ভট্টাচার্য, প্রমথেশ রায় প্রমুখ। যে-সময়ের কথা বলছি, তখন ওই কলেজে মুসলিমদের প্রবেশাধিকার ছিল না।
এহেন সময় কাজী নজরুল ইসলাম দৌলতপুরে এলেন। আমার বাবা নজরুলকে কলেজে আহবান করলেন – ছাত্রদের কিছু বলবার জন্য। কলেজ কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিলেন – নজরুল সর্বজনপ্রিয় মানুষ হলেও, জাতিতে মুসলিম। সুতরাং কলেজে তিনি প্রবেশ করতে পারবেন না। অধ্যক্ষ কলেজের দ্বার রুদ্ধ করার জন্য ফতোয়া জারি করলেন। জলদগম্ভীর স্বরে আমার বাবা ছাত্রদের বললেন – সবাই কলেজ ছেড়ে বাইরে চলে এসো। কলেজের দ্বারদেশে নজরুল কী বলেন শোনো। তাঁর আদেশে প্রতিটি ছাত্র কলেজের সামনে সমবেত হলেন। ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন যশস্বী গায়ক সন্তোষ সেনগুপ্ত, যশস্বী চক্ষুবিশারদ বলাই মিত্র, পরবর্তীকালের যশস্বী সাংবাদিক হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের শচীন্দ্রলাল ঘোষ, যশস্বী লেখক-গবেষক গ্রামোফোন কোম্পানির সন্তোষকুমার দে প্রমুখ অনেকেই। আমার মা তখন বাড়িতে। খবর পেয়ে আমার হাত ধরে টানতে টানতে প্রায় ছুটে কলেজের সামনে হাজির। আমার বাবার অনুরোধে সেদিন নজরুল বলদৃপ্ত কণ্ঠে শোনালেন তাঁর ‘জাতের নামে বজ্জাতি’ 888sport app download apkটি। r
লেখা এবং লেখক প্রসঙ্গে
এই লেখাটি অমিতাভ ঘোষের শেষ দু-তিনটি লেখার একটি। গত ৩ সেপ্টেম্বর (২০১০) তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর লেখার ফাইলে অপ্রকাশিত এই লেখাটি পাওয়া যায়। কালি ও কলমের জন্যেই তিনি এটি প্রস্ত্তত করেছিলেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত বাংলা ভাষার সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার সংগীত সমালোচক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল সুবিদিত। তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত সংগীতবিষয়ক পত্রিকা বিশ্ববীণা পাঠকমহলে এক সময় অত্যন্ত সাড়া জাগিয়েছিল। বইয়ের মধ্যে আছে চার খন্ডে বিশ্ববিদ্যার আনন্দ প্রাঙ্গণে রবীন্দ্রনাথ (সম্প্রতি পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে), শান্তিনিকেতনের শান্তিদেব, দেশশ্রী সাগরময় ইত্যাদি। কালি ও কলমের গত আষাঢ় ও ভাদ্র (১৪১৭) 888sport free betয় যথাক্রমে শান্তিদেব ঘোষ ও শোভন সোমকে নিয়ে তাঁর দুটি লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।

Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.