এদিকটা, কিচেনের কোণ থেকে বিপরীত কামরার উত্তর দেয়ালের দিকে সরাসরি তাকালে দেখা যায় একটি যুগলছবি। বিয়ের সাজে তরুণ-তরুণী। কনেটিকে গাঁদাফুল ভাবলেও বেশ তরতাজা, ভুল করে ভোমরাও এসে বসতে পারে তার ওপর; যেন মৌ মৌ, মাটিগন্ধা! আর বরটা? সেই সোনালি সময়ে আঁকা শাহি তসবির থেকে নেমে এসে যেন পোজ দিয়েছে। একদিন স্টুডিও কাউন্টার। প্যাকেট করবার আগে প্রোপ্রাইটর দেখতে দিলেন। তাৎক্ষণিক, মুগ্ধদৃষ্টি। প্রথমে একনজর। তারপর দেখতে দেখতে বলে উঠেছিলেন, দ্যাখ দ্যাখ চাঁদ, কি সুন্দর!

জ্বি-হ্যাঁ, তাই তো!

কেন, বল তো?

তার আমি কি জানি? ফ্রেমটা দুহাতে ওপর-নিচ কাত করে ধ’রে মৃদুস্বরে চাঁদবানু বলল, মনে হয় তুলেছে ভালো।

তাতো অবশ্যই, তবে সেই সঙ্গে আরো কিছু আছে!

ঠিক বুঝতে না পেরে একটু পাশ ফিরে তাকিয়ে বলল, কী?

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর, সে তুমি!

আন্তরিক হাসতে থাকে সদ্যপরিণীত নূরউদদীন।

না, না আমি নই, আপনি। প্রথমদিনই দেখে দাদিআম্মা তো বলেছিলেন একেবারে রাজপুত্র!

দাদিদের মন বড়ই উদার, দরিয়ার মতো!

জ্বি-না, আপনি খুবসুরত আরো অনেকে বলেছে।

বলুক যা খুশি। কিন্তু চাঁদ, তোমার রূপের কোনো তুলনা হয় না। আসমানের চাঁদকে হার মানিয়েছ তুমি! আমি সত্যিই ভাগ্যবান।

ছবি দেখে মনে হচ্ছে?

না, না। তোমাকে যে পেয়েছি, এইজন্যে।

হুঁ, বুঝেছি। বড়বুর ধারণা ছিল পুরুষ মানুষ এভাবেই কথা বলে। এটা মিথ্যা।

মিথ্যা! জোয়ারই তো, আবেগ-অনুভূতি যা হৃদয় থেকে উঠে আসে তা মিথ্যা কী করে হয়?

জানি না, আমি কঠিন জিনিস বুঝিও না। যে মিথ্যাটাই সত্য, তা মেনে নিতে পারলেই তো শান্তি!

এইসব কথা চাঁদবানু কখনো বলেছিল কি-না তা ওর মনে পড়ে না, হতে পারে হালকা ঢেউয়ের মতো কখনো হয়তো বয়ে গিয়েছিল।

যদি বলে থাকে কোনোদিন, চলে গেছে।

আর এভাবেই চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে। চলে যাচ্ছে সবকিছু। হারিয়ে যাচ্ছে অনন্তে, ফিরে আসবে না আর। ছায়া-ছায়া যদি কিছু ওঠে, জাগে, পড়ে যায়- সেগুলোকেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়ার অর্থ হয় না।

এরই মধ্যে আজকের দিনটা। আজকের দিনটা, শুক্রবার। একটু যেন অন্যরকম। যে-দিন তারিখটা পেয়েছিল তখন থেকেই নানা কল্পনার রঙিন ফানুস উড়িয়েছে। একটি নতুন live chat 888sport সংসদ। ওদের প্রথম প্রকল্প হাতে নিয়েছে। বিশেষ বড় নয়। তিরিশ মিনিটের একটি টেলিফিল্ম। ওটার নায়িকা সে, নির্বাচিত হয়ে গেছে! একটি পল্লীবালা, তার সুখ। তার দুঃখগাথা। যাই হোক, একটা-কিছু তো থাকবেই। মুভি ক্যামেরা দেখেনি এমন নয়, কিন্তু কখনো এটার সামনে দাঁড়াবে, ভাবেনি। আর অভিনয়? সে-তো আকাশকুসুম। গ্রুপটা ‘ওর’ বন্ধু-বান্ধবের। তাই রক্ষে। ইতোমধ্যেই অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। একটানা কিছু না। ছোট ছোট শট। ছোট ছোট ভঙ্গি। ছোট ছোট সংলাপ। পরিচালক যেভাবে ব্যাখ্যা করবে, বুঝিয়ে দেবে, শুধু সেভাবে সেটা করবে। ফিরে আসার পর নিভৃতে কখনো শুয়ে শুয়ে, কখনো বসে, কিংবা কাজ করবার সময় ভাবনায় বিভোর থেকেছে : এত এত শক্তিমতী নবপ্রজন্মের 888sport live chatী থাকতে ওকে কেন পছন্দ? হয়তো তার চলনবলন, কাপড় পরার ধরন অনেকটা গেঁয়ো, তাই। বিকেলবেলায় একটা গাড়ি আসবে ওকে নিয়ে যেতে মহড়ার আড্ডায়, সেট শুটিং অংশটার ধারণও হতে পারে, ভেতরটা আশা-নিরাশায় দুলছিল। এখন কোনো আপত্তি, কোনো অসুবিধাই কিছু না, সোয়া নয়টা বেজে গেলেও নূর ঘুমাচ্ছিল, কেবল ডবল খাটে টাঙানো মশারিটা ওপরে তুলে দিয়েছে; ওয়াড়-লাগানো গরম কম্বলে আপাদমস্তক 888sport app, কোঁকড়া চুলের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছিল। রাত দেড়টা পেরিয়ে গেলে ফিরেছিল। একটা মেগা সিরিয়ালের চিত্রগ্রহণ চলছে এখন। বাসায় আসা-যাওয়ার স্বাধীনতা পুরোপুরি – আদর করে পায়ে ঠেলা দিলেও বিরক্তি প্রকাশ করে। কানের কাছে শব্দ করলে তো আরো। তিন বছরের দাম্পত্য, মেয়েটা বাপের চেহারা পেয়েছে। মিনি নূর মারজান। দুই বছরেরটি হলো। পাশের ফ্ল্যাটেও আরেকটি আছে, সে অবশ্য মরদ! হাউ মাউ, চিৎকারে ওস্তাদ। গৃহকর্ত্রী উভয়ের বেবিসিটারের মতো কাজ করছেন।

খোলামেলা, জলদি জলদি। একটুখানি সংসার, তবু আয়োজন তো কম না। একটার পর একটা সব করতে হবে। জায়গা তো পরের দরোজাটাই, মিনিকে ব্রেস্টফেড দিয়ে রেখে এসেছিল। ওখানে সে হাসিখুশি থাকে, খেলনা ছড়িয়ে দিলে কাউকে বিশেষ জ্বালাতনও করে না।

ঠিকা পান্নাখালা বুয়া আসবে বেলা সাড়ে দশটায়, এখনো প্রায় এক ঘণ্টা। এখন চাঁদবানুর জোশ কোনদিকে ঠিক ধরা যায় না। কিচেনটা হারমোনিয়ামের রিড চালাবার মতো দ্রুত সিজিল করে ফেলে। চুলা দুই বার্নার, একটাতে নিজেই বড় ডেকচিতে পানি বসিয়ে দিল। কর্তা উঠে বসলেই ডাক ছুড়ে দেবেন। বাথরুমে গরম পানি চাই। তারপর অন্য ফিকির। পিঁড়ি-বেলুন ঠিক আছে। মিটসেফের ওপর সয়াবিন তেলের জার, আটা-ময়দার বোয়াম। ধোয়া থালাবাসন সাজিয়ে রাখা, আর ভেতরে এক সারি ডিম। এবং গতকালকের নিজ হাতে করা খেজুরগুড়ের পায়েস। জানালার ঝাঁজরির নিচটায় ছোট টেবিলে চায়ের কাপ-পিরিচ, কেটলি নামালো। হঠাৎ কী মনে হতে এটা-ওটা দেখে; কিন্তু শেষে চামচটা দিয়েই, কোনো আওয়াজ যাতে না হয়, তেমনি মেঝেতে খালি পা ফেলে ফেলে বিছানার কাছে যায়। তেপায়াটা ডান হাতের দিকে ছিল।

ধোঁয়া-ওড়ানো বেড-টি। মজা দেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ফিরে আসে। খোয়াবনামা যদি ভাবে, মন্দ কী। কিছুক্ষণ যায়। তারপর হঠাৎ শুনতে পেল মেঝের ওপরে ঝন্ঝন্ শব্দ, কপাটের পাশ থেকে মুখ বাড়ালে দেখে, সব টুকরো টুকরো, এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে আছে।

কী হলো? কেন এই কাণ্ড! চাঁদবানুর ভেতরে থরথর করে কাঁপুনি উঠল। মুখটা কালো হয়ে গেছে, ফ্যাকাশে ঠোঁটজোড়া। চীনে মাটি হলেও চাড়ায় পারা পড়লে পা জখম হতে পারে, ওসব ছাড়িয়ে সাবধানে আরেকটু ভেতরে আসে। এসময়ে একটুখানি অস্ফুট আর্তধ্বনি। শখের জিনিসটা, ওর নিজেরও একটা আছে। বাণিজ্যমেলা থেকে কিনেছিল, শুধু দুজনের জন্যে। নাটক থেকে সিনেমায় যাচ্ছে, প্রথম সুযোগেই নতুন নামটা বানিয়ে নিয়েছে : শাহনূর। এমনি ধরনের যাদের পরিচিতি তারাই হিরো হয় বিশেষত বলিউডে, ঢালিউডেও তার ছোঁয়া আছে। পারিবারিক নূরউদদীন আহমদ ছিল, তাতে সুবিধা হয়েছে। কানে গিয়েছিল হয়তো ওই ছোট্ট আওয়াজটুকু, কিছুক্ষণে কম্বলের নিচটা একটু ফাঁক হয়ে যায়।

ন্যাকামি রাখ। তুমি জানো না? দুধ-চিনি ছাড়া আমি বেড-টি খাই না? চাঁদ কী জবাব দিতে যাচ্ছিল, থেমে গেল। নূর আরো কথা বাড়ায়, এটা তো কিছছু না। আমি সব ভাঙবো, স-ব। কিছছু রাখবো না।

ও মাগো! এবারে ডুকরে কেঁদে ওঠে চাঁদবানু, বলতে থাকে – আমি কী অপরাধ করেছিলাম যে আমাকে এমন শাস্তি দিচ্ছেন? আপনি তো এমন ছিলেন না।

এরকম আমি ছিলাম না। কারণ আমি একটা ইডিয়েট ছিলাম। পয়সাওয়ালার মেয়ে, আমাকে টেকা-পয়সার লোভ দেখিয়েছ। শহরে নিয়ে এসেছ।

আমি আপনাকে নিয়ে এসেছি!

হ্যাঁ, আর কে? তুমিই তো!

ভণ্ডামি, ভণ্ডামি! ডাহা ভণ্ডামি। আপনিই আমাকে ছলে-বলে রাজি করিয়েছিলেন। আপনি বারবার বলেননি তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না?

হ্যাঁ, বলেছি। বলেছি কারণ আগে সবকিছু আমি জানতাম না।

সবকিছু আবার কী?

তা-ও শুনতে চাও?

জ্বি, চাই। বলল চাঁদবানু, পরক্ষণেই মুখ নিচু করল।

তাহলে শোনো। আমি জানতাম না তোমার বর্তমান মা আঞ্জুবিবি তোমার মা না। তুমি তার সতীন কন্যা। বরপক্ষ ছেলের জন্যে একটা ভালো ঘড়ি ও একটা মোটর সাইকেল চেয়েছিল, এই তো। রাজিও হয়; কিন্তু তোমার নানা চব্বিশ বছরেও দিতে পারেননি।      তোমার মা কাঁদতে কাঁদতে মারা গেছেন। তোমার বাবা তার চিকিৎসা করাননি। এমন মেয়ে কখনো সম্পত্তি পায়?

সম্পত্তির জন্যেই আমার দিকে আপনার টান ছিল?

না, সবটা তা-ই নয়। তোমাকেও আমি ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু- থাক ওসব। বলে আর কী হবে! তুমি একটা- যেটুক লেখাপড়া জানো তা কিছছু না। জুনিয়র ইশকুল পাশ। বাপের ধনসম্পদ না পেলে তোমার আর কী দাম থাকে! একটা কাজের মেয়ের সঙ্গে তফাৎ কী?

ও মাগো, এসব কী বলছেন! আমি তো কিছছু জানতাম না। আঁচলটা দুহাতের মুঠোতে গুটিয়ে ধরে পেছনদিকে দৌড় দিল, রান্নাঘরে ঢুকে দেয়ালে পিঠ-লেপটে বসে পড়ে। হু-হু করে কাঁদতে লাগল। ভেতর থেকে ঢেউ উঠছে পড়ছে। এই তো এক দৃশ্য, খুব বেশিদিনের না। সপ্তাহ তিন হয়। ছবির নয়া চুক্তিটা পাওয়ার পর আগের সময়ে বাড়ি ফিরতেন না, কমপক্ষে সাড়ে এগারোটা-বারোটা হতো। সে-রাত দশটার মতো। হঠাৎ কী-একটা মনে পড়ায় বেডরুমে ঢুকতেই প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে। বিছানায় কালো বস্তার মতো কী একটা! ঝাঁকড়া চুল বড়সড় মাথাটা নড়ল, মোচড় দিয়ে পাশ ফিরতেই দেখে দাড়ি-গোঁফভর্তি জবরদস্ত একটা পুরুষ মানুষ! ওকে কাঁপতে দেখে তার দাঁতে হাস্য। চাঁদ এমন থতমত খেয়ে গেছে, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুচ্ছিল না। ঘরে অজানা-অচেনা এক পৃথক পুরুষ!

চোখের পানি ফেলতে-না-ফেলতেই লোকটা ঝট করে উঠে পড়ল এবং ঝাঁপ দেয়ার মতো নিচে নেমে সটান দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলল, খবরদার একটুও নড়বে না। চিৎকারের চেষ্টাও করবে না। একটুও কষ্ট দেবো না। কোলপাঁজা করে তোকে আমি কিডন্যাপ করে নিয়ে যাব। অলরাইট? তুই আমার খুব পছন্দ!

হিংস্রদৃষ্টি, জোব্বাজাব্বা দুই হাত বাড়িয়ে এগুতে থাকলে নিজের অজান্তেই যেন আতঙ্কিত, বুকফাটা আর্তনাদ করে ওঠে। হুড়োহুড়ি, আশেপাশের লোকজন এসে হাজির, কিন্তু তারাও হকচকিয়ে যায়। এমন সময়-

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ বিকট অট্টহাস্য। একটানে মাথার নকল বাবরি ও দাড়ি-গোঁফ খুলে নিচে ফেললে হিন্দি ছবির দৈত্যের জায়গায় দেখে এ বাসার ভাড়াটে নূরউদদীন! সবাই কমবেশি জানত অ্যাক্টর, কিন্তু স্টুডিওর পোশাক-মেকআপ তেমনি রেখে এসে এমন কাণ্ড ঘটাবে তা আন্দাজও করতে পারেনি।

কান্না থামাতে পারেনি চাঁদবানু, কিন্তু শব্দ বন্ধ করেছে। আর তখন দুই চোখ থেকে কেবল র্দর্দ করে পানি পড়ছিল। স্বামী অভিনয়ে পৃথক পুরুষ হয়েছিল, ঠিক আছে, মাঝে-মাঝে এমন রসকস মন্দ না। পরে উপস্থিত সকলেই খুব হেসেছিল, সে নিজেও। আলাদিনের বাতির দৈত্য তো যা চায় তাই নিমেষে এনে দিতে পারতো মায় দালানকোঠা, সুন্দরী রাজকুমারী, মণিমুক্তা, উপাদেয় খাদ্যসামগ্রী তো কিছু না। কিন্তু আজ এই বাস্তব ভদ্রলোক কি ছুড়ে দিলেন? কেবল ঘৃণার ইটপাটকেল, বিষাক্ত সন্দেশ চমচম প্রাণহরা! দেখতে শুনতে দেবতা, এত কিছুও তার পেটে ছিল?

এগুলো তো ছায়া নয়, মায়ার হেঁয়ালি নয়, কয়েক পলকের জন্যে তবু অপূর্ব ছবিও নয়।

শহরে আসার পর গত সোয়া তিন বছরে কয়েকটি বই দেখেছে। দেখেছে গল্প-নাটক চরিত্র। সিনেমাকে কেন সবাই বই বলে বুঝতো না। তবু গানের সুরে সুরে আত্মহারা এবং প্রেমের দৃশ্যে আরো অধিক। ভুল, সবই ভুল। হয়তো সবটা নয়, কিছুটা অন্তত। নিজের ক্ষেত্রে মনে হতো যেটুকু পেয়েছে তা-ই সত্য, যা পায়নি তা নয়। সেসব বাকি আছে হয় স্বপ্নে, নয় কল্পনায়। সে সমস্ত ধোঁয়া, কখনো কুয়াশা, অথচ তা-ও তো লাগে ভালো, উপভোগ করে – এটা আবার কী? সময় প্রজাপতির মতো পাখা জাপটিয়ে কখন উড়ে গেছে, বুঝতেও পারেনি। অথচ কষ্টই তো ছিল। একটা শব্দ বাজে, মেগাসিটি। অর্থ নাকি বিশাল নগরী। বেশি লোকের বসবাস। তবু জায়গা পায়নি। মাঝে-মাঝে কমলাপুর গিয়েও অপেক্ষমাণ যাত্রীদের মধ্যে কম্বল পেতেছে, চাদর গায়ে ঘুমিয়েছে। তখন নিভৃতে মনে হতো ভুলই করে ফেলেছে খুব বড় একটা। ঘরে বিমাতা, ওকে বাড়ি থেকে তাড়ানোই উদ্দেশ্য ছিল; আড়ালে আবডালে সলা-পরামিশ শেষ, এক দোজবরের সঙ্গে শাদি ঠিক করে ফেলে। আত্মীয়-স্বজন বড় বড়, যোগাযোগও নিয়মিত। শরিফ আদমি, পয়সাওয়ালা। নরসিংদীতে আড়ত আছে। বয়স তুলনায় দ্বিগুণের চাইতে কিছু কমই হবে বরং। কাঁচাপাকা চুল বটে, কিন্তু স্বাস্থ্য ভালো। পেটটা একটু ঢাউস, এই যা। এমন নামি-দামি দুলহা, কোনো কোনো অভিভাবকের মতে হাতে আসমান পাওয়া। ফাঁকে-ফোকরে কানে এসে লেগেছে সবই। প্রথমে দুঃখ-জরজর, কিন্তু অল্পক্ষণেই জ্বলে উঠল, যদিও প্রকাশ্যে দাউদাউ করে উঠতে পারেনি। সাঁঝের আঁধারে আমতলায় মায়ের কবরের কাছে গিয়েছিল, একদমকা হাওয়া শুধু গা ছুঁয়ে যায়। সারা বাড়িতে কেবল একজন আছেন, চাচিআম্মা, তার বুকে পড়ে নিঃশব্দে অশ্রুপাত করে অনেকক্ষণ। তিনিও বোবার মতো, পিঠে হাত দিয়ে আদর করতে থাকেন। ফাল্গুন-চৈত্র মাস, গণকেরা এসময়েই লগ্নধার্য করেন এবং মোল্লা-মুন্সিরাও তা-ই, এজন্যই যে আবহাওয়া ফুর্তিফার্তার সঙ্গে মানানসই। তার আরো মাসখানেক বাকি ছিল। আহমদ মিয়াচান্দ, বাজানের নামেই মিয়াবাড়ি; চিকন বুদ্ধির লোক, ধীরেসুস্থে এগুচ্ছেন। দেওয়া-থোওয়ার কথা পাকাপাকি করছেন গোপনে, পানচিনি কিংবা দেখাসাক্ষাতে নয়, নিরালায়। মেজবানিটা দরাজ হাতেই করবেন। ওসি সাহেবের সঙ্গে খাতির আছে, হাসি-ঠাট্টার মধ্য দিয়ে অনুমোদন করিয়ে রেখেছেন। বড় একটা মেলাই দেবেন, তিন গরু, চার খাসি। আলাদা পোলাও-কোরমাও থাকবে, তার জন্যে ডাঁশা মুরগি তিন ডজন। কিন্তু ভয়ও একটা আছে, তা বদনাম। মরহুমা বড়বিবি কদর বানুর শেষ সন্তান এই মেয়েটি চাঁদ, ষোলো বছরে পা দিয়েছে মাত্র। জামাইর বড় নাতনির সমান। তবে একটা জোরালো যুক্তি দশগাঁয়ের 888sport sign up bonusতে এখনো আছে- সেকালে সাত-আট বছরেও বিয়ে-শাদি হতো। তাছাড়া জনমনিষ্যির আবার মতামত কি, সবার কল বাতাসে নড়ে। ভুঁড়িভোজনটা ভালোমতন করিয়ে দেবেন, ব্যস এক সাইড শেষ- আর ছোটদের হাতে মণ্ডা-মিঠাইয়ের পোটলা ধরিয়ে দেবেন। পাখির স্বরে জিন্দাবাদ উঠবে না? তবু এসব বিসমিল্লাহ, সঙ্গে আরো কিছু আছে। শোনা যায়, আগামী ইলেকশনে দাঁড়াবেন। তাই বছর আড়াই আগে থেকেই সারা এলাকাজুড়ে জাল পাতা শুরু করেছেন। মেয়েটার সুরাহা হয়ে গেলে পিঠোপিঠি ওর বড় ভাইটাকে ধরবেন। এখনই মাথায় খেলা করছে, সেখানে আরেক অঙ্ক। সিন্দুক হালকা করে হলেও যদি লক্ষ্মীপুরের খানপরিবারে ঢুকে পড়া যায়, কেল্লা ফতে। বিরোধীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে নির্ঘাৎ।

এখনো একান্নবর্তী পরিবার। অ্যামবিশনের লাইন ধরেই ছোটভাই আফতাবকে মুসলিম হলে আবাসিক রেখে পড়িয়েছেন।

ইচ্ছা ছিল, অ্যাডভোকেট হোক। নিজেদের মধ্যে একজন ডাক্তার আর একজন উকিল থাকা নানাদিক থেকেই জরুরি।

মেজো আনোয়ারকে ঠেলেঠুলে অনেক দূর পর্যন্ত নিয়েছিলেন। নরম চলনবলন, কিন্তু সে-ই টেক্কা দিয়েছে। বুঝতে পারেননি ওর ফিলসফি ‘নিজের চরকায় তেল দাও’। সবার অগোচরে সম্পর্কও পাতিয়েছিল। ফাইনাল দিয়ে সপরিবারে বিলাত চলে যায়। এখন টাওয়ার হ্যামলেটের একজন জিপি। দুজনেরই উত্তম পসার।

ছোটর কেসটা বড় করুণ, একেবারে প্রতিকারহীন। সে-ও মন দেওয়া-নেওয়া করেছিল। প্রাচীন জমিদার বংশ। মেয়েটি অতিশয় পুরনো ভাষায় সতীসাধ্বী, কিন্তু বন্ধ্যা। বেশিরভাগ ঘরের ভেতরেই থাকে,  নিরিবিলি। তবু সমস্যাটা জানত। একদিন রাত বারোটা। চারদিকে নীরবতা। বাংলাঘরেই নিজে গেল। একই ফিকিরে বড়মিয়ার প্রতিষ্ঠিত জুনিয়র ইশকুলের হেডমাস্টার নূরউদদীন। চাঁদকে আগলে ধরে ওর দিকে তাকিয়ে বলতে লাগল, বাবা! আমার সন্তান নেই। মনে রেখো, চাঁদই আমার আপন কন্যা। ওপরে আল্লাহ, নিচে জমিন। ওকে তোমার হাতে সঁপে দিলাম। তুমি ওর হেফাজত করবে।

নিচু হয়ে নূর তাঁর কদমবুচি করে, মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে বলল, এ আমার সৌভাগ্য আম্মাজান। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।

তোমাদের মঙ্গল হোক। রওনক জাহানের চোখের কোণে চিকচিক পানি দেখা দিয়েছিল, আঁচলের খুট দিয়ে মুছলেন, চাঁদবানুর হাতে একটা পোটলা দিলেন এবং বললেন, কয়েক হাজার টাকা আছে। প্রয়োজনে খরচ করবি। ভেতরে একটু কাগজও আছে – শহরে আমাদের বাড়ির ঠিকানা। খুব বিপদ হলে যেতে পারিস।

কেউ হঠাৎ এসে পড়লে অসুবিধা হোক এটা চায় না। ওর মন বলে স্বাভাবিক হয়ে যাবে, এবং এটাই উচিত। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই চোখের পানি থামাতে পারে না। এই অতীতের দৃশ্যগুলো। কিছু ব্যথা, কিছু কথা। ঝিকমিক করতে থাকে; এবং অশ্রুর সঙ্গে যেন একের পর এক ঝরে। আঙুলের হিসাবে মাঘ শেষ হলেও ফাল্গুনের আসি-আসি। ভালো ঠান্ডা ছিল। মাথার ওপর থেকে কাপড় ঝুলানো। একজনের চাদর, আরেকজনের গিলাফ।

পা টিপে টিপে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা। পথে নামা। সাবধানে হাঁটতে থাকা। এক অদ্ভুত তকলিফ। বুঝতে পারে না। কতটা, কীরকম।

প্রথম গন্তব্য রেলওয়ে ইস্টিশন। একটা যেন ঘোরের পাল্লায় পড়েছে। চুপচাপ যাচ্ছিল। আকাশভরা ছায়াপথ, পাকা ধানক্ষেতের মতো ছড়ানো নক্ষত্র। ওপরে তাকাবার ইচ্ছা হয় না। কাছের ঝোপে একটু আওয়াজ হলে, সঙ্গীর বাঁ হাতটা জড়িয়ে ধরে।

কী ব্যাপার চাঁদ, খুব ভয় পাচ্ছ না-কি?

জ্বি-না, আপনি আছেন না? একটু থেমে বলল, ইস্! কী ভুলটাই না করে ফেলেছি! জানেন? বাবার একটা দুনলা বন্দুক আর দুইটা পিস্তল আছে। সহজেই পারতাম। একটাও যদি নিয়ে আসতাম!

কিছছুই হতো না। খল্খল্ করে হাসে নূর, বলল, চোর-ডাকাত-সন্ত্রাসীদের অস্ত্র অনেক বড় বড় – লক্ষ্মীটির মতো ধরা দিলেই কিঞ্চিৎ আশা থাকে। কিন্তু ঘুরে দাঁড়ালে খতম।

উহ্! এমন কথা বলতে পারলেন? আপনি দেখছি একটা চমৎকার কাপুরুষ! কথাবার্তায় কাজেকর্মে আপনাকে সাহসী মনে হয়েছে, সেজন্যেই তো আপনার সঙ্গে এসেছি।

তার মানে তুমি আমাকে ভালোবাসো না, এই বলতে চাও?

জ্বি-না, আমি কিছছু বলতে চাই না। একটু থেমে বলেছিল, আপনি এখন আমাকে ছেড়ে গেলেও এই রতনপুরের চার সীমানায় আমি থাকবো না। আমি দৌড় দেবো। ছুটে যাবো। আপনিই তো বলেছিলেন পৃথিবীটা অনেক বড়। কোথাও স্থান না পেলেও থামবো না। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করবো না।

হয়েছে, হয়েছে। বুঝেছি সব, আর বলো না। এইসব বড় বড় কথা কার কাছ থেকে শিখেছ তা-ই ভাবছিলাম। বলেছিলে তোমার মা কদর বানু ম্যাট্রিক পাশ ছিলেন, বাড়ির ভেতরের একটি ঘরে মেয়েদের বয়স্ক-শিক্ষা ক্লাস নিতেন। আর তোমার এক মামু তো ছিলেন বাহাদুর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ হয়েছিলেন। নতুন এসেছিলাম তো, আমি ততটা খেয়াল করিনি। দেশের জন্যে যদি মারা যান, 888sport app download bd গ্রহণ করতে না-কি নিষেধ করে গিয়েছিলেন!

জ্বি স্যার, সত্য কথা। আমাকে মাফ করে দেবেন স্যার, আপনাকে আঘাত করার জন্যে আমি কিছু বলিনি। আমার সখিরা আছে না, ওদের ভেতরে আমার চাইতে আরো অনেক বেশি আগুন। একটু অছিলা পেলেই জ্বলে ওঠে।

হুঁ। সত্যি চাঁদ, আমি তাজ্জব বনে যাচ্ছি।

কেন, তেমন কথা তো আমি কিছু বলিনি।

বলনি, তাই। আমিও পাড়াগাঁয়ে জন্মেছি এবং গরিব ঘরে। কিন্তু দারিদ্র্যকে আমি ঘৃণা করতাম। সেজন্যে গৈগেরামকেও ছোট মনে করতাম। খুবই তুচ্ছ ভাবতাম। কিন্তু এই! এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে জনগণই উন্নত, জনগণই শ্রেষ্ঠ। শিক্ষিত সমাজের মনপ্রাণ জুড়ে কেবল কালি আর কালি-! প্রত্যেকেই সুবিধাবাদী ধূর্ত আর দুর্নীতিপরায়ণ-। তারা শাসক, শোষক।

ক্ষমা চাই স্যার, ক্ষমা। মনে হচ্ছে, সত্যই আপনাকে বড় আঘাত করেছি। আমি যা বললাম, তার কোনো অর্থ নেই। ফাঁকা বুলি। মৃত্যুর আগে মা বলে গেছেন, 888sport promo codeর অধিকার ও মর্যাদারক্ষার জন্যে জান দিবি, কিন্তু তবু কারো কাছে মাথা নত করবি না। আসলে আমরা তো কিছুই করতে পারি না। দড়িতে বাঁধা গবাদিপশুর চাইতেও আমরা অসহায়। আপনি আমার প্রতি রাগ করবেন না। কি, রাজি তো?

হ্যাঁ, চাঁদ। কিন্তু শুধু তা-ই নয়। আমি তোমার কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ – তুমি আমার চোখ খুলে দিয়েছ।

তারপর অনেকক্ষণ ধরে দুজনেই চুপ। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র সেতু, পার হচ্ছিল। নূর কোমর বেষ্টন করে ধরেছে, আপত্তি করতে পারেনি চাঁদবানু। অবস্থা এমন নিরুপায়। পূর্ণিমা যদি থাকত কথা ছিল না। কিন্তু এখন অল্প অল্প আভা – হালকা মেঘের আড়ালে কোথায় শশিকলা বোঝা যাচ্ছিল না। একটা-একটা সিলফারে পা দিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। চারদিকটা নিঝ্ঝুম। ভুল হওয়া অসম্ভব নয়। পেছনে কিংবা সামনে যদি নিশুতি রাতের গাড়ি আসার আওয়াজ হয়, তাহলে ভীষণ বিপদ। পেছনে যেতে পারবে না, সামনেও না। ইঞ্জিনের কাজ ইঞ্জিনকে করতে দিয়ে ঝিমায় অনেক ডেরাইভার আর তখন তার সামনের লাইট জ্বালানো থাকলেও পুলের ওপরে লোকজন আছে কি-না বোঝা মুশকিল। চাকার নিচে পড়লে তো ভর্তা। ভারসাম্য ঠিক রাখছে, অনেক জলদিতেই ওপারে পৌঁছল। হাঁপাচ্ছিল দুজনেই। পিঠে হাত রেখে নূর বলে একটু জিরিয়ে নিতে। সে আপত্তি করলো না। এমন নির্জনতা, ঘন হয়েই বসেছিল। মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে কোথাও- আধো আলো, আধো ছায়া। সে মুহূর্তে বাজুতে উষ্ণ হাতের একটি টান আর তিনটা শব্দ- একটা কিস্ করবো। নো- খবরদার। সটান উঠে দাঁড়িয়ে সামনে যাবার রোখ করে। ইউ আর সো ক্রুয়েল! ইয়েস ইয়েস। দৌড় দেয় না। কিন্তু লম্বা লম্বা পদক্ষেপ নিতে নিতে বলল, আপনার সঙ্গে যাচ্ছি। আপনার সঙ্গে থাকবো। কিন্তু আমার- আমার গায়ে হাত দেবেন না। আমার শেষ কথা।

এরপর নৈঃশব্দ। ট্রেন আসে, ট্রেন ছাড়ে। দুজনে কাছাকাছি। ট্রেন থামে, ওরা নামে। দুজন পাশাপাশি। রিকশার ক্রিং ক্রিং।

তোপখানা রোড, গলির ভেতরে একটি হোটেল। একটি ডবল রুম ভাড়া নেয়। নিচে খাওয়া-দাওয়া করে। একই টেবিল, মুখোমুখি। আবার সিঁড়ি, আবার দোতলা। বড় খাট, দুজনার। ওপরে গুটানো ছিল, ছেড়ে দেয় মশারিটা। দুই প্রান্তে দুই বালিশ।

আপাদমস্তক, কম্বলমুড়ি চাঁদবানু। মাথাও 888sport app। দেখা যায় শুধু নাকজোড়া। বাতি নেভায় না। রাত গভীর হয়, নূর চুপিচুপি। উঠে গিয়ে অফ করে। এখন যেন শুধু তরঙ্গ, আর বিদ্যুৎ-চমক। আসলে কিছছু না। খুব কালো আঁধিয়ার। একটা শরীর, উন্মত্তের মতো।

আচমকা, আচমকা ঘুম ভেঙে যায়।। সজোরে উঠে বসতে চায়, চিল্লান পারে না। শাড়ির আঁচলে মুখ বাঁধা। অসম্ভব ধড়ফড় করছে বুকের ভেতরটা। বুঝতে পারে, কে। প্রবল শক্তিতে। চেপে বসেছে লোকটা। দুই স্তন। একবার এটা, আরেকবার ওটা নিয়ে মাতামাতি। নিচে কুঁকড়ে ছিল। প্রাণপণেই যেন দুই হাতে চেষ্টা করে, খুলতে পারছে না। একি ধ্বনি, না কোনো একটা বাজনা- চাঁদ আমি, আমি। আমি মরে যাচ্ছি। একটু দয়া কর। দয়া, দয়া। একবার দাও। দাও, দাও। মুখের বাঁধন টেনে খুলে ফেলেছিল, দুই পা যুক্ত করে তার পেটে প্রচণ্ড একটা লাথ্থি মারল। মেঝের ওপরে ধপাস করে একটা শব্দ, তার সঙ্গে কণ্ঠস্বর, দিলাম, এই নাও!

এই তো, এ-ও একটা সময়। একটা দিন, সকাল সাড়ে নটার দিক থেকে সূর্যাস্তের রাত, রাত দশটা, বারোটা। তিনটা, চারটা। কেটে যাচ্ছিল, কেটে গেছে। কাজের বুয়া পান্নাখালা এসেছিল, সেই গালভরা পান, চিবোচ্ছিল – যেজন্যে এই নাম। গোসলের গরম পানির পাতিল নামায়, সাহেবকে ঠেলা দেয়, ডাকাডাকি করে তোলে। এমনি ভালো সম্পর্ক, রাগ হয় না তার, কটূক্তি করে না। এত বেলা ইস্তক যে নিদ্রা- কাজের উত্তেজনা, পরিশ্রম। আরো কিছু কারণ ছিল? না, না। গতরাত বাসায় ফিরতে বেশি দেরি হয়েছিল, একটানা জাগনা থাকায় গলা না ভিজিয়েও পারা যায় না। তাই সকাল বেলায় বেড-টির কাপ-পেয়ালা ছুড়ে ফেলে ভেঙেছিল, তার সবটা দোষ ওর ছিল না। কিন্তু কে এত বিচার করে! যতটুকু যেভাবে দেখা ততটুকুই ওদের বোধ্যতা। রাতের পরন বদলে হলদে-সবুজ-লাল মনোরম ডিজাইনের একটি টাঙ্গাইল পরেছে এবং মুখে তেমন বিষণ্নতা নেই, দেখে ভালো লাগল। আসলে চাঁদ, চাঁদের মতোই। দুপুরের খাওয়া হলো, মেঘটা কাটিয়ে দিতে ঠাট্টা-মশকরাও করল কিছু। বিকালে টেলির যন্ত্রযান এসে গেল ঠিক চারটায়। ছেলেদের মুখ দেখেই বুঝেছিল এরা ভদ্র, সুশীল, পরিচ্ছন্ন। ঘণ্টাখানেক আগেই তৈরি হয়ে যায় – চরিত্র অনুযায়ী সকল কস্টিউম ও অর্নামেন্টের ব্যবস্থা নির্মাতারাই করবে জানিয়েছিল, তবু শাহনূর একটা সেট আনবে বলেছিল। সেজন্যে ওর সুদৃশ্য ট্রাভেলিং ব্যাগটা গিয়ে খোলে। সব পেয়েও যায়; কিন্তু সঙ্গে আরো কিছু ছিল। ছুরি, ড্যাগার, চাপাতি, দড়াদড়ি। বিয়ারের ক্যান, একাধিক ডজন; এবং নানা ধরনের মদের বোতল। সে ভীষণ দমে গিয়েছিল। কিন্তু কেন এগুলো, কিছছুই ভাবতে পারলো না। ইয়ার-বান্ধবের মিলনমেলা, যা হবার হোক। এটাই যখন কালচার দুর্ভাবনাও বেকার। পান্নাখালা দরাজদিল, কিন্তু গোয়েন্দাগিরির কিছুটা অভ্যাস আছে। বিশেষত, যখন দেখে মহব্বত কা নিশানা। নায়ক গোসলে ছিল, তখন বিছানা করতে গিয়ে পেয়ে যায় একটা চৌকোনো বড় খাম। খুলে দেখে, পাঁচ-ছয়জন সুন্দরীর ছবি। এ বাসায় এসেছে, দুজনকে চেনেও বটে। কিচেনে ছিল, চাঁদের কাছে প্রায় দৌড়ে যায়। ভেবেছিল বিরাট কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে। কিন্তু হতাশই হলো, চাঁদের বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না। খুলে দেখাতে বললে, একটা-একটা বার করে। সব দেখালে নিস্পৃহ মৃদুস্বরে বলে এগুলো ওর হিরোইন। পেশাগত পরিচয় তার বেশি কিছু না, এমন একটা ভাবও চেহারায়।

এখন তো পাত্তা দিচ্ছ না। এক বড় চিমটি জর্দা মুখে দিয়ে বলল পান্নাখালা, আমি কী ভাবছি টের পাবে কইলজা ধইরা টান দিলে। আমি হুনছি, এই মৌরী মেয়েটা মারাত্মক। তার অনেক প্রেমিক!

খুব আদরের চোখে দেখে চাঁদবানুকে পান্নাখালা। তার এই বয়সী একটা মেয়ে ছিল, ডেলিভারি কেসে মারা যায়। তার সন্দেহ হয়, জামাইটির কারবার। সে চকের একজন ছোট ব্যবসায়ী, এক নম্বর বদমাশ। পাড়ায় যেত।

অনেকটা অকারণেই মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তার বাঁধা কাম। যে-সময়ে যেটা তা-ই করে। মিনিকে পাশের বাসা থেকে কোলে করে আনে, গোসল করায়। পাটভাঙা হালকা জামা-কাপড় পরিয়ে মায়ের কোলে দিল।

শাওয়ার বাথ নিয়ে শোবার ঘরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ালে নূরকে হ্যান্ডসাম লাগছিল। মফস্বল থেকে পালিয়ে আসার পর দুই রাত অসহ্যরকম কেটেছিল, কিন্তু তৃতীয় দিনে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় : হোটেলটির কাছে, পুরানা পল্টনে, বেশ কাছেই ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের অফিস ছিল। দুর্বোধ্য নূরউদদীনকে প্রায় ধরে নিয়ে গিয়ে আধুনিক রীতিতে বিবাহটা সম্পন্ন করে। অবৈধতার প্রশ্নটি আর রইলো না। এখন দেখছে, খসমটির চেহারা জিরো নয় এবং সে হিরোও হয়ে গেছে, সুতরাং ইচ্ছা করেই কিছু-কিছু ছাড় দেয়। সিরিজটা নেয়ার পর থেকে বিনোদন পত্র-পত্রিকাগুলোতে লাইমলাইটে এসেছে। বড়সড় রঙিন ছবি ছাপা হয়। ওঠে সাক্ষাৎকার। কী পছন্দ-অপছন্দ! নায়িকা মৌরীর সঙ্গে ক্রমান্বয় ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের গুঞ্জনটাও আস্তে-ধীরে যেন পল্লবিত হয়ে উঠছে। এতদিনে যেন হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছে চাঁদ শাহনূরকে, প্রথমদিকে একবার যে-মন্তব্য করে ফেলেছিল সেরকমই – আসলেই ভীরু। যে-কাজ ও যে-পরিবেশ তাতে তার প্রেম-প্রেম খেলা অসম্ভব হবে না, কিন্তু এটুকুই। আর বেশি সামনে বাড়বে না।

আড়ালে গিয়েছিল। আঁচলের নিচে মায়ের দুধ খাইয়ে মিনিকে পান্নাখালার হাতে তুলে দিল। ওকে পাশের বাসায় নির্দিষ্ট কামরায় ঘুম পাড়াবে। ছুটির দিনে যা হয়, এদিকে দুজনে টেবিল সাজিয়ে দুপুরের আহার শেষ করে। সবই আটপৌরে, একটি জিনিস শুধু নতুন, তা হলো, স্বামী অন্যদিকে মনোযোগ দিলে আড়চোখে চাঁদ তাকে দেখছে এবং স্ত্রীরও তেমন অবস্থায় নূর ওর দিকে তাকিয়ে থাকছে। ওরা কী জানতে চায়, কী বুঝতে চায়? আরো কী বাকি আছে? একটি সিনেমা-কাগজে উঠেছে নায়ক শাহনূরের গোপন চিঠির অংশ : মৌরীকে লিখেছে, তোমাকে চাই আমি, শুধু তোমাকেই, যা চাও তাই দেবো উজাড় করে, আমাকে বাঁচাও। এটা হতে পারে একটা গসিপ, কোনো সাংবাদিকের লীলাখেলা। তা হয় না?

আর শাহনূরের মনে হয় ফিল্মলাইনে যাওয়ার পর থেকে চাঁদবানুর চোখের চাউনিতে কী এক অগাধ রহস্যের অঞ্জন লেগেছে – সে কারুর ভালোবাসায় মজেছে নাকি?

এইসব, এমনি এমনি। স্পষ্ট হোক কিংবা অস্পষ্ট, কেউ কিছছু বুঝতে পারে না।

একটি মিনিটও দেরি হয়নি, বরং দুতিন মিনিট বাকি আছে, চেক গ্রামীণ পোশাক, জুতায় খুটখাট শব্দ করে হেঁটে গিয়ে ওঠে থেমে থাকা মাইক্রোবাসটায়, কিন্তু ভেতরে যাওয়ার পর বসবার সময় বাইরে তাকাতেই দেখে শাহনূর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা বেজার। ওহ্ হো, ভুল হয়ে গেছে, তক্ষুনি নেমে কাছে গেল এবং ঝট্ করে নিচু হয়ে পা-জোড়া ছোঁয়। কোমলস্বরে বলল, আমার জন্যে দোয়া করো। যেন তোমার নাম রাখতে পারি। তোমাদের পার্টির মজাটা পেলাম না, আফসোস লাগছে।

শাহনূর কোনো কথা বলতে পারলো না। স্টার্ট নিয়ে গাড়িটা ব্যাক করে চলতে থাকলে তার ভেতরে চাঁদবানুকে দেখে, তখন সে হাত নেড়ে বিদায় নিচ্ছিল। আড়ালে চলে গেলে সে ঘরের ভেতরে যায়।

ভোর চারটার দিকে যখন বাসটি ফিরে এলো তখন কলকাকলি করতে করতে পাখিরা উড়ে যাচ্ছে। ঘুমঘুম, তবু তিনটে তরুণের মুখ উদ্দীপ্ত, কৃতজ্ঞ। বিদায়ের সৌজন্য দেখাতে নেমেছে। চাঁদ যখন সবচেয়ে বিনীত ও সুদর্শন ছেলেটির সঙ্গে কথা বলছিল, এমন সময় কোটপরা উদ্ভ্রান্ত শাহনূর ভেতর থেকে ছুটে আসে, তার ধাক্কা লেগে নিচে পড়ে যায় চাঁদবানু। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়াল। সিরিয়াল টিমের বড় কালো গাড়িটা চলে যেতে ক্রমে পেছন হটছিল, দুই হাত তুলে চিৎকার করে উঠল, আমাকে ফেলে যেয়ো না, যেয়ো না। আমাকে নিয়ে যাও। আমার জীবনকে তোমরা নিয়ে যাচ্ছ, আমি এখানে থাকবো না। ওকে নিয়ে আবার ফিরে আসবো – ফিরে…

ওর কথা শেষ না হতেই একসঙ্গে যেন দুতিনটি আগ্নেয়াস্ত্র চারদিক প্রকম্পিত করে গর্জে ওঠে। চোখ-মুখ-বুক, তার সমস্ত শরীর নিমেষে ঝাঁঝরা হয়ে যায়, গোঙানির মতো গরগর আওয়াজ, কাত হয়ে ধপ করে পড়ে যায় মাটির ওপর।

কাঁপছিল থরথর করে, জুতো খুলে পড়ে গেছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে আসে চাঁদবানু, লেপটে বসে পড়ে। রক্তাক্ত মাথাটা তুলে নেয় কোলের ওপর। ফরসা হয়ে গেছে। সব দেখা যায়, কিছুটা ঝাপসা হলেও। প্রাণ যায়নি এখনো। একটু কাত হয়ে চাইলে ওর হাতে ধরে। সাহায্য করে। সব কথা স্তব্ধ। ওর মুখটা যেন দেখতে চাইছে, কিন্তু আসছে না দৃষ্টিতে। সে-অবস্থায়ই চোখের কোণ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। জান চলে যেতে চাচ্ছে, যেন পারছে না। কষ্ট, বড় কষ্ট। তৃষ্ণা, তৃষ্ণা। আশপাশে যারা এসে ভিড় করেছিল, তারা কিছছুই অনুভব করতে পারছে না। চাঁদবানু, হ্যাঁ চাঁদবানুই, ঠাহর করেছে। সে ঝুঁকে পড়ে এবং আঁচলের নিচে ওর ডানস্তনটা হাতে ধরে, বডিস থেকে বার করে। মুখ কিছুটা হা করাই ছিল, বোঁটাটা তার মধ্যে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল ফিসফিস, টানেন, খান, পিয়াস থাকবে না। ওর কথা শুনলো কি শুনলো না, সে বুঝলো না। ক্রমে শান্ত হয়ে আসে ছিন্নভিন্ন তার দেহটা ঢেউ উঠেছে, আস্তে আস্তে থেমে যায় হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন।

ইতোমধ্যে ফজরের আজান হয়ে গেছে। জরুরি কল পেয়ে দলবল নিয়ে কর্তব্যরত ওসি এসে পড়েছেন। ঘরগুলোর ভেতরে গিয়ে সরজমিনে সবকিছু দেখলেন। বাইরে টেবিল-চেয়ার দেয়া হলো। বসে ঘণ্টাখানেক স্থানীয় বাসিন্দাদের জবানবন্দি নিলেন। বাছাই আলামত জড় করলেন এবং বাসার কক্ষগুলো সিল করার পর আবার নিহতের কাছে এলেন।

রোদ উঠে গেছে। মহল্লার ছোট-বড়, বুড়ো, প্রবীণ-নবীন, সবাই এসে ভিড় করেছে।

মোটা-তাজা কনেস্টবলের হাতে সদ্যখোলা হ্যান্ডকাপটা ঝুলছিল। মাননীয় ওসি সাহেবকে উপবিষ্ট করাবার জন্যে লোকারণ্যের ভেতর দিয়ে বাড়িওয়ালার কুশন-চেয়ারটা এসে গেল। দিন নেই, রাত নেই, বড় ঝামেলা। তিনি আসন গ্রহণ করে চাঁদবানুর দিকে তাকালেন; ওর তখন গ্রামকন্যা অভিনয়ের কাপড়চোপড়ই পরা ছিল। খুবই বিপর্যস্ত; কিন্তু সপ্রতিভ, শান্ত চেহারা।

তমিজ দেখালেন ওসি সাহেব, সহানুভূতির সুরে বললেন, ম্যাডাম! জানেন তো আমরা হুকুমের চাকর। আমরা আইন-কানুনের সংরক্ষক। রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রেখেছি। আপনার বাসায় যে-কাণ্ড ঘটেছে তা অতিশয় মর্মান্তিক ও ভয়ংকর। বাইরের লোকেরাই এসে করেছে, বিভিন্ন সাক্ষ্য থেকে তা আমরা প্রাথমিকভাবে জেনেছি। কিন্তু আপনি পরিবারের মধ্যমণি, আপনি এর নাড়ি-নক্ষত্র সব জানেন। আপনাকে আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে। থানায় যেতে হবে আমাদের সঙ্গে। ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট!

বেশ তো, থানা কোথায়, আমাকে নিয়ে চলুন। শাহনূরের জর্জরিত চেহারাটা একদৃষ্টে দেখতে দেখতে উঠে দাঁড়াল। আজব জন্তু যেন একটা, দারুণ আগ্রহ নিয়ে সবাই তাকে দেখছে। প্রথম পেশার সাজ সে নষ্ট করলো না, মাথায় কাপড় টানলো না, চাঁদবানু স্নিগ্ধ স্বরে বলল, উনি আমার বিবাহিত স্বামী ছিলেন, কিন্তু অন্য কেউ- তাঁকে আমি চিনতাম না। আমাদের পবিত্র আইন যদি প্রমাণ করে আমাদের মধ্যে মিলমহব্বত ছিল না, আমিই তাকে খুন করিয়েছি- তবে তো ন্যায়বিচারে আমারও মৃত্যুদণ্ড হবে। একজন বেগানা আদমির জন্যে জান দেওয়া তো আরো অনেক বড় সোয়াব। জান্নাতুল ফেরদাউস শিউর, কি বলেন?

উপস্থিত সবাই ভাবল, খুন-খারাবির প্যাঁচে পড়লে লোকের মাথা খারাপ হয়ে যায়, এ মেয়েটিরও তাই হয়েছে।