প্রশান্তধাম

আজকাল গল্প নিয়ে কেউ ভাবে নাকি?

গল্প তো গল্পই। এ নিয়ে অত ভাবনা-চিন্তার কী রয়েছে? বায়বীয়, ফাঁকা, মূল্যহীন যে-বস্তু, তাকে পাত্তা দেয় কেউ?

আসলে গল্পের ভাগ্যে সব কালে অবহেলাই লেখা থাকে। কেউ কেউ তো ঠোঁট উল্টে বলেই দেন, ‘এগুলা বিশ্বাস করো? সব গল্প, বুঝলা?’ এমনভাবে বলবে, শুনলে মনে হবে, গল্প বুঝি পাড়ার কোনো চালচুলোহীন পাগল ছেলে একটা। সারাক্ষণ শুধুই টিটকিরি আর উপহাস প্রাপ্য।

অথচ গল্প ছাড়া চলেও না। একে অস্বীকার করা যায় বটে। তবে কিছুতেই বাদ দেওয়া যায় না। তখন সবকিছু আলুনি তরকারির মতো বিস্বাদ হয়ে পড়ে। মুখে তোলা দায়।

এই যে মাসুদদের পরিবার, যারা এককালে ছিল ছবির মতো ছায়াসুনিবিড় মন্মথপুর গ্রামের বাসিন্দা, লেখাপড়া শিখে নিজেদের লুকাতে এখন কানাডায়, তারা কি এত বছরেও ভুলতে পারছে হারানো দিনের সেসব গল্প?

তৃতীয় জেনারেশন চলছে ওদের। মাসুদ এখন রীতিমতো বৃদ্ধ। পরের জেনারেশন জানেই না মন্মথপুর কোথায়। সুদীর্ঘ সময়ের অভিবাসী জীবনে শুধু একবার, তাও মাত্র ক-বছর আগে, সম্ভবত দু-হাজার 888sport cricket BPL rate-বাইশ হবে, সবাইকে নিয়ে মাসুদ সেখানে পা রেখেছিল। কম্পন যা হয়েছে তা ওর চলৎশক্তিহীন আব্বা কুদ্দুছ খান, ছোট ভাই আলতাফ খান আর ওর ভেতর। বাকি সবাই তো বেড়ানোর মুডে ছিল, মউজ-মাস্তিভরা বেলুন এক-একজন।

মাসুদের আম্মার 888sport sign up bonusর মতোই কালো কুচকুচে জলের সেই মন্দবাসা মন্মথপুর থেকে বলতে গেলে প্রায় অপহৃত। আবর্জনা আর দুর্গন্ধ মিলে বদ্ধ নর্দমায় পরিণত হয়েছে একদা উচ্ছল প্রাণবন্ত সেই নদী। প্রশান্তধামও আর নেই। সেখানে সরকারি মার্কেট হয়েছে। পান-সুপারি, গরুর মাংস থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের ফুল-লতা, সব। শুধু প্রশান্তধামের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না কোথাও। হয়তো নিলামে ওঠার পর কোনো ঠিকাদার ইট-পাথরগুলো ট্রাকে তুলে নিয়ে ভরাট করেছে কোনো রাস্তা।

তবু প্রতি পদে মাসুদকে তাড়া করেছে প্রশান্তধাম আর মন্দবাসার গল্পের ভূত। রিখটার স্কেলে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে ওরই অন্তর্মূলে।

এ গল্প ছাড়া আর কী?

আর মন্মথপুর? শুধুই একটি বাণিজ্যিক উপশহর। বিল্ডিং আর দোকানময় চারধার। কিছু নেই বাস্তবে। ওরাও সেখানে অপরিচিত অভ্যাগত। হোটেলে থাকতে হয়েছে এক রাত। পরে কক্সবাজার ঘুরেফিরে চলে এসেছে কানাডায়। সবাই বলে, এ হলো 888sport apps সফর। শুধু ওরা কজন এখনো গল্পের মোহে বলে, আমাদের মন্মথপুর!

ওদের ভেতরই মন্মথপুরের গল্পটা, বিশেষ করে মাসুদের ভেতর, এমনভাবে গেঁথে রয়েছে যে এখান থেকে ছাড়া পাওয়ার কোনো রাস্তা চেনা নেই ওদের।

গল্পের স্বভাবটাই এমনতরো। তুমি যতই লুকাতে চাও নিজেকে, গল্প একবার ঘাড়ে চেপে বসলে তা থেকে রেহাই মেলে না কখনো।

জমিদারের একদা লাঠিয়াল ছিল কুদ্দুছ খান। সন্তান উচ্চশিক্ষিত হওয়ায় কলঙ্কময় আত্মপরিচয় আর অন্ধকার পরম্পরা নিয়ে ওদের ভেতর লজ্জা দানা বাঁধতে শুরু করে। সেসব ঢেকে ফেলতেই মাসুদ উদ্যোগী হয়ে কানাডায় চলে এলো সপরিবারে। ভেবেছিল, দুর্গন্ধময় পচা শেকড় থেকে উন্মূল হলে ওরা বুঝি সুখে থাকবে। ভেবেছিল, ওরা সবাই মিলে টরন্টোকে ভালোবাসবে নতুন করে। এখানকার বরফ আর প্রকৃতি বুঝি অন্য এক গল্পের জন্ম দেবে ভেতরে। কিন্তু বাস্তবে মন্মথপুরেই পড়ে রয়েছে ওরা কজন। যত ভুলতে চেয়েছে নিজেকে ও নিজেদের অতীত, ওদের অন্তরাত্মা তত মিশে গেছে শৈশব-কৈশোরের মনোরম বাগানের সৌরভময় মোহাচ্ছন্ন বসন্ত-বাতাসে।

চাইলেও পিছু ছাড়ে না। দিন যত এগোচ্ছে সুপার গ্লুর মতো গাঢ় হচ্ছে সেই সম্পর্ক।

অপারগ মাসুদ, যে কি না এ-গল্পের প্রধান চরিত্র, সুযোগ পেলেই একনাগাড়ে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। কানাডা কিছুতেই আর আপন হয় না। বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মতো কেবল দূরে-দূরে থাকে, কাছে আর আসে না!

কুদ্দুছ খানের বড় সন্তান মাসুদ স্বভাবের দিক থেকে ছিল অন্য টাইপ।

সেটা ছোটবেলা থেকেই বুঝতে পারত ওর আব্বা।

মেজাজ-মর্জি ঠিক তারই মতো। রাগ হলে নিমেষে হিংস্র হয়ে পড়ত। আদর করে যতই ‘চল মসু, প্রশান্তধাম থেইক্যা ঘুইর‌্যা আই’ বলে কোলে তুলতে চাইত ছেলেকে, ততো সে বেপরোয়া হয়ে বলত, ‘আমি কারো কোলে চড়ি না। আমি একলা যামু।’

শুধু প্রশান্তধাম কেন, মাসুদ স্কুলেও যেত একাকী। হাজার বললেও ছোট ভাই আলতাফকে সঙ্গে নিতে চাইত না। দামি পোশাক-পরিচ্ছদ পরতে চাইত। দামি খাবারের দিকে লোভ ছিল বরাবর। সবচেয়ে বড় কথা – সে কখনোই না শুনতে পারত না। না শুনলেই খেপে যেতো; মুখের এক অদ্ভুত ভঙ্গি করে বলে উঠত, ‘তুমরা আমার মা-বাফ না। তুমরা কেউ না।’ চোখ দিয়ে অবিরল জল ঝরত ক্ষোভে-দুঃখে-অভিমানে। এতটুকু ছেলের চেহারা কেমন যেন অপরিচিত লাগত তখন। রাগী আর একরোখা।

‘তাইলে তর মা-বাফ কেডা?’ আমেনা ওর গাল টিপে ঠোঁটের কোণে হাসি ছড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে। পাশে দাঁড়ানো কুদ্দুছ খানের চেহারায়ও মিটিমিটি হাসির ছোঁয়া।

‘আমার আসল মা-বাফ থাহে হিগন। আমার জীবনে একডা ফাড়া আছে। ওইডা কাডানের লাইগা পইড়া রইছি তুমরার ইগন।’ বলে আঙুল তুলে প্রশান্তধাম দেখিয়ে দেয়।

কথাগুলো মাসুদ এমনভাবে বলত যে, তৃতীয় কোনো ব্যক্তির কানে গেলে মনে হবে ঘটনা সত্যি কিংবা কেউ শিখিয়ে-পড়িয়ে রেখেছে দুধের এই বাচ্চাটিকে। বাপের মুখে শোনা রূপকথার কোনো এক গল্পই হয়তো এরকম এক বিটলামি করে ফেলেছে এটুকুন দুধের বাচ্চার সঙ্গে।

গল্প আর কিছু পারুক বা না পারুক, এগুলো খুব পারে!

কিন্তু কুদ্দুছের কাছে এসব গর্হিত কথা, পাগলামোর নামান্তর। তাই সে শোনার সঙ্গে সঙ্গে জিভ কাটত। ওর চোখের দৃষ্টি ঘন ঘন রং পাল্টাত। শিলপাটার মতো বিশাল মুখ তার। সেখানে শৈশবের বসন্তের দাগগুলো যেন ওকে আরো অস্বাভাবিক আর হিংস্র করে তুলত। সে আমেনার দিকে তাকিয়ে পিটপিট করা চোখে বলত, ‘এইডা কি আমার পোলা?’

‘আস্তাগফিরুল্লা। এইডা আপনে কি কন? ছিঃ।’ আমেনা লজ্জা-শরমে বারবার করে মাথায় ঘোমটা টানত। যেন ঘোমটা তুলে দিলে এসব প্রশ্নের অন্তর্নিহিত পঙ্কিলতা ওকে আর স্পর্শ করতে পারবে না।

‘নাইলে অদ্দুরা পুলা এই কতা কয় কেমতে? ওই পুলা, তরে এই কতা শিখাইছে কেডা?’ কুদ্দুছ খান মাসুদের শরীরে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে। তাতেই ওর শিশু-শরীর শন-বাঁশের কুঁড়েঘরের মতো নড়ে ওঠে।

তবু মাসুদ ভাবলেশহীন মুখ করে ওর সামনে দাঁড়িয়ে থাকত। বুক টান করে কুদ্দুছের চোখে চোখ রাখত। তারপর বারো-তেরো বছরের ছেলেটি উত্তর দিত, ‘কেডা আবার কইব? আমি সব বুঝি। আমারে ইংলিশ প্যান্ট কিন্যা দিবানি কও? নইলে আমি হেই বাড়িত যামু গা। হেরার কাছে প্যান্ট খুঁজুম। আমারে খুব ভালা পায় হেরা। দিবানি কও?’

কুদ্দুছ ছেলের শরীরে এবার দু-হাত দিয়ে সত্যি-সত্যি ঝাঁকুনি দিয়ে বলত, ‘আরে হারামজাদা, হেরা জমিনদার। তুই তো লাইট্টলের ফোলা। অত বয়স অইছে, হিডাও বুজছ না উল্লু কুনহানের?’

‘আগে আমারে ইংলিশ প্যান্ট কিইন্যা দিবানি কও? নইলে গেলাম গা। হেরার থেইক্যা লমু। হেরাই আমার
মা-বাফ।’ বলে ছুটে যেতে চাইত প্রশান্তধামের দিকে।

পেছন থেকে কুদ্দুছ খান ওকে ধরে ফেলত। তারপর শুরু হতো বাপ-পুতের বাৎসল্যমাখা জাবড়াজাবড়ি-ধস্তাধস্তি।

যতক্ষণ না কুদ্দুছের কাছ থেকে মাসুদ প্যান্ট বুঝে পেয়েছে, ততক্ষণ সে এভাবেই কাহিল করে রাখত ওর জন্মপিতাকে।

মাসুদ যে সরকারি স্কুলে পড়ত, সেখানেও গোল বাঁধিয়েছে কয়েকবার। ওকে কেউ ‘বাড়ি কই’ জিজ্ঞাসা করলেই সোজাসুজি বলে দিত, ‘প্রশান্তধাম।’

একদিন কুদ্দুছ খানকে ডেকে পাঠালেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আলী রেজা খান। এলাকার সম্মানিত মানুষ তিনি। তাঁর সামনে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কুদ্দুছ।

কিছুক্ষণ ওর দিকে বিরক্তিভরা চোখে তাকিয়ে রইলেন রেজা সাহেব। তারপর বলে উঠলেন, ‘এই যে কুদ্দুছ মিঞা, এইসব কি শিখাইতেছ পুলারে, এ্যা?’ স্থানীয় লোক। বদলি হয়ে বাড়ির কাছে এসেছেন। সবাই তাঁর জানাশোনা। কথার সুরেও একই এলাকার টান।

‘কিতা অইছে মাস্টারসাব?’ কাতর গলায় প্রশ্ন করে কুদ্দুছ খান। উৎকণ্ঠায় মন জবুথবু।

‘তুমি জানো না? তোমার ব্যাটারে বাড়ি কই জিগাইলেই প্রশান্তধাম দেহাইয়া দেয়। এক ছেলেরে কইছে হের আসল মা-বাফ নাকি জমিদার জনার্দন রায় আর নন্দিনী রায়। এসব উল্টাসিধা কী শিকাইতেছ কও দিহি? পরে তো এই পুলা হাউরের ডাকাইত অইবো। একদিন জমিদারবাড়িত গিয়া ডাকাইতি করবো, বুঝো না কুস্তা?’

মাসুদের ওপর সেদিন বড় রাগ হয়েছিল কুদ্দুছ খানের। বাড়ি ফিরে গুম হয়ে বসেছিল অনেকক্ষণ। তখন ছেলেটাকে কাছে পেলে হয়তো মশলার মতো হাত দিয়েই পিষে ফেলত। হাতের কাছে ছেলে না থাকায় জানে বেঁচে গেছে তখন।

মাসুদকে পেল বিকালবেলায়। রাগ তখন কমে এলেও গয়াম গাছের একটা কচি ডাল ভেঙেছিল ওর পিঠে। মাঝখানে আমেনা এসে ওকে বাঁচিয়েছে। বউর পিঠেও বেহুদা দু-চার ঘা পড়েছে। তা সত্ত্বেও ছেলেকে বাঁচাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল আমেনা বিবি, ‘পুলাডারে কিতা মাইরা লাইবেন? ছাড়েন, ছাড়েন। আফনের পায়ে ফড়ি, ছাড়েন।’

পাড়া-প্রতিবেশী অনেকেই মাঠে বসে বড় পর্দায় সিনেমা দেখার মতো সেই দৃশ্য দেখেছে। অনেকদিন পর যেন
এ-তল্লাটের নামকরা লাইট্টল কুদ্দুছ খানের হাতের নির্দয় কেরামতি দেখে ওরা খুব আনন্দ পাচ্ছে।

তবু মাসুদের মাথা থেকে প্রশান্তধাম যায়নি কোনোদিন। চোখ মুছতে মুছতে কেবলি বলতে থাকে, ‘তুমরা আমার কেউ না। দেইক্য, একদিন আমি ওদের কাছেই চইলা যামু। দেইক্য তুমরা।’

ছোট ভাই আলতাফ একেবারে উল্টো স্বভাবের। ভীতু, কোমল আর বাধ্য এক সন্তান।

বড় ভাইয়ের দুর্দশায় ওর চোখ থেকে অবিরাম জল গড়াচ্ছে। ভাইকে জড়িয়ে ধরে সে বলছে, ‘ভাই, তুমি ইগনই থাকবা। কুনখানে যাইবা না।’ ছোট ভাইর কান্নার শব্দে সবাই হতবাক। ভ্রাতৃপ্রেম যে এত গভীর হতে পারে তা দেখে

পাড়া-প্রতিবেশীদেরও চোখ ছলছল করে ওঠে।

কুদ্দুছ লাইট্টলের সন্তানভাগ্য দেখে তখন অনেকের

শরীর-মনে ঈর্ষার চুলকানি দেখা দিত।

‘ছাড় আমারে। আমি তরার কেউ না।’ বলে কাঁদতে কাঁদতে মাসুদ প্রশান্তধামের দিকে এগিয়ে যেত। কেন যেন ওর মনে হতো, যত সুখ সব ওরই জন্য জমা রয়েছে ওই প্রশান্তধামের গাছে-গাছে, এর আনাচে-কানাচে।

কিন্তু মাসুদ ঢুকতে পারত না সেখানে। কাঠ ও লোহার তৈরি বিশাল সিংহদরজার সামনে মুছুয়া এক দারোয়ান বসে থাকত ।

ওকে আসতে দেখলেই বলে উঠত, ‘ওই যে লাইট্টল কুদ্দুছের বান্দর ফুতটা আইছে। হাহাহা। কী রে, তর বাড়ি কই?’

এতটুকু না টসকে বুক টান করে মাসুদ উত্তর দিত, ‘এইডাই আমার বাড়ি।’

অন্য যারা ছিল সবাই একসঙ্গে হি-হি করে হেসে উঠত। সেই হাসিতে মিশে থাকত তীব্র বিদ্রূপ আর উপহাস।

এখনো চোখ বুজলে করুণামেশা সেই হাসির অনুরণন মাসুদ শুনতে পায় নিজের ভেতর। বুকটা জ্বালা করে ওঠে তীব্র দহনে!

দুই

নদীর নাম মন্দবাসা।

এমনিতে কুচকুচে কালো জল তার; তবে রোদ পেলে জলের রং কাচের গুলির মতো দেখায়।

গ্রীষ্মের দুপুরে নীলাকাশ যখন নগ্ন মন্দবাসার বুকের ওপর স্থির চোখে তাকায় তখন বারবার করে যেন নদীর রং বদল হতে শুরু করে। এমনিতে গায়ের আদি রং পাকা তালের মতো; তবু কখনো আকাশ কাছে চলে এলে
ক্ষণে-ক্ষণে হীরা-পান্না-মুক্তার গহনায় রূপ-বদল হয় মন্দবাসার। সুখের সময় ওটুকুই।

রোদ পড়ে এলে হাওয়ায় দীর্ঘশ্বাস ভেসে বেড়ায়। তীরঘেঁষা বৃক্ষরাজির অন্তরভরা থোক-থোক বেদনা সেখানে মিশে থাকে। কেননা মন্দবাসা নামের এক দুঃখী পরীর দেহকাণ্ড ঘিরে এ নদীর-বহতা অস্তিত্ব। এ-তল্লাটের অনেকেই সেসব বিশ্বাস করে। সেই বিশ্বাস থেকে বহুকাল মন্দবাসার বুকে খলবল করা মাছ খায়নি এ-তল্লাটের লোকজন।

মন্দবাসাকে নিয়ে গল্পটাও বেশ চমকপ্রদ। হঠাৎ একদিন প্রশান্তধামের পূর্বপুরুষগণ ঘুমের ভেতর কোনো এক 888sport promo codeর কান্নার শব্দ শুনতে পান। অথচ চোখের সামনে কাউকে খুঁজে না পেয়ে আন্দাজে পেছনের খিড়কি দুয়ার খুলে তাকাতেই তাঁরা বিস্মিত ও হতবাক হয়ে পড়েন। চোখের সামনে দেখতে পান চুলের মতো কুচকুচে কালো এক জলধারা। এ কীভাবে সম্ভব? রাতারাতি কিভাবে এ-জলধারা ওদের সুরম্য অট্টালিকার গায়ে এসে আছড়ে পড়ছে? তখনই সেই পরীর মৃত আত্মা ওদের সামনে আবির্ভূত হয়ে তার করুণ জীবনগাথা শোনাতে শুরু করে।

মন্দবাসা এক পরীর নাম। কিন্তু পরীরা সাধারণত যেরকম সুন্দরী হয়ে জন্মায় সে তা নয়। ওর গায়ের রং কালো। পরীদের রূপনগরে মন্দবাসা ব্যতিক্রম হওয়ায় সে সবার তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হতে থাকে। ওর সঙ্গে কেউ কথা কয় না, মেশে না। সবাই শুধু ওর সঙ্গ এড়িয়ে চলতে চায়; একধরনের শঙ্কা নিরন্তর ওদের পিছু ধাওয়া করে বেড়ায়, পাছে ওরা কেউ মন্দবাসার মতো হয়ে পড়ে, সেজন্য।

একসময় পরীরাজ্য রূপনগরের রানীর নির্দেশে ওকে বন্দি করে একটি আলো-বাতাসহীন ঘরে রেখে দেওয়া হয়। কেউ একজন রানীকে বোঝায় যে, মন্দবাসার নিশ্বাসেও বিষ থাকতে পারে, যা বাতাসে মিশে অন্যদের সৌন্দর্যহানি ঘটাবে। সবার একটাই ভয় – ওকে বড় হতে দিলে একসময় অন্যরাও ওর মতো কালো-কুৎসিত হয়ে পড়বে। পরীরাজ্যে কালো মানেই কুৎসিত কদাকার এক অস্তিত্ব। ওদের কাছে গায়ের কালো বর্ণ মানে মৃত্যুর মতো সমার্থক এক পরিণতি। তাই কেউ ওর মতো হয়ে বাঁচতে চায় না। এসব শুনে-শুনে কান ঝালাপালা পরীরানীর। অগত্যা একদিন ক্ষিপ্ত হয়ে মন্দবাসাকে মেরে ফেলার আদেশ দেন তিনি।

বন্দি মন্দবাসা একা একা ঘুরঘুর করে ঘরের ভেতর। সে উড়তে পারে না, নাচতে পারে না, হাসতেও পারে না। পরীদের অপরূপ সব গুণ একে একে ওর কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছে সবাই মিলে। বিষণ্ন, নিঃস্ব, পরিত্যক্ত এক মন ছাড়া গর্ব করার মতো ওর কাছে কিছু নেই। এখন ওকে প্রাণটাও দিতে হবে। পরীরানীর পক্ষ থেকে সে-কথাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বয়স হওয়ার আগেই সে ঝরে পড়ছে পরীরাজ্য থেকে। এজন্য ওর কান্নাও পাচ্ছে না। কারণ অমর সৌন্দর্যের লীলাভূমি পরীদের রাজ্যেও যে মৃত্যুর মতো অন্ধকার ঘনিয়ে আসতে পারে তা তখনো ওর বোধগম্য হয়নি।

কিন্তু এ-গুরুদণ্ড অন্য সবাই মেনে নিলেও মন্দবাসার মা ভালোবাসা শুরু থেকেই তা মেনে নিতে পারেননি। তিনি পরীদের গুরুমায়ের কাছে গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়েন, ‘মা, মাগো। আপনি আমার এ অবুঝ কন্যাটিকে বাঁচান। দয়া করুন।’

‘এ পরীরানীর আদেশ। এ কি কখনো খণ্ডানো যায়, ভালোবাসা?’

‘আপনি পারেন। আপনি ওর প্রাণ বাঁচান গুরুমা।’

গুরুমা কদিন গভীরভাবে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে থাকেন। তারপর ছুটে গেলেন পরীরানির কাছে। গুরুমার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে পরীরানি বলে উঠলেন, ‘আপনি যতই অনুরোধ করুন, আমি অপারগ, আমার হাত-পা বাঁধা গুরুমা। মন্দবাসাকে থাকতে দেওয়ার অর্থ পরীদের এ-স্বর্গ ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া। যে সৌন্দর্য নিয়ে
স্বর্গ-মর্ত-পাতালে আমাদের এত খ্যাতি, সেটুকু আর থাকবে না। কালো-কুৎসিতকে কে পছন্দ করে বলুন গুরুমা?’

‘কথা ঠিক বলেছ তুমি। আমি তোমার যুক্তি মানি। কিন্তু ওর দোষ কোথায় বলো?’

‘আমার কিছু করার নেই গুরুমা।’ কঠিন হয়ে আসে পরীরানীর কণ্ঠ। দৃষ্টি পাথরের মতো স্থির।

‘কিন্তু আমি যে না ভেবে পারি না। ধর্মগুরুকে যে সবার কথা সমানভাবে দেখতে হয়। শোনো, আমার একটি প্রস্তাব আছে।’

‘কি বলুন?’ বিরক্ত পরীরানি। ভেতরে উষ্মার আগুন। গুরুমা বলেই সহ্য করতে হচ্ছে। অন্য কেউ হলে হয়তো এতক্ষণে আগুন জ¦লত।

‘মন্দবাসাকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দাও।’

‘সেখানে তো পরী হয়ে বাঁচতে পারবে না সে।’

‘ওকে আমি কুচকুচে কালো জলের নদী করে পাঠাবো পৃথিবীতে। তুমি রাজি হলেই হলো।’

কতক্ষণ কী যেন ভাবলেন পরীরানি। তারপর বলে উঠলেন, ‘আমি রাজি। তবে সে যেন কোনোদিন পরীরাজ্যে ফিরে আসতে না পারে সে-ব্যবস্থা করতে হবে।’

‘তথাস্তু রানী। তাই হবে।’

ডেরায় ফিরে ভালোবাসাকে ডেকে পাঠলেন গুরুমা। সব শুনে ভালোবাসা অনেক কাঁদলেন। গুরুমাকে বললেন, ‘ঠিক আছে গুরুমা। কিন্তু মন্দবাসা মর্তে যাওয়ার আগে আমি শেষবারের মতো আশীর্বাদ করতে চাই।’

‘কী আশীর্বাদ?’

‘ও যেন রূপের জন্য নয়, ভালোবাসার জন্য মানুষের আপন হতে পারে চিরকাল। এটুকুই আশীর্বাদ।’

গুরুমা কী যেন ভাবলেন একটুক্ষণ। চোখ তাঁর অপত্যস্নেহে আর্দ্র হয়ে ওঠে। তিনি গভীরভাবে বুঝতে পারেন সন্তান-হারানো মায়ের নিভৃত কষ্ট। তিনি ভালোবাসার মাথায় হাত বুলিয়ে উত্তর দিলেন, ‘তাই হবে মা।’

কথা শেষ করে মন্দবাসা কাঁদতে থাকে। নদীর জলে ঢেউ ওঠে। ঢেউয়ের শব্দের সঙ্গে বাতাস মেশে। কান্না আর গভীর দীর্ঘশ^াস ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। বারবার আঘাত করে প্রশান্তধামের ইট-কাঠ আর পাথরের মসৃণ শরীরে।

জনার্দন রায়ের দাদু গিরিধারী রায় মন্মথপুরের পরাক্রমশালী নিষ্ঠুর জমিদার হলেও মন্দবাসার কাহিনি তাঁকেও নাড়া দিয়ে যায়। তিনি বললেন, ‘আমি সামান্য মানুষ। তোমার জন্য আমি কী করতে পারি, মা?’

‘আপনি কি আমাকে আপনার কোলে তুলে নেবেন? আমার বড় ভালোবাসা পেতে ইচ্ছা করে যে।’ কেঁদে ওঠে মন্দাবাসা।

‘কীভাবে?’ গিরিধারী রায়ের দৃষ্টিজুড়ে বিস্ময়।

‘জানি না। জানি না। আমি যে ভালোবাসা ছাড়া কিছু বুঝি না।’ এ-সময় মন্দবাসার বুকজুড়ে হাহাকার নদীর চারপাশে হু-হু শব্দ তোলে। চোখে ভাসে মায়ের প্রতিমাতুল্য মুখখানি।

সে কঁকিয়ে ওঠে, ‘মা, মা।’

এ-কাহিনি মাসুদ শুনেছে কুদ্দুছ খানের কাছে। ওকে কোলে নিয়ে সে যতবার মন্দবাসার তীরে এসেছে, ততবার এ-কাহিনি ওকে বলেছে। শুনে শুনে নিজের অজান্তে সে জড়িয়ে গেছে গল্পের জালে। মাসুদের আব্বা কুদ্দুছ খানের গল্প বলার কায়দাও ছিল অসাধারণ। প্রতিটি খুঁটিনাটি এমন করে বলতে পারত যে মাসুদ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে পড়ত, আপন করে নিত প্রতিটি খুঁটিনাটির সঙ্গে নিজেকে।

মাসুদের শৈশব-কৈশোরে মন্দবাসাকে সে খুঁজে ফিরত নদীতীরে। হাতের তালুতে টলটলে জল নিয়ে ভাবত, এই কি মন্দবাসা? করুণ মুখ, ভেজা আঁখিপল্লব, শুকনো ঠোঁটজোড়া আর চোখের তলায় কালো দাগের অসহায় রিক্ত নিঃস্ব মেয়েটিকে ভেবে সে কষ্ট পেত।

যত বড় হয়েছে, মাসুদের বুক থেকে সেই মন্দবাসা যায়নি। বরং গেড়ে বসেছে দিন-দিন।

বছরে একবার কি দুবার প্রশান্তধামের ভেতরে ঢুকতে পারত মাসুদ আর ওর ছোট ভাই আলতাফ।

সেটা ছিল পূজার সময়।

বছরের শুরু থেকে সেই কটা দিনের জন্য মুখিয়ে থাকত কুদ্দুছ খান ও তার পরিবার। আনন্দের সীমা-পরিসীমা নেই তখন। আমেনাকে বলত, ‘পুলা দুইডারে দেহাইয়া আনি প্রশান্তধাম। কী কও?’

‘রাইখ্যা আয়েন না আবার। লগে কইরা লইয়া আইয়েন।’

‘চিন্তা কইরো না।’

দুই ছেলেকে নিয়ে হাসতে হাসতে প্রশান্তধামে ঢুকে পড়ত কুদ্দুছ খান। সেদিন কোনো দারোয়ান মাসুদকে বাধা দিত না। যে দারোয়নটা মাসুদকে নিয়ে মশকরা করত, কাছে ডেকে নিয়ে পিঁপড়ার ঢিবির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে অসহ্য কষ্ট দিত, তার সেদিন একেবারে অন্যরূপ।

কোনোরূপ হিংস্রতার লেশ নেই মুছুয়া দারোয়ানগুলোর ভেতর। অমায়িক আর মোলায়েম চেহারা নিয়ে ওর দিকে তাকায়। বোঝাই যেত না অন্যসময় এই লোকগুলোই নিষ্ঠুর জল্লাদের মুখোশ পরে থাকে। দুর্গাপূজার উৎসব-আনন্দ শুধু ওদের স্বভাবই বদলে দিয়েছে, তা নয়। যে কদিন উৎসব চলবে, ওরা মুখিয়ে থাকে অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে। কেউ খেতে না পেলে হাত ধরে বসিয়ে খেতে দেয়। মিষ্টি করে কথা বলে। পূজার উপঢৌকন সংগ্রহ করে ওদের হাতে গুঁজে দেয়। সে এক অন্য চেহারা ওদের। মাসুদ অবাক হয়ে চেয়ে-চেয়ে ওদের স্বভাবের আজব এ-পরিবর্তনটি দেখত। মনে মনে হাসি পেত ঠিক; কিন্তু চেপে রাখত নিজের ভেতর। ছোট ভাই আলতাফ কিংবা কুদ্দুছ খানকেও বুঝতে দিত না। কেন যেন ওই কড়া বয়সেই মনে হতো – সব খোলাসা করে দিলে ঘটনার ভেতরকার সার মজাটুকু হয়তো লোপ পেয়ে যাবে। তখন মাসুদ হাসবে কি নিয়ে? ওর কান্না বা রাগ কাকে ঘিরে তখন ঘুরপাক খাবে? তাই সে চুপচাপ থেকে শুধু পর্যবেক্ষণ করত। বলত না কিছুই।

বিশাল উঠানে এ-বাড়ির কর্মচারীরা সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকত। নতুন কিছু পাওয়ার কৌতূহল সবার চোখেমুখে। জমিদার জনার্দন রায়ের স্ত্রী নন্দিনী রায় একে-একে সবাইকে পূজার উপহার তুলে দিতেন হাতে। ওরা দুই ভাই পেত দুটো ইংলিশ প্যান্ট। ওদের আব্বা পেত গামছা, দুটো করে লুঙ্গি আর থোক কিছু টাকা। আমেনা না গিয়েও পেত শাড়ি। তারপর ছিল পেট পুরে খাওয়া-দাওয়া। কলাপাতায় খাবার পরিবেশিত হতো।

বড় বড় মাছের টুকরো আর দই-মিষ্টি দেখে সব ভুলে যেত মাসুদ। সে কিছুতেই ঢেউ খেলানো কলাপাতায় খেতে পারত না। দই আর ডাল গড়িয়ে যেত মাটির দিকে। পাশ থেকে কুদ্দুছ খান ওকে সাহায্য করে বলত, ‘তাড়াতাড়ি হাত চালা বাজান। নাইলে সব মাডি লইয়া লইবো।’ শুনে দ্রুত খেতে শুরু করত মাসুদ। যখন সাদা রসগোল্লা আর পানতোয়া পড়ত ওর পাতে তখন যে কী ভালো লাগত। মনে হতো পৃথিবীজুড়ে বেহেশতি আনন্দ বইছে।

এরকমই এক দুর্গাপূজার উৎসবে মাসুদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল মন্দবাসার। ওর চেয়ে মাথায় সামান্য ছোট। গোলাপি রঙের ভেলভেটের ফ্রক পরা। পায়ে ফ্রকের রঙের সঙ্গে মেলানো জুতা জোড়া। মাথার চুল ঘাড়ের দুদিকে বেণি করে এলানো। গায়ের রং কালো। কিন্তু চোখের মণিদুটো কচি আমপাতার মতো বাদামি। মায়া আর ভালোবাসার রসে চোবানো। ওর দিকে তাকাতেই মাসুদের তৎক্ষণাৎ মনে হলো, মন্দবাসা ওকে জিজ্ঞাসা করছে – অ্যাই ছেলে তোমার নাম কী?

‘আমার নাম মাসুদ। তুমি কেডা?’

‘আমি মন্দবাসা। ওই নদীর নামে নাম। আকাশের যে কোনায় পরীদের রাজ্য, আমি সেখানকার। আমার গায়ের রং কালো তো। তাই সবাই মিলে আমাকে তোমাদের পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি আমায় খুব ভালোবাসো, না?’

‘কীভাবে বুজলা? ’

‘প্রায়ই দেখি তুমি মন্দবাসার পাড়ে পাড়ে ঘুরে বেড়াও। কী খোঁজো সেখানে?’

‘জানি না।’

‘তুমি যারে খোঁজো সে তো এই আমি। এজন্যই তো আমি মনুষ্য-জন্ম নিয়েছি।’

মাসুদ বুঁদ হয়ে থাকে মন্দবাসায়। ওর কোমল মন কত কিছু যে আঁকতে শুরু করে। কখনো পরীরাজ্য, কখনো মন্দবাসার মুখ, কখনো নদীর জলতরঙ্গ – সব মিলেমিশে একাকার হয়ে পড়ে।

সহসা ওকে চমকে দিয়ে যে মেয়েটি নন্দিনী রায়ের হাত ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিল সে এক ছুটে ওর কাছে এসে থামল। মুখে বলল, ‘তোমাকে প্রায়ই খিড়কি দিয়ে নদীর পাড়ে পাড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখি। কি খোঁজো?’ জলতরঙ্গের মতো গলার সুর, অবিকল ওর মন্দবাসা।

মাসুদ ওটুকুন বয়সে থতমত খেয়ে যায় মেয়েটির কথায়। কী উত্তর দেবে বুঝতে পারে না। তার আগেই মেয়েটি বলে ওঠে, ‘আমিই মন্দবাসা। দেখা হবে তোমার সঙ্গে।’ বলে যেভাবে ছুটে এসেছিল সেভাবেই লাফাতে লাফাতে নন্দিনী রায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।

হতভম্ব কুদ্দুছ খানের সম্বিৎ ফিরে পেতে সময় লাগে। যখন নিজের ভেতর ফিরে আসে তখন ছেলের শরীরে দু-হাত দিয়ে একটা ঝটকা লাগায়। মুখে বলে, ‘জমিদারের কইন্যার লগে তর কিতা? বাফের চাকরিডা খাইতে চাছ হারামজাদা?’

মাসুদ মুখ ঘুরিয়ে নেয়। কেমন লজ্জা লাগে। সরাসরি বাপের চোখের দিকে তাকাতে পারে না।

গভীর রাতে বাপের কোলে শুয়ে মাসুদ প্রশ্ন করে, ‘আইচ্ছা আব্বা, মন্দবাসা কি একলগে নদী আবার মানুষ অইতে পারে?’

‘পারে তো। যদি কোনো মানুষের ফুত মন্দবাসারে নিজের কইরা পাইতে চায় তহনই তার দেহ মুনষ্যাকৃতি ফিইরা পাইবো। অহন ঘুমা। আর কুনদিন য্যান তরে জমিদারের মাইয়ার লগে কতা কইতে না দেহি। ঘুমা অহন।’

মাসুদ চোখ বুজতেই টের পায় মন্দবাসা ওকে ডাকছে। বলছে, ‘নদীর পাড়ে আইসো। আমি অপেক্ষায় থাকব।’

মাসুদ কখন ঘুমিয়ে পড়ে কুদ্দুছ খানের কোলে, সে টের পায় না। কুদ্দুছ তাকিয়ে থাকে এই একগুয়ে-একরোখা স্বপ্নপাগল ছেলেটির মুখের দিকে। সারাক্ষণ ছেলেটা যে কী নিয়ে থাকে তা ওর জানা নেই। তাই ভয় হয়।

কুদ্দুছ ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নীরবে।

তিন

মন্মথপুর একসময় মানুষের কল্পনাকে সত্যি সত্যি উসকে দিতে পারত। এর জল-হাওয়ায় ভেসে বেড়াত সৌরভমাখা অপরূপ এক মাদকতা। একধরনের পাগলপারা ঘোর আর স্বপ্ন ছিল মানুষের অন্তর জুড়ে।

পাখির চোখ দিয়ে দেখলে মন্মথপুর জনপদটি ওপর থেকে একটা ঝোপের মতোই মনে হতো তখন। বিশাল সব বৃক্ষ আর নানা রকম লতাগুল্ম আনত ভঙ্গিতে ঢেকে রাখত জায়গাটি। প্রায়ই ঝাঁকে-ঝাঁকে সাদা বকের দল ওড়ার জন্য বের হয়ে আসত সবুজ বনানীর গভীর থেকে। তখন নীলাকাশ, সবুজ বৃক্ষমালা আর মন্দবাসার কালো জল বকের সঙ্গে খিল খিল করে হাসত অবিরাম।

মন্দবাসা নদীটি এখানকার মানুষের কল্পনার সঙ্গী। স্থানীয় লোকজন একে নদী নয়, মানুষ হিসেবে ভাবে। তাই দুর্ভাগিনী মন্দবাসার বুকে যত মাছ ভেসে বেড়াত, সেগুলো এরা সহজে খেতে চাইত না।

কাউকে বাধ্য করা হয়নি না খেতে। আসলে মন্দবাসাকে ভাবা হতো মন্মথপুরের বাসিন্দাদের আশ্রিতা কন্যা হিসেবে। পরীরাজ্যে তার ঠাঁই হয়নি কালো হওয়ার কারণে, তাই সে মন্মথপুরে আশ্রয় পেয়েছে। মীনগুলো আশ্রিতা এ-কন্যার খেলার সঙ্গী। দুঃখী মেয়েটি ওদের সঙ্গে খেলে ওর নিঃসঙ্গতা দূর করে। মন্মথপুরবাসী কীভাবে সেসব খেলার সঙ্গীদের খেয়ে ফেলবে?

মাসুদ যখন নদীর কাছে গিয়ে দাঁড়াত তখন মাছগুলো নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত স্বচ্ছ জলের ভেতর। মাছরাঙাগুলো খুব বিরক্ত করত মন্দবাসাকে। পানকৌড়ির ইচ্ছেমতো মুখ ডুবতো। নদীর জলে মুখ ডুবিয়ে রাখা দুই তীরের গাছ থেকে কত রকমের পাখি যে এর শীতল জলে ঝাঁপ দিয়ে আনন্দকেলিতে মগ্ন হয়ে থাকত। এসব দেখে মাসুদের সময় কখন যে কেটে যেত তা সে নিজেও টের পেত না।

 ওর প্রধান শখ ছিল নদীর তীর ধরে ঘুরে বেড়ানো। মাসুদের কাছে এ শুধু নদী নয়, অভাগা মন্দবাসা!

শান-বাঁধানো বেশ কটি স্নানের ঘাট ছিল নদীর কূলজুড়ে। কোনোটা যোগমায়া ঘাট নামে পরিচিত, কোনোটার নাম সুধানন্দ। আবার নামই ছিল না কোনোটার। গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড দাবদাহে যখন মানুষ অস্থির হয়ে যেত তখন গাছের ছায়া আর মন্দবাসার জল ছাড়া ওদের খরপ্রাণে প্রশান্তি ঢেলে দেওয়ার আর কিছু ছিল না। এ-নদী যেমন জমিদারবাড়ির প্রিয় ছিল তেমনি সাধারণ মানুষগুলোও একে প্রাণ দিয়ে আগলে রাখত। এর ভেতর কোনো খাদ ছিল না।

মাসুদ সন্ধ্যার পাতলা অন্ধকারে প্রশান্তধামের পেছনে যেখানে নদীটা শেষ হয়ে গেছে, সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকত। নদীর জলের খলখল ছলছল শব্দের ভেতর কান পেতে কিছু একটা খুঁজে ফিরত। এ হাসি না কান্না তা ভেবে আকুল হতো ওর কিশোর-মন।

প্রশান্তধামের ছায়া নদীর জলে তিরতির করে কাঁপত আর সেই কাঁপুনি মাসুদের বুকের গহিনে এক শিহরণ তুলত। সে বুঝতে পারত কেউ একজন ওকে ডাকছে।

আসলে এ-বাড়িটা মাসুদের কাছে এক অগাধ রহস্যের খনি। এর মানুষগুলোকে ওর দূরের তারার মতো লাগে।

এ-বাড়ির ভেতরে ঢোকার অনুমতি নেই ওর। তবু যখনই কুদ্দুছ খানের সঙ্গে বছরে এক-দুবার ভেতরে ঢুকেছে তখনই ওর বুক ধড়ফড় করতে শুরু করেছে। ছবিগুলো উল্কি কেটে রয়েছে মাসুদের বুকের ভেতর। চাইলে
যখন-তখন মনে পড়ে যায়।

মোরাম বিছানো রাস্তা ধরে এগোনোর সময় কুদ্দুছ খান বলে, ‘বকুল ফুল চিনছ?’

‘না।’

‘ওই যে জামগাছের মতন দেখতে, হিডিরে কয় বকুল গাছ। দ্যাখ নিচে কত বকুল ফুল।’

মাসুদ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে গাছদুটোর দিকে। সে মাটি থেকে অঞ্জলি ভরে কিছু বকুল তুলে নেয়। নাকের কাছে তুলে ধরতেই শরীরটা যেন কেমন করে ওঠে। মন্দবাসার শরীরেও কি একই সুবাস? গাছ দুটো কি ওর ভাই? এরকম নানা উত্তরহীন প্রশ্ন ঘুরপাক খায় ওর ভেতরে।

কিছুদূর আরো এগোনোর পর লম্বা দালান। জমিদারবাড়ির কাছারিঘর। এখানেই প্রথমবার সে একটি তৈলচিত্র দেখতে পায়। দেয়ালের সঙ্গে টানানো চিত্রটির দিকে তাকিয়ে যখন অবাক হচ্ছে তখন ওর আব্বা বলে ওঠে, ‘এর নাম জনার্দন রায়। আমরার জমিনদার। খুব ভালা লোক।’

সেই থেকে যতবার জমিদারবাড়িতে পা রেখেছে ততবার বিশাল চিত্রকর্মটি ওকে বিস্মিত করেছে। মূল মানুষটিকেও সে দেখেছে। কিন্তু চিত্রকর্মের মানুষটির সঙ্গে এর দুস্তর তফাত। বাস্তবের মানুষটি কেমন যেন ন্যুব্জ, খানিকটা পরাজিত। কিন্তু চিত্রের মানুষটিকে লাগে প্রাণবন্ত আর দৃপ্ত। দুরন্ত স্বপ্ন তাড়া করছে তাঁকে। দু-চোখ জুড়ে সেই স্বপ্নের রেশ মন্দবাসার ওপর দিয়ে উড়ে চলা বকের ঝাঁকের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। যত দেখে তত ভালো লাগে।

মাসুদদের বেড়ার ঘরটি জমিদারবাড়ি থেকে বেশি দূরে নয়। সে ছোট ভাই অলতাফের মতো নয়। সে দুরন্ত এক স্বপ্নে বিভোর কিশোর। সে আমেনা নয়, কুদ্দুছের ন্যাওটা। রাতে বাপজান কোলে নিয়ে না শুলে ওর দু-চোখ ভরে ঘুম আসে না। ওর ঘুম মানেই বাপের গল্প বলা। নইলে সারারাত নির্ঘুম কাটবে।

‘জমিনদারডা অত বুড়া কেরে আব্বা? ছবিত দি অনেক সুন্দর?’

‘আমরার জমিনদার ছবির লাহানই আছিল এককালে। চোখ থেইক্যা আগুন ঝরত। তাকান যাইত না। যা মনে লইত তা-ই করত। কারো কতা কানে লইত না। একবার জমিনদার গিন্নিরে লইয়া গেল বনে। সেইখানেই ঘটল বিপত্তি।’

‘কি ঘটল আব্বা?’ প্রশ্ন করার সঙ্গে সঙ্গে সে গভীর জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। সেখানে সে দেখতে পায় হাতির ওপর বসে জনার্দন রায় আর নন্দিনী রায় এগিয়ে চলেছেন। জনার্দন রায়ের হাতে বন্দুক। কজন পাইক-পেয়াদা ঘোড়ার ওপর চড়ে রয়েছে। বাকি সব পদব্রজে জমিদারের হাতিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে চলেছে গভীর জঙ্গলের দিকে।

সহসা জনার্দন রায়ের চোখ পড়ে গেল এক হরিণীর ওপর। জলাশয়ে নেমে চুকচুক করে জল পান করছে। হরিণীর শরীর ভারি। চলতে কষ্ট হচ্ছে। চোখের কোণে ক্লান্তি। মনে হলো হাঁপাচ্ছে।

কিন্তু জনার্দন রায়ের হাতে বন্দুক। মাথা গরম। বন্দুকের নল তাক করতে ওর সময় লাগে না। পাশে বসা নন্দিনী হায় হায় করে ওঠে। মুখে বলে, ‘এ কি করছেন? এ তো পোয়াতি হরিণী। একে হত্যা করা ঠিক নয়। এ পাপ।’

‘মৃগয়ায় এসে এসব বলতে নেই নন্দিনী। এজন্যই সঙ্গে করে তোমাকে আনতে চাইনি। সব কিছুতে পাপ-পুণ্য বিচার করলে খাবে কি?’ বলেই তিনি গুলি করে দিলেন শ্রান্ত হরিণীর গায়ে। পোয়াতি হরিণী লুটিয়ে পড়ল। জনার্দন রায় হাতির হাওদা থেকে নেমে ছুটে গেলেন সেদিকে। হরিণী কাতরাচ্ছে অসহ্য কষ্টে। ফোলা পেটে ছররা গুলি লাগায় চামড়া ছিঁড়ে মায়ের পেটে নিশ্চিন্ত-নির্ভাবনাময় হয়ে শুয়ে থাকা

ভ্রƒণ-শাবকের নিরীহ অসহায় মুখ বেরিয়ে রয়েছে।

সে-অবস্থায় বাঁশে ঝুলিয়ে হরিণীকে নিয়ে আসা হলো জমিদারের অস্থায়ী তাঁবু প্রাঙ্গণে। ছাল ছাড়ানো হলো। পেটের ভেতর থেকে নাড়িভুঁড়ি বের করা হলো। তারপর শাবকসহ সেই দেহের ভেতর-বাইরে লবণ-মরিচ-হলুদ আর তেল মাখিয়ে আগুনে ঝলসে ভক্ষণ করল সবাই। দ্রাক্ষারসের গেলাস অমাত্যদের হাতে হাতে। এভাবে রাতভর উল্লাসে মত্ত হয়ে ভোরবেলায় ঘুমে ঢলে পড়েন সবাই। ভোরবেলায় এক ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে কেঁপে ওঠে জমিদারের সমস্ত শরীর। লোমশ ভালুকের মতো কুৎসিতদর্শন এক জীব ওর মুখের সামনে মুখ নাড়িয়ে বলে উঠল, ‘তুই শাপগ্রস্ত। তোর নিস্তার নেই।’

ঘুমটা ভেঙে গেল। নন্দিনী সব শুনে বলল, ‘আমি না করেছিলাম গুলি না করতে। তবু নিষ্ঠুরতা দেখালে। প্রকৃতিকে আঘাত করবে আর প্রকৃতি বসে থাকবে? প্রতিশোধ তো নেবেই। অতিভোগে বিনাশ ডেকে আনলে নিজ হাতে।’ স্ত্রীর চোখে জল।

‘তুমি কাঁদছ?’ জমিদারের চোখে অপার বিস্ময়।

‘আমি কাঁদছি সেই তৃষ্ণার্ত পোয়াতি হরিণীর জন্য। যে একটু জল খেতে চেয়েও পারেনি।’

জনার্দন রায় চুপ করে রইলেন। কুলগুরুর কাছে গিয়ে সব খুলে বললেন। তিনি সব শুনে বললেন, ‘অনুতাপই তোকে মানুষ বানাবে।’

তারপর থেকে জমিদার বদলে যেতে শুরু করলেন। তাঁর মেজাজ পড়ে গেল। সবার সুখ-দুঃখের খবর নিতে থাকেন। মানুষের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। মন্মথপুরের মানুষের জন্য পুকুর কাটালেন। খরা বা বন্যায় প্রজাদের খাজনা মওকুফ করে তাদের পাশে দাঁড়ালেন। বড় বড় দুটো অনাথালয় করলেন। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের বাসোপযোগী করে তোলার জন্য নদী-জলাশয় আর বৃক্ষশোভিত এক অভয়ারণ্য গড়ে তুললেন মন্মথপুরে। সেই অরণ্য অজস্র পাখপাখালি, পশুপাখি আর নানারকম হরিণ-হরিণীর চারণক্ষেত্র হয়ে উঠল।

মাসুদ সব শুনতে লাগল ওর আব্বার কোলে শুয়ে। কিন্তু মাথা থেকে ওর মন্দবাসা আর যায় না। সে প্রশ্ন করে, ‘আর মন্দবাসা?’

‘এখন ঘুমা।’ বলে থামিয়ে দিলো ছেলেকে কুদ্দুছ খান।

কুদ্দুছ খানের মুখে মন্দবাসাকে নিয়ে গল্প শুনে শুনে মাসুদের ভেতর মাকড়সার জালের মতো তৈরি হয়েছে এক স্বপ্নের জগৎ।

জগৎটি অলীক বা ধরাছোঁয়ার বাইরে হলেও ওর নিকট বাস্তব। সেখানে বিশ্রাম নিয়ে সে অফুরন্ত সুখ পায়। ওর সমস্ত অস্তিত্ব এর সঙ্গে মিশে থাকে। যখনই কোনো না-পাওয়ার বেদনা ওকে পীড়িত করে তখনই সে আশ্রয় পেতে চায় এ-রাজ্যে। এ-রাজ্যের মালিক জনার্দন রায়। যিনি সব কিনে নেওয়ার এবং কিনে অন্যকে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। মন্দবাসা ওর পরমাত্মীয়। দেখা হলে যে কি না ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করবেই, ‘কেমন আছো? কি করো?’

এমন কি যে প্রশান্তধামে ওকে ঢুকতে দেওয়া হয় না, সেটিও সে ভাবে নিজের। সে পাত্তা দেয় না এসব। মনে মনে সে ঠিকই জানে, একদিন আসবে যেদিন সবাই ওকে দেখে কুর্নিশ জানাবে। সে হলো রূপকথার ছদ্মবেশী রাজকুমার। এক অজ্ঞাত কারণে সে লাঠিয়ালের বাড়িতে লালিত পালিত হচ্ছে। কিন্তু একদিন সবাই বুঝবে. সে আসলে কে। মন্দবাসাই সব বলে দেবে। এ-নদী সব জানে। তাই সে পাড়ে পাড়ে ঘুরে বেড়ায়। সে একা হয়েও একা নয়। প্রশান্তধামের দুটো নুয়ে পড়া বকুল গাছও সে-কথা জানে। শুধু জানে না মন্মথপুরের মানুষগুলো। ওর আব্বা-আম্মা আর ছোট ভাই আলতাফ। এ-দুঃখ কেউ বোঝে না; বুঝতে চায় না।

 সন্ধ্যার পর সে যখন মন্দবাসার পাড়ে হেঁটে বেড়ায় তখন মনে হয় নদীটাও ওর সঙ্গে হেঁটে বেড়াচ্ছে। নিশ্বাস ফেলছে ওর ঘাড়ে। ফিসফিস করে কথা বলছে ওর সঙ্গে। জলের ভেতর ঘুরঘুর করা স্বাধীন মাছগুলোকে মনে হয় মন্মথপুরের প্রজা। ওদের ভেতর একটা বিশাল কাতলা মাছ রয়েছে। ওকে দেখলেই সে ডাঙার দিকে ছুটে আসে। বুড়ি তুলে কী যেন বলতে চায়। বিশালাকৃতির কালি বোয়ালটা তো আরো দুরন্ত। নিমেষের ভেতর সে
এখানে-ওখানে চলে যায়। চাঁদের ফিকে আলো মন্দবাসার কালো জলে পড়তেই ওরা যেন আরো উচ্ছল হয়ে ওঠে। ঘাটের যে সিঁড়িটায় মন্দবাসা এসে ঢেউ তুলে থেমে যায় সেখানে মাছগুলো চুমু খায়। পাখনা নাড়ে। কেউ কেউ তো চাঁদটাকে ধরার জন্য লাফ দেয় শূন্যে।

মাসুদ ওদেরই অংশ বনে যায়। গাছের ছায়া ওকে ঢেকে রাখে। যে-ঘাটগুলো দিনের আলোয় মানুষের পদচারণায় রমরম করত, যে-নৌকাগুলো গমগম করত কুলি-কামিনের মালসামান তোলা-নামানোর কাজে, সেসব এখন দূর থেকে নিঃসঙ্গ দেখায়। নৌকাগুলোয় ভূতের চোখের মতো হারিকেন দোলে; মাঝিরা পাটাতনে মাটির উনুনে করে ভাত-তরকারি রাঁধে, রান্নাবান্নার পাঁচমিশালি গন্ধ ভেসে বেড়ায় মন্দবাসার বুকে। সে-গন্ধ মাসুদের নাকেও সুড়সুড়ি দেয়।

ওর মন খারাপ হয়। সে তাকিয়ে থাকে প্রশান্তধামের দিকে। বিশাল অট্টালিকাটি মন্দবাসার কালো জলে তিরতির করে কাঁপে। চাঁদ যোগ দেয় তাতে। মাসুদের চোখে স্বপ্নের ঘোর হয়ে থাকে প্রশান্তধামের সেই চাঁদ। সে বুঁদ হয়ে নদীর জলে স্বপ্নের সেই প্রতিবিম্ব লক্ষ করে। ওর নিকট অপার রহস্যের খনি এ-প্রশান্তধাম। এর অন্দরে থাকে মন্দবাসা নামে ওরই সমবয়সী এক কন্যা। যার চোখের দিকে তাকালে এ-নদীটাকে সে দেখতে পায়। আর থাকেন এক জমিদার। যার সঙ্গে মাসুদের কখনো মুখোমুখি হতে হয়নি। শুধু একটি তৈলচিত্র সম্বল, জমিদারকে খুঁজে পায় সেখানেই। মাঝে মাঝে ভিড়ের ভেতর এক-দুবার ‘ওই যে জমিদার’ বলে কুদ্দুছ মাসুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছে বটে; কিন্তু বলতে না বলতেই তিনি সরে গেছেন দৃষ্টিসীমার বাইরে। প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে কিশোর মাসুদ তাকিয়ে থাকে কতগুলো মাথার দিকে। এর ভেতর সে জমিদারকে খুঁজে পায় না। যার দিকে চোখ যায় তার সঙ্গে তৈলচিত্রের মানুষটির কোনো মিল খুঁজে পায় না। মন খারাপ হয় অকারণে।

 সন্ধ্যায় মন্দবাসার তীরে বসে সে অভিমান করে। কালি বোয়ালটা কাছে এলে বিড়বিড় করে অনেক কিছু বলে। ‘আমি য্যান কেউ না। কও, ভালা লাগে? ’ গলা ধরে আসে মাসুদের। এ-বাড়িটা কবে ওকে ধরা দেবে সে জানে না। আদৌ ধরা দেবে কি না তাও জানা নেই। তবু এত টান, এত আপন মনে হয় যাঁদের, তাঁরা কেন দূরে-দূরে থাকে সারাক্ষণ?

প্রশান্তধামের মাটিতে পা দিলেই একধরনের বনেদিয়ানা আর আভিজাত্যের ঝলক মাসুদকে চমকে দেয়।
এ-ঝলঝলে রং ওকে বুঁদ করে রাখে। মনে হয়, এ-রং ওর শরীরকেও ঘিরে রাখুক। ওরও বড় ইচ্ছে হয় রং মেখে এ-বাড়ির সবার মতো যেখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতে। সবাইকে দেখিয়ে সে-ও বলতে চায়, ‘এই অইলাম আসল আমি। তুমরা চিননি আমারে?’

কিন্তু সে তো প্রশান্তধামের ভেতরেই ঢুকতে পারে না। মুছুয়া দারোয়ান দুটো পথ আটকে বলে, ‘তুই লাইট্টলের বড় পুলাডা না? কী চাছ?’

‘আমি ভিতরে যামু।’

‘কেরে?’ ওরা হাসে, হাসিতে গোঁফের ডগা কাঁপে।

‘আমি বকুল গাছের নিচে গিয়া ফুল তুলুম।’

আবার হাসে ওরা। বলে, ‘এইডা তর বাড়ি?’

‘হ।’ নির্ভীক দৃষ্টি, ক্লাস এইট তখন ওর।

‘আবার ক, এইডা তর বাড়ি?’ এবার দারোয়ান দুটোর চোখ লাল হতে শুরু করে।

‘মিছা কই আমি? এইডা আমরার বাড়ি। এডাই হাছা।’ ভাবলেশহীন চেহারা, কণ্ঠস্বর দৃঢ়, কম্পনহীন।

‘তাইলে ওইডা কী?’ বলে ওদের থাকার একচালা ঘরগুলো দেখিয়ে দেয়। প্রশান্তধামের পাশে ওদের সারিসারি থাকার কুঁড়েঘর। সেখানে ওদের আবাস। সেগুলো গোলামঘর হিসেবে পরিচিত। বলা হয়, একসময় বিভিন্ন হাট থেকে যেসকল ক্রীতদাস কেনা হতো, এরা তাদেরই বংশধর।

‘ওইডা মিছা।’ বলতেই দারোয়ান তেড়ে আসে ওর দিকে। লাঠি নিয়ে ভয় দেখায়। মুখে বলে, ‘খালি কুদ্দুছ্যার পুলা দেইখ্যা ছাইড়া দিলাম। নাইলে আছাড় দিয়া ফেডা গাইল্লা ফেলাইতাম, পুলা। যা ভাগ হারামজাদা।’

সেদিন বড় কষ্ট হয়েছিল ওর। মন্দবাসার তীরে দাঁড়িয়ে আপনমনে সেই দুঃখের কথা বিড়বিড় করে বলতে থাকে। কাতলা মাছটা ওর কাছে এগিয়ে আসে মাঝ দরিয়া থেকে। সন্ধ্যার আলো-অন্ধকারের মায়ায় জড়ানো মাছটাকে দেখে ওর আবেগ আরো উথলে ওঠে, মুখে বলে, ‘কও, আমি তুমরার কেউ না? কও?’ ফুঁপিয়ে ওঠে মাসুদ। হঠাৎ এসময় সে ছায়ার মতো মন্দবাসাকে দেখতে পায় দূর থেকে। প্রশান্তধামের পেছন দিককার খিড়কি দুয়ার খুলে বেরিয়ে এসে ঘাটের কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। নিবিড় দৃষ্টি ওর ওপর।

মাসুদ স্পষ্ট দেখতে পেল মন্দবাসা ওকে ডাকছে। সেই মেয়েটি, যাকে দুর্গাপূজার উৎসবে জমিদারবাড়িতে দেখেছিল। জমিদার গিন্নির আঙুল ধরা সেই মেয়েটি ওকে ডাকছে, হাত নাড়ছে ওর কাছে যাওয়ার জন্য!

সে এক পা এক পা করে নদীর পাড় থেকে ঘাট বেয়ে খিড়কি দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। সন্ধ্যার মায়াবী অন্ধকার ওর মুখের ওপর।

মন্দবাসা বলল, ‘প্রতিদিন দেখি তুমি এদিকে ঘুরে বেড়াও। কী করো তুমি?’

‘কিছু না। এমনি হাইট্টা বেড়াই। এ-নদীর মাছ আমার বড় ভালা লাগে। এরা মুক্ত। যখন খুশি যেখানে-সেখানে ঘুইরা বেড়াইতে পারে। ভয় নাই একটুও।’ সলজ্জ হয়ে ওঠে ওর দৃষ্টি। সে দ্রুত নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করে।

‘তুমি কথা বলো ওদের সঙ্গে, না? আমি সব লক্ষ করি।’

মাসুদ মাথা নুয়ে থাকে। সহসা সে প্রশ্ন করে বসে, ‘নদী আর মানুষ কি এক?’

মন্দবাসা ওর প্রশ্ন শুনে চারপাশে তাকায়। ওর দৃষ্টি নমনীয়; সেখান থেকে আদর আর মমতা মধুর মতো চুঁইয়ে পড়তে থাকে। মাসুদ ঠিক তা টের পায়।

পরক্ষণে ওকে চমকে দিয়ে মন্দবাসা খিলখিল করে হেসে ওঠে। সিঁড়ি ভেঙে ওপরের দিকে উঠতে উঠতে বলে ওঠে, ‘দেখা হবে। ধীরে ধীরে সব জানতে পারবে। আসি।’

মন্দবাসা ধোঁয়ার মতো এসেছিল, আবার ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল চোখের সমানে প্রশান্তধাম নামের বাড়িটার ভেতর।

রাতে ওর ঘুম হয়নি। কেবলি মনে হতে থাকে এ-বাড়িটার সঙ্গে ওর একটা সম্পর্ক রয়েছে। কেউ বুঝতে না পারলেও সে ঠিক নিজের ভেতর তা অনুভব করছে। নইলে ওর চারপাশটা কেন ওকে প্রশান্তধামের দিকে খিঁচে নিয়ে যাবে?

সে আব্বাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘মন্দবাসা কেন একই লগে মানুষ আর নদী হয় আব্বা?’

‘ঘুমা চুপ কইরা। হারাদিন খালি আছে প্রশান্তধাম আর মন্দবাসা লইয়া। লেহাপড়াত মন দে। গরিবের ঘোড়ারোগ।’ বলে থামে।

ওদের টিনের চালের ওপর ডালপালা মেলে ছড়িয়ে আছে ঝাঁকড়া মাথার দুটো রেন্ডি-কড়ই। গ্রীষ্মের রাতে সেগুলো থেকে গোটা ঝরে পড়ে চালে। সেই শব্দ মাসুদের মনে শিহরণ জাগায়। মনে হয়, চাপাস্বরে ফিসফিস করে কেউ কিছু একটা বলতে চায় ওর কানে কানে। সে-ই শুধু বোকা। কিছু বুঝতে পারে না। অশরীরী এক অনভূতি ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

এত বছর পরও চোখ বুজলে মাসুদের কানে বাজে নীরবতার ভেতর কম্বল মুড়ি দেওয়া সেই ছিন্নমূল শব্দ। যখনই টরন্টোর রাস্তা সাদা বরফে ছেয়ে যায়, বাইরে বেরোনোর কোনো উপায় থাকে না, জবুথবু সময় হাত গুটিয়ে বসে থাকে বিষণ্ন বদনে, তখনই গল্পগুলো বরফ-বৃষ্টির মতো ওর ভেতরে সাড়া তোলে।

বাস্তবে এখন প্রশান্তধাম, মন্মথপুর কোনো কিছুরই আর অস্তিত্ব নেই।

সে-ও আগের মাসুদ নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে কর্মব্যস্ত জীবন ওর। গাঁটে গাঁটে বার্ধক্যের কামড়। একটুতেই ক্লান্তি চলে আসে।

তবু গল্প ওর পিছু ছাড়ে না।

বয়স যত ওর চলাফেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করছে তত ওর ফেলে আসা মন্মথপুরের প্রশান্তধাম ঝিকিমিকি করতে থাকে অন্তরে। ওখানকার সঙ্গে সকল বন্ধন ছিন্ন করার পরও কেন যে গল্পের নেশা ওর কাটে না!

বুঝতে পারে না মাসুদ।